ডরোথী -7
পোড়া মাটির টেরাকোটার কাজ করা মন্দির । কিছু টা গিয়েই দেখা হলো আর একটা মন্দির । পাঁচ তলা সমান উঁচু এই মদনমোহন মন্দির । দোতলার সমান উঁচু বিগ্রহের স্থান । সেখানেই এক বৃদ্ধার সাথে আলাপ রসময়ীর । তাঁর কাছে ই শোনা গেল যে সেখানে একটা ঢিপির মতো ছিল । পরে সেখানে মন্দির তৈরি হয় । এক ভক্ত মদনমোহনকে আটার রুটি খেতে দিতেন । তখন একদিন মদনমোহন তাঁকে বললেন,একটু নুন তো আমায় দিতে পারিস । ভক্ত বলে- নুন কোথায় পাবো?এতো বায়না তোমার । আজ নুন চাইছো,কাল পায়েস চাইবে । এসব আমি কোথায় পাব?আমি কারো কাছে চাইতে পারবো না । তোমার ব্যবস্থা তুমি করে নাও ।
পরদিন একটা আশ্চর্যের ঘটনা ঘটেছে । এক বণিক নুন ভর্তি এক জাহাজ করে যাচ্ছিলেন । সেই জাহাজ মন্দিরের একটু দুরে আটকে পড়লো । বনিক আশেপাশের লোকের সাহায্য চাইলেন । তাঁরা মদনমোহন মন্দিরে দেবতার কাছে মানত করতে বলে । বনিক সেই মতো মদনমোহন এর কাছে মানত করলেন । – “যদি জাহাজ চলতে শুরু করে তবে তিনি মন্দির গড়ে দেবেন । ” ভক্তের কাছে মদনমোহনের নুন খাবার গল্প শুনে মদনমোহনের জন্য অনেক নুন দিয়ে গেলেন ।
পরদিন সত্যি সত্যিই জাহাজ চলতে শুরু করলো । এর পরের কথাতো সবার চোখের সামনে ঘটছে । তাই হলো । পাঁচ তলা সমান উঁচু মন্দির করে দিলেন তিনি ।
এসব শুনে রসময়ীর ভক্তিআরো গাঢ়ো হলো । এবার টাঙ্গা চলেছে বঙ্কুবিহারী মন্দিরে । এটা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে । পলকে দর্শন হয় । পর্দা সরে যেতে ঠাকুর দেখতে পাওয়া গেল । আবার বঙ্কুবিহারী পর্দায় ঢাকা পড়ে গেলেন ।
এবার গন্তব্য সোনার তালগাছ । এটা লালাবাবুর মন্দির । লাল ইঁটের,কারুকাজ টেরাকোটার । তাল গাছে সোনার তাল ও সোনার পাতা । পুরো গাছ টাই সোনার । স্বর্ণ কলস ও রয়েছে । লালা বাবুর কথা সেই বৃদ্ধার কাছে শোনা । লালা বাবু নাকি মুরশিদাবাদ থেকে বৃন্দাবনে এসেছিলেন ।
সেঠ এর মন্দির ও অতি পুরোনো । এঁকে রাধা গোবিন্দের মন্দির ও বলে । বিগ্রহ জয়পুরের পাথরের । সেঠ এর মন্দিরের পেছনে কাত্যায়নী মন্দিরে মা দুর্গার সোনার বিগ্রহ । এবার টাঙ্গা চলেছে গোপীনাথ ও শ্যামসুন্দর মন্দিরে । টাঙ্গা ওয়ালাকে দুগর বলেন- আর দেরি নয়,এবার চলো নিকুঞ্জ বনের দিকে । ঘোড়া ছুটলো তির বেগে । বাঙালি টাঙ্গা ওয়ালা বাংলায় কথা বলতে বলতে নিকুঞ্জ বনের আর নিধু বনের দিকে রওনা হলো ।
এ বনে রাতে কেউ আসে না । সন্ধ্যার দিকে সবাই চলে যায় । সেবাইতরা সন্ধ্যার আগেই ভোগ নিবেদন করে বাইরে চলে যায় । সারা দিন বাঁদরামি করে বাঁদরেরা । কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সব হাওয়া হয়ে যায় । সাঁঝ থেকে সারারাত এই বনে রাধা কৃষ্ণের আবির্ভাব হয় । মিলন ও হয় । সবই শোনা কথা । একজন নাকি রাধা কৃষ্ণের মিলন দেখার জন্য লুকিয়ে ছিল ঐবনে । কিন্তু সকাল হতেই তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে ।
টাঙ্গাওয়ালার কথা শুনে রসময়ীর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । মনে পড়ছে নৌকা বিলাসের সুর । – দুঁহুতনু আজ এক হলো রে । নিভৃত নিকুঞ্জ বনে । হেরয়ে নয়ন ভরি । রাধা গোবিন্দ যুগল মাধুরী ।
নিকুঞ্জ বনের মাঝে ঢোকার প্রবেশ দ্বার এ ছোলা- ওয়ালা ছোলা বিক্রি করছে । ভকৎ দুগর কে বললো ছোলা কিনে দিতে । ভকৎ সবার হাতে একটু একটু করে ছোলা দিলো । বনের ভেতরে বিরাট বিরাট গাছ । বাঁদর গুলো লাফালাফি করছিল গাছের ডালে । এ গাছ থেকে ও গাছে ঝাঁপিয়ে পড়ছে । রসময়ীর মন তখন অন্য জায়গায় । মন বলছে,কৈ কৃষ্ণ, কোথা কৃষ্ণ? দুপুর রোদে ও রোমাঞ্চ হচ্ছে রসময়ীর । এই সেই বন যেখানে রাধা কৃষ্ণের মিলন হতো ! চলতি পথে এক বিধবা মহিলার সাথে আলাপ হলো । তাঁদের বাপ ঠাকুরদার আমলের বাস । দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে তাঁদের বৃন্দাবনে । মথুরায় মেয়ের বিয়ে হয়েছে । তাঁরা বাংলা কথা বলতে পারে না । শ্বশুর শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ বাংলা জানে না । এমন কি ছেলে মেয়েরা মাছ মাংস খায় না । বৃন্দাবন এ ও মাছ মাংসের পাট নেই । তাঁরা সেবাইত তাই গোবিন্দ এর ভোগ তাঁরা নেন । গোবিন্দের যে ঘরে পুজো হয় সেখানেই তাঁর রান্না হয় । মাটির নিকোনো ঘর ।
মহিলা বলেন- – ‘কতো দিন এ নিয়ম রাখতে পারব জানি না ।
রসময়ীর মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । এখানে ও কি বারানসীর মতো বিধবাদের আশ্রয় হীন হয়ে ঠাঁই নিতে হতো?বিধবা ভাতা আর ভিক্ষা অন্নে দিন যাপন করতে হতো তাদের!মূল কথা বিশ্বনাথ ধামের নাম করে,লোভ দেখিয়ে দায় সারা হয়েছে । এর জন্য সমভাবে নারী ও পুরুষ দায়ী । বাড়ির পুরুষ দের কামুকতার শিকার হতে হয়েছে বিধবাদের । আর সেই ঘরের মেয়েদের ধর্মের দোহাই দিয়ে ঘর ছাড়া করেছেন । কিন্তু নিজের স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে পারেন নি । রাগ হয় রসময়ীর । এ সব বিধবাদের মোটা ভাত মোটা কাপড়ের পরিবর্তে মন্দিরে কাজ করতে হয় । বিশ্বনাথ এর নাম নিয়েই পড়ে থেকেছেন তাঁরা ।
রসময়ী শুনেছিলেন,গোবর্ধন মন্ডলের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা মাকে কাশীতে পাঠিয়ে দেয় । সুউপায়ী তিন ছেলে ,দুই মেয়ে যার তাঁকে শেষ বয়সে কাশীতে পড়ে থাকতে হয় । যৎসামান্য টাকা ছেলেরা পাঠাতো । তা দিয়ে কোন রকমে ঘর ভাড়া হতো । সেই সময় পাঁচ টাকা করে তিনি বিধবা ভাতা পেতেন । পাঁচ টাকা তখন অনেক । মানসিক দৈন্যতা ঢাকার জন্য বলতেন- স্বামী চলে গেছে আর কিসের মায়া? মায়া ত্যাগ করতেই বিশ্বনাথ ধাম এ থাকা । ছেলে মেয়েরা ছুটিছাটায় মায়ের কাছে গেছে । মাকে আনন্দ দিতেই যাওয়া । ছোট ছেলের কর্মসংস্থান ছিল ভূপাল । সেখানে একটা সাঁতারের স্কুলে সাঁতার শেখাতেন । কখনো সখোনো মা তাঁর ছোট ছেলের কাছে গেলে বৌমা রকমারি পদ রান্না করতেন । অঢেল পদ । খাওয়া থেকে ফেলা বেশী । আর ছেলেরা যখন বারাণসী আসতে তখন মায়ের আনন্দ আর ধরে না । যেভাবে ই হোক রকমারি রেঁধে খাওয়াতেন ছেলেদের । আবার ছেলেরা চলে গেলে । মা একাহারি । দিনে প্রসাদ পেলে আর রাঁধতে হয় না । আবার যে কে সে । রাতের আহারে বাহার নেই । এক চুমকি দুধ পেলেই হয়ে যায় ।
বড়োর অবস্থা ভালো না হলে ও মন্দ নয় । মা মাঝে মাঝে ছোট ছেলের টানে বিশ্বনাথ ধাম থেকে যান বারাণসী । সেখানে ও বৌমার আড়াই দাঁড়াই দেখতে হয় । কিছু বলার উপায় নেই । বিশ্ব নাথ ধাম এ থেকে শুদ্ধাচারে খাওয়ার অভ্যাস । নিজের টুকু নিজেই করে নেন । বৌমা বাড়তি মাছ, মাংস সব নালায় ফেলে দিচ্ছে । সহ্য করতে না পেরে বলেছেন- বৌমা,নালায় ফেলো না । কাজের লোক দের দাও । ওরা খেয়ে তোমায় দু হাত তুলে আশীর্বাদ করবে । তার উত্তরে শুনেছেন – ভুলে ও করবেন না । । মাথায় উঠে যাবে । শাশুড়ি আমতা আমতা করে বলেন- তা বটে তবে লুকিয়ে ফেলো । ওঁরা যেন নালায় দেখতে না পায় । শাশুড়ির সে কথা কোনো কাজে দেয়নি ।
এসব ছেলেদের শিশু কালের বা যৌবনের ছবি মায়ের স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বল জ্বল করছে । বঙ্গাইগাঁও থাকতে সব শোনা রসময়ীর । গোবর্ধন মন্ডলের ভাই সনাতনের ছেলেরা খুব ভালো । তাঁরা বাবা মা কে খুব ভালোবাসে । মেজ ছেলে শক্তি বিড়ির কারখানার মালিক । ছোট মলয় বিড়ির কারখানার মালিক ।
দুর্গা পদ দুঃখ করে বলেছিলেন রসময়ীকে- – এমন ও হয় গো,মা কে কেউ কাছ ছাড়া করে? আমার মা বেঁচে নেই । তাই কষ্ট পাই আর ওদের মা বেঁচে থাকতে ও ‘দুর ছাই’ করে দিলো? কথায় আছে না” ভাগের মা গঙ্গা পায় না” এ ও তাই ।
তখন রসময়ীর চোখে পড়েছে স্বামীর ছলছলে চোখ । সান্ত্বনা দিয়েছে সে । – মা কি কারো সারা জীবন থাকে গো?একদিন যেতেই হয় । চিন্তায় ছেদ পড়ল রসময়ীর,ঘাড়ের ওপরে কি যেন একটা । মাথা নাড়তেই বুঝতে পারলো তার মাথায় একটা বাঁদর । ভয়ে শক্ত হয়ে গেল বাঁদর রসময়ীর মাথা টকাস টকাস করে খুঁটে চলেছে । ব্যথায় কাতর রসময়ী । পাশের মহিলা সাহস যুগিয়ে চলেছে । – নড়বে না । তাহলে রেগে যাবে । তোমার মাথায় উঁকুন আছে কিনা দেখছে । না পেলে ছেড়ে দেবে ।
তাই হলো উঁকুন না পেয়ে বাঁদরটা রসময়ীকে ঠাস করে একটা চড় কষালো । আচম্বিতে রসময়ীর বুকের মাঝে হাত ঢুকিয়ে দেয় বাঁদরটা । বেসামাল রসময়ী । একে মাথায় ঘোমটা নেই,তায় শাড়ি উথাল পাতাল বাতাসে । লজ্জায় লালের ছটা সারা মুখে । সকলের দৃষ্টি তাঁর মুখের ওপরে । কিছু বোঝার আগেই বাঁদরের একখানা হাত রসময়ীর বুকের খাঁজে ঢুকে গেল । সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে এলো বাঁদরের হাত খানা তাতে একটা পুঁটুলি । ছোলা টা হাতে না রেখে রসময়ী রুমালে পুঁটুলি করে বুকের খাঁজে রেখে ছিলেন । সেটাই টেনে বার করেছে বাঁদরটা । এতোক্ষনে কাঁধের ভার সরে গেল । এতক্ষণ মহিলা দুর্গা পদর হাত ধরে রেখেছিলেন । এবার ছেড়ে বলেন- বাঁদর কে তাড়াতে যাচ্ছিলে? কি হতো বলোতো?সব বাঁদর চলে আসতো । তোমার বৌ ও ছাড়া পেতো না ।
দুর্গা পদ রসময়ীকে একটা বেদী তে বসিয়ে দিলেন । ভকৎ রাম কোথা থেকে জল নিয়ে এলো । ভকৎ ভাবী কে চোখে মুখে জল দিতে বললো ।
দেখতে দেখতে ভিড় টা একটু পাতলা হয়ে এলো । কারণ কুঞ্জ বনের দর্শকরা বুঝেছে যে এখানে আর দেখার কিছু নেই । রসালো যা দেখার তা দেখা হয়ে গেছে । যার সঙ্গে নিকুঞ্জ বনে দেখা সেই মহিলা ওদের ছাড়লেন না । বললেন- কাছেই আমার বাড়ি । চলো শ্রী কৃষ্ণের ভোগ শাকান্ন নেবে ।
দুর্গা আর দুগর রাজি হয়ে গেলেন এবার পাঁচ জনে টাঙ্গায় ওঠা হলো । সেই বাড়ি পৌঁছে রসময়ী খুশি । রান্না ঘর মাটির । সুন্দর নিকোনো ঠাকুর ঘর সেখানেই ভোগ খাওয়া হলো । অন্ন ভোগ,সাথে শাক,ডাল,বাঁধাকপির তরকারি । তৃপ্তি করেই খাওয়া হলো তার পর সিমেন্টর মেঝেতে বিশ্রাম । একটু বিশ্রামের পর ভকৎ কে তৈরি হতে বললেন দুগর । বিধবা মহিলাকে দুর্গা দশ টাকা দিয়ে বলেন – এটা রাখুন ঠাকুর কে নিবেদন করবেন ।