ডরোথী -6
ঘরে ঢুকে দুগর পরিবারের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । দুগরের বাবা দুগরকে কি সব বলছে তা বুঝতে পারলেন না দুর্গাপদ । দুগর বাবার কথায় লজ্জা পেলেন দেখে দুর্গা পদ জিজ্ঞেস করলেন । – – কি বললেন তোমার বাবা? – তোমার ওখানে ভাই কে কাজে লাগাতে পারবে কি না ভাই কে?
দুর্গাপদ, দুগরের বাবা কে বলেন – কেন হবে না ? হবে । ভকৎ আমার কাছে থাকবে । আমার কাঠের ব্যবসা আছে । তাতেই কাজে লাগিয়ে দেবো । আমার ও তো একটা লোক থাকলে ভালো হয় । তাছাড়া শুনেছি ও নাকি ভালো পুজো করতে পারে । ওখানে ও করবে । আমার শনি মহারাজ আছে । – ঘরে তো করে তোমার ও ঘরে করবে । বাবা কে বুঝিয়ে বলে দুগর । ওর বাবা দুর্গার হাত চেপে ধরলেন । দুর্গা ওঁকে প্রণাম করেন । দুগরের বাবা দুর্গার মাথায় হাত রাখেন । চা খাওয়ার পর দুগরের মা একখানা পেতলের ঝাঁপিতে পুজোর জিনিস গুটিয়ে দেন । রসময়ীর প্রণাম নিলেন না তিনি । বলেন আগে পুস্করনাথকে প্রণাম করে এস । দুগরই বুঝিয়ে দেন ।
হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন র দিকে রওনা হলো ওরা । ওখান থেকেই পুস্করের বাস ছাড়ে । সকালের মনোরম দৃশ্য চার দিকে । বেশ লাগছে রসময়ীর ।
বাস দাঁড়িয়েই ছিল । ঠেলে ঠুলে ঢুকতে হলো ভেতরে । কোনো রকমে একটা বসার জায়গা হলো , তাতে রসময়ী বসলেন এই সীট্ ও পাওয়া যেত না কারণ এই সিট্ এ একটা ছেলে বসে ছিল । তাঁর মা কে অনুরোধ করে বসেছেন রসময়ী । করার হয়েছে যে ঐ বাচ্চাটাকে তিনি কোলে নিয়ে বসবেন । রসময়ী ভাবেন,ঐ ছেলে তো রসময়ীর পেটের ছেলে ও হতে পারতো । এক একটা ঝাঁকিতে মনে হচ্ছে বাস বুঝি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে । দুগর আর দুর্গা কোন রকমে ড্রাইভার এর সীট্ এর দিকে কোন রকমে ঠাঁই করে নিয়েছে । হঠাৎ ই একটা ঝুড়ি দুগর এর পিঠের উপর পড়ল । দুর্বোধ্য ভাষার কচকচানি শুরু হলো । তারই মধ্যে সুদূর রাজস্থানে তাড়স্বরে দুগর আর দুর্গা বাংলায় কথা বলে চলেছে । এতক্ষণে ফাঁকা রাস্তা শেষ । এবার বাস চলেছে পুরোনো শহরের মাঝখান দিয়ে । কিছু টা গিয়েই বাস থেমে গেল । যে যার বোঝা নিয়ে নেমে গেল । এতক্ষণ রসময়ী ভেবেছিল সবাই বুঝি পুস্কর ধামে চলেছে । কিন্তু মন্দিরের দিকে মাত্র কয়েক জনই এলো । মাঝখানে কুন্ড মানে পুকুর । তার চার কোনা বাঁধানো । চার দিকে বড়ো চাতাল । একটা বড়ো ঘরের আকারের হবে । । তার ই এক পাশে ব্রহ্মার মন্দির । এটা ই ব্রহ্মার আদি কুন্ড ।
অনেকেই স্নান করছে এই কুন্ডে । রসময়ী আর দুর্গা ও স্নান সেরে নিলেন । ভিজে কাপড়ে কুন্ডের চার দিকে প্রদক্ষিণ করলেন তাঁরা । রসময়ীর পুজো সারা হতে মেয়েদের ঘেরাটোপে শাড়ি বদলে নিলেন । আর ভিজে শাড়ি থলেতে ভরে নিলেন ।
রসময়ীর পড়নে এখন গোলাপী তাঁতের শাড়ি । এখন পড়েছেন আটপৌরে ঢংয়ে । সেই রসময়ী এখন কোথায়? এই রসময়ী তো এখন ভক্তিরসে টলমল করছে । দুর্গা ভাবে, পান্ডা নেই । । এ কেমন তীর্থ! কোলকাতা র কালিঘাটে পুজো দিতে তো গন্ডায় গন্ডায় পুরোহিত ছেঁকে ধরে সবাই কে । আবার দুর্গা র নজর গেল রসময়ীর সিঁথিতে । সিঁদূর পড়তে ভোলেননি । চুল আঁচড়ে মাথায় কাপড় তুলেছে । দেখে বোঝা যায় অপার শান্তি রসময়ীর মনে । কারো দিকে নজর নেই । ডুবে আছে সে পুস্করনাথ এ । রসময়ীর এই ভাব দেখে দুর্গা করজোড়ে আঁকুতি জানায় সেই অসীম শক্তিমান কে । দুগর বসে আছেন চাতালে । ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন । বললেন – একটু চা খাবে তো? প্রশ্ন টা দুজনকেই । রসময়ী বলেন – আপনাদের বাড়ির ঠাকুর প্রণাম করে তবে জল খাবো । এখন বাড়িতে ফিরলেই ভালো হয় । ফিরতি পথে বাস একদম ফাঁকা । হুহু করে বাস ছুটছে । ভালো লাগায় রসময়ীর মনটা ছেয়ে আছে । বার বার মনে হচ্ছে তিনি বুঝি ব্রহ্মার পাদস্পর্শ পেয়ে গেছেন । কয়েকটি মেয়ে কে দেখা গেল পড়নে ঘাগরা । ওপরে ফতুয়ার মতো জামা । তার ওপরে উড়নি । এখানে এই পোশাকের চল । কারো কারোকে সিঁথির ওপরে ঝুমকোর মতোই টিকলী । দুগর এর বাড়ি পৌঁছে বাইরে পা ধুয়ে ভেতরে ঢোকা হলো । দুগর ওর । মা কে কি যেন বললেন । দুগর এর মা রসময়ী র হাত ধরে নিয়ে গেলেন ঠাকুর ঘরে । মুগ্ধ রসময়ী!কি সুন্দর ঠাকুর ঘর । জমকালো সাজ শনি মহারাজের । পেতলের ঠাকুর । তার ওপরে চাঁদোয়া টানানো । তাতে জরির ঝালোর দেওয়া । সার্টিন এর কাপড় দিয়ে দেয়াল মুড়ে দেওয়া হয়েছে । আসনে আসীন তেরো চোদ্দ বছরের একটি ছেলে । কথা না বলে রসময়ী মেঝেতে বসে পড়লো । যতোক্ষন পুজো না হয় বসে ই রইল সে । এবার পুজো শেষ । পুরোহিতের হাতের ছোট্ট ঘন্টা বাজতে শুরু হয়েছে । বাড়ির সকলে চলে এলো ঠাকুর ঘরে । পুরোহিত ঘন্টা বাজাতে বাজাতে বলছে – বোলো বোলো শনি মহারাজ কি জয় হো । সংগে সংগে বাড়ি র সকলে বলছে – ‘বোলো বোলো শনি মহারাজ কি জয় হো । রসময়ী কাঁদতে কাঁদতে বলছে – বোলো বোলো শনি মহারাজ কি জয় হো । বলতে বলতে লুটিয়ে পড়ে কান্নায় । সকলে স্তব্ধ । পূজারী ছেলে টি রসময়ীর কপালে ঘিয়ের প্রদীপের তাপ বুলিয়ে দেয় । বলে – ভাবী জি চরণামৃত লিজিয়ে । রসময়ী চোখ তুলে চায় তার দিকে । মুখে তার মিষ্টি হাসি । কোষাকুষি র থেকে চরণামৃত দিলো রসময়ীর গন্ডুসে গন্ডুসে । দুগরের মা রসময়ী কে নিয়ে গেলেন রান্না ঘরে । রসময়ী দুগরের বাবা আর মা কে প্রণাম করলেন । দুগর এর বোন সবার জন্য । সরবৎ নিয়ে এলো । দুর্গা দুগরের ভাই কে প্রশ্ন করে – হিন্দি কোথায় শিখলে?তোমার বাড়িতে কেউ তো হিন্দি বলে না । হাসলো সে । বললো,স্কুলে ই হিন্দি শিখেছে । এই ছেলে কে নিয়ে ওদের ভয় । ও নাকি বিপথে চলে গেছে । দুর্গা বলেছেন – আমাদের সাথে যাবে?বাড়ির জন্য কষ্ট হবে না তো?অনেক দূর । ইচ্ছে করলে ই আসতে পারবে না । তা ছাড়া তোমার দাদা ও অন্য জায়গায় থাকবে ।
উত্তরে ভকৎ রাম বলেছে – কিউ না রহ পাউংগা? আপ ঔর ভাবী জী তো রহেংগে । ভাবী জি ঔর আপ বহৎ আচ্ছে হো ।
দুর্গা পদ ভাবেন এই ভালো ভাব মূর্তি টা খসে না পড়ে । কি জানি রসময়ী আর দুর্গার এই হাসি যদি না থাকে!অমন অনেকেরই হয়ে থাকে দেখেছেন । লোকের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একরকম মুখোশ পড়ে থাকে । হাসে গল্প করে আবার তারা বাড়ি এলে চেহারা পাল্টে যায় । রসময়ীকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই । তাঁর নিজেকে নিয়েই চিন্তা ।
কিন্তু ফিরে গিয়ে তো ব্যবসা পাতিতে মন দিতে হবে । একটা লোক হলে তো ভালো ই হয় । যাই হোক ভকৎ রাম কে নিতেই হবে । দুগরের সাথে কথা বললেন – দুগর ভাই,আমি কিন্তু দু এক মাস ওকে মাইনে পত্র দিতে পারবো না । গিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে । যা পাবো তা দিয়ে তিন টা লোকের পেট চালাতেই বেড়িয়ে যাবে ।
দুগর বলেন – আরে!তোমার যা ইচ্ছে তাই করো । সেদিন ই ফেরা হলো না । কারণ ভকৎ রাম । হঠাৎ করে ছেলে কে ছেড়ে দিতে মায়ের মন চাইছে না । দুগর ও জোর করছে ক’দিন থেকে যাবার জন্য । ধারে কাছে বেড়াতে যাবার কথা বলছে । দুর্গা রাজী হয়নি খরচার কথা ভেবে ই । ভকৎ রামকে নিয়ে একটু খরচ আছে বটে । তবে সম্ভব হলে একবার বৃন্দাবন টা ঘুড়ে যাবেন । দুগরের জন্য কিছু খরচ করতে হয়নি এখানে । সে টাকা টায় বৃন্দাবনে খরচ করতে পারে । যাবার আগে দুগরের বোন কয়েকটা ময়ূরের পালক দিয়েছে রসময়ীকে । দুগরের মা একটা ময়ূর পুচ্ছের পাখা দিলেন । সন্ধ্যা সাতটায় গাড়ি ছাড়লো । তখন ও সূর্য অস্ত যায়নি । কারণ এটা পশ্চিমের দেশ । সূর্য অনেক দেরিতে অস্ত যায় । অজানা পরিবারের থেকে যে ভালোবাসা পেল রসময়ী তা কখনোই
ভুলবে না ।
কথা হলো এবার একসাথে বার হবে ওরা চার জন । পথে দিল্লি ঘুড়ে,মথুরা পথে বৃন্দাবন ও দেখে সোজা চলে যাবেন গন্তব্য স্থলে ।
রাতের গাড়িতে রওনা হলেন সবাই । এবার সংগে আছে ভকৎ রাম ।
দিল্লি পৌঁছতে সকাল সাতটা । নানা বর্ণের ছটা ঝিলিক দিচ্ছে পশমী রাজকীয়তা থেকে । অজানা পরিবারের থেকে যা পেল রসময়ী কোন দিন তা ভুলবে না ।
দিল্লির সকালে নতুন গন্ধ ভালো লাগছে রসময়ীর । স্টেশন থেকে বাস ধরে সোজা আগ্রা । পথে যমুনা নদীর পাশেই তাজমহল মন কেড়ে নিল । ইতিহাস বইয়ের পাতা এসে যাচ্ছে । তখন একটা স্বপ্নের দেশে ভাসছে রসময়ী । চোখে দেখা তো অন্য ছবি । এর সাথে তো বইয়ের কোন মিল নেই । দুগর বললো – বহন,তাজ মহল দেখে নাও ।
রসময়ী মনের সাথে ইতিহাস বইয়ের পাতায় চলে গেল । স্ত্রীর জন্য শাহজাহান এই মহল তৈরি করেছিলেন এই প্রেমের সৌধ ।
আবার আগ্রা থেকে বাসে রওনা দেয়া হলো মথুরার পথে । মথুরায় দুগরের একজন জানা শোনা ছিল । সেখানেই মালপত্রের বোঝা রেখে স্নান করে মথুরা ঘুড়ে বেড়ানো হলো । টাঙ্গা বুক করে নেওয়া হলো । সে ই বৃন্দাবনে ঘুরিয়ে দেখাবে । বড়ো মন্দির ছাড়া সব জায়গায় নামা হচ্ছে না । রসময়ীর হাত জোড়াই আছে । শুধু যেখানে দরকার সে কপালে ঠোকাচ্ছে । ভকৎ রাম পাশে বসে তাই রসময়ী কে অনুকরণ করে চলেছে । ভাবীজির দেখাদেখি কপালে হাত ঠুকছে ।
প্রথমে রাধা গোবিন্দ জী র মন্দিরে দাঁড়ালো ।