Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গৌহাটী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে গেছে মলি আর ডরোথী। একই সাথে দুজনে পড়াশুনা করছে। মলি,সুছন্দা,সুপর্ণা আর ডরোথী। একই সাথে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। বিরঝোড়া হাইস্কুলে পরে নাইট কলেজ হয়। ওখানে পি .ইউ র ক্লাস শুরু হয়েছে। সুছন্দা খুব ভালো নাচতো। সুছন্দা আর মলি অনেক নৃত্য নাট্য করেছে ।সুছন্দা ভালো অভিনয় ও করতো। মলি গান গাইতো আর সুছন্দা নাচত। সুছন্দারা রেলের ওল্ড কলোনীতে থাকতো। মলিদের বাড়ি ছিল শনি বাড়িতে। সে সব দিন তামাদি হয়ে গেছে । সুছন্দার বাবা বদলী হয়ে শিলিগুড়ি চলে গেলেন । সেই সব ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেল। শুধু মলি আর ডরোথী কাছাকাছি রয়ে গেল। দুজনেই গৌহাটীতে ঝালুক বাড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে ছুটিছাটায় আসে বঙ্গাইগাঁও ।

মলি বাড়িতে থাকলে মায়ের সাথে বাবাকে নিয়ে রসিকতা করে। মলির মা রসময়ী দেবী মেয়ের কথায় রাঙা হয়ে ওঠেন লজ্জায়। বাপ সোহাগী মেয়ের মুখের কোন রাখঢাক নেই। বদ মেজাজি দূর্গা পদর, মেয়েকে দেখলে রাগ জল হয়ে যায়। রসময়ী মলির ছোটবেলা কখনো মলিকে মার ধোর করলে,রাগ করে দুর্গা পদ উনুনে জল ঢেলে দিতেন।সবই স্ত্রী কে শিক্ষা দিতে । যাতে আর কোন দিন গায়ে হাত না তোলে। চার সন্তানের মা রসময়ী। মনে পড়ে সেই পুরনো দিনের কথা । দুর্গা পদ চৌধুরী আর রসময়ীর তখন নতুন সংসার । ছেলেু পুলে তখন ও হয়নি। এখন দুর্গা পদ দিবানিদ্রা দেন। সে কালে এ সবের বালাই ছিল না। কাঁচা বয়সে এসব শৌখিনতাই মনে হতো। বয়স বাড়ার সত্বে ও শরীরের কথা ভাবেননি । স্ত্রী রসময়ী মিষ্টি মহিলা । অমায়িক ব্যবহার ।সদা হাস্য মুখ।অমন স্ত্রী বলেই দুর্গা পদ পার পেয়ে গেলেন এ যাত্রায়।পার পেলেন বলার কারণ অমন বদ মেজাজি মানুষ ।তাঁর সাথে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারা ক সামান্য আনতে পেরেছিলেন ও দেশ থেকে। তাই দিয়ে ই ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার বুদ্ধি টা ছিল খাঁসা। তাই তর তর করে উঠেছেন পিছু হটতে হয়নি। রসময়ী তল পান না দুর্গা পদর। এই ভালো এই মন্দ। অথৈ জলে পড়ার মতো নাকাল হতে হয় রসময়ীকে চোখের জলে। এই ভাবে ই চার সন্তানের জন্ম দেন তিনি ।

একেবারে রূপকথার গল্প। কোথায় নাকি রসময়ী শুনেছেন পুস্করে স্নান করে যা কামনা করা যায় তাই মেলে।সাতটা বছর কেটে গেছে বিয়ের পর।নিঃসন্তান রসময়ীর দিন কাটে না ।স্বামী সবে কাঠের ব্যবসা শুরু করেছেন।তেমন কিছু নয়।তবে গ্রাসাচ্ছাদন চলে যায় কোন রকমে ।দুটি প্রাণি তাই দু পয়সা সাশ্রয় ও করেন ।তবে সে টাকা নিজের কাছে ই রাখেন । এ ভাবে ই দিন চলে যাচ্ছিলো। স্ত্রীর মনের আশা পূরণ করতে পারছিলেন না দুর্গাপদ। পুস্করে আর যাওয়া হলো না। বলতে বলতে ক্লান্ত রসময়ী। আর আশা রাখেন না পুস্কর ধামে যাওয়ার ।দিনেদিনে রসময়ীর হাসিতে ভাঁটা পড়ছে । তা নজরে পড়ে দুর্গার । আগে ঘরে এলে স্ত্রী এক ঘটি জল এগিয়ে দিতেন স্বামীর পা ধোয়ার জন্য। তাঁর পর গামছা দিতেন পা মোছার জন্য। সেসব কাজের মধ্য দিয়েই স্ত্রীর প্রেমের স্পর্শ পেতেন। কিছু দিন হলো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন দুর্গা। ঘটির জল,গামছা সবই এগিয়ে দেন। কিন্তু মালার সুতোর মতো থাকেনা ভালোবাসার ছোঁওয়াটি। ক্লান্তির ছাপ সে চোখে মুখে ।- ‘কি হলো শরীর খারাপ নাকি?- প্রশ্ন করেন দুর্গা। – না। ঠিক আছে ।- রসময়ী বলেন ।

টিনের ছাউনি হলেও মেঝেটা দুর্গা বাঁধিয়ে নিয়েছেন। মাটির ঘরে নানান ঝামেলা। প্রথম কথা রোজ ঘর নিকোনোর হ্যাপা রসময়ীর। রসময়ী বড়লোকের আদুরে মেয়ে। মা বাপ বদনাম করবে। তাছাড়া সাপ,ইঁদুর,ব্যাঙ সব ই ঘরে ঢুকবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ট্যাঁক এর টাকা। এতো বছর পর মনে পড়ে যায় সব কথা। হরিহর বাবুর বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি হলো সব কিছু। মাটির ঘর তাই সিঁদেল চোরেরা ঘরের বেড়ার এফোর ও ফোর করে ফেললো বড়ো গর্ত করে। মেঝেটা সিমেন্টের হলে যদি বা শব্দ হতো। টের পেত বাড়ির লোকজন। তাদের বাড়িতে জনা দশেক লোক। সবই কাজের লোক। কেউ টের ও পেল না। ঘর শূন্য হয়ে গেল । তাই তিনি ভেবে রেখেছেন- আধা খ্যাচরা কাজ করবেন না। তাই টাকা জমা করছেন। যাতে একবারে কাজটা শেষ করতে পারেন। ইচ্ছে ছিল দোতলা তোলার। কিন্তু দালান ঘর আর তোলা হলো না ।

ক’দিন আগে হরিহর বাবু র বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। এদিক ওদিক করে সমস্ত টাকা,ও স্ত্রীর গয়না জড়ো করে একটা কৌটোয় ভরে মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন। হরিহর বাবুর এমনই কপাল যে চোরেদের সিদ্ কাটার সময় সাবলের ঘা পড়বিতো পড় ঐ কৌটোর ওপরে ই পড়লো। আর চোরেদের দখলে চলে গেল ঐ কৌটোর মাল কড়ি। সর্বহারা হলেন হরিহর বাবু। ব্যবসা টা ছিল কয়লার । সে যুগে দামি জিনিস। সুতরাং ফুলে ফেঁপে উঠতে দেরি হয়নি । যাইহোক তখন কার মতো সকলে শোকে মুহ্যমান। এমনকি কাজের লোক অবধি।পাড়ার ছেলে বুড়োর ভীর বেড়েছে সেখানে। লোক আসার খামতি নেই । হরিহর বাবুর বড়ো ছেলের ভাবান্তর নেই। সে শুধু হাসি মুখে ই মানুষের ঢল দেখছে বাড়িতে। রোজের একাকিত্ব নেই। তাই বুঝি খুশি। যারাই এসেছে তারা একটা মানুষ রূপী কুকুর অর্থাৎ হরিহর বাবু র বড়ো ছেলেকে দেখেছে,যে জন্মাবধি পঙ্গু । বোধ শক্তির বাইরের জীব সে। তাঁর ছোট বেলা কোন রকমে কোলে কোলে কেটে গেলেও বড়ো হয়ে সমস্যা র ঢের লেগে গেল। হরিহর বাবুর মেজ ছেলেকে বড়ো দাদাকে স্নান করানো,টয়লেটিং করানো সব দায়িত্ব তার ।এটা কতো দিন সম্ভব!এরপর তার ব্যবস্থা হয় চারপায়ী জীব এর মতো। চেন এ বাঁধা থাকে সারাদিন ।রোজ কার নিয়মে বাঁধা ।শিকলের যতো টুকু ব্যাপ্তি ততো টুকুই নড়াচড়ার পরিধি তার ।চেনা অচেনা অনেকেই এসেছে। সবাই এসেছে সিদ্ কাটার রকম সকম দেখতে। দেখে রাখা দরকার ।জীবনের কোন কাজে লাগে কে জানে?জীবনে “বেসিক হিউম্যান নিড “এর মতো কখন কি কাজে লাগে কে জানে?এটা না দেখাটা অপদার্থতা। যারাই এসেছে তারা ই আশ্চর্যজনক দুটো বিষয় দেখেছে । প্রথম টার কাছে দ্বিতীয়টা হেরে গেছে । কারণ পরের টি তাঁরা ঐ ছোট্ট জায়গায় দেখেনি। মানুষ তাও আবার শিকলে বাঁধা! সেকালে যে ঐ শিকলে বাঁধা ছেলে টি ঠিক মতো চিকিত্সার ব্যবস্থা ছিল না। ঘরের সবাই কে যুদ্ধ করতে হতো অমন একটা সন্তান নিয়ে । এদের কে বলা হয় “স্প্যাসটিক চাইল্ড “।

যাক্ গে,যে কথা হচ্ছিল সে কথায় ফিরি। সবাই হরিহর বাবু র বাড়িতে গেলে ও দুর্গা পদ যাননি সেখানে। এতে দেখার কি আছে!নির্বুদ্ধিতার কাজ করে সব কিছু হারিয়েছেন তিনি । এবার নিজের বাড়ির কথা ভাবতে হবে। মেঝেতো পাকা করাই আছে,এবার দেয়াল তুলে দিলেই হবে । যাতে সিদ্ কাটতে না পারে। ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে এলেন ।

রোজ কার নিয়মে ঘটির জলে পা ধুয়ে গামছা দিয়ে হাত পা মুছে নিলেন। কি ব্যাপার !রসময়ীকে দেখা যাচ্ছে না!তাহলে কি রান্না ঘরেই আছে সে! রান্না ঘরে ঢুকে দেখলেন ,হ্যাঁ ।রসময়ী এখানেই রয়েছেন। চূড়ো করে থালায় ভাত বেড়েছেন। পাশে দু তিন খানা বাটি সাজিয়েছেন । গতিক সুবিধের নয় তা বুঝেই বললেন,”তোমারটা ও নিয়ে নাও।এক সাথে ই খাই।” – আজ আমার উপোস ।- মিনমিনে স্বর রসময়ীর। – কিসের উপোস? – আজ শনিবার । এখন থেকে শনিবার উপোস করবো। – সকালে বললে না,তাহলে এতো ভালো পাবদা মাছটা আনতাম না। তোমার শরীর এমনি ভালো নেই। তায় আবার উপোস সহ্য হবে! শরীরটার দিকে একটু যত্ন নাও। – আমার আবার শরীর তার আবার যত্ন! এমন শরীর গেলেই বাঁচি। রসময়ী চোখে আঁচল চাপা দিলেন।

থালায় জল ঢেলে উঠে দাঁড়ালেন দুর্গা । দেশ থেকে আসার পর কোনো দিন রসময়ী চোখের জল ফেলেননি। মনটা খারাপ হয়ে গেল তাই তখুনি ঘর থেকে বার হলেননা। একটু গড়িয়ে নিতে বিছানায় শুলেন। ভাবলেন রসময়ীর মতো একটা হাসিখুশি স্ত্রীর চাহিদা শুধু পুস্করধামে যাওয়া। তাই তিনি মেটাতে পারছেন না!সোনা না দানা না ,কিছুই চাহিদা নেই রসময়ীর। হঠাৎই ঠিক করে ফেললেন পুস্করধামে যাবেন।চুলোয় যাক ব্যবসা। রসময়ীর রস না থাকলে এই নিরস জীবনের কোন দাম নেই । পাশেই রসময়ী পাশ ফিরে শুয়ে। স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরে বললেন,- কি গো যাবে নাকি পুস্করে?

বহু দিনের ইচ্ছে পুস্করধামে যাওয়া। তাই আশা ভঙ্গের ভয়ে বললেন- যাও ইয়ার্কি করো না । দুর্গা বলেন- না গো সত্যি বলছি । – সত্যি বলছো?- -রসময়ীর চোখে জল মুখে হাসি । হাসি দেখে বুকটা ভরে যায় দুর্গাপদ র। এই না হলে জীবন!কি ভুল যে করছিলেন তিনি তার ঠিক নেই । স্ত্রী কে কাছে টেনে নিলেন । – যাবো গো যাবো ।দেখে নিও সাতদিনের মধ্যে যাবো। – সত্যি বলছো তো?মিথ্যে বললে আমার দারুণ কষ্ট হয় । – না গো না ,তোমায় মিথ্যে বলতে পারি?হাজার টাকা জমানো আছে। ওতেই বেড়িয়ে ফিরে আসা অবধি চলে যাবে। এমনকি ফিরে এলে ব্যবসার টাকা অবধি থাকবে । স্বামী গরবে গরবিনী স্ত্রী ।স্বামীর বুকে মুখ ঘসে রসময়ী । কথা রাখতে পেরেছেন দুর্গা পদ। চললেন সঙ্গে নিয়ে একমাত্র সাথী তাঁর স্ত্রী ও বালিশ চাদর মোড়ানো সতরন্চি।আর একটা হাত ব্যাগ ।তাতে একখানা ধূতি সার্ট ,লুংগী,গেঞ্জি। আর রসময়ীর দুখানা ব্লাউজ,শাড়ি,সেমিজ।আর রসময়ীর হাতে একটা ঝোলা ।তাতে পথের খাবার দাবার । বঙ্গাই থেকে সন্ধ্যে বেলার ট্রেন ছাড়লো ।কামরা প্রায় খালি ।জেগে ঘুমিয়ে আনন্দে রসময়ীর রাত কেটে গেল ।ভোরে পৌঁছলো শিলিগুড়ি স্টেশন এ। বরিশাল থেকে আসার পর এই প্রথম ট্রেন এ চড়া । খুব ভালো লাগছে দুর্গা র ।রসময়ী কে দেওয়া কথা রাখতে পেরে আরো খুশি তিনি ।

রসময়ী র প্রশ্ন- কখন পৌঁছব গো পুস্করধামে? দুর্গা- এই তো ট্রেন এ চাপলে। সে তো অনেক দূর ।আজতো রবি বার,বুধবার পৌঁছে যাবো পুস্করে। শোন,এখন খালি আছে,স্নান সেরে এসো ।

মগ আর গামছা নিয়ে স্বামীর ভালোবাসায় রাঙানো রসময়ী স্বামীময় হয়ে চলেছেন স্নানে।স্ত্রীকে বাথরুমের দরজায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলেন নিজের জায়গায়। বসে ভাবতে লাগলেন ফিরে এসে ব্যবসা জমবে তো?আবার ভাবলেন যা করার বাবা পুস্করনাথই করবেন । শিলিগুড়ি থেকে একজন উঠলেন ওদের কামরায়।কাছাকাছি বসেছে ।ভাবলেন,এই ফাঁকে হিন্দিটা একবার ঝালিয়ে নিলে কেমন হয়!যাচ্ছেন তো বাইরে ।হিন্দি তো বলতেই হবে । – এই যে বাবু,আপ্ কাহা যাইতা হায়?

বাবুটি থমকে যান ওঁর কথায়। তারপর পরিস্কার বাংলায় বলেন- আমি দুঃখী রাম দুগর। মাড়োয়ারি আমি । দুর্গা বলেন- বাহ্ আপনি তো ভারী সুন্দর বাংলা বলেন । দুগর বলে- থাকবো বাংলায় আর বাংলা শিখবো না?যেখানে থাকি সেখানের ভাষাটা শেখা উচিত । দুর্গা বলেন- আমি আসামের ভাষা শিখে নিয়েছি। কারণ ওখানে ই থাকি।তবে হিন্দিটা রপ্ত হয়নি ।

কথা বলতে বলতে রসময়ী বাথরুম থেকে এসে গেছে ।বেশ ফ্রেশ লাগছে রসময়ী কে।স্ত্রী কে দেখে দুর্গা উৎফুল্লিত ।আলাপ করালেন সহযাত্রীর সাথে । বললেন- হ্যাঁ গো,ইনি দুগর বাবু ।রাজস্থানে যাবেন।আমাদের আর চিন্তা নেই । রসময়ী বলেন- কেন?আমরা তো পুস্করধামে যাবো। দুগর বলেন- হ্যাঁ ।রাজস্থানেই পুস্করনাথ ।

লজ্জা পান রসময়ী। আগে বাড়িয়ে কথা বলার জন্য। ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে স্বামী বুঝি মত বদল করে রাজস্থানে যাচ্ছেন। জায়গা মতো বসে রসময়ী চিরুনি খুঁজে বার করলেন। দুর্গা পদর নজর কাড়ছে রসময়ীর একঢাল চুল ।দুগরের সাথে কথা বলতে বলতে ফাঁকে ফাঁকেই নজর পড়ছে স্ত্রীর চাঁদ পনা মুখের দিকে। টকটকে রং যেন রোদের আলোয় ঝকমক করছে। ঘরে তো বৌ কে দেখারই সময় হয় না। ব্যবসার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন উদয় অস্ত ।তাঁর বৌ যে এতো সুন্দরী তাও বুঝি ভালো করে জানা হয়নি। নতুন বৌ কে যখন দেখেন তখন যুবক বয়স। তাই দেখা নয় ,গোগ্রাসে গেলা ই হয়েছে। সে সব দিনের কথা মনে পড়ে হাসি পায়। ভুলেই গিয়েছিল সব। আজকালকার মতো ফুল শয্যা টয্যা হয়নি। কালরাত্রির দিনটা শুধু ই অপেক্ষা কখন সকাল হবে । সকালে নতুন বৌ কে দেখতে পাবেন ।

দূর ছাই সকাল হতেই জ্যাঠা মশাই পাঠিয়ে দিলেন কয়েকটা কাজে। বৌ কে দেখবে কি করে!সেই কাজ সাড়তে সাড়তে বেলা গড়িয়ে গেল। বড়িষাল এমনই জলা জায়গা। তায় বর্ষা কালে চার দিকে জলে জল ময়। বাড়ি অবধি নৌকো করে যখন ফিরলো তখন সূর্য ডুবু ডুবু। ঘরে ঢুকে ও বৌয়ের দেখা পায়নি ।কাকী,মামী,জেঠির পরিমণ্ডলে পরিবৃত হয়েছিল সে । উপবাসে ক্লান্ত শ্রান্ত দুর্গার পিঁড়ি পড়েছিল অবহেলিত জনের মতো রান্না ঘরে। যেমন টা রোজ পড়তো। বাপ মা মরা ছেলেটাকে মোহিনী মাসীই টানতো ।এটা ওটা ভাতের আঁড়ালে গুঁজে দিতো মোহিনী মাসীই। তাই দুর্গা সে পদ গুলোর স্বাদ পেতো। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর মোহিনী মাসী বলতো,”বাবা দুর্গা হাঁ করতো”। বলেই ভাতের দলা মুখে ঢুকিয়ে দিত। তখন শিশু কালের মাকে দুর্গা দেখতে পেত । মা বলতো,”দুর্গা হাঁ কর দেখি”। দুর্গা হাঁ করলে মা সুর করে বলতো,”কাগের দলা বগের দলা টপ্পত করিয়া গিলিয়া ফেলা “। দুর্গার চোখের কোণে জল এসে গেল। ধূতির খুঁটে জল মুছে ফেলে। মোহিনী মাসীর নজর এড়ায় না। বলে- কি রে কেউ কিছু বলেছে?

দুর্গা বলে- ,তোমার মনে আছে আমার মা কে? মোহিনী- থাকবে না আবার?ঘর আলো করা বৌ এসেছিল । অতো রূপ সহ্য হলো না তোর জেঠীর ।হিংসে,বুঝলি না?নইলে বৌটি বাপের বাড়ি যেতে চায়নি। তাকে জোর করে পাঠালো এরা ।

দুর্গা- বাবা কিছু বলেননি ? মোহিনী- সে আবার কি বলবে?বড়ো শান্ত ছিল । ভক্তি ছেদ্দা করতো বড়ো ভাই আর ভাজ কে। কোন ওজর আপত্তি ছাড়াই পাঠালো বৌ টাকে। তোকে আটকে এখানে রেখে দিলে। তোর বাবা,তোর মাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসতে গেল। আর ফিরলো না।পরদিন খবর এলো,নৌকা ডুবিতে অনেকেই ডুবে গেছে। মাঝি মল্লারের মধ্যে কয়েক জন বেঁচেছে ।একজন খবর দিয়ে গেছে ।

দুর্গাপদর ধরা গলা। কান্না গিলে বললো- -বৌ এলো। মা দেখতে পেলো না ।

মোহিনী বললো- দূর বোকা,মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই বৌ এসেছে ।অতো লক্ষী মন্ত মেয়ে। দেখবি তোকে কতো যত্ন আত্তি করবে ।

জেঠিমা রান্না ঘরে ঢুকে বাজখাঁই গলায় বলেন- মোহিনী তুই কি ছেলে টার মাথা খাবি? – কি যে বলো দিদি। সারা দিন পেটে ভাত পড়েনি। তাই খেতে দিলাম । – বেশি আল্হাদ দিস না। ঐ মায়ের ই তো ছা আর কতো হবে ।
দুর্গার কান্না পেয়ে যায়। কথায় কথায় মায়ের খোঁটা দেয় জেঠিমা। খাওয়া শেষ হতে মোহিনী মাসী ঘরের দিকে যেতে ঈষাড়া করে। হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় দুর্গা। ঘরে ঢুকে চমকে উঠলো ।এ কার ঘর?এতো গোছ করা। বিছানায় একটা জমকালো সুজনি পাতা। নতুন বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকে এসেছে বুঝি ।রাগ হলো জেঠি আর কাকীর ওপর। তাকে ঘরে যদি না পাঠাবে তবে ঢং করে এই লোক দেখানো বিয়ের কি দরকার ছিল? শোনা কথা,বৌয়ের বাপের পানের বরজ আছে । ভালো পণ দিতে হয়েছে। অথচ বৌয়ের নাম অবধি জানা হয়নি। বিয়ের সময় শুধু পদ্মের কলির মতো ফর্সা দুখানা হাতই ধরেছিল। রাগেই ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো দুর্গা। দারুণ নরম তো!চাদর খানা উল্টে দেখলো। ওর পুরোনো তোষকের ওপরে একখানা নরম মোটা তোষক পাতা । এও বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকে এসেছে বুঝি ।আগের তোষক খানা হয়তো মায়ের বাবা দিয়েছিলেন ।যাইহোক বৌয়ের দৌলতে একটু আরাম করে শুতে পাবে।

আরামে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা জানে না । হঠাৎ ই কাকিমার চিৎকারে ধরমর করে উঠে পড়লো দুর্গা । – এই যে নবাব পুত্র বৌ রইলো বসে আর তুমি ঘুমাচ্ছো?এ দেখি উল্টো ।আমাদের সময়ে আমি রইলাম বিছানায় বসে আর তোমার কাকু অন্য ঘরে ।ছিঃছিঃ ।এমন লক্ষী শ্রী বৌয়ের বরের কি চেহারা!বাঁদরের গলায় মুক্তো মালা।

বৌ চুপ করে দাঁড়িয়ে। দুর্গা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালো। কি করবে তা বোঝে না। কাকিমা বৌ কে নিয়ে বিছানায় বসালো। লজ্জায় বৌয়ের দিকে তাকাতে পারে না। কাকিমা বিদ্রূপ করে বলেন,- যাও যাও আর ন্যাকামো করতে হবে না। যেন ভাজা মাছ টা উল্টে খেতে পারে না ।

কাকিমা অনেকক্ষণ চলে গেছে। দুর্গা জানে সবাই আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা কি খোলা থাকবে?বোঝেনা দুর্গা। তাছাড়া বিকেল এ খেয়েছে বলে কি রাতে খাবে না?এখুনি কি ওরা শুয়ে পড়বে? বৌয়ের দিকে নজর পড়তেই রাতের খাওয়ার কথা ভুলে গেল দুর্গা। খাটে বসে নতুন বৌ। বৌয়ের চোখ জোড়া ঘোমটার আড়ালে। নাকের আর ঠোঁটের গড়ন দেখা যাচ্ছে। নাকের নোলকের পাথরটা ওপরের ঠোঁটে টলটলে জলের দানার মতো রয়েছে । দুর্গার নজর ঐ ভরন্ত যৌবনে। কোন চিন্তা না করে দুর্গা ঘটাং করে দরজায় ডাসা তুলে দিয়েছে । রক্তের দাপাদাপি অনুভব করার সময় দেয়নি সে। গোগ্রাসে গেলার মতো বৌকে টেনে নিয়েছে। প্রবেশ করেছে জগৎ সংসারের নিয়ম অনুযায়ী। একেবারে নিজের হয়েছে একটা প্রানী। যার সব কিছু দুর্গার । এই বোধ টায় দুর্গা অনাদি কালের পুরুষ জাতির মতোই অহমিকা বোধ করেছে। এই একজন অন্তত দুর্গাকে ভালোবাসবে। সন্মান করবে । কারো কাছে ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে দুর্গা দূর্বল পুরুষ হয়ে গেছে। একমাত্র মোহিনী মাসী বাদে সকলেই হেলা করে দুর্গাকে।

ভোর বেলা জেগে ও বৌয়ের শাড়ি টেনে রেখেছে। যাতে বৌ উঠতে না পারে। জাপটে ধরেছে বৌ কে। লজ্জায় বৌয়ের গালের লালিমা দেখার মতো হয়েছে।মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে দুর্গা। কৈ এমন রূপ তো কোথাও চোখে পড়েনি। চোখে চোখ পড়তেই আঁকুলিবিকুলি আঁচলের তরে। সুযোগ ছাড়েনি দুর্গা । – ছাড়বো,তবে রাতের মতো আর একবার এসো । – না না। সবাই জেগে যাবে । – ঠিক আছে,তোমার নাম টা বলো। – রসময়ী পাল। এ মা ভুল হয়ে গেছে। রসময়ী রায় চৌধুরী। দুর্গা পিঠের তল থেকে রসময়ীর শাড়ির আঁচল গোছ করে বার করলো । – যাও আজ ছেড়ে দিলাম ।

হঠাৎ ই রসময়ী দুর্গার কানের কাছে মুখ নিয়ে চাঁপা গলায় বললো- তোমার গালে আর নাকে সিঁদূর।

বলেই এক দৌড়ে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । শেষের কথা বোঝার আগেই দুর্গার কানে ভেজা নরম ঠোঁটের অনুভূতিটা মেখে যায়। মুখ ধুতে মন চায় না অনুভূতিটা চলে যাওয়ার ভয়ে । কিন্তু উপায় নেই। নাকে গালে সিঁদূর নিয়ে কি ঘোরা যায়?

মনে পড়ে যায় ছোট বেলার কথা। পন্ডিত এর কথা । মাতৃ পিতৃ হীন বলে ই পড়াশুনায় এগুতে পারে নি । এক বছরের বেশি পাঠশালায় যেতে দেয়নি। অথচ জ্যাঠতুতো দাদাদের পড়াশুনা করানো হয়েছে ।

নিতাই পন্ডিত জ্যাঠা মশাইকে বলেছিলেন – রাম বাবু,আপনার ভাইপোর মাথাটি খাঁসা। একটু পড়াশুনা করালেই সব ধরে ফেলে ।

জ্যাঠা মশাই উত্তরে বলেছিলেন- বেশি পড়ে কাজ নেই। হিসেবেটা বুঝিয়ে দিন। পয়সার হিসাব বুঝতে পারলেই চলবে ।

পন্ডিত মশাই দুর্গার বাবা নেই বলে কষ্ট পেতেন। – তোমার বাবা নেই তাতে কি হয়েছে? আমি তোমাকে পড়াবো। কাজের ফাঁকে তুমি আসবে আমি পড়িয়ে দেব। পাঠশালায় না পড়ে ও তুমি অনেক কিছু জানতে পারবে ।

সেই থেকে জ্যাঠা মশাই এর ফুট ফরমায়েস খাটার ফাঁকে ফাঁকেই পন্ডিত মশাই এর কাছে গিয়েছে দুর্গা। একটু বড়ো হয়ে খেতের ফসল তোলার দেখভাল, দুর্গা ই করেছে। সারা বছর নুন ছাড়া কিছুই কিনতে হয়নি। ছুটোছুটি করার দায় সব দুর্গার ওপরে ছিল। দুর্গার তো হক আছে সে সম্পত্তির । সবাই সব জেনে ও হেয় করে দুর্গা কে।

রসময়ী আজকাল রান্না ঘরে মোহিনী মাসীর সাথে যায়। নতুন বৌ আসার পর থেকে কদর বেড়েছে দুর্গার। এ ও মোহিনী মাসীই শিখিয়েছে রসময়ীকে। পই পই করে বলে দিয়েছে- জ্যাঠা,কাকার সাথেই যেন দুর্গার ভাতের থালা পড়ে। একবার পাত পড়ে গেলে তো জেঠি আর না বলতে পারবে না ।শনিবার পাওনা গন্ডা বুঝে একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে দুর্গা। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো ঘাটলায় মোহিনী মাসী ডাকলেন দুর্গাকে। – অ দুর্গা ইদিকে একটু আয়। একেবারে হাত পা ধুয়ে যা। শোন,জ্যাঠা কে খেতে দেবে নতুন বৌ। ওখানে তোকে ও খেতে দেবে। জ্যাঠার সাথেই বসবি । – সে কি !জ্যাঠার সাথে ই খাবো? – অতো কথায় কাজ নেই। যা এক্ষুনি পাত পড়ে যাবে। চলে যা। মোহিনী মাসীর কথা মতো ঘরে গেছে দুর্গা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে। নিকোনো হয়েছে দাওয়া। ওখানে জ্যাঠা রাজসিক ভাবে খেতে বসেন। কখন ও বা কাকা ও বসেন। সেখানে দুর্গার ঠাঁই হয় রান্না ঘরে । আজ কি হবে ভেবে বুক দুরূ দুরূ করছে দুর্গার। বড়ো বড়ো দু খানা পিঁড়ি পাতা হয়েছে ।

জ্যাঠা মশাই একখানা পিঁড়িতে বসলেন। গেলাসের জল নিয়ে ছিটোলেন ডান হাতে করে। নজর পড়লো রসময়ীর ঘোমটা দেওয়া মুখের দিকে। দু হাতে দুখানা থালা রসময়ীর। ডান হাতের থালা জ্যাঠা মশাইকে দিয়ে বাঁ হাতের থালা পাশের পিঁড়ির কাছে রাখলেন রসময়ী ।প্রমাদ গনছে দুর্গা। জ্যাঠা মশাই গলা তুলে কাকাকে ডাকেন- নিমাই,ভাত দিয়েছে।

নতুন বৌ বার বার দুর্গার দিকে তাকাচ্ছে।

কাকী চেঁচিয়ে বলে- সে বাড়ি নেই ।বৌমা ভাতটা তুলে রাখো।

নতুন বৌ এর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রাগ হয় স্বামীর ওপর। বলেই ফেলে- কি দরকার তোলার? আপনার ভাসুরপো বসে পড়ুক ।

সবাই মুখ চাওয়া চায়ি করছে। এই ফাঁকে দুর্গা টপ করে বসে পড়ে। নইলে বৌ আবার রেগে যাবে । জ্যাঠা মশাই বলেন- বেশ তো একসাথে দিলেই তো পারো আমাদের। তোমার ও আর বার বার দিতে হয় না । কাকী মা,জেঠিমার মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে।ভয়ে দুর্গা ওদিকে নজর ফেরায়নি। সেই থেকে শুরু হলো দুর্গার রাজসিক খাওয়া। আগে থালায় ঢাই করা থাকতো ভাত। আর তার ফাঁকে ফাঁকে গোঁজা সবজি ।কখনো কখনো মোহিনী মাসী ভাতের ফাঁকে লুকিয়ে দিয়েছে মাছ ভাজা । তাও কেউ এসে না পড়ে তাই গব গব্ করে খেয়ে নিতে হতো মোহিনী মাসীর নির্দেশে। হাত মুখ ধুয়ে যখন ঘরে গেছে দুর্গা তখন মোহিনী মাসীর মুখে হাসি,ছল ছলে চোখ । – অ দুর্গা,বাবা কেমন খেলি?পেট ভরে খেলি তো? আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো- তোকে অমন অচ্ছেদ্ধার খাওয়া খেতে দেখে আমার বুকটা ফেটে যায়। যাক্,সোনার পিরতিমে বৌটা এসেছে। আমার আর চিন্তা নেই ।

মোহিনী মাসীর চোখ মুছিয়ে দেয় দুর্গা ।পান নিয়ে এলো রসময়ী। মুখে তার তৃপ্তির হাসি।সে বলে – ও মাসী খেতে চলো। তোমাদের দিয়ে আমি বসবো। মোহিনী মাসী আর রসময়ী চলে গেলেন। দুর্গা ভাবে বৌয়ের দৌলতে ভালো খেতে পেলাম,শুতে পেলাম । কটা দিন এই সুখ আছে জানা নেই । মোহিনী মাসী বলেছিল এই দেশ থেকে চলে যেতে। দুর্গা ভাবে মায়ের মতো যদি এরা বৌয়ের সাথে ব্যবহার করে তবে সত্যি এদেশ ছেড়ে একদিন চলে যাবে। কতো লোক তো কোলকাতায় পাকাপাকি বসবাস করছেন । কেউ বা দু জায়গায় থাকছে ।

ভাতঘুম চোখে লেগেছিল। বিছানা নড়ে উঠতে বুঝলো রসময়ী এসেছে । এপাশ ওপাশ করছে সে।

কি গো,খেলে?সবাই কে দিয়ে খেলে?

না। মোহিনী মাসী আমায় জোর করে জেঠিমা কাকিমার সংগে বসিয়ে দিলো। তোমার জেঠিমা রাগ করছিলেন। খাবার পরে বলেন আমার মা নাকি ভালো শিক্ষা দেয়নি। শাশুড়ির সাথে কেউ খেতে বসে?

তুমি কি বললে?

চুপ করেই ছিলাম।আমাদের বাড়িতে মা আর বৌদি তো এক সাথেই খায় ।

মোহিনী মাসী কিছু বলেনি ?

হ্যাঁ ।অনেক কথা শুনিয়েছে মোহিনী মাসীকে।ওকে নাকি ওর বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে ।

নাঃ। আর পারা যাবে না । আমরাও কলকাতা চলে যাবো। কয়েকটা দিন মানিয়ে নাও।তারপর দেখি কোথায় যাওয়া যায় ।

বছর ঘুরেছে। অত্যাচারের নমুনা বেড়েছে। রোশটা রসময়ীর ওপরে। অশৌচ হলে মেয়েলী নিয়ম বেড়েছে। শুতে হয়েছে রান্না ঘরের নিকোনো মেঝেতে ।তাও শীতের মধ্যে একটা মাত্র চাদর পেতে। গায়েও একখানা মাত্র চাদর ঐ শীতে। সকালে সব কেচে শুকিয়ে নিতে হবে। কারণ রান্নার জন্য রান্না ঘর পরিস্কার করতে হবে। রান্না ঘরে ঢোকা যাবে না রান্নার সময় কিন্তু ঢাই ঢাই কাপড় কাচা যাবে । যেহেতু রান্না করছে না তাই কাপড় কাচতে হবে । সে ও আবার পুকুর ঘাটে। ঘাট নোংরা হচ্ছে না । সেই জলে ই সবাই চান করছে । দুর্গা ঠিক করে নিয়েছে। আর এদের সাথে নয়। অনেক অত্যাচার সয়েছে দুর্গার মা আর বাবা । এখন নতুন বৌ কে ও সহ্য করতে হচ্ছে । জ্যাঠতুতো দাদাদের পড়াশুনা করানো হয়েছে। কাকার ছেলে ও পড়াশুনা করে বিদেশে বড়ো চাকরি করছে। আর দুর্গা কে পন্ডিতের কাছে পড়তে দেয়নি। পন্ডিত এর কাছে কিছু পড়াশুনা করে দুর্গার আফশোস কিছুটা কমেছে ।কিন্তু রসময়ীকে সাতদিন জ্বর নিয়ে রান্না ঘরে পড়ে থাকতে দেখে আর ও দেশ ছাড়তে বদ্ধমূল হয়েছে দুর্গা। রসময়ী তার মামা কে জানিয়েছে যে দুর্গা আর রসময়ী আসামেই চলে যাবে পাকাপাকি ভাবে ।

জ্যাঠা মশাই টাকা পয়সা কিছু দেননি বরং কড়া কড়া কথা শুনিয়েছেন। রসময়ীর বাবা কিছু টাকা কড়ির ব্যবস্থা করেছেন ।

দেশ ছেড়ে আসার সময় মোহিনী মাসীকে আনতে চেয়েছিল দুর্গ। মোহিনী মাসী দেশ ছাড়তে চায় নি । বলেছে- “-অ দুগ্গা,কোথায় যাবো রে বাপ।” এই বলে বুকফাটা কান্নায় দুর্গাকে জড়িয়ে ধরেছে। আবার বলেছে- অ দুগ্গা,তুই আমার বাপ। আমার ছেলে। আমি মরলে তে রাত্তির বাতি দিস বাপ ।

স্টীমার ঘাট অবধি মোহিনী মাসী এসেছে। স্টীমার ছেড়ে দিতে কিছুটা পাড়ের পাশ দিয়ে চলেছে । মোহিনী মাসী ও পাড়ের পাশ দিয়ে ছুটেছে যতোটা সম্ভব। চিৎকার করে বলেছে- “অ দুগ্গা,আমায় ভুলিস নি বাবা ।” সেই চিৎকার দুর্গা আজ ও ভোলেনি ।- “-অ দুগ্গা টপ করে হাঁ কর দেখি ।” মোহিনী মাসীই দুর্গা কে বড়ো করে তুলেছে। মায়ের সেই আলো আঁধারিতে দেখা মুখ মিলিয়ে গেছে মোহিনী মাসীতে ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *