Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডবল || Mahasweta Devi

ডবল || Mahasweta Devi

বহুদিন হল আর মনের মতো ছবি করেন না নায়ক, দর্শকদের মনের মতো। আর, পাবলিক খাচ্ছে না বোঝার পর নায়ক (বি. কম.+ বি. এড.+ লাইব্রেরিয়ানশিপ পাশ) গভীর প্রজ্ঞা বশে, অসুস্থতার কারণে সাময়িক বিরতি নেন। কী তাঁর অসুখ, কেন তিনি বেলভিউতে, এসব নিয়ে কিছুকাল দৈনিক পত্রিকা, সিনেমা + সাহিত্য + জ্যোতিষী + রাজনীতি + খেলাধূলা + দূরদর্শন পত্রিকাগুলি সরগরম রাখে বাজার। প্রখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়। এক নায়িকা বলেন, আর কিছু চাই নে। ঠাকুর ওকে ভালো করে দিন।

ওঁর স্ত্রীর সে সময়ে বাজার গরম হয়। কেন না স্বামীকে তিনি হরলিকস খাওয়াচ্ছেন, মাথায় হাত বোলাচ্ছেন, স্বামীর কল্যাণে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিচ্ছেন, এ রকম নানা ছবি ছাপা হয়, নানা সাক্ষাৎকার।

নায়কের মেয়ে জামাই আমেরিকা থেকে ট্রাঙ্কল করে। ছেলে উড়ে আসে বোম্বাই থেকে।

আমাদের নায়কের বয়স চল্লিশ এবং পঁয়তাল্লিশ দুটোই। ১৯৪৩—এ জন্মালেও ১৯৪৮টা পাবলিক জানে। ফলে প্রতি বছর তাঁর সরকারি জন্মদিনে পার্টি হয়। প্রাইভেট জন্মদিনে বয়স পাঁচ বছর বাড়ে। বউদি সেদিন স্বহস্তে রেঁধে দিনে খাওয়ান। ঝপ করে বিয়ে, ধপ করে ছেলে—মেয়ে। তিনি মহানায়ক নন, জননায়ক। ”জননায়ক” শব্দটিই তৈরি ও প্রচার করা হয়েছিল। বরাবরই তিনি অ্যাকশন চিত্র করেছেন। সিনেমায় দিসুম দিসুম, ঘোড়া চড়ে পাহাড় লাফানো, চলন্ত ট্রেনের কামরা থেকে কামরা গমন, প্রজ্জ্বলন্ত দশতলা বাড়ি থেকে, ”মালা! তোমাকে আমি বাঁচাব” বলে পাইপ বেয়ে আরোহণ ও নায়িকা উদ্ধার, এসব তাঁর একচেটিয়া ছিল।

এমন লোককেও ”জাগো জাগো ভৈরব” চিত্রের পর বসে যেতে হল কেন না স্যামুয়েল সরখেল মিরজাফরি করল। সে কাহিনী বড়োই দুঃখের। মিরজাফরির কাহিনী তো দুঃখেরই হয়। সেদিন নায়ক স্যামুয়েলকে পেলে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতেন। তাঁর সংকল্প শুনে প্রযোজক বলেছিল, বাপের নাম ও জানে? যে ভোলাবেন?

—সে কি! জন্মদাতা পিতার নাম জানে না?

নায়কের মনে একটা ”ছি ছি” রণিত হয়েছিল। সিনেমায় তিনি অন্তরে পিউরিটান, অ্যাকশনে অরণ্যদেব। এখন, এমন যদি হত যে বাস্তবে তিনি আসলে লম্পট এবং অ্যাকশনে ভয় পান, তখন তাঁকে পিউরিটান সাজতে হত।

তাঁকে নিয়ে বাঁচোয়া হল, তিনি বাধ্যতামুলক পিউরিটান। যে জ্যোতিষার্ণব বলেছিলেন, চাকরি ছাড়ো সত্য কয়াল! গগনে ভাত হও। নক্ষত্রলোকে তোমার স্থান! নায়কের খুড়তুত ভাই হিসেবেই মুখ দেখাও!

তিনি ত্রিকালজ্ঞ, রাজজ্যোতিষী, মহাজ্ঞানী। তাঁর কথা নায়কের জীবনে সুফলাসেবিত শস্যক্ষেত্রের চেয়েও অধিক ফলদায়ী হয় সে ষোলো বছরের কথা। তিনিই বলেছিলেন, সাফল্য আসবে। তবে একটা কথা, নক্ষত্র—জীবন অতি ভয়ানক। মন উচাটিত হবে। বিবাহিতা স্ত্রী ব্যতীত প্রত্যেক স্ত্রীলোককে মা—মাসি—মামী—জ্যেঠি—খুড়ি—পিসি— ভগিনী— ভাগিনি—ভাইঝি—কন্যা ইত্যাদি চোখে দেখবে। অন্যথা করেছ কি সমূলে পতন হবে।

—সে যে কঠিন গুরুদেব।

—জানি! জানি! সে জন্যেই তো রত্নাদি ধারণ করিয়ে দেব। বাকি জীবন রত্নাদির নজরদারিতে থাকবে।

এ কারণেই প্রথমে পিউরিটানিকতা অভ্যাস করতেন বাধ্য হয়ে। সুখের কথা হল, চলচ্চিত্রেও তাঁর ভূমিকা থাকত অত্যন্ত পিউরিটান এক ব্যক্তির, যাকে সমাজসংসার প্রথম ও দ্বিতীয় রিলে ভুল বুঝত। যে ভয়ানক সব অ্যাকশন দ্বারা সমাজদ্রোহী হয়েই সমাজকল্যাণ করত এবং পঞ্চদশ রিলে বোঝা যেত সে মহান।

ফলে ক্রমেই তিনি পিউরিটান হয়ে গেলেন।

চিত্রজগতের পক্ষে ব্যাপারটি অত্যন্ত শুভ হল। বাঙালি দর্শক সিনেমায় ধর্ষণ—রাহাজানি— হত্যা—দিসুম তখনই পছন্দ করে যখন দ্বিতীয় নায়িকা চিত্রশেষে বিবাহিত নায়ককে বলে, ”তুম মেরে ভাই হো!”

সহ্য করে স্ত্রীর উপর প্রচণ্ড অত্যাচার, যখন চিত্রান্তে নায়ক ফিরে এসে স্ত্রীকে জড়াতে চায় এবং স্ত্রী স্বামীকে প্রণাম করতে ছাড়ে না।

সেই জননীকেই সহ্য করে বাঙালি দর্শক, যে নচ্ছার ছেলের শত নষ্টামি সত্ত্বেও আর্ত ক্রন্দনে পুলিশের পা ধরে ছেলেকে দেখতে চায় ও তীব্র আর্তনাদে বলে, ”আমি যে মা!”

এর কারণ বাঙালিকে আসলে যা ভাবানো হয়েছে তাই সে ভাবে। মিলন ও সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। এই সংরক্ষণশীলতাই বাঙালিকে রক্ষা করছে। ধ্বংস কোরো না, রক্ষা করো। মার্কসবাদে ঘোষিত বিশ্বাস (অ থেকে হ সকল মার্কসবাদ বিশ্বাসী মানুষের ও দলের) ও সাঁইবাবার বিভূতিতে কোনো সংঘাত দেখে না বাঙালি। মানব নশ্বর, কিন্তু মূর্তি অবিনশ্বর বলে মানুষকে ন্যাংটোপোঁদা রেখেও মূর্তি বসায়। উক্ত ন্যাংটোপোঁদা মানুষরাও দেশনেতাদের মূর্তি স্ববাসস্থানে কামনা করে। এ ভাবেই বাঙালি জননী ক্ষেত্রে যশোদা, পত্নী ক্ষেত্রে সীতাকে চায়, দুহিত ক্ষেত্রে সুকন্যাকে। বাঙালি প্রাচীন ধারণাকে বর্জন করে না, নতুন ধারণাকে পাশে ঠাঁই দেয় মাত্র। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণকে মুর্দাবাদ করা অপচেষ্টাকে পারমুটেশন—কম্বিনেশান পদ্ধতিতে ”কিছু থাক কিছু যাক” করা গেছে। সমাজে পুরুষশাসনকে মন্দ বলে কিন্তু ভারতললনাদের নিদ্রা থেকে উত্থান চায় না স্বঘরে। সিনেমা ক্ষেত্রেও বাঙালি শেষ অবধি সেই কাহিনী দেখতে চায় যাতে সব ঠিক হ্যায়।

বাঙালি মানসিকতার ইচ্ছাপূরণ আমাদের নায়ক। ব্যক্তিজীবন নিরমায় কাচা ছোটো মেয়েটির জামার মতোই শুভ্র।

সিনেমায় টাকা করেও নায়ক গেরস্ত স্বভাব ছাড়েননি। তিনি দাপুটে স্বামী, কঠোর পিতা। দর্শক ও অনুরাগীকে মুগ্ধ করার জন্য নয়, স্ববিশ্বাসেই তিনি পিতামাতার বাৎসরিক, গ্রীষ্মে আম উৎসর্গ মহালয়াতে কালীঘাটের গুয়ে গঙ্গায় স্নান করেন।

এ জন্যই তিনি বাঙালিজনের নায়ক বা জননায়ক।

স্যামুয়েল এঁকেই চূড়ান্ত ল্যাং মারে।

সে অনাথ, বাবার নাম জানে না শুনে নায়ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বাপের নাম জানে না, তার কী মরালিটি থাকবে বল?

প্রযোজক, আউট অফ নায়ক, কম পয়সা করেনি। ”রক্ত” সিরিজটাই সুপারহিট। ”ভাইয়ের রক্ত”, ”জননীর রক্তবিন্দু”, ”রক্ত আর আগুন”, ”রক্ত রাঙা দিন”, চারটি ছবিই চলেছে। ”জাগো জাগো ভৈরব” চলল না।

প্রযোজক খিঁচিয়ে বলল, মরালিটি নিয়ে কি ধুয়ে খাব? ছবিটা চলল না…

—তুমি ‘রক্ত” বাদ দিয়ে নাম দিলে কেন?

—গল্পের যা ছক!

বস্তুত, ছবিতে গল্পও দরকার এ বোধটা প্রযোজক ও নায়কের পরে এসেছে। আগের প্রযোজক ”ঋণ” সিরিজ করেছিলেন। ”মায়ের ঋণ”; ”ঋণ শোধ”; ”দেশের ঋণ”, সবই চলেছিল। গল্পকার সুচন্দন বসাক ছকে ফেলে গল্প লিখে যেতেন। পাবলিক নিত।

—এবার তো গল্প ভাল ছিল। ”বিদ্রোহ আজ” বইটাও সুপারহিট। কিনলাম সে জন্যে। সব নষ্ট করল স্যামুয়েল।

—ভেগে গেল কোথায়?

—বিয়ে! বিয়ে করেছে! আর লাইফ রিকস করবে না। স্বামী—স্ত্রী দোকান দেবে।—শালা!

—উপায়?

—আরেকটা স্যামুয়েল খোঁজা।

নায়ক আঁতকে ওঠেন।

—গুরুদেবের কাছে জেনে আসি।

—চলুন, আমিও যাব।

গুরুদেব খুব রুষ্ট হন। বলেন, জানতাম খারাপ খবর আনবে। এনেছ?

প্রযোজক চমকে যায়।

—কী করে জানলেন?

—আমি ওর বাড়িতে বসে। ও আউটডোর করছে। দিনের ত্রিংশ দণ্ডে মানে বিকেল ছ’টা নাগাদ একটা কাক ওর বাগানে মাটিতে বসে ”আবা আবা” ডাকতে থাকল। তখন জানি শ্রবণকর্তা দুঃসংবাদ শুনবে। কাক ডাকে আবা আবা! সুখবর কেমতে শুনবে বাবা? এ হল অতি কঠিন সমস্যা। খবরটা কী?

—স্যামুয়েল ভেগেছে।

—স্যামুয়েল…ভেগেছে? এ তুমি কী শোনালে চাঁদু? সে না থাকলে…

—অন্য স্যামুয়েল খুঁজতে হবে।

—ও—ই শোনো, কাক ডাকছে।

প্রযোজক চাঁদু পাল বর্তমানে টাকার গরমে তপ্ত। পুত্রলাভে উল্লসিত। নতুন অ্যাম্বাসাডর কিনে গর্বিত। এই গুরুদেবের ভক্ত সেও। কিন্তু তার বয়স সবে বত্রিশ। ফলে রক্ত এখনও গরম।

সে বলে, কাক তো ডাকেই।

—বাজে ক’টা চাঁদু?

—এগারোটা বেজে দু’সেকেন্ড।

অর্থাৎ চতুর্দশ দণ্ড। উত্তরে বসে কাক কোয়া কোয়া ডেকে গেল। শুনল তিনজন, বুঝল একজন। ভুলেও আরেকটা স্যামুয়েল খুঁজো না। সত্য তাহলে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হবে।

—তা হলে উপায়?

—কিছুদিন ক্ষ্যামা দাও। স্যামুয়েল ফিরবেই।

চাঁদু বলে, সে জন্যে ছবি থেমে থাকবে?

—বিকেল পাঁচটায় অর্থাৎ অষ্টবিংশতি দণ্ডে ঈশান—কোণে কাক সা—সা ডাকবে, সত্যকে শুনতে হবে, সে হল সু—সময়।

—অর্থাৎ?

—স্যামুয়েলকে পেয়ে যাবে, অথবা তার মতো কাউকে। এখন কিছুকাল ছুটি নাও।

চাঁদু বলে, ছুটি নিয়ে বসে থাকবে, কাক ধরতে?

—বগলামুখীর যজ্ঞ করে কবচ দিয়েছি। কবচই কাক টেনে আনবে। সব পরেপ্পর হয়ে যাবে।

সত্য অথবা শ্রাবণ রায় অথবা নায়ক (স্ত্রীর নাম শ্রবণা) মনে মনে সংশয়ী হন। গুরুদেব পাগল হয়ে যাননি তো?

—পাগল আমি হইনি সত্য।

নায়ক কেঁপে ওঠেন।

—আমিও তীর্থে যাব।

—আমার কী হবে?

—”কাকচরিত্র” দিয়ে গেলাম। দেখে চোলো। দণ্ডের হিসেব কীভাবে করবে, লিখে দিলাম। চাঁদু, ”বিদ্রোহ আজ” বইয়ে সত্যর কী কী আছে?

—ঘোড়া চড়ে নদী পার, পাড় থেকে জলে লাফ, চলন্ত মোটরের ছাত থেকে চেম্বার ফোট, অজগরের সঙ্গে লড়াই, মানে টেরি ফিলম মানে টেররিস্ট যুগের গল্প…

—স্যামুয়েল বিনা…

গুরদেব মাথা নাড়েন ও কিছুকাল বাদে তীর্থ বলে বেরোলেও নৈহাটিতে শিষ্যবাড়ি গিয়ে সহসা স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি কাকাশ্রম তৈরি করেন। ভাতে রাম মেখে খাওয়াবার ফলে এক পাল কাক পক্ষীধর্ম ছেড়ে মোদো কাক হয়ে যায় এবং তাঁর বশীভূত হয়। ”কাকচরিত্র” ফুটপাথে বিক্রি হয়, কিন্তু কাক বিষয়ে দৈবী প্রেরণা একা তিনিই পান। তবে এসব ক্রমে ক্রমে হয়।

এ কাহিনীতে গুরুদেব ও কাকাশ্রম এক প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র। শ্রাবণ রায়ের জীবনে এ অধ্যায়ে বিপর্যয় ঘটায় স্যামুয়েল। সে সিনেমার একটি একসট্রা মেয়েকে বিয়ে করে চলে যায় এবং অন্যদের বলে যায়, এর নাম প্রেম।

নায়ককে অসুস্থ হতে হয়। জনগণের শুভেচ্ছা নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নিতে হয়। ছাদের ঘরে বসে কাকের ডাক অনুধাবন করতে হয়। ক্যাসেট চালিয়ে দণ্ডে দণ্ডে কাকের ডাক রেকর্ড করতে হয়।

কাক সম্ভবত বলে, ক্রোলন ক্রোলন!

অথবা মুর মুর!

অথবা আহে আহে!

অথবা খাবা খাবা!

অথবা মহে মহে!

নায়ক শুধু কা কা শোনেন।

স্যামুয়েল ও তিনি, দুই দেহ এক সত্তা।

ছায়া যদি কায়া ছেড়ে উল্টো বাগে অবিরাম হাঁটে, সেটা তার বেইমানি। অ্যাকশন হিরো নায়কের ক্ষেত্রে ডবল বেইমানি। কেন না স্যামুয়েল তাঁর ডবল।

সব অ্যাকশনই সে করত।

যোগাসন, মাসাজ, প্রাতঃভ্রমণ, ডায়েটিং অক্ষুণ্ণ রেখে নায়ক স্যামুয়েলের কথা ভাবেন।

কাকের দিকে কান পেতে থাকেন।

মনে মনে বলেন, বাসমোতি চাল আধ কিলো রাঁধিয়ে ভাত দিচ্ছি, অয় অয় ডাক হারামি।

কাক ডাকে কা কা।

আগে অ পরে আ।

এ ভাবেই স্যামুয়েল সরখেলের কারণে নায়কের জীবন কাকে ভরে যায়।

চাঁদু পাল এসে বলে, কাঞ্চনকুমার উঠছে। টি.ভি.তে খুব ক্যান্টার করছে।

—তাকে নেবে ভাবছ?

—দাদা! ব্যবসার নাম ব্যবসা।

—স্যামুয়েলের নামে বিজ্ঞাপন দাও তো!

—দিচ্ছি। কিন্তু মাস দুয়ের বেশি দেরি করব না।

—কাঞ্চনকুমারের ডবল লাগবে না?

—হয়ে যাবে। ওর মতো চেহারা কতজন করে ফেলেছে। ওই যে স্যুটিং, শার্টিং, রাজদূত, হরলিকস, তাজমহল চা, সব বিজ্ঞাপনে মুখ দেখায়। তাছাড়া টি.ভি. তে ”বলাকা বিদায়” ছবিতে কুমার সেজছিল। বাজার আছে।

—বিজ্ঞাপন দাও।

দুপুর একটায় সতেরো দণ্ডে ছাতের দক্ষিণে বসে কাক আয়—আয় ডাকছিল কি? যে জন্যে চাঁদু পাল হাড়ে কাঁপ ধরিয়ে দিয়ে গেল এমন করে?

দূরদর্শনে নায়ক এখনও নামতে চান না। ছোটো পর্দা থেকে বড়ো পর্দায় উত্তরণ সম্ভব, যদি বয়স থাকে। এখনও তো নায়ক ঈষৎ বয়স্ক যুবকদের ভূমিকায় নায়কই থাকেন।

পুরোনো দিনের নায়ক ললিতদা বলতেন, নায়িকা বা নায়কের দাদা হয়েছ কি, দাদার পর বাবা, বাবার পর পিতামো করে দেবে। বুদ্ধিও ছিল তোমার, তোমার কালে টাকাটাও বেশি, বাড়ি করোচো, ফ্ল্যাট কিনোচো, শেয়ার কিনোচো, দুটো গাড়ি। না খেয়ে তো মরবে না। নায়ক ছিলে, নায়ক থেকেই টা টা কোরো। মহানায়কের কথা মনে কোরো। যেন রাজা চলে গেল।

—কিসে আর কিসে ললিতদা! মহানায়ক একটাই হয়, দুটো হয় না। আমি তো তুচ্ছ!

—আমাদের কালে অ্যাকশন কম ছিল। তবে যা করতাম, নিজেই।

নায়ক মাথা নাড়েন এখন।

কত যত্নের দেহ। মাসাজ, যোগব্যায়াম, ডায়েট, কত দামি শরীর! ঘোড়ায় চড়বেন, আগুনে ঝাঁপ দেবেন, জলে সাঁতরাবেন, একটা কিছু হয়ে গেলে?

তাঁর যে কেন এ দুর্ভোগ হল! নায়ক শনিবার কালীঘাট গেলেন। মা, সকলকে সব দিচ্ছ। শ্বশুর বউ পুড়িয়ে খালাস পাচ্ছে। গরমেন্টগুলো চুরি করছে দোহাত্তা। আমি আউটডোরে যেয়েও চিত্রাকে বলতাম, পিঠ চুলকে দিও না ঝুনু! তোমাকে আমি ভগ্নী ভাবে দেখি।

নায়িকাদের বোন বলেছি, নায়িকাদের মা থাকলে মা বলেছি। এদিক—ওদিক করলেই পতন হত।

পুজো দিয়ে বেরিয়ে অনুরাগীদের ভিড় ঠেলে গাড়িতে ওঠার সময়ে পুরোনো পাণ্ডা দলীপরাজ (আসল নাম বৈদ্যনাথ) বলে, নিজের ছক ভালো থাকলে তো হবে না দাদা। স্যামুয়েলের ছকে হয়তো গণ্ডগোল।

পিছন থেকে এক অসভ্য ছোকরা বলে, দাদা কি রিটায়ার হয়ে গেলেন?

আরেকজন কেউ বলে, আরে, বক্স অফিস নেই।

বড়ো দুঃখ মনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পাবলিক আওয়াজ দিচ্ছে, যাদের আনন্দ—উত্তেজনা—রোমাঞ্চ যোগাবার জন্যে স্যামুয়েল তাঁর হয়ে কতবার জীবন বিপন্ন করেছে। বাড়ি ফিরতে অহো, কী সুসংবাদ।

তাঁর বাড়িতে যে ছোকরা সিকিউরিটি, তার নাম আঙুর। আঙুর ক্যাসেট চালিয়ে কাকের ডাক রেকর্ড করে ওঁকে সাহায্য করে।

আঙুর বলে, সগাল আটটা নাগাদ মানে ষষ্ঠদণ্ডে, যে কাগটাকে নত পরিয়েচি, সে পশ্চিমে বসে পোষ্কের অহা—অহা বলে ডাগল। আপনার মাতার ওপর বসিছিল। অবশ্যি হেগেও গেচে, সে আমি ধুযে দিয়েচি।

হ্যাঁ, শ্রবণার (আগের নাম ছিল শোভনা, কিন্তু শ্রাবণের স্ত্রী হিসেবে বহুদিন সে শ্রবণা, ছেলে শ্রবণ এবং মেয়ে শ্রাবণী) মাসতুতো ভাই সিমেন্ট জমিয়ে নায়কের এক বিমূর্ত মূর্তি করেছিল। সিমেন্টের বৃহৎ ডিম, তার একদিকে পাখা। নায়ক ওটি ছাতেই রাখেন। ভিজে কাপড় মেলতে এসে ওর ওপর রেখে একটি একটি করে মেলা বড়ো সুবিধাজনক। নায়কের মাথায় নাইলনের মশারি রেখে জল ঝরানোও হয়। উক্ত মাসতুত ভাই পেট্রল পাম্প চালায় এখন, যার নাম শিল্পী সার্ভিস।

—রেকর্ড করেছ?

—করেছি।

পরিষ্কার অহা অহা ডাক।

এবং স্যামুয়েলের চিঠি।

”সংবাদপত্রে পিকচার দেবার দরকার ছিল না। আমার ঠিকানা দিলাম। দরকার থাকলে দেখা করুন। যদি আসেন অবশ্যই ব্রিং সাম মানি।”

নায়ক শ্রবণাকে বলেন, গুরুদেবের নাম করে একশোটা টাকা পাঠাতে হয়। কাক—ভোজন করাবেন।

আঙুর বলে, বেস্পতিবার পুন্নিমার আলোয় ভাইকে একটা কাগ ধত্তে বলিচি। বাড়ির পাশে বিস্তর কাগের বাসা। ভাই তো সাট্টা খেলে। দিন কয়েক দই খাওয়ালেই সাট্টায় নম্বর লেগে যাবে।

—ডিমের ব্যবসা করবে বলে পাঁচশো টাকা নিল না?

আঙুর বলে, সে ভাই ডিম বেচে যাচ্ছে। এটা সবার ছোটো। এগান্নে আচি তো সবাই। সাট্টা খেলেই ও দালান দিল। বড়ো তেজি জিনিস। সবার সয় না।

—নফর নস্কর লেন জান?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ধুনরি পাড়ার পাশের গলি। ওখেনে এগটা কেস কত্তাম যে!

—আজই যাব আঙুর, আজই।

আঙুর বলে, সুসংবাদ দিইচি, ক্যাশ ছাড়বেন কিচু, মাল খাব। এগবার সুষুমার কাচেও যাব। অনেকদিন দেকা নেই। পার্মেট তো রাকতে পারিনি। টেমোরি, তবু মাজে মাজে যেতে হয়।

নায়ক এ সব কথায় খুব এ—হে—হে মনে করেন। গুরুদেবকে বোতল বোতল রাম দেন বটে, কিন্তু নিজে খান না। এবং স্ত্রীলোক বিষয়ে আঙুরের দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর পছন্দ নয়। শ্রবণা বলে, মনকে বড়ো করো। জান, পয়সা থাকলে আঙুর আর সুষমা বে’ করত?

—বিয়ে তো করেছে।

—আহা, আরেকটা করত। সিকিউরিটি আপিস ওকে কী বা দেয়! সে জন্যেই ওকে খেতে দিই!

নায়ক একটি মেজো পাত্তি এগিয়ে দেন। পঞ্চাশ টাকা কোনো টাকা নয়। কাজ করে টাকা নিচ্ছে।

হঠাৎ তাঁর কৌতূহল হয়।

—কাক ধরে নথ পরাও কী করে?

আঙুর বাংলা মায়ের সরল ছেলে। সে বলে, এগদিন কাকাশ্রম দেকে শিকে এইচি। ভাতে—বাংলায় মাখিয়ে দিই। মদের নেশায় লাট পাট। ধর আর নত পরাও। সুষুমাকেও বেপট বাংলা খাইয়ে চেপে ধরে সোনার নত দিয়ে নাক পটাস করে ছ্যাঁদা করে দিই ছিলাম। কাগেরাও, বুজলেন, ইস্তিরি ভাবের পাকি। মদ্দা কাগের মদ্যেও মাদি ভাবটা খুব বেশি। যাবেন, দেকবেন, গুরুদেব কাগেদের কী খাইয়ে বশ করেচে।

—যাকগে ও কথা। আজই চল।

সিকিউরিটি ছাড়া নফর নস্কর লেনে কেন, কোথাও যান না নায়ক। কে কোথায় কী করে দেবে, খোমা বদলে গেলে ভাত গেল।

দুই

নফর নস্কর লেনের নতুন নামকরণ শহিদ মাতঙ্গ হাজরা লেন এবং ধুনির পাড়ার বস্তি লোপাট, বড়ো বড়ো গুদাম, কিন্তু আঙুর ঠিক চিনে ফেলে পথ। ১/৪/২২বি, বাড়িটি এক বারাকবাড়ি। গলির মুখে গাড়ি রেখে ঢুকতে হয়, মুখ রুমালে ঢেকে, সানগ্লাস পরে। স্যামুয়েল সরখেল বলতে কেউই চেনে না। বারাকবাড়ির সামনাসামনি একটি মদের ঠেক, আবগারি লাইসেন্স নম্বর লেখা। বাংলা ও মাংসের ঘুঘনি সেবন নিরত এক পাকাটে চেহারার প্রৌঢ় বলে, দোতলা। কপাটে নাম লেখা আছে। তা, এমন চ্যায়রা পোশাক…কাজের খবর এনেছেন বুঝি?

নায়ক জবাব দেন না। মর্মাহত তিনি। আত্মবিশ্বাসে চাকু ঢুকে যায়। রক্তাক্ত আত্মবিশ্বাস খাবি খায়। সাত মাস পর্দায় নেই। তাতেই তাঁকে চিনল না? আঙুর নিচুগলায় বলে, এরা বাংলা ফ্লিম দেকে না।

বহু মল মূত্র, গলিতে শুকনো টিউবওয়েল বাঁধা ছাগল এবং কলহরতা দুদল স্ত্রীলোক পেরিয়ে ঢোকা যায় বারাকবাড়িতে। বাড়ির দেয়ালে লেখা, ”পৈরো সভা যদি এ বাড়ি ভাঙতে চায় বিকল্প বাড়ি দিতে হবে—গোলাম হোসেন লজের বাসিন্দা বিন্দ।”

কনডেমড হাউস! কাক! তুমি কোথায় নিয়ে এলে নায়ককে? কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওঁরা দোতলায় ওঠেন। একটি ঘরে ক্যালেটে ”জিনে লালা হুঁ” বাজে। কোনো যুবতী চিল চিৎকারে বলে, মুফতে ঘোড়া চড়া যায় না। পয়সা নিয়ে তবে এসো।

এমন নরকে ঢুকেছে হারামজাদা! ”এস. টি. অ্যাকশান বীর” লেখা কপাটে টোকা মারতে স্যামুয়েল দরজা খুলে দেয়।

—এসেছেন!

—ভেতরে আসব?

—ভেতরে? আসুন।

ঘরটি যথেষ্ট বড়ো। যদিও দেয়াল, যিশুর ক্রুসবিদ্ধ ছবি, চৌকি, একটি টেবিল, দুটি চেয়ার, ঘরের কোণে জনতা স্টোভ ও সামান্য বাসন, ফরফরে আরসলা, সবকিছুতে পড়ে নেওয়া যায় এ সবই কনডেমড। স্যামুয়েলের পরনে প্যান্ট অতীব ঢলঢলে, দেহ ঝুলে গেছে। মুখে খোঁচা দাড়ি, চুল খুব লম্বা, কনডেমড চেহারা।

—টাকা এনেছেন?

নির্বাক নায়ক দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরেন। আরো আছে সঙ্গে। সব বের করা ঠিক হবে না।

স্যামুয়েল মাথা নাড়ে।

—হিসেব মনে রেখেছেন।

—স্যামুয়েল, কথা ছিল।

—এখানে বলতে কষ্ট হবে?

—তুমি এখানে এলে কবে?

—স্যামুয়েল ”রক্ত রাঙা দিন”—এর বিক্রমজিত হয়ে যায় ও বিষাক্ত হেসে বলে, এখানেই তো আছি।

—এখান থেকেই তুমি…?

—নিশ্চয়।

—এ তো ভেরি আনহেলদি বাড়ি।

—কে বলল? যখন ডবল হয়ে কাজ করতাম, হেলথের অভাব দেখেছ?

—তা—তোমার—স্ত্রী?

স্যামুয়েল বলে, চলে গেছে। ফ্যানসি মার্কেটে কারবার করতে গেলাম, মার খেয়ে গেলাম, তিন মাসে মহব্বত খতম। চলে গেল সোয়ামির কাছে।

—স্বামী—মানে—?

—হাজব্যান্ড তো ছিলই। সেখানেই গেল, না আর কোথাও গেল, কে বলবে? আঙুর চুক চুক শব্দ করে।

—তা, কথা হল শ্রাবণ বাবু?

—এ ঘরে….চল না গাড়িতে, যাই গঙ্গার দিকে। এখানে খুব হীপ লাগছে।

—কেন? আরে! আমি আর তুমি। দুজনেই বিক্রমজিত, দুজনেই বিপ্লব, দুজনেই পুরন্দর, কিন্তু বছরের পর বছর একজন ফিরত বালিগঞ্জ সার্কুলারে, একজন ফিরত ”গোলাম হোসেন লজে”, দুজনে এখানে কিছুক্ষণও বসা যাবে না?

—চল তো!

নায়ক স্নেহের তিরস্কার করেন।

—চল, আজ তোমাকে পেয়েছি যখন, ছাড়ছি না। (গলাটি অন্তরঙ্গ করেন, যদিচ মনে ঘোর সংশয়। খাইয়ে মাখিয়ে মক্কেলকে পুরোনো চেহারায় ফেরাতে মাস খানেক তো যাবে। অ্যাকশান দৃশ্য নয় পরে তোলা হবে।) চল তো। এই রকম কষ্টে আছ—চল, পেট ভরে খাওয়াব, মন ভরে কথা শুনব।

স্যামুয়েল এখন পুরন্দর। ”মায়ের ঋণ” চার মাস চলেছিল। ”পাগলি মায়ের পাগল ছেলে” গানটি সুপারহিট করে দিয়েই বান্ধব দত্ত দুর্ঘটনায় ফুটে যান।

—কষ্টে আছ কথাটা উইথড্র করো বিজয়।

—বেশ! উইথড্র করলাম।

—দেশসেবকের আবার কষ্ট কী? কোটি কোটি দেশবাসী যখন….দেখছ তো আঙুর। পারতাম, আমিও পারতাম। কিন্তু ডবল হয়েই দিন কেটে গেল।

নায়ক সময়োচিত সহাস্যে (বুকের মধ্যে ধুকুপুকু, যে জায়গায় এসেছেন, গলির মোড়ে গিয়ে হয়তো দেখবেন, গাড়ি হাওয়া) বলেন, বেশ তো। সাইড রোলও করতে পার যাতে সেটা দেখব। জামা পরে নাও। দাড়িটা কামাবে?

—না, ব্লেড ফেলে দিয়েছি পরশু। মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে—

—ছি ছি স্যামুয়েল। আত্মহত্যা মহাপাপ।

আঙুর বলে, এখন করছ কী?

—মিশনে যাই, বই বাঁধাই। আরো ধান্দা—

—আগে না সোর্ড ফাইট শেখাতে?

—টেম্পোরারি। চলুন।

তিন

ভিক্টোরিয়ার সামনে ময়দানে নায়ক ও স্যামুয়েল। ব্লু ফক্সে ভরপেট খেয়েছে স্যামুয়েল ও আঙুর। নায়ক স্যুপ খেয়েছেন। নৈশ ডায়েট দুটি রুটি, স্যালাড ও দুধ আজ বাদ গেল। সকালে কোষ্ঠকাঠিন্য হবেই। স্যামুয়েল এখন নায়কের পয়সায় কেনা ক্লাসিক সিগারেট খাচ্ছে।

ওর নীরবতা বেশ অস্বস্তিকর। দুজনে দুজনকে দেখছেন। যেন দুটো চিতাবাঘ ভয়ানক সতর্কতায় এ—ওকে তফাতে রেখে ঘুরছে। কে আগে ঝাঁপ মারে।

—বুঝলাম তো সবই। তুমি ডুব মারলে কেন?

—তুমি কেন কাগজে ছবি ছাপালে শ্রাবণ রায়?

তুমি! শ্রাবণ রায়! আগে ”সার” বলত।

—তোমাকে যে আমার ভীষণ দরকার।

—’বিদ্রোহ আজ!”

—জান?

—বইটা পড়েছি। ঘোড়া চড়ে নদী পার! পাড় থেকে জলে লাফ। চলন্ত মোটরের ছাতে শুয়ে জানলা দিয়ে পুলিশ অফিসার খতম! জঙ্গলে অজগরের সঙ্গে লড়াই! চারটে অ্যাকশান।

—বইটা কেনা হয়ে গেচে।

—নায়কও আছে।

—বাঃ তুমি ছাড়া…

স্যামুয়েল হাসে। ঘাতকের হাসি। হা—হা—হা, ইংরেজের গুপ্তচরের রক্তে হাত রাঙা করে…

—পারবে না?

—কী করে পারব?

—যেমন করে আমি পারতাম!

—তোমার মতো কে পারে বল?

—তাহলে তো ঝেড়ে কাশতে হয়।

—বল, বল।

—”মায়ের ঋণ” থেকে আমি তোমার ডবল। আটটা ছবিতে তোমার বদলে ছ’বার তরোয়াল ঘুরিয়েছি। বার দশেক ঘোড়া চেপে লাফ মেরেছি। আগুন থেকে নায়িকাকে বাঁচাতে—আর পাথর থেকে পাথরে টপকে সেই যে বিখ্যাত সিন। বন্দুক কেড়ে নিয়ে ছুটছি। কয়েকবার মরে যেতে পারতাম শ্রাবণ রায়।

—জানি, জানি স্যামুয়েল।

—সেবারই তো পড়ে গিয়ে—

স্যামুয়েলের ভুরু কুঁচকে যায়।

—সেবারই তো পড়ে গিয়ে পাঁজরায় ফাট ধরে গেল। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালেই প্লাস্টার ব্যান্ডেজ করে—তুমি জানবে না, তোমরা গাড়িতে বেরিয়ে গেলে কাঁকড়াঝোড়। সগর্বে বলে, ভাঙা পাঁজরা নিয়েই ঘোড়ার পিঠে পাহাড় থেকে—রিস্কের পরে রিস্ক…

—এখন তো ভালো আছ।

—খুব ভালো।

—চেহারাটা, মানে ফিগারটা আর আমার মতো নেই অবশ্য। বাঁ কাঁধটা একটু নামিয়ে চলছ।

—জাগো জাগো ভৈরব!

—তার মানে?

—ত্রিশূল দিয়ে অত্যাচারী জমিদারকে বিদ্ধ করে, বারবার দুরন্ত আক্রোশে শ্রাবণ রায় তাকে মারছে। কাঁধের হাড় সরে গেল স্যামুয়েলের।

—যদি বলতে!

—বললে কী করতে? কনট্রাক্ট থাকত দৈনিক টাকায় কাজ করব। রিস্ক আমার। দৈনিক টাকা! একশোতে শুরু, আড়াইশোতে উঠেছিলাম।

—তুমি আমার সঙ্গে চল।

—কোথায়?

—আমার বাড়ি। (হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা) ডাক্তার দেখবে, গুড ফুড খাবে, টাকা বাড়বে…

—খুব তাড়াতাড়ি দুজনে একরকম হয়ে যাব? মীনার কথা তো সেটাই ছিল। তোমাকে ভাঙিয়ে লোকটা পয়সা পিটছে। তুমি যত রিস্ক নিচ্ছ। সিনেমার সময়ে ডাক! ওর যদি তোমাকে ছাড়া নাই চলে, ও কেন তোমাকে আলাদা টাকা দেয় না? খেয়ে মেখে ও হয়ে যাতে থাকতে পার? একদিন তো মরে যেতেও পার। তখন কী হবে?

—তুমি তো বলনি।

খুব নিচু গলায় তীব্র আক্রোশে স্যামুয়েল বলে। জিজ্ঞেস করেছ তুমি? করেছে চাঁদু পাল? মানুষের শরীর। মারদাঙ্গা করতে করতে আজ পাঁজরে ফাট, কাল কাঁধে ডিসলোকেশান, কে জিজ্ঞেস করেছে? ডবল তো! আসলি মাল তো নয়। কি, আরেকটা পাচ্ছ না?

—তোমার আমার হাড়ের স্ট্রাকচার, হাইট, ফিগার, সব একরকম, এ যে কী আশ্চর্য!

—এখন তো তা নয় শ্রাবণ বাবু।

গভীর আনন্দে স্যামুয়েল ”গোল্ড কাপ” ছাপা জীর্ণ নাইলনের জামা বাতাসে ওড়ায়। গা খুলে উদলা করে।

—বাঁ কাঁধ ঝুঁকে থাকে। পেটে দেখ ঘোড়ার খুরের চোটে চারটে সেলাই, মাংস মাসল সব গন। হাড়ও শুকোবে। এখন আর মিল কোথায়? দুজনে এক ড্রেসে এক মেকাপে থাকলেও মিলবে না। কদ্দিন দুজনে এক ছিলাম। এখন আসলি—ডাবলি ফারাক।

স্যামুয়েল হাসতে থাকে।

বিপন্ন, বিপন্ন, নায়ক। কুমির তোর জলকে নেমেছি। কিন্তু কুমির তো ধরা দেয় না।

এবার কেজো ব্যবসায়ীর ভূমিকা।

—স্যামুয়েল। স্বীকার করছি, তোমার অনেক ট্রাবল গেছে। কিন্তু ”সার” বলতে, জানাতে পারতে।

—আরে! শুটিং কালে দুজনে এক। তারপর তো ডবলের নফর নস্কর, অসলের ‘মাতৃস্মৃতি”। দু’জনের দু’পথ। জান শ্রাবণ বাবু! তুমি যদি নফর নস্করে যেতে আমি যেতাম তোমার বাড়ি, দুজনের চেহারায় হয়তো মিল থাকত।

—আর কথা নয়। আজ থেকেই চল। শরীর সারাও। আমার ওখানে থাক।

—তোমার ওখানে?

—আর কোথায়?

—আবার ডবল হব?

—টাকা বাড়বে, কোম্পানি দেবে, আমি দেব।

—মীনা বলেছিল বটে আমার অন্য গতি নেই। কেন বলেছিল জান? আমি যে মানুষ, সেটা তো ভুলে যাচ্ছিলাম। তোমার ডবল করি, সে জন্যেই নামডাক আমাদের পাড়ায়। খুব নামডাক।

—তবে ও বাড়িটা ছাড়তে হবে।

—থাকব কোথায়?

—ব্যবস্থা কি হবে না?

স্যামুয়েল আরেকটি সিগারেট ধরায়।

—সেটা কি করা যাবে শ্রাবণ বাবু? ভেবে দেখ, বলতে পার মানুষ কে? আমি না তুমি? না না, শোনো, বহুৎ দিন ভাবছি কথাটা…

—পাগলামি কোর না।

—একজন সিনেমা, একজন মানুষ। তুমি তো ছায়াছবির ছায়া। চেহারা টসকায়নি, মুখ কী সব পলেস্তারা করে ঠিক রেখেছ। তুমি ভক্কা। বছরের পর বছর এক চেহারা। আদমি তো আমি।

ভাঙা বা ফাটা পাঁজরে তবলা চাপড়ে স্যামুয়েল চেঁচিয়ে ওঠে, মানুষের চেহারা শুকোয়, অ্যাকশানে চোট খায়, মীনা ফুটে গেলে কলজে ছুরি খায়। তোমার জন্যে আমি আবার চেহারা ফেরাব, আবার লাইফ রিস্ক করব, কেন? হাত দেখেছ? এ হাতে তরোয়াল ঘুরবে না চাঁদু! পা দেখেছ? পাহাড়ে লাফাবে না পা, শিরাগুলো লাফায়। বডি দেখেছ? শিশুতীর্থ সরোবরে ছেলেদের সাঁতার শেখাতে গিয়ে জলে নেমে দম চলে গেল, ভয় পেয়ে গেলাম!

—এ সবই আস্তে আস্তে…

—তার চেয়ে! শ্রাবণ বাবু! চল তোমাকে নিয়ে যাই। ঠিক আমার ডবল করে ফেলি।

আসল মানুষের মতো হয়ে যাও। কি! পারবে?

স্যামুয়েল কি অরণ্যদেব?

ও কি অতিকায় হচ্ছে?

—নায়কের চেহারা ও রকম হলে…

—নায়কের চেহারা ওরকম হলে? থুঃ।

স্যামুয়েল থুথু ফেলে।

—কোথায় পড়ে আছ তুমি? ডায়মনকাটা শেতলা ওমপুরীকে পাবলিক নিচ্ছে, আর আমাদের নেবে না? খুব নেবে। আসলি ক্যা হ্যায় নকলি ক্যা হ্যায়, পাবলিক ভড়কি খেয়ে যাবে। ক্যানটার করে দেব শ্রাবণ বাবু! তোমাকে আমি হতে হবে। রিস্ক নিতে হবে। আমি তোমার জন্যে বেয়াল্লিশ বার রিস্ক নিলাম। তুমি একবারও পারবে না। যাও!

—যাব?

—যাও!

স্যামুয়েল রাজার মতো হাত নেড়ে দেয়।

—ডরপোক নকলির সঙ্গে নো মহব্বত!

স্যামুয়েল দৌড়তে থাকে। হাঁ করে বাতাস গেলে ও চমৎকার স্প্রিন্ট করে। পারি, এখনও পারি শ্রাবণ বাবু! কিন্তু আর আমাকে পাচ্ছ না। লাফিয়ে হার্ডল পেরোতে পারি, সব পারি শ্রবণ বাবু, কিন্তু নকলির জন্যে আর…

শ্রাবণ রায়ের মাথা ঘুরে যায়।

চার

ছাতের পাঁচিল থেকে সংলগ্ন নিমগাছে লাফ মারতে গিয়ে শ্রাবণ রায়ের অকাল মৃত্যুর সংবাদ আপনারা পড়েননি। (এমন কিছু কি ঘটেছিল?)

হৃদরোগে অকালমৃত্যুর কথা পড়েছেন।

”বিদ্রোহ আজ” অপয়া বই বলে ওটি ছবি করার বাসনা ত্যাগ করেছে চাঁদু পাল।

একটি সিনেমা+সাহিত্য+জ্যোতিষী+হোআট নট পত্রিকা এই হিড়িকে একটি মার্কেট রিসার্চ সংস্থাকে দিয়ে জনমত সংগ্রহ করাচ্ছে। এক হাজার লোককে জিজ্ঞেস করা হবে কয়েকটি প্রশ্ন—

(ক) ”বিদ্রোহ আজ” পয়া, না অপয়া?—হ্যাঁ/না

(খ) শ্রাবণ রায় কি হৃদরোগে মৃত?—না/হ্যাঁ

(গ) শ্রাবণ রায় কি দুর্ঘটনায় মৃত?—হ্যাঁ/না

(ঘ) এটি হত্যা, না আত্মহত্যা?—হত্যা/আত্মহত্যা

শ্রাবণ রায়ের ছবিগুলি পুনঃপ্রদর্শিত হচ্ছে। যথেষ্ট ভিড়। মহিলারা কাঁদছেন।

স্যামুয়েল এ জন্য কতটা দায়ী সে কথা বলা অসম্ভব, কেন না ”গোলাম হোসেন লজ” ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাসিন্দারা কে কোথায়, তা নিয়ে ”নিরাশ্রয়” নামক ঝকঝকে আধা সাহেবি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তদন্তে নামেনি।

আঙুর কয়েকদিন বাদে গুরুদেবের কাছে যায় এবং গুরুদেব ওকে বলেন, ভালো লোকটাকে মেরে ফেললি?

—চাঁদু বাবু বলছে, মাথায় ভিরমি লেগেছিল। ”নিজেই পারি, ডবল লাগবে না” বলে লাফ মেরেছিল।

—আর তুমি ওকে বুঝিয়ে ছিলে গাছ থেকে কাক ধরে (কাক চরিত্র/পৃষ্ঠা ১৮/১১ নং সূত্র দেখুন) সাত দিন দই রুটি খাইয়ে অষ্টম দিনে কাকটা কেটে…বশীকরণ করবে স্যামুয়েলকে!

আঙুর বলে, ভিমড়ি কাটবেন না। সে কেঁদে খুন হচ্ছিল, পায়ে ধরছিল, বই পড়তে দিলাম, ইউরেকা বলে সে পাঁচিলে উঠে নিমগাছে ঝাঁপ মারবে তাই জানি? হতভাগ্য বই তো আপনি ধরালেন!

—একটা ডবলের জন্যে…অমূল্য প্রাণ!

দুজনে চুপ করে যান। গুরুদেব অস্ফুটে বলেন, স্যামুয়েল! শ্রাবণ! খুব মিসটিফাইং!

—গভীর রহস্য। আমি ভয় খেয়ে গেছি।

রামসিক্ত ভাত খেতে কাকেদের হুলাহুলি।

কাক ডাকে কা কা

আগে অ পরে আ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *