ডবল পটললাল
০১. হট্টমন্দির
পরিণাম, পরিণতি এসব মোটেই ভাল শব্দ নয়। বিশেষ করে পটললাল বিষয়ে কোনও রচনার নাম একটু হালকা রকম হওয়াই নিয়ম।
পটললালকে আপনারা অনেকেই অল্পবিস্তর চেনেন। লাল গানে নীল সুর হাসিহাসি গন্ধ, পটললালের গল্প হবে ফুরফুরে মেজাজের, অবশেষে তার কিনা এই পরিণতি।
.
অনেক দিন আগে একটা বিলিতি সিনেমা হয়েছিল, দেয়ার ইজ নো বিজিনেস লাইক শো বিজিনেস, অর্থাৎ শো বিজিনেসের মতো বিজিনেস নেই।
আমাদের পটললাল আদ্যন্ত এই শো বিজিনেসের লোক। যাত্রা-থিয়েটার-সিনেমা বেতার-দূরদর্শন এই সব নিয়ে যে বৃহৎ রঙ্গজগৎ সেই জগতের লোক পটললাল, তার স্ত্রী সুলেখা এককালের নামকরা নর্তকী। তখন অবশ্য সুলেখার সঙ্গে পটললালের সদ্ভাব চলছে না। তা না চলুক এ গল্পে সুলেখাকে আমরা টানব না।
রঙ্গজগতের ভিতরে এবং বাইরে নানা ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে পটললাল সিনেমার টালিগঞ্জে এসেছে। তবে এ যাবৎ জীবিকার জন্যে পটললাল করেনি এরকম কাজ প্রায় নেই বললেই চলে।
জুতোর দোকানের ম্যানেজারি থেকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাব বিক্রি, প্রয়োজনে যে কোনও কাজ পটললাল করেছে। তার সহ্যক্ষমতাও অসাধারণ। নিজের থাকা-খাওয়া নিয়ে তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
সেই যে পুরনো একটা কথা আছে। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে। এ কথাটা বোধহয় পটললালের মতো লোক সম্পর্কেই একদা রচিত হয়েছিল।
হট্টমন্দির কথাটা খুব মজার। হট্ট মানে হাট, হাট বসে সপ্তাহে একদিন। বড়জোর দুদিন। অন্যান্য দিন হাটের চালাঘরগুলি শূন্য পড়ে থাকে। তখন যত রাজ্যের ভবঘুরে, ভিখিরি সেখানে রাত্রিযাপন করে। কখনও কখনও গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরাও এই সব শূন্য চালাঘরে রাত্রিযাপন করেন, সেই জন্য প্রাচীন টিপ্পনীওলা ব্যঙ্গার্থে হট্টমন্দির শব্দটা রচনা করেছিলেন।
পটললালের ক্ষেত্রে হট্টমন্দিরে রাত্রিযাপন কোনও ব্যাপারই নয়। ফুটপাথে, রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, অচেনা বাড়ির বারান্দায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেকেই রাত্রিযাপন করে।
পটললাল এসব জায়গায় ভাগ্য বিড়ম্বনায় অনেক সময়েই আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এসব খুব বড় কথা নয়। পটললাল সকলের থেকে আলাদা একটি কারণে যে সে অনেক সময় কারার অন্তরালে রাত্রিবাস করে। কখনও পুলিশ হাজতে, কখনও জেল হাজতে।
তা, কারাবাস তো অনেককেই করতে হয়। ফৌজদারি মামলায় অনেকেরই তো কারাদণ্ড হয়। তা ছাড়া, মামলা চলাকালীনও আসামির জেলবাস বা হাজতবাস হয়। জামিন না পাওয়া পর্যন্ত।
.
হাসির গল্পে এসব জটিল আইনের কথা আনা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু পটললাল যখন গল্পের নায়ক, এসব বিষয় চলে আসা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
চুরি-ডাকাতি রাহাজানি ইত্যাদি কোনওরকম দুষ্কর্মের জন্যে নয়, নিতান্তই পেটের দায়ে, জীবিকার প্রয়োজনে পটললালকে মাঝেমধ্যে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় সেখানে সব সময়ে জামিন হয় না। তখন তাকে জেলে যেতে হয়। জেলখানা বা থানার হাজতঘরই পটললালের হট্টমন্দির।
০২. ডবল
একটু পিছন থেকেই শুরু করি।
বেশি নয়, এই চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর।
.
…হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে দুই ভাই নীলাম্বর ও পীতাম্বর চক্রবর্তী বাস করিত। ও অঞ্চলে নীলাম্বরের মতো মড়া পোড়াইতে, কীর্তন গাহিতে, খোল বাজাইতে এবং গাঁজা খাইতে কেহ পারিত না।….
কেউ কেউ হয়তো পঙক্তিগুলি চিনতে পারছেন, শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ উপন্যাসের আরম্ভ এই ভাবে। সেই বিখ্যাত উপন্যাস অবশ্য রচিত হয়েছিল আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে।
সে যা হোক, পঞ্চাশ বছর আগে সেই গত শতকের পাঁচের দশক নাগাদ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের খুব রমরমা বাংলা সিনেমায়। সেই ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, মলিনা দেবী, সুনন্দা ব্যানার্জি, সন্ধ্যারানীর কম্বিনেশন। হৃদয়ের তন্ত্রীতে মোচড় দেয়া, চোখের জলে ভেজা সেসব কাহিনি বাঙালি মানসকে আপ্লুত করে রেখেছিল।
এই সব শরৎচন্দ্ৰীয় চলচ্চিত্রের প্রথমেই দেখা যেত শরৎচন্দ্রকে। সামনাসামনি নয়। সেটা সম্ভব ছিল না, শরৎচন্দ্র পনেরো-বিশ বছর আগে পরলোক গমন করেছেন। পিছন থেকে দেখা যেত, পক্ক কেশ, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা গুঁজে লিখে চলেছেন।
হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে দুই ভাই.প্রায় দু মিনিট ধরে উপন্যাস লিখনরত শরৎচন্দ্রকে দেখিয়ে ছবি শুরু হল।
সাধারণ দর্শক হয়তো মনে করত সত্যি সত্যি শরৎচন্দ্রের ছবি, হয়তো আগে তোলা ছিল, তাই দেখানো হচ্ছে।
কিন্তু ব্যাপারটা যে তা নয়।
দক্ষিণ কলকাতার এক বহু পরিচিত সিনেমা হলের সংলগ্ন এক রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ছিলেন শরৎবাবু। ভদ্রলোকের নাম অবশ্য শরৎবাবু ছিল না, বোধহয় ফণিবাবু বা মণিবাবু ছিল, কিন্তু লোকমুখে তার নাম হয়ে গিয়েছিল শরৎবাবু। ১৭৬
কারণ তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে তৈরি সিনেমাগুলোয় শুরুতে কাগজ কলম নিয়ে উপন্যাস রচনারত শরৎচন্দ্রের ডামি হতেন। পিছন থেকে তোলা ছবিতে তাকে শরৎচন্দ্রের লেখা লিখতে হত।
একালের ভাষায় বলা চলে, ওই ফণিবাবু বা মণিবাবু ছিলেন শরৎচন্দ্রের ডবল।
ডবল ব্যাপারটা আজকাল মোটামুটি সবাই বোঝেন। রাজনীতি এবং সিনেমায় ডবলের খুবই প্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে।
কলকাতায় অবশ্য এরকম ঘটে না কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে পাটনা গেলেই দেখা যাবে রাজপথে আগে-পিছে দুটো গাড়ি যাচ্ছে। দুটো গাড়িতেই মাননীয় লালুপ্রসাদ বসে আছেন। এর একটা আসল, দ্বিতীয়টি নকল। লালুপ্রসাদ ডবলের ওই একই রকম চেহারা, জামাকাপড়, দেহাতি কেশবিন্যাস। চট করে দেখলে বোঝার উপায় নেই, কে আসল লালুপ্রসাদ। শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে পরিত্রাণের এটা একটা উপায়।
দিল্লিতে প্রধান নেতাদের ডবল ব্যাপারটা জলভাত। পাকিস্তানে নাকি পাঁচটা মোশারফ আছে। ইরাকে সাতটা সাদ্দাম হোসেন। রাশিয়া-আমেরিকাতেও প্রথাটি অবিদিত নয়। বরং বলা উচিত রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষেত্রে ডবল-ট্রিপল বা ততোধিক অস্তিত্ব রচনা এই সব বড় বড় রাষ্ট্রশক্তির মস্তিষ্ক প্রসূত।
সিনেমা ডবলের আবির্ভাব অবশ্য এসবের চেয়ে অনেক সরল কারণে। বলিউডের প্রথম সারির নায়কদের অনেক সময়েই আগুনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে নায়িকাকে কোলে করে তুলে আনতে হয়, মোটর গাড়ি চাপা পড়তে হয়, পাহাড় চূড়া কিংবা বহুতল প্রাসাদের অলিন্দ থেকে লাফিয়ে পড়তে হয়। তারকাগণ নৃত্যগীতে এত ক্লান্ত ও ব্যাপৃত থাকেন যে এই সব কষ্টসাধ্য এবং বিপজ্জনক কাজ তারা করেন না।
বোম্বে সিনেমায় শুধু নয় হলিউডেও একই ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, সিনেমার ডবলেরা আসলে স্টান্টম্যান। কোনও নায়কের মতো শরীর, স্বাস্থ্য, উচ্চতা, তাদের পরনে নায়কের পোশাক। ক্যামেরা অদ্বিতীয় নায়কদের এই দ্বিতীয় সত্তাকে সামনাসামনি ধরে না। তাহলে কারসাজি ধরা পড়ে যাবে। পাশ থেকে কিংবা পিছন থেকে এদের ছবি দেখানো হয়।
০৩. প্রবললাল
ডবল পটললাল কাহিনির প্রায় অর্ধেক চলে গেল ডবল শব্দের ওপরে আলোচনা করে, এখন। পটললালকে অবশ্যই ধরতে হবে।
কিন্তু তার আগে শ্রীযুক্ত প্রবললালের কথা না বলে উপায় নেই। এর কারণ এই যে আমাদের পটললাল হল প্রবলবাবুর ডবল।
শ্রীযুক্ত প্রবললাল এক মধ্যবয়েসি শিশ্নোদর পরায়ণ দেহাতি ভদ্রলোক। বিহারের এক। জেলাশহরের উকিলের মুহুরির ছেলে। ঝরঝরে বাংলা বলেন সামান্য বিহারি টানে। বড়বাজারে গোলমরিচের ব্যবসা। সম্প্রতি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তার আগামী প্রযোজনা বিবি বাজার বইয়ের অন্যতম সহকারী পরিচালক হলেন পটললাল।
প্রযোজক প্রবলবাবুর পুরো নাম প্রবল প্রতাপ লাল। সমস্তিপুর আদালতের সরকারি উকিলের মুহুরি তার বাবা রামপ্রতাপ লালার ইচ্ছে ছিল তার বি.এ. ফেল ছেলে প্রবলকে মুহুরির কাজেই নিজের কাছে রেখে দেবেন।
কিন্তু প্রবল প্রতাপ মুহুরি বৃত্তির মতো সামান্য কাজে নিযুক্ত থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি। ইতিমধ্যে তিনি পৈতৃক নাম সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছেন। মধ্যপদ প্রতাপ বিসর্জন দিয়েছেন, লালার আকার উড়িয়ে দিয়েছেন, এখন শুধু প্রবললাল।
রামপ্রতাপের অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রবললাল একদিন সব দেহাতির স্বপ্নশহর কলকাতায় চলে এলেন সামান্য একটা কাজ নিয়ে। কলকাতায় বড়বাজারে সমস্তিপুরের ভগলু সিংয়ের একটা মশলার দোকান আছে। ভগলুবাবুর সঙ্গে প্রবললাল কলকাতায় চলে এলেন, তাঁর মশলার দোকানে সহকারীর কাজে।
ভগলু সিংয়ের এই মশলার দোকান থেকেই প্রবলবাবুর উন্নতির শুরু। এখানেই প্রবলবাবু ক্রমশ জানতে পারেন ভেজাল মহিমা। কী করে সস্তা সাদা তেল রং মিশিয়ে এবং ঝঝের জন্য সজনে গাছের শুকনো ছাল মিশিয়ে সরষের তেল হয়। কী করে লঙ্কাগুঁড়োয় লাল ইটের মিহিগুঁড়ো মেশাতে হয়।
সবচেয়ে ভাল ব্যবসা ছিল দুধে জল মেশানো। সে ব্যবসা অবশ্য ভগলু সিং তাঁর পোস্তার মশলার গদি থেকে চালাতেন না, সেটা চালাতেন জোড়াসাঁকোয় বাসাবাড়ি থেকে। পুরনো কেতার উঠোনওলা বাড়িতে চারটে গোরু বাঁধা থাকত, সেগুলো সবই কামধেনু। দৈনিক একশো লিটার, দুশো লিটার যত দুধই লাগুক অনাথ আশ্রমের চোরাচালানি মিল্ক পাউডার এবং কর্পোরেশনের জল মিশিয়ে প্রস্তুত হত। গোরু চারটে ছিল নেহাতই বিজ্ঞাপন।
কিন্তু গোরুর দুধের ভাল ব্যবসাটা উঠে গেল। কোনও উপায় ছিল না। বাজারে জলের বোতল এসে গেল, জলের বোতল এক লিটার বারো টাকা, জল অবশ্য কর্পোরেশনের কলের। এই জল মিশিয়ে দুধ বেচতে গেলে অন্তত তেরো টাকা দাম করতে হয়। কিন্তু বাজারে দুধের দাম তেরো টাকার কম। ফলে দুধে জল না মিশিয়ে জলে দুধ মেশানোই এখন লাভ। কিন্তু দুধ মেশানো জল বিক্রি করা জল মেশানো দুধ বিক্রি করার চেয়ে অনেক কঠিন। অল্প দুধ মেশানো ফ্যালফেলে, ট্যালটেলে জল বাজারে চালু করা অসম্ভব কাজ।
ভগলুবাবুর গদিতে প্রবললালের হাতে খড়ি হওয়ার শেষ পর্যায়ে এক বার ভগলুবাবু দেশে যান প্রবললালের ওপর গদির দায়িত্ব দিয়ে। দুঃখের বিষয় ভগলুবাবুর আর কলকাতা ফেরা হয়নি। সমস্তিপুরে পৌঁছানোর আগেই রেলগাড়ি থেকে ভগলু সিং অপহৃত হন। তাঁর পরিবারের লোকেরা বিরাট অঙ্কের টাকা পণ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভগলুবাবুকে আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ধানবাদের এক হোটেলের ঘরে তার ছুরিকাবিদ্ধ মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করে।
অনেকে বলেন এ সমস্ত ব্যাপারেই প্রবলবাবুর পূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভগলু সিং অপহরণের টাকা তিনিই পেয়েছিলেন। তা ছাড়া বড়বাজারের মশলা ও জলের ব্যবসা সেটাও প্রবললালের হাতে চলে আসে।
ভগলু সিংহের সমস্তিপুরের আত্মীয়েরা কলকাতায় বড়বাজারে এসে কোনও পাত্তা পাননি। একটা দেওয়ানি মামলা হয়েছিল, সেটাও কালক্রমে ভেস্তে যায়।
প্রবললালের হাতে ব্যবসা রমরমিয়ে উঠল। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। প্যাকেটে গুঁড়ো মশলার ব্যবসা করলেন, নাম দিলেন খাঁটি (KHANTI), অবশ্য খাঁটির অধিকাংশই ভেজাল।
তবে তার প্রধান কৃতিত্ব হল গোলমরিচ উৎপাদক হিসেবে। এই কলকাতা শহরে এবং শহরতলিতে যত কাটাফলের দোকানদার আছে, তারা প্রত্যেকে প্রবলবাবুর কাছ থেকে মাসে মাসে একশো টাকা করে মাসোহারা পায়। এর বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে একদিন তারা সারা সপ্তাহে যত পেঁপে কেটে বিক্রি করেছে তার বিচিগুলো দিয়ে যায়। বিবাদীবাগের ভিতরে ট্রামলাইনের পাশে বড় বড় তালপাতার মাদুরে প্রবলবাবুর লোকেরা এই সব বিচি শুকিয়ে নেয়। শুকিয়ে পাকা পেঁপের কালো বিচি অবিকল গোলমরিচের মতো দেখতে হয়।
এদিকে প্রবলবাবু গোলমরিচের গুদাম থেকে শূন্য বস্তাগুলি কিনে আনেন। পাটের বস্তার গায়ে, খাঁজে খাঁজে গোলমরিচের গুঁড়, ভাঙা গোলমরিচের অংশ লেগে থাকে। পেঁপের শুকনো বিচিগুলো এই সব বস্তায় ভরে ভাল করে ঝাঁকালে সেগুলোর গায়ে খাঁটি গোলমরিচের ঝাঁঝ-গন্ধ লেগে যায়। তখন খাঁটির প্যাকেটে অল্প কিছু আসল গোলমরিচের সঙ্গে এগুলো ভরতি করে খাঁটি গোলমরিচ বাজারে বিক্রি করা হয়।
গোলমরিচ অতি মূল্যবান মশলা। প্রবলবাবু ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। এর পরে এত কাঁচা টাকার সদ্ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে বড়বাজার সমীপবর্তী চিৎপুরে যাত্রা ব্যবসায় দৃষ্টিপাত করেন। সেখানেই তাঁর পটললালের সঙ্গে আলাপ।
এরপর নানা চোরাপথে ঘুরতে ঘুরতে দুজনেই টালিগঞ্জে সিনেমালাইনে এসে পৌঁছেছেন। দুজনে একসঙ্গে প্রায় কখনওই কাজ করেননি, সম্প্রতি বিবি বাজার চলচ্চিত্রায়নের ব্যাপারে পটলবাবুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন। তিনি প্রযোজক, পটলবাবু সহকারী পরিচালক।
০৪. ডবল পটললাল
যারা জানেন না তাদের অবগতির জন্যে লিখছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালকের কাজ চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাই পর্যন্ত সব কিছু।
সহকারী পরিচালক পটললাল তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে এই সব বহুবিধ কাজের মধ্যে পড়ে:
ক। প্রযোজক মহিন্দরের বর্তমান রক্ষিতার অতিরিক্ত অনুসন্ধিৎসু প্রাক্তন স্বামীকে গুণ্ডা দিয়ে ভয় দেখানো,
খ। পরিচালকের বেকার ভাইপোকে সিডিউন্ড কাস্ট সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে দেয়া, পরিচালক অবশ্য বর্ণহিন্দু।
গ। নায়িকার মদ্যাসক্ত স্বামীকে চোখে চোখে রাখা এবং মদ্যপানে সঙ্গদান করা। অর্থাৎ, চিত্র পরিচালনা ছাড়া আর সব কিছুই সহকারী পরিচালককে করতে হতে পারে। পটললালও তা করেছে। কিন্তু এখন পটললালকে যা করতে হচ্ছে, তা অসম্ভব, অবিশ্বাস্য।
পটললালকে ডবল হতে হচ্ছে, প্রবলের ডবল।
প্রবললাল চলচ্চিত্রের প্রযোজক হলেও তিনি কোনও অভিনেতা নন। তাঁর বিবি বাজার সিনেমায় ডিসুম-ডুসুম ফাঁইটিং সিন অবশ্যই থাকছে কিন্তু সে তো নায়ক এবং ভিলেনের মধ্যে, তিনি তো আর সেসব নিজে করতে যাচ্ছেন না।
আসলে অভিনয়ে নয় জীবনে প্রবললালের ডবল প্রয়োজন। নানা ধরনের ছোট বড় ফৌজদারি মামলায় প্রবলকে প্রায় নিয়মিত আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, জেলে বা পুলিশ হাজতেও যেতে হয়।
এই কাজটা প্রবলবাবুর মতো ব্যস্ত ব্যবসায়ীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। প্রবলবাবু পটললালের মধ্যে তার দ্বৈত সত্তা খুঁজে পেয়েছেন।
তিনি আর পটললাল দুজনেই সোয়া পাঁচফুট। গাট্টাগোট্টা, কৃষ্ণকায়। দুজনেই জর্দা পান খান, দুজনেই ঝরঝর করে ভুল ইংরেজি বলেন। সবচেয়ে বড় কথা দুজনের নাম প্রায় এক রকম, পটললাল এবং প্রবললাল। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত একদিন স্টুডিয়োতে আলাদা করে ডেকে নিয়ে, প্রবললাল পটললালকে প্রস্তাব দিলেন, পরিচালনার কাজ কিছু করতে হবে না, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করছি ফৌজদারি মামলাগুলোয় আপনি আমার ভূমিকায় অভিনয় করুন।
পটললাল অবাক হয়ে বললে, আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
প্রবললাল বুঝিয়ে দিলেন, নানা ব্যাপারে ফেঁসে গেছি মশায়। অনেক রকম সত্যিমিথ্যে ফৌজদারি মামলা মার্ডার, কিডন্যাপিং, জাল-ভেজাল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না, ভাল উকিল, টাউট লাগিয়েছি, টাকা খরচ করছি। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন।
পটললাল বলল, এসব ব্যাপারে আমার কী করার আছে?
এবার প্রবল বললেন, দেখুন আমি আর আপনি দুজনেই লাল, প্রবললাল ও পটললাল। দুজনাই মাঝারি ধরনের প্রায় একই রকম দেখতে। অনেকগুলো মামলায় আমি জামিনে রয়েছি। বারবার তারিখ পড়ে, আদালতে যাই। কাঠগড়ায় দাঁড়াই। আবার জামিন পাই। ফিরে আসি। আমার ইচ্ছে, আপনি আমি সেজে আমার এই কাজগুলো করুন।
পটল বলল, তারিখে তারিখে গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে? সে না হয় দাঁড়ালাম, কিন্তু যদি জামিন না হয়। জেলে যেতে হবে। কিংবা পুলিশ হাজতে।
প্রবলবাবু বললেন, জামিন না হলে হাকিম আছে। ভাগ্য খারাপ হলে দু-চারদিন হাজত বাস হতে পারে। তারপরে বেরিয়ে আসবেন। জেলখানা খারাপ জায়গায় নয়। আজকাল খাওয়া-দাওয়া ভাল। টিভি আছে। শোয়ার জন্যে কম্বল আছে। তারপর একটু থেমে পটলকে প্রবলবাবু বললেন, দেখুন আমি খোঁজ নিয়েছি, আপনার স্ত্রী আপনাকে বাসায় ঢুকতে দেয় না। রাতের বেলা কুকুরদের সরিয়ে এই স্টুডিয়োর বারান্দায় ঘুমোন। এর চেয়ে জেলখানা ভাল। ভাল মজুরি পাবেন। প্রতিবার কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্যে দুশো টাকা, আর জেল খাটতে হলে পাঁচশো টাকা।
নিজের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে প্রবলবাবুর প্রস্তাবে পটললাল রাজি হয়ে গেছে। জেল খাটা নিয়ে তার মনে কিঞ্চিৎ সংস্কার ছিল, সেটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সে সংকোচ দূর হয়েছে, প্রবলবাবুর আপ্তবাক্যে, আরে মামলায় জেল কি আপনি খাটবেন? খাটব আমি, কাগজপত্রে সব জায়গায় আমারই নাম থাকবে। আপনি আরামসে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেবেন। জেলে মদ-সিগারেট যা চান পেয়ে যাবেন, আমি ব্যবস্থা করব।
পটললালের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। এখনও জেল খাটতে হয়নি। তবে প্রায় নিয়মিত আলিপুর আদালতে, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কখনও-বা হাওড়ায় গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। তবে যে দাঁড়াচ্ছে সে পটললাল নয়, ডবল পটললালও নয়। সে হল, প্রবললাল, ডবল প্রবল।