ঠাকুর, থাকবি কতক্ষণ
চেয়ারে বসে দুলছিল দ্বিজদাস। সেই ভোররাত থেকে জোর খাটুনি গেছে আজ, সামনের শো কেসগুলো ভরতি, চট করে দেখলে সাজানো বাগান মনে হয়। বাইরে তাকাল ও, বিকেল হতে একটু দেরি আছে। রোদের তেজ মরেছে। দ্বিজদাসের এই দোকান সীতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে ভূটানের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। নড়েচড়ে বসল দ্বিজদাস। হাতলছাড়া চেয়ার, দ্বিজদাসের হাতল থাকলে বসতে অসুবিধে হয়। বড় চর্বি জমে যাচ্ছে শরীরে। আঙুল দিয়ে বুকের তলায় খাঁজ ধরে না। এই শালা মিষ্টির গন্ধে শরীর ফুলছে। কথাটা ভাবতেই নরেশের দিকে নজর পড়ল। ওর। খেকুড়ে চেহারা, অথচ দিনরাত মিষ্টি বানাচ্ছে ও। কার যে কী হয়? খালি গা, এই শীত আসা সময়টাও গায়ে কাপড় রাখতে পারে না। ওপরের দিকে তাকাল সে। কাঠের সিলিং-এর ওপরে। মৃদু পায়ের শব্দ ঘোরাফেরা করছে। সাজগোজ হচ্ছে বোধহয়। সীতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিকান ঠাকুর দেখতে যাবেন। দ্বিজদাস যার কাছে হাতি-শ্বেতহস্তী। মুখঝামটা দিয়ে দু-বছর আগে যে বলত, সার্কাসে নাম লেখাইনি তো যে সাদা হাতি বুকে তুলব।
সকাল থেকেই ঢাক বাজছে পুজো মণ্ডপে। বোল পালটানো দুপুর থেকে। সীতাদেবী সকন্যা গিয়েছিলেন বরণ করতে। তারপর থেকেই ঢাক বলছে, ঠাকুর থাকবি কতক্ষণঠাকুর যাবি বিসর্জন। একঘেয়ে বেজে যাচ্ছে ঢাকদুটো। এই স্বর্গ ছেঁড়ার পুরোনো ঢাকি। এখনও মাইক। ঢুকতে দেয়নি শ্যামাকাকারা। আশেপাশের জায়গাগুলোর মধ্যে স্বৰ্গ ছেঁড়ার পুজোর নামডাক বেশি। পুজোটা বনেদী।
ঠিক এই সময় দ্বিজদাস দেখতে পেল হারু ঘোষ রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসছে। সোজা হয়ে বসল ও। শালা এদিকে আবার আসে কেন? সঙ্গে-সঙ্গে শ্যামাকাকাদের মুখ মনে পড়ে গেল ওর। আজ সকালেই দল বেঁধে এসেছিল ওরা।
হারু ঘোষ এক লাফে দোকানে উঠে এল। তারপর চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দ্বিজদাসের দিকে হাত বাড়াল, দেশলাইটা দিন তো।
পা থেকে মাথা অবধি চিড়বিড় করে উঠল। ভীষণ বাড় বেড়ে গেছে তো আজকাল। কিন্তু ততক্ষণে ওর হাত চলে গেছে ড্রয়ারের মধ্যে। সিগারেট খায় না নিজে, কিন্তু পেছনের দেওয়ালে রাখা গণেশের সামনে দু-বেলা ধূপ জ্বালাতে হয়। দ্বিজদাসের হাত থেকে দেশলাইটা নিয়ে সিগারেট ধরাল হারু। তারপর সামনের টেবিলে একটা পা ভাঁজ করে বসল, আজ সকালে ওরা এসেছিল কেন?
কারা? চমকে উঠল দ্বিজদাস। শালারা খবর পায় কী করে।
শ্যামাকাকাদের গুষ্টি। আমাকে তাড়াতে বলল?
হুঁ। মাথা নাড়ল দ্বিজদাস, গেলেই তো হয়।
বাড়িটা কার? ভাড়া দিই কাকে? ওদের বলে দিতে কি হয়েছিল সেখানে গিয়ে কথা বলতে। সে হিম্মত তো কোনও শালার নেই। ফুক-ফুক করে ধোঁয়া ছাড়ল হারু, সব শালার কেচ্ছা আমি জানি। ট্যাক্সি ড্রাইভার রতনা সাক্ষী দেবে। এখন এসেছে সতীত্ব মারাতে। যাক, আপনাকে সাফ বলে দিচ্ছি, এসব ব্যাপারে নাক গলাবেন না। আজ বিকেলে ওদের ঠান্ডা করব আমরা। যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল ও। তবে এবার ভেতরদিকে। দোকানের পেছনদিকেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। একটু পরেই হাসির আওয়াজ শুনতে পেল দ্বিজদাস। সীতা না রমলা? রমলা সীতার চেয়ে আঠারো বছরের ছোট। কিন্তু এখন গলার স্বরে পার্থক্য বোঝা যায় না। পেছন থেকে দেখলে দ্বিজদাসই মাঝে-মাঝে গুলিয়ে ফেলে। ছেলেবেলায় রমলা বলত, আমি মায়ের মেয়ে। এখন বলে সীতা ঘোষের মেয়ে। না, হাসিটা তাঁরই, রমলা না, তিনিই হাসছেন।
শ্যামাকাকা বলে গেছে হারু ঘোষকে নোটিশদিতে। সামনের পয়লা থেকে ঘর খালি করে দেয় যেন। স্বৰ্গ ছেঁড়া তেরাস্তার মোড়ে এই দোকান, দোকানের ওপর কাঠের বাড়ি, পেছনে বাগান আর বাড়ি–দ্বিজদাসের বাবা ধর্মদাস ঘোষ করে গিয়েছিলেন। আর কি জানি কেন, করার আগে বুড়োর কি ভীমরতি হয়েছিল, ভালোবেসে বউমাকে সব লিখে দিয়ে গিয়েছেন। তখন অবশ্য বউ মাথায় ঘোমটা দিত, হারু ঘোষ আসেনি স্বর্গছেঁড়ায়।
এই স্বর্গছেঁড়ায় জন্মেছে দ্বিজদাস। জন্ম অবধি জায়গাটাকে ও একটু-একটু করে বাড়তে দেখেছে নিজের মতো। ধর্মদাসের আমলে সন্ধের পর তেরাস্তার মোড়ে আসত না কেউ। পাশে খুঁটিমারীর জঙ্গলে তো এখনও হাতি আসে, খাস টাইগার দেখা যেত তখন। রাস্তাই ছিল না বলতে গেলে। একটু-একটু করে সব হল। পাশের জঙ্গলে কাঠ কেটে তক্তা বানাতে মিল বসল, মিলিটারিদের ক্যান্টনমেন্ট বসছে কয়েক ক্রোশ জমি জুড়ে বিনাগুঁড়িতে। ব্যস, স্বৰ্গ ছেঁড়ায় হুড়মুড় করে লোক ঢুকতে লাগল। সেলুন, দর্জির দোকান এমনকী রেডিও সারাই। সন্ধের পর জমজমাট। আর এই তেরাস্তার মোড়ে আগে যেখানে ভবানী মাস্টারের ভাঙা ঘর ছিল সেটাই ভাড়া নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে দোকান করতে এল হারু ঘোষ। ফটোর দোকান। জলপাইগুড়ির ফটোর দোকানে কাজ শিখে এই প্রথম নিজে ব্যাবসা শুরু করেছে। শুনে তো অবাক দ্বিজদাস। স্বৰ্গ ছেঁড়ায় ফটো তুলবে কে? সব তো মদেশিয়া কুলিকামিন। জন্ম থেকে চা-বাগানে খাটে। তা সীতাবেদী তখন মাথায় ঘোমটা দিতেন জরিপাড়ের। অবশ্যই বাইরে বেরুলে। মা মেয়েতে ছবি তুলিয়ে এলেন প্রথম দিনই। সেই হল কাল। পেছনের বাগানঘরটা খালি পড়েছিল, মাসিক দশ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে এল হারু ঘোষ। সেদিনটা স্পষ্ট মনে আছে দ্বিজদাসের। শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা আর একটা এয়ারব্যাগ হাতে নিয়ে দোকানে ঢুকেছিল হারু। তারপর সেগুলো মাটিতে রেখে প্রায় পেন্নাম। করতে এসেছিল হাত বাড়িয়ে। হা-হা করছ কি? –প্রায় ছিটকে উঠেছিল দ্বিজদাস। তখনও এত চর্বি জমেনি শরীরে।
বউদির শরীরে বড় মায়া। ওই ছোট দোকানঘরে কি থাকা যায় বলুন। উনি তো অবাক। ও, আমার নাম হারু ঘোষ–ছবি তুলি। তা আপনাদের বাগানঘরটা বউদি আমায় ভাড়া দিয়েছেন। উনিই তো এই সীতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক না? কাঁচুমাচু করে বলেছিল ছোঁকরা।
বিস্ময়ে চোখ দুটো রসচেপা রসগোল্লা হয়ে গিয়েছিল দ্বিজদাসের। ভাড়া দিয়ে দিল ঘর আর তাকে জানাল না? তাও আবার এই লপেটা ফটোগ্রাফারকে? ততক্ষণে দশটা টাকা পকেট থেকে। বের করে হারু এগিয়ে ধরেছে, নিন অ্যাডভান্স।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল দ্বিজদাস, যে ভাড়া দিয়েছে তাকেই দেবেন।
ও। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সযত্নে টাকাটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল হারু। তারপর বোঁচকা দুটো দু-হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল সটান। যেন চৌদ্দপুরুষের বিছানা এটা, হাঁটাটা এত ফুটানিমারা। হাঁক শুনেছিল দ্বিজদাস, বউদি এসে গেলাম, এবার চা খাব একটু।
হারু ঘোষের বয়স পঁচিশের নিচেই। পনেরো বছর আগে দ্বিজদাস ওরকম চেহারার ছিল। ছিমছাম চেহারার দ্বিজদাস এটুখানি বউ সীতাকে নিয়ে ধর্মদাস জলপাইগুড়ি থেকে ছবি তুলিয়ে বাঁধিয়ে এনেছিল। রাত্তিরবেলায় ঘরে ঢুকে দ্বিজদাস দেখে ছবির কাঁচের ওপর সীতার কপাল জুড়ে গোল সিঁদুরের টিপ। নিচে লাল চন্দনে লেখা পতি পরমগুরু। আর তখন রাত হত সন্ধে। থেকেই। ইলেকট্রিক আসেনি তখনও স্বৰ্গ ছেঁড়ায়। সাতটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে দরজার। খিল দিত সীতা। কিছুতে হ্যারিকেন নেভাবে না। তারপর সেই বছর না ঘুরতেই রমলা হয়ে গেল। রমলা এসে সীতাকে সুন্দর করে তুলেছে দিনদিন। মেয়েছেলের অমন সুন্দর উপুড় করা কড়াই-এর মতো পিঠ দেখতে চাইলে সীতাদেবীকে দেখতে হয়। ফুড ইনসপেক্টর এসে দোকানের মালিকের নাম উচ্চারণ করেছিল–সীতাদেবী। আর তারপর থেকে কখন কেমন করে সীতা দেবী হয়ে গেছে–দ্বিজদাস এখন বউকে সীতাদেবী বলে ডাকে। ডাকাডাকি চুকে গেছে অনেক দিন। কথাবার্তা হয় কি হয় না। তেমন দরকার পড়লে রমলা আসে। তবে রোজের হিসেব–মানে এই দোকানের বিক্রিবাটার টাকা রাত্তিরে গিয়ে দিয়ে আসে ও নিজেই। রাত দশটার সময় দোকান বন্ধ করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে দ্বিজদাস। রেডিওতে খবর হয় তখন। হিসেবের কাগজ আর টাকাটা গাটারে বেঁধে টেবিলের ওপর রেখে বারান্দা পেরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় সে। কাঠের বাড়িতে দ্বিজদাসের পায়ের শব্দ শরীরের ভারে মচমচ করে। বুড়ো বাপ মরার আগে এ নিয়ম করে গিয়েছিল–যা কিছু বিক্রি হবে তা এই বউমাকে দেবে রোজ। লক্ষ্মী বাঁধা থাক লক্ষ্মীর কাছে। খরচা রাখবে নিজের কাছে লাভ বউমা জমা করবেন। সীতাদেবী। এসে নাকি সব কিছু সোনা করে দিয়েছে বুডোের এরকম ধারণা ছিল। তা একদম কী যে সব হয়।
ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ, ঠাকুর যাবি বিসর্জন–দশ আঙুলে টেবিলে বোল তুলল দ্বিজদাস। পেটে বায়ু হচ্ছে আজকাল। এক জায়গায় বসে থাকা, একদম নড়াচড়া নেই। বায়নার কাগজগুলোর ওপর চোখ বোলাল একবার। মোট দুহাজার চারশ ত্রিশ টাকার বায়না আছে। মাল নিতে আসবেন বাবুরা ঠাকুর জলে পড়লেই। আর তখন খুচরো বিক্রি অনেক সময় বায়নাকে ছাড়িয়ে যায়। নিশ্বাস ফেলার জো থাকে না তখন। অবশ্য নরেশ দশ হাতে সব ম্যানেজ করবে নিশ্চিত। তবু শিরদাঁড়া খাড়া রাখতে হবে দ্বিজদাসকে।
রোদের তেজ কমেছে। একটু-একটু হাওয়া ছাড়ছে উত্তর দিক থেকে। শিশুর দাঁতের মতো হিম মেশানো তাতে। ভূটানের পাহাড়গুলোর মাথায়-মাথায় কুয়াশা চাঙড় বাঁধছে। নতুন জামাপরা। বাচ্চাগুলো হইচই করছে মোড়ে। কিন্তু ওরা কেউ নেই এখন। ভালো করে দেখল দ্বিজদাস, হারু ঘোষের দল আজ তেমাথায় আড্ডা দিচ্ছে না। হঠাৎ একটা জিপের আওয়াজ কানে এল, দ্বিজদাস দেখল পাদানিতে একটা ঠ্যাঙ বের করে বসে বড়বাবু আসছেন। সাত মাইল দূরে। হৃদয়পুরে থানা। দ্বিজদাস তাড়াতাড়িতে চেয়ারের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা ফতুয়াটা উলটো করে পরতে পরতে সামলে নিল। শালা পেটের কাছে বোতামটা কখন ফস হয়ে গেছে। অনেকখানি সাদা চামড়া লোম নিয়ে উদোম হয়ে থাকে।
শব্দ করে জিপটা এসে থামল দোকানের সামনে। কোনওরকমে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিজদাস হাতজোড় করল, আরে কি সৌভাগ্য, বড়বাবু যে, আসুন-আসুন।
মাথা থেকে টুপি খুললেন বড়বাবু, তারপর চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বললেন, খবরটবর কেমন?
একটু চুপসে গেল দ্বিজদাস। কী খবর, কীসের খবর! দোকানের পেছনে ভিয়েনের পাশেই রেশন দোকান থেকে ব্ল্যাকে আনা এক মন চিনি পড়ে আছে যে। কী আশ্চর্য, নরেশটার যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান হয়। মাথা দোলাল ও, ভালো আপনার আশীর্বাদে–।
কী সব মাস্তান-ফাস্তান নাকি এসেছে–তারা কোথায়? পোঁদের চামড়া তুলে ঢাক বানাব বলে দেবেন সবকটাকে। কে এক হারু ঘোষ নাকি আছে–সে কী করে? বড়বাবু জিপে বসেই চোখ কোঁচকালেন। পাশেশব্দ হতেই দ্বিজদাস দেখল নরেশ একটা প্লেটে চারটে আট আনা সাইজের কমলাভোগ আর চমচ নিয়ে দাঁড়িয়ে। চুমো খেতে ইচ্ছে হল শুঁটকোটাকে, শালার বুদ্ধি রাবণের মাথার মতো মাঝে-মাঝে বেড়ে যায়। চট করে প্লেটটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বড়বাবুর সামনের ধরল সে, ফটো তোলে।
ফটো তোলে? নধর মিষ্টিগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি বিধিয়ে মিষ্টি তুললেন বড়বাবু। রস টপ-টপ করে পড়ছে। কাঠির ডগায় মিষ্টিটাকে নাচিয়ে মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে বললেন, লীলা করেন বলুন। মিষ্টির জন্যে কথাগুলো জড়িয়ে গেল। প্লেট ধরে থাকল দ্বিজদাস। বড়বাবু এক-এক করে তুলে নিচ্ছিলেন এমন সময় কাণ্ডটা ঘটে গেল হঠাৎ। কোত্থেকে একটা কাক ছোঁ মেরে শেষ মিষ্টিটা তুলে নিয়ে গেল আচমকা। তার ডানার স্পর্শে কিংবা ঘাবড়ে গিয়ে দ্বিজদাসের হাত থেকে প্লেটটা মাটিতে পড়ে উপুড় হয়ে থাকল। ভয়ে ভয়ে কাকটার দিকে তাকাল দ্বিজদাস। ওরই দোকানের সাইনবোর্ডের ওপর বসে মিষ্টি। ঠোকরাচ্ছে সেটা। আর তখনই একটা হইহই হাসির শব্দ কানে এল ওর। কে হাসে? কোন দোকান থেকে? কিছুই হয়নি এমন ভান করে রুমালে মুখ মুছতে-মুছতে বড়বাবু বললেন, গলাটা কার, চেনেন? ঘাড় নাড়ল দ্বিজদাস।
কী চেনেন তাহলে, রাবিশ! বলে ড্রাইভারকে ইশারা করলেন বড়বাবু। সঙ্গে-সঙ্গে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে জিপটা চলে গেল শ্যামাকাকাদের বাড়ির দিকে।
ঠিক বুঝতে পারছিল না দ্বিজদাস, বড়বাবু এলেন কেন? শালা কাকটাও শত্রুতা করার সময় পেল না। ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ ঠাকুর যাবি বিসর্জন। বোল তুলল সে দশ আঙুলে। চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করল ও। হবে হবে, আজ শালাদের চামড়া ছাড়াবে। আহা হো-হো। খুব আনন্দ হচ্ছে বুকের মধ্যে। চোখ খুলতেই দেখল রমলা দাঁড়িয়ে সামনে। থতমত হয়ে গেল ও। মেয়েটা দোকানে কেন? বেশ লম্বা হয়েছে তো। ঠিক মায়ের মতো চুলের গোছ। কিছু চাই মা? আদুরে গলায় বলল দ্বিজদাস।
মাথা নাড়ল রমলা, না, মা বলল দুটো টাকা বিক্রির খাতায় জমা করতে। চারটে কমলাভোগ। বলে গটগট করে ভেতরে চলে গেল। রমলার পেছনদিকে তাকাতে কেমন কান্না পেয়ে গেল দ্বিজদাসের।
টুকটাক গোলমাল চলছিল অনেক দিনই। ধর্মদাস বেঁচে থাকতেই। তখন বদমায়েশি করত অন্যভাবে। রাত্তিরে হিসেব চুকিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে ঘরে গিয়ে দেখত সীতাদেবী শুয়ে আছেন। গরমকালে এখানে বেশ গরম পড়ে। ছোট রমলা মায়ের গা ঘেঁষে শুতো। জায়গা কম বলে। পাশের খাটে দ্বিজদাস। বড় গরম সীতাদেবীর। রাত্তিরবেলা শোওয়ার সময় শুধু তলার জামা পড়ে শুতো। কুতুকুতু চোখে দেখত নিজের খাটে শুয়ে দ্বিজদাস। হ্যারিকেন জ্বলতো ঘরে। তারপর একসময় উঠে গিয়ে চুপিচুপি সীতাদেবীর পাসে বসত। শরীর তখন মোটা হতে আরম্ভ করেছে। উত্তেজনায় হাঁপ ধরত বুকে। ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকত সীতাদেবী। কোনওরকমে হাতটা ছোট জামার ওপরে রেখেছে কি না রেখেছে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল রমলা। চিমটি কেটে মেয়েকে। তুলে দিত সীতাদেবী। তারপর উঠে বসে কোলে তুলে নিত মেয়েকে, আহা কেঁদোনা, কেঁদো না–বাবা এসেছে দ্যাখো, তোমাকে আদর করবে বলে এসেছে–আহা রে–সুর করে-করে বলত তখন। গলাটা থাকত বেশ উঁচুতে–অন্য ঘরে ধর্মদাসের কানে যেতে অসুবিধে হত না। কথাগুলো। চুপচাপ ফিরে আসত দ্বিজদাস নিজের খাটে। খুব জোরজারি করলে মুখ ঝামটা দিত। সীতাদেবী, সার্কাসে নাম লেখাইনি তো যে বুকে সাদা হাতি তুলব!
ধর্মদাস মারা যেতে প্রায়ই জলপাইগুড়ি যেত সীতাদেবী রমলাকে নিয়ে। বাপের বাড়ি। তখন লোকজনের মুখে শুনত সে আজ রূপশ্রী কাল আলোছায়া-সীতাদেবী সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছে। ফিরে আসত নতুন-নতুন সাজগোজ নিয়ে। এই স্বর্গ ছেঁড়ায় সীতাদেবীর মতো স্টাইলিস্ট মেয়ে। একটাও নেই। বড়বাবু একবার পুজোর সময় দেখে দ্বিজদাসকে বলেছিলেন, আপনার ওয়াইফ তো বেশ মডার্ন। আর তখন থেকে খোঁজ নিতে শুরু করেছিল ও আসল ব্যাপারটা কী? নিশ্চয় কেউ আছে পেছনে, সীতাদেবী যাকে নিয়ে মজেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কারও হদিস পায়নি ও। চরিত্রের এই দিকটা পুজোর বাসনের মতো পরিষ্কার সীতাদেবীর। তখন একদিন, ধরে বলেছিল ও, কেন এমন করছ–আমি কী করেছি তোমার? মুখঝামটা দিয়েছিল সীতাদেবী, আঃ, প্লে করো না তো! আমার কাছে একদম ভিড়বে না বলে দিচ্ছি। ক্ষ্যামতা না থাকলে পুরুষমানুষ ভেড়ার যুগ্যি–মাথায় কি শিঙাড়ার পুর পোরা যে বোঝো না! আর তখন মনে-মনে ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফেলেছিল দ্বিজদাস। শরীরটা যত মেদে ভরে যাচ্ছে ততই সব কিছুতেই হাঁপ ধরে যায়। সীতাদেবীর কথাটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে–চর্বি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ধুতির তলায়। আন্ডারওয়ার পড়ার দরকার হয় না আজকাল। অবশ্য দোকানে ওর সাইজ কিনতেও পাওয়া যায় না ছাই।
শেষপর্যন্ত ওই হারু ঘোষ এল। যেন এর আসার জন্যে সীতাদেবী এত বছর ধরে এত সব কাণ্ড করেছে। এর আসার জন্যেই ছিপছিপে দ্বিজদাসের এখন হাঁটতে কষ্ট হয়। সব কানে আসে ওর–তেমাথায় দোকান, কান খাড়া রাখলেই সব সেঁদোয়। প্রথম-প্রথম ছোঁকরাগুলো বলত রমলা নাকি হারু ঘোষের লভে পড়েছে। হারুকে ঘরজামাই করবে সীতাদেবী। তারপর শোনা গেল সীতাদেবী স্বয়ং নাকি জলপাইগুড়িতে গিয়ে হারু ঘোষের সঙ্গে একা সিনেমা দেখেছেন। রমলা ছিল না সঙ্গে। দুপুরে রমলা যখন ইস্কুলে যায়, দোকান বন্ধ করে খেতে আসে হারু ঘোষ। খেয়ে সীতাদেবীর বিছানায় গড়ায়। আর এইসব কথা যত ছড়াতে লাগল ভেতরে-ভেতরে তত খুশি হল দ্বিজদাস। এইবার লোকে থুথু দেবে সীতাদেবীর মুখে। আঙুল তুলে দেখাবে, পুজোমণ্ডপের কাজ করতে দেবে না বাড়িতে নিমন্ত্রণ করবে না কেউ। এককালে স্বৰ্গ ছেঁড়ায় এসব নিয়ম ছিল। আর তখন এই দ্বিজদাসের পা ধরে কাঁদতে হবে সীতাদেবীকে–সে দৃশ্য বুকের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছিল দ্বিজদাস। কিন্তু এই চেনা স্বৰ্গ ছেঁড়াটা কখন যে এমন পালটে গেছে এটা জানা ছিল না। ওর। বাইরে থেকে হু-হুঁ করে আসা লোকজন এই কথাগুলো কদিন আচার খাওয়ার মতো লোগ। করল। বেমালুম চাপা পড়ে গেল সব। কেউ আর এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সীতাদেবী সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে–হাসে সবাই। এখন কালেভদ্রে হারুর সঙ্গে দেখা হয়। অথচ দুজনেই একই। বাড়িতে আছে।
কদিন আগে যখন ফটোর দোকানে কেচ্ছাটা হয়ে গেল তখন দ্বিজদাস ভেবেছিল এবার। সীতাদেবীর ছানি কাটবে। বানারহাটের দুটো মেয়ে নাকি এসেছিল ছবি তুলতে। দোকানে বসে দ্বিজদাস তাদের দেখেনি। ছবি তোলার সময় হারু ঘোষ ওদের গায়ে হাত দিয়েছে সেই নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। কিন্তু সবার চেয়ে হারু ঘোষের গলা ছিল ওপরে। মেয়ে দুটো যত চেঁচায় হারু তার চেয়েও বেশি। শেষপর্যন্ত পাঁচজন গিয়ে থামিয়ে দিল। এই পাঁচ জন আবার হারুদেরই সাকরেদ। রাত্রে বাড়ি এলে সীতাদেবী হারুকে বলেছিল, মেয়ে দুটোর চেহারা দেখেই বোঝা যায় কি চিজ–একটু ভালো রকম শিক্ষা হওয়া দরকার ছিল।
কুয়োর জলে মুখ ধুতে ধুতে নিজের কানে শুনেছে দ্বিজদাস। শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছে। ইদানিংযত উঠতি মেয়ের দল ভিড় জমায় ফটোর দোকানে। শাড়ি পরব-পরব–কি ছবি তোলা। চাই। তাজমহল আঁকা পরদার সামনে বসিয়ে হারু নাকি ছবি তোলে। চিবুকে হাত দিয়ে মুখ ঠিক করে দেয়। এই শ্যামাকাকার ছেলে নতুন বিয়ে করে বউকে নিয়ে ছবি তুলতে গিয়েছিল ওখানে, তখন নাকি দুবার শাটার টিপেছিল হারু। শ্যামাকাকার সন্দেহ দুবার ছবি তুলেছে ও, প্রথমবার দুজনের, দ্বিতীয়বার ছেলেকে বাদ দিয়ে শুধু বউয়ের বুঝতে দেয়নি ছেলেকে।
দোকানে ভিড় বাড়ছে। মিষ্টি বিক্রি শুরু হয়ে গেল। ড্যাং ড্যা ড্যা ড্যাং ড্যাং বানারহাটের ঠাকুর লরিতে চেপে এসে গেল। রাস্তায় নেমে পড়েছে লোকজন। ভাসানের ঘাটে চলেছে সবাই। বিরাট মেলা বসে ঘাটে। ভেঁপু বাজিয়ে তেচাকার সাইকেল রিকশাগুলো ছুটোছুটি করছে এখন। স্বৰ্গ ছেঁড়ার ঠাকুর এখনও মণ্ডপে-ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ–ঠাকুর যাবি বিসর্জন। মাথার ওপরে কোনও শব্দ নেই কেন? সাজগোজ হয়ে গেলে তো এবার বেরিয়ে পড়ার কথা। কাঠের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে একবার বিক্রির পয়সা গুনতে লাগল দ্বিজদাস। হাত চালাও হেনরেশ, বিসর্জন হল বলে! চেঁচিয়ে বলল ও, যেন ওপরের ঘরে তেনার কানে যায়। শ্যামাকাকারা আজ তৈরি।
এই স্বৰ্গ ছেঁড়া নিজেদের হাতে করে গড়েছেন শ্যামাকাকারা। সেখানে এইসব ভুইফোঁড় ছোঁকরারা যা ইচ্ছে করবে তা হতে দেওয়া যায় না। সকালে শ্যামাকাকা বলেছিলেন রেঞ্জারসাহেবের মেয়ে আর পোস্ট আফিসের একটা ছোঁকরাকে নিয়ে হারু গিয়েছিল খুঁটিমারীর জঙ্গলে ছবি তুলতে। কয়েকটা মদেশিয়া নাকি দেখেছে। বিশ্রী-বিশ্রী ছবি সব সিনেমার মতো। আজ রাতে হারুর দোকান তল্লাসি হবে।
এইটে শোনার পর কেমন ভালো লাগছিল না দ্বিজদাসের। সে জানে ছোঁকরার ডার্করুমে তার কী ছবি আছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ না বেরোয়। রেঞ্জারসাহেব এসেছিলেন শ্যামাকাকার সঙ্গে। পোস্ট অফিসের ছোঁকরাকেও আজ ছাড়া হবে না। গত বছর ভাসানের দিন ওরা মদ খেয়ে মেলায় কার গায়ে হাত দিয়েছিল। এবার সেই রকম একটা কিছু করলেই হয়। হবে, কারণ কাল। হারু এক বেলা সামচি গিয়েছিল এয়ারব্যাগ নিয়ে। সামচিতে মদের কারখানায় সস্তায় সব পাওয়া যায়–এ খবর পেয়ে গেছেন শ্যামাকাকারা।
নড়েচড়ে বসল দ্বিজদাস। ঢাক বাজছে জোরে। স্বৰ্গ ছেঁড়ার ঠাকুর মণ্ডপ ছেড়ে বের হল। ডাকের সাজ–মা-মা আবার এসো। মনে-মনে বলল দ্বিজদাস। তেমাথায় এসে গেল ঠাকুর। মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হয়। সবার সামনে শ্যামকাকারা হেঁটে যাচ্ছেন। ঠাকুর যাবি বিসর্জন–মা দুর্গা যেন ছলছল চোখ করে দ্বিজদাসকে দেখে গেলেন। পেছন-পেছন ঢাকি চলে যেতেই তেমাথা চুপচাপ হয়ে গেল। রাজ্যের লোক গিয়েছে ভাসানের ঘাটে। এখনও ঠাকুর আসছে আশেপাশের বাগানগুলো থেকে।
এই সময় দ্বিজদাস উঠে দাঁড়াল। ওপরে সাড়া শব্দ নেই কেন? যাবে না নাকি? এরকম তো হয় না। বুকের ভেতর ছটফট করছে দ্বিজদাসের। একবার গিয়ে দেখে এলে হয়। আহা, ভাসানের ঘাটে যদি ও থাকতে পারত! কিন্তু এখন এই দোকান ছেড়ে যাবে কি করে?
সময় চলে যাচ্ছে। ভূটানের পাহাড়গুলো আকাশের নীলে মিশে গেছে এখন। সন্ধের অন্ধকার। আসতে না আসতেই জলঢাকা থেকে আসা বিদ্যুৎ রাস্তার আলোগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। এমন সময় সেই পার্থিব শব্দ কানে এল দ্বিজদাসের। ভাসানের ঘাটে হইহই শব্দ। কী হল? উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে ওর। দোকানের দরজায় এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল অনেকে ছুটে আসছে। কী হয়েছে হে? চিৎকার করল দ্বিজদাস। মারামারি–জোর মারামারি বেঁধে গেছে। বড়বাবুর জিপটা এতক্ষণ কোথায় ছিল, সাঁ করে মোড় ঘুরে ঘাটের দিকে চলে গেল। ছেলে বুড়ো বাচ্চা মেয়ে সব পালিয়ে আসছে ঘাট থেকে। ফণী পিওনকে দেখে কাছে ডাকল দ্বিজদাস, কী ব্যাপার হে?
শ্যামাবাবুর মাথা ফেটেছে। ওদের তিনজন শুয়েছে। একটা লাঠি আছে আপনার কাছে, লাঠি? উত্তেজনায় কাঁপছিল ফণী পিওন।
আর তারপরেই দেখতে পেল দ্বিজদাস। বিরাট একটা ভিড় এগিয়ে আসছে তেমাথার দিকে। ভিড়টার মধ্যিখানে বড়বাবুর জিপ। সেই সঙ্গে চিৎকার চলছে সমানে। ভিড়ের মুখগুলো দেখল ও–আঃ, সব চেনামুখ। হারু ঘোষ অ্যান্ড পার্টির কেউ নেই এর মধ্যে। ওই তো রেঞ্জারসাহেব, দাশু রায়, স্কুলের মাস্টারমশাইরা। জিপটা ঠিক তেমাথায় এসে দাঁড়াতেই শ্যামাকাকা নেমে দাঁড়ালেন। দ্বিজদাস দেখল কপালে ছেঁড়া কাপড় ব্যান্ডেজ করে বাঁধা। তার একটা পাশ লাল হয়ে আছে। শ্যামাকাকা পাশের একজনকে কী বলতে সে ছুটে গেল রিকশা স্ট্যান্ডে। সমস্ত তেমাথায় গিজগিজ করছে লোক। এমনকী ওর এই মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতেও লোক দাঁড়িয়ে। বৃত্তের মতো ঘিরে দাঁড়িয়ে সবাই জিপটাকে লক্ষ করছে। একটা রিকশাকে টানতে-টানতে হাজির করা হল জিপটার পাশে। সবাই চুপচাপ দেখছে। আশেপাশের চা-বাগানের যারা ভাসানে এসেছিল তারাও আছে ভিড়ের মধ্যে।
হঠাৎ শ্যামাকাকা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিপে বসা বড়বাবুর দিকে জোড়হাত করলেন, হুজুর, সমবেত স্বৰ্গ ছেঁড়ার মানুষজনের পক্ষ থেকে আপনার কাছে আবেদন করছি, হারামজাদাটাকে একবার রিকশার ওপরে দাঁড়াতে দিন। সবাই একটু দেখুক। বড়বাবু কী বলতে শ্যামাকাকা নিচু গলায় উত্তর দিলেন। তারপর হঠাৎ দেখা গেল হারু ঘোষ জিপের পেছন থেকে নেমে আসছে। উত্তেজনায় টান-টান হয়ে দ্বিজদাস দেখল হারু ঘোষের জামাকাপড় ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। গেঞ্জি ছিঁড়ে পেট দেখা যাচ্ছে। মাথার চুল উসকোখুসকো। একটা চোখ ফুলে ঢেকে গেছে। কিন্তু শালা হাঁটছে দ্যাখো–যেন শাজাহান। কারও দিকে না তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে এসে রিকশায় উঠে দাঁড়াল হারু ঘোষ। আর কী আশ্চর্য, রিকশায় উঠেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল একমুখ।
আর সঙ্গে-সঙ্গে সমবেত জনতা হইহই করে উঠল। অথচ কিছুই হয়নি এমন ভাব করে সিগারেট টানতে লাগল হারু। হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসছে অন্য বাগানের লোক। দাশু রায় আর পারলেন না, ছুটে গিয়ে চড় মারলেন হারুর গালে। রিকশায় দাঁড়িয়েছিল বলে মাথাটা সরিয়ে নিল ও সময়মতো। চড়টা কাজে লাগল না বলে আর একজন এগিয়ে এল। কে যেন চিৎকার করল বেচন হাজামকে ডেকে ওর মাথা কামিয়ে দিন। ওদিকে হারুর ওপর অনেকগুলো হাত নামা-ওঠা করছে। ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ–ঢাকের বোলের তালে-তালে শরীর দুলিয়ে দ্বিজদাস কী মনে হতেই হাত বাড়িয়ে নরেশকে ডাকল। নরেশ আসতেই দ্বিজদাস উত্তেজনায় দুলতে-দুলতে ফিসফিস করে বলল, ছুটে যা, গিয়ে শালাকে এক থাপ্পড় মারবি বাঁ-চোখে। ওটা ফোলেনি।
ফ্যালফ্যাল করে তাকাল নরেশ। তারপর কাঠের দোতলার দিকে দেখল। যা, আমি তোর মনিব আমি বলছি। বুকে হঠাৎ সাহস এসে গেল দ্বিজদাসের। দাবড়ানি দিয়ে ঠেলে পাঠাল নরেশকে।
শুঁটকো শরীর নিয়ে ভিড় ঠেলে ছুটে গেল নরেশরিকশার দিকে। মার-মার–মনে-মনে চেঁচাচ্ছিল দ্বিজদাস। হাতের নাগাল পাচ্ছে না নরেশ। শালা যা বেঁটে। দু-হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে হারু। সমানে কিলচড় পড়ছে, কিন্তু ভেঙে পড়ছেনা। লাফিয়ে-লাফিয়ে বুড়ো নরেশ হাত চালাল, কিন্তু নাগাল পেল না। সারা শরীর দুলিয়ে হা-হা করে উঠল দ্বিজদাস। যেন ও নিজেই। মারতে পারছে না।
কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে চলে এ নরেশ, হাত পাচ্ছি না, দাদাবাবু যে বড় লম্বা।
দাদাবাবু! সারা শরীর জ্বলে গেল দ্বিজদাসের। বাঁ-পায়ের ছেঁড়া চটিটাকে ছুঁড়ে দিল ও। নে শালাকে জুতোপেটা কর, আমার জুতো দিয়ে, আমি দেখব। না পারলে তোর একদিন কি। আমার! বেচন হাজামকে কে যেন ধরে আনছে। চোঁ-চোঁ করে ছুটে গেল নরেশ। রিকশার কাছে ভিড়ের ফাঁক গলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে দ্বিজদাসের–আহা! হাত তুলল জুতো নিয়ে নরেশ, এই পড়ল হারুর গালে, ওকি, ধরে ফেলেছে যে শালা! জুততাসুদ্ধ হাত ধরে ফেলেছে! ততক্ষণে ওকে রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে বেচন হাজামের সামনে বসিয়ে দেওয়া হল।
খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটে এল নরেশ, ধরে ফেলল, ধরে ফেলল যে হাতটা। আমি কী করব। কাঁদো কাঁদো হল নরেশ।
আমার জুতো, জুতো কোথায় ফেললি হারামজাদা, নিয়ে আয়, আমার জুতো নিয়ে আয়–যা। চিৎকার করে উঠল দ্বিজদাস।
আর সঙ্গে-সঙ্গে শব্দ করে ওপরের জানলা খুলে গেল। নরেশের ঘাড় ধরেছিল দ্বিজদাস, থমকে গেল। জানলা খোলার শব্দ হতেই আচমকা চুপ মেরে গেল তেমাথা। সবাই মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে ওপরে। দ্বিজদাসের সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল হঠাৎ। আর তারপরেই গলাটা কানে এল, নরেশবাবুকে বলো ছেঁড়া জুতো আর আনতে হবে না। তুমি ভেতরে এসো। শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল জানলাটা। সঙ্গে-সঙ্গে সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল নরেশ। গিয়ে শো কেসের পেছনে বসে হাঁপাতে লাগল।
অসহায়ের মতো দ্বিজদাস দাঁড়িয়ে রইল খানিক, তারপর পা টেনে-টেনে ভেতরে এল। সারা শরীরে কুলকুল করে ঘাম দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর। তেমাথার জনতা এখন হারু ঘোষকে নিয়ে ব্যস্ত। দ্বিজদাস চোখ তুলে দেখল পেছনের দরজার সিঁড়ি বেয়ে একজোড়া পা, হাঁটু, কোমর বুক শেষে মুখ নেমে এল। সীতাদেবীর মাথায় জড়ির পাড়। মুখ নিচু করতে-করতে দ্বিজদাস শুনতে পেল, এই বয়েসে এত উত্তেজনা তোমার মানায়–ছিঃ!
ভাসানের ঘাটে দুর্গাঠাকুর এতক্ষণে জলে নামলেন।