ট্রেকার্স (Trekkers) : 05
১০ মার্চ খবর বেরোল আবার। একটি তরুণকে অযোধ্যা পাহাড়ের উপর একটা ঝোরার ধারে, ঝোপে মৃত পাওয়া গিয়েছে। ডান হাতের ড্র্যাগন উল্কি দেখে শনাক্ত করা সহজ হয়েছে। মাথাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। জামাকাপড় কাদামাখা, ছেঁড়াখোঁড়া। মতিলাল নেহরু রোডের মিত্র পরিবারে স্তব্ধতা নেমেছে। বাবা-মা উভয়েই ডাক্তার। ছেলেও ডাক্তার হচ্ছিল। আত্মীয়স্বজনরা সাধারণত ওঁদের পান না। ডাক্তার মিসেস প্রীতি মিত্র ব্যস্ত গাইনি। তাঁর স্বামী ডাক্তার অভ্র মিত্র অর্থোপেডিক ডাক্তার, বিরাট পসার। অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে ওঁদের পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আরিয়ানের মামা-মামিরা চারজন এসেছেন ফোন করে। ডাক্তার মিত্র পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন। চুল উসকোখুসকো, নাইট ড্রেস ছাড়েননি। প্রীতি বিছানায় শোওয়া, একদম চুপ। বড়মামা, প্রীতিরও বড়। বললেন, “তোমরা কি একেবারে শিয়োর যে… আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও।”
প্রীতি বললেন, “ডান হাতের ওই ড্র্যাগন উল্কি আর কার হবে দাদা? ছেলেটা আমাদের একেবারে বসিয়ে দিয়ে গেল।”
হঠাৎ ডাক্তার মিত্র পায়চারি থামিয়ে বলে উঠলেন, “তা কেন? আমাদের জীবন তো ওকে একেবারে বাদ দিয়েই চলছিল প্রীতি, তাই চলবে। অসুবিধে কী?”
তিনি প্রীতির প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রীতি স্বামীর দিকে তাকালেন না। দাদাকে বললেন, “ওর চার বছর বয়স পর্যন্ত প্র্যাকটিস করিনি দাদা। তারপরে ও স্কুলে গেল, দুপুরে ক্রেশ-এ যেতে ও খুব ভালবাসত। আমিও শুরু করলাম। এত কষ্ট করে শেখা বিদ্যা কেউ প্রয়োগ না করে ফেলে রাখতে পারে, না রাখা উচিত?”
“ইন দ্যাট কেস এইসব মেনে নিতে হবে। অকুপেশান্যাল হ্যাজার্ড। মায়ের আনঅ্যাটেন্ডেড মৃত্যু। ছেলের হত্যা।”
ডাক্তার অভ্র মিত্রর মা ছোট ভাইদের কাছে থাকতেন। সেখানে পুরোপুরি একটি পরিবার ছিল। পুত্রবধূ মেয়েকে আনতে স্কুলে গিয়েছে। এসে দেখে, মা চলে গিয়েছেন। ডাক্তার বললেন, “হার্ট ফেলিওর।”
সেটা যে কেন প্রীতির উপর চাপালেন অভ্র ঈশ্বর জানেন। কিন্তু প্রীতি জানেন, উনি ওই রকমই। ভাল ছাত্রী ছিলেন, বিদ্যাটার উপর একটা ভালবাসা ছিল, দায়বদ্ধতা ছিল। তিনি যে প্র্যাকটিস করবেন, এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে প্রীতি মনেই করেননি। অভ্র তাঁর সহপাঠী। নিজে ডাক্তার। অথচ কী করে যে এত বড় কথাটা ভাবতে পারল! এ তো বিদ্যাটার প্রতি, রোগীদের অর্থাৎ সমাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। ট্যাক্সের টাকায় মেডিক্যাল কলেজ তার পরিকাঠামো, শিক্ষা, ল্যাবরেটরি, আউটডোর, এমার্জেন্সি! জনসাধারণের এত পয়সা, এত আশা খরচ করে বাড়ি বসে থাকাটা পাপ না ? অভ্র কি সেটা জানে না? খুব জানে। কিন্তু তার স্বভাবই হল, কোনও অঘটন ঘটলেই জিনিসটার জন্য প্রীতির উপর দোষারোপ করা। প্রীতির দাদা-বউদি, ভাই-ভাজ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। দাদা বললেন, “এ সময়ে আর…”
অভ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি এখন বাথরুমে যাবেন, দরজা বন্ধ করবেন, তারপর চুল ছিঁড়বেন নিজের। আর কী করতে পারেন? মেডিক্যালে ঢুকেছে, সেকেন্ড ইয়ার, বছর বিশেক বয়স। ছোট থেকেই যথেষ্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সমর্থ ছেলে। সে যদি বলে, বন্ধুদের সঙ্গে ক’দিন এক্সকারশনে যাবে জাস্ট তিনটে দিন, আপত্তি করার কী আছে? ছেলেটা খারাপ এমন কোনও নিদর্শন তো তাঁরা পাননি। জামাকাপড়, ফ্যাশন এসব দিকে একটু বেশি নজর ছিল। তাঁদের ওই বয়সে ছেলেরা এগুলোকে হাস্যকর মনে করত। কলেজের ছেলে রোলেক্স ঘড়ি পরছে, গলায় হার, কানে মাকড়ি, এসব তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। অবশ্য তাঁর বাবা ছিলেন অধ্যাপক, মা গৃহবধূ। তাঁদের ছেলের বাবা-মা উভয়ের মিলিত আয় মাস গেলে কী অঙ্ক ধারণ করে, তা তাঁরা ছাড়া আর কেউ জানেন না। তাঁদের ছিল বড়জোর নিউ মার্কেট আর এদের মাল্টিপ্লেক্স, আইনক্স, শপিং মল, এসক্যালেটর। তফাত তো একটা হবেই। আত্মীয় স্বজনদের বাঁকা কথা, চোরা চাউনি তিনি এখনই শুনতে পাচ্ছেন, দেখতে পাচ্ছেন। শুধু এক্সপার্ট হলেই কি হয়, টাকা রোজগার করলেই কি হয়? বাবা হতে হয়, যথার্থ বাবা। কাজের ঘোরে মানুষ যদি একমাত্র সন্তানের দেখভাল করতে না পারে, তা হলে সে কাজের, সে উপার্জনের মানে কী? বেসিনের দু’দিকে দুটো হাত দিয়ে আয়নার দিকে চেয়ে রইলেন অভ্র। চুলে সাদা বেড়ে গিয়েছে প্রচুর, গাল খানিক ঝুলে পড়েছে, চোখদুটো কেমন রাগী-রাগী। ছেলেটা কি তাঁকে ভয় পেত?
প্রীতির বউদি বললেন, “কোথায় যাবে বলেছিল?”
ফ্যাঁসফেঁসে গলায় প্রীতি বললেন, “দিঘার কথা তো বলেছিল। যাবে চার বন্ধু, ওর বন্ধুদের সবাইকে তো চিনি না।”
“মানে সবাই কি ছেলে?”
“হ্যাঁ বউদি, সবাই-ই ছেলে। এখন দেখা যাচ্ছে, সবটাই মিথ্যে কথা বলেছিল।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, দিঘা বলে পুরুলিয়া যাবার মানে কী? পুরুলিয়া বললে কি আমরা বাধা দিতাম? জিনিসটা অ্যাক্সিডেন্ট না মার্ডার…” বলতে-বলতে তিনি কেঁপে উঠলেন।
ছোট ভাই বলল, “না দিদি। আমার মনে হয়, জিনিসটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। হয়তো কোনও অ্যাডভেঞ্চার, আর তাই-ই আসল কথাটা বলেনি। ও তো খেলাধুলো করত খুব।”
“হ্যাঁ, ও তো অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ওয়াটার স্কিয়িং, সার্ফিং, সবই করেছে রে। অ্যাথলিট ছেলে, সে যদি কোনও অ্যাডভেঞ্চারেই যেতে চায়, আমরা বাধা দেব এ কথা সে ভাবল কেন?”
“তোরা কি খুব আতুপুতু করতিস? খুব আদর দিতিস?”
প্রীতি বললেন, “আতুপুতু করবার আমাদের সময় কই? আদর, শাসন এসব অতিরিক্ত মাত্রায় করতে হলেও সময় চাই। শনিবারটা আমি অফ নিতাম। রাতে আমার সঙ্গে খেত, রোববারে বাবার অফ বাবার সঙ্গে খেত। এ ছাড়া যে যখন চেম্বার ছেড়ে বা অপারেশন থাকলে সেসব শেষ করে আসতে পারত। ও ঠিকঠাকই মানুষ হচ্ছিল বলে আমাদের ধারণা। দাদা, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এখন কী করব! আমি আইডেন্টিফাই করতে যেতে পারব না বলে দিয়েছি। অভ্র খুব সম্ভব একটু পরেই যাবে। পুলিশের গাড়ি আসবে। তোমরা চাইলে কেউ সঙ্গে যেতে পারো।”
প্রীতির ছোট ভাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এরা ধনী এবং ব্যস্ত লোক। কখনও কারও সাহায্য চায় না। করেও না সেভাবে। তবে ডাক্তার বলে কিছু না কিছু পরামর্শ, চিকিৎসা, চেনাশোনার সুবিধে পাওয়া যায়ই। এটা মস্ত সাহায্য। কেননা আজকালকার দিনে কোনও ডাক্তার, আত্মীয়-বন্ধুর মধ্যে না থাকলে বাঁচার আশা কম। অনেকেই ধনেপ্রাণে মারা যান।
বিকেলবেলা হন্টনে গিয়ে চারদিকে এই আলোচনাই শুনলেন ধ্রুবজ্যোতি। ইয়ং জেনারেশন কী হল, কী হয়ে দাঁড়াচ্ছে? বাড়িতে না বলে অজ্ঞাত স্থানে পাঁচটি ছেলেমেয়ে চলে যায় কীসের টানে? বাড়ির প্রতি, বাবা-মা’র প্রতি কি কোনও দায়িত্ব থাকতে নেই? নিজেদের তৈরি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং অলীক একটা জগতে বাস করে এরা। ইতিমধ্যেই খবরে নাকি বলেছে, ছেলেটি খুন হয়েছে কিনা পরিষ্কার বলা যাচ্ছে না। কেননা, সে ঝোরার খরস্রোতে বোল্ডারে-বোল্ডারে ঠোকাঠুকি খেতে-খেতে ভেসে এসেছে, এটা খুব স্পষ্ট। থ্যাঁতলানো, ডিকম্পোজড্ লাশ একটা। জামা-কাপড় নেই। কিন্তু কাদা, শ্যাওলামাখা শর্টস আটকে আছে। খালি আধখানা ড্র্যাগন-উল্কি ছাড়া শনাক্তকরণের আর কোনও উপায় নেই। ধ্রুব শুধু মন দিয়ে হেঁটে গেলেন, কারও সঙ্গে কোনও আলোচনায় গেলেন না। মনটা ভাল লাগছে না। একেবারেই ভাল লাগছে না।
বাড়ি থেকে পালানোর রোগ চিরকাল আছে। আগেকার দিনে বাড়িতে অমানুষিক প্রহার খেয়ে ছেলেরা পালিয়ে যেত, পড়াশোনার চাপ ভাল লাগত না বলে পালিয়ে যেত। অ্যাডভেঞ্চারের, অ-চিরাচরিতের নেশা ছিল, ছিল দেশে দেশে ভ্রমণ করা। তারপর সিনেমায় নামবার জন্য পালাবার ঝোঁক হল। অ্যাডাল্ট মানুষ, বিবাহিত ছেলে-মেয়ের বাবা, অনেক সময়ে বিবাগী হয়ে যেত। অমুক সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছে, এরকম তো যখন-তখন শোনা যেত। আর প্রেমে পড়ে পালানোও বরাবরই ছিল। সেই পথ ধরে বেচাকেনা যা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা-ও ছিল।
কিন্তু এরা কেরিয়ার বোঝে, বিলাস-ঐশ্বর্য-ভোগ এই সমস্ত নিয়ে মাথা ঘামায়। স্মার্টও খুব। তা হলে, এরা কোথায় গেল? কেন গেল? কার পাল্লায় পড়ল? ঐশ্বর্য, স্বার্থপরতা, স্মার্টনেস এসবও এদের বাঁচাতে পারল না?
বাড়িতে এসে আরও একটা ধাক্কা খেলেন ধ্রুবজ্যোতি। সংযুক্তা মুখ ভারী করে বসে রয়েছে।
চা-টা খাওয়া হল। মিলুই এনে দিয়ে গেল। সেই একই বারান্দা, সেখানে একই টেবিল, এলানো বেতের চেয়ারে একই কলমকারির কুশন। তবু সব কিছুর উপর একটা ভারী কুয়াশা ঝুলে রয়েছে। মিলুর মধ্যে যেন একটা অস্বস্তি, সংযুক্তা কেমন নির্বাক এবং বিমুখ। কোনও কথাই হল না পুরো চা-পর্ব জুড়ে। কথা বলার সময় এটা নয়, তিনি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে গেলেন। অন্ধকার যখন রীতিমতো ভারী হয়ে নেমে আসছে, গোল আলোটা জ্বেলে দিলেন ধ্রুব। সংযুক্তা বললেন, “বিলু আর ফিরবে না। বিয়ে করছে।”
“মানে?”
“মানে যা শুনলে তাই।”
“হচ্ছে, না করছে? জোর করে ওর বাড়ির লোকে দিয়ে দিচ্ছে? সেক্ষেত্রে আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হবে।”
“বাড়ির লোক বলতে ওর কে আছে, কী যে বলো!”
“টাকা-পয়সা নিয়ে একখানা মেয়েকে ঝেড়ে দিতে তো এই জাতীয় মাসি-পিসিই লাগে।”
“না, উনি নিজেই করেছেন।”
“ডিটেলস?”
“ওদের ওখানে মনোহারী দোকান আছে। খুব নাকি বিক্রি। বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। কিন্তু একেবারেই ছোকরা দেখতে।”
“ও-ই লিখেছে নাকি এগুলো, ছোকরা-টোকরা?”
“না, ওটা আমার টিপ্পনী। ও লিখেছে, অত বড় বলে মনে হয় না।”
“ওর কত হল?”
“আঠারো হয়ে গিয়েছে।”
“তবে আর কী!” ধ্রুবজ্যোতি হাত উলটালেন। সংযুক্তা উঠে গেলেন একেবারে নিঃশব্দে। ওঁর বেশি লেগেছে। মেয়েদের আবেগ-আসক্তি বেশি তো! তিনি যেটা করেন একটা প্রজেক্টের মতো করে করেন হয়তো। তিনটি মেয়ে আপাতত। তিনটি প্রজেক্ট। শীলু বিপিও, একেবারে স্বনির্ভর হয়ে গিয়েছে। বিলুটার অঙ্কে খুব মাথা। দেখা যাক, যদি অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে কিছু করতে পারে। মিলুর গল্প-কবিতায় খুব ঝোঁক, রাশি রাশি পড়ে। লাইব্রেরিতে ভর্তি করে দিয়েছেন, খুব পড়ে। দেখা যাক, ও কোনদিকে যায়। তিনি এভাবে ভাবেন। সংযুক্তা ভাবেন, মিলুটা ছটফটে, খুব চঞ্চল স্বভাবের, বিলুটা বরং ধীর স্থির, ভেবে চিন্তে কাজ করে। তবে ওদের কারওই শীলুর মতো প্র্যাকটিক্যাল সেন্স নেই, ওরকম সটান, স্মার্টও ওরা নয়। ওদের গাইড্যান্স লাগবে আরও বেশি। নিজের ছেলেমেয়ে নেই বলে সন্তানম্নেহ তো খানিকটা পড়বেই!
তাঁর খুব হতাশ লাগে। এদের কারও-ই মা-বাপ নেই, গলগ্রহ ছিল সংসারে। তাঁরা নিয়ে এসে যত্ন করে বড় করছেন, লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, ভাল-মন্দ চিনতে শেখাচ্ছেন। কিন্তু বয়োধর্ম যাবে কোথায়? আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ! কারুর বিদ্রোহ জাগে, হাতে রিভলভার দেশের শত্রুর দিকে তাক করার জন্যে হাত নিশপিশ করে। কারও শরীর জাগে, সিঁদুর, বাসর, ফুলশয্যা, সারা জীবনের অধীনতা, শুধু এইটুকু পাওয়ার জন্যে। তারপর একের পর এক সন্তান আসতে থাকবে। শরীর ভাঙতে থাকবে। নাঃ, হাজার চেষ্টা করেও বোধহয় কারও জন্য কিছু করা যায় না।