Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 25

ট্রেকার্স || Bani Basu

এইভাবে পাণ্ডুলিপিটা শেষ করে, ধ্রুবজ্যোতি যে-দিন প্রকাশের জন্যে জমা দিলেন, তার দিন দুই পর এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ বেরোল। আরিয়ানের বলে যে লাশটিকে শনাক্ত করা হয়েছিল, করেছিলেন আরিয়ানের নিজের বাবা-মা, সেটা নাকি আদৌ আরিয়ানের নয়! যেটাকে ড্র্যাগন ট্যাটু বলে মনে হয়েছিল, সেটা আসলে বিছে। এ ধরনের উল্কি আদিবাসীরা ব্যবহার করেই থাকে। কিন্তু আরিয়ানের বাবা তার দেহ চিনতে পারলেন না! দায়িত্বশীল ডাক্তার একজন! ছেলেটির অন্য আত্মীয় বন্ধুরা তাঁদের সংশয় পুলিশকে জানান। ডেডবডির রং কালো। আরিয়ান ছিল টকটকে ফরসা। যতই পচ ধরা দেহ হোক, এতটা তফাত হবে? দেহের গঠনে অবশ্য খুব মিল। আরিয়ানের বাবা-মা চুপ। বেশি চাপাচাপি করলে বলছেন, “তা হলে তাকে ফিরিয়ে আনুন। নইলে আর আমাদের বিরক্ত করবেন না।”

ধ্রুবজ্যোতি কাগজে বেরোনো নামগুলো ব্যবহার করেই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। না হলে মেজাজ আসছিল না। পরে প্রত্যেকের নাম বদলে দেন। তাঁর খুশিই হওয়ার কথা। কেননা পুরো উপন্যাসটাকে খবরের কাগজজাত বলে চিনতে পারলে পাঠকের একধরনের কৌতূহলপাঠ পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে তো লেখকের মান থাকে না। উপরন্তু লেখকের সৃষ্টিক্ষমতার ঘাটতি পড়েছে, এমন মন্তব্যও আসতে থাকে। লেখকের এগুলোতে কান দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন সন্ধিৎসু সমাজতাত্ত্বিক হিসেবেও দেখতে পছন্দ করেন। তাঁর উপন্যাস আর বাস্তব খবরের শেষ, একরকমের হল না বলে তো তাঁর স্বস্তি পাওয়ারই কথা। কিন্তু তিনি সেটা পুরোপুরি পেলেন না। ছেলে-মেয়েগুলো কোথায় গেল? তিনি যে এদের সৃষ্টি করেছেন! যেমন করেছেন, মিলুকে। তিনি পিতা, তিনি তো ঈশ্বরই। তাঁর ভাবনা হতে লাগল। কী হল? হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশের পাতায় চোখ রাখলে ভয় হয়। এত মানুষ নিরুদ্দেশ? ক’দিন আগে একটা পরিসংখ্যান দিয়েছিল, বছর ভর কতজন নিরুদ্দেশ হন। আর কতজন ফিরে আসেন। ভয়াবহ! কিন্তু এরকম একসঙ্গে নিরুদ্দেশ হওয়ার কেসও তো যখন-তখন হয় না।

খেতে-শুতে অন্যমনস্ক থাকেন তিনি। সংযুক্তা লক্ষ করেছেন, “কী নিয়ে এত ভাবছ? উপন্যাস শেষ হয়ে গিয়েছে?”

তিনি যদি বলেন উপন্যাসের কথা ভাবছেন না। উপন্যাসের বাস্তব মডেলদের জন্য ভাবছেন, সংযুক্তা নিশ্চয়ই বকাবকি করবেন। আমাদের কি এমনিতেই যথেষ্ট ভাবনা নেই যে, উড়ো ভাবনা ডেকে আনছ? তাঁদের দু’জনের মধ্যে সংযুক্তাই প্র্যাক্টিক্যাল মানুষ। তিনি তাই কিছু বলেন না। খালি গোরু খোঁজা করে খবরের কাগজে ওদের খোঁজেন, চোখ পেতে রাখেন টিভি নিউজে।

ইউনিভার্সিটি-ক্যান্টিনে মিলি সাধারণত যায় না। সে দিন দলে পড়ে গিয়েছিল। একটি যুবক যেচে এসে আলাপ করল।

“আমি রঞ্জন, আপনি মিলি, না?”

“হ্যা,” বলে মিলি পাশ কাটিয়ে বেরোতে যাবে, যুবকটি বলল, “আসুন না, কোথাও একটু বসি। এখানে বড্ড ভিড়।”

মিলি অবাক হয়ে চাইল, “আমি ক্লাসে যাব না? আশ্চর্য তো আপনি?”

“খুব জরুরি কথা ছিল।”

মিলি কোনও কথা না বলে ক্লাসে চলে গেল। কিন্তু তার মনে খটকা লেগে রইল।

বিকেলে বেরিয়ে দেখে, বাসস্টপে সেই চরিত্র দাঁড়িয়ে। উলটোদিকে ধ্রুবজ্যোতিও এসে গেছেন। সে দৃঢ় পায়ে রাস্তা ক্রস করে ওপারে গেল। চরিত্রটিও ক্রস করল।

“মেসোমশাই, মিলির সঙ্গে আমার একটু জরুরি আলাপ ছিল।”

“কে আপনি?”

যুবকটি পকেট থেকে তার আই-ডি কার্ড বের করে। সিআইডি। এবার ইয়াং ম্যান পাঠিয়েছে।

“কী চান?”

“মিলির সঙ্গে জাস্ট একটু আলাপ-আলোচনা, আলাদা।”

“অনেক তো হল। খুনে, জোচ্চোর, টেররিস্ট ধরতে পারেন না। সেই যে পাঁচটি ছেলে-মেয়ে উধাও হয়ে গেল গত বছর, তাদের পাত্তা করতে পারেননি এখনও। নিরীহ ভদ্রলোক, ছেলেমানুষ মেয়ে এদের হয়রান করছেন? ছিঃ ছিঃ।”

ছেলেটি বলল, “আমিও তাই বলি, বুঝলেন মেসোমশাই। কী করব, চাকরি তো! তবে আমার উদ্দেশ্য আপনাদের হয়রান করা নয়, হেল্প করা। শুনলেই বুঝবেন। কাছাকাছি একটা কফি হাউজ আছে। কিছু যদি মনে না করেন, ওপরওয়ালার নির্দেশ, আমার কি আর ইচ্ছে করে?”

মিলি বলল, “চলো বাবা। উনি কী বলছেন, শুনেই যাই।”

এখনও কফি হাউজে তেমন ভিড় হয়নি। মিলি আর যুবকটি যেখানে বসল, ধ্রুবজ্যোতিকে বসতে হল তার থেকে কিছু দূরের টেবিলে। একটা কফি নিয়ে বসে নজর রাখছিলেন মিলির ওপর। মুখ দুশ্চিন্তায় কালচে। এমন সময়ে পাশের টেবিলে দুটি ছেলেমেয়ের কথায় তিনি কান খাড়া করলেন।

“দীক্ষিত সারও তো সেই থেকে মিসিং। পাঁচ-ছ’মাস হয়ে গেল। এখন কোথা থেকে অত ভাল সার পাই বল তো?” মেয়েটি বলল।

ছেলেটি জবাব দিল, “এরকম টিচার আর দেখবি না। সায়েন্স, হিউম্যানিটিজ-এ ফান্ডা এক। কমার্সের অ্যাকাউন্টেন্সি এমন বুঝিয়ে দেবে জলের মতো।”

“দিয়া, রূপ, ওই মিসিং ছেলেমেয়েগুলো রে। সব ওঁর কোচিং-এ পড়ত।”

“সত্যি? তুই ওদের মিট করছিস?”

“দিয়া আর রূপকে বেশ কয়েকবার, উজ্জ্বলকে একবার, লিডার লাইক, জানিস? ওরা অন্য গ্রুপে ছিল।”

“কী হল বল তো ওই গ্রুপটার?”

“ইলোপ-ফিলোপ করেছে হয় তো।”

“যা খুশি করুক, সারটাকে যে কে কোথায় নিয়ে গেল?”

ছেলেটি হেসে বলল, “অতবড় সারকে আবার কে কোথায় নিয়ে যাবে! যেখানে গিয়েছেন, উনি স্বেচ্ছায় গিয়েছেন। ফ্যামিলি বলে তো কিছু নেই শুনেছি। তা ছাড়া ওঁকে তো মিসিং বলে কেউ খোঁজাখুঁজি করছে না! প্রচুর টাকা করেছেন, এখন কোথাও গিয়ে আরাম করছেন, দেখ গে যা।”

ওদের কথাবার্তার বিষয় পালটে গেল। কিন্তু আসন্ন বিপদ সত্ত্বেও ধ্রুব রোমাঞ্চিত হয়ে বসে রইলেন। তা হলে তাঁর অনুমান ঠিক? এদের একজন প্রাইভেট কোচ ছিলেন, সেখানেই বিভিন্ন স্ট্রিমের ছেলেমেয়েগুলির আলাপ। খুব জনপ্রিয়, ব্রিলিয়ান্ট কোচ। বাঃ দেশাইয়ের জায়গায় দীক্ষিত। এবং তিনিও মিসিং! কেমন একটা আপ্লুত হয়ে বসে রইলেন তিনি, যতক্ষণ না মিলি এসে ডাকল, “বাবা চলো।”

“চল।”

যুবকটি তাঁদের সঙ্গেই বেরোল, “নমস্কার। সেল ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছি মিলিকে, দরকার হলে একটা ফোন করে দেবেন।”

মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি নিলেন তিনি। ট্যাক্সিতে কোনও কথা নয়। তাঁদের পুরো পরিবারে এই সাবধানতার অভ্যাস এসে গিয়েছে এখন।

“কী বলল মক্কেল? কে উনি উপকারী বন্ধু এলেন যে, ওঁকে একটা ফোন করে দিতে হবে?”

মিলি বলল, “ওপরে চলো।”

লোকটি মিলিকে বলেছে, পুলিশ নাকি একেবারে স্থির নিশ্চিত যে মিলিই লোকগুলিকে খুন করেছে। বাধ্য হয়ে। কিন্তু সিআইডি-র ওই রঞ্জন চায় না, মিলি পুলিশের হাত পড়ুক। মিলি যা করেছে, বেশ করেছে। আত্মরক্ষার জন্য মানুষ যা খুশি করতে পারে। সে মিলিকে রক্ষা করতে চায়। তাই তাকে সতর্ক করে দিতে এসেছে। তার যদি কিছু বলার থাকে, ওখানে ফেলে আসা কোনও জিনিসের কথা মনে পড়ে, মিলি যেন রঞ্জনকে বলে। ও ওর সাধ্যমতো সেসব সরিয়ে আনবে। যেমন, ক্লিপ, রাবার ব্যান্ড হয়তো খুব ছোট্ট জিনিস…

“ও তোকে কী ভেবেছে? হাঁদা গঙ্গারাম? তুই কী বললি?”

“আমি ধৈর্য ধরে ওর কথা শুনলাম। কেননা, যতবার অসহিষ্ণু হই, ও বলে, ‘আমায় বলতে দিন, আমায় বলতে দিন।’ ঠিক আছে, বলতে দিলাম। শেষকালে বললাম, শুধু শুধু আমার বয়সের একটি মেয়েকে বার বার খুনি বলা হচ্ছে, এটা কি হিউম্যান রাইটস কমিশনে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ নয়? পুলিশ বলে কি পাবলিকের মাথা কিনে নিয়েছে?”

লোকটি নাকি ওকে ডেট করতে চায়। মিলিকে ওর ভীষণ ভাল লেগেছে। মিলি রাজি না হওয়ায় খুব হতাশ। “বাবা, ওরা এমন কিছু একটা পেয়েছে, যাতে করে আমার ওপর এত সন্দেহ! কী হতে পারে সেটা? হাত-পায়ের ছাপ পেলে তো হয়েই যেত। তা যখন নয়, কী হতে পারে?”

ধ্রুব ভাবিত হয়ে পড়লেন। মিলির অ্যাডিশন্যাল পরীক্ষা না দেওয়াটা, পটকার ওর স্কুলের কাছাকাছি বস্তিতে থাকাটা, শাড়ির পাড়, বায়ো পরীক্ষার পর তাঁদের মিলির বন্ধুর বাড়ি খোঁজখবর করাটা… এইগুলোই গেঁথে-গেঁথে গল্প তৈরি করেছে ওরা।

তিনি ভাবলেন, মিলিকে আর একবার সাবধান করে দেবেন। আশা দেবেন। কিন্তু দেখা গেল, মিলিই তাঁকে সাবধান করছে, আশা দিচ্ছে।

“বাবা, খুব সাবধান! লোকগুলো কী মারাত্মক চালাক বুঝেছ তো? কিন্তু আমরা কোনও অন্যায় করিনি, এইখানে আমাদের জোর। থানা-আদালত যদি সত্যিকার নিরপেক্ষ হত, ন্যায়বিচার করত… আমি এখুনি গিয়ে সারেন্ডার করে আসতাম। কিন্তু ওরা শয়তানের পক্ষে। দেখতে পাচ্ছে, দুটো গুন্ডা, মাতাল। বুঝতে পারছে, এখানে কোনও মেয়ে ছিল, পালিয়ে গিয়েছে। খুব ভাল করে বুঝতে পারছে, তার উপর কী নৃশংস অত্যাচার চলেছে! আমি পুলিশ চিফ হলে বলতাম, বাবা, এ কেসে আর এগোতেই হবে না। শয়তান, ঠিক শাস্তি পেয়েছে। অনেক কষ্টে, অনেক মূল্য দিয়ে আমি তোমাদের পেয়েছি, একটা মানুষের মতো জীবন পেয়েছি, কোনও মতেই আমি হারব না। যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়, কনভিক্‌ট করে, আমি বলব, আপনাদের কাজ আমার দ্বারা হয়ে গিয়েছে বলে আমাকে আপনাদের মেডেল দেওয়া উচিত। আমি সমাজকে দুটো পিশাচের হাত থেকে বাঁচিয়েছি।”

এই মেয়ের ভিতর এত আগুন ছিল, ধ্রুব আগে বোঝেননি। এখন হঠাৎ ওঁর মনে হল, “খুব প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বারবার বাধা পেয়ে যারা বড় হয়, যাদের জীবনী লেখা হয়, মিলি বোধহয় সেই জাতের। সত্যিই তো পাচার হওয়া মেয়ে, ব্রথেলে অত্যাচারীর চোখে আঙুল ঢুকিয়ে পালাল, ট্রাক ড্রাইভারকে নেশায় আচ্ছন্ন রেখে দ্বিতীয়বার পালাল, দারোগা বাড়ির নির্যাতন থেকে এনজিও অবধি পথ করে নিল, তারপর এমন একজনকে খুঁজে নিল, যে ওকে আশ্রয় ও ভালবাসা দেবে। এই পশ্চাৎপট মাথায় রেখে ও এতদূর এসেছে। কম্পিউটার তো করছেই, গানে প্রতিদিন উন্নতি করছে। এ তো যে-সে নয়, এ বিশেষ একজন। এ মেয়ের ভিতর এত গান ছিল, তা-ও তো তাঁরা আগে বোঝেননি! এত যখন ছিল, তখন আরও অনেক আছে। সবই একটু স্নেহের জলসিঞ্চনে, নিরাপত্তার শক্ত ভিতের উপর গড়ে উঠছে। কী, কী দিতে পেরেছেন তাঁরা, মিলিকে? সংগীত, বিদ্যার প্রতি আগ্রহ, সাহিত্য-পিপাসা, শেখবার উচ্চাকাঙক্ষা, আত্মবিশ্বাস, মানুষের উপর বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে ভারসাম্য, উপস্থিত বুদ্ধিটা ওর একেবারে নিজস্ব। খুব আনন্দের কথা, তাঁরা পেরেছেন। যথেষ্ট বিনয় সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না যে, মিলির ‘মিলি’ হয়ে ওঠায় তাঁর একটা বিশাল ভূমিকা ছিল। সংযুক্তার তো বটেই। কিন্তু তাঁরও। অথচ মিলি একেবারেই তাঁর অচেনা সমাজের মানুষ। মজার কথা, চারপাশে যে ছেলেমেয়েদের দেখেন, কিছুদিন আগেও পড়ানোর সূত্রে অনবরত যাদের ধ্যানধারণার কাছাকাছি আসতে হয়েছে, তাদের ঘিরে যে কাল্পনিক কাহিনি লিখলেন, তা সত্য হল না। তিনি তো ব্যাপারটাকে প্লট হিসেবে নেননি। একটা অন্বেষণ ছিল ওটা।

ছ’মাস কেটে গেলেও পাঁচটি ছেলেমেয়ের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। পুলিশ শেষ পর্যন্ত থিয়োরি বার করল যে, তারা মাওবাদীদের পাল্লায় পড়েছে। যদি মাওবাদীরা ওদের মেরে ফেলে থাকে, তা হলে তাদের দেহাবশেষ কোথাও-না-কোথাও পাওয়া যেতে পারে। আর ওরা যদি মাওবাদীদের দলে যোগ দিয়ে থাকে, তা হলে তো হয়েই গেল। সে ক্ষেত্রে তাদের সন্ধানের জন্য যে অতন্দ্র দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি দরকার, তার উপযুক্ত সময়, লোকবল কি পুলিশের আছে? অনবরত ঘটে যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক লুট, গৃহস্থবাড়িতে ডাকাতি-খুন, জটিল সব হত্যার কেস, রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুণ বীভৎস খুন জখম। কার অত সময় আছে? মন্ত্রী-সান্ত্রিদের কাছের লোক হলেও বা কথা ছিল। কিন্তু এদের বাবা-মা’রা বোধহয় ঠিক ওই সার্কলের লোক নয়। ডাক্তার, প্রাইভেট ফার্মে এগজিকিউটিভ, এইরকম। তাঁদের দিক থেকে কোনও প্রেশার নেই কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। পুলিশ মন্ত্রীর ডান হাত খুনে-গুন্ডার হত্যার সমাধান করতে একটি ছোট মেয়েকে, যাকে বলে হাউন্ড করে চলেছে, অথচ পাঁচ-পাঁচটি তাজা ছেলে-মেয়ে উবে গেল, তাদের আদৌ কোনও হেলদোল নেই।

এইভাবে দিন কেটে যায়। ধ্রুব মনে করেন, তাঁর মাথা থেকে ওরা বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু যায়নি যে, সেটা ধরা পড়ে তাঁর এলোমেলো স্বপ্নে। আরিয়ান ছেলেটি মলিন মুখে বলছে, “আমাকে শেষ পর্যন্ত রেপিস্ট বানালেন! অন্য ছেলেমেয়েগুলি ছায়ার মতো ভিড় করে এল। আপনারা বড়রা, বুড়োরা, আমাদের মধ্যে ভাল কিছু দেখতে পান না, না?” তিনি কথার উত্তর দিতে চান। ওরা হাতের ভঙ্গিতে চুপ করিয়ে দেয়। অনেক চেনা, আধচেনা মুখ ভিড় করে আসে।

সেদিন যেটা দেখলেন, মাঝরাত থেকে শেষরাতের মতো কোনও সময়ে। দেখলেন, ছ’টি গ্রিক ধরনের চাদর পরা মূর্তি কুয়াশার মধ্য দিয়ে স্লো মোশানে লাফাচ্ছে। লাফিয়ে-লাফিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে গিরিশৃঙ্গ, সমুদ্র, নদ-নদী, মেঘ, আকাশ। কে, ওরা কে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন। প্রতিধ্বনিময় জলদগম্ভীর গলায় কেউ বলল, “চিনতে পারলে না? ওরা তো দেশাই আর তার পঞ্চশিষ্য। ওরা খুঁজতে গিয়েছে।” কী? কী খুঁজছে? এর উত্তরে, একটা বিশাল রামধনু রঙের বুদবুদ উঠল। তারপর সেটা ফেটে গেল। ভিতরে ব্যাখ্যার অতীত কিছু রয়েছে। একটা গভীর উত্তেজনাময় আহ্লাদ তাঁর বোধে-বোধে ঢুকে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে তিনি রংহীন একটা মাঠের মধ্যে উত্তরের আশায় ঘুরে বেড়ালেন। কী দেখলেন? কিছু দেখলেন কি, না শুধু অনুভব করলেন? বাকি সময়টুকু তিনি কেমন নেশাগ্রস্ত, ধ্যানগ্রস্ত হয়ে রইলেন। গভীর নিশ্বাস পড়তে লাগল। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে তিনি কি প্রাণায়াম করছিলেন? স্বপ্নের বাইরে বেরোতে পারছিলেন না, চাইছিলেনও না। তিনি যদি ওদের সঙ্গে যোগ দেন, তা হলে কি পাবেন না? ওরা যেখানে যায়, তিনিও যাবেন, যত দুর্গমই হোক। এই জটিল সন্দেহ, জিঘাংসা, কুটিলতা, বিশ্বাসভ্রষ্টতার মধ্যে তিনি আর নিশ্বাস নিতে পারছেন না।

“দিয়া,” তিনি ডাক দিয়ে উঠলেন। “আরিয়ান, উজ্জ্বল, আমি আসছি। এক মিনিট, মাই ডিয়ার বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। বিভাবরী, রূপরাজ আমাকে ফেলে যেয়ো না। দেশাইকে বলো, আমি আসতে চাই, আমি আসছি।”

যত পরিষ্কারভাবে কথাগুলো স্বপ্নের মধ্যে বললেন, অত পরিষ্কারভাবে বাস্তবে শোনা গেল না। সংযুক্তা দেখলেন, একটা ছাই-ছাই রঙের শেষরাত অর্ধস্ফুট হচ্ছে চারধারে। পাখা ঘুরছে, জানলার পর্দা নড়ছে, অস্পষ্ট অবয়ব আলমারি, টেবিল, চেয়ার আর তাঁর পাশের মানুষটির। কী যেন বিড়বিড় করছেন। শরীরটা কাঁপছে, ঠোঁট নড়ছে। তিনি উঠে বসলেন। দীর্ঘদিন ধরে বড়ই টেনশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। সবরকম দুশ্চিন্তার কথা ধ্রুব তো তাঁকে বলেন না। অনেক চিন্তা তাঁর লেখালেখির জগতের সঙ্গেও জড়িত। সেগুলো ধ্রুবর কাছে ভীষণ জরুরি। কীসে কার কী প্রতিক্রিয়া হয়, কে জানে! তিনি ধ্রুবর গায়ের ঘাম মুছিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর সমস্ত শরীর কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে রয়েছে। কী স্বপ্ন দেখছেন ধ্রুব? ভাল কিছু? স্বপ্ন দেখা ভাল। দেখুন। সুখস্বপ্ন যখন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25
Pages ( 25 of 25 ): « পূর্ববর্তী1 ... 2324 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress