ট্রেকার্স (Trekkers) : 23
ঝোরাটা সবার প্রিয়। ঝিরঝিরে গোড়ালি ডোবা। পৌঁছে গেছে ট্রেকাররা। ফাল্গুন মাসের পরিষ্কার আকাশ। চাঁদের আলো ঝরে পড়ে জলে হিরের কুচি অভ্রের কুচি ভাসছে। এত জোরালো চাঁদের আলো যে, রাতের খাওয়া চন্দ্রালোকেই হয়ে যায়। আজকে বাবাই একটা পোলাও রেঁধেছে। কাজু, কিশমিশ, পেস্তা, টিনের মটরশুঁটি, আলু সব দিয়ে একটা সরল পোলাও। কে জানত, সেটা এত ভাল হবে!
কাগজের প্লেটে সবাইকে পরিবেশন করল দিয়া। একটা চমৎকার আমের আচার তার সঙ্গে। মুখে দিয়েই সবাই ‘আহা-আহা’ করে উঠল।
“কী রেঁধেছিস রে?” উজ্জ্বল বলল। “তোর এ গুণ আছে তা তো জানতাম না!”
“দূর, আমি রান্নার কী জানি! করে দিলাম একটা। সেই বিগিনার্স লাক বলে একটা কথা আছে না, বোধহয় তাই,” বাবাই বলল লাজুক মুখে।
বলল বটে, কিন্তু বাবাই মোটেই রান্নায় অত আনাড়ি নয়। তার মা মফস্সলের মেয়ে, কন্যা যতই পড়াশোনা করুক, আর খেলোয়াড় হোক, রান্না, ঘর গোছানো, কাপড় কাচা এগুলোর একটাও বাদ যায়নি তার শিক্ষা থেকে।
দিয়া বলল, “আমিও পারি, আমায়ও একটা চান্স দে।”
“হিংসে হচ্ছে, নাকি?” আরিয়ান বলল।
“তা তো একটু একটু হচ্ছেই। আমি বরাবর বাবাইকে হিংসে করি তো,” সাফ জবাব দিয়ার। “একে স্প্রিন্ট কুইন, তার ওপরে ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ, পার্সন্যালিটি দ্যাখ… যাই হোক, কু—ল। আমার মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচে নয়। এখন আবার দেখা যাচ্ছে, ফ্যান্টাস্টিক কুক। হিংসেটা আরও বেড়ে যাবে না?”
দিয়ার কথায় ছোটখাটো হাসির হাওয়া বয়ে গেল সবার উপর দিয়ে। শিরীষ-সেগুন মাথা নাড়তে থাকে। হাওয়াতে কীসের যেন রেণু গুঁড়ো-গুঁড়ো উড়তে থাকে। দিয়ার মনে হয়, ওগুলো চাঁদেরই গুঁড়ো। জ্যোৎস্না থেকে ভেঙে-ভেঙে তৈরি হয়েছে। পাথর ভেঙে-ভেঙে যেমন বালি হয়। বন যেখানে গভীর হয়েছে, সেখানটা যেন পাহাড়ের ভুরু। সেখান থেকে একটা ভীষণ সেক্সি বুনো গন্ধ আসছে। গন্ধটা তাকে এমন মাতাল করে দিচ্ছে, কী করে সে নিজেকে প্রকাশ করে। ভেতরটা টগবগ করে ফুটছে যেন। মনে হচ্ছে, সেই একজন। একটি মাত্র বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ রকম অর্থহীন ব্যাকুলতা তার আগে কখনও হয়নি। হঠাৎ দিয়া উঠে পড়ল, তারপর জ্যোৎস্না মাড়িয়ে মাড়িয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগল।
“বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ ও ওদিকে যাচ্ছে কেন?”
“এন সি বোধহয়,” আরিয়ান বলল।
“এন সি-ই হোক, আর যাই-ই হোক, একা এভাবে যাওয়া তো ঠিক নয়।” বাবাই বলল, “উজ্জ্বল তুই যা। প্লিজ, একটু নজর রাখ।” আরিয়ান বলল, “যা-যা, শিগগির যা।”
বাবাই বুঝতে পারছিল, নেচার্স কল-টল নয়, কিছু একটা হয়েছে দিয়ার। মান-অভিমান! তার রান্নার প্রশংসার সঙ্গে জড়িত কি? চরিত্রের জটিলতার দিক দিয়ে এইসব মেয়েদের কোনও তফাত নেই। শুকতারা আর দিয়া এখানে এক। একজন সবাইকে গাছে তুলে দিয়ে বাই-বাই টুকুও না করে স্রেফ পালিয়ে গেল। আর একজন এখন বনের দিকে যাচ্ছেন। উজ্জ্বল ছাড়া আর কেউ ওকে সামলাতে পারবে না। কী ঝামেলাই হয়েছে!
রূপ চুপচাপ ছিল। বলল, “চল বাবাই, আমরা এই প্লেট-ফ্লেটগুলো ঝরনার জলে ফেলে আসি।”
“পলিউশন হবে না?” বাবাই জিজ্ঞেস করল।
“প্লাস্টিক তো আর নয়, কী বল আরিয়ান।”
আরিয়ান কিছু বলল না।
দু’জনে প্লেট, গ্লাসগুলো কুড়িয়ে জড়ো করল। ভুক্তাবশেষ বলতে বিশেষ কিছু নেই। যেটুকু আছে, একটু দূরে গিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিল রূপ।
বলল, “পাখিগুলোকে পোলাও থেকে বঞ্চিত করি কেন, বল বাবাই?”
বাবাই হাসল, “পাখিদের বঞ্চিত করতে তুই চট করে পারবি না। প্রকৃতি নিজেই ওদের সহায়। রান্না করতে হয় না, লেখাপড়া শিখতে হয় না, সবটাই এক্সট্রাকারিকুলার। খুঁটে-খুঁটে খাওয়া সারাদিনের কম্মো।”
বলতে বলতে ওরা ঝরনার কাছাকাছি এসে পড়েছিল। বাবাই একটা গোল থালা, টেনি কয়েটের মতো ঘুরিয়ে ছুড়ে দিল জলে। সেটা হেলতে-দুলতে খানিকটা চলে, লাফিয়ে নামল জলের সঙ্গে, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
রূপ বলল, “আমার মনে হয় এগুলো টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা ভাল। দেখ, জল বেশি নেই। স্রোতও তেমন নেই।”
বাবাই সায় দিয়ে জিনিসগুলো ছিঁড়তে লাগল। দাঁড়িয়ে একেবারে জলের পাশে, হঠাৎ পা হড়কে গেল বাবাইয়ের। রূপ তাড়াতাড়ি তাকে হাত ধরে ওঠাতে গেল। এত কম জায়গা, এত পিছল যে, বাবাই এসে পড়ল সোজা রূপের বুকের ভেতর। দু’জনেই দু’জনের বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পাচ্ছে। মাথার উপর নীলচে চাঁদ, শরীরময় জলকণার মতো জ্যোৎস্নাকণা লেগে রয়েছে, পায়ের নীচে জল। রূপ ধরা গলায় বলল, “একটু দাঁড়া, আমি তোকে টেনে তুলছি।”
পিছন থেকে কর্কশ গলা শোনা গেল, “হোয়াট দা হেল আর ইউ ডুয়িং হিয়ার? আমাকে একলা বসিয়ে রেখে কৃষ্ণলীলা হচ্ছে? একটা কাপল গিয়েছে ওদিকে, আর একটা আমার চোখের সামনে, বাঃ!”
রূপের কলার ধরে এক ঝাঁকুনি দিল আরিয়ান। বাবাই ছিটকে পড়তে গিয়ে কোনওমতে দু’জনের পিছন দিক দিয়ে উঠে এল। প্রাণপণে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল দু’জনকে। আরিয়ান এক ঘুঁষি মারল রূপকে। রূপ বাঁ চোখটা ঢেকে কোনওক্রমে ঘুঁষিটা ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করল, পারল না। আরিয়ান আবার খ্যাপা ষাঁড়ের মতো এগিয়ে আসছে। রূপ সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
পিছন থেকে হঠাৎ একটা গম্ভীর গলা, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে কি এটা?” উজ্জ্বল শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে দু’জনকে ছাড়াল। দু’জনে দু’দিকে ছিটকে পড়েছে।
“ব্যাপার কী, আরিয়ান?” আরিয়ান ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এবার খুব খারাপ কয়েকটা গালাগাল দিল। উজ্জ্বল এক চড় মারল তাকে। “হোয়াট ননসেন্স! ব্যাপারটা কী? বল। ঠিকঠাক বল।”
“কাকে বলব?” আরিয়ান মাটিতে থুতু ফেলল। আরও একবার গালাগালি দিয়ে উঠল আরিয়ান। আরও একটা থাপ্পড়।
“শি ইজ মাইন,” সে বাবাইয়ের দিকে আঙুল দেখাল।
“ইন হোয়াট সেন্স?” উজ্জ্বল বলল।
রূপরাজ উঠে আসতে আসতে বলল, “তাই কি ওকে ড্রাগ খাইয়ে রেপ করেছিলি?”
আরিয়ান প্রথমে হকচকিয়ে গেল। চাঁদের আলোয় মুখের রং বোঝা যাচ্ছে না। তারপর বলল, “কোন সোয়াইন বলেছে? কে? রণবীর? দেব?”
“সমস্ত বলে দিয়েছে,” দিয়া বলে উঠল। “তুই ভাবছিস তোর ‘ক্রাশ’ ক্লাবের ওই লম্পটগুলো তোকে প্রোটেকশন দেবে? ইউ আর স্যাডলি মিসটেকন ইয়ার।”
হিংস্র মুখ করে আরিয়ান বলল, “ও নিজে কী করেছে? জিজ্ঞেস করিসনি তো?”
“সব জানি। বিচার হবে ওয়ান বাই ওয়ান, কেউ বাদ যাবে না। তবে ওর বিরুদ্ধে তোর সাক্ষ্যটা দরকার।”
“সাক্ষ্য? ও-ই তো নাটের গুরু। দ্যাট সোয়াইন। ও বলেনি, তুই তোরটা পাবি, যদি আমি আমারটা পাই। ওরটা মানে, তুই দিয়া ঘোষাল।” উচ্চারণের অযোগ্য কিছু ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করল আরিয়ান।
“ব্যস আমাদের কাজ কমপ্লিট,” উজ্জ্বল শান্ত গলায় বলল।
“যথেষ্ট এভিডেন্স বলে গ্রাহ্য হবে আশা করি ক্যাসেটটা,” দিয়া বলল আরও শান্ত গলায়।
হঠাৎ আরিয়ান ছুটে গেল দিয়ার দিকে। উজ্জ্বল দু’পা এগিয়ে গিয়ে তাকে দিল এক ধাক্কা। রূপ আর এক ধাক্কা দিয়ে বলল, “জঘন্য কদর্য এই কাজটা দ্বিতীয়বার করিস না। মনে রাখিস লেসনটা। রেপের জন্য ক’বছর আর জেল হয়! ও কিছুই না। ওটা কেটে যাবে। কাটবে না যেটা, সেটা হল দুর্নাম। মা-বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাবি কী করে ভাব।”
আরিয়ান উঠে এসে উজ্জ্বলকে আক্রমণ করল। উজ্জ্বল তার পাটাতনের মতো কাঁধ দিয়ে ওকে ঠেকিয়ে বলল, “আমরা তোকে মিছিমিছি মারধর করতে চাই না। জাস্ট আইনের হাতে তুলে দেব। দু’জন দু’দিক থেকে ঠেলতে ঠেলতে তাকে ঝোরার দিকে নিয়ে গেল। রূপ বলল, “বেশি ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করিসনি।” তারপর অন্যদের দিকে ফিরল, “চল আমরা ফিরি। আজকের রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে, কাল সকালবেলাই ফিরব। গোছগাছ কমপ্লিট করে রাখিস সবাই।” তাঁবুতে ফিরে গেল চারজন।
উজ্জ্বল বলল, “দিয়া ক্যাসেটটা আমার কাছে দে। আর একটা কথা, ও যদি রাত্রে আবার এটার ওপর ডাকাতি করবার চেষ্টা করে, করবেই, আমাদের পালা করে জেগে পাহারা দিতে হবে।”
বাবাই বলল, “কিন্তু ও তো তাঁবুতে ফিরবেই। ওর জিনিসপত্তর রয়েছে। শোবেও নিশ্চয়। আমার মনে হয়, এরপর ও কাকুতি-মিনতি করবে আমাদের কাছে। এই ধরনের কাপুরুষরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই-ই করে। সে পথটা খোলা রাখ।”
“মানে?” দিয়া চড়া গলায় বলে উঠল। “তুই কি ওকে মাফ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করছিস?”
“না, না। আমি বলছি ডাকাতিটা ভিতরে এসে ইমোশন্যাল চেহারায় করবে, কাজেই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।”
একটু পরে আরিয়ান সত্যিই দুপদাপ করে তাঁবুতে ফিরে এল। নিজের মালপত্রের ভেতর থেকে একটা বোতল বের করল। তারপর আবার দুপদাপ করে ফিরে গেল।
“মাল নিয়ে এসেছে, আমি অনেক আগেই টের পেয়েছি,” রূপ বলল।
বিরাট শব্দে কোথাও একটা বাজ পড়ল। উজ্জ্বল তাঁবুর বাইরে থেকে ঘুরে এল। বলল, “বৃষ্টি হবে, মনে হচ্ছে।”
কোথা থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। উপরের দিকে ইতিমধ্যেই বৃষ্টি হয়েছে কি না কে জানে! তাদের তাঁবু খাটানো হয়েছে মোটামুটি সমতল জায়গায়। কিন্তু বেশি বৃষ্টি পড়লে কী হতে পারে ভেবে, সবাই মালপত্র নিয়ে বসেই রইল।
ঘুমোব না, ঘুমোব না করেও ঘুম এসেই যায়। সকলেরই ঢুল এসেছে। দিয়া একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাই স্বপ্ন দেখছে, সে হিমালয়ে চড়ছে। তেনজিং নোরগে সঙ্গে আছেন, সামনের উপত্যকায় নাকি মানস সরোবর। পৌঁছে দেখে, ও মা এ তো ওদের রোগাসোগা চূর্ণী নদী! মা-বাবা দু’জনেই নদীর জলে চান করে উঠে এল… নাঃ মা-বাবা তো নয়! শুকতারা আর আরিয়ান! এইরকম চলছেই চলছেই।
রূপ হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ও ভাবছে, ও জেগে আছে। পাহারা দিচ্ছে। কে যেন তাকে ঝাঁকাচ্ছে ঝাঁকাচ্ছে।
“কী রে?” উজ্জ্বল সামনে।
“সর্বনাশ হয়েছে!”
“কী?”
“আরিয়ান ঝোরার জলে পড়ে গিয়েছে।”
“পড়ে গিয়েছে মানে?”
উজ্জ্বল বিরক্ত হয়ে বলল, “পড়ে গিয়েছে মানে পড়ে গিয়েছে। যাচ্ছিল তো। হামাগুড়ি দিতে গিয়ে পড়ে গিয়ে থাকবে।”
“তুই কী করে জানলি?”
“এত কথা না বলে শিগগির বের হ। তোর কাছে নাইলন রোপ আছে না? নিয়ে আয়। আমি এগিয়ে যাচ্ছি।”
ওদের কথাবার্তায় দিয়া আর বাবাইয়েরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সকলেই বেরিয়ে এল।
বাইরে ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঝোরার ধারে পৌঁছোতে পৌঁছোতেই ভিজে গেল সব।
ভোর হয়ে এসেছে। আকাশে যতই মেঘ থাক, সূর্য উঠলে চরাচরে একটা ঘোলাটে, সাদাটে ভাব আসেই। ওরা একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। ঝোরার মধ্যে একটা বোল্ডারের ওপর আরিয়ান বসে, বোতলটা ওর কোলে, আরিয়ান গলা ছেড়ে গান গাইছে। কী গান, কী বৃত্তান্ত এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না।
“তার মানে পড়ে যায়নি,” উজ্জ্বল বলল। “আমি যখন দেখেছি, ও কীরকম গুঁড়ি মেরে ওই বোল্ডারটায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল।”
“আরিয়ান, আরিয়ান। চলে আয় ম্যান,” রূপ চেঁচাল প্রাণপণে।
আরিয়ান শুনতে পেল বলে মনে হল না। পরক্ষণেই ওরা একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখল। হুড়মুড় করে একটা শব্দ। ঝোরাটার ওপর দিক থেকে ঝাঁপিয়ে আসছে জল। মুহূর্তে জল বেড়ে তো গেলই। ওরা দেখল আরিয়ান একটা পাক খেয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
উজ্জ্বল পাড় ধরে দৌড়ে নামতে-নামতে দড়িটা ছুড়ে দিচ্ছে। “আরিয়ান ধর ধর, প্লিজ ট্রাই… ট্রাই।”
ওর সঙ্গে বাকি তিনজনও দৌড়ে নামছে। ঝোরার জল উপচে পড়ছে, পাড় ভাসিয়ে দিচ্ছে এখন। আরিয়ান ক্ষীণভাবে একবার দড়িটা লুফে ধরতে চেষ্টা করল, পারল না। ধাক্কা খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে গেল। নামতে নামতে অবশেষে ওরা স্থির হয়ে দাঁড়াল। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় রূপরাজ বলল, “তোরা সরে দাঁড়া, এ জলে ভীষণ স্রোত।”
একটা বাঁক ঘুরে ঝোরাটা ওদের চোখের বাইরে চলে গিয়েছে। উজ্জ্বল শুকনো উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “সর্বনাশ!”
রূপ বলল, “যে করে হোক, ওকে উদ্ধার করতেই হবে,” তার গলা এখনও ফ্যাঁসফেঁসে।
“এ টেকনিক্যাল লোকের কাজ, রূপ। আমরা এ জলে পা ঠেকালে পর্যন্ত ভেসে যেতে পারি। লেটস হোপ, অল ইজ নট লস্ট। আরিয়ান ইজ আ রিসোর্সফুল গাই। সাঁতার জানে, জানে অনেক ট্রিকস। হয়তো…হয়তো…”
“হুইস্কিটা যদি না খেত! পুরো বোতল শেষ করেছে বোধহয় বসে বসে,” দিয়া বলল।
কাকভেজা ভিজে ওরা আদিবাসী বসতিটার দিকে চলল।
এক-এক করে লোক জমতে লাগল। বিবরণ শুনে ওরা মাথা নাড়তে লাগল। ওদের মতে, কোনও আশাই নেই। এবং বডি উদ্ধার করবার জন্যে এখন কিছুই করা যাবে না। তবু উজ্জ্বল আর রূপকে নাছোড়বান্দা দেখে, তিন-চারজন লোক কয়েকটা মস্ত লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে ওদের সঙ্গে চলল। উজ্জ্বল মেয়েদের বলল, “তোরা ফিরে যা টেন্টে। গোছগাছ করে নে।”
জামাকাপড় বদলে এখন ওরা চুপচাপ তাঁবুর ভেতরে বসে। জেদ করে হয়তো উজ্জ্বলদের সঙ্গে যেতে পারত। আরও আরও নীচে, জীবিত বা মৃত আরিয়ানের সন্ধানে। কিন্তু কোথাও তো একটা সীমা টানতেই হয়। দিয়া অতক্ষণ ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছিল। তার এখন জ্বর এসে গিয়েছে। বাবাইয়ের সহ্যশক্তি আর একটু বেশি, কিন্তু সেও কাবু। দু’জনেই গরম চায়ে ব্র্যান্ডি দিয়ে খেয়ে নিল, সঙ্গে প্যারাসিটামল।
প্রকৃতিই কি শেষে শোধ নিল? প্রকৃতি অন্ধ নিয়মে চলে। প্রকৃতির তো কোনও বিবেক নেই! আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো তার উপরে অনেক গুণ বা দোষ আরোপ করি। আচ্ছা, আরিয়ান তো ওদের কাছে ক্ষমা চাইতে পারত! যেমনটা ওরা আশা করেছিল! তার বদলে ও হুইস্কির বোতল নিয়ে ঝোরার ধারে চলে গেল। কেন? ইগো? হার মানবে না? ক্ষমাপ্রার্থনাটা কাপুরুষের কাজ! ওর কি ধারণা ক্রাশ ক্লাবের কীর্তিটা বীরপুরুষের? এবং বীরপুরুষেরা ভাঙে, তবু মচকায় না? ওর না মচকানোর চিহ্ন হল তা হলে ওই বোতলটা। কিন্তু ঝোরার ধারে গেল কেন? ওখানেই জ্যোৎস্নালোকে ওদের শেষ বনভোজন। ওখানেই চারজনের এত দিনের পরিকল্পনার নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স। এগুলোই কি মিলিতভাবে ওকে ঝোরাটার ধারে টানছিল? আচ্ছা, রেপের মামলার আসামি হওয়ার চেয়ে কি ও আত্মহত্যাটা ভাল মনে করেছিল? সুরার সাহায্যে মনে সাহস আনা। ওইরকম মাতাল অবস্থায় ও কেন ঝোরার পাথরে বসতে গেল? তা যদি বলো, মাতালের কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে?
এখন, ওর স্বীকারোক্তি আর সাক্ষ্য সংবলিত ওই ক্যাসেটটা বিপজ্জনক হয়ে গেল। পুলিশ বলবে, ওরা প্ল্যান করে মার্ডার করেছে। ঠান্ডা মাথায়। নষ্ট করে ফেলো ক্যাসেটটা। রণবীরের উপর আর প্রতিহিংসা নেওয়াও হচ্ছে না। কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ক্যাসেট বাদেও কি ওরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে? ঠিক আছে। অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়েছ, দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কেন তোমরা বাড়িতে ঘুণাক্ষরেও জানালে না? একটা এক্সকার্শনে যাচ্ছ বন্ধুরা মিলে, এর মধ্যে এত লুকোছাপার কী দরকার? গোপন কোনও উদ্দেশ্য তোমাদের অবশ্যই ছিল। সিক্রেট অ্যাজেন্ডা। দুটি মেয়ে সঙ্গে। তৃতীয় মেয়েটি মাঝপথে চলে এসেছে। অর্থাৎ গিয়েছিল, তিন ছেমরি, তিন ছ্যামরা, পার্ফেক্ট সিক্সসাম। সেক্স অ্যাঙ্গল তো দেওয়াই যায়। সেক্স ফলোড বাই মার্ডার। খুবই চলতি ফর্মুলা।