ট্রেকার্স (Trekkers) : 20
পাহাড়ে ওঠার ভাল রাস্তা আছে। সবাই সেই পথ দিয়েই যায়। কিন্তু যদি নতুন কিছু করতে চান, দেখতে চান তা হলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করাই ভাল। কী দেখবেন না দেখবেন আমি বলে দিচ্ছি না, নিজেরা আবিষ্কার করুন, আনন্দ পাবেন। তবে ওই পাহাড়ের মাথাটা তো ফ্ল্যাট, মালভূমি যাকে বলে, মজা নেই। বড় জন্তুজানোয়ার নেই, বরা ছাড়া। ভয়ের কিছু নেই, মশা থেকে সাবধান। হিল ম্যালেরিয়া অবশ্য এ সময়টায় হয় না, তবু সাবধানের মার নেই। ট্রেকিং-এর যাবতীয় সরঞ্জাম বুঝিয়ে দিতে-দিতে পরেশ মাহাতো বললেন।
‘পুরুলিয়া ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ওদের সঙ্গে তিনটি মেয়ে আছে দেখে, প্রথমটা ওদের নিবৃত্ত করবারই চেষ্টা করছিল। একজন টেনিস প্লেয়ার, স্টেট লেভেলে খেলে, আর একজন ডিস্ট্রিক্ট লেভল স্প্রিন্ট চ্যাম্পিয়ন শুনে আর কিছু বলেনি। তবে মাল বইবার ও কিছুটা গাইডগিরি করবার জন্য একজন লোক দিতে চাইলে ওরাও আপত্তি করল না।
জিপে করে মাইল পঞ্চাশেক রাস্তা, বাঘমুণ্ডি পেরিয়ে একেবারে পাহাড়ের তলা থেকেই ওরা চড়তে শুরু করবে। এতটা আরাম অবশ্য রূপরাজদের প্ল্যানে ছিল না। কিন্তু দিয়া জেদ ধরে বসল। বলল, “এইটা আমি ফিনান্স করছি, না বলবি না। আসল সময়ের জন্য এনার্জি থাকবে না, অন্তত আমার।” সত্যিই দিয়াটা দুবলি, ডেলিকেট-ডেলিকেট একটা ভাব আছে ওর। খেলাধুলো একটু-আধটু করলেও, অন্যদের সঙ্গে এ-ব্যাপারে তুলনাই হয় না। নাচেও অবশ্য যথেষ্ট পরিশ্রম লাগে এবং দিয়া যেভাবে নাচটা অবলীলায় করে দেখাল, মনে হয় খুব সহজ। কিন্তু ততটা নমনীয়তা তো আর এক দিনে, কোনও ব্যায়াম ছাড়া সম্ভব হয়নি। ঠিক আছে, বলছে যখন পারবে না, জোর করার দরকার নেই।
একটু এগোতেই পাহাড় তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের উপরে। ঝোপঝাড়ই বেশি কিন্তু গাছ যা আছে, তাদের গাছ বলে মনে হয় না। যেন মশালমানুষ। ইতস্তত পলাশ গাছে ফুল ফুটে পাহাড় আলো হয়ে রয়েছে। গাইড দেখিয়ে দিল, ওইগুলো কুসুমগাছ। পাতাগুলো লাল হয়ে ছোট-ছোট অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। ওরা বেশিদিন এমন থাকবে না। ভাগ্য ভাল, এই কুসুমবন এখনও তার আগুনে রূপ ধরে রেখেছে। কেঁদ, মহুয়ার কালচে সবুজ, পলাশ-কুসুমের দু’রকম লাল, শিরীষের হালকাতর সবুজ, সেগুনের বড় বড় পাতার মধ্যে থেকে মাথা উঁচিয়ে থাকা মঞ্জরী। যতই ওঠে, এপাশে ওপাশে ঝোরা দেখতে পায়। খুব সামান্য জল কিন্তু কাচের মতো স্বচ্ছ জলের প্রতিভাই আলাদা। বনময়, পথময় বিছিয়ে আছে মহুয়ার ফল। কোলরা কুড়োচ্ছে কোথাও-কোথাও। মাতাল হয়ে আছে হাওয়া।
“কীরকম লাগছে?” রূপরাজ জিজ্ঞেস করল। তার পছন্দ করা জায়গা, তাই তার আলাদা খাতির এখন।
আরিয়ান বলল, “ফ্যানটাস্টিক। হ্যাটস অফ টু ইউ, রূপরাজ।”
উজ্জ্বল যোগ করল, “বনরাজ, ট্রেকরাজ, থ্রি চিয়ার্স।”
দিয়ার মুখে একটা মুগ্ধ, বিহ্বলভাব। সে সেই চোখ-মুখ উঁচু করে পলাশ দেখছে।
বাবাই পাথর টপকে-টপকে খেলতে-খেলতে যাচ্ছে। সে-ও কিছু বলল না।
শুকতারা বলল, “রূপ তোর স্টকে এরকম আর ক’টা আছে রে!”
বড় বড় পায়ে এগিয়ে যায় সবাই। আস্তে আস্তে উঠতে থাকে।
ঠিক হল, ক্যাম্প এক জায়গাতেই খাটানো হবে। সেটাকে ঘিরে কাছাকাছি জায়গাগুলো এক্সপ্লোর করা হবে। পথটাই লক্ষ্য, অযোধ্যা পাহাড়ের মালভূমির উপর কারও তেমন টান নেই। গাইডটি ক্যাম্প করবার মতো জায়গা খুঁজে দিল দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ। একটা মুণ্ডা বসতির মধ্যে দিয়ে উঠে এল ওরা। কিছু দূরে জঙ্গলের আড়ালে একটা ঝোরা আছে। সমতল, চওড়া, লম্বাটে জায়গাটা। ঝোপঝাড় কেটে ফেলল গাইডসহ বাকি তিনজন। একটা পাথরের উপর বসে লম্বা একটা সিগারেট ধরাল শুকতারা।
এই সুন্দর জঙ্গল আর মহুল গন্ধের সঙ্গে সিগারেট যায় না বলতে শুকতারার মন্তব্য হল, ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ।’
“দেখিস, আবার গাঁজা টানছিস না তো?” আরিয়ানের মন্তব্য। প্রথমে শুকতারা জবাব দিল না। একটু পরে বিদ্রূপের সুরে বলল, “ওগুলো তোদের আর তোদের ওই ফক্কড় ক্লাবটার সমস্যা, আমার না। ইনফেমাস ক্লাব একটা।”
দিয়া কিছুই শুনছে না, সে পাখি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ডাক শোনা যাচ্ছে, অথচ পাখি দেখা যাচ্ছে না। বাবাই একটা গাছে ঠেস দিয়ে নোটবই বার করল। সে খুঁটিনাটি লিখে রাখছে ভ্রমণের, কিন্তু কাউকে দেখাচ্ছে না।
একটাই ক্যাম্প, মিলিটারি সবুজ রঙের। রান্না বাইরে হবে। গাইড বলল, কাঠকুটোর অভাব হবে না। তবে ওরা তো সঙ্গে কেরোসিন-স্টোভ এনেইছে। ক্যাম্পের মধ্যে একধারে ওদের জিনিসপত্র নামানো হল, নেহাত কম নয়। শুকতারা মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলল, “এইটুকু জায়গা, ছ’টা স্লিপিং ব্যাগ সেফ ডিসট্যান্সে ফেলে পাতবার জায়গা হবে? তোরা যদি আমাদের শ্লীলতাহানি করিস, বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে। কেননা আমার দুটো আঙুল স্রেফ তোদের দু’চোখে ঢুকে যাবে। নখগুলো দেখেছিস তো?” আঙুল ছড়িয়ে নখ দেখাল শুকতারা।
আরিয়ান হাসতে লাগল, “আরে ইয়ার, তুই আমাদের শ্লীলতাহানি করবি কিনা সেই গ্যারান্টি দে আগে।”
বাকিরা একটু-আধটু হাসলেও দিয়া অন্যমনস্ক। বাবাই তার নোটবুক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। সে একটু গম্ভীর, যতক্ষণ পেরেছে বাবা-মা’র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছে। বাঘমুণ্ডি থেকে আর টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।
উজ্জ্বল একটা বড় চাদর বের করল নিঃশব্দে। তারপর ক্যাম্পের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সেটা পর্দার মতো খাটিয়ে ফেলল ঠিক মাঝখানটায়। বলল, “সিনেমা দেখিস না? এ-সব সিচুয়েশনে শাড়ি খুব কাজে লাগে। তোরা তো শাড়ি কী জিনিস ভুলে গিয়েছিস। কাজেই এই চাদরটা দিয়ে চালিয়ে নে। ও-পাশটা তোদের প্রাইভেসি, এ-পাশটা আমাদের।”
রূপ রাঁধল খিচুড়ি। সে তার স্কাউটিং দিনগুলোর মকশো করছে। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ একসঙ্গে চাপিয়ে দিয়েছে। হলুদ আর নুন, অনেকটা ঘি ছড়িয়ে দিয়ে নামাল।
“ভাল শেফ”, আরিয়ান বলল।
উজ্জ্বলের মন্তব্য, “খাসা রেঁধেছিস।”
শুকতারা বলল, “এত ঘি রোজ দু’বেলা খাওয়াবি নাকি। তবে তো আমার টুয়েলভ ও’ ক্লক বেজে যাবে রে!”
“কী রে তোরা কিছু বলছিস না?” রূপ একটু চিন্তিত। বাবাই আর দিয়া কেন যে এত চুপচাপ।
আরিয়ান বলল, “ওরা সামহাউ ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব হয়ে গিয়েছে।”
দিয়া বলল, “এই জায়গার সঙ্গে এই খিচুড়ি ছাড়া আর কিছুই মানাত না।”
বাবাই হেসে বলল, “চলে যায়” এতক্ষণে সে একটু হাসল।
খাওয়া শেষ হতে হতে চারটে বেজে গেল। সবাই যার যে-দিকে ইচ্ছে ছিটিয়ে পড়ল এবার। প্রত্যেকের হাতে টর্চ। একটা করে লাঠি। সূর্য লুকোচুরি খেলছে গাছগুলোর সঙ্গে। খেলতে-খেলতে একেবারে লুকিয়ে পড়ল। তাকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ একটা মৃদু মোমআলোয় ছেয়ে রয়েছে চরাচর। সেই আলোয় ঘুরতে-ঘুরতে উজ্জ্বল এসে বলে গেল ওদের, “আর কিছু না থাকলেও শেয়াল আর হায়না আছে, অন্ধকারে খুব বেশি ঘুরিস না। ক্যাম্পের পাশে একটা কেঁদ গাছের ডালে একটা লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখল ওরা। অন্ধকার ভারী হয়ে নামতে লাগল।”
কী অদ্ভুত অন্ধকার! বাদুড়ের ডানা যেন ক্রমশ মুড়ে ফেলছে তাদের, আকাশে কৃষ্ণপক্ষের পাখসাট। ছিটকে যাচ্ছে তারার ফুলকি। গাছপালা, ঝোপঝাড় সব যেন মুণ্ডা-জুয়াংদের সাসানদিরি কিংবা তাদের নানা রকমের বোঙা, সব জীবন্ত। কিন্তু খালি অর্ধেকটা। চট করে জানান দেবে না কেউ যে তারা জ্যান্ত। বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে বুনো পোকার এরোপ্লেন। গায়ের মলমের গন্ধে তারা ছিটকে বেরিয়ে যায় ঝোপঝাড়ে অন্য প্রাণীর সন্ধানে। ঝিঁঝি কোমল ধা-এ ঐকতান শুরু করে। ক্রমশ চড়ে, আরও চড়ে, তারপর পঞ্চমে গিয়ে অবশেষে ঝমঝম করে বাজতে থাকে ঘুঙুর। সাবধান, খুব সাবধান, ফিসফিস করে কে কাকে বলে। শহরের ক্লাবের হঠাৎ-অন্ধকারের থেকে এই প্রাকৃতিক অন্ধকার অনেকগুণ নিবিড়। কিন্তু…ওইরকম অশালীন কী, অশ্লীল ? মনে তো হয় না। এই অন্ধকারের একমাত্র বিশেষণ হয়, ‘সাবলাইম।’ কিন্তু যে যেভাবে নেয়। টর্চের শহরে আলোর বিন্দু যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়। জোনাকির চেয়ে জোরালো, স্থায়ী আলো। একমাত্র মালিকের ইচ্ছেতে নেভে, একদম মানায় না। এই জঙ্গুলে আঁধারে হায়নার জ্বলজ্বলে চোখই বেশি মানানসই। মুণ্ডা বসতি থেকে হল্লার আওয়াজ, অস্পষ্ট গান, হাওয়ায়-হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়। কখনও নিকট, কখনও দূর। টর্চের খেলা চলে। দুটো বিন্দু একত্র হয়, তিনটে। তারপর টুক করে নিভে যায়। একটা টর্চ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে চলে যায়। যেখানে মিটমিটে হলেও মানুষের আলো, মানুষের হল্লা। জংলি হলেও মানুষ-গলার গান একঘেয়ে সুরে, ধামসা মাদল কখনও, অনভ্যাসের এবং দিশি হলেও মহুল মদ।
“আমি এত রিস্ক নিতে পারব না,” অন্ধকারের মধ্যে একজনের চিন্তা ডানা মেলে উড়ে গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল কেঁদ গাছের নীচের ডালে।
“প্ল্যানটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে, সেটাই এখনও জানা গেল না,” আর একজনের ভাবনা জোনাকিদের সঙ্গে উড়ে বেড়ায়। দপ করে জ্বলে উঠছে এখানে, ওখানে।
“আগাপাশতলা কিছুই তো জানি না। বিগিনিং, মিডল আর এন্ড।”
“এত ভয় জীবনে কখনও করেনি।”
“বেশ একসাইটিং লাগছে আমার। জীবনটা কী? একটা বাঁধা পথে চলা আর চলা, যতক্ষণ না বাঁধা পথ শেষ হয়। তার চেয়ে এরকম অন্ধকার, রহস্য, এরকম সাসপেন্স ভাল।”
“কীভাবে ওকে একা পাওয়া যায়!”
“কোথায় গেল ও, যাকে নজর রাখতে বলেছিলাম সে কি রাখছে?”
“একজনের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করা খুব সহজ। কিন্তু তার উপর নজর রাখা হয়েছে।”
“কী করে ওকে একা পাওয়া যায়?”
“এত ভয় আমি জীবনে পাইনি।”
“এতটা রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”
জোনাকি উড়ে যায়, তারা খসতে থাকে, রাতের আকাশ খণ্ড-খণ্ড আলোর দীপিকা হয়ে তাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যায়।
ধামসা-মাদল বাজতে থাকে, গান হতে থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। মহুয়ার উৎসব বাঁধনছাড়া হয়ে যায়, তারপর তারায় ভরা আকাশের তলায় ঘুমন্ত দেহগুলি ছড়িয়ে থাকে।
কে যেন তার কানে কানে বলতে থাকে, “আরে ইয়ার বোল তো দো, কিসকো আচ্ছা লাগতা?”
সে বলে, “উও জো খিলাড়ি সেক্সি বেব হ্যায় না, উও মেরি দিল কী আগ।”
“দিল কী আগ তো, দিল কী বাত করো।”
“আগ হ্যায় না আগ আগ!”