ট্রেকার্স (Trekkers) : 10
৭/২ বাড়িটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। তিন ভাই, প্রত্যেকের একটি করে স্ত্রী এবং সর্বসাকুল্যে পাঁচটি ছেলেমেয়ে বাড়িতে। বড়জন নিঃসন্তান, বাকিদের মধ্যে মেজ-র তিন ও ছোট-র দুটি। মেজ-র উপরের দুটি ছেলে, একজন কাজকর্ম করছে আর একজন খুঁজছে। ছোটটি মেয়ে, সে পড়াশোনা করছে। ছোটরও দুটি ছেলে। বড় রূপরাজ আজ পনেরো দিন ধরে নিখোঁজ। পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে। এখনও পর্যন্ত কিছু কিনারা করতে পারেনি।
জ্যাঠা বলছেন, “আরও বকো সবাই মিলে, এ আমাদের কাল নয় যে কেউ কানমলা সইবে।”
জেঠিমা বলছেন, “ছেলেটা জেদি সবাই জানে। জোর করে তাকে কিছু করা যাবে না, তবু সায়েন্স নিল না বলে তোমরা বাপ-দাদারা সব তাকে কম শুনিয়েছ?”
“সেইজন্য এতদিন পরে সে বাড়ি থেকে পালাল, কী যে বলো বউদি।” রূপরাজের বাবা বললেন।
বউদি বললেন, “আমি জেনারালি বলছি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের কখন কীসে লেগে যায়।”
এত কিছুর মধ্যে রূপরাজের মা অজন্তা একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছেন। প্রথমটা ছিল শক, তারপর থেকে তিনি ভাবছেন, শুধু ভেবে যাচ্ছেন। রূপ যে বাড়ির কারও সঙ্গেই তার ভাবনা-চিন্তা ইদানীং ভাগ করত না এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এঁদের একটু সেকেলে ধরনের বাড়ি। রূপ ভেতরে-ভেতরে একটু বিদ্রোহী ছিল। গতানুগতিক ভাবনাচিন্তা সইতে পারত না। একটু যেন রাফ, কর্কশ, রূঢ় হয়ে উঠেছিল ইদানীং। ভেতরে-ভেতরে কী চলছিল? ‘বন্ধুদের সঙ্গে একটা আউটিং-এ যাচ্ছি’, গুছোনো শেষ হয়ে গেলে এই তার প্রথম কথা।
“কোথায় রে?”
“ধরো সুন্দরবন।”
“ধরতে হবে কেন, সত্যি-সত্যি কোথায় যাচ্ছিস?”
“সব কিছুতেই তোমাদের কৈফিয়ত চাওয়ার কী আছে? বড় হয়ে যাইনি এখনও?”
“একে কৈফিয়ত বলে? যত বড় হয়েই যাক, লোকে বাড়িতে তো বলে যায়।”
“দিঘা যাচ্ছি। দু’-চার দিন থাকব। যদি ভাল লেগে যায়, আর একটু এক্সপ্লোর করব। ভাববে না একদম।”
বাস খতম। ওইটুকুর বেশি সে আর কিছু বলেনি। সাতদিন হয়ে যাওয়ার পর আরিয়ানের বাড়ি থেকে ফোন এল, “রূপরাজ কি ফিরেছে?”
“না, আমরাও ভাবছি। তবে ও বলে গিয়েছিল, একটু দেরিও হতে পারে।”
“তাই বলুন, যাক।”
চোদ্দো দিন হয়ে যাওয়ার পর ওঁরা পুলিশে ডায়েরি করলেন। আর তখনই জানা গেল, ওদের সঙ্গে গিয়েছে দিয়া আর বাবাই নামে দুটি মেয়ে এবং আরও একটি ছেলে যার নাম উজ্জ্বল। শুকতারা বলে একটি মেয়ের যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যায়নি। এবারই তো ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে গেল। বিশেষত রূপরাজের বাড়িতে। এটা কি একটা গ্রুপ ইলোপমেন্ট? হঠাৎ প্রেমে পড়বার ছেলে তো রূপ নয়। যদি বা পড়ে, বাড়িতে জানাল না, কারও সম্মতি বা আপত্তি আছে কিনা জানল না, হঠাৎ এরকম ডুব দিল? সকলেই ছাত্র, কারওই কোনও রোজগার নেই। তখনই কোনও গ্যাং-এর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কাটা সবাইকে চেপে ধরে। যা দিনকাল পড়েছে।
রূপ যতই রাফ হোক, মন্দ কিছু যে সে করতে পারে না এ বিষয়ে অজন্তা নিশ্চিত। তাকে চট করে কেউ কাবু করতে পারবে না, এ বিষয়েও তিনি নিশ্চিত। মেয়ে দু’টির জন্যেই কি ওরা বিপদে পড়ল? দিঘায় পুলিশ চিরুনি তল্লাসি চালিয়েছে। কোনও পাত্তাই করতে পারেনি।
বাবাই যেদিন প্রথম কলেজ গেল হইচই, “এতদিন কোথায় ডুব মেরেছিলি?” বাবাই ঈপ্সাকে লক্ষ্য করছিল, ঈপ্সা বলল,“সত্যি, তুই একটা দেখালি বাবাই, দশ দিন অ্যাবসেন্ট। সেদিনটাই বা কী করলি?”
“কী করেছি?” বাবাই শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আরে, আলো নেবার পর তো তোকে আর দেখতেই পেলুম না। আবার যখন জ্বলল অনেক খুঁজেও তোকে পেলুম না। কে যেন বলল, তুই চলে গিয়েছিস। আমার খুব খারাপ লাগছিল। হঠাৎ আলো নেভায় তুই বোধহয় খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলি, আমার ওপর রাগ করেছিস?”
বাবাই বলল, “কোথায়-কোথায় খুঁজেছিলি?”
“এনটায়ার হল, বিহাইন্ড দ্য কাউন্টার, টয়লেট।”
“কে তোকে বলল আমি বাড়ি চলে গিয়েছি?”
“কে যেন কে যেন, দাঁড়া মনে করার চেষ্টা করি।”
“আমার চেনা কেউ?”
“উঁহু, তুই কী করে চিনবি? তোকে র্যান্ডম ক’জনের সঙ্গে আলাপ করালাম, তোর কি মনে থাকবে? আমিও সবাইকে থোড়ি চিনি।”
“আলো নিভে যেতে কী করলি?”
ঈপ্সা বলল, “সামবডি কিসড্ মি, সামবডি ট্রায়েড টু পাম্প মাই বলস্। দিয়েছি কামড়ে। তারপর তোকে খুঁজতে গিয়েছি টয়লেটে। সেখানে আবার দেখি দু’জন জড়াজড়ি। বেরিয়ে এসে আর একটা টয়লেট ফাঁকা ছিল। যতক্ষণ না আলো এল ওইখানেই ছিলাম। আলো এল, আমি বেরিয়ে তোকে আরও খুঁজলুম। ওঃ হো রণবীর, ওই পাঞ্জাবি ছেলেটা বলল, ও তো চলে গিয়েছে।”
“রণবীর?”
“তুই চিনবি না, রণবীর কপুর।”
“ঈপ্সা, তুই তো জানতিস এখানে এইসব হয়। আমাকে নিয়ে গেলি কেন? যদি বা নিয়ে গেলি, বলে দিলে পারতিস।
ঈপ্সা বলল, “তুই খুব রাগ করেছিস না? আমি সত্যি জানতাম না রে দশ-পনেরো মিনিট এরকম আলো নিভিয়ে রাখবে। ভ্যালেনটাইন তো, মাফ করে দে। বাবাইয়ের চোখদুটো হঠাৎ জ্বলে উঠল। সে বলল, “ভ্যালেনটাইন মাই ফুট। ডার্টি ডগস্, অ্যাম সোয়ারিং টু টিচ দেম আ লেস্ন”
তার জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল ঈপ্সা। বলল, “কী হয়েছে রে বাবাই?”
“নেভার মাইন্ড,” বাবাই সেখান থেকে সরে গেল। হঠাৎ তার মনের মধ্যে একটা আগুনের শিখার মতো দপ করে জ্বলে উঠল, সেইসঙ্গে ঘেন্না। সে বরাবর মাথা-ঠান্ডা মেয়ে। কেন যে আজ ঈপ্সার সঙ্গে কথা বলার পর তার এই মুড বদল হল, সে জানে না। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে। ঈপ্সার কথা থেকে মনে হল, ও কিছুই জানে না। তবে একটু-আধটু এইসব ওরা ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। যদি শোনে তাকে আর দিয়াকে ড্রাগ দিয়ে অচেতন করা হয়েছিল, কী প্রতিক্রিয়া হবে ঈপ্সার? যদি শোনে সেই অচেতন দেহ দুটোর উপর জবরদস্তি চালিয়েছে কারা চূড়ান্ত কাপুরুষের মতো, তা হলে? তা হলেই বা কী অবস্থা হবে ঈপ্সার? শুধু তাকে আর দিয়াকেই এরা ভিকটিমাইজ করল কেন সেটাও একটা মস্ত বড় প্রশ্ন। দরকারের সময়ে উজ্জ্বলের সাহায্য পেয়েছে, দিয়া যে নিজে ভিক্টিম সে-ও অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু এবার তাকেই রাশটা নিতে হবে। ঈপ্সা যতটা দেখাচ্ছে, ততটা নির্দোষ কি? ওকে ওখানে নিয়ে যাবার জন্যে অত পীড়াপীড়ি করেছিল কেন, বাজি ছিল নাকি কারও সঙ্গে? কাউকে কি সে কখনও অপমান করেছে নিজের অজ্ঞাতে? কোনওরকম কেতা নেওয়া, মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, এরকম কিছু? মনে করতে পারল না সে। একমাত্র সে-ই ভ্যালেনটাইন। সেটার কোনও জবাব সে দেয়নি। কিন্তু সেখানে তো কারও নাম ছিল না। পাশ থেকে ঈপ্সা ঠেলল, “সার তোর দিকে তাকাচ্ছেন, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস?” হুঁশে ফিরে আসে বাবাই।
ক্লাসের শেষে সে খুব হালকা গলায় বলল, “রণবীর কপুর কে রে?”
“ওই তো, ‘ক্রাশ’-এর সেক্রেটারি।”
“বুঝলাম, ওর পরিচয়টা কী?”
“পরিচয় মানে তো বাবার পরিচয়? ওর বাবা জেনসেন্স-এর সিইও, মা-ও কোথায় যেন এনজিও চালান। ব্যাপক কামায়।”
“ও নিজে?”
“ও নিজে… বোধহয় হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করছে। কেন, ইন্টারেস্টেড?”
গা জ্বলে গেল বাবাইয়ের। বলল, “হোটেল ম্যানেজমেন্ট, তা হলে সেদিনের ব্যবস্থাও নিশ্চয়, ও-ই করেছে সব।”
“তা বলতে পারি না, তবে সেক্রেটারি তো! ওর একটা দায়িত্ব আছে।”
“ওই বাড়িটা কার, রণবীর কপুরের?”
“না তো! ওটা তো ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।”
“তুই যে বলেছিলি, কারও না কারও বাড়িতে হয়।”
ঈপ্সার কাছে যেটুকু জানা গেল, রণবীর কপুর সেক্রেটারি। জনৈক দেবার্ক সরকার প্রেসিডেন্ট, মেম্বার অনেক। তবে নিয়মিত যারা যায় তাদের সংখ্যা কম। কার অত সময় আছে প্রতি শনিবার হল্লা করতে যাবে? কারও বাড়িতে হয়। তবে বাড়িগুলো একটু অদ্ভুত। যেদিন বাপ-মা কেউ থাকেন না, বা যার বাড়িতে অন্য আলাদা মহল আছে, সেখানেই হয় এগুলো। সাধারণত মিউজিকের সঙ্গে নাচ, আড্ডা, কেউ কেউ ড্রাগ নেয়, বোতলও চলে। ঈপ্সারা কেউ এই ক্লাবের আসল চরিত্রের কথা বাড়িতে বলে না, তা বললে যাওয়া একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। ওরা যেদিন যায়, বলেই দেয় ড্রাগ-ফাগ চলবে না। বিশেষ বিশেষ দিনে খুব ফুর্তির আয়োজন হয়, যেমন সেদিন হয়েছিল। দেশাই সারের ক্লাসের সৌজন্যে ওখানে অনেক অন্য কলেজের বা স্ট্রিমের বন্ধুদের সঙ্গে জানাশোনা ওদের। রূপ যেমন সেদিন প্রথম গেল, দিয়া মাঝে মাঝে যায়। দিয়া খুব পিকিউলিয়ার, সবাই ওকে জব্দ করবার কথা ভাবে।
“সে কী ? ও তো এমনিতেই ডিপ্রেস্ড, ওকে জব্দ করবার ভাবনা ইনহিউম্যান।”
ঈপ্সা বলল, “দেখ বাবাই তুই সব কথা জানিস না, কমেন্ট করবি না। দিয়ার অনেক অ্যাডমায়রার আছে। কিন্তু ও সবাইকে এমন তাচ্ছিল্য করে যে, আমাদেরই গা জ্বলে যায়। হয়েছে-হয়েছে তোর চেহারা সুন্দর, না হয় তুই অনেক টাকার মালিক, ওরকম যেন আর নেই! এই তো শুকতারাই বিশাল বড়লোক, গ্ল্যামারাস। কই অমন তো করে না?”
বাবাই বলল, “ও তাই ছেলেদের রাগ ওকে বাগে পাচ্ছে না বলে? আর তুই একটা মেয়ে হয়ে জিনিসটাকে সাপোর্ট করছিস, জাস্টিফাই করছিস? বাঃ।”
“ছেলেমেয়ে, ফেমিনিস্ট, জেন্ডার ডিফারেন্স এসব ইতিহাস হয়ে গিয়েছে বুঝলি বাবাই। তোরা গ্রামে থাকিস বলে টের পাস না। এখন সবাই সমান।”
বাবাই বলল, “হ্যাঁ, সবাই সমান বলেই কাগজভর্তি বধূহত্যা, বধূ নির্যাতন আর রেপের খবর। আচ্ছা ঈপ্সা, তোকে কেউ অজ্ঞান করে রেপ করলে তোর কেমন লাগবে?”
“অজ্ঞান কী করে করবে?” ঈপ্সা অবাক।
“ধর, তোর ড্রিঙ্কের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিল।” বাবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
“কার এত সাহস আছে?” ঈপ্সা তেড়ে উঠল।
“ধর না এমন ঘটল, কী করবি?” বাবাইয়ের হেলদোল নেই।
“পুলিশে খবর দেব, সে মক্কেলকে যদি পাই চোখ খুবলে নেব, জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব।”
“গুড, তুই প্রতিহিংসার কথা ভাবছিস, হিন্দি সিনেমা।”
“তুই কি বলতে চাস ছেড়ে দেব লোকটাকে?”
“তুই তো জানিসই না কে, জ্ঞান হতে দেখলি তোর জামাকাপড়ে রক্ত। সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, বিশেষ-বিশেষ জায়গা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।”
“বাবা, তুই এমন করে বলছিস, যেন সত্যি-সত্যি এরকম ঘটেছে।”
“ঈপ্সা, তুই কাগজ পড়িস না? ক’দিন আগেই গোয়ার আঞ্জুনা বিচে একটা মেয়ের অবিকল এই দশা হয়েছিল। তাকে আবার জলের ধারে ফেলে রাখা হয়েছিল, যাতে অজ্ঞান অবস্থায় মেয়েটা ডুবে মরে যায়। গেলও তাই। ওর জায়গায় নিজেকে কল্পনা কর। তারপর গ্রাম শহর, জেন্ডার ডিফারেন্স, দিয়াকে জব্দ করা, এসব বিষয়ে কথা বলতে আসিস।”
বাবাই ঈপ্সার পাশ থেকে বেরিয়ে গেল। রাগ চোখের জল হয়ে ফেটে বেরোবার উপক্রম হয়েছিল। সে অনেক কষ্টে বকে ধমকে তাকে ভেতরে পাঠায়।