Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » টুথব্রাশ || Sharadindu Bandyopadhyay

টুথব্রাশ || Sharadindu Bandyopadhyay

প্রসঙ্গটি বৈষয়িক। অপিচ মনস্তত্ত্ব যৌনতত্ত্বের সঙ্গেও ইহার কিঞ্চিৎ সম্বন্ধ আছে।

রসশাস্ত্র বিষয়বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে। সুতরাং মানুষের মৌলিক মূল্য লইয়া দরকষাকষি রসের হাটে চলিবে কি না তাহাতে সন্দেহ আছে। হিউম্যান ভ্যালুস কথাটা শুধু বিদেশী নয়, অত্যন্ত অর্বাচীন।

.

সুবোধবাবুর মস্তকে একটি অত্যাশ্চর্য টাক ছিল। টাক সাধারণত মস্তকের সম্মুখভাগে বঙ্গোপসাগরের আকারে পড়িয়া থাকে, ইহাই রীতি। সুবোধবাবুকে দেখিয়া কিন্তু কেহই সন্দেহ করিতে পারিত না যে, তাঁহার টেরি কাটা মস্তকের সমস্ত পশ্চাদ্ভাগটা উষর নির্লোমতায় একেবারে ধু ধু করিতেছে। তাঁহার চরিত্রেও, বোধ করি, এমনই একটা ধোঁকালাগানো অ-গতানুগতিক বৈচিত্র্য ছিল, সম্মুখ দেখিয়া সহসা পশ্চাতের খবর পাওয়া যাইত না।

আমার সহিত অল্পদিনের জন্যই আলাপ হইয়াছিল; পশ্চিমের যে শহরে আমি বেড়াইতে গিয়াছিলাম, তিনি ছিলেন সেই শহরের একজন উন্নতিশীল ব্যবসাদার। ভদ্রলোকের বয়স পঁয়ত্রিশ হইতে চল্লিশের মধ্যে, ধীর প্রিয়ভাষী লোক, অত্যন্ত সাধারণ কথাও বেশ রস দিয়া বলিতে পারিতেন। আলাপের পূর্বে অন্য পাঁচজনের মুখে তাঁহার অখ্যাতি-সুখ্যাতি দুই-ই শুনিয়াছিলাম; তাহা হইতে এই ধারণা জন্মিয়াছিল যে, ব্যবসা-সম্পর্কে তিনি যেমন নিষ্ঠুর, তৎপূর্বে ও পরে তেমনি অমায়িক।

বাণিজ্য-ব্যপদেশে তাঁহার সংস্পর্শে আসি নাই বলিয়াই, বোধ হয়, সুবোধবাবুকে আমার ভাল লাগিয়াছিল। কার্পণ্য-দোষ তাঁহার ছিল না; প্রতি সন্ধ্যায় তাঁহার বাড়িতে বহু ভদ্রবেশী অভ্যাগতের ভিড় জমিত। সুবোধবাবুর আধুনিকা ও সুচটুলা স্ত্রীকে কেন্দ্র করিয়া একটি সামাজিক আসর গড়িয়া উঠিয়াছিল। তিনি নিজেও এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন; তাঁহার মোলায়েম হাসি-তামাসা এই সান্ধ্য সভার একটা উপভোগ্য উপাদান ছিল।

কেন জানি না, তাঁহাকে এই মজলিসের বায়ুমণ্ডলে রবারের রঙিন বেলুনের মতো নির্লিপ্ত সহজতায় ভাসিয়া বেড়াইতে দেখিয়া আমার মনে হইত, যেন তিনি মনের মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষের প্রত্যেক কথা ও কার্য ওজন করিতেছেন, তাহার মূল্য ধার্য করিতেছেন। এ বিষয়ে মুখে তিনি কিছুই বলিতেন না, তবু তাঁহার মনের এই তুলাদণ্ডটি যে সর্বদা সক্রিয় হইয়া আছে, তাহা অনুভব করিয়া আমি একটু অস্বস্তি বোধ করিতাম।

একদিন তিনি মৃদু হাসিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন, আচ্ছা, আপনি ছড়ি ব্যবহার করেন কেন, বলুন দেখি?

যুক্তিসম্মত কোনও উত্তরই ছিল না। বেড়াইতে বাহির হইবার সময় একটা ছড়ি হাতে না থাকিলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা ও নিঃসম্বল মনে হয়—এইটুকুই বলিতে পারি।

তাহাই বলিয়াছিলাম। উত্তরে তিনি আমার পানে সেই ওজনকরা দৃষ্টি ফিরাইয়া একটু হাসিয়াছিলেন মাত্র, কিন্তু তাঁহার কাছে এই অকারণ ছড়ি বহন করিয়া বেড়ানো যে একান্ত অনাবশ্যক শক্তিক্ষয়, তাহা অনুভব করিয়াছিলাম।

মনুষ্যচরিত্রের গুঢ় মর্ম উদঘাটন করিতে যাঁহারা অভ্যস্ত, তাঁহারা হয়তো সুবোধবাবুর বিচিত্র টাক ও অন্যান্য বাহ্য অভিব্যক্তি হইতে তাঁহার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ধরিয়া ফেলিতে পারিবেন, কিন্তু এক মাসের পরিচয়ের ফলে তিনি আমার কাছে যেন একটু আবছায়া রহিয়া গিয়াছেন। এমন কি, শেষের যে গুরুতর ঘটনাটা একসঙ্গে বজ্র-বিদ্যতের মতো তাঁহার মাথার উপর ফাটিয়া পড়িয়াছিল, তাহার উগ্র। আলোকেও লোকটিকে স্পষ্টভাবে চিনিতে পারি নাই। হয়তো আমারই নির্বুদ্ধিতা, কোনও বস্তুকে যাচাই করিয়া তাহার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করিবার বিদ্যা এত বয়সেও অর্জন করিতে পারি নাই। অথচ শুনিয়াছি, এই বিদ্যাটাই নাকি চরম বিদ্যা শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমন কি দর্শনশাস্ত্রেরও শেষ সাধনা।

গুরুতর সংবাদটি আমাকে যিনি প্রথম দিলেন, তিনি সম্ভবত সুবোধবাবুর ব্যবসায়-ঘটিত বন্ধু; উত্তেজনা-উদ্ভাসিত মুখে বলিলেন, খবর শুনেছেন বোধ হয়?

কিসের খবর?

শোনেননি তা হলে! হাস্যোজ্জ্বল ক্ষুদ্র চক্ষু দুইটি আকাশের পানে তুলিয়া তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন, বড়ই দুঃসংবাদ। সুবোধবাবুর স্ত্রী,—তাঁকে কাল রাত্তির থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

সেকি! কোথায় গেলেন তিনি?

যা শুনছি–এক ছোকরা খুব ঘন ঘন যাতায়াত করত, তার সঙ্গেই নাকি কাল রাত্রে—। তাঁহার বাম চক্ষুটি হঠাৎ মুদিত হইয়া গেল।

মোটের উপর খবরটা যে মিথ্যা নয়, তাহা আরও কয়েকজন জানাইয়া গেলেন। কেহ স্ত্রী-স্বাধীনতার ধিক্কার দিলেন; কেহ বা গলা খাটো করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, ঠিক এই ব্যাপারটি যে ঘটিবে, তাহা তিনি পুরা এক বৎসর পূর্বে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন। যে ব্যক্তির মস্তকের পশ্চাদ্দিকে টাক, এবং বকেয়া টাকা না পাইলে স্বজাতি বাঙালীর নামে যে মোকদ্দমা করিতে দ্বিধা করে না, তাহার স্ত্রী যে-ইত্যাদি।

সুবোধবাবুর কথা ভাবিয়া দুঃখ হইল। নিরপরাধ হইয়াও যাহারা অপরাধীর অধিক লজ্জা ভোগ। করে, তাঁহার অবস্থা তাহাদেরই মতো। সহানুভূতি জানাইবার বন্ধুর হয়তো অভাব হয় না, কিন্তু মুখের সহানুভূতিকে চোখের বিদ্রূপ যেখানে প্রতি মুহূর্তে খণ্ডিত করিয়া দিতেছে, সেখানে সহানুভূতির মতো নিষ্ঠুর পীড়ন আর নাই। তাই মজা-দেখা বন্ধুর মতো সমবেদনার ছুতায় তাঁহার বাড়িতে গিয়া ধৃষ্টতা করিতে সংকোচ বোধ হইতে লাগিল।

তবু না গিয়াও থাকিতে পারিলাম না। মনের গহনে একটা নিষ্ঠুর শাপদ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, সুবোধবাবুর মর্মপীড়া প্রত্যক্ষ করিবার জন্য সে-ই বোধ হয় সন্ধ্যার সময় আমাকে তাঁহার বাড়িতে টানিয়া লইয়া গেল।

অন্য দিনের মতো বাড়িতে মজলিসী বন্ধুরা কেহ নাই। বারান্দায় একাকী বসিয়া সুবোধবাবু মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে হাত বুলাইতেছেন; আমাকে দেখিয়া অন্যান্য দিনের মতো সহাস্য সমাদরে আহ্বান করিলেন, আসুন আসুন!

স্ত্রী কুলত্যাগ করিলে মানুষ ঠিক কিভাবে আচরণ করিয়া থাকে, তাহার অভিজ্ঞতা না থাকিলেও সুবোধবাবুর ভাবগতিক স্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইল না। যেন কিছুই হয় নাই। হাসিমুখে দুই চারিটা সাময়িক প্রসঙ্গের আলোচনা, এমন কি একবার একটা রসিকতা পর্যন্ত করিয়া ফেলিলেন।

বেজায় অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। যাঁহার দুঃখে সান্ত্বনা দিতে আসিয়াছি, তিনি যদি দুঃখটাকে গায়েই না মাখেন, তবে সান্ত্বনা দিব কাহাকে? অপদস্থের মতো নীরবে হেঁটমুখে বসিয়া রহিলাম, প্রসঙ্গটা উত্থাপন করিতেই পারিলাম না।

দিনের আলো নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছিল। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর এক সময় চোখ তুলিয়া দেখিলাম, সুবোধবাবু তাঁহার তৌল করা চক্ষু দিয়া আমার মনের কথাটা ওজন করিতেছেন। মুখে একটু হাসি।

চোখাচোখি হইতেই তিনি মৃদুস্বরে হাসিয়া উঠিলেন; তারপর বাগানের একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের ডগার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, আমার টুথব্রাশটা কে চুরি করে নিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না।

অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গে চমকিয়া উঠিলাম, মুখ দিয়া আপনিই বাহির হইয়া গেল, টুথব্রাশ!

তিনি তেমনই অর্ধ-নির্লিপ্তভাবে বলিলেন, হ্যাঁ, টুথব্রাশ। তুচ্ছ জিনিস সংসারযাত্রা নির্বাহের একটা সামান্য উপকরণ; যে লোকটা চুরি করেছে, তার রুচির প্রশংসা করতে পারি না। কিন্তু তবু সাবধান হওয়া দরকার। ভাবছি, আর টুথব্রাশ কিনব না।

অবাক হইয়া তাঁহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। আমার দিকে সহসা চক্ষু নামাইয়া তিনি বলিলেন, আপনি কখনও দাঁতন ব্যবহার করেছেন? শুনেছি, স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও ভাল। মনে করছি, এবার থেকে ইউক্যালিপ্টাসের দাঁতন ব্যবহার করব। সস্তাও হবে, আর কিছু না হোক, চুরি যাবার ভয় থাকবে না। দাঁতন কেউ চুরি করবে না!—বলিয়া হঠাৎ একটু জোরে হাসিয়া উঠিলেন।

তারপর সুবোধবাবুর সহিত আর দেখা হয় নাই। তাই খবরের কাগজে মাঝে মাঝে তাঁহার নাম দেখিতে পাই; তাহাতে মনে হয়, তাঁহার মোহমুক্ত বিষয়বুদ্ধি তাঁহাকে বৈষয়িক উন্নতির পথেই লইয়া চলিয়াছে।

তিনি আবার টুথব্রাশ কিনিয়াছেন, অথবা দাঁতন দিয়াই কাজ চালাইতেছেন, সে সংবাদ কিন্তু খবরের কাগজে পাই নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress