টালিগঞ্জে পটললাল
চিরকাল তো ছিল না। আজ সিনেমা বলতে সবাই হলিউড-হলিউড করে যাচ্ছে। আমেরিকার লস এঞ্জেলস শহরের গোলমেলে শহরতলি এখন হলিউড নামে পৃথিবীর চলচ্চিত্রের রাজধানী। অন্যদিকে হৃতগৌরব, দীর্ণ, জীর্ণ টালিগঞ্জ বছরের পর বছর ধুকছে। এবং সবচেয়ে অপমানের কথা এখন ওই ম্লেচ্ছদেশীয় হলিউডের অনুকরণে টালিগঞ্জকে টলিউড বলা হয়। কিন্তু ভাল করে অবশ্যই মনে আছে, অন্তত মনে না থাকার কথা নয়, এই টালিগঞ্জের সঙ্গে মিলিয়েই একদা হলিউডকে হলিগঞ্জ বলা হত।
এর সব কথা ডাক্তার সহদেব শুকের জানার কথা নয়। তিনি তাঁর পার্কসার্কাসের চেম্বারে বসে শেষ রোগী চলে যাওয়ার পরে হোমিওপ্যাথিক কবিতা লিখছিলেন।
সহদেববাবু হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, কবিতাও তিনি হোমিওপ্যাথিক ডোজে লেখেন। তাঁর কবিতায় তেজ বেশি, যদিও আকারে ছোট।
একটু সময় পেলেই সহদেববাবু কাব্যচর্চা করেন। চর্চা মানে অবশ্য পাঠ নয়। শুধু লেখা। লেখার জন্যেই লিখে যাওয়া।
এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে মিস জুলেখার শেষতম স্বামী পটললালকে উদ্ধার করার পর তার গোয়েন্দাগিরিতে রীতিমতো হাতযশ হয় (পটললাল ও মিস জুলেখা দ্রষ্টব্য)। সহদেববাবু এখন ডাকাতি, রক্তারক্তির মধ্যে নেই, তিনি খুচখাচ পালিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, দলিল-উইল জাল, তহবিল তছরূপ, জোচ্চুরি এইসব তদন্ত করেন। তবে তার পছন্দের কাজ হল, ব্যাভিচার, নারী হরণ, ফুসলানো ইত্যাদি সব স্ত্রী ঘটিত ব্যাপার।
কিন্তু কড়েয়া রোডে তাঁর হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারখানায় রোগী গিজগিজ করে। কদাচিৎ সহদেব ডাক্তার সময় পান রোগী দেখা ছাড়া, ওষুধ দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু করার। এবং এতে তার চমৎকার আয় হয়। আর সেই জন্যই হয়তো সহদেববাবুর মন চায় প্রাণ ভরে পদ্য লিখতে এবং সুযোগ পেলে গোয়েন্দাগিরির উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়তে।
এই তো আজই কলকাতার বনেদি পাড়া গুরুসদয় দত্ত রোডের বিখ্যাত বড়লোক কোটিপতি খান্ডোলিয়ার বাড়ি থেকে একটা গোলমেলে কেস এসেছিল তার হাতে।
খান্ডোলিয়া পরিবারের প্রধান পেশা স্মাগলিং। দুবাইতে, সিঙ্গাপুরে, হংকংয়ে তাদের কাজকারবার, যাতায়াত। এ বছর গ্রীষ্মকালে খান্ডোলিয়া পরিবারের প্রধান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়া সিঙ্গাপুর থেকে একটি কালো কুচকুচে পমেরেনিয়ান কুকুর বহুমূল্যে কিনে এনেছিলেন।
পমেরেনিয়ান হল ঝুলো ঝুলো লোমওয়ালা ফুটফুটে সাদা জাতের কুকুর। এ জাতের কুকুর অন্য কোনও রঙের প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু সিঙ্গাপুরের এই কুকুরটা হল অস্বাভাবিক কালো। এই কুকুরটি অত্যধিক দাম দিয়ে, দশ হাজার ডলারে ক্রয় করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণবাবু।
অবশ্য এর পেছনে তার একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধিও কাজ করেছিল।
নানা রকম ঝঞ্ঝাট, পুলিশ-আবগারি-আয়কর ইত্যাদির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়া সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চোরাকারবারির লাইন ছেড়ে দেবেন। নতুন ব্যবসায় যাবেন।
ব্যবসাটা ক্যাসেটের। ভিডিও ক্যাসেট। দূরদর্শনের জন্যে নয়, সরাসরি ভি সি পি-তে দেখানোর জন্যে, পঞ্চাশ মিনিটের আকাশি ছবি। পুরোপুরি নীল বা ব্লু-ফিল্ম যাকে বলে, তা নয়–সেন্সরের চোখে ধূলো দেবার জন্য একটু ঢাকাঢাকি থাকবে, একটু খোলাখুলিও থাকবে, তবে সেটা আলাদা প্রিন্টে, ছাড়পত্র পর্ষদের মাননীয় সদস্যদের সেটা দেখানো হবে না।
উত্তরপ্রদেশ, একটা ইউনাইটেড প্রভিন্সের, ইউ আর পি রয়েছে, ইংরেজি বানানে উত্তরপ্রদেশেও। ইউ পি অর্থাৎ ওপরে, আর সেই ওপরের ওপরে খান্ডোলিয়া পরগনা।
খান্ডোলিয়া পরগনার শেষ মনসবদার শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়া প্রথম যৌবনে উর্দুমিশ্রিত হিন্দি ভাষার কয়েকটি কাহানিয়া রচনা করেছিলেন। দুই-একটি গল্পের নাম এই রকম পার্বতীর সঙ্গে তিনদিন চাররাত। কিংবা গভীর রাতে দিঘির পারে।
গল্পগুলির নাম শুনেই কেমন আমিষ মনে হয় এবং সত্যিই তাই। পুরুষানুক্রমে নিরামিষভোজী উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সন্তান শ্রীকৃষ্ণবাবু বলা বাহুল্য, তাঁর সময় ও দেশের তুলনায় খুব আধুনিক ছিলেন। কিন্তু রক্ষণশীল গোঁড়া সম্পাদকেরা তার লেখা ছাপেনি।
তার নবযৌবনের সেই অবদমিত ইচ্ছা এখন শ্রীকৃষ্ণবাবু পূরণ করতে চান। তার ভিডিও ছবিগুলি তিনি নিজেই পরিচালনা করবেন বলে মনস্থ করছেন। এখন নায়িকা সংগ্রহে মন দিয়েছেন, একটু খলবলে উঠতি বয়সিনী তাঁর বিশেষ পছন্দ। তেমন তেমন নায়িকার সন্ধান পেলে তিনি নিজেই তার পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে সেই নায়িকার স্ক্রিন টেস্ট নিচ্ছেন। সম্প্রতি হালতুর মম মজুমদার তাঁর নজরে পড়েছে। কালো, ছিপছিপে অথচ উজ্জ্বলযৌবনা মম শহর ও শহরতলির যে কোনও ফাংশনের মুখ্য আকর্ষণ। বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার ফাঁকি দিয়েছে কিংবা খলনায়কের চোলি কা পিছের সঙ্গে মম যখন কোমর এবং কোমরের কাছাকাছি। জিনিসপত্র আন্দোলিত করে নাচে, স্বচ্ছ ও সামান্য বসনে, দর্শকবৃন্দও একইভাবে আন্দোলিত হতে থাকে।
সবই ঠিকঠাক ছিল।
গভীর রাতে দিঘির পারে মূল কাহিনিতে বেশ কয়েকটি স্ত্রী চরিত্র ছিল। কিন্তু মম মজুমদারের সুবাদে শ্রীকৃষ্ণবাবু স্ত্রী চরিত্র একটিতে দাঁড় করিয়েছেন। আগে ছিল দিঘির চার পারে চারটি সজীব ঘাঘরা কাঁচুলি পরিহিতা রঙচঙা দেহাতি রমণীর চরিত্র, এখন একাই মম মজুমদার।
শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়ার নতুন চিত্রনাট্যে দিঘির চার পারেই মম।
প্রথম পারে বৈষ্ণবীর ভূমিকায়। গলার কণ্ঠী, ললাটে চন্দন, পরিধানে অন্তর্বাসহীন হাঁটু পর্যন্ত তোলা দোভাজ সিফন শাড়ি। দ্বিতীয় পারে কোমরের নীচে স্বচ্ছ লুঙ্গি, উর্ধাঙ্গে শুধুমাত্র প্রায় স্বচ্ছ ওড়না।
চতুর্থ এবং শেষ পার একটু ছায়া ছায়া, একটু ধোঁয়া ধোঁয়া। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, চপলা নায়িকা। মম মজুমদার কী পরে আছেন কিংবা সত্যি কিছু পরে আছেন কি না?
তৃতীয় পার বাদ রয়ে গেল আমার এই বর্ণনায়। কিন্তু আমার কি ক্ষমতা আছে শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়ার কল্পনাশক্তি ব্যাখ্যা করার। তবু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। তৃতীয় পারে মম মজুমদার পারেই নেই। তিনি আছেন পারের কাছে জলে সিঁড়ির পইঠা ধরে চিত সাঁতার দিয়ে। ফিকে নীল জলের নীচে মাছের মতো ঝলমল করছে তার অনাবৃত শরীর।
শ্রীকৃষ্ণবাবু মম মজুমদারের ব্যাপারটা প্রায় কবজা করে ফেলেছেন। এখন আর এ নিয়ে তেমন কোনও চিন্তা নেই। ব্যবসায়িক ভাষায় বলা যায় ম্যানেজ করে ফেলেছেন।
শ্রীকৃষ্ণবাবু তার পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে এখন প্রায় প্রতিদিনই কুমারী মম মজুমদারের স্ক্রিন টেস্ট নিচ্ছেন। মম মজুমদার অবশ্য কখনও একা আসেন না। কোথাকার যেন, কুলমারি নাকি কী এক পরগণার গোঁড়া বনেদি কায়স্থকুলকন্যা, তাঁর রাখ-ঢাক অনেক।
মম মজুমদারের মা-বাবা থাকেন আসামের চা বাগানে। মম থাকেন হালতুতে মামার বাড়িতে। তার মামা হলেন জীবানন্দ দত্ত। অতীতের দিকপাল তবলাবাদক। কয়েকটি জলভরতি চিনেমাটির পেয়ালা দুহাতের দুটো কাঠি দিয়ে বাজিয়ে জলতরঙ্গ বাদক হিসেবে দত্তমশায় একদা দেশ বিখ্যাত রয়েছেন। এখন তিনি মম মজুমদারের এসকর্ট, সেক্রেটারি এবং সর্বোপরি অভিভাবক।
জীবানন্দবাবু বুদ্ধিমান লোক। বহুকাল এ লাইনে আছেন। স্ক্রিন টেস্টিংয়ের তিনি কিছু বোঝেন না, সুতরাং সে ব্যাপারে মোটেই নাক গলান না। ভাগিনেয়ীকে শ্রীকৃষ্ণবাবুর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে নীচের একটা বার-এ তিনি অপেক্ষা করেন। ঘণ্টা দুয়েক বাদে কাজ সেরে মম ফিরে আসে। ততক্ষণে জীবানন্দবাবু কয়েক গেলাস লাইম জিন, এক প্লেট তন্দুরি চিকেন খেয়ে নিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে বন্দোবস্ত করা আছে। বার-এ বিলটা তিনিই মিটিয়ে দেন।
এই পর্যন্ত ভালই চলছিল।
শ্রীকৃষ্ণবাবু নিজের নামেই শ্রীকৃষ্ণ ক্যাসেট কোম্পানি চালু করতে উদ্যোগী হলেন। এই সময়েই তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দুর্লভ পমেরেনিয়ানটি বহু মূল্যে কিনে আনেন।
কুকুরটির নামকরণ হয় ব্ল্যাক প্রিন্স। শ্রীকৃষ্ণবাবুর মনোবাসনা হল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের মতো তিনিও তার কালো কুকুরের লোগো দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ক্যাসেট বাজারে ছাপবেন। বিজ্ঞাপনে, প্রচারে, ক্যাসেটের কভারে সর্বত্র ব্ল্যাক প্রোফাইল ফটো থাকবে। নীচে লেখা থাকবে।
কুকুরও ভালবাসে
শ্রীকৃষ্ণ ক্যাসেট
০২.
পটললালের আগমন
মিস জুলেখার তৎকালীন পতিদেবতা পটললালকে উদ্ধার করে মিস জুলেখার ক্রোড়ে ফিরিয়ে দেওয়ার পরে অল্প কিছুদিন জুলেখা দম্পতির সঙ্গে ডাক্তার সহদেব শুকের যোগাযোগ, যাতায়াত ছিল।
তারপর, যেমন হয় ধীরে ধীরে ডাক্তার শুক নিজের কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ায় তাঁদের আর খোঁজখবর নিতে পারেননি, আর কার্যসিদ্ধি হওয়ার পর গোয়েন্দাকে, অসুখ সেরে যাওয়ার পরে ডাক্তারকে, মামলা জেতার পরে উকিলকে কেই বা খেয়াল রাখে, জুলেখা দম্পতিও যোগাযোগ রাখেননি। তাদের নিজের নিজের কাজকর্ম আছে।
জুলেখা অবশ্য গোড়ার দিকে একবার এসেছিল ওষুধ নিতে। না, কোনও অসুখ-বিসুখের ব্যাপার। নয়, তাঁর অসুবিধে দাঁড়িয়েছে তাঁর শরীরের আয়তন, মেদবৃদ্ধি নিয়ে।
মিস জুলেখা ভীষণ মোটা হয়ে গেছেন। বিশাল ভুঁড়ি হয়ে গেছে। নাচের মেয়েদের এরকম হয়। একটু ঢিল দিলেই বিসদৃশ মোটা হয়ে যেতে হয়।
এদিকে বিশাল দেহে, ধামার মতো ভুড়ি নিয়ে নৃত্য প্রদর্শন খুব মনোরম হয় না। বিশেষ করে আদিরসাত্মক নৃত্যদৃশ্য যে দর্শকেরা দেখতে আসে তারা খুব কোমল রুচির হয় না। তারা হলের মধ্যেই হাসাহাসি করে, শিস দেয়, টিটকিরি দেয়। এমনিতেই এ ধরনের নাচে কঠোর পরিশ্রম। তার ওপর ওই টিটকিরি, প্রতিবাদ। নাচের শেষে মিস জুলেখা কাঁদতে কাঁদতে স্টেজ থেকে উইংসে ফিরে চোখের জল মোছেন।
ডাঃ শুক অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি জানেন ওই স্থূলতা কোনও ওষুধে কমানো যাবে না। বেশি খাটতে হবে, কম খেতে হবে। এই হল এর একমাত্র চিকিৎসা।
বলা বাহুল্য, এই চিকিৎসা মিস জুলেখার মনঃপূত হয়নি। ডাঃ শুক প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, ভাজা, মিষ্টি বন্ধ। বাংলা মদ বন্ধ। কিন্তু এই তিনটি ছাড়া জুলেখার চলে না। বহুদিনের অভ্যেস।
ডাঃ শুক বুঝেছিলেন মিস জুলেখা মোটেই ব্যায়াম করার পাত্রী নয়, তা হলে নাচের তালিমই করে যেত, মেদ বাড়তে পারত না। তাই বলেছিলেন, দৈনিক দশ কেজি করে কয়লা ভাঙতে এবং চারবার করে তার ফ্ল্যাটের সবগুলো ঘরের মেঝে মুছতে।
কিন্তু চারবার না হলেও, ঘরের মেঝে যদিও বা দৈনিক দু-একবার মোছার চেষ্টা করা যায়, কয়লা ভাঙা অসম্ভব।
এমনিতেই আজকের বাজারে দশ কেজি কয়লার দাম কম নয়। তা ছাড়া এত কয়লা দিয়ে জুলেখা কী করবেন। কী কাজে লাগবে এত কয়লা, মাসে প্রায় আট মণ কয়লা। বলতে গেলে একটা রেলগাড়ির খোরাক। এদিকে জুলেখাদের গৃহে কয়লার উনুন কেন কোনওরকম উনুনই নেই। খাবার-দাবার, চা জলখাবার, সবই আসে হোটেল থেকে। খুব প্রয়োজনে একটা ছোট কেরোসিন স্টোভ আছে, সেটা ব্যবহার করা হয়।
সুতরাং মিস জুলেখা অন্তর্হিত হলেন। এবং তারপর আর আসেননি।
আজ হঠাৎ সকালবেলা চেম্বার ভাঙার মুখে পটললাল পাল এসে হাজির। পটললালকে অনেকদিন সহদেব দেখেননি। আজ দেখলেন, চেহারা খুব বদলায়নি। তবে মুখ গম্ভীর।
পটললালকে দেখে প্রীতি নমস্কার জানিয়ে ডাক্তার শুক জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন।
পটললাল একই রকম শুকনো মুখে জবাব দিলেন, মোটামুটি।
পটললাল মোটামুটি বলার সঙ্গে মুটির কথা মনে পড়ল ডাক্তার শুকের। তিনি প্রশ্ন করলেন, মিস জুলেখা? জুলেখা দেবী কেমন আছেন? আজকাল আর খবরের কাগজে যাত্রা-থিয়েটারে বিজ্ঞাপনে জুলেখা দেবীর নাম-টাম দেখতে পাই না।
পটললাল গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন, জুলেখা এখন কলকাতায় থাকে না।
সহদেব শুক কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, সে কী, কোথায় গেলেন উনি?
পটললাল বললেন, জুলেখা, দি গ্রেট মাদার ইন্ডিয়া সার্কাসে জয়েন করেছে। এখন বোধহয় দুবাইতে আছে। এখন আর নাচ করে না।
ডাক্তার শুক এই সংবাদে বেশ বিস্মিত হলেন, একটু থেমে তারপর বললেন, তা হলে এখন মিস জুলেখা কী করেন?
পটললাল মুখ তেতো করে বললেন, অন্য সময় কী করে বলতে পারব না, তবে সার্কাসের খেলার সময় বুকের ওপর হাতি তোলেন।
এই সংবাদে আরও চমকিত হলেন ডাক্তার শুক, বুকের ওপর হাতি তোলেন।
পটললাল বললেন, কাজটা তেমন মারাত্মক কিছু নয়। জুলেখা স্টেজের ওপরে চিত হয়ে শুয়ে থাকে, বুকের ওপর কাঠের পাটাতন দেয়া থাকে। একটা বড় হাতি এসে সেই পাটাতনের দুধারে সামনের দুপা দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর একটু ভেবে নিয়ে যোগ করল, হাতি যত বড় হবে, হাতির যত ওজন বেশি হবে, তত সুবিধে।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সহদেব ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি? কিন্তু কেন? ব্যাপারটা তো বোঝা যাচ্ছে না।
পটললাল এবার বুঝিয়ে বললেন, বুকের ওপর যে কাঠের তক্তাটা থাকে হাতির সামনের দুটো পায়ের চাপ তার দুদিকে পড়লে তক্তাটা ধনুকের মতো বেঁকে যায়। বুকের ওপর মোটেই চাপ পড়ে না। হাতি যত ভারী হবে তত বেশি বেঁকবে।
ডাঃ সহদেব শুকের বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে এরপর পটললাল বললেন, তবে সাহস লাগে। রিসকও আছে। হাতির পা একটু বেসামাল হলে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যাবে, মানে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে জুলেখা।
এই রকম প্রাথমিক আলাপ হয়ে যাওয়ার পরে সহদেব ডাক্তার এবার পটললাল পালের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কী প্রয়োজনে এসেছেন।
পটললাল যা বললেন, তার মোদ্দা কথা হল এই যে, জুলেখা চলে যাওয়ার পর থেকে তার খুব কষ্টে কাটছে। যাত্রা-থিয়েটারে আর সুবিধে নেই, এখন টালিগঞ্জে আছেন। এক প্রযোজকের ফাঁইফরমাস খাটেন, কোনওরকমে গ্রাসাচ্ছাদন চলে।
স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তার সহদেব শুক বুঝতে পারলেন, এটা কোনও চিকিৎসার ব্যাপার নয়, নিশ্চয়ই গোয়েন্দাগিরির কাজ। সুতরাং তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কাজটা কী?
পটললাল বললেন, একটা কুকুর খুঁজে দিতে হবে?
সহদেব গোয়েন্দা বললেন, আমাকে কুকুর খুঁজতে হবে?
পটললাল বললেন, কিন্তু আপনি তো সেবার আমাকে খুঁজে বার করেছিলেন।
সহদেববাবুর চিরকালই একটু ঠোঁটকাটা, তিনি বললেন, কিন্তু পটলবাবু, আপনি কী যা তা বলছেন। আপনি কি কুকুর? আপনি তো কুকুর নন।
একবার নিজের কানের পাতা দুটোর ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে এবং নিজের পশ্চাৎদেশ ঘাড় ঘুরিয়ে অবলোকন করে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে নিলেন পটললাল যে তিনি কুকুর নন, তারপর জানালেন, কিন্তু আপনাকে বলছি ডাক্তারবাবু, এটা কোনও সামান্য কুকুর নয়।
সহদেব গোয়েন্দা প্রায় স্বগতোক্তি করলেন, সামান্য কুকুর নয়? অসামান্য কুকুর? সে আবার কী? সেই সঙ্গে এ কথাও জানিয়ে দিলেন, গোয়েন্দার কাজে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমাকে ডাক্তারবাবু বলবেন না। আমাকে এস এস বলবেন, প্রথমে এস সহদেব পরে এস, শুক।
পটল বললেন, কুকুরের দাম দশ হাজার ডলার। শুনে এস এস বললেন, কুকুরটা কোথায় কেনা হয়েছিল?
পটললাল বললেন, সিঙ্গাপুরে স্যার।
এস এস বললেন, সে যা হোক, সিঙ্গাপুরি ডলারের এত দাম নয়, তবুও একটা কুকুরের দাম হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু কুকুর খোঁজার কাজ আমি করি না।
সত্যিই পটললাল কুকুর খোঁজার কাজ নিয়ে আসায় সহদেব গোয়েন্দা খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন। এমনকী তেমন তেমন না হলে নারী খোঁজার কেসও সবসময় তিনি নেন না।
মন-না-ভরানো, তুচ্ছ-অতি তুচ্ছ সব কেলেঙ্কারি যার মধ্যে কোনও উত্তেজনা নেই, রহস্যের ঘেরাটোপ নেই। সহদেব ডাক্তার ঠিক করেছেন যদি মিস জুলেখার কেসের মতো কেস পান, ভেবে দেখবেন, না হলে গোয়েন্দাগিরিতে যাবেন না।
তাই সহদেব ডাক্তার এখন সময় পেলেই কাব্যচর্চা করেন, তার রোগীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কবি। আছেন, দুজন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং কয়েকজন আধুনিক কবিও আছেন, এমনকী একজন নারীবাদী মহিলা কবিও আছেন।
এই অবস্থায় তার কাছে একটি কুকুর ঘটিত কেসও এসেছে। কবি-গোয়েন্দার জীবনে এটা একটা দুঃসহ অপমান। তাও কিনা প্রস্তাবটা এসেছে তার প্রিয় পাত্রী জুলেখার বর এই পটললালের কাছ থেকে।
০৩.
কবি সহদেব
কিন্তু আজ ডাক্তার সহদেব শুকের মনটা খুব প্রসন্ন। তা না হলে পটললালের ওই কুপ্রস্তাবে তিনি এতক্ষণ খেঁকিয়ে উঠে তাকে চেম্বার থেকে বার করে দিতেন।
কাল শেষ রাত থেকে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছেন সহদেববাবু। প্রতিদিন এর একটু পরেই তিনি মর্নিং-ওয়াকে বেরোন। কিন্তু আজ বৃষ্টির জন্যে বেরোতে পারলেন না। ফলে প্রাতঃভ্রমণের দেড় ঘণ্টা সময় চুটিয়ে কাব্যচর্চা করেছেন।
প্রথম দিকে সহদেববাবু শুধুই গান লিখতেন। কিন্তু আজকাল কবিতা লেখার দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। গান লেখার ঝামেলা অনেক, অনেক আটঘাট, সঞ্চারী-অন্তরা কত কিছু মেনে চলতে হয়।
কবিতা লেখা অনেক সোজা। খোলামেলা ব্যাপার। একটু তাল মিলিয়ে লিখে যাও, পারলে মিল দাও, মিল না দিলেও কিছু আসে যায় না। আর তেমন বেকায়দা দেখলে মুক্ত ছন্দ বা এলানো গদ্যে লিখলেই হয়ে যায়।
এই তো আজ সকালেই ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে খাতা কলম খোলার আগেই দাঁত মাজতে মাজতে সহদেববাবুর ফ্লো এসে গিয়েছিল। বড় বড় কবির মতো সহদেববাবুরও মনের মধ্যে ফ্লো এসে গেলে নিজেকে আর সামাল দিতে পারেন না।
আজ সকালেও তাই হল। বাঁ হাতটা টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ডান হাতের তর্জনীতে টুথপেস্ট বার করে লাগিয়ে তাই দিয়ে বাথরুমের আয়নায় কাঁচের ওপরে দ্রুতগতিতে লিখে ফেললেন।
রক্ত হরিতাভ
দন্ত মঞ্জন,
চড়ুই-গাংচিল
শালিক-খঞ্জন
শ্যালিকা ঠাকুরানি
নয়নে অঞ্জন।
আমারে দোষ দ্যায়
সে ব্যাটা কোনজন ৷
দুঃখের বিষয় এই কবিতাটি লিখতে প্রায় দশটাকা খরচ হয়েছিল সহদেব ডাক্তারের। একটা রঙিন টুথপেস্টের প্রায় আধাআধি ফুরিয়ে ফেলেছিলেন। বাথরুমের আয়নাটা যার ওপরে নীল টুথপেস্টে এই কাব্যচর্চা হয়েছিল সেটা জলে ধুয়ে পরিষ্কার করতে গিয়ে ভেঙে ফেলে সহদেববাবুর পরিচারিকা। তাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। সে বাসন মাজতে পারে, কাপড় কাঁচতে পারে, মেঝে মুছতে পারে কিন্তু। টুথপেস্ট মাখানো আয়না সাফ করার তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তার হাত থেকে স্লিপ করে। আয়নাটি চৌচির হয়ে যায়।
এই আয়নাটির ক্রয়মূল্য দেড়শো টাকা ধরলে আজ সকালের ফ্লো আসা কবিতাটির জন্যে। সহদেববাবুর গচ্চা গেল একশো ষাট টাকা। কিন্তু কেউ যদি ভেবে থাকেন যে আয়নার কাঁচে রঙিন টুথপেস্ট নিয়ে কবিতা লিখে সহদেববাবু ক্ষান্ত হয়েছিলেন, এতেই তার ফ্লো রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা হলে বলব এই কবি-গোয়েন্দার বিষয়ে তার কোনও ধারণাই গড়ে ওঠেনি।
দাঁত মাজার পরে ধীরেসুস্থে চায়ের টেবিলে বসে চা খেতে খেতে সহদেববাবু তার অতি প্রিয় নিউ মার্কেট থেকে কিনে আনা মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই কবিতার খাতায় ওই একই বিষয়ে, মানে সঁত মাজা নিয়ে কবিতা রচনায় মন দিলেন।
এবার অবশ্য রঙিন টুথপেস্ট দিয়ে নয়। বেছে বেছে বারো রঙের বারোটা ফেল্ট পেনের একটা সেট কিনেছেন সহদেববাবু, সেই কলমের সেট দিয়ে একেক পংক্তি একেক রঙে লিখতে লাগলেন তিনি। বলা বাহুল্য, রঙের বাহুল্যে এই কবিতাও যথেষ্ট খোলতাই হল।
সবুজ সুনীল দাঁতের মাজন,
তুমিই রাজ্ঞী তুমিই রাজন ॥
ঝিরঝির দিন ঝিরিঝিরি রাত
তাজ্জব বাত ঝকঝকে দাঁত।
ওগো সাদা ফেনা কেউ তো জানে না
তব কাছে মম কতখানি দেনা…
এই রকম লাইনের পর লাইন একটি দীর্ঘ পদ্য, দু পেয়ালা চা খেতে খেতে সহদেব শুক রচনা করে ফেললেন। সহদেববাবু তাঁর কবি পেশেন্টের দৌলতে ভালই জানেন যে এখন আর তব কিংবা মম এই জাতীয় প্রাচীন শব্দ কবিতায় ব্যবহার করা হয় না কিন্তু পরোয়া করেন না। তিনি তো আর আধুনিক কবিতা লিখছেন না, তিনি লিখছেন চিরায়ত জীবনধর্মী পদ্য।
এই তো চা খাওয়ার পরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বিভিন্ন টাডা মামলার বিবরণ, সঞ্জয় দত্ত উপাখ্যান, ইয়াকুব মেমন কাহিনি পাঠ করতে করতে ঝরঝর করে অনবদ্য ভঙ্গিতে লিখে ফেললেন:
টা-টা টাডা
তোর গাড়া
গরম গরম।
কাজু সাজু
আজু আজু
শরম শরম ॥
এইরকম চলেছে আজ সকালবেলা থেকে। বেলা হতে রোগী আসার সময় হয়ে যাওয়ায় মরক্কো লেদারের কবিতার খাতা নিয়ে সহদেববাবু তার চেম্বারে চলে এসেছেন, রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে পদ্য রচনা করে যাচ্ছেন, সেগুলো আকারে ক্ষুদ্র হলেও অকিঞ্চিৎকর নয়। বিভিন্ন রোগী দেখে মনে যেমন যেমন ভাব আসছে তেমনই লিখছেন। যথা:
ওলাওঠা কলেরা।
মন বলে চলেরা।
অথবা
বুকভরা নিশ্বাস,
ফুসফুসে ফিসফাস।
পদ রচনার এ জাতীয় ফ্লোয়ের মধ্যে যখন হাবুডুবু খাচ্ছেন ডাঃ সহদেব শুক ঠিক সেই সময় কিনা কুকুর খুঁজে দেওয়ার মতো হাস্যকর প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন পটললাল পাল।
মনের আবেগ যথাসাধ্য সংযত করে সহদেববাবু জানতে চাইলেন, কী এমন মহামূল্য কুকুর, যেটাকে খুঁজে বার না করলে চলবে না?
এবং এই সময়েই বুদ্ধিমান সহদেব ডাক্তারের মাথায় একটা কথা খেলে গেল যে পটললাল এখন টালিগঞ্জে সিনেমার লাইনে আছেন, নিজের একটা ব্যাপারে পটললালকে কাজে লাগতে পারে।
০৪. যার ধন তার ধন নয়
কবিতা লিখে কোনও পয়সা হচ্ছে না, গোয়েন্দাগিরিতে বিশেষ কিছু নয়, তবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারির ব্যবসায় আজ কিছুদিন হল বেশ ভাল উপার্জন হচ্ছে ডাঃ সহদেব শুকের।
মোট কথা, ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক বেশি ডাক্তার শুকের। এক কবিতা লেখার নেশায়। খরচ-খরচা খুব কম। সবচেয়ে দামি কাগজে, দামি কালিতে লিখলেও সারা বছরে যা খরচ হয় তা যারা মদ বা সিগারেট খায় তাদের এক বেলার খরচের সমান।
সুতরাং সহদেব শুকের হাতে টাকাপয়সা ভালই জমে যায়। এসব ক্ষেত্রে অন্য দশজন যা ভুল। করে থাকে, অতি বুদ্ধিমান সহদেববাবুও ঠিক তাই করেছেন।
উদ্বৃত্ত আয়ের হিসাব আয়কর দপ্তর জানতে পারবে না, ফলে বেশি আয়কর দিতে হবে না এই ভরসায়, তদুপরি বেশি সুদ পাওয়া যাবে এই আশায় ব্যাঙ্কে বা পোস্টাপিসে টাকা না রেখে তিনি চিটফান্ডে টাকা জমাতে আরম্ভ করলেন।
চিটফান্ড শোনার পরও লোকে কী সাহসে এখানে বহু কষ্টের বহু পরিশ্রমের টাকা জমায় এ বিষয়ে অবশ্য সহদেববাবুর মনে বেশ খটকা ছিল।
কিন্তু এই সময়ে ডা. শুকের এক নতুন রোগী তাকে বোঝাল যে এ চিট সে চিট নয়। এ চিট মানে জোচ্চোর নয়, এ চিট অন্য জিনিস, একেবারে যাকে বলে কামধেনু কিংবা রূপকথার টাকার গাছ। তেমন তেমন জায়গায় ঠিকমতো টাকা গচ্ছিত রাখতে পারলে বছর বছর টাকা ডবল হয়ে যাবে।
বছর বছর টাকা ডবল হয়ে যাওয়ার লোভ কম নয়। তা ছাড়া তার সেই রোগী সত্যকুমার ভক্ত যখন জানালেন যে তিনি নিজেই সর্বশ্রেষ্ঠ চিটফান্ডের প্রধান এজেন্ট তখন শুকদেববাবু আর ইতস্তত করলেন না তার উদ্বৃত্ত আয় সত্যকুমারবাবুর কোম্পানিতে গচ্ছিত রাখতে।
তা ছাড়াও চিট ফান্ড হলে কী হবে সত্যকুমারবাবুর কোম্পানির নামটি বড় আশাব্যঞ্জক মারিনা। ইংরেজিতে নামের বানান এম এ আর আই এন এ (MARINA)৷
মারিনা শব্দটা ভাঙলে সাদা বাংলায় দুটো শব্দ মারি এবং না পাওয়া যায়। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি তার নামের মধ্যেই বলে দেয় মারি না, তা হলে তার ওপরে আস্থা না থেকে যায় না।
সুতরাং সত্যকুমারবাবুর প্ররোচনায় সহদেববাবু মারিনার ওপরে যথেষ্ট আস্থা রেখেছিলেন। এবং অবেশেষে ভরাডুবি হয়েছেন। ঠিক কত টাকা তিনি মারিনার চিট ফান্ডে বিনিয়োগ করেছিলেন সেটা অবশ্য কোনওদিন কাউকে খুলে বলেননি। তবে তার ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার হরি চক্রবর্তীর ধারণা মোট টাকার পরিমাণ লক্ষাধিক হতে পারে। সে দেখেছে প্রত্যেক শনিবার ওই সত্যকুমার এসে বেশ কয়েক হাজার করে টাকা নিয়ে যেত আর নানারকম রঙিন কথা বলত।
সত্যকুমারবাবু কখনও বলতেন, আপনার সেই জুলাই মাসের এগারো হাজার টাকা কুড়ি হাজার হয়ে গেছে, টাকাটা এনে দেব নাকি ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু বলতেন, আরে না না। আবার লাগিয়ে দিন।
আরেকবার সত্যকুমার বললেন, একটা আর্ট ফিল্ম তৈরি হচ্ছে। মারিনার মালিক ভবসিন্ধু ঘোষ সিনেমা প্রযোজনায় নেমেছেন, নেমেই প্রথম দুটো বইতে দশ-বারোটা মেডেল পেয়ে গেছেন।
ডাক্তারবাবু হয়তো বলেছেন, তাই নাকি?
সত্যকুমারবাবু গড় বড় করে সিনেমা দুটোর নাম বলে দিয়েছেন, তারপর গলা নামিয়ে ডাক্তারবাবুকে বলেছেন, আপনার সব টাকা এবার আর্ট ফিল্মে লাগিয়ে দিন।
আর্ট ফিল্ম জিনিসটা যে কী ডা. সহদেব শুকের সে বিষয়ে সম্যক ধারণা নেই। কিন্তু কী করে যেন এটা বোঝেন যে ওসব জিনিস সাধারণ দর্শক দেখে না। তাই আপত্তি জানিয়ে বললেন, আর্ট ফিল্ম তো ফ্লপ হবে, ওখানে টাকা খাটিয়ে মারা পড়ব যে।
তখন আরও গলা নামিয়ে সত্যকুমারবাবু গোপন কথাটা বললেন।
আর্ট ফিল্মের লাভ হলের টিকিট বিক্রির ওপরে নির্ভর করে না। তার ফিকির আলাদা।
প্রথম বই তোলার খরচ খুব কম। অভিনেতা, অভিনেত্রী, লেখক এদের জন্যে বিশেষ টাকাপয়সা লাগবে না। অভিনেতা, অভিনেত্রী হয় আনকোরা অর্থাৎ যাকে সিনেমার ভাষায় বলে নবাগত-নবাগতা। কিংবা থিয়েটারের লাইনের বড় জোর টালির নালায় ভেসে যাওয়া অতীতের আবর্জনা, যাঁদের বক্স অফিস শূন্য এবং যেকোনও সুযোগ পেলেই হল, অর্থ না পেলেও কৃতার্থ বোধ করেন।
এদিকে পরিচালক নিজেই চিত্রনাট্যকার, সুরকার, সংগীতকার ইত্যাদি ইত্যাদি। শুটিংয়ের জন্যেও স্টুডিয়ো ভাড়ার বিশেষ প্রয়োজন নেই, রাস্তায় ঘাটে, বস্তিতে বাজারে লোকেশন শুটিং। ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। মোট কথা, আর্ট ফিল্মের পিছনে ব্যয় খুবই যৎসামান্য।
অথচ আয়ের মোটা পথ রয়েছে। সরকারের, ফিল্ম কর্পোরেশনের সাহায্য, ভর্তুকি, অনুদান, ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হয় না) একটু চেষ্টা করলেই সংগ্রহ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আয় যা। হয়, ব্যয় তত না করলেও চলে, ইচ্ছেমতো লাভ রাখা যায়।
বলা বাহুল্য, সহদেববাবু লোভের ফঁদে পা দিয়েছিলেন এবং এখন আফসোস করছেন। মারিনা কোম্পানির চেয়ারম্যান সাহেব জোচ্চুরি ও প্রতারণার দায়ে ধরা পড়েছেন। বহু কষ্টে একবার জামিন পান তো সঙ্গে সঙ্গে আবার গ্রেপ্তার হন। তিনি সহদেববাবুর এবং আরও কারও কারও টাকায় দিন আনি দিন খাই নামে যে বইটি প্রযোজনা করেছিলেন সেটা প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল। কয়েকদিন আগে পুলিশ সেই সব ফিল্ম আরও অনেক কাগজপত্রসহ উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।
এই সব নিয়ে দৈনিকই সব চাঞ্চল্যকর খবর বেরোচ্ছে। সহদেববাবু আশা সম্পূর্ণ ছেড়ে দেননি, এখনও ভাবেন টাকার কিছু অংশ অন্তত উদ্ধার হবে।
০৫. মারিনা
যদিও পটললাল আজ তাঁর কাছে কুকুর খুঁজে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসায় সহদেববাবু পটললালের ওপর খুব চটে গিয়েছিলেন, পরে ভেবে দেখলেন এই লোকটা সিনেমা লাইনের সুলুক সন্ধান জানে। হয়তো পটললাল টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে লাগতে পারে।
সুতরাং তার সমস্যা পটললাল গুছিয়ে বলার আগেই সহদেব ডাক্তার নিজের সমস্যার কথা পটললালকে জানালেন।
সব কথা পটললাল খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, মাঝে মাঝে তার চোখ ঝকঝক করতে লাগল।
সহদেববাবুর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পটললাল প্রায় স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন, তাহলে ভুজঙ্গবাবুর ছোবল আপনিও খেয়েছেন।
কে ভুজঙ্গবাবু? ছোবল মানেই বা কী? সহদেববাবুকে পটললালকে অনুরোধ করলেন রহস্য না করে সমস্ত ব্যাপারটা খোলসা করে বলতে।
দেখা গেল জনৈক ভুজঙ্গবাবুর ওপর পটললালের ভীষণ রাগ। তিনি কেবল গজরাতে লাগলেন, তাতে পরিষ্কার করে কিছুই বোঝা যায় না।
বহু কষ্টে সহদেব ডাক্তার পটললালের ভাষণ থেকে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলেন তা হল দীর্ঘদিন ভুজঙ্গবাবু প্রাচীন পাপী। পটললাল তাকে দীর্ঘদিন হল চেনেন।
অহিভূষণ, ভুজঙ্গভূষণ দুই ভাই। পারিবারিক ব্যবসা ছিল হাটখোলায় রেডির তেলের পাইকারি কারবার। রেডির তেলের চাহিদা কমে যেতে সরষের তেলের ভেজালের জন্যে তারা শেয়ালকাটার বীজ আর সজনেগাছের ছাল সরবরাহ করতেন বড়বাজারে, তারপর চিৎপুরের যাত্রা হয়ে হাতিবাগানের থিয়েটারে।
সেই হাতিবাগানের হল থেকে পটললাল এদের চেনেন। জুলেখা যখন থিয়েটারে নাচত, তখন এরা কম জ্বালিয়েছে জুলেখাকে। এমনকী সতীসাধ্বী জুলেখার কোমরের নীচের মাদুলি নিয়ে এই। দুই ভাই নোংরামি করেছে।
তবে ওই থিয়েটারের সময়েই দুভাইয়ে গোলমাল শুরু হয়, বনিবনা বন্ধ হয়।
এক শুভ সন্ধ্যায় বহুলক্ষ টাকার ইনসিওর করে এবং পরে থিয়েটার হলের জমিটা জীবনভাই-মরণভাই প্রোমোটার্স অ্যান্ড ডেভেলাপার্স ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে লিজ দেওয়ার চুক্তি করে দুভাই দুদিকে চলে গেলেন।
তার আগে হাতিবাগান বাজারের পেছনের চক্রবর্তী বাড়ির চোখে ছানি পড়া বৃদ্ধ দারোয়ান সীতারামকে অহি-ভুজঙ্গ দুজনে পাঁচশো-পাঁচশো করে হাজার টাকা দিয়ে গেলেন।
টাকাটা বকশিস নয়, পারিশ্রমিক।
সীতারাম উত্তর কলকাতার পেশাদার অগ্নিসংযোগকারী। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় সে রাজাবাজার ও উল্টোডাঙার বস্তিতে আগুন লাগিয়ে হাত পাকিয়েছিল। এই বৃদ্ধ বয়েসে, অশক্ত শরীরে আগুন লাগানোর ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনস্বীকার্য। কোথায় পেট্রোল লাগবে, কোথায় কেরোসিন হলে হবে নাকি শর্ট সার্কিট করাতে হবে, তার ওপরে কখন ভাল সময়, দিনে না রাতে, কখন কাজটা নিরাপদ এবং নিঃসন্দেহে হবে, এ সমস্ত বিষয়ে সীতারামই শেষ কথা।
সে যা হোক, অগ্নিকাণ্ডের বিবরণে গিয়ে লাভ নেই। তবে পটললালের কথা থেকে সহদেববাবু বুঝতে পারলেন যে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে অহিভূষণের আর কোনও খোঁজখবর নেই। কিন্তু পটললালের বিশ্বাস যে অহিভূষণকে কোনও কায়দা করে ভুজঙ্গভূষণ ধরাধাম থেকে সরিয়ে ফেলেছে কিংবা কোনও পাগলাগারদ-টারদে জোর করে ভরে রেখেছে।
পাগলাগারদ বড় সাংঘাতিক জায়গা, বিশেষ করে জেলখানার ভিতরের পাগলাগারদ, একেবারে সেখানে প্রবেশ করলে কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষেই প্রমাণ করা সম্ভব হবে না যে সে পাগল নয়। সে যা-ই করুক তার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ আবিষ্কৃত হবে।
এই পর্যন্ত শুনে সহদেব ডাক্তার বললেন, আমাকে কুকুর খুঁজতে বলছেন কেন? তার চেয়ে বলুন আমি এই অহিভূষণকে খুঁজে বার করে দিচ্ছি।
পটললাল বললেন, স্যার, অহিভূষণ হারিয়ে গেলে কারও কিছু আসে যায় না, তার স্ত্রী পুত্র পরিবার নেই, সে বিয়ে করেনি। কিন্তু এই কুকুরটা হারিয়ে যাওয়ায় ঘোর সর্বনাশ হয়েছে।
কুকুর হারানোয় এমন কী সর্বনাশ হতে পারে যা মানুষ গুম করে ফেলার চেয়েও মারাত্মক? একটু চিন্তায় পড়লেন সহদেববাবু। তাঁর গোয়েন্দা মন বলল ব্যাপারটা খুব সোজা নয়।
এরপরে পটললাল ঘণ্টাখানেক ধরে যা যা বলে গেলেন তা খুবই মর্মান্তিক।
জুলেখা সার্কাসে যোগদান করে বিদেশে যাওয়ার পরে জুলেখার পূর্বতন মালিকদ্বয় ফাঁইফরমাস খাটার কাজে পটললালকে নামমাত্র বেতনে নিয়োগ করেন। দৈনিক সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থিয়েটার হলের দোতলায় ডিউটি। পটললালের কাজ ছিল মালিকদের ঘরে। দোতলায় পাশাপাশি দুটি ঘরে দুই মালিকের সন্ধ্যার পরে শোয়া বসা। ঘরের মধ্যে চেয়ার টেবিল যেমন আছে, তেমনই আছে সোফা কাম বেড। যদি কখনও অভিনেত্রী অথবা অভিনেত্রী যশপ্রার্থিনী দুই ভাইয়ের কারও সঙ্গে ঘরের ভিতরে থাকেন তখন বাইরেটা আগলানোর দায়িত্ব ছিল পটললালের।
এ ছাড়া জর্দা পান, সিগারেট, সোড়া, ফরমায়েশ মতো ছুটে ছুটে আনতে হত, তাও পান থেকে চুন খসলে পরিত্রাণ নেই।
এর বদলে দুই ভাই পটললালকে যা মাসোহারা দিত তাতে দুবেলা পেট ভরে, হোটেলে ভাত খাওয়া হত না। কিন্তু পটললালের এমন কোনও যোগ্যতা নেই যাতে এ বাজারে অন্য কোনও কাজ জোগাড় করতে পারেন।
অবশেষে অগ্নিকাণ্ডের দিন সন্ধ্যাবেলা পটললালের ওপরে সাংঘাতিক একটা কাজ চাপিয়ে দুভাই দুদিকে চলে গেলেন।
তারা পটললালকে বলে গেলেন, রাত সোয়া দশটায় থিয়েটার হলে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগবে। যে ঘরে শর্ট সার্কিট হবে সেই ঘরে কয়েক টিন কেরোসিন তেল রাখতে হবে। আগুন লেগে যাওয়ার পরে আসল কাজ। মোড়ের মাথায় মিষ্টির দোকান রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেখান থেকে কিংবা অন্য কোথাও থেকে, অগ্নিকাণ্ডের অগ্রগতি প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর ফোন করে একটা জায়গায় জানাতে হবে। এসব কাজ ঠিকমতো করতে পারলে পটললালের যে সাড়ে তিন মাসের মাইনে বাকি আছে সেটা পরদিন সকালে পাবে।
আপাতত সেদিন রাতের খরচ-খরচা একটি দশ টাকার নোট পটললালের হাতে তুলে দিয়ে দুভাই কেটে পড়লেন।
দুঃখের বিষয়, সেদিন কী একটা হিসেবের ভুলে সোয়া দশটার জায়গায় থিয়েটার হলে আগুন। লাগে সাড়ে নয়টায়। অহি-ভুজঙ্গ আর একটু আগেই চলে গেছেন। সবে পটললাল জিনিসপত্র গোছাতে বসেছেন, থিয়েটার হল যখন পুড়েই যাবে, যা কিছু ছিল, ছোটখাটো জিনিস হাতের কাছে কুঁজো, গেলাস, ফুলদানি, অ্যাশট্রে, পাপোশ, পর্দা সব কিছু তিনি একটা বড় ঝোলার জন্য ভরছিলেন, এমন সময় চিড়িক চিড়িক করে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিটের আগুন, তারপর কেরোসিন টিন ফেটে যাওয়ার গগনবিদারী আওয়াজে একলাফে চোঁচা দৌড় দিলেন।
এক দৌড়ে হাতিবাগান থেকে টালিগঞ্জে। তবে পথে দুবছর লেগেছিল। রীতিমতো ঘুরপথ যাকে বলে।
এই দুবছর পটললাল করেননি এমন কোনও কাজ নেই। পটললাল তার বিভিন্ন কাজের যে তালিকা সহদেববাবুকে পেশ করলেন সেটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
১) ময়দানে ফুচকাওয়ালাদের কাছ থেকে ফুচকা খাওয়ার পর লোকেরা শালপাতা ফুটপাথ বা মাঠে ফেলে দেয়। শালপাতার ঠোঙা জোড়ার কাঠি খুলে সেই শালপাতা পাইপের গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে আবার ফুচকাওয়ালার কাছে বেচলে দৈনিক সাত থেকে দশ টাকা পাওয়া যায় এবং সেই সঙ্গে ফুচকাওয়ালা দয়ালু হলে, দুয়েকটা ফুচকা ফ্রি।
২) অনুরূপভাবে অক্ষত চায়ের ভড় কুড়িয়ে সেটা ধুয়ে আবার বিক্রি করা।
৩) দরজির দোকানে নতুন তৈরি জামায় সূঁচ সুতো দিয়ে বোতাম লাগানো।
৪) আদালতে সাক্ষী দেওয়া। ছোটখাটো চুরি-জোচ্চুরি, মারামারি এই রকম ফৌজদারি মামলায় আবার ভাড়াটে বাড়িওয়ালা, স্বামী-স্ত্রী ঘটিত দেওয়ানি মামলায় নানারকম সাক্ষী লাগে। সব আদালতের বটতলা মিথ্যা সাক্ষীতে ভরতি। কাজটা ভাল। তবে তীব্র প্রতিযোগিতা।
মামলায় মিথ্যে সাক্ষী হওয়ার পর্যায়ে পটললাল আবিষ্কার করেন যে ফৌজদারি মামলায় মিথ্যে সাক্ষী হওয়ার চেয়ে কিঞ্চিৎ বিপজ্জনক অথচ যথেষ্ট লাভজনক কাজ রয়েছে একটা, সেটা হল মিথ্যে আসামি হওয়া।
অনেক বড়লোক, গুণ্ডা, ব্যবসায়ী বা স্মাগলার ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। পরে জামিনে খালাস হয়ে বেপাত্তা হতে পারেন না। তার জায়গায় কাঠগড়ায় অন্য একজন প্রক্সি দেয়। এ কাজে আয় বেশি, দৈনিক পাঁচশো টাকার মতো।
তবে জেল-জরিমানা হলে একটু ঝামেলা আছে। জরিমানার টাকা অবশ্য মূল আসামিই দিয়ে দেয়। জেল হলে জেল খাটতে হয়, একটা ভাল দিক যে জেলে থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হয় না, সেটা ফ্রি। তা ছাড়া জেল খাটার সময় আসল আসামির কাছ থেকে মাসোহারা পাওয়া যায়। মাসে প্রায় পাঁচশো টাকা। ছয় মাস জেল খাটলে মোটা আয়। তা ছাড়া জেল থেকে বেরোলেই টাকাটা নগদে হাতে পাওয়া যায় এবং এই টাকা প্রায় কখনওই মারা যায় না।
একটা প্রতারণার কেসে মিথ্যে আসামি হয়ে এ বছর মেয়াদ খাটতে গিয়ে আলিপুর জেলে আবার ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে পটললালের দেখা।
ভুজঙ্গবাবু গ্রেপ্তার হয়েছেন মারিনা কোম্পানির প্রধান পরিচালক হিসেবে। থিয়েটার পর্ব শেষ করে ভুজঙ্গবাবু প্রথমে একটা অভিনব কোম্পানি খোলেন। কোম্পানির নাম ম্যমি ইন্ডিয়া করপোরেশন। এই কোম্পানির বহু বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, বিজ্ঞাপনটি পাঠ করলেই কোম্পানিটির অভিনবত্ব জানা যাবে।
ম্যমি ইন্ডিয়া করপোরেশন
প্রাচীন মিশরীয় পদ্ধতি।
ম্যমি বানাইবার সহজ উপায়।
আর চিন্তা নাই।
প্রিয়জনের মৃত্যুর পর মৃতদেহ
অল্প খরচে
ম্যমি করিয়া ঘরে রাখুন
মৃতদেহ আর পোড়াইতে হইবে না।
মৃতদেহ আর কবর দিতে হইবে না।
যোগাযোগ করুন: পোস্ট বক্স নং…
দুঃখের বিষয়, কয়েকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরে বিষয়টি বহুজনের সঙ্গে পুলিশেরও নজরে পড়ে। এবং একটু খোঁজখবর নিয়েই পুলিশ বুঝতে পারে ব্যাপারটি পুরো জোচ্চুরি। নারকেল তেল এবং সরষের তেল একত্রে মিশিয়ে তার মধ্যে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে এক রকম প্রলেপ বানানো হয়েছে, সেটাই মৃতদেহের গায়ে মাখাতে হবে। ব্লিচিং পাউডারের গন্ধে কয়েকদিন মৃতদেহের পচনের গন্ধ টের পাওয়া যাবে না। এরপর পুলিশের চাপে পড়ে ভুজঙ্গবাবু লাইন বদল করেন এবং সরাসরি টাকা জাল করার ব্যবসায় চলে আসেন। নতুন কোম্পানি করে নাম দেন মারিনা।
.
এই পর্যন্ত শুনতে সহদেববাবুর প্রায় ধৈর্যভঙ্গ হয়ে এসেছিল। মারিনার প্রসঙ্গ উঠতে তিনি বেশ চনমনে হয়ে উঠলেন। মারিনা থেকেই ভুজঙ্গবাবুর আর্ট ফিল্মের কথা সহদেববাবুর মনে পড়ল। দিন আনি দিন খাই করতে গিয়ে সহদেববাবুর টাকাটা যে চোট খেয়েছে, সেটা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
পটললালের কাহিনি আরও একটু বাকি ছিল।
পটললাল জেল খেটে যখন বেরোলেন তখনও জেলে বিচারাধীন বন্দি হয়ে আছেন ভুজঙ্গবাবু।
ভুজঙ্গবাবুই পটললালকে খান্ডোলিয়ার ঠিকানাটা দিয়ে বলেছিলেন দেখা করতে।
কিন্তু দেখা করে খান্ডোলিয়াকে ভুজঙ্গবাবুর নাম বলতেই খান্ডোলিয়া এই মারেন কী সেই মারেন।
০৬.
খান্ডোলিয়ার বেনামি এজেন্সি জীবনভাই-মরণভাই প্রোমোটার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অহি-ভুজঙ্গ ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছ থেকে হাতিবাগানের থিয়েটার হলটার লিজ নিয়েছিলেন বিশেষ গোপনে।
আগুন লাগানো, অগ্নি সংযোগ যাকে ইংরেজিতে বলে আর্সন, আইনের চোখে অত্যন্ত গর্হিত, জামিনের অযোগ্য অপরাধ।
শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়া পরিকল্পনা করেছিলেন আগুনের ব্যাপারটা অল্পে মিটে গেলে সেই জমিতে বহুতল বাড়ি বানাবেন।
কিন্তু বাদ সাধল জনগণ। জনগণের মাথায় কখন যে কী পোকা লুকিয়ে থাকে খান্ডোলিয়া সাহেব সারা জীবনেও বুঝে উঠতে পারেননি।
হল পুড়ে যাওয়ার পরে সাংঘাতিক হইচই, খবরের কাগজে লেখালেখি মিটিং পথসভা আরম্ভ হয়ে গেল। হলের ওদিকে এগোয় কার সাধ্যি। পাবলিক ধরতে পারলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ফলে খান্ডোলিয়া সাহেব একথা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারলেন না যে তিনি পুড়ে যাওয়া হলের জমিটা লিজ নিয়েছেন।
বন্ধুবান্ধব এবং উকিলের পরামর্শে তিনি একদম চুপ করে রইলেন। তাঁর যত রাগ গিয়ে পড়ল ওই দুই ভাই অহিভূষণ আর ভুজঙ্গভূষণের ওপর। কিন্তু তারা তখন কোথায়? অহিভূষণ পরপারে। অথবা জেলের মধ্যে পাগলা গারদে। আর ভুজঙ্গভূষণ সেই সময়ে বক্স নম্বরের আড়ালে ম্যমির ব্যবসা করছেন। তাঁর পাত্তা করা অসম্ভব।
পরে অবশ্য যখন মারিনা কোম্পানি করেন, সেই সময়ে ভুজঙ্গভূষণের খবর পেয়েছিলেন খান্ডোলিয়া কিন্তু তিনি ভুজঙ্গভূষণকে যোগাযোগ করার আগেই ভুজঙ্গবাবু সিনেমার কারবারে নেমে পড়েছেন। তখন আর ভুজঙ্গবাবুকে পায় কে, কখনও আর্ট ফিল্মের ডিরেক্টরের সঙ্গে কামস্কাটকা যাচ্ছেন, আবার ফিরে এসেই তরুণী নায়িকার সঙ্গে চলে যাচ্ছেন হাওয়াই দ্বীপে। ভুজঙ্গভূষণ তখন হাওয়ায় উড়ছেন। ওই এক জায়গায় তার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ খান্ডোলিয়ার মিল, দুজনেরই বালিকা নাবালিকা নায়িকার ওপরে ঝোঁক।
সে যা হোক, পটললাল দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ ক্রোধ প্রকাশ করার পর শ্রীকৃষ্ণবাবু একটু ঠান্ডা হলেন। তারপর জানতে চাইলেন, ভুজঙ্গবাবু কী খবর দিয়েছেন, তিনি জেলের ভিতরে বসেই কোনও নতুন কারবার কেঁদেছেন কি না?
পটললাল তখন ভুজঙ্গভূষণের দুটি বার্তা খান্ডোলিয়াকে দিলেন। দুটোই খান্ডোলিয়ার পক্ষে আশাব্যঞ্জক।
প্রথম বার্তাটি হল থিয়েটার হলের জমির লিজের টাকা মারা যাবে না। ভুজঙ্গবাবু জেল থেকে বের হয়েই একটা প্রগতিশীল নাট্যপ্রেমী সংঘ গঠন করে খান্ডোলিয়া সাহেবকে সভাপতি করবেন। ওই সংঘের পক্ষ থেকেই একতলায় একটা খুপরি মতো থিয়েটার হল করে বাকি তলাগুলো। বানালেই সব ক্ষয়ক্ষতি উশুল হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় বার্তাটি পূর্বোক্ত মম মজুমদারকে নিয়ে। ভুজঙ্গবাবুর মুখে শোনা এবং জেল থেকে বেরিয়ে যাচাই করে দেখা হালতুর মম মজুমদারের বৃত্তান্ত বেশ সরস করে বললেন পটলবাবু এবং ভুজঙ্গবাবুর হয়ে খান্ডোলিয়াকে অনুরোধ করলেন ভুজঙ্গবাবুর অবর্তমানে মমকে দেখাশোনা করতে।
তারপর থেকে মমকে যথেষ্টই দেখাশোনা করছেন শ্রীকৃষ্ণবাবু। তবে চপলা বালিকা, আর তার অভিভাবক মামাটিও একটি জিনিস।
মামাকে রসে এবং মমকে বশে রাখার দায়িত্ব পড়েছে পটললালের ওপরে। এভাবে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকে কালো পমেরেনিয়ানটি এনে খান্ডোলিয়া সেটারও দেখাশোনা খাওয়ানো বেড়ানোর ভার দিলেন পটললালকে। এবং এর পরেই হয়েছে গোলমাল। সেই অত্যুজ্জ্বল অস্বাভাবিক কৃষ্ণ সারমেয়টি যার কিনা ফটো মানে লোগো থাকবে শ্রীকৃষ্ণ ক্যাসেটে সেই কুকুরটি বেড়াতে নিয়ে গিয়ে একদিন হারিয়ে ফেললেন পটললাল।
.
কুকুর খোঁজার ব্যাপারে বিতৃষ্ণা থাকলেও পটললাল কথিত ভুজঙ্গভূষণ তথা খান্ডোলিয়া কাহিনি শুনে সহদেব ডাক্তার বেশ চনমনে হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আর সময় ব্যয় না করে পটললালকে জেরা করা শুরু করলেন, কুকুরটা আপনার কাছ থেকে হারিয়ে গেল?
পটললাল বললেন, একদম ম্যাজিকের মতো ব্যাপার স্যার। ৪৪৪
ম্যাজিক-ট্যাজিক থাক, সহদেব বললেন, ঘটনাটা ঠিকমতো পরিষ্কার করে বলুন।
পটললাল বললেন, খান্ডোলিয়া গিন্নি কুকুর পছন্দ করেন না, আর তাকে যমের মতো ভয় করেন খান্ডোলিয়া। সেই জন্যে কুকুরটাকে পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছিল। দুপুরে যখন মম মজুমদারের স্ক্রিন টেস্ট নিতেন খান্ডোলিয়াসাহেব, তখন মম মজুমদারের মামাকে বার-এ বসিয়ে কুকুরটাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিট ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ের পার্কটায় চলে যেতাম।
এতক্ষণ কথা বলে পটললালের হাঁফ ধরে গিয়েছিল। এবার পকেটে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, একটা সিগারেট খেতে পারি স্যার?
সাধারণ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের চেম্বারে ধূমপান নিষেধ, এতে ওষুধের তেজ চলে যায়। তবে ডাক্তারবাবু সে জাতের চিকিৎসক নন। তার ওষুধের তেজ অত সহজে যাওয়ার নয়।
পটললাল সিগারেট খাওয়ার অনুমতি পেয়ে পকেট থেকে প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে কবুল করলেন, স্যার, আপনি বোধ হয় জানেন সিগারেটে সব সময় শানায়, গাঁজা চরস না খেলে মনে ঠিক তুরীয়ভাব আসে না। তা ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ের সেই পার্কে একটা বহু পুরনো গাঁজার ঠেক আছে। ওদিকের যত ড্রাইভার, দারোয়ান, পিয়ন, এমনকী কলেজের ছাত্র, অফিসের বাবুসাহেব দুপুরে ওখানে আসে। এমনকী একবার কলেজের দুটো মেয়ে এসেছিল। গাঁজার কলকিতে তাদের টান দেখে পুরনো গেঁজেলরা বলিহারি যায় আর কী। একটা মেয়ে তো এক টানে ফট করে কলকি ফাটিয়ে ফেলল। আরেক বার…
এসব অপ্রাসঙ্গিক কথায় সহদেব ডাক্তারের গোয়েন্দা মন বিরক্ত বোধ করছিল, তিনি পটললালকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওসব থাক। আসল কথা তাড়াতাড়ি বলুন। কুকুর হারাল কী করে?
কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে পটললাল বললেন, সেই কথাই বলছি স্যার।
আমি পার্কে গিয়ে কুকুরটাকে কখনও ছেড়ে দিতাম না। এক পাশের রেলিংয়ে বেঁধে ও পাশের বকুল গাছতলায় ঠেকে গিয়ে বসতাম। এমন জায়গায় বসতাম যেখান থেকে কুকুরটার দিকে লক্ষ রাখা যায়। ধোঁয়ায়-আমেজে দু-আড়াই ঘণ্টা চমৎকার কেটে যেত।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বিপদ হল সেদিন। এই তো তিনদিন আগে, দুপুরবেলায় বেশ ঝলমলে রোদ ছিল। সবে কুকুরটা বেঁধে বকুলতায় গিয়ে দু ছিলিম টেনেছি, আকাশ অন্ধকার করে এল। কিছুক্ষণ পরে তুমুল বৃষ্টি, আমার কাছে ছাতা ছিল না, কিন্তু বাকিদের কাছে তিন-চারটে ছাতা ছিল, সেই ছাতার নীচে ভাগাভাগি করে বসে ঝরঝর বৃষ্টিতে আমরা মনের সুখে গাঁজা টানতে লাগলাম। বৃষ্টির গুঁড়ো গায়ে লাগছে, ঠান্ডা হাওয়া। সেদিনের গাঁজাটাও খুব সরেস ছিল স্যার।
সহদেব ডাক্তার ধমক না দিয়ে পারলেন না, বললেন, আসল কথা বলুন। বাজে কথা বলছেন কেন?
পটললাল আমতা আমতা করে বললেন, আসল কথা খুব সংক্ষিপ্ত স্যার।
ভাদ্রমাসের বৃষ্টি তো, জোর দুপশলা হয়ে একটু পরেই থেমে গেল। আমিও একটু পরে গাঁজার ঠেক ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আগে লক্ষ করিনি, রেলিংয়ের কাছে এসে কুকুরটাকে শিকল খুলতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ।
সহদেব ডাক্তার বললেন, সর্বনাশ মানে কুকুরটা নেই? এই তো?
কুকুরটা নেই, তা নয় স্যার। পটললাল বললেন, কালো কুকুরটা নেই, কুকুরটা বদল হয়ে গেছে, চেনে বাঁধা রয়েছে একটা সাদা কুকুর।
আশ্চর্য! রীতিমতো বিস্মিত ও চিন্তিত হলেন সহদেব ডাক্তার, তা হলে কুকুর চুরি হয়নি, কুকুর বদল হয়েছে। এরকম তো কখনও শুনিনি।
কিছুক্ষণ কী সব ভেবে নিয়ে সহদেব ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, পরের কুকুরটা এখনও আছে তো?
পটললাল বললেন, তা আছে। ওই পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটেই আছে।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলেন সহদেববাবু। পটললালকে বললেন, চলুন একবার পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে গিয়ে কুকুরটা দেখি।
হাতের ঘড়িটা দেখে পটললাল বললেন, সাড়ে এগারোটা বাজে। এখনই যেতে চান?
সহদেববাবু বললেন, কেন, এখন অসুবিধে কী?
পটললাল বললেন, একটু ইতস্তত করেই বললেন, কয়েকদিন ব্যবসার কাজের চাপ থাকায় খান্ডোলিয়া সাহেব দুপুরে মম মজুমদারের স্ক্রিন টেস্ট নিতে পারেননি। বলেছিলেন আজ সকালে স্ক্রিন টেস্ট নেবেন। আমি মমকে খবর দিয়ে আপনার এখানে এসেছি।
গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে দ্বিধা করলে চলে না। সহদেব ডাক্তার বললেন, চলুন। চলুন। এখন আর সকাল আছে নাকি মশায়। সকাল কখন চলে গেছে।
সহদেব ডাক্তার পটললালকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলেন।
কড়েয়া থেকে পার্ক স্ট্রিট পাঁচ মিনিটের রাস্তা। পটললালের পকেটে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি আছে। দোতলায় ফ্ল্যাটে উঠে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতর ঢুকলেন দুজনে।
খান্ডোলিয়া সাহেব নেই। বাইরের ঘরের ডিভানের ওপরে আলুলায়িত কেশ, শিথিল বসন শ্ৰীমতী মম মজুমদার শুয়ে রয়েছেন। তার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে একটা সাদা পমেরেনিয়ান কুকুর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।
যতটা সন্তর্পণে সম্ভব মম মজুমদারের কোল থেকে সাদা কুকুরটা তুলে নিলেন সহদেব ডাক্তার। কুকুরটা উৎখাত করার সময় চোখ বুজেই মম তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে ওই একটু উঃ উঃ করলেন।
সেদিকে কর্ণপাত না করে সহদেব ডাক্তার পমেরেনিয়ান কুকুরটাকে সোফার ওপরে শুইয়ে দিলেন। কুকুরটা ওপর থেকে সাদা মনে হলেও পুরো সাদা নয়, পেটের কাছটা কালো।
সহদেব ডাক্তার পটললালকে কুকুরটা ওই ভাবে ধরতে বলে পাশের বাথরুম থেকে ট্যাপ খুলে এক আঁজলা জল এনে কুকুরটার পেটের কালো জায়গায় ঘষতে লাগলেন। একটু পরে পেটের কালো রং মুছে গিয়ে সাদা লোম বেরোতে লাগল।
পটললাল বুদ্ধিমান লোক, ব্যাপারটা দেখেই বুঝতে পেরেছেন, বললেন, তা হলে কালো রংটা কাঁচা।
সহদেব বললেন, এটা সেই একই কুকুর। কালো রংটা নকল। সিঙ্গাপুর জোচ্চোরে ভরতি। তাদেরই কেউ খান্ডোলিয়া সাহেবকে ঠকিয়েছে সাদা কুকুর কালো রং করে। পার্কে বৃষ্টির জলের তোড়ে কালো রং ধুয়ে গেছে, পেটের কাছে একটু আছে বৃষ্টির ছাট সরাসরি ওখানে লাগেনি বলে।
এরপর পটললালকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দু-চার দিন পরে স্নান করাতে গেলেই ব্যাপারটা ধরা পড়ত। বৃষ্টিতে ভিজে আগেই হয়ে গেল।
ঘটনার অভিনবত্বে পটললালের মতো পোড় খাওয়া লোক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, একটু আত্মস্থ হয়ে বললেন, তা হলে খান্ডোলিয়া সাহেবকে খবর দিই।
সহদেব ডাক্তার বললেন, কোনও প্রয়োজন নেই। আপনি বরং দোকানে গিয়ে এক কৌটো কালো জুতোর কালি আর একটা ভাল দেখে বুরুশ নিয়ে আসুন।
পটললাল বেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ হওয়ার পর মম মজুমদার ডিভানে উঠে বসলেন, গায়ের কাপড়-চোপড় ঠিক করলেন। তারপর কুকুরটাকে কোলে নিয়ে সহদেব ডাক্তারকে বললেন, আপনি? আপনাকে চিনলাম না তো?
সহদেব বললেন, আপনি আমাকে চিনবেন না। তবে আপনি আমার টাকায় ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে হাওয়াই দ্বীপে গিয়েছিলেন।
কথার মধ্যেই কালি বুরুশ নিয়ে পটললাল ফিরে এলেন। সহদেব ডাক্তার মমকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কী রকম কুকুর পছন্দ করেন, সাদা না কালো?
শ্ৰীমতী মম মজুমদার কিছু বলার আগেই পটললাল তার কোল থেকে কুকুরটাকে নামিয়ে মেজেতে শুইয়ে জুতো পালিশ করার মতো করে কালো কালি লাগিয়ে জোর বুরুশ চালাতে লাগলেন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে শ্রীমতী মম মজুমদারের চোখের সামনে সাদা কুকুরটা কালো কুকুর হয়ে গেল। সিঙ্গাপুর থেকে যেমন এসেছিল তার চেয়েও কুচকুচে কালো।
পুনশ্চ।
এই কাহিনির নাম হওয়া উচিত ছিল, কুকুর ও পটললাল। কিন্তু যখন টালিগঞ্জে পটললাল নাম দিয়ে গল্পটা শুরু করি ভেবেছিলাম গল্পের পটভূমিকা টালিগঞ্জেই রাখব।
সামান্য কারণে সেটা সম্ভব হল না। কয়েকদিন হল টালিগঞ্জের এক আর্ট ফিল্মের পরিচালক আমার একটা রচনা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ অবস্থায় এসব নিয়ে হাসাহাসি করার সাহস পাচ্ছি না। তবে কারও যদি এক নজরেই শ্রীমতী মমকে দেখে পছন্দ হয়ে থাকে তাকে জানাই শ্রীমতাঁকে নায়িকা করে আরেকটি কাহিনিতে আমি অবিলম্বে হাত দিচ্ছি।