একটা মস্ত ঘরের মধ্যে
একটা মস্ত ঘরের মধ্যে তারা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ঘর বললে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। পাথরের এবড়ো-খেবড়ো দেওয়াল, নীচেও নুড়ি-পাথর ছড়ানো। ঘরের মধ্যে বোধহয় দুশো বছরের বদ্ধ বাতাসের সোঁদা গন্ধ। টর্চের আলোয় যত দূর দেখা গেল, এখান থেকে বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই।
অনু বলল, “নবীনদা, এবার কী করবে? এ তো দেখছি অন্ধকূপ!”
নবীন একটু চিন্তিতভাবে বলল, “চিন্তা করো না, উপায় একটা হবেই।”
শীতে-জলে কাদায় মাখামাখি হওয়ায় তিনজনেরই অবস্থা করুণ। তার ওপর পরিশ্রম বড় কম যায়নি।
নবীন টর্চটা ফেলে চার দিক ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। নিরেট পাথর, কোথাও ফাঁক-ফোঁকর তার নজরে পড়ল না।
নবীনের শেষ ভরসা সেই অশরীরীর কণ্ঠস্বর। কিন্তু গুহায় ঢুকবার পর থেকেই সে আর স্বরটা শুনছে না। তবে নবীনের স্থির বিশ্বাস, কণ্ঠস্বরটা তার ঠাকুরদার। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অনু আর বিলুর কাছ থেকে যত দূর সম্ভব দূরে সরে গিয়ে ঘরের একেবারে কোণে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, “দাদু! প্রম্পট করছ কেন বলো তো?” জবাব নেই।
“বলি, ও ঠাকুরদা, তোমার হলটা কী?”
তবু জবাব নেই।
হতাশ গলায় নবীন বলল, “বলি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি, দাদু?”
হঠাৎ গলার স্বরটা শোনা গেল। কানের কাছে কে যেন খিঁচিয়ে উঠে বলল, “আমি তোর দাদু কোন সুবাদে রে বাঁদর? কুলদা চক্কোত্তির নাতি হলে কি তুই এত গবেট হতিস? যা, জাহান্নমে যা।”
বিল হঠাৎ হেসে উঠে বলল, “ও নবীনদা, তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ?”
নবীন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “কারও সঙ্গে নয়, এই আপনমনেই একটু কথা বলছিলাম আর কি! যাকে বলে থিংকিং অ্যালাউড।”
“মাটির নীচে এই ঘরটা কারা বানিয়েছিল নবীনদা?”
“জানি না ভাই, তবে আমাদের পূর্বপুরুষেরাই কেউ হবে।”
“কেন বানিয়েছিল, তা বুঝতে পারছ? গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কোথাও তো ঘড়া বা কলসি দেখছি না।”
নবীন পায়ের নীচের নুড়ি-পাথরগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। সময় যে হাতে বেশি নেই, তা সে ভালই জানে। একটা বড় চ্যাটালো পাথর সরিয়ে তলাটা পরীক্ষা করতে করতে সে বলল, “গুপ্তধনের দরকার নেই ভাই, এখন এখান থেকে সরে পড়াটাই বেশি দরকার।”
এমন সময় হঠাৎ নীচের সুড়ঙ্গে পর পর কয়েকটা গুলি চালানোর শব্দ হল। আর সেই শব্দটা এই বদ্ধ ঘরে এত জোরে ফেটে পড়ল যে, তিনজনেই ভীষণ চমকে উঠে কানে হাত চাপা দিল।
বারুদেরপোড়া গন্ধে ঘরটা ভরে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে। নবীন হতাশ গলায় বলল, “ওরা নেমে এসেছে।”
অনু তার ভাইকে বুকে চেপে ধরে বলল, “কিন্তু আমরা তো ওদের শত্রু নই! যদি চেঁচিয়ে সেকথা ওদের বলা যায়, তা হলে কী হয়?”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু খুব লাভ হবে বলে মনে হয় না।”
নবীন সুড়ঙ্গের মুখটায় এগিয়ে গেল। তার পর চেঁচিয়ে বলল, “গুলি করবেন না। আমাদের সঙ্গে দুটো বাচ্চা আছে। আমরা বিপদে পড়েছি।”
কিন্তু নবীনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফের কয়েকটা গুলি এসে পাথরের গায়ে বিঁধল। পাথরের কুচি ছিটকে এসে লাগল নবীনের মুখে। সে সভয়ে সরে এল।
বলল, “এরা খুনে।”
বিলু অনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুই, আমার জন্য ভয় পাচ্ছিস, দিদি? মরলে সবাই মরব। অত ভয় কী? এখানে অনেক পাথর আছে। ওরা ওপরে ওঠার চেষ্টা করলে পাথর ছুঁড়ে মারা যাবে। কিন্তু ওদের গুলিতে আমাদের কিছুই হবে না।”
নবীন টর্চটা অনুর হাতে দিয়ে বলল, “বিলু ঠিকই বলেছে। তবে ওদের ঠেকানোর ভার আমার ওপর। তোমরা দুজনে ঘরটা খুঁজে দ্যাখো, কোথাও বেরোবার পথ পাও কি না।”
নবীন সুড়ঙ্গের মুখটায় ঘাপটি মেরে বসে রইল। হাতে পাথর। এই বিপদের মধ্যেও সে ভাবছিল, কুলদা চক্রবর্তী লোকটা কে? নামটা কখনও শুনেছে বলে তার মনে পড়ছিল না। তবে চাঁপাকুঞ্জের কালীবাড়ির পুরুতরা চক্রবর্তী ছিলেন। তাঁদের কেউ কি?
নবীন শুনতে পেল, সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়েকজন লোক বুক-ঘষটে এগিয়ে আসছে। খুবই সন্তর্পণে আসছে, কিন্তু বদ্ধ জায়গায় শব্দ গোপন করা যাচ্ছে না।
নবীন শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল।
টর্চের অত্যন্ত জোরালো আলোয় তলার সুড়ঙ্গটা উদ্ভাসিত হয়ে গেল। একটা লোককে আবছা দেখা গেল, হামাগুড়ি দিয়ে নীচে এসে থেমেছে।
নবীনের হাতের পাথর নির্ভুল লক্ষ্যে ছুটে গিয়ে ঠং করে লাগল লোকটার মাথার টুপিতে। টুপিটা লোহার। লোকটা একটুও না দমে হাতটা উঁচু করে, ধরল। একটা পিস্তলের মুখ দেখতে পেল নবীন। চট করে মাথাটা সরিয়ে নিল সে।
ঝিং করে গুলিটা গিয়ে লাগল ঘরের ছাদে। ঘরটা কি কেঁপে উঠল সেই শব্দে?
তার পর দু পক্ষ চুপচাপ। নবীন টের পাচ্ছিল, তার পিছনে অনু-বিলু সারা ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। টর্চ জ্বেলে পথ খুঁজছে। যদি কোনও ফাটল বা গর্ত নজরে পড়ে।
নবীন সাবধানে আবার মুখটা বাড়াল। যা দেখল, তাতে বুক হিম হয়ে গেল তার। সামনের লোকটা বুক-ঘষটে আরও খানিকটা উঠেছে। কোমর থেকে কী একটা জিনিস খুলে নিয়ে লোকটা হঠাৎ ওপর দিকে ছুঁড়ে মারল।
কিছু বুঝে উঠবার আগেই একটা প্রচণ্ড শব্দ আর আলোর ঝলকানি। গুহাটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল, এবং এত প্রচণ্ড আওয়াজ নবীন কখনও শোনেনি। তার মাথাটা হঠাৎ ঝিম ধরে, কানে তালা লেগে, চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। অজস্র পাথরের টুকরো আর ধুলোবালি খসে পড়ল তার ওপর।
নবীন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কিছুক্ষণের জন্য।
হঠাৎ তাকে নাড়া দিয়ে অনু বলল, “নবীনদা! নবীনদা! শিগগির! পথ পেয়েছি!”
নবীন চোখ খুলল। তার পর ধীরে ধীরে উঠে বসল। উঁকি মেরে দেখল, প্রচুর পাথরের টুকরো আর ধুলোবালি খসে পড়ায় নীচের সুড়ঙ্গটা প্রায় ঢেকে গেছে। লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ধুলো আর ধোঁয়ায় তিনজনই কাঁপছে, চোখে জল।
নবীন উঠল, কিছুক্ষণ সময় পাওয়া যাবে। তবে বেশি নয়। ওরা এই সামান্য বাধা ডিঙিয়ে ঠিকই চলে আসবে।
অনু তার হাত ধরে টেনে নিতে-নিতে বলল, “বোমার শব্দে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শাপে বর হয়েছে। দেখবে এসো।”
নবীন দেখল, গুহার ডান ধারে পাথরের দেওয়ালে বিশাল চিড় ধরেছে। একটা চৌকো পাথর আলগা হয়ে নড়বড় করছে।
নবীন এবার একটু ভাবল, পাথরটাকে যদি সে সামনের দিকে টেনে সরায়, তা হলে ছিদ্রটা ফের বন্ধ করার উপায় থাকবে না, এবং পাজি লোকগুলো পথের সন্ধান সহজেই পেয়ে যাবে। তাই সে পাথরটাকে ভিতরের দিকে প্রাণপণে ঠেলতে লাগল।
পাথরটা ধীরে-ধীরে সরে যেতে লাগল। মাত্র হাত-খানেক লম্বা এবং চওড়া একটা পথ পাওয়া গেল।
অনু আর বিলু সহজেই গলে গেল ভিতরে। সবশেষে নবীন।
পাথরটাকে আবার জায়গামতো বসিয়ে দিতে সামান্য সময় লাগল নবীনের। টর্চের আলোয় দেখা গেল, একটা লম্বা সরু পথ টানা বহু দূর চলে গেছে।
টর্চের আলো কমে আসছে। বেশিক্ষণ জ্বলবে না। ক্লান্ত পায়ে চুপচাপ তিনজন হাঁটতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।
বিলু শ্রান্ত স্বরে বলল, “নবীনদা, ওরা যদি এই গলিতে ঢুকতে পারে, তা হলে আমাদের তাক করে গুলি চালাতে খুব সুবিধে হবে, তাই না? গলিটায় কোনও বাঁক নেই, উঁচু-নিচু নেই।”
নবীন তা জানে। আর জানে বলেই সে নিজে পিছনে রয়েছে। গুলি যদি আসে, তবে তা তার গায়েই প্রথম বিধবে।
নবীন অভয় দিয়ে বলল, “ওরা নিজেরাও এখন বিপদের মধ্যে আছে। চলো, ওসব কথা ভাববার দরকার নেই। জীবনে সব সময়েই উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা ভাববে।”
কয়েক মিনিট হাঁটবার পর গলিটা হঠাৎ সরু হয়ে গেল। তার পর ঢালুতে নেমে থমকে দাঁড়াতে হল তিনজনকে, সামনে আর রাস্তা নেই। গলিটা ঢালু হয়ে কালো জলের মধ্যে নেমে হারিয়ে গেছে।
বিলু বলল, “এখন?”
অনুও সভয়ে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “নবীনদা, টর্চটা আর বেশিক্ষণ জ্বলবে না কিন্তু!”
নবীন জানে, বিপদে মাথা গুলিয়ে ফেললে লাভ নেই। এখনই মাথা ঠাণ্ডা রাখার সময়।
মনে যাই থাক, মুখে একটু নির্ভয় হাসি হেসে নবীন বলল, “ঘাবড়াচ্ছ কেন? সাঁতার জানো তো?”
অনু মাথা নেড়ে বলল, “সাঁতার জেনে তো লাভ নেই, সুড়ঙ্গটা জলের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার মানে জলটা পার হতে হবে ডুব-সাঁতার দিয়ে। জলের ভিতর দিয়ে কতটা যেতে হবে, তা তো জানি না!”
নবীন তার কোটটা খুলে ফেলল। বলল, “আরে সেটা কোনও সমস্যাই নয়। আমি চট করে জলে নেমে দেখে আসছি। যদি পার না হওয়াই যায়, তা হলে অন্য উপায় বের করতে হবে।”
“এই ঠাণ্ডায় তুমি জলে নামবে?”
“আমি কেন, তোমাদেরও হয়তো নামতে হবে, তৈরি থেকো। মনটাকে শক্ত করো, পারবে।”
নবীন সাবধানে জলে পা দিল, তার পর বুক ভরে দম নিয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে ডুব দিল।
প্রথমটায় অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না সে, শুধু এগিয়ে যেতে লাগল। ঠাণ্ডায় হাত-পা প্রায় অসাড় হয়ে আসছিল তার। কিন্তু বাঁচতেই হবে। এবং বাচ্চা দুটোকে বাঁচাতেও হবে।
তার বলিষ্ঠ হাত ও পায়ের তাড়নায় জল ছিটকে সে হুশ করে মাথা তুলল। বুঝতে পারল, মাথার ওপরটা ফাঁকা। জলের ওপর গুহার ছাদ উঁচুতে উঠে গেছে।
নবীন জলে ভেসে কয়েক সেকেণ্ড বিশ্রাম নিল। হাতে সময় একেবারেই নেই।
বুক-ভরে দম নিয়ে সে আবার ডুব দিয়ে ফিরে চলল। জলের ওপর মাথা তুলে সে দেখল, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। “অনু! বিলু!” প্রথমটায় কেউ সাড়া দিল না।
তার পর খুব ক্ষীণ কণ্ঠে অনু বলল, “নবীনদা! ফিরে এসেছ?”
“হ্যাঁ।”
“এই গলিতে ওরা ঢুকে পড়েছে। আলো ফেলছে। দু বার গুলিও চালিয়েছে। ও পাশে কী দেখে এলে?”
“তোমরা ডুব-সাঁতার দিতে পারবে?”
“পারব। আমরা দুজনেই ভাল সাঁতার জানি।”
“তা হলে ভয় নেই। মিনিট-খানেক ডুব-সাঁতার দিতে পারলেই জলে-ডোবা জায়গাটা পেরিয়ে যাব। ও দিকে মাথার ওপর ফাঁকা জায়গা আছে। তবে তারপর খানিকটা সাঁতরাতে হবে! গায়ের ভারী জামাগুলো খুলে ফ্যালো। আর আমার লাঠিটা দুজনেই চেপে ধরো। আমি টেনে নিয়ে যাব।”
দুই ক্লান্ত ভাই-বোন কোট-টোট ছেড়ে ফেলল। তারপর লাঠি ধরে জলে নামল। বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে নামতেই ঠকঠক করে কেঁপে উঠল দুজন।
কিন্তু ঠিক এই সময়েই দুম করে একটা বিকট আওয়াজে গলিটা কেঁপে উঠল।
লাঠিটা চেপে ধরে অনু, বিলু আর নবীন দম বন্ধ রেখে জলে ডুবে পড়ল।
নিকষ কালো জলের মধ্যে শুধু লাঠিটাই তাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ।
নবীন প্রাণপণে এগোচ্ছিল। তবে এক-হাতে লাঠি ধরে-থাকায়, খুব জোরে সাঁতারাতে পারছিল না সে।
কিন্তু প্রাণের ভয় বড় ভয়।
আচমকাই নবীন টের পেল, অসাড় হাত থেকে কখন লাঠিটা খসে গেছে।
আতঙ্কে নবীন জলের মধ্যে চার ধারে হাতড়াতে লাগল। লাঠি! লাঠিটা কোথায়?
মাথার ওপরে ছাদে দুম করে মাথা ঠুকে গেল তার। চোখ পলকের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। তবু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সচেতন রাখল সে।
আচমকাই লাঠিটা পেয়ে গেল পায়ের কাছে। চেপে ধরে এগোতে গিয়েই বুঝল, ওরা ভাই-বোন লাঠিটা ছেড়ে দিয়েছে।
হায়হায় করে উঠল নবীনের বুকটা। বাচ্চা দুটো ছেলে-মেয়ে এভাবে বেঘোরে ডুবে গেল? সে কিছু করতে পারল না? নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল তার।
কিন্তু দম শেষ হয়ে আসছে। আর বেশিক্ষণ নয়। এক্ষুনি সে নিজেও ডুবে যাবে, যদি সেও মরে, তবে বাচ্চা দুটোর খোঁজ করবে
নবীন প্রাণপণে তার অসাড় হাত-পা নাড়তে লাগল।
যখন জল থেকে মাথা তুলে খাস নিতে পারল নবীন, তখন তার বুক হাপরের মতো উঠছে পড়ছে।
কিছুক্ষণ কোনও কিছু চিন্তা করতে পারল না নবীন। শুধু হাঁ। করে দম নিল। তার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল তার শ্বাস।
অনু আর বিলু কোন্ অতলে গেল, কে জানে! বিপদ থেকে বাঁচিয়ে এত দূর এনেও শেষরক্ষা হল না? নবীন কনকনে ঠাণ্ডা জলে থেকেও গায়ে শীত টের পাচ্ছে না। বাচ্চা দুটোর জন্য দুঃখে নিজের শরীরের কষ্টও সে ভুলে গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার ডুব দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ক্ষীণ গলার স্বর শুনতে পেল, “নবীনদা!”
“কে, অনু?”
আশায় আনন্দে ব্যাকুল হয়ে নবীন চেঁচাল।
“হ্যাঁ। তুমি কোথায়?”
“এই তো! তোমরা দুজনেই কি আছ একসঙ্গে?”
“হ্যাঁ। আমরা তো তোমার লাঠি ছেড়ে দিয়ে আগে-আগে সাঁতরে চলে এসেছি।”
নবীনের বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল। গলার স্বর কোথা থেকে আসছে আন্দাজ করে সে এগিয়ে গেল। অনু আর
বিলু প্রায় দশ বারো হাত এগিয়ে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
অন্ধকারে কেউ কারও মুখ দেখতে পেল না। তিনজনেরই হাঁফ ধরা অবস্থা। বেশি কথা বলা অসম্ভব।
নবীন শুধু বলল, “চলো।”
তিনজন পাশাপাশি সাঁতরাতে লাগল।
বিলু জিজ্ঞেস করল, “নবীনদা, ওরা কি জল পেরিয়ে আমাদের পিছু নিতে পারবে?”
নবীন’বলে, “কিছুই অসম্ভব নয়। তবে ওরা হয়তো আমাদের ফেলে রাখা জামাকাপড় দেখে ভাববে, ভয়ে আমরা জলে ডুবে গেছি, আর জলে-ডোবা সুড়ঙ্গ তো ভীষণ বিপজ্জনক। ওরা হয়তো চট করে এ-পথে আসবে না।”
অনু আর বলু সত্যিই ভাল সাঁতরায়। বেশি জল না ছিটকে, নিঃশব্দে লম্বা জল টেনে দুজনে নবীনের চেয়েও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল।
“এ রকম আর কতক্ষণ সাঁতরাতে হবে, নবীনদা? আমরা কোথায় যাচ্ছি বলে তো?” অনু জিজ্ঞেস করল।
নরীন সখেদে বলে, “কে জানে? জন্ম থেকেই তো কেটেরহাটে আছি, এখানে যে এ রকম সব সুড়ঙ্গ বা মাটির নীচে এ রকম জলে-ডোবা জায়গা আছে, কস্মিনকালেও জানতাম না।”
আরও বেশ কিছুক্ষণ পর তিনজনেই একসঙ্গে পায়ের নীচে মাটি পেয়ে দাঁড়াল। ঢালু, পিছল জমি। সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। এত অন্ধকার যে মনে হয়, চোখ বুঝি অন্ধই হয়ে গেছে। হঠাৎ।
ধীরে-ধীরে তিনজন ঢালু বেয়ে উঠল। অবসন্ন, দুর্বল। চলচ্ছক্তিহীন।
নবীন মায়াভরে বলল, “আর ভয় নেই, পথ এবার পাবই, বসে একটু জিরিয়ে নাও।”
অনু, বিলু ধপধপ করে বসে পড়ল।
নবীন একটু দম নিয়ে বলল, “কেটেরহাটে অনেক কিংবদন্তি আছে। আমি সেগুলো এতকাল মোটেই বিশ্বাস করিনি। আজকের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি, সবটাই কিংবদন্তি নয়। পিছনে কিছু সত্যও আছে।”
বিলু সোৎসাহে বলে উঠল, “কিংবদন্তির গল্পগুলো বলবে আমাদের নবীনদা?”
নবীন একটু হাসল। বলল, “বলব। আগে তো তোমাদের এই অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করি।”
অনু কিন্তু দিব্যি হাসি-মাখানো গলায় বলল, “তুমি আমাদের কথা ভেবে এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন বলো তো নবীনদা? আমি কিন্তু একটুও দুশ্চিন্তা করছি না। রং অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ ভাল লাগছে। আমি একবার বড়ধেমো কয়লাখনিতে নেমেছিলাম। আমার এক মেলোমশাই চাকরি করেন ওখানে। একটুও ভয় করেনি। এটাকেও তেমন একটা খনিগর্ভ বলে মনে হচ্ছে।”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “কে জানে কী! হতেও পারে কোনও পুরনো আমলে ইংরেজরা হয়তো খনি-টনি খুঁড়েছিল। তার পর কাজ আর এগোয়নি। এখন চলল, ওঠা যাক।”
টর্চ নেই। সামনে নিবিড় অন্ধকার। ভরসা শুধু নবীনের লাঠিগাছ। নবীন লাঠিটা সামনে বাড়িয়ে ঠুকে-টুকে রাস্তার আন্দাজ করে চলতে লাগল। পিছনে অনু আর বিলু।
বেশ কিছুটা চলার পর নবীন টের পেল, পায়ের তলার জায়গাটা যেন শান বাঁধানো।
আরও খানিকটা এগোনোর পরই লাঠিটা একটা দেওয়ালে ঠেকে গেল। হয় রাস্তা বন্ধ, না হলে গলিটা বাঁক নিয়েছে।
নবীন বলল, “দাঁড়াও। সামনে বাধা আছে।”
অনু-বিলু দাঁড়িয়ে গেল। নবীন দেওয়ালটা হাতড়ে দেখল। চৌকো পাথরের দেওয়াল। চার দিক হাতড়াতে গিয়ে হঠাৎ সে টের পেল, দেওয়ালের গায়ে একটা দরজা রয়েছে। কাঠের দরজা, নবীন দরজাটা ঠেলল।
বহু পুরনো কাঠে ঘুণ ধরে একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে।
এক ঠেলাতেই দরজাটা ভেঙে পড়ে গেল।
“কী হল নবীনদা?” অনু আর বিলু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
“একটা দরজা। তোমরা এখানেই দাঁড়াও, আমি ঘরের ভিতরটা আগে দেখে নিই।”
নবীন ভিতরে ঢুকল। ঘরের মধ্যে সেই পুরনো বদ্ধ বাতাসের সোঁদা গন্ধ। ইঁদুরের দৌড়োদৗড়ি তো আছেই। নবীন হাতড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটা পুজোর ঘণ্টা পেয়ে গেল। বেশ ভারী আর বড়সড়। নাড়তেই চমৎকার ঠুনঠুন শব্দ হল।
সভয়ে বিলু চেঁচিয়ে উঠল, “ঘণ্টা বাজছে কেন নবীনদা?”
নবীন অভয় দিয়ে বলল, “ভয় নেই। আমিই বাজিয়েছি। এটা একটা মন্দির।”
“আমরা ঢুকব?”
“এসো। মাটির নীচে এ রকম একটা মন্দিরের কথা আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। আজ বিশ্বাস হল। সিদ্ধিনাথও এই মন্দিরটা বহুকাল ধরে খুঁজছে।”
অনু আর বিলুও অন্ধকারে চার দিক ঘুরে দেখতে লাগল। অন্ধকারে তারা মন্দিরের মধ্যে আরও কিছু জিনিস আবিষ্কার করল। একটা মস্ত পিতলের প্রদীপ, একটা পাথরের সিংহাসনে একটা বিগ্রহ, কয়েকটা পুজোর বাসনকোসন, কোষাকুষি, একটা লোহার সিন্দুক।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আবিষ্কারটা অবশ্য করল বিলু। দুটো পাথর। একটা জরাজীর্ণ কাঠের বাক্স হাতড়াতে গিয়ে দুটো পাথর আর কয়েকটা লম্বা সরু কাঠির মতো বস্তু পেয়ে গেল সে।
“নবীনদা, এগুলো কী বলল তো? দুটো পাথর, আর কয়েকটা কাঠি!”
নবীন বলল, “দাও, ওগুলো আমার হাতে দাও। কপাল ভাল থাকলে ও-দুটো চকমকি পাথরই হবে।”
নবীন পাথর দুটো সামান্য ঠুকতে চমৎকার স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল। কাঠির মাথায় বারুদ বা ওই জাতীয় কোনও সহজ-দাহ্য বস্তু লাগানো। খুব সাবধানে কয়েক বারের চেষ্টায় নবীন একটা কাঠি ধরিয়ে ফেলতে পারল।
প্রদীপের সলতে বা তেল নেই। কাঠির সামান্য আগুনটা অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ জ্বলল। নবীন খুঁজে-পেতে একটা পেতলের ছোট কলসি পেয়ে গেল। থাকারই কথা। কেটেরহাটের বিখ্যাত শীতলা মন্দিরেও এ রকমই কলসিতে প্রদীপের ঘি রাখা হয়। মুখবন্ধ কলসির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নবীন দেখল, তলানি ঘি এখনও আছে। তবে জমাট আর শক্ত। খামচে-খামচে তাই তুলে প্রদীপে দিল নবীন। নিভস্ত কাঠি থেকে আর-একটা ধরিয়ে নিল। পকেট থেকে ভেজা রুমালটা বের করে অনুকে দিয়ে বলল, “চটপট এটা পাকিয়ে সলতের মতো করে দাও।”
সামান্য পরেই প্রদীপ জ্বলে উঠল। এতক্ষণ অন্ধকারে কাটানোর ফলে সামান্য প্রদীপের আলোতেই তিনজনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
তার পর অবাক বিস্ময়ে তারা ভূগর্ভের মন্দিরটা ভাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগল।