Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোড়াসাঁকোর ধারে || Abanindranath Thakur » Page 12

জোড়াসাঁকোর ধারে || Abanindranath Thakur

হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল

হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল জনকয়েক সাহেব মেম আর্টিস্ট নিয়ে। সন্ধ্যেবেলা আর্ট স্কুলেই তারা ঘণ্টা দুয়েক কাজ করত; আলোচনা সমালোচনা হত, মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়াও চলত, অনেকটা আর্ট ক্লাব গোছের। মার্টিন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার থর্নটন সাহেবই দেখাশোনা করতেন। তাঁর উপরেই ছিল ওই আর্ট ক্লাবের সব কিছুর ভার। চমৎকার আঁকতেও পারতেন তিনি। অমায়িক সৎ লোক ছিলেন, মহৎ প্রাণ ছিল তার। অমন সাহেব দেখা যায় না বড়। আমার সঙ্গে খুব জমত। সেই থেকেই আমার সঙ্গে তার আলাপ। পরে আমাদের সোসাইটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। আমি যখন আর্ট স্কুলে তিনি আসতেন আমার কাছে প্রায়ই; আবার ডেকেও পাঠাতেন কখনও কখনও। চারটের পরে যেতুম তার আপিসে। খুব বিশ্বাস ছিল আমার প্রতি, টেবিলের দেরাজ থেকে তাঁর আঁকা নানারকম স্থাপত্যকর্মের প্ল্যান বের করে আমায় দেখাতেন, পরামর্শ চাইতেন। কোন্‌টা কি রকম হলে আরো ভালো হয় দু বন্ধুতে মিলে বলা কওয়া করতুম। সেই সময়ে দেখেছি তার ড্রইং। ভারি সুন্দর। ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরেছেন; উদয়পুর জয়পুরের কতকগুলি স্কেচ্‌ করেছেন, লোভ হত দু-একখানির উপর। অনেক সাহেব এদেশের স্কেচ্‌ করেছে, ছাপিয়েছেও দু-একজন; কিন্তু তাদের স্কেচ্‌গুলিতে কেমন যেন বিদেশের ছাপ থাকত আর থর্নটনের অ্যালবাম যেন ভারতবর্ষের হুবহু ছবি। মাঝে মাঝে তার ফ্ল্যাটেও যেতুম; তেতলার ফ্ল্যাট, গোল সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে চাপরাসিকে জিজ্ঞেস করতুম, ‘সাহেব আছেন?’ চাপরাসি উত্তর দিতে না দিতেই ওদিক থেকে ঢিলে ঢালা পাজামা পরে সাহেব এসে উপস্থিত হতেন; তারপর দুজনে বসে কত গল্প, কত হাসি, কত মজাই না করতুম। প্রাণ-খোলা হাসি ছিল তার। তাদের আর্ট ক্লাব ভেঙে গেলে পর, ক্লাবের বোর্ড আলমারি আমাকে তিনি দিয়েছিলেন। বললেন, ‘কী হবে আর এসব দিয়ে, তুমিই নিয়ে যাও, কাজে লাগবে।’

আমাদের আর্ট সোসাইটির উনি একজন বড় উৎসাহী সভ্য ছিলেন। শুধু তাই নয়, বড় খদ্দেরও ছিলেন। নন্দলালের অনেক ছবি উনি কিনেছেন। একবার নন্দলালের ‘সতী’ ছবিখানি কিনেছেন। সে সময়ে আমরা ঠিক করি, ভালো ভালো ছবিগুলি ছাপিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেব। করিয়েও ছিলুম কিছু, খুব ভালো হয়েছিল। তা সেই ‘সতী’ ছবিখানি ও আর খানকয়েক ছবি, ভালো করে প্যাক করে জাপানে পাঠানো হল ছাপাবার জন্য। ওকাকুরা, টাইকান, ওঁরা ব্যবস্থা করে দিলেন। ভালো কোম্পানিতে ছবিগুলি ছাপা হয়ে কিছুকাল বাদে তা ফেরত এল। থর্নটনের ‘সতী’ও এল। তিনি ছবির প্যাক খুলে ছবিটি বের করে দেখেন, ছবি আর চিনতেই পারেন না। খবর পাঠালেন, শিগগির এসো, কাণ্ড হয়ে গেছে, সতী কি রকম বদলে গেছে। সেই আগের সতী আর নেই। তাড়াতাড়ি গেলুম। কি ব্যাপার? গিয়ে দেখি তাই তো, মনে হয় আগুনে পুড়ে সতীর গায়ের রঙ যেন ছাই হয়ে গেছে। রুপো পুরানো হয়ে গেলে যেমন হয় তেমনটি। সাহেব বললেন, ‘এ কেমন হল?’ বললুম, ‘রঙ বিগড়ে গেছে। কেন গেছে তা কি করে বলব বল?’ সাহেব বললেন, ‘এ সারানো যাবে না?’ বললুম, ‘না, এ আর সম্ভব নয়।’ সাহেবের মন খারাপ, তাঁর সতীর এমন দশা হয়ে গেল। তখনকার ছবি আমরাই বেশির ভাগ কিনে রাখতুম। সতীটির উপর আমার খুব লোভ ছিল। সাহেব কিনে নিলে, কি আর করি। বললুম, ‘তুমি যদি এই ছবিটি না রাখ তবে আমায় দিয়ে দাও, তার বদলে অন্য ছবি নাও।’ সাহেব বললেন, ‘তবে তোমার ছবি দিতে হবে আমায়।’ বললুম, তা বেশ। পছন্দ কর কোন্‌টি নেবে।’ শেষে সাহেব ঔরঙ্গজেব দারার মুণ্ড দেখছেন যে ছবিটি ও আর-একটি ছবি এই দুখানির বদলে সতীটি আমায় ফেরত দিলেন।

বাড়ি নিয়ে এলুম সতীর ছবি। মনে মনে ভাবছি কি উপায় করা যায় এর। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল একটা কোনো বইয়ে পড়েছিলুম খোলা হাওয়া-আলোতে রাখলে কতকগুলো রঙের জলুস ফিরে আসে। ভাবলুম, কি জানি, জিঙ্ক দিয়ে মুড়ে পাঠিয়েছিল ছবি, জিঙ্কের গরমে ও জাহাজের গুমটে মিলে কেমিক্যাল ক্রিয়ায় হয়তো রঙ বদলে গিয়ে থাকবে। বাড়িতে এসে ছবিখানি আমার শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে টাঙিয়ে রাখলুম। পুবের আলো এসে পড়ে তাতে রোজ। রইল তো সেখানেই। কিছুদিন বাদে একদিন দেখি, সতীর রঙ ফিরে গেছে, সেই আগের রঙ এসে লেগেছে গায়ে, আলো দিয়ে যেন ধুইয়ে দিয়েছে তার পোড়া রঙ। বাঃ বাং, এ তো বড় মজা। উড্‌রফকে ডেকে এনে দেখাই, থর্নটনকে ডেকে এনে দেখাই। তাঁরাও দেখে অবাক। থর্নটনকে বললুম, ‘কি, লোভ হচ্ছে নাকি? কিন্তু পাবে না আর ফিরে। আমার কাছে এসে সতীদেহের রঙ ফিরে এলো, আর কি দিই তোমার হাতে তুলে?’ সাহেব শুনে হাসেন, বলেন, ‘না, এ তোমারই থাক্।

থর্নটনের মত অমন বন্ধ হয়নি আর আমার। তাঁরই চাপরাসিকে দিয়েছিলেন আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতে। বলিনি সে গল্প বুঝি? একবার সাহেব যাবেন দেশে, চাপরাসিকে দিয়ে গেলেন আমার কাছে। বললেন, ‘এর ছবি আঁকার হাত আছে, একে তুমি ছবি আঁকা শেখাও; খরচপত্তর যা লাগে তা আমি দেব। সাহেব চলে গেলেন দেশে; পরদিন চাপরাশি এল আমার আর্ট স্কুলে। সাহেবেরই একটা লাল নীল পেনসিল দিয়ে ট্রামগাড়ি, কলকাতার রাস্তা, এই সব আঁকত অবসর সময়ে। বসিয়ে দিলুম তাকে নন্দলালের সঙ্গে। তাদের বললুম, ‘এও একজন ছাত্র, একে যেন অবজ্ঞা কোরো না। এখানে সবার আসন সমান।’ চাপরাসি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে; বললুম, ‘বোস তুই এখানে এই বেঞ্চিতে।’ সে কেবলি কাঁচুমাঁচু করে; কিছুতেই বসতে চায় না। তাকে ভালো ভাবে বসাতেই আমার লাগল বেশ কিছুদিন। রোজই সে আসে, ছবি আঁকে। কি আর তেমন আঁকবে এই কয়দিনে, তবু হাত তার ধীরে ধীরে বেশ পাকা হয়ে আসছিল। সাহেব দেশ থেকে ফিরে এলেন, চাপরাসি আবার তার কাজে যোগ দিলে। একদিন সাহেব এসে বললেন ‘তুমি আমার চাপরাসির করেছ কি? ছবি আঁকার কথা ছেড়ে দাও, লোকটা একেবারে বদলে গেছে। তার শিষ্টতা আচারব্যবহার কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করছে। আগের সেই চাপরাসি আর নেই, তুমি আগাগোড়া লোকটাকে এমন করে বদলে দিলে কি করে?’ বললুম, ‘আর কিছু নয়, আমি শুধু ওকে বসতে শিখিয়েছিলুম।’

সে সময়ে বাংলাদেশের যত জমিদার মিলে একটা সোসাইটি হয়, নাম ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন। সিংহ মশায় সভাপতি। উড্‌রফ আর ব্লান্টও জুটল সে সময়ে। সুরেন কোমর বেঁধে কাজ করে তাতে। সুরেনের মাথায়ই খেলল প্রথমে একটা ছবির একজিবিশন করতে হবে। আমার যা কখানা ছবি ছিল, ওকাকুরা এনেছিলেন সঙ্গে কিছু জাপানী প্রিন্ট, আর এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জোগাড় করলে আরও কখানা ছবি। তাই নিয়ে সে তৈরি একটা মস্ত বাড়ি ছিল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের; নিচের তলায় বিলিয়ার্ড রুম, পড়বার ঘর, উপরে ব্যবস্থা আছে কোন সভ্য দূর থেকে এলে থাকতে পারে সেখানে, সুরেন চাইলে সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই একজিবিশন হবে। সিংহ মশায় বললেন, ‘ছবির আমি বুঝিনে কিছুই; তবে চাইছ ঘর একজিবিশন সাজাতে, তা নাও।’ সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই ছবি সব সাজানো হল। বেশ লোকজন আসত দেখতে; আমাদেরও ভাল লাগত, ইচ্ছে ছিল আরো কয়েকদিন চলে এমনি। এদিকে ছোকরা ব্যারিস্টার ছিলেন অনেক সেই অ্যাসোসিয়েশনে, নতুন বিলেতফেরত, তাঁরা রোজ সন্ধ্যেয় আসেন, বিলিয়ার্ড খেলেন, ব্রিজ খেলার আড্ডা জমান, তাঁদের হল মহা অসুবিধে। কদিন যেতে না-যেতেই তাঁরা লাগলেন গজগজ করতে, ‘ঘর আটকে রাখা হয়েছে।’ গজগজানি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছবি-টবি নামিয়ে নিলুম দেয়াল থেকে। সেই একজিবিশনে উড্‌রফ, ব্লান্ট, এঁদের সঙ্গে আলাপ জমল। সেই হল প্রথম আমাদের ছবির একজিবিশন। তার দু-তিন বছর পরে হ্যাভেল চাইলেন তাদের সেই ছোট্ট আর্ট-ক্লাবটা ভালো করে তৈরি করতে। কমিটি গঠন হল, আমরা তাতে যোগ দিলুম। ল্যাণ্ডহোল্ডার্সদেরও কেউ কেউ এলেন। উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহনও এলেন। লর্ড কিচনার সভাপতি, আমাকে হ্যাভেল বলেন সম্পাদক হতে। আমি বলি, ‘ওসব হিসেব-নিকেশে আমি নেই। পারিনে কোনোকালে।’ কিছুতেই ছাড়েন না, শেষে যুগ্ম সম্পাদক হই। জানো, বেশ কিছুকাল আমি লর্ড কিচনারের সম্পাদকগিরি করেছি। একবার এক পার্ট দিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। এখানে শান্ত্রী, ওখানে শান্ত্রী, বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে তো বুক আঁতকে আঁতকে ওঠে। রাস্তাও কি রকমের; গাড়ি ঘুরে ঘুরে পৌঁছল দোতলায় না তেতলায় ঠিক ওঁর ঘরটির সামনে। নানারকম জিনিসের সংগ্রহ ছিল তার। প্রায়ই যেতে হত সেখানে। এখন সেই পার্টিতে এসেছেন অনেকেই নিমন্ত্রিত হয়ে। এক রাজা বন্ধু ধরলেন, ‘আমায় লর্ড কিচনারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে।’ সাহেব দেখি তখন মেমের সঙ্গে গল্পে মশগুল এক ফুলবাগানে। ভাবভঙ্গী দেখেই মনে হচ্ছে, বেশ জমে উঠেছে। ভাবলুম, দরকার নেই বাপু এখন গিয়ে, কি জানি মিলিটারি মেজাজ, দেবে হয়তো এখনি মাথাটা গুড়িয়ে। রাজ-বন্ধু এদিক থেকে কেবল খোঁচাচ্ছেনই। কি করি, একপায়ে দুপায়ে এগিয়ে গেলুম খানিকটা। সাহেব কথার ফাঁকে একবার পিছনে তাকিয়েছেন কি, রাজাকে ঠেলে দিলুম, বললুম, ‘ইনি হচ্ছেন রাজা অমুক।’ সাহেব হাত ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে বললেন, ‘Well Tagore, take him upstairs and show him my collection, please.’ রাজাকে নিয়ে চলে গেলুম সেখান থেকে। রাজা তো খুব খুশি ওইটুকু হ্যাণ্ডশেক করতে পেয়েই। যাক সেকথা। এখন এই সোসাইটির নাম কি দেওয়া যায়? কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন অরিয়েটাল আর্ট সোসাইটি। আমি বললুম, ‘না, নাম হোক্‌ এর ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট। শুধু বাঙালি নয়, দুই সম্প্রদায় মিলল এতে। দাদাও ছিলেন। অনেকে স্থায়ী সভ্য হলেন। পার্ক স্ট্রীটে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল, আর্টিস্টরা কাজ করবে সেখানে; কেউ যদি ইচ্ছে করে থাকতেও পারে, এমন ব্যবস্থা রইল। আর্ট স্কুলের মস্ত হলে দু-তিনটে ছবির একজিবিশন হল। উড্‌রফ তার জাপানি প্রিন্টের কালেক্‌শন দিলেন। Gesiking বলে এক মেম সব ঋতুর ফুল এঁকেছিলেন দেশি ধরনে, তাও একবার দেখান হল। দেখতে দেখতে আমাদের সোসাইটি খুব জমে উঠল। মাৰ্চেণ্ট কমিউনিটি, সিভিলিয়ান কমিউনিটি, লাটবেলাট জজ-ম্যাজিস্ট্রেট রাজারাজড়া সবাই তাতে যোগ দিয়েছেন; সবাই কিছু-না-কিছু করছেন। উড্‌রফ ক্যাটালগ লিখতেন। তখনকার ক্যাটালগ সাহিত্য ছিল বললেই হয়। প্রতি ছবির নিচে গল্প থাকত; আমার ইংরেজি বিদ্যেয় কুলোত না, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কোনো রকম করে লিখে দিতুম। উড্‌রফ তা থেকে ভালো করে লিখতেন।

দেখাদেখি অন্য আর্টিস্টরা ঠিক করলেন, তাঁরা নিজেরা একটা সোসাইটি করবেন। হরিনারায়ণ বসু ছিলেন আর্ট স্কুলের ভাইস্‌প্রিন্সিপাল, বরদাকান্ত দত্ত সেকেণ্ড মাস্টার, মন্মথ চক্রবর্তী যিনি বউবাজারের আর্ট স্কুল প্রথম শুরু করেন, এই কয়জন মিলে ঠিক করলেন একটা সভা করে সব ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় সভা হবে। আমাকেও তাঁদের দলে টানবার ইচ্ছে; ঠিক হয় আমাদের বাড়িতেই সভা বসবে। সভার সব ঠিক, খাওয়াদাওয়ারও কিছু ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। এখন সেই সভার মধ্যেই কে কি কাজ করবে এই নিয়ে মহা তর্কাতর্কি; শেষ পর্যন্ত প্রায় তুমুল ব্যাপার। এ বলেন, ‘আমি কেন প্রেসিডেন্ট হব’, উনি বলেন, ‘অমুক থাকতে ও কাজের ভার আমার উপর কেন’ ইত্যাদি। হল না আর শেষ পর্যন্ত কিছুই, ওখানেই থেমে যেতে হল সবাইকে। আমি বললুম, ‘শুরুতেই যখন এই রকম মারামারি তখন আমি, বাপু, এর মধ্যে নেই।’ গেল ভেঙে সব স্কীম।

আমরা যে সোসাইটি করেছিলুম সে ছিল একেবারে অন্যরকমের। আমরা করেছিলুম এমন একটা সোসাইটি যেখানে দেশী বিদেশী নির্বিশেষে একত্র হয়ে আর্টের উন্নতির জন্য ভাববে, শুধু ভারতীয় নয় প্রাচ্য শিল্পের সব জিনিস দেখানো হবে লোকদের। তাতে এমন ব্যবস্থাও ছিল যার যা ব্যক্তিগত শিল্পবস্তুর সংগ্ৰহ ছিল তাও দেখানো হত। মাঝে মাঝে এক-একজনের বাড়িতে পার্টি জমত। সভ্য সবাই আসত; আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়াদাওয়া, আর্ট সম্বন্ধে আলোচনা, সবই হত। উড্‌রফ পান পর্যন্ত দিতেন তাঁর বাড়িতে যখন পার্টি হত। পান, ফুলের মালাও চল হয়ে গিয়েছিল সাহেববাড়িতে সেই সময়ে। তা ছাড়া যে-দেশে যা-কিছু সুন্দর পাওয়া যায় এনে সাজিয়ে দিতুম একজিবিশন করে। সেসব একজিবিশনও হত এক বিরাট ব্যাপার। কাঁচের বাসন, কার্পেট, যেখানকার যা কিছু ভালো ভালো পুতুল, গয়না, ছবি, কিছু বাদ পড়ত না। সব বাছাই বাছাই জিনিস, যা-তা হলে আবার হবে না।

একবার এমনি এক বিরাট বার্ষিক একজিবিশনের আয়োজন হচ্ছে। উড্‌রফ বললেন, ‘এবারে ভারতবর্ষের সব জায়গার জিনিস জোগাড় করতে হবে।’ তিন মাস আগে থেকে জায়গায় জায়গায় চিঠি লিখে দেওয়া হল; কোথাও আমাদের লোক গেল জিনিস সংগ্রহ করতে; কোথাও বা টাকা পাঠানো হল, পার্সেল করে যেসব জিনিস আসবে তার খরচ বাবদ। কিছুদিন বাদেই নানা জায়গা থেকে ছোট বড় হালকা ভারি প্যাকিং বাক্স আসতে লাগল, সে কি উৎসাহ আমাদের বাক্স খোলার। আমাদের চতুর্দিকে সাজানো প্যাকিং বাক্স ঠাসা, একটা-একটা করে খোলা হচ্ছে। দিল্লি থেকে এসেছে সুন্দর সুন্দর পটারি; কাশ্মীর থেকে নানারকম শাল, হাতের কাজ, তার মধ্যে একটা পুরানো পেপারম্যাসের উপর কাজ করা দোয়াতদানি ছিল বড় সুন্দর, এখনো মনে পড়ে, বড় বড় কার্পেট; কেষ্টনগরের পুতুল; বোম্বে থেকে ভীষণ সব ছবি; লক্ষ্ণৌর তাস, বাদশা-বেগমের মিনিয়েচার আঁকা, বেগম-বাদশারা খেলত; উড়িষ্যার পট; আর গঞ্জাম থেকে এল তিনটি হাতির দাঁতের মূর্তি—একটি কূৰ্ম অবতার, একটি রাধাকৃষ্ণের বিহার, সবাইকে দেখাবার মত নয়, কিন্তু কি চমৎকার মূর্তি, পাকা হাতের কাজ—উড্‌রফ দেখেই বললেন, ‘এই রকম আমার একটি চাই। তুমি যে করেই হোক আমায় এই মূর্তিটি করিয়ে দাও, যত টাকা লাগে ভাবনা নেই।’ ডেকে পাঠালুম আচারী মাস্টারকে, চমৎকার কাঠের কাজ করত সে। তাকে বললুম, ‘ভালো চন্দনকাঠে তুমি এর দুটি নকল করে দাও।’ সে কয়েকদিনের মধ্যেই দুটি মূর্তি কেটে নিয়ে এল, ঠিক হুবহু সেই মূর্তিটি কপি করে ছেড়ে দিয়েছে। তার একটি উড্‌রফকে দিলুম, একটি আমি নিলুম। আর একটি মূর্তি, সেটি কৃষ্ণের। আধহাতমত উঁচু মূর্তিটি, বাঁশিটি ধরে আছেন মুখের কাছে; সে কি ভাব, কি ভঙ্গি, কি বলব তোমায়, মূর্তিটি দেখে আমি অবাক। অদ্ভুত মূর্তি, আইভরির রঙটি পুরানো হয়ে দেখাচ্ছে যেন পাকা সোনা। সেই মূর্তিটি দেখেই কেন জানি না আমার মনে হল, এর নিশ্চয়ই জুড়ি আছে। এমন সুন্দর কৃষ্ণের রাধা না থেকে পারে কখনো? নিশ্চয়ই এই যুগলমূর্তির পূজো হত এককালে। সেই জোড়ভাঙা রাধাকে আমার চাই। গঞ্জাম থেকে যে বন্ধু এই মূর্তিগুলি পাঠিয়েছিলেন তাঁকে লিখলুম। তিনি জানালেন, বহুকালের মূর্তিটি, অনেক খোঁজ করে পেয়েছেন, কিন্তু রাধার সন্ধান জানেন না। যাক, একজিবিশন তো হয়ে গেল। কিন্তু মনের খটকা আর যায় না, যাকে পাই খোঁজ নিই। দিল্লির দরবারেও এই মূর্তি তিনটির একজিবিশন হয়েছিল; ক্যাটালগে ছবি আছে। সবাইকে সেই ছবি দেখাই আর বলি, ‘এর রাধার সন্ধান পেলে আমায় জানাবে।’

গিরিধারী ওড়িয়া কারিগর এল সোসাইটিতে কাজ করতে। তার প্রপিতামহও খুব বড় কারিগর ছিল। তার তৈরি তিনটি কাঠের সখী আছে আমার কাছে, অতি সুন্দর। গিরিধারী বলত, তার প্রপিতামহ নাকি পুতুলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারত। সে একটা উৎসব-অনুষ্ঠানের ব্যাপার ছিল। গিরিধারীর মুখে শুনেছি, সে তখন ছোট, কাছে যাবার হুকুম ছিল না কিন্তু দেখেছে সেই উৎসবের তোড়জোড়। একবার নাকি পুরীর রাজার শখ হয়, তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে চাই পুতুল নিজে নিজে এসে জগন্নাথকে প্রণাম করবে।’ গিরিধারীর প্রপিতামহ সেই পুতুল তৈরি করেছিলেন। পুতুল নিয়ে গেল জগন্নাথের মন্দিরের কাছে, রাজাও এলেন। কারিগর সেখানে পুতুলকে ছেড়ে দিলে, পুতুল টকটক করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জগন্নাথকে প্রণাম করে ফিরে এল, দেখে সকলে অবাক্‌, রাজা বহু টাকা পুরস্কার দিলেন কারিগরকে।—সেই গিরিধারীকে বলি, যত ডিলার ছিল আমাদের নানা জায়গা থেকে আর্টিস্টিক জিনিস এনে দিত, তাদের বলি—কেউ আর হারানো রাধার সন্ধান দিতে পারে না।

মাতাপ্রসাদ নামে আমার আর-একজন লক্ষ্ণৌর ডিলার ছিল; তার কাছে যেটা চাইতুম কি রকম করে হাতে এনে দিত। তাকেও বলে রেখেছিলুম আমার ওই রাধিকা চাই। বহুদিন পর সে একদিন এল নানারকম জিনিসপত্তর নিয়ে। বসে আছি বারান্দায়; থলি থেকে একটি একটি জিনিস বের করে আমার হাতে দিচ্ছে। দেখে কোনোটা রাখব বলে পাশে রাখছি, কোনোটা ফেরত দিচ্ছি। সবশেষে সে বের করলে একটি আইভরির পুরোনো মূর্তি, লক্ষ্ণৌ থেকে এটি সে সংগ্রহ করেছে। বললে, ‘ভাঙা মূর্তি পছন্দ হবে কি না আপনার জানিনে।’ বলে সেটি আমার হাতে দিলে, মূর্তিটি হাতে নিয়ে আমার তো বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। এ যে আমার সেই রাধিকা! এতদিন যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মুখ দিয়ে আমার আর কথা সরছে না। রাধিকার যে হাতে পদ্ম ধরে আছে সেই হাতটি আছে অন্য হাতটি ভাঙা। হাত ফিরতে ফিরতে হাত ভেঙে গেছে, বা যারা পূজো করত তারাই ফেলে দিয়েছিল হাত ভেঙে যাওয়াতে, কি জানি। ডিলার যা দাম চাইলে তাকে দিয়ে ঘরে উঠে এলুম। তখনি একজন ভালো কাঠের মিস্ত্রি ডাকিয়ে আমার রাধার জন্য একহাত উঁচু একটি মন্দিরের ফরমাশ করলুম। বললুম, এমনভাবে মন্দির তৈরি করবে ভিতরে রাধাকে রেখে, আমি যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে দেখতে পারি। মন্দিরের নিচে একটা চাবি থাকবে, সেটা ঘোরালেই আমার রাধা ঘুরে ফিরে দাঁড়াবে।’ সে এনে দিলে চমৎকার একটি কাঠের মন্দির তৈরি করে। তাতে রাধিকাকে প্রতিষ্ঠা করে অলকের মার হাতে দিলুম; বললুম, ‘রেখে দাও একে যত্নে তুলে। তিনি মন্দিরসুদ্ধ রাধাকে অতিযত্নে তুলে রাখলেন তার কাপড়ের আলমারিতে। মাঝে মাঝে শখ হয়, বের করে দেখি, কেউ এলে দেখাই, আবার রেখে দিই।

তার পর অনেক বছর কেটে গেছে। বহুদিন রাধাকে দেখিনি, মনেও ছিল না তেমন। সেদিন মিলাডা এসেছে। তার সঙ্গে কথায় কথায় মনে পড়ল আমার রাধিকার কথা। মিলাডা কেবল ভিনাস ভিনাস করে, ভাবলুম দিই একবার তার দর্প চূর্ণ করে। বীরুকে ডেকে বললুম, ‘আন তো বীরু আমার রাধিকাকে একবার।’ বীরু ভিতরে গিয়ে বললে পারুলকে। পারুল খুঁজে পায় না কোথা সেই মন্দিরটি। শুনে আমি নিজে গেলুম ভিতরে; বললুম, ‘সে কি কথা, রাধিকা যাবে কোথায়? আমি নিজের হাতে রেখেছি এই আলমারিতে, দেখ ভালো করে।’ মনে মনে ভয় হল, কেউ নিয়ে যায়নি তো? ভাবতেই বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। অলকের মার অসুখ, কথা সব ভুলে যান; তাঁকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, ‘দেখ খুঁজে, ওখানেই তো রেখেছিলুম।’ চাবি নিয়ে পারুল আলমারি খুলে তচনচ করলে; কোথাও নেই মন্দিরটি। পারুল নিচের তাক থেকে বের করলে কাঠের বাক্স থেকে একটি জাভানীজ কাঠের পুতুল। মাদাম টোন একবার এনেছিলেন জাভার নানারকম সব জিনিস, বিচিত্রা হলে তার প্রদর্শনী হয়। তার মধ্যে দুটি পুতুল ছিল; রাজকুমারী আর তার সখী। দাদা কিনলেন রাজকন্যাটি, আমি কিনলুম সখীটি। সেও ভারি সুন্দর; লাল শাড়িটি পরা, খোঁপাটি বাধা, তাতে ফুল গোঁজা। পারুল সেইটি হাতে নিয়ে বললে, ‘এইটেই কি?’ আমি বললুম, ‘আরে না। এ হল রানীর দাসী। রাধিকা হল রানী, তার কেন এমন চেহারা, এমন সাজসজ্জা হবে। খোঁজ, খোঁজ, নামাও সব কাপড়চোপড় জিনিসপত্তর আলমারি থেকে। এখানেই আছে যাবে কোথায়।’ জিনিসপত্র সব নামানো হল। না, কোথাও নেই সেই রাধিকা। হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে থাকগুলি সব দেখি। কপাল দিয়ে আমার ঘাম ঝরতে লাগল। শেষে, এক কোণায় একটি বেশ বড় পার্শিয়ান কাঁচের বোল ছিল, সেইটি যেই সরিয়েছি দেখি রাধিকার মন্দির। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘ওরে পেয়েছি রে পেয়েছি। দেখ্‌ দেখ্‌ এই তো আমার রাধিকা ঠিক তেমনি আছে।’

অতি যত্নে রাখতে গিয়ে, আমি কি অলকের মা রেখেছিলুম ওটি কাচের বোলের পিছনে লুকিয়ে,—মনে নেই কারোই। যাক, পাওয়া তো গেল, পারুলকে বললুম, ‘এবারে জেনে রাখে ভালো করে, আর যেন না হারায়।’ তার পর এলুম বারান্দায়। যে চেয়ারে বসে পুতুল গড়তুম দেখেছ তো সেটি? তাতে হেলান দিয়ে বসে মন্দিরটি হাতে নিয়ে বললুম, ‘এবারে ডাকো মিলাডাকে।’ মিলাডা এল। বললুম, ‘কি তুমি ভিনাস ভিনাস কর। দেখ একবার, তোমাদের ভিনাস ঝক্ মেরে যাবে এর কাছে।’ ব’লে এক হাতে ধরে আর হাতে মন্দিরের দরজাটি খুলে দিলুম। মিলাডা দেখে একেবারে থ। আমি মিলাডার মুখের দিকে একবার করে তাকাই আর নিচের চাবি ঘোরাই, সঙ্গে সঙ্গে রাধিকাও ঘুরে ফিরে দাঁড়ায়। তাকে সামনে থেকে দেখালুম, পিছন থেকে দেখালুম। যে হাতে পদ্মটি ধরে আছে সেদিক থেকে দেখালুম, অন্য হাতটিও ঘোরালুম, বললুম, ‘দেখ, সব দেখ। তোমাদের ভিনাসেরও হাত নেই; কোন হাতে কি ছিল কেউ জানলও না কোনোদিন; আর আমারও রাধিকার হাত নেই। তবে এক হাতে পদ্ম আছে এটা তো জানতে পারা যাচ্ছে। এ হল আমার খণ্ডিরাধিকে। পুরীর রাজার যেমন ছিল খণ্ডিরানী, এ তেমনি আমার খণ্ডিরাধিকে।’

খণ্ডিরানীর গল্প জানো? পুরীর রাজাকে বলে চলন্ত বিষ্ণু, রাজ রথে হাত দিলে তবে রথ চলে। বহুকাল আগে একবার রথযাত্রা হবে, জগন্নাথ রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন। রাজা চলেছেন রথের আগে আগে, চামর করতে করতে। চারদিক লোকে লোকারণ্য; রথের দড়ি টানবার জন্য তীর্থযাত্রীদের তাড়াহুড়ো ঠেলাঠেলি; কেউ কেউ পড়ে যাচ্ছে ভিড়ের চাপে—দেখেছ রথযাত্রা কখনো? এখন, রথ চলেছে ভিড় ঠেলে। রাজা দেখেন পথের পাশে এক পরমাসুন্দরী ভিখারিনী ব’সে ছেঁড়া ময়লা একখানি শাড়ি পারে। রূপ দেখে রাজা গেলেন মোহিত হয়ে। বাড়ি ফিরে এসে রাজা আনালেন সেই ভিখারিনীকে; আনিয়ে রানী করলেন তাকে। সেই রানীর ছিল এক হাত কাটা, লোকে বলত তাকে খণ্ডিরানী। আমি যখন পুরীতে যাই তখনো সেই খণ্ডিরানী বেঁচে; বুড়ি হয়ে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে যেতে পাণ্ডারা দেখাত এই খণ্ডিরানীর বাড়ি। চলন্ত বিষ্ণুর খণ্ডিরানী কালে কালে বুড়ি হয়ে গেল। কিন্তু আমার খণ্ডিরাধা? কালে কালে তার রূপ খুলছেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress