Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোড়া ভরতের জীবনকাহিনি || Shibram Chakraborty

জোড়া ভরতের জীবনকাহিনি || Shibram Chakraborty

জোড়া ভরতের জীবনকাহিনি

বেশ কিছুদিন আগেকার কথা। গত শতাব্দীর শেষের দিকে, তখনও তোমরা আসনি পৃথিবীতে। আমিও আসব কি না তখনও আন্দাজ করে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময়ে বারাসতে এই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটেছিল। অবশ্য তারপর আমিও এসেছি, তোমরাও এসেছ। আমি আসার কিছুদিন পরেই দিদিমার কাছে গল্পটি শুনি। তোমাদের দিদিমারা নিশ্চয়ই বারাসতের নন, কাজেই তোমাদের শোনাবার ভার আমাকে নিতে হল।

সেই সময় একদা সুপ্রভাতে বারাসতে রামলক্ষ্মণ ওঝার বাড়ি যমজ ছেলে জন্মাল। যমজ কিন্তু আলাদা নয়—পেটের কাছটায় মাংসের যোজক দিয়ে আশ্চর্যরকমে জোড়া। সেই অদ্ভুত লক্ষণ রামলক্ষ্মণ পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমার বরাতজোর বলতে হবে। লোকে একেবারে একটা ছেলেই পায় না, আমি পেলাম দু-দুটো—একসঙ্গে এবং একাধারে।’

ডাক্তার এসে বলেছিল, ‘কেটে আলাদা করার চেষ্টা করতে পারি কিন্তু তাতে বঁাচবে কি না বলা যায় না।’

রামলক্ষ্মণ বললেন—‘উঁহুঁ-হুঁ! যেমন আছে তাই ভালো। ভগবান দিয়েছেন, কপালের জোরে ওরা বেঁচে থাকবে।’

ছেলেদের নাম দিলেন তিনি রামভরত ও শ্যামভরত।

পৌরাণিক যুগে জড়ভরত ছিল, তার বহুকাল পরে কলিযুগে এই বিস্ময়কর আবির্ভাব—জোড়াভরত।

জোড়াভরত প্রতিদিনই জোরালো হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমশ হামাগুড়ি দিতেও শুরু করল। চার হাতের চার পায়ের সেএক অদ্ভুত দৃশ্য! কে একজন যেন মুখ বেঁকিয়েছিল—‘ছেলে না তো, চতুষ্পদ!’ রামলক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করেছেন—‘চতুর্ভুজও বলতে পারো। সাক্ষাৎ ভগবান! সকালে উঠেই মুখ দেখি, মন্দ কী!’ তারপর পুনশ্চ জোড় দিয়েছেন—‘হ্যাঁ, নেহাত মন্দ কী?’

ক্রমশ তারা বড়ো হল। ভায়ে ভায়ে এমন মিল কদাচ দেখা যায়। পরস্পরের প্রতি প্রাণের টান তাদের এত প্রবল ছিল যে কেউ কাউকে ছেড়ে একদন্ডও থাকতে পারে না। তাদের এই অন্তরঙ্গতা যে-কেউ লক্ষ করেছে সে-ই ভবিষ্যদবাণী করেছে যে, এদের ঘনিষ্ঠতা বরাবর থাকবে, এদের ভালোবাসা চিরদিনের। সকলেই বলেছে যে, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই একটা প্রবাদ আছে বটে, কিন্তু যেরকম ভাবগতিক দেখা যাচ্ছে তাতে এদের দু-ভাইয়ের মধ্যে কখনো ছাড়াছাড়ি হবে, দুঃস্বপ্নেও এমন আশঙ্কা করা যায় না। এদের আত্মীয়তা কোনোদিন যাবার নয়, না:। বাংলা দেশে আদর্শ ভ্রাতৃত্বের জন্যে মেডেল দেবার ব্যবস্থা সে-সময়ে থাকলে সে-মেডেল যে ওদেরই কুক্ষিগত হত একথা অকুতোভয়ে বলা যায়।

দু-ভায়ে একসঙ্গেই খেলা করত, একসঙ্গে বেড়াত, একসঙ্গে খেত, আঁচাত এবং ঘুমোত অন্য সব লোকের সঙ্গ তারা একেবারেই পছন্দ করত না। সবসময়েই তারা কাছাকাছি থাকত, একজনকে ছেড়ে আরেক জন খুব বেশি দূরে যেত না। রামলক্ষ্মণের গিন্নি তাদের এই সুগুণের কথা জানতেন, এই কারণে যদি-বা কখনো কেউ হারিয়ে যেত, স্বভাবতই তিনি অন্যজনের খোঁজ করতেন। তাঁর অটল বিশ্বাস ছিল যে একজনকে যদি খুঁজে পান তাহলে আরেকজনকে অতি সন্নিকটেই পাবেন। এবং দেখা গেছে তাঁর ভুল হত না।

আরও বড়ো হলে রামলক্ষ্মণ ওদের গোরু দুইবার ভার দিলেন। রামলক্ষ্মণের খাটাল ছিল। সেই খাটালে গোরুরা বসবাস করত, তাদের দুধ বেচে ওঝা মহাশয়ের জীবিকানির্বাহ হত। রামভরত গোরু দুইত, শ্যামভরত তার পাশে দাঁড়িয়ে বাছুর সামলাত—কিন্তু সবদিন সুবিধে হয়ে উঠত না। এক-একদিন দুরন্ত বাছুরটা অকারণ পুলকে লাফাতে শুরু করত। শ্যামভরতকেও তার সঙ্গে লাফাতে হত, তখন রামভরতের না লাফিয়ে পরিত্রাণ ছিল না। রামভরতের হাতে দুধের বালতিও লাফাতে ছাড়ত না এবং দুধের অধঃপতন দেখে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রামলক্ষ্মণ স্বয়ং লাফাতেন।

এত লাফালাফি সহ্য করতে না পেরে রামলক্ষ্মণের গিন্নি একদিন বলেই ফেললেন, ‘দুধের বাছা, ওরা কি দুধ দুইতে পারে?’

রামলক্ষ্মণ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, ‘না:, কিছু হবে না ওদের দিয়ে। স্কুলেই দেব, হ্যাঁ।’

স্কুলের নামে দু-ভায়ের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল।

একদিন তো বাছুরটা শ্যামভরতকে টেনে নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল। রামভরতকে তখন দুধ দোয়া স্থগিত রেখে, অগত্যা বাছুর এবং ভায়ের সঙ্গে দৌড়োতে হল।

রামলক্ষ্মণ সেদিন স্পষ্টই বলে দিলেন, ‘না তোরা আর মানুষ হবি না। যা, তবে স্কুলেই যা তাহলে।’

স্কুলে গিয়ে দু-ভায়ের অবস্থা আরও সঙ্গিন হল। একসঙ্গে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে আসে। কিন্তু সেকথা বলছি না। মুশকিল হল এই, এক ভাই লেট করলে আরেক ভায়ের লেট হয়ে যায়। সেই অপরাধের সাজা দিতে এক ভাইকে কনফাইন করলে আরেক ভাই তাকে ফেলে বাড়ি চলে আসতে পারে না, তাকেও আটকে থাকতে হয়। বিনা দোষেই। একজন যদি পড়া না পারে এবং তাকে মাস্টারমশাই বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন, তখন অন্য ভাইকে নিখুঁতভাবে পড়া দেওয়া সত্ত্বেও, সেইসঙ্গে বেঞ্চে দাঁড়াতে হয়। সবচেয়ে হাঙ্গামা বঁাধল সেইদিন যেদিন, দুজনের কেউই পড়া পারল না আর মাস্টার বললেন একজনকে বেঞ্চে দাঁড়াতে, আরেকজনকে মেঝেতে নিলডাউন হতে। মাস্টারের হুকুম পালন করতে দুজনেই প্রাণপণ চেষ্টা করল খানিকক্ষণ। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। ‘ধুত্তোর’ বলে সেইদিন তারা স্কুল ছাড়ল—ও-মুখোই হল না আর।

বাড়িতে বাবাকে এসে বলল, ‘মানুষ হবার তো আশা ছিলই না, তুমিই বলে দিয়েছ। অমানুষ হবার চেষ্টা করলাম, তাও পারা গেল না।’

শ্যামভরত ভায়ের কথায় সায় দিয়েছে, ‘অমানুষিক কান্ড আমাদের দ্বারা হবার নয়। নিলডাউন আর বেঞ্চে দাঁড়ানো। দুটো একসঙ্গে আবার।’

তারপর থেকে রামলক্ষ্মণ ছেলেদের আশা একেবারেই ছেড়েছেন।

ওরা যখন যুবক হয়ে উঠল তখন ওদের মধ্যে এক-একটু গরমিলের সূত্রপাত দেখা গেল। রামভরত ভোরের দিকটায় ঘুমোতেই ভালোবাসে। তার মতে সকালবেলার ঘুমটাই হচ্ছে সবচেয়ে উপাদেয়। কিন্তু শ্যামভরতের সেই সময়ে প্রাতভ্রমণ না করলেই নয়। ভোরের হাওয়ায় নাকি গায়ের জোর বাড়ে। বাধ্য হয়ে আধা-ঘুমন্ত রামভরতকে ভায়ের সঙ্গে বেরোতে হয়।

মাইল-পাঁচেক হেঁটে হাওয়া খেয়ে শ্যামভরত ফেরে, ক্লান্ত রামভরত তখন শুতে পারলে বঁাচে। ঘুমোতে ঘুমোতে ভায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে সেই কখন, আর দৌড়োতে-দৌড়োতে ফিরল এই এখন এরকম অবস্থায় কার-না পা জড়িয়ে আসে, কে না গড়াতে চায়? কিন্তু শ্যামভরত তখন-তখনই আদা-ছোলা চিবিয়ে ডনবৈঠক করতে লাগবে—কাজেই রামভরতের আর গড়ানো হয় না, তাকেও ভাইয়ের সঙ্গে ওঠবোস করতে হয়।

ব্যায়াম সেরেই শ্যামভরত স্নান সারবে। রামভরত বিছানার দিকে করুণ দৃষ্টিপাত করে তেল মাখতে বসে—কী করবে? স্নান সেরেই শ্যামভরতের রুটির থালার সামনে বসা চাই—সমস্ত রুটিন বঁাধা। ব্যায়াম করেছে, ভোরে হেঁটেছে, তার চোঁ চোঁ খিদে। বেচারা রামভরতের রাত্রে ঘুম হয়নি, ভোরেও তাকে জাগতে হয়েছে, দারুণ হাঁটাহাঁটি। তারপর ফিরে এসেই এক মুহূর্ত পায়নি—গরহজম হয়ে এখন তাঁর চোঁয়া ঢেকুর উঠছে।

সেবলেছে, ‘এখন খিদে নেই, পরে খাব।’

ভাই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে, ‘পরে আবার খাবি কখন? পরে আমার আবার কখন সময় হবে? আমার কি আর অন্য কাজ নেই?’

সেজবাব দিয়েছে, ‘আমার খিদে নেই এখন।’

শ্যামভরত চটে গেছে, ‘খিদে নেই, কেবল খিদে নেই! কেন যে খিদে হয় না আমি তো বুঝি না। কেন, তুমিও তো ব্যায়াম করেছ বাপু! তবে? খিদেয় আমি মরে যাচ্ছি, আর তোমার খিদে নেই—এ কেমন কথা?’

কাজেই রামভরতকে গরহজমের ওপরেই আবার গলাধঃকরণ করতে হয়েছে।

খাওয়াদাওয়া সেরে, প্রথম সুযোগেই রামভরত ভাইকে বিছানার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। ‘এবার একটু শুলে হয় না?’

‘শোয়া আর শোয়া! দিনরাত কেবল শোয়া! কী বিছানাই চিনেছ বাবা!’ শ্যামভরত গম্ভীরভাবেই ছিপ হাতে নেয়।

‘এই দুপুরে রোদের দারুণ গরমে তুমি মাছ ধরতে যাবে?’ রামভরত ভীত হয়ে ওঠে।

‘যাবই তো।’ শ্যামভরত বলে, ‘কেবল শুয়ে শুয়ে হাড় ঝরঝরে হবার জোগাড় হল। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি পড়ে পড়ে ঘুমোও, আমি মাছ ধরতে চললুম।’

শ্যামভরতের গায়ে জোর বেশি, টানও প্রবল। কাজেই কিছু পরেই দেখা যায়, শ্যামভরত মাছ ধরছে আর রামভরতকে তার কাছে চুপটি করে বসে থাকতে হয়েছে।

বেলা গড়িয়ে আসছে, এক ভাই মাছ ধরে, আরেক ভাই পাশে বসে ঢুলতে থাকে।

এইভাবে দু-ভাই ক্রমশ আরও বড়ো হয়ে ওঠে।

একদা বাপ রামলক্ষ্মণ বললেন, ‘বড়ো হয়েছিস, এবার একটা কাজকর্মের চেষ্টা দ্যাখ। বসে বসে খাওয়া কি ভালো?’

বসে বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে কিংবা দৌড়োতে দৌড়োতে কীভাবে খাওয়াটা সবচেয়ে ভালো সেসম্বন্ধে জোড়াভরত কোনোদিন ভাবেনি, কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপের কথা মেনে নিয়েই চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

গাঁট্টাগোট্টা চেহারা দেখে একজন ভদ্রলোক শ্যামভরতকে দারোয়ানির কাজে বহাল করলেন। কিন্তু রামভরতকে কাজ দিতে তিনি নারাজ। শ্যামভরত দিনরাত পাহারা দেয়, রামভরতও ভায়ের সঙ্গে গেটে বসে থাকে।

ভদ্রলোক শ্যামভরতের খোরাকি দেন। রামভরতকে কেন দেবেন? রামভরত তো তাঁর কোনো কাজ করে না। সেযে গায়ে পড়ে, উপরন্তু তাঁর বাড়ি পাহারা দিয়ে দারোয়ানির কাজে বিনে পয়সায় অমনি পোক্ত হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে যে তিনি কিছু চার্জ করেন না এই যথেষ্ট।

তিন দিন না খেয়ে থেকে রামভরত মরিয়া হয়ে উঠল, বললে, ‘আমি তাহলে গাড়োয়ানিই করব।’

এই-না বলে গোরুর গাড়ির একজন গাড়োয়ানের সঙ্গে, কেবল খাওয়া-পরার চুক্তিতে অ্যাপ্রেনটিস নিযুক্ত হয়ে গেল।

এরপর রামভরত গাড়োয়ানি করতে যায়। শ্যামভরতকেও ভায়ের সঙ্গে যেতে হয়। উন্মুক্ত সদর দ্বার বিনা রক্ষণাবেক্ষণে পড়ে থাকে। কোনোদিন-বা শ্যামভরত দরজা কামড়ে পড়ে থাকে সেদিন আর রামভরতের গাড়োয়ানিতে যাওয়া হয় না।

অবশেষে একদিন এক কান্ড হয়ে গেল। ক্ষুধাতুর রামভরত থাকতে না পেরে বাগানের এক কাঁদি মর্তমান কলা চুরি করে খেয়ে বসল। শ্যামভরত ভাইকে বারণ করেছিল কিন্তু ফল হয়নি। তখন থেকে শ্যামভরতের মনে বিবেকের দংশন শুরু হয়ে গেছে।

কর্তা তাকে পাহারা দেবার কাজে বহাল করেছেন। চুরিচামারি যাতে না হয়, তাই দেখাই তো তার কর্তব্য। কিন্তু এ চুরি যে কেবল তার চোখের সামনেই হয়েছে তা নয়, সেএতে বাধা দেয়নি, দিতে পারেনি; এমনকী একরকম প্রশ্রয়ই দিয়েছে বলতে গেলে। তার কি এতে কর্তব্যের ত্রুটি হয়নি? এ কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? কে বড়ো? ভাই, না মর্তমান কলা?

অবশেষে আর থাকতে না পেরে, শ্যামভরত চুরির কথাটা কর্তার কাছে বলেছে। কর্তা হুকুম দিয়েছেন, ‘চোরকো পাকড় লেয়াও।’

চোর পাকড়ানো অবস্থাতেই ছিল, সুতরাং তাকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। কর্তা তৎক্ষণাৎ রামভরতকে শ্যামভরতের সাহায্যে থানায় ধরে নিয়ে পুলিশের হাতে সমর্পণ করেছেন।

সাত দিন ধরে বারাসতের আদালতে এই চুরির বিচার চলেছিল। রামভরত আসামি, শ্যামভরত সাক্ষী। রামভরত আসামির কাঠগড়ায়, তার হাতে হাতকড়া—শ্যামভরত ভায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। আবার শ্যামভরত যখন জবানবন্দি দেয় তখন রামভরতকে ভায়ের সঙ্গে সাক্ষীর কাঠগড়ায় আসতে হয়।

অবশেষে রামভরতের এক মাস জেলের হুকুম দিলেন হাকিম। রামভরতকে জেলে নিয়ে গেল, কিন্তু শ্যামভরতকেও সেইসঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। অথচ শ্যামভরতের জেল হয়নি। মহা মুশকিল ব্যাপার। নির্দোষের অকারণ সাজা হতে পারে না। অগত্যা রামভরতকে জেল থেকে খালাস দিতে হল।

খালাস পাওয়ামাত্র রামভরত বলা নেই কওয়া নেই, ভাইকে ঠ্যাঙাতে শুরু করে দেয়। তাদের জীবনে প্রথম ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব। শ্যাম রামকে ঘুসি মেরে ফেলে দেয় সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গিয়ে পড়ে তার ঘাড়ে, তারপর দুজনে জড়াজড়ি, হুটোপুটি, তুমুল কান্ড।

রাস্তার লোকেরা মাঝে পড়ে বাধা দেয়। দুজনকে আলাদা করবার চেষ্টা করে। কিন্তু আলাদা করতে পারে না। অল্পক্ষণেই বুঝতে পারে, দুজনকে তফাত করা তাদের ক্ষমতার অসাধ্য। কাজেই তাদের ছেড়ে দেয় পরস্পরের হাতে। তারাও মনের সুখে মারামারি করে। অবশেষে দুজনেই জখম হয়, তখন দুজনকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল—একই স্ট্রেচারে।

হাসপাতাল থেকে ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করে ছেড়ে দেবার পর দুজনে বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি চলে, কিন্তু কেউ একটি কথা বলে না। রামভরত গুরুগম্ভীর, শ্যামভরত ভারি বিষণ্ণ। রামভরত আস্তে আস্তে হাঁটে, মাঝে মাঝে কপালের ঘাম মোছে। শ্যামভরত থেকে থেকে ঘাড় চুলকোয়। সেই ফাঁকে আড়চোখে ভায়ের মুখের ভাব লক্ষ করার চেষ্টা করে।

দু-ভাই চুপচাপ হেঁটে চলে।

অবশেষে রামভরত আফিমের দোকানের সামনে এসে পৌঁছোয়। একটা টাকা ফেলে দেয় দোকানে। এক ভরি আফিম কেনে, কিনেই মুখে পুরে দেয় তৎক্ষণাৎ।

শ্যামভরত ব্যস্ত হয়ে ওঠে, রামভরত কিন্তু উদাসীন। শ্যামভরত মাথা চাপড়ায়, রামভরত এক ঘটি জল খায়। শ্যামভরত চায় ভাইকে নিয়ে তখুনি আবার হাসপাতালের দিকে ছুটতে। রামভরত কিন্তু দেওয়াল ঠেস দিয়ে একটা খাটিয়ায় বসে পড়ে। শ্যামভরত তখন কেঁদে ফেলে, বলে, ‘এ কী করলি ভাইয়া।’

রামভরত ভারী গলায় জবাব দেয়, ‘কলা খেলে আফিম খেতে হয়।’

‘আচ্ছা এবার তুই যত খুশি কলা খাস, আমি আর বলব না।’ শ্যামভরত লুটিয়ে পড়তে চায় মাটিতে।

রামভরত গম্ভীর হয়ে ওঠে, ‘আফিম খেলে আর কলা খেতে হয় না।’

এই কথা বলে সে, খাটিয়ার ওপর সটান হয়। দেখতে দেখতে রামভরত মারা যায়।

আর শ্যামভরত?

শ্যামভরতকে যেতে হয় সহমরণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *