জুতোচোর হইতে সাবধান
নতুন চটি জোড়া একধারে খুলে রেখে সরোজদের বাড়ির হলঘরে ঢুকলুম। প্রতি শনিবার সন্ধেবেলা ওখানে ধর্মসভা হয়। জমায়েত নেহাত মন্দ হয় না। মেঝেতে মোটা মোটা শতরঞ্চি পাতা। একটু ফুল। ভালো ধূপের গন্ধ। মৃদু আলো। সব মিলিয়ে ভারী সুন্দর এক পরিবেশ। প্রথমে ভজন হয়। তারপর ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ব্যাখ্যা। সবশেষে আমেরিকান কায়দায় প্রশ্নোত্তর। মানুষের আধ্যাত্মিক ক্ষুধা ইদানীং খুব বেড়েছে। আর বাড়বে নাই বা কেন? ল্যাং মারামারির পৃথিবীতে মানুষকে একটা কিছু তো ধরতেই হবে। কিছু না ধরলে বাঁচব কী নিয়ে। কে আছে আমাদের, কী আছে আমাদের? সারাটা জীবন শুধু ধান্দাবাজি। সব বক্তাই প্রায় একই কথা বলেন। বিশ্বাস, ভক্তি, ত্যাগ, গুরুকৃপা, শরণাগতি। এইসব মশলা একসঙ্গে মিশিয়ে ধৈর্য ধরে একটু তা দিতে পারলেই, আনন্দেরই বইবে জোয়ার, পাবি মোক্ষধাম।
অনেক সুন্দরী সুন্দরী মহিলা আসেন। গলায় গলা মিলিয়ে ভজন করেন। হলঘরে যেন স্বর্গ নেমে আসে। কোনও কালেই আমার ধর্মে তেমন মতি ছিল না। জীবনে গোটাকতক বড় ধাক্কা খেয়ে সার বুঝেছি ইহ সংসারে কিছু নেই। সব ধোঁকাবাজি, স্বার্থ। কেউ কথা দিয়ে কথা রাখে না। ভালোবাসে না। গ্রাহ্য করে না। যার ক্ষমতা আছে কথায় কথায় অপমান করে। সুযোগ পেলেই মানুষ ঠকায়। মানুষের করতে পারলেই ভালো। না পারলেই খারাপ। মনের এই বীভৎস অবস্থায় সরোজদের বাড়িতে এসে বড় শান্তি পাই। আড়ে আড়ে মহিলাদের দিকে তাকাই আর ধর্মকথা শুনি। তাকানো উচিত নয়; তবু চোখ চলে যায়। কী করব! চোখের যেমন স্বভাব। আবার এ-ও ভাবি, আমি তো শুধু দুটো চোখ নই, আরও অনেক কিছু। তবে আমার মনের চেহারা অন্যরকম। সম্পূর্ণ উদাসী। কোনও কামনা-বাসনা নেই। ষড়রিপু প্রায় জব্দ করে ফেলেছি। সার্কাসের রিং। মাস্টারের মতো। যেই চাবুক ঘোরাই বাঘগুলো সব ছাগল হয়ে যায়। যেই সাপুড়ে-বাঁশি বাজাই সাপগুলো আর ফণা তুলে দাঁড়াতে পারে না। নেতিয়ে পড়ে। ভালোমন্দ খাওয়ার লোভ আর আমার নেই। নেই মানে, পেটে সহ্য হয় না। নিরামিষ ধরে ফেলেছি। ফেলেছি মানে আমাকে ধরে ফেলেছে। দাঁত গেছে, মাংস আর চিবোতে পারি না। ডিম সাহস হয় না। ডিমে শুনেছি বাত বাড়ে। আমাদের বাতের বংশ। গেঁটে বাত আর মুখের বাত—দুটোই আমাদের বংশের ধারা।
মাছে আঁশটে গন্ধ লাগে। সকলের লাগে না, আমার লাগে; কারণ আমার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিডনি দুর্বল হলে ওইরকম হয়। কীরকম একটু একটু করে ত্যাগের পথে এগিয়ে। যাচ্ছি। ভাবতেও ভালো লাগে। আজকাল রাগ হলেও আর রাগি না। রাগলে হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপে। প্রেসার চড়ে গিয়ে চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছেন, হার্টের অবস্থা ভালো নয়। রাগারাগি করলে সেরিব্রাল স্ট্রোক হতে পারে। হলেই প্যারালিসিস। না বাবা পক্ষাঘাতে পড়ে থাকতে চাই না। তাই আজকাল ক্ষমাসুন্দরের দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখি। ক্ষমাই পরম ধর্ম। কামিনী কাঞ্চনে আর সে আসক্তি নেই। এই যে মহিলাদের দিকে আড়চোখে চাই, সে অন্য কারণে। ভাবি, দেশটার কী হচ্ছে! এমন সব সাজ-পোশাক! এমন খোলাখুলি কি জনসমক্ষে। বেরোনো উচিত? আমার মতো সংযমী আর কজন আছে! এই কি আমাদের সনাতন ভারতের লাজনা নারী! মনে মনে বলি, আর চেয়ে চেয়ে দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ধর্মকথায় কান থাকে না। কল্পনায় দরজি হয়ে ব্লাউজের হাতা বসাই, কোমরে পটি লাগাই, গলাটাকে ছোট করি। নারীই তো ধর্মপথের সহায়! তাঁরা যদি এইভাবে অনবরত আকর্ষণ ছোড়েন, আমার না হয় কিছুই না, আমার ব্লাডে সুগার, কিন্তু অন্যের কী হবে! কাঞ্চনে আমার আর আসক্তি নেই, কারণ যত আয় বাড়বে তত বাড়বে ট্যাক্স, আমার অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরে। সরকারের জন্যে রোজগার। করে লাভ কী! তাছাড়া নিজের ভোগ তো গেছে, অন্যের ভোগের জন্য উদয়াস্ত খেটে মরার মতো গাধা আমি নই। আমি আজ প্রায় একজন নিরাসক্ত যোগী। সিদ্ধিলাভ হতে আর দেরি নেই; অবশ্য সিদ্ধি বস্তুটা কী, আমার ঠিক জানা নেই। কে যেন বলছিলেন সিদ্ধি না খেয়েই, সিদ্ধি খাওয়ার মতো অবস্থাকেই বলে সিদ্ধিলাভ। চোখ দুটো উলটে কপালের দিকে চলে যাবে। মুখটা যেন রসভরা পেল্লায় এক রসগোল্লা। চটরপটর কথার খই আর মুখে ফুটবে না। মৃদুমন্দ হাসি। বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাতের চেটোটা মাঝে মাঝে উঠবে আর পড়বে। থেকে থেকে গলাটাকে খাদে নামিয়ে এনে বলা—শিব, শিব। চলতে গেলে পা টলবে; তখন গাইতে হবে সুরাপান করিনে আমি সুধা খাই জয় কালী বলে। ছোট একটা উঁড়ি হবে। শরীরের সমস্ত খোঁচাখ্যাঁচা গোল হয়ে যাবে। আধ্যাত্মিক মেদে ঢেকে বর্তুলাকার সিদ্ধ শরীর। ভাত-ডাল-কচু-ঘেঁচু প্রভৃতি জাগতিক আহারে আর রুচি থাকবে না। শরীর সামান্য যা গ্রহণ করবে; তা হল ফল, ছানা, নরমপাক সন্দেশ, মেওয়া, একটু পরমান্ন। যতদিন না সিদ্ধিলাভ হচ্ছে, ততদিন তো এই যৎসামান্য ভোগ জুটবে না। সেই সাতসকালে ভুরিভোজ করে দাসত্বে দৌড়োতে হবে। সারাদিন ঈশ্বরী কথা। শোনা হবে না। কেবল বিষয়ের কথা। ব্যবসা-বাণিজ্য। পরচর্চা, পরনিন্দা। দূরে তো আর থাকা যাবে না। তালে তাল মেলাতেই হবে। নয়তো শত্রু বেড়ে যাবে। অসৎ কাজও কিছু করতে হবে। নিজের জন্যে, ওই মনিবের জন্যে। মোটা মাইনে দেয়, নিমকহারামি তো আর সম্ভব নয়। অধর্ম হবে।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, আর গীতার ধর্মব্যাখ্যা শুনছি। তেমন মন লাগছে না। চোখ চলে যাচ্ছে বারে বারে মহিলাদের দিকে। গীতাটা মনে হয় সামান্য নীরস। একটু বোরিং, তেমন টান নেই। কী যে ছাই আছে ওতে! এই ভাবনা আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে এক দাবড়ানি লাগালুম। অমন করলে তো সিদ্ধিলাভ হবে না। প্রথম প্রথম শুনতে হবে; তারপর তো আমি শোনাব। আর শোনাবারও বেশি কিছু নেই। তিনটি মাত্র বাক্যসত্যম শিবম, সুন্দরম। সে তোমার। রাজকাপুরের ছবিও হতে পারে, আবার ধর্মও হতে পারে। যে যেভাবে নেয়। সেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের গল্প। মাঠের মাঝখানে একটা টিবি। প্রথম রাতে এক মাতাল টলতে টলতে আসছে। ঢিবিটাকে দেখে বলেছ, কী বাবা! রাত পাকা হবার আগে নেশাটা পাকিয়ে ফেলেছ; আর বোতল সাবাড় করেও আমার কিছু হল না, টলে বেড়াচ্ছি। মাঝরাতে এল এক চোর। সে বললে, বাঃ,। রাত শেষ হবার আগেই কাজ হাসিল। আর আমার কিছুই হল না বাপ। শেষ রাতে এলেন এক যোগী। তিনি বললেন, বাঃ, ভাই। ঠিক সময়টিতে ধ্যান লাগিয়ে বসে আছ! তাহলে আমিও বসে যাই।
এই হল ব্যাপার, যে যেভাবে নেয়! এইন-টা, সাড়ে নটা নাগাদ ধর্মসভা শেষ হল। অনেক অনেক কথা ঝরে গেল তুষারের মতো। বক্তা মাঝে মাঝে ভাবের চোটে কেঁদে ফেলছিলেন। আমিও। কাঁদতে চাইছিলুম। যেখানে যা। এখানে একটু অশ্রু বিসর্জন করতে না পারলে সকলের নজরে পড়া যায় না। বুকের কাছে খুব ঢেউ খেলালুম, মানে নিংড়োলুম। একফোঁটাও জল বেরোল না। অনেকক্ষণ জল খাওয়া হয়নি, শরীর একেবারে ড্রাই হয়ে গেছে। যাক, সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। অনেকের হাঁটা দেখে মনে হল মাতাল হয়েছে। সাধে রামপ্রসাদ লিখেছিলেন—সুরাপান করিনে আমি সুধা খাই জয়কালী বলে। এই হল সেই সুধা। ঘরে ধূপের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, মেয়েদের শরীরের দামি সেন্টের খুশবু। যেন একটা লীলাখেলা হয়ে গেল। সরোজ প্রতিবারের মতো ধ্যানে বসেছে। এ ধ্যান সহসা ভাঙবে না। অত বড় কন্ট্রাক্টর, আর্কিটেক্ট। লাখ লাখ টাকা আয়। তবু কী ভক্তি! এই যে ধ্যানে বসল তো বসলই। পাশেই টুকটুকে একটা লাল টেলিফোন। টেলিফোনটা বাজলে ওই ধ্যানের মধ্যেই ধরবে। না ধরে উপায় কী! টেলিফোনের তার বেয়ে। ব্যবসা গড়িয়ে আসে। লাখ, বেলাখ। টাকা না থাকলে ধৰ্ম হয়! আর লোকেই বা আসবে কেন হা ভাতের ঘরে। যে যাই বলুক, সরোজ এক মহাপুরুষ। ধ্যানও করছে, ব্যবসাও করছে। সবশেষে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম আমি। ফাঁকা বারান্দা। বাতাস দৌড়োচ্ছে। এ কী, আমার জুতো! আমার নতুন জুতো। জুতো কোথায় গেল! অনেকদিন পাঁয়তারা কষার পর কাল সবে কিনেছি। যাঃ, সর্বনাশ হয়ে গেল। ধর্মের সঙ্গে জুতোর কী সুন্দর সম্পর্ক! দেখ তো না দেখ। মন্দিরে এক মায়ের ভক্ত জুতো খোলা মাত্রই আর এক ভক্ত অমনি সজাগ। সঙ্গে সঙ্গে দায়মুক্ত করে চম্পট। যতক্ষণ জুতো না চুরি যাচ্ছে ততক্ষণ ধর্মস্থান ধর্মস্থানই নয়। সরোজের ধর্মচক্র তবে আজই জাতে উঠল। সে না হয় হল, আমি কী করি! একজোড়া নতুন আরও দামি জুতো পড়ে আছে। এ জোড়াটা মনে হয় সরোজের। সরোজ এখন ধ্যানে। দেখে মনে হচ্ছে আমার হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানস্থ। মনটাকে এত উর্ধ্বে তুলে দিলুম, যেখানে তুমি, আমি ভেদ নেই। আত্ম-পর জ্ঞান নেই। সবই সেই আমি। সবই আমার। চোখ বুজিয়ে জুতো জোড়া পায়ে গলালুম, তারপর গুটিগুটি সিঁড়ির দিকে। লোকে কেন জুতো চুরি করে এখন বুঝছি। সাংঘাতিক এক উত্তেজনা। গুটিগুটি হাঁটছি আর মনে হচ্ছে এই বুঝি ধরা পড়ে গেলুম। সরোজ পেছন থেকে বলে উঠল বুঝি অ্যায়! নিজের জুতো চুরি গেছে দেখলে বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মনে হয় নিজের আত্মাটাই যেন চুরি হয়ে। গেছে। আর অন্যের জুতো পায়ে গলিয়ে আসতেও মনে হল আর একজনের আত্ম সঙ্গে সঙ্গে আসছে। মানুষ আত্মার খোঁজ করছে যুগ যুগ ধরে। জুতোই যে আত্মা, এ বোধটা আমারও ছিল, তাদেরও নেই। সরোজের বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে বললুম, ওহে! জুতোই আত্মা।
পরের সপ্তাহে ধর্মসভায় গিয়ে দেখি দেয়ালে ঝুলছে বড় বড় অক্ষরের নোটিশ-জুতো চোর। হইতে সাবধান। নোটিশটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখি আরও একজন থমকে। দাঁড়িয়েছেন। আমি তাঁর পায়ের দিকে তাকালুম। আমার মতোই চালাক। আমার পায়েও সরোজের জুতো জোড়া নেই। অন্য জুতো।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানেও জুতোচোর, আশ্চর্য!
আমি হাসলুম। মনে মনে বললুম, যেমন আপনি আর আমি।
আজ আমি ভীষণ চালাক। একটা সাইড-ব্যাগ এনেছি। জুতো জোড়া ব্যাগে ভরে আসরে গিয়ে বসলুম। শরৎচন্দ্র যেমন বলেছিলেন—আজ আমি অজুতো-বল। নিজের আত্মা নিজেরই ব্যাগে।