রসগোল্লা সামলাতে
রসগোল্লা সামলাতে সরে যান করুণাময়ী।
কিন্তু করুণাময়ীর ছেলে কেমন করে সামলাবে নি জকে? কী করে বুঝবে এ স্বপ্ন না মায়া? শয়তানী না স্বর্গীয় সুষমা?
আরাম কুঞ্জর প্রোপ্রাইটার এন, কে চ্যাটার্জি কি হঠাৎ ঈশ্বরের স্পর্শ পেয়ে সমস্ত ক্লেদমুক্ত। হয়ে, মহৎ হয়ে গেছে? সুন্দর হয়ে উঠেছে?
.
হয়তো তাই।
হয়তো ক্লেদাক্ত মানুষটা নির্মল হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের স্পর্শ কখনো কখনো এসে পৌঁছায় বুঝি কুৎসিত জীবনের কাদার উপর।
তাই বারংবার কোটের হাতায় চোখ মুছছে রিষড়ের হরিকুমারের ছেলে নন্দকুমার।
সুখে থাক মা, শান্তিতে থাক। আমি তোর হতভাগা পাষণ্ড মামা, কত জুলুম করেছি তোর ওপর, কত কষ্ট দিয়েছি। তবু এটুকু মনে জানিস যা করেছি বুদ্ধির ভুলে করেছি। কিন্তু তুই আমার মেয়ে নয় ভাগ্নী, একথা কোনদিন মনে করি নি।
মল্লিকা বুঝতে পারে না।
মল্লিকা দিশেহারা হয়ে এই ভাবাবেগের অর্থ খোঁজে। এ কী তার চির অভিনেতা মামার এক নতুন অভিনয়? নিখুঁত, নিপুণ! নাকি হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আর অসম্ভবকে সম্ভব করা সন্ধান করে করে শুধু তার পালানো ভাগ্নীকে আশীর্বাদ করতে এসেছে আরাম কুঞ্জর প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি?
সেই আশীর্বাদটুকু দিয়েই আবার ফিরে চলে যাবে সেই হাজার মাইল ভেঙে? কোনও উদ্দেশ্যসিদ্ধি নয়? কোনও হিংস্র প্রতিশোধ নয়? অতীত কলঙ্কের কথা ফাঁস করে দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা নয়, কিছুই নয়?
এই যে বাবাজী।
তাড়াতাড়ি চোখের শেষ আর্দ্রতাটুকু কোটের হাতায় নিশ্চিহ্ন করে চাটুয্যে বলে, কী বলে যে তোমায় আশীর্বাদ করব! ভাল ভাল কথা তেমন জানি না, তাই শুধু বলছি তুমি সুখী হও, দেবতা তুমি, অধিক আর কি বলব।
প্রভাত থতমত খায়। হতভম্ব হয়। এ কী!
জগতের যত বিস্ময় সবই কি আজ প্রভাতের জন্যই অপেক্ষা করছিল?
শাণিত ছোরার বদলে আশীর্বাদের শান্তিবারি?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রভাত আর কিছু ভেবে না পেয়ে হঠাৎ হেঁট হয়ে চাটুয্যের পায়ের ধুলো নেয়। ঠিক যেমন নেয় ভদ্র জামাইরা বাড়িতে শ্বশুর-সম্পৰ্কীয় কেউ বেড়াতে এলে।
চাটুয্যেও ঠিক ভদ্র শ্বশুরের মতই বলে, থাক থাক। দীর্ঘজীবী হও! মল্লিকা মাকে তাই বলছিলাম, অনেক জন্মের পুণ্যে দেবতার দেখা পেয়েছিলি তাই তরে গেলি, নরক থেকে ত্রাণ পেলি। স্বর্গ থেকে তোর মা আজ তোদের শত আশীর্বাদ করছে। তোমাকে আর কি বলব বাবা, পাণ্ডব-বর্জিত দেশে পড়েছিলাম, সৎপাত্রে মেয়েটার বিয়ে হয়তো জীবনেও দিতে পারতাম না। দেখে মে,-বড় শান্তি পেয়ে গেলাম। তবে যাই মা মল্লিকা। আসি বাবা প্রভাত।…বেয়ান কোথায় গেলেন, বেয়ান। বড় মহৎ মানুষ। একটু পায়ের ধুলো নিয়ে যাই।
স্বভাব-বাচাল লোকটা বেশি কথা না কয়ে পারে না। কিন্তু যারা শোনে, তারা অকূল সমুদ্রে আথালিপাথালি করতে থাকে।
সৎ বস্তু, সুন্দর বস্তু, মহৎ বস্তুকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে না পারার মত যন্ত্রণা আর কি আছে?
.
অনেক রাত্রে বোধহয় কৃষ্ণপক্ষ, আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে, জানলার ধারে চৌকীটাকে টেনে এনে বসে আছে ওরা।…প্রভাতের মুখে প্রসন্নতা। কিন্তু মল্লিকার মুখ ভাবশূন্য।
মল্লিকা যেন এখানে বসে নেই।
প্রভাত এই ছায়াছায়া জ্যোৎস্নায় হয়তো ধরতে পারে না সেই অনুপস্থিতি, তাই ওর একটা হাত হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে গভীর সুরে বলে, মানুষের কত পরিবর্তনই হয়! :
মল্লিকা কথা বলে না।
প্রভাতই আবার বলে, স্বার্থবুদ্ধিতে যাই করে থাকুন, তোমার মামা কিন্তু তোমাকে . ভালবাসেন খুব!
মল্লিকা তবু নীরব।
প্রভাত একটু অপেক্ষা করে বলে, ছেলেমেয়ে তো নেই নিজের! সাপের বাঘেরও বাৎসল্য স্নেহ থাকে। কি বল? তাই না?
মল্লিকা একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ঘুম পাচ্ছে, শুচ্ছি।
চাঁদের আলো রেলগাড়ির মধ্যেও এসে পড়েছিল। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল না নন্দকুমার চাটুয্যের। আর অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। সে ইচ্ছে কামরার দরজাটা খুলে ঝপ করে লাফিয়ে পড়বার। পড়লে কেমন হয়?
গাড়িটা যে ক্রমশই তাকে তার ভয়ঙ্কর একটা আশার ঘর থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এই করতেই কি হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিল চাটুয্যে, হাজার লোকের কাছে সন্ধান নিয়ে নিয়ে? পেয়ে হারাবার জন্যে?
আশ্চর্য! বুদ্ধির গোড়ায় কি শনি ধরেছিল চাটুয্যের? তাই তার তখন অকারণ মনে হয়েছিল যার জন্যে ছুটোছুটি তার বদলে খুব মস্ত একটা কি পেলাম! সেই পরম পাওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে মুঠোয় পাওয়া জিনিস মুঠো খুলে ফেলে দিয়ে এল।
এন কে-র মত ঘোড়েল লোকটা কিনা ঘায়েল হয়ে গেল সস্তা একটু ভাবালুতায়? আসলে সর্বনাশ করেছিল মেয়েটার ওই টানটান করে চুল বাঁধা কপালের মাঝখানের মস্ত সিঁদুর টিপটা। ওই কপালটা দেখে মনে হচ্ছিল না ও মল্লিকা। মনে হল ও হরিকুমার চাটুয্যের সেই কিশোরী মেয়েটা! অকাল কুম্মাণ্ড নন্দকুমারের ছোট বোন। যে বোনটা পরে অনেক দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা সয়ে আর চেহারা সাজ বদলে তবে মরেছিল।
কিন্তু যখন মরে নি, সাজ বদলায় নি, তখন অমনি টানটান করে চুল বাঁধতো সেই মেয়েটা, আর ফর্সা ধবধপে কপালের মাঝখানে ওই রকম জ্বলজ্বলে একটা টিপ পরত।
মল্লিকা যেন নন্দকুমারের দুর্বলতার সুযোগ নেবার জন্যেই তার মরা ছোট বোনের চেহারা আর সাজ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
কিন্তু এন কে পাগল নয়। সাময়িক দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে সে।
উঃ, যাই ভাগ্যিস ঠিকানাটা ভাল করে লিখে আনা হয়েছে।
গণেশ মুচকি হেসে বলে, জানতাম!
জানতিস? কী জানতিস রে তুই শূয়ার?
জানতাম ফিরিয়ে আনতে পারবেন না
পারব না? অমনি জানতিস তুই?
চিরপরিচিত পরিবেশে ফিরে এসে নিজেকে একটা গাধা বলে মনে হয় চাটুয্যের। তবু মুখে হারে না। বলে, তোর মতন তো বুন্ধু নই যে একটা হঠকারিতা করে বসব? দেখে এলাম, এবার চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে। ট্যান্ডন ফিরেছে?
কবে! এসে বলল, এন কে-র মেয়েকে খুঁজে বেড়াবার এত কী দায় আমার? মেয়ের কি অভাব আছে? ভাড়া ফেললেই মেলে। কত চাও?
হু। টাকার কাঁড়ি খেয়ে আবার লম্বা লম্বা বোলচাল। দেখাচ্ছি বাছাধনকে। আর নায়ার?
তার কোন খবর জানি না।
.
তা খবর জানবার কথাও নয়। সে তখন চাটুয্যের ফেলে আসা পথেই ঘোরাফেরা করছে।
সে কথা বলাবলি করে করুণাময়ীর বড়বৌ আর মেজবৌ। পরনিন্দারূপ মহৎ আর শোভন কাজটিতে তাদের ভাবের আর অন্ত নেই।
সেই ভাবের ক্ষেত্রে বসে দুজনে বলাবলি করে, মামা এসে যাবার পর থেকে ছোট বৌয়ের কী রকম অহঙ্কার অহঙ্কার ভাব হয়েছে দেখেছিস?
তা আর দেখিনি? শাশুড়িকে লুকিয়ে কত আসত, বসত, কাজ শিখত আগ্রহ করে, আর এখন এমুখো হয় না।
দেখেছি তাই! এখন আবার দেখছি ওবাড়ির নতুন ঠাকুরপোর সঙ্গে ভাবের ঢলাঢলি, না কি জুয়া খেলাখেলি চলে।
জুয়া।
তাই তো বলল ঠাকুরপো। ডাকলাম সেদিন যাবার পথে। বললাম, কী গো, নতুনকে পেয়ে পুরনোদের যে একেবারে ভুলেই গেলে? তা অপ্রতিভ হয়ে বলল, প্রভাতদার বৌ অনেক রকম তাসখেলা জানে, তাই শিখছি
লজ্জাও করে না। মেয়েমানুষের কাছে খেলা শেখা
মরণ তোমার! মেয়েমানুষই তো সকল খেলার কাজী। তেমন তেমন খেলিয়ে মেয়েমানুষ হলে–তা আমাদের ইটিও তো কম যান না। এসে অবধি তো অনেক খেলাই দেখাচ্ছেন। এই একেবারে কনে বউটি, চোখ তুলে তাকান না। এই আবার দেখ, যেন সিনেমা অ্যাকট্রেস। চোখের চাউনি ভুরুর নাচুনি দেখলে তাক লেগে যায়। ঠাট দেখলে গা জ্বলে। ঠাকুরপো চুপি চুপি বলল, ওসব তাস খেলা নাকি স্রেফ জুয়া খেলা। বাজী ধরে খেলা তো? বলে নাকি কত খারাপ খারাপ বড়লোক ওই তাস খেলাতেই সর্বস্বান্ত হয়।
বলি এত সব জানল কোথায় ও?
কী জানি বাবা! আমরা তো সাতজন্মেও শুনি নি ওসব, জানা তো দূরের কথা। শুধু কি তাই, ঠাকুরপোর কাছে নাকি একদিন বাহাদুরী করে বলেছে-যত রকম মদ আছে জগতে, আর যতরকম সিগারেট পাওয়া যায় বাজারে, ও নাকি সমস্তর নাম জানে।
এত সব তোমায় বলল কে গো?
কে আর, ছোঁড়াটাই। বলেছে কি আর বুঝে? আমিই কুরে কুরে বার করেছি। এতক্ষণ কিসের কথা হচ্ছিল গো? জিগ্যেস করলেই ভয় পেয়ে বলে ফেলে, কিছু কথা হচ্ছিল না, শুধু মুখপানে চেয়ে বসেছিলাম এই কথা পাছে দাঁড়ায়, সেই ভয় আর কি।
তা ভয় ভাঙতে আর কতক্ষণ? মেয়েমানুষ যদি প্রশ্রয় দেয়! হাঁদা ছেলেটার পরকাল ঝরঝরে হল আর কি!
আমাদের ছোটবাবুরও হয়েছে ভাল! ওই বৌয়ের মনোরঞ্জন করে তো চলতে হচ্ছে?
.
এমনি অনেক কথা হয় দুই জায়ে।
এমনিতে যারা পান থেকে চুন খসলে পাড়া জানিয়ে কেঁদল করে।
ওদের আলোচনার মধ্যে থেকে যে ইশারা উঁকি মারে, সেটা কিন্তু খুব একটা মিথ্যে নয়। খুড়তুতো দ্যাওর পরিমলকে নিয়ে হঠাৎ যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে মল্লিকা। বিশেষ করে তাস নিয়ে যেন মেতে ওঠে, কাড়াকাড়ি হুড়োহুড়ি আর সহসা উচ্চকিত হাসির শব্দ বাড়ি ছাড়িয়ে অন্য বাড়ি পৌঁছায়।
করুণাময়ী বাড়িতে খুব কমই থাকেন এই রক্ষে, তবু মাঝে মাঝে বিরক্ত হন তিনি। বলেন, মামা এসে একদিন দেখা দিয়ে গিয়ে আসপর্দাটা যেন বড় বাড়িয়ে দিয়ে গেল মনে হচ্ছে। কই, এত বাঁচাল তো ছিল না ছোট বৌমা! এতবড় ডাগর ছেলেটার সঙ্গে এত কিসের ফষ্টি-নষ্টি? ওর লেখাপড়া আছে, ওর মাথায় তাসের নেশা ঢুকিয়ে দেবার দরকারই বা কি?
প্রভাতকে লক্ষ্য করেই অবশ্য বলতেন এসব কথা।
.
প্রথম প্রথম প্রভাত হেসে ওড়াত। বলত, ডাগর ছেলেটা তোমার বৌয়ের থেকে পাঁচ বছরের ছোট মা?…বলতো-মামা হঠাৎ একদিন দেখা দিয়ে মন কেমন বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন, মনটা প্রফুল্ল করতে যদি একটু খেলাধূলো করে ক্ষতি কি? বৌদিরা তো ও রসে বঞ্চিত, তাই পরিটাকেই ধরে এনে
বলাবাহুল্য বৌদিদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি যে করুণাময়ীর চক্ষুশূল সে কথা জানতে বাকী নেই প্রভাতের, ওইটাই বলত মাকে থামাতে। কুটিল কুচুকুরে (করুণাময়ীর ভাষায়) বউ দুটোর চেয়ে যে খোলামেলা-মন দ্যাওরপোটাকে তিনি শ্রেয় মনে করবেন এ সত্য প্রভাতের জানা।
কিন্তু প্রভাতের নিজেরই একদিন বিরক্তি এল।
ছাতে উঠে গিয়ে তাসের আসর বসানোর সখটা তার চোখে একটু বেশি বাড়াবাড়ি ঠেকল।
উঠে গেল নিজেই।
দেখল পাতা মাদুরের ওপর তাসগুলো এলোমেলো ছড়ানো, আর কি একটা জিনিস নিয়ে তুমুল কাড়াকাড়ি করছে পরিমল আর মল্লিকা।
ব্যাপার কি?
ভুরু কোঁচকালো প্রভাত।
পরিমল অপ্রতিভ হয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে বলে, দেখ না, চার টাকা হেরে গিয়ে বৌদি এখন আমার জিতের পয়সা দেবে না বলছে।
টাকা, পয়সা, এসব কি কথা? বাজী ধরে তাস খেলা হচ্ছে নাকি? ক্রুদ্ধ গম্ভীর স্বরে বলে প্রভাত। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতের সেই গাম্ভীর্যকে নস্যাৎ করে হেসে ওঠে মল্লিকা। বাঁচাল হাসি।
বাজী না ধরলে কি আর খেলায় চার্ম আসে?
না না, এসব আমার ভাল লাগে না। টাকা পয়সা নিয়ে খেলা
ভয় নেই–তোমার পয়সা খোওয়া যায় না। খেলা শেষে আবার ফেরৎ নেওয়া-নিয়ি হয়।
প্রভাত স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, তাই যদি হয় তো এ খেলার দরকারটাই বা কি?
আর সে বিরক্তিকে ব্যঙ্গ করে হেসে ওঠে মল্লিকা, দরকার যে কি, তুমি তার কি বুঝবে? ও রসে বঞ্চিত! তোমাদের এই স্রেফ আলুভাতের আস্বাদবাহী সংসারে দম বন্ধ হয়ে আসে যে মানুষের!
প্রভাত একটু নরম হয়।
ভাবে, সত্যি ও ছেলেমানুষ, একটু আমোদ আহ্লাদের দরকার আছে বইকি। বাড়িটা আমাদের সত্যিই বড় স্তিমিত। আমি সারাদিন খেটেখুটে এসে বাড়ির আরামটি, ঘরের খোটি চাই, মা নিজে পাড়া বেড়িয়ে বেড়ান, অথচ ওকে একটু আধটু বেরোতে দিতেও নারাজ, বেচারার দম বন্ধ হয়ে আসা অন্যায় নয়।
আর আর তাছাড়া
চকিত লজ্জায় একবার ভাবে, একটা বাচ্চাটাচ্চাও হলে হতে পারত এতদিনে। আর তাহলে নিঃসঙ্গতা বোধ করে পাড়ার দ্যাওরকে খোমোদ করে তাস খেলতে হত না ওকে।
কিন্তু প্রভাত বিচক্ষণ। এক্ষুণি সংসার বাড়িয়ে ফেলতে নারাজ।
সে যাক।
আপাতত ভিতরে নরম হলেও পরিমলকে শিক্ষা শাসন দেবার জন্যেই গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে, তা হোক। তাস খেলা ছাড়াও জগতে অনেক কাজ আছে। বই পড়লেই পারে। তাছাড়া দুজনে আবার খেলা কি? জমে নাকি?
হঠাৎ প্রভাতকে স্তব্ধ করে দিয়ে এক টুকরো ইঙ্গিতবাহী রহস্যময় হাসি হেসে মল্লিকা বলে ওঠে, খেলা তো দুজনেই জমে ভাল।
প্রভাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পরিমল পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়, আর মল্লিকা সহসা সেই তাস ছড়ানো পাতা মাদুরটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।
মল্লিকার হাসিটাও যেমন অস্বস্তির, কান্নাটাও তেমনি যন্ত্রণাদায়ক। আর প্রভাতের কাছে দুটোই অর্থহীন।
তবু কান্না কান্নাই। অর্থহীন হলেও কান্না দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ভয়ঙ্কর কোনও আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেলেও না। আর অপর পক্ষের কান্নার ভার এ পক্ষের অপরাধের পাল্লাটা ভারী করে তোলেই।
প্রভাতের মনে পড়ে, এর আগে আর কোনদিন মল্লিকাকে এমন তিরস্কার করে নি সে।
খুবই স্বাভাবিক যে মল্লিকা আহত হবে, বিচলিত হবে।
তবে? তবে কতক্ষণ আর পড়ে পড়ে কাঁদতে দেওয়া যায় মল্লিকাকে?
.
প্রভাত মনে মনে সংকল্প মন্ত্রপাঠ করে, নাঃ, কাল থেকে আর এ রকম নয়। মল্লিকার দিকে একটু অধিক দৃষ্টি দিতে হবে। মল্লিকার জন্যে একটু অধিক সময়।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই
পাড়ার যে পুরনো ক্লাবটা একদা প্রভাতের কৈশোর আর নব-যৌবন কালের একান্ত আনন্দের আশ্রয় ছিল, যার মাধ্যমেই তারা গড়ে তুলেছিল ওই হাওড়া যুব পাঠাগার, আর এখন যে ক্লাবের টিম বড় বড় জায়গায় খেলতে যায়, তারই বর্তমান কর্মকর্তারা ধরে করে পড়েছে প্রভাতকে স্থায়ী প্রেসিডেন্ট হতে হবে।
ছেঁকে ধরেছে তারা, প্রভাতদা, আগের যাঁরা, তাঁরা কেউই প্রায় এদিকে নজর দেন না, কেউ কেউ বা অন্য জায়গায় চলে গেছেন, আমরা যা পারছি করছি। আপনি যখন আমাদের ভাগ্যে এসে পড়েছেন, আর ছাড়ছি না আপনাকে।
ছাড়ছি না ছাড়ব না।
আজন্মের পরিচিত ঠাই যেন এই কটা উৎসুক ছেলের মধ্যে দিয়েই স্নেহ-কঠিন দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায়, ছাড়ছি না! ছাড়ব না।
মা বলেন, আর ছাড়ব না।
মন বলে, আর ছাড়ব না।
আর অনেক যোজন দূরের আকাশ থেকে যে পাখীটিকে ধরে এনে খাঁচায় পুরেছে প্রভাত? সেও বুঝি পরম নির্ভরে বুকের কাছে আশ্রয় নিয়ে মৌন সজল দৃষ্টির মধ্যে বলে ছাড়ব না, ছাড়ছি না।
এমন একান্ত করে প্রভাতের হয়ে যেতে না পারলে, মামাকে দেখে কি একটুও উতলা হত না মল্লিকা? বলত না একবারটি নয় ঘুরে আসি, চিরকালের জায়গা
মামা তো আর ঘাতকের বেশে আসে নি, এসেছিল নিতান্তই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়ের রূপেই। কিন্তু মল্লিকা একবারও বলেনি, দেখতে ইচ্ছে করে সেই জায়গাটা।
না, মল্লিকা তা বলেনি। মল্লিকা তা বলতে পারে না।
মল্লিকা নীল আকাশের ওড়া পাখী ছিল না। ও যে পায়ে শিকলি বাঁধা খেলোয়াড়ের খেলা দেখানো পাখী ছিল। প্রভাত তাকে আপনার খাঁচায় এনে রেখেছে বটে, কিন্তু পায়ের শিকলি তো কেটে দিয়েছে।
তাই না সে অমন নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে শুধু দুটি চোখের চাহনি দিয়েই আশ্বাস দেয় প্রভাতকে, ছাড়ব না ছাড়ব না।
মল্লিকা সুখী। মল্লিকাকে সুখী করতে পেরেছে প্রভাত। মল্লিকা কৃতজ্ঞ। মল্লিকাকে কৃতজ্ঞ হবার অবকাশ দিয়েছে প্রভাত। মাঝে মাঝে একটু উল্টোপাল্টা আচরণ করে বটে, সেটা নিতান্তই ওর অভিমানী স্বভাবের ফল। তাই তো ভাবতে হচ্ছে প্রভাতকে, ছুটির দিনগুলো আর কাজের দিনের সন্ধ্যাগুলো মল্লিকার জন্যে রাখতে হবে।
ওই ক্লাবের ছেলেগুলোর কাছ থেকে কি করে ছাড়ান পাওয়া যাবে?
আর আপাতত মল্লিকার এই অভিমানের কান্নার হাত থেকে?
অনেক চেষ্টায় আর অনেক যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয় প্রভাতকে, মল্লিকা কি ভেবেছে বিরক্ত হয়েছে প্রভাত? পাগল নাকি! মল্লিকার ওপর বিরক্তির প্রশ্ন ওঠেই না। কিন্তু এখানকার জ্ঞাতি সমাজ তত ভাল নয়? ওই পরিমলটার যদি পরীক্ষার ফল ভাল না হয়, সবাই দূষতে বসবে মল্লিকাকেই। বলবে–আড্ডা দিয়ে দিয়ে ছেলেটার মাথা খেয়েছে মল্লিকা। ওটা যে এই তিনবার ঘষটে ঘষটে ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে, সে কথা কেউ মনে রাখবে না।
তবে নিজেরা সাবধান হওয়াই ভাল।
ওকে ভয় পাওয়াবার জন্যেই বিরক্তির ভান দেখাতে হয়েছে প্রভাতকে। এইসব যুক্তির জাল বোনে প্রভাত। মল্লিকার কাছে বসে। একসময় মল্লিকা চুপ করে।
আর তারপর সহসা উঠে একেবারে নীচের তলায় নেমে গিয়ে করুণাময়ীর কাছে বসে।
প্রভাত আত্মপ্রসাদে পুলকিত হয়, নিজের বুদ্ধি আর যুক্তির কার্যকারিতায়।
.
কিন্তু মল্লিকার ওই আকস্মিক কান্না কি সত্যিই প্রভাতের বিরক্তি প্রকাশের অভিমানে? না, সে কান্না গভীরতর কোন অবচেতনার স্তর থেকে উঠছে এক অক্ষমতার নিরুপায়তায়?
.
-বউয়ের আওতা ছাড়িয়ে ছেলেকে একেবারে একা পাওয়া বড়ই শক্ত। ধারে কাছে বৌ নেই, ছেলের কাছে বসে দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইলাম, কি হল বৌয়ের একটু সমালোচনা, তার আচার-আচরণের একটু নিন্দেবাদ, এমন মাহেন্দ্রক্ষণ জোটা দুষ্কর দিদি।
এ যুগের বৌগুলোই হচ্ছে শাস্ত্রসম্মত সাধ্বী-সতী। স্বামীর একেবারে ছায়ায় ছায়ায় ঘোরে। ফাঁক পাওয়ার আশা দুরাশা।…আগের আমলে শুধু শোওয়াটাই একসঙ্গে ছিল, তাও যতটা সম্ভব সন্তর্পণে। আর এখনকার আমলে দিদি, খাওয়া শোওয়া ওঠা বসা চলাফেরা, বেড়ানো না বেড়ানো, সব যুগলে।..আদেখলে ছোঁড়ারা কেন যে আপিস যাবার সময়টুকুও বৌকে বগলদাবা করে নিয়ে যায় না তাই ভাবি। সেটুকু ফাঁক রাখে বোধহয় বউদের দিবে-নিদ্রের জন্যে। নইলে–শুনলে বিশ্বাস করবে, আমার ছেলে চুল ছাঁটতে গেল, বৌ সঙ্গে সঙ্গে চলল সেলুনে। কেলাব লাইব্রেরী সিনেমা থিয়েটার, আত্মজনের বাড়ী, সর্বত্র চলল কাছা ধরে।…কোথাও একলা ছাড়বে না। ছেলে তো মা বলে ডেকে কাছে এসে বসতে ভুলেই গেছে!
এক নাগাড়ে এই শতখানেক শব্দযুক্ত আক্ষেপোক্তিটি করে নিশ্বাস নিলে করুণাময়ীর পাঠবাড়ীর বান্ধবী।
করুণাময়ী কিন্তু এ বিবৃতিতে সই দেন না। বরং বলেন, আমার ছেলে বৌ কিন্তু অমন নয় ভাই।
ছেলে বৌ বলতে অবশ্য করুণাময়ী তার ছোট ছেলে বৌয়ের কথাই মনে নিলেন। কিন্তু বান্ধবীটি কথায় হেরে–ছোট হয়ে যাবার পাত্রী নয়। তিনি সবেগে বলেন, রেখে দাও দিদি তোমার ছেলে বৌয়ের গুণগরিমা। বড় মেজ তো বুকের ওপর পাঁচিল তুলে বসে বসে গুণ দেখাচ্ছেন, আর এটিও কম নয়। তুমি দোষ ঢাকলে কি হবে, পাড়াপড়শী তত আর কানা নয়? ওইতো সবাই বলছিল, কাল তোমার ছেলেবৌ নাকি ওদের কেলাবের লাইব্রেরিতে গিয়েছিল, আর তোমার বৌ নাকি রাজ্যির ছেলেগুলোর সঙ্গে বাঁচালতা করছিল। তা সাধ্যি আছে তোমার সেকথা তুলে বকতে, না সময় মিলছে ছেলেকে আড়ালে ডেকে অত আস্কারা দিতে মানা করতে? হুঁ, কিন্তু যাই বল ভাই, পাড়ার বৌঝিরা কেউ আর এখন বৌটি নেই বটে, তবে কেলাবে লাইব্রেরিতে কেউ যায় নি অদ্যাবধি।
.
এ অপমানে গুম হয়ে গেলেন করুণাময়ী, এ সংবাদে আহত। ভাবলেন, বলতে হবে প্রভাতকে। তাঁর অবশ্য বান্ধবীর মত অবস্থা নয়। কারণ তার বৌ ঠিক শাস্ত্রসম্মত সাধ্বীসতী নয়। সে অত ছায়ার মত বরের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে না। বরং একটু খামখেয়ালি মত। আছে তো আছে, নেই তো নেই। হয়তো বাগানেই ঘুরে বেড়ালো, হয়তো পুকুরঘাটে গিয়েই বসে থাকল, হয়তো ছাতেই উঠে গেল।
তবে পরিমলটা বড্ড আসতে সুরু করেছে। বয়সের ধর্ম আর কি! যেখানে রূপযৌবন, সেখানেই আকর্ষণ। বৌদিদি যে তোর থেকে পাঁচ-সাত বছরের বড়, তাও হিসেব নেই। যাক, ছেলেকে বৌয়ের আওতার বাইরে পাওয়া করুণাময়ীর পক্ষে শক্ত নয়।
ভাবলেন সবই বলবেন।
.
বলবেন বলেই ছেলেকে খুঁজছিলেন, ছেলেই তাকে খুঁজে বার করল এসে। রুদ্ধকণ্ঠে বলল– মা, মল্লিকা কই?
মায়ের সামনে এমন নাম করে উল্লেখ করে না প্রভাত, বলে, তোমার ছোট বৌ। মল্লিকা শুনে চমকে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন করুণাময়ী। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন? ঘরে নেই?
না তো।
ছাতে গিয়ে বসে আছে তাহলে।
না না, দেখেছি।
তা অত অস্থির হচ্ছিস কেন? মেজ বৌমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছে হয়তো।
না মা, না। সব জায়গায় খোঁজ করেছি।
শোন কথা। কর্পূর নাকি যে উপে যাবে। ঘাটে দেখেছিস?
ঘাটে! সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে, এখনো ঘাটে?
তা আশ্চয্যি নেই। আজকাল তো ওইরকম খামখেয়ালীই হয়েছে। প্রথম প্রথম কী শান্ত, কী নরম, কী ভয় ভয় লজ্জা লজ্জা ভাব দেখাল, ক্রমেই যেন বিগড়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে। তোমাদেরও যেমন আদিখ্যেতা হয়েছে আজকাল! সখ করে বৌকে রাজ্যির বেটাছেলের সঙ্গে মিশতে দেওয়া! আরে বাবা, ওতে বৌ-ঝি বারচকা হয়ে যায়। ঘরতলায় মন বসে না। কাল তো শুনলাম
কিন্তু কি শুনছেন, সে কথা কাকে আর শোনাবেন করুণাময়ী?
শ্রোতা তো ততক্ষণে টর্চ হাতে ঘাটের পথে হাওয়া!
.
হ্যাঁ করুণাময়ীর অনুমানই ঠিক।
ঘাটের ধারেই বসে আছে মল্লিকা। কিন্তু একাই কি বসে ছিল? না টর্চের ক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রভাতকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে?
এমন সময় এখানে কেন? এ প্রশ্ন না করে প্রভাত বলে ওঠে, এখানে কে ছিল?
এখানে? হঠাৎ উদ্দাম একটা হাসিকে অদূরবর্তী বাঁশবাগানের ঝোড়ো হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় মল্লিকা।
এখানে ভূত ছিল। তোমার পদশব্দে ভয় খেয়ে পালাল।
প্রভাত বসে পড়ে বাঁধানো ঘাটের পৈঠেয়। বলে, এমন সময় এখানে কী?
মাছ ধরছি।
মাছ ধরছ?
হু গো। দেখ না এই চার, এই ছিপ, এই বঁড়শি—
নাঃ একেবারে ছেলেমানুষ! কী যে ভাবছিল প্রভাত!
সহসা প্রভাতও হেসে ওঠে। বলে, একটি বৃহৎ রোহিত মৎসের গলায় তো জন্মের শোধ বঁড়শি গিঁথেছ, আবার কেন?
মল্লিকা আবার হেসে উঠে বলে, কে কার গলায় বঁড়শি গেঁথেছে, কে কাকে ছিপে তুলেছে, সেটা বিচারসাপেক্ষ। নইলে আর রাতের মাছ অসাবধানে বেড়ালে খেয়ে গেছে বলে সন্ধ্যেবেলা মাছ ধরতে আসতে হয়?
এই ব্যাপার! ছি ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যায় প্রভাতের।
এমনি ছেলেমানুষ, আর এমন প্রেমে বিভোর স্ত্রীকে সে কিনা সন্দেহ করছিল? ভাবছিল বাড়ীতে আসতে বারণ করেছে বলে পরিমলটা হয়তো পুকুরঘাটে এসে জুটেছে, আর সময়ের জ্ঞান ভুলে আড্ডা হচ্ছে। খেয়ালই নেই যে অফিস থেকে ফেরার সময় উৎরে গেছে প্রভাতের।
নাঃ, পাঁচজনের পাঁচকথায় মনটা বিগড়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পথে ফট করে এমন একটা কথা বলল মেজদা! তাই না ঘরে এসে বৌকে দেখতে না পেয়েই অমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল প্রভাত।
কাকতালীয় ব্যাপার এইভাবেই ঘটে।
নইলে মল্লিকা যখন প্রভাতের খাওয়ার অসুবিধে নিরাকরণ করতে একটা বেপরোয়া ছেলেমানুষী করছে বসে, প্রভাত তখন এক তীব্র সন্দেহে নিজেকে জর্জরিত করছে।
না না।
এখানে কেউ ছিল না। টর্চের আলোর বিভ্রান্তি। গাছপালার ছায়া। বাঁশপাতার সরসরানি।
বড় অন্যায় হয়ে গেছে। মল্লিকা প্রভাতের মন জানতে না পারুক, প্রভাত তো নিজে জেনেছে। বোধ করি অপরাধস্থালন করতেই আদরে ডুবিয়ে দেয় প্রভাত মল্লিকাকে।
কেড়ে রেখে দেয় ছিপ হুইল বঁড়শি। বলে, থাক আর মাছে কাজ নেই, খাবার জন্যে আরও ভাল জিনিস আছে।
করুণাময়ী ছেলের দেরি দেখে উদ্বিগ্নচিত্তে পিছু পিছু আসছিলেন, লজ্জায় ঘেন্নায় গরগর করতে করতে ফিরে যান। ততক্ষণে একটু একটু জ্যোৎস্না উঠেছে, কাজেই দৃশ্যটা একেবারে অদৃশ্য নয়।
.
যে সন্ধ্যায় জ্যোৎস্না উঠেছিল সেই সন্ধ্যায় ঝড় উঠল। কাঁচা আম ঝরানো তোলপাড় করা ঝড়।
হঠাৎ আচমকা।
জানলা দরজা আছড়ে পড়ে, দেওয়ালে টাঙানো ছবি দড়ি ছিঁড়ে পড়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়। পরে শুকোতে দেওয়া কাপড় ফস্ করে উড়ে গিয়ে পাক খেতে খেতে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয় কে জানে।
দরজার মাথার তাকে সাজানো পুতুল পড়ল গড়িয়ে, সাঙা থেকে লক্ষ্মীর আঁপি কড়ির কৌটো ছিটকে ধূলোয় লুটোল।
আমবাগান আর বাঁশবাগানে চলতে লাগল যেন ক্ষ্যাপা অসুরের রাগী লড়াই।
.
এ ঝড়ের মধ্যে বুঝি সেই দূর অরণ্যের আছড়ানি, দূর সীমান্তের হাতছানি। এ ঝড়ে অনেক দূরের রোমাঞ্চ আর অনেক দিনের ভুলে যাওয়া মদের স্বাদ।
জানলাগুলো সব খুলে দেয় মল্লিকা।
প্রভাতের ঘুম গভীর। প্রথমটা জাগে নি, হঠাৎ ছবি পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল। চমকে উঠে বসে বলল, কী সর্বনাশ! ও কি? জানলা খোলা কেন? বন্ধ কর, বন্ধ কর।
ঝড়ের শব্দে ওর কথার শব্দ ডুবে গেল।
ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে এল প্রভাত।
দেখল দুরন্তবেগে মল্লিকার চুল উড়ছে, আঁচল উড়ছে, মল্লিকা জানলার শিক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে মাথায় সেই ঝড় খাচ্ছে।
কী হচ্ছে? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
মল্লিকা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না।
প্রভাত দাঁড়াতে পারছিল না এই উত্তালের মুখে, তবু দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরল, ছাড়িয়ে নিতে গেল শিক থেকে কপাট বন্ধ করবে বলে। কিন্তু বড় দৃঢ়মুষ্টি মল্লিকার।
মল্লিকা, এ কী সখ? চোখে মুখে ধূলো ঢুকে মারা যাবে যে! নিজে ধূলোর ভয়ে চোখ বুজে মাথা নীচু করে বলে প্রভাত, দোহাই তোমার, জানলার কাছ থেকে সরে এসো।
সহসা ঘুরে দাঁড়ায় মল্লিকা। কঠিন গলায় বলে, না।
না!
হ্যাঁ। হ্যাঁ। তুমি যাও। অন্য ঘরে চলে যাও। জানলা দরজা বন্ধ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোও গে। নয়তো মার আঁচলতলায়। সেই তোমার উপযুক্ত ঠাই।
মল্লিকা!
মল্লিকা আবার ফিরে দাঁড়িয়েছে বাইরের দিকে মুখ করে। বন্যপশুর আর্তনাদের মত একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, প্রভাত দাঁড়াতে পারছে না।
প্রভাত দাঁড়াতে পারে না।
তবু ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। বলে, মল্লিকা, অসুখ করবে।…মল্লিকা, বাইরে থেকে কিছু ছিটকে এসে চোখে মুখে লেগে বিপদ ঘটাবে।
মল্লিকা নিরুত্তর।
আর পারে না প্রভাত।
বেশ যা খুসি কর। বলে সত্যিই পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
ভাবে, আশ্চর্য! অদ্ভুত! এক এক সময় কী যে হয় ওর!
ওদের বংশে কেউ কি পাগল ছিল? শরীরে সেই রক্তকণিকা বহন করে রয়েছে বলেই মাঝে মাঝে উন্মত্ততা জাগে ওর?
কখন যে ঝড় কমেছে, কখন যে তার আর্তনাদ থেমেছে, খুব স্পষ্ট মনে নেই প্রভাতের, শুধু মনে আছে অনেকক্ষণ ঘুম আসে নি। আর একবার ও ঘরে গিয়ে চেষ্টা করেছিল মল্লিকাকে জানলা থেকে সরাতে পারে নি।
ঘুম ভাঙল প্রভাতের অনেক বেলায়। তাড়াতাড়ি এঘর থেকে শোবারঘরে গিয়ে দেখল, ঘর খালি। দেখে নীচে নেমে এল। আর নেমে এসে যে দৃশ্য দেখল, তাতে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না।
নীচের দালানে বড় একটা ধামা ভর্তি ঝড়ে পড়া কাঁচা আম করুণাময়ী তার থেকে বেছে বেছে এগিয়ে দিচ্ছেন, আর মল্লিকা সেগুলো নিয়ে দ্রুতহস্তে ছাড়াচ্ছে।
এ কী কাল রাত্রের সেই মল্লিকা?
মল্লিকা কি বহুরূপী? নাকি মাঝে মাঝে মল্লিকার উপর ভূতের ভর হয়?
কিন্তু মা সামনে, তাই সম্বোধনটা মল্লিকাকে করা চলে না, আবেগ আবেগ গলায় মাকেই বলে, মা, কাল সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে তুমি বাগানে নেমেছিলে?
আমের সঞ্চয়ে পুষ্ট এবং বাহাদুরিতে হৃষ্ট করুণাময়ী হেসে বলেন, না নামলে? ঝড় থামার অপেক্ষায় থাকলে একটা আম চোখে দেখতে পেতাম? রাজ্যের ছোঁড়াছুঁড়ি এসে বাগান বেঁটিয়ে নিয়ে চলে যেত না?
সে তো বুঝলাম। কিন্তু গেলে কি করে?
কি করে আবার? যেমন করে ফি বছর যাই। তোর বৌদিরা তো আবার এদিকে অহঙ্কারের রাজা, ঠেকার করে একটা আম নেয় না, এদিকে তোর বড়দা মেজদার স্বভাব তো জানিস? আচার নইলে ভাত মুখে রোচে না। তা এই কাঁচা আমের সময়
প্রভাত হেসে ওঠে।
এদিকে তো বড় মেজ পুত্তুরের সাতশো নিন্দে না করে জল খাও না, অথচ তাদের মুখরুচির দায়ে প্রাণের ভয় তুচ্ছজ্ঞান করে রাতদুপুরে ঝড়ের মুখে ছোটো আম কুড়োতে! তাজ্জব!
করুণাময়ীর মন আজ প্রসন্ন। তাই এ কথায় অভিযোগ অভিমানের দিক দিয়ে না গিয়ে হেসে বলেন, তা তাজ্জব বটে। বুঝবি এরপর এর মানে। আগে ছেলের বাপ হ।
প্রভাত লজ্জায় লাল হয়।
গোপন কটাক্ষে একবার মল্লিকার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু সে মুখে কোনও বর্ণবৈচিত্রের খেলা দেখতে পায় না। সে যেমন আনত মুখে হাত চালাচ্ছিল তেমনি চালাতেই থাকে।
অনেকক্ষণ পরে অন্তরালে দেখা হয়।
আস্তে বলে, রাতের ভূত ঘাড় থেকে নেমেছে?
মল্লিকাও আস্তে উত্তর দেয়। কিন্তু সেই মৃদুতার মধ্যে যেন অনেক যোজন দূরত্ব। মজবুত ইস্পাতের কাঠিন্য।
ভূত কি ঘাড় থেকে সহজ নামে?
প্রভাত এই দূরত্বের কাছে একটু যেন অসহায়তা বোধ করে, তাই জোর করে সহজ হতে চায়। বলে, তুমি তো দেখি ইচ্ছে করলেই ভূতকে ঘাড়ে তুলতে পারো, ঘাড় থেকে নামাতেও পারো। সত্যি, মাঝে মাঝে কী যে হয় তোমার!
কী হয়, সে সম্বন্ধে কি মনে হয় তোমার!
কী মনে হয় আসলে জানো? তুমি বড্ড বেশি সিরিয়াস। জীবনটাকে অত ভারী ভাববার দরকারই বা কি? ইচ্ছে করলেই তো হালকা করে নেওয়া যায়, সহজ করে নেওয়া যায়।
সবাইয়ের পক্ষে হয় তো তা যায় না।
ওটা ভুল। হালকা হব ভাবলেই হালকা হলাম, এর আর কি? চলো আজ সন্ধ্যায় কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা যাক। একঘেয়ে বাড়ি বসে থেকে থেকে–
মল্লিকা তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলে, বেড়াতে? কোথায়? হাওড়া-ময়দানে?
হাওড়া-ময়দানে!
তা ছাড়া আর কোথায়? লোকালয়ে গেলেই তো নিন্দে। সেদিন একটু লাইব্রেরিতে গিয়েই তো—
প্রভাত একথা বলতে পারে না, তোমার আচরণে যে কেমন একটা ব্যালেন্সের অভাব মল্লিকা, তাই তো নিন্দে হয়। সেদিন লাইব্রেরিতে তুমি যে কী অদ্ভুত মাত্রাছাড়া বাঁচালতা করলে! বলতে পারে না। শুধু বলে, আমাদের এই জায়গাটা কলকাতা শহরের প্রবেশপথ হলে কি হবে, বড্ড বেশি ব্যাকওয়ার্ড যে! একটুতেই নানা কথা। কথার সৃষ্টি করে লাভ কি বল? তার চেয়ে সবাই যা করে তাই করাই ভাল নয় কি?
সবাই যা করে? মল্লিকা নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে বলে, সেটা কি?
ধর সিনেমা গেলাম। ওতে আর কেউ নিন্দে করতে আসবে না। নিজেরা তিনবেলা দেখছে সবাই।
সিনেমা! ওঃ!
কেন, পছন্দ হল না?
পছন্দ? হঠাৎ হেসে ওঠে মল্লিকা। যেমন হঠাৎ হাসিতে মাঝে মাঝে চমকে দেয় প্রভাতকে–তেমনি চমকে দেওয়া হাসি। হেসে বলে, সে কী! পছন্দ হবে না কি বল? বরের সঙ্গে সেজেগুজে সিনেমা যাব, এর থেকে পছন্দসই আর কি আছে?
তাহলে রাজী?
নিশ্চয়।
একেবারে টিকিট কেটে নিয়ে আসব তাহলে? আর যতটা সম্ভব সকাল সকাল আসব। তুমি কিন্তু একেবারে ঠিক হয়ে থেকো! ওই যা বললে–সেজে-গুঁজে একটু থেমে বলে, মাকে একটু তাক বুঝে, মানে আর কি মুড বুঝে জানিয়ে রেখো, কেমন?
সেটা তুমিই রেখে যাও না?
আমি? আচ্ছা আমিই বলে যাব। বলে বটে, তবে এই ভাবতে ভাবতে চান করতে যায়, মার মুডটা পাব তো? পেতেই হবে। রান্নার সুখ্যাতি করতে হবে প্রথমে, তারপর একটু ভাত চেয়ে নিয়ে খেতে হবে। তাহলেই
ছোট সুখ, ছোট ভাবনা। নিতান্ত তুচ্ছতা দিয়ে ভরা বাংলার তেলেজলে কাদায় মাটিতে গড়া অতি সাধারণ প্রভাত গোস্বামী।
আশ্চর্য যে, এই প্রভাত গোস্বামীই সেই হাজার মাইল দূরের দুর্ধর্ষ বাঘের গুহা থেকে তার মুখের গ্রাস চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল।
কি করে পেরেছিল?
জল হাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতি, এরাই কি মানুষকে ভাঙে গড়ে? আসলে মানুষের নিজস্ব কোনও আকার নেই? মাটি আর হাওয়া তাকে বীর করে, কাপুরুষ করে, ভীরু করে, বেপরোয়া করে?
কিন্তু তাই কি?
যাইহোক আপাতত আজকে প্রভাত খুব একখানা সাহসী পুরুষের ভূমিকা অভিনয় করল। মাকে সোজাসুজি বলল, মা, ওবেলা একটু সকাল সকাল আসব। সিনেমা যাব।
করুণাময়ী অবশ্য এ সংবাদে প্রীত হলেন না। হনও না। বিরসকণ্ঠে বলেন, সিনেমা? এই তো কবে যেন গেলি?
আরে সে তো কতদিন!
তা বেশ যাবে যাও। রাত করে ফেরা, বৌকে নিয়ে একটু সাবধানে ফিরো। দিনকাল খারাপ!
কী মুশকিল! দিনকালের আবার কি হল?
হল নাই বা কেন? এই তো মেজবৌমা কাল বলছিল, দুপুরের ফাঁকে নাকি একটা সা জোয়ান মত লোক আমাদের আমবাগানের ওদিকে ঘোরাঘুরি করছিল।
করছিল! অমনি! তোমার ওই মেজবৌমাটি হচ্ছেন এক নম্বরের গুজব-সাম্রাজ্ঞী।
না না। ও বলল পষ্ট দেখেছে। বলল তার নাকি ভাব-ভঙ্গী ভাল নয়।
প্রভাত হেসে উঠে বলে, অতিরিক্ত রহস্য সিরিজ পড়লেই এইসব দিবাস্বপ্ন দেখে লোকে। রাস্তা দিয়ে একটা লোক হেঁটে গেল, উনি তার ভাবভঙ্গী অনুধাবন করে ফেললেন। যত সব!
মেজবৌদির কথাকে চিরদিনই উড়িয়ে দেয় প্রভাত, আজও দিল।
তবে কিছুদিন আগে হলে হয়তো দিত না, দিতে পারত না। যখন সদাসর্বদা ভয়ঙ্কর একটা আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল তার ছায়াসঙ্গী।
মল্লিকাকে নিয়ে আসার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত এমন ছিল। তখন মেজবৌদি এমন সংবাদ পরিবেশন করলে হয়তো হেসে ওড়াতে পারত না প্রভাত। ভয়ে সিঁটিয়ে উঠত।
চাটুয্যে এসে দেখা-সাক্ষাৎ করে যাবার পর থেকে সেই ভয়টা দূর হয়েছে প্রভাতের। আতঙ্ক আর তার ছায়াসঙ্গী নেই। বুঝেছে চাটুয্যের দ্বারা আর কোনও অনিষ্ট হবার আশঙ্কা নেই তাদের। মল্লিকার সুখ-সৌভাগ্য দেখে মন পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার মামার। স্নেহের কাছে স্বার্থ পরাস্ত হয়েছে।
অতএব আবার পুরনো অভ্যাসে মেজবৌদির বৃথা ভয় দেখানোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলে। মা যে ততটা ভুরু কোঁচকান নি, এতেই খুশীর জোয়ার বয় মাতৃগতপ্রাণ প্রভাতের। দাদাদের আর বৌদিদের দুর্ব্যবহারে বিক্ষত মাতৃহৃদয়ে, সদ্ব্যবহারের প্রলেপ লাগাবার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে প্রভাত সেই কবে থেকে! তাই না মাকে এত মেনে চলা।
হুট করে মল্লিকাকে নিয়ে আসায় তাতে একটা ছন্দপতন হয়েছিল বটে, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছেয় আর প্রভাতের আপ্রাণ চেষ্টায় সে ছন্দ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিল অবশেষে।
করুণাময়ী ঈষৎ অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, সে যাই হোক, সাবধানের মার নেই।
আচ্ছা বাপু আচ্ছা, যতটা পারব সাবধান হব।
অফিসে বেরিয়ে পড়ে প্রভাত।
খানিক পরেই গঙ্গাস্নান ফেরৎ আসেন করুণাময়ী একটু যেন হন্তদন্ত হয়ে। ডাক দেন। ছোটবৌমা, ছোটবৌমা!
মল্লিকা দোতলা থেকে নেমে আসে।
করুণাময়ী ব্যস্তভাবে বলেন, নীচেরতলায় বাগানের দিকের ঘরে ছিলে তুমি?
মল্লিকা নির্লিপ্তভাবে বলে, কই না তো! এই তো নামলাম ওপর থেকে। কেন?
বাঁশঝাড়ের ওদিক থেকে হঠাৎ মনে হল কে যেন ওই ঘরের জানলার নীচে থেকে সরে গেল! কাল মেজবৌমাও বলছিল। দেখ দিকি ঘরের কোনও জিনিস খোয়া গেছে কিনা। আমাদের পাঠবাড়ীর গিন্নীর তো সেদিন জানলা দিয়ে এক আলনা কাপড় চুরি গেল। যেমন বুদ্ধি, জানলার কাছে আলনা! আঁকশি দিয়ে দিয়ে বার করে নিয়ে গেছে। তোমার এ ঘরে
না, নীচের ঘরে তো আমার কিছু থাকে না।
কথাটা ঠিক। কোন কিছুই থাকে না ও ঘরে। নেহাৎ সংসারের বাড়তি ডেয়োটকনা বোঝাই থাকে। জানলা দিয়ে আঁকশি চালিয়ে বার করে নিয়ে যাবার মাল সে সব নয়।
তত্রাচ করুণাময়ী একবার সে ঘরে ঢোকেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাস করেন। জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলেন, সন্দেহ হচ্ছে কোনও চোরাচোড় তক্কে তক্কে ফিরছে। কাল মেজবৌমার কথায় কান দিইনি, আজ প্রভাতও সে কথা হেসে ওড়ালো, কিন্তু এ আমার নিজের চোখ, অবিশ্বাস করতে পারি না। কেমন যেন হিন্দুস্থানী মতন একটা লোক
মল্লিকা কিন্তু করুণাময়ীর বকবকানিতে কান করে না। নির্দিষ্ট নিয়মে ওঁর হাত থেকে গঙ্গাজলের ঘটি আর ভিজে কাপড় গামছাটা নেয়। উঠোনে নেমে কাপড়খানা শুকোতে দিয়ে আসে টানটান করে। বলে, আপনার উনুনে আগুন দিই?
দিও দিও। আগে একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিই। ভারী তো রান্না, আপনার একলার আবার রান্না! একপাকে ফুটিয়ে নেব।
কথাটা অবশ্য তেমন সমূলক নয়।
একলার জন্যে সাতখানি রাঁধেন করুণাময়ী। যদিও ছুতোটা করেন প্রভাত আমার ভালবাসে। টুকটুক করে রাখেনও সেসব প্রভাতের জন্য গুছিয়ে।
রাত্রে প্রভাতকে খেতেই হয় সেই সুক্ত, পোস্তর বড়া, মোচাহেঁচকি, কচুরশাকের ঘণ্ট।
.
হ্যাঁ, এমনিই সব পাঁচখানা রাঁধবেন এখন করুণাময়ী। আর মল্লিকাকে বসে থাকতে হবে তার জোগাড় দিতে। গঙ্গাস্নানে যাবার আগে মল্লিকাকে খাইয়ে আমিষ হেঁসেলের পাট চুকিয়ে যান করুণাময়ী। তিনি নিজে যখন খান, তখন জলখাবারের সময় হয়ে যায় মল্লিকার। করুণাময়ীর খুব ইচ্ছে হয় আর একদফা ভাতই খাক ছোট বৌ, শাশুড়ির অনবদ্য অবদান দিয়ে, কিন্তু ভাত খেতে চায় না বৌটা। একবেলাই খেতে নারাজ তা দুবেলা! পশ্চিমে মানুষ তো, মোটা মোটা। রুটি গিলে মরেছে চিরকাল।
.
রান্নার জায়গায় দৃষ্টিপাত করে করুণাময়ী বলে ওঠেন, মেতির শাক কটা রেখে গিয়েছিলাম, কই বেছে রাখনি ছোট বৌমা?
শাক!
মল্লিকা যেন ভেবে মনে আনতে চেষ্টা করে শাক বস্তুটা কি! যাত্রাকালে কি যেন একটা বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী, সে কি ওই শাকের কথা?
কিন্তু না, বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী অন্য কথা। শাকটা রেখেছিলেন ছোট বৌমার বিবেচনাধীনে। যার বিষয়ে বলে গিয়েছিলেন তার দিকে নজর পড়তেই শিউরে ওঠেন, কি সর্বনাশ! সেই কাঁচা আমের কাড়ি ছায়ায় পড়ে আছে? রোদের দিকে টেনে দাও নি ছোট বৌমা? ছি ছি! মন তোমাদের কোন দিকে থাকে বাছা! অত করে বলে গেলাম!
নিজেই হিঁচড়ে টেনে আনেন তিনি ঝুড়িটা।
মল্লিকার মনে পড়ে এই কথাটাই বলে গিয়েছিলেন করুণাময়ী।
কিন্তু মল্লিকার চিন্তাজগতে কাঁচা আমের ঝুড়ির ঠাই কোথায়? করুণাময়ী সেই কথাই বলেন।
বলেন, তোমার তো সবই ভাল ছোট বৌমা, এই ভুলটাই একটা রোগ। মাথাটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা কর দিকি!
মল্লিকা উঠোনে এসে পড়া ভরদুপুরের প্রখর রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলে, করব।
করুণাময়ী বলেন, হ্যাঁ তাই বলছি। সন্ধ্যেবেলায় সিনেমা না থিয়েটার কোথায় যেন যাবে শুনলাম। তা আমি তো তখন পাঠবাড়ীতে যাব। দোরজানলা সব ভালো করে বন্ধ করে সদরে তালা লাগিয়ে চাবিটা ও বাড়ি রেখে যেও। আমিই যদি আগে আসি!…ভালো করে মনে রেখো, কি জানি তখন কোন মতলবে ঘুরছিল লোকটা। এই যে তোমরা সন্ধ্যেবেলা বাড়ী থাকবে না, জেনেছে হয়তো কোন ফাঁকে। তালায় চাবিটা লাগিয়ে তালা টেনে দেখে তবে বেরিও।
সাবধানের ত্রুটি করেন না করুণাময়ী। তার জানার জগতে যেসব সাবধানতা আছে, তার পদ্ধতি শিক্ষা দেন তাঁর অবোধ ছোট বৌকে।
কিন্তু দরজা কি শুধু ঘরেই থাকে?
আর সে দরজায় চাবি লাগাতে পারলেই সমস্ত নিরাপদ?
.
প্রভাত আসছিল ভারি খুশী খুশী মনে।
আজ একটা সুখবর পাওয়া গেছে অফিসে। বেশ কিছু মাইনে বেড়েছে।
ভাবতে ভাবতে আসছিল, বাড়ি গিয়ে মল্লিকাকে বলবে, রাতে আজ খুব ভালো করে সাজতে হবে তোমায় মল্লিকা! সেই তোমার ফুলশয্যার শাড়িটা পরবে, খোঁপায় জড়াবে রজনীগন্ধার মালা, কপালে চন্দনের লেখা। তোমায় দেখব বসে বসে।
কিন্তু বাড়ি এসে সে কথা বলবার আর ফুরসই পেল না বেচারা প্রভাত গোস্বামী। ওই : সৌখিন কবিত্বটুকু ফলাবার আগেই চোখ ঝলসে গেল তার।
অপরূপ সাজসজ্জায় ঝলমলিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল মল্লিকা।
পরনে পাতলা জরিদার শাড়ি। রজনীগন্ধার মালা জড়ানো শিথিল কবরী নয়, সাপিনীর মত কালো চকচকে জরি-জড়ানো লম্বা বেণী।
ঠোঁটে গাঢ় রক্তিমা, নখে রঙের পালিশ। গালেও বুঝি একটু কৃত্রিম রঙের ছোঁয়াচ। সুর্মাটানা চোখে কেমন একটু বিলোল কটাক্ষ হেনে বলে, কেমন দেখাচ্ছে?
খুব কি ভাল লাগে প্রভাতের? লাগে না। তবু
প্রভাত হাসে, আর বলে, বড় বেশি রূপসী: একটু যেন ভয় ভয় করছে।
ভয়!
তাই তো! পথে নিয়ে বেরোতে সাহস হচ্ছে না।
.
কিন্তু প্রভাতের সেই তুচ্ছ কৌতুকের কথাটুকু কি কোনও ক্রুর ভাগ্যদেবতাকে নিষ্ঠুর কৌতুকের প্রেরণা দিল? তাই ভয় এল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে! লুটে নিয়ে গেল প্রভাতের জীবনের রং, ঈশ্বরের বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা।
সিনেমা হল থেকে প্রভাতের বাড়ি ফিরতে এই পথটা একটু গা-ছমছমে বটে। এরই আশেপাশে নাকি হাওড়ার বিখ্যাত গুণ্ডাপাড়া।
কিন্তু সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখে তো আগেই ফিরেছে প্রভাত আর প্রভাতের পাড়ার লোকেরা।
দুদিন আগেও লাস্ট শোয়ে ছবি দেখে এসেছে প্রভাতের মেজদা মেজবৌদি
তবু পাড়ার লোক আর জ্ঞাতিগুষ্ঠী ধিক্কার আর ব্যঙ্গের স্রোত বহালো।
হবেই তো! সুন্দরী রূপসী বৌকে সঙ্গে করে রাত নটায় গুণ্ডাপাড়া দিয়ে…ছি ছি, এত কায়দাও হয়েছে একালের ছেলেদের!…হল তো, বৌকে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল, ভ্যাকা হয়ে দেখলি তো দাঁড়িয়ে?…হ্যাঁ, তবু রক্ষে যে তোকে খুন করে রাস্তায় শুইয়ে রেখে যায়নি!…
আবার একথাও বলল, পাড়া কি এত নিশুতি হয়ে গিয়েছিল সত্যি যে অতবড় কাণ্ডটা কারুর চোখে পড়ল না, এতখানি চেঁচামেচি কারুর কানে গেল না?…ভয়ানক একটা চেঁচামেচি ধস্তাধস্তি তো হয়েছে নিশ্চয়ই।
চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি?
হ্যাঁ, পুলিশকে তাই বলতে হয়েছে বইকি।
বলতে হয়েছে একসঙ্গে চার-পাঁচজন গুণ্ডা ঝাঁপিয়ে পড়ে
কিন্তু প্রভাত তো জানে একটাই মাত্র লোক। যে লোকটা একখানা ছোট গাড়ি নিয়ে পথের একধারে চুপ করে বসেছিল চালকের আসনে, গাড়ির দরজা খুলে। স্পষ্ট সাদা চোখে দেখেছে প্রভাত, সেই খোলা দরজা দিয়ে ঝপ করে ঢুকে পড়েছে ঝলমলে ঝকঝকে, চোখে সুর্মা টানা মল্লিকা।
আর প্রভাত?
প্রভাত তো তখন রাস্তার ওপারে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রঙিন মশলা দিয়ে মিঠে পান সাজাচ্ছিল। হঠাৎ যে মল্লিকার রঙিন মশলা দেওয়া মিঠে পান খাবার ইচ্ছে হয়েছিল।
তাই তো প্রভাতকে ঠেলে পাঠিয়েছিল রাস্তার ওপারে পানের দোকানে। বলেছিল, আমি দাঁড়াচ্ছি। দেরি করবে না কিন্তু।
দেরি কি করেছিল প্রভাত? বড্ড বেশি দেরি? তাই ধৈর্য হারিয়েছিল মল্লিকা?
গাড়ীর নম্বর?
না, সে আর দেখবার অবকাশ হয়নি প্রভাতের। রাস্তা পার হবার আগেই হুস করে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল গাড়ীটা, দরজা বন্ধ করার রূঢ় একটা শব্দ তুলে, যে শব্দটা অবিরত ধ্বনিত হচ্ছে প্রভাতের কানে। গাড়ীর পিছনে বৃথা ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছিল। কিন্তু চালকের মুখটা দেখা হয়ে গিয়েছিল তার পাশের দোকানের আলোতে।
চিনতে পেরেছিল বইকি।
ওর সঙ্গে কতগুলো দিন একই জিপের মধ্যে গায়ে গায়ে বসে কত মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়েছে প্রভাত।
বউ হারিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না।
পুলিস কেস করতে হচ্ছে।
হাওড়া অঞ্চলের অনেক গুণ্ডাকেই দেখতে যেতে হচ্ছে প্রভাতকে, সনাক্ত করতে। কিন্তু কই, সেই চার-পাঁচটা লোককে তো–? নাঃ, তাদের বার করতে পারছে না পুলিশ।
হাওড়া অঞ্চলে দুবৃত্তের অত্যাচারের একটা খবর খবরের কাগজেও ঠাঁই পেয়েছে কোন একটা তারিখে। তা ও আর আজকাল কেউ তাকিয়ে দেখে না।
দেখেওনি। কেউ লক্ষ্য করেনি। কে কত লক্ষ্য করে?
নইলে প্রভাতের বাড়ির পিছনের বাগানের মধ্যেকার ওই সর্টকাটটা ধরে তো পাড়ার কত লোকই বাস-রাস্তায় যাওয়া আসা করে, কেউ তো তাকিয়ে দেখে নি ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে ছেঁড়া চুলের নুড়ো, এঁটো শালপাতার ঠোঙা, আর বাজে কাগজের কুচোর গাদায় চার ইঞ্চি লম্বা চওড়া ওই কাগজের টুকরোটুকু পড়ে আছে কত বড় ভয়ঙ্কর একটা সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে।
তা তারা দেখলেই কি ধরতে পারত, কতখানি ভয়ঙ্করতা লুকিয়ে আছে ওই কাগজটুকুর মধ্যে?
পারত না। কী করে পারবে?
চিঠি নয়, দলিল নয়, শুধু দুটি বাক্য। নির্ভুল বানানে পরিষ্কার ছাঁদে লেখা। বাংলা নয় ইংরিজি অক্ষরে। তা হোক, চিনতে ভুল হয় না প্রভাতের। এই এতগুলো দিনের মধ্যে মল্লিকার হাতের লেখা তো কতই দেখতে হয়েছে প্রভাতকে। বাংলা, ইংরেজি সবই। হাওড়া টকি ইভনিং শো। এই ছোট্ট দুটি কথাই তাই যথেষ্ট।