Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জীবন কাহিনি || Shaktipada Rajguru » Page 6

জীবন কাহিনি || Shaktipada Rajguru

বৈকালের রোদ-ম্লান হয়ে উঠোনে লুটিয়ে পড়েছে।

বাবুদের তারের খাঁচায় রাখা ময়ূরটা তখনো ডেকে চলেছে মাঝে মাঝে কর্কশ স্বরে।

চাকর দারোয়ানদের ঘুমও ভেঙেছে।

দু’একজন বড় দরজাটার রকে-বসে আড্ডা জমিয়েছে। সরকার মশাই-এর ডাকে পাইক উঠে আসে।

—চা নিয়ে আয়।

গদাইচরণ চা খেয়ে বের হবার আয়োজন করে।

ব্যাপারটা নিজে একবার যাচাই করে দেখবে। তারপর পরশার দল হাতেই আছে, ওই উঠে আসা ছেলেটাকে তিন-তুড়িতে বিদায় করে দিতে পারে সে।

ফতুয়ার ওপর পাঞ্জাবিটা চাপায় সরকার মশাই।

কথাটা শুনে অবধি কেমন যেন মাথায় আগুন জ্বলছে গদাই-এর। সব ওলট-পালট হয়ে যায় চিন্তার মাঝে।

সন্ধ্যা নামছে।

পথে বের হয়ে গদাই সরকার আনমনে চলেছে।

সারাদিন একফালি ঘর বন্ধ থাকে বউ-ঝিরা কাচ্ছা-বাচ্ছা সমেত। সামান্য এতটুকু ঠাঁই, আলো-হাওয়ার প্রবেশ পথ রুদ্ধ। তাই বৈকালের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-ছেলে-বউ-ঝিরা রাস্তায় বের হয়ে পড়ে দলে দলে।

রং-বেরঙের শাড়ি শোভাযাত্রা শুরু হয়ে যায়; গাছগাছালি ঘেরা ও বড় বিলের ধারে। সন্ধ্যা-তারা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবার আঁধার নামে।

পাখির ডাকে ভরে ওঠে চারিদিক। লেকের দিকে ক্রমশ ভিড় কমে আসে।

গদাইচরণ সন্ধ্যার পরে একটু আঁধার হলেই জীবনবাবুর বাড়িতে যাবে। জানে জীবনবাবু যথারীতি পালিয়ে থাকবে পাওনাদারের ভয়ে। সেই অবকাশে একটু গল্প-সল্প করে আসবে বাসন্তীর সঙ্গে। দেখবে আগের সেই হাসি-খুশির সম্পর্কের মাঝে কোথাও চিড় খেয়েছে কিনা?

সেই সময়টুকুর জন্য অপেক্ষা করছে, লেকের ওদিকে ঘুরে-ফিরে নড়ে-চড়ে। নির্জন আবছা অন্ধকারে হঠাৎ একটা গানের সুর শুনে চমকে ওঠে গদাইচরণ। ওপাশে একটা গাছের নীচে কারা বসে আছে, ঠিক ঠাওর করতে পারে না।

একটা মেয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইছে।

বেশ মিষ্টি গলাটি।

তন্ময় হয়ে দূরে বসে গান শুনছে গদাইচরণ। ও-গান তার জন্য গাওয়া নয়, ওই ছায়ারূপা একটি মেয়ে নিজের মনের খুশিতেই গান গাইছে, পাশে বসে আর একজন।

এ জগতের সীমানা ছাড়িয়ে পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে উধাও হয়ে গেছে তারা দুজনে।

ওদের গানের সুর উৎকর্ণ শোনে গদাইচরণ।

স্বপ্ন দেখে, সে-ও এমনি যেন কোন্ অসীম জগতের মাঝে উধাও হয়ে যাবে। একটি মুখ মনে পড়ে, বাসন্তীর কথা ভাবছে সে।

হঠাৎ ওদের দুজনকে গান থামিয়ে উঠে পড়তে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় গদাইচরণ। এতক্ষণ চেনা-চেনা ঠেকছিল গলাটা, ঠিক ধরতে পারেনি।

অনুমানও করেনি বাসন্তী এমনি করে নির্জন লেকের অন্ধকারে সেজেগুজে আসবে সেই হতভাগা ছেলেটার সঙ্গে বেড়াতে।

শুধু বেড়াতেই আসেনি, দু’জন এখানে তন্ময় হয়ে বসেছিল। গানও গাইছিল বাসন্তী মনের আনন্দে।

ওরা কি কথা নিয়ে হাসাহাসি করছে। তারা জ্বলা একটু আলো-আঁধারিতে ঢাকা পথ দিয়ে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল তারা।

বাসন্তী আর সেই হতভাগা বাউণ্ডুলে ছেলেটা।

গদাইচররণে দু’গালে ওরা যেন দুটো মোক্ষম চড় কষে দিয়ে গেল। থ’ মেরে বসে আছে গদাইচরণ লেকের ধারে।

লোকজন, মেয়েছেলের ভিড় কমে আসছে। দু’একজন যারা বসেছিল, তারাও উঠে পড়ছে, নির্জনে এখানে একা বসে থাকাও নিরাপদ নয়।

দূরে আলো জ্বলে উঠছে ক্রমশ।

গদাইচরণের মনে হয় পরেশের কথাই সত্যি। শুধু সিনেমাতেই যায়নি বাসন্তী আর ওই ছেলেটা, এখানেও সিনেমায় দেখা নায়ক-নায়িকার মতো বসেছিল। ওরা বেড়ে চলেছে অনেক।

মনে হয়, গদাইচরণ ডুবেই মরবে লেকের জলে এই নিভৃত অন্ধকারে। পরক্ষণেই কার ডাকে চমক ভাঙল।

—স্যার!

দাঁত বের করে এগিয়ে আসে কালীচরণ—হাতকাটা কালী। ওদের পিছনে পিছনে সে এতদূর অবধি এসেছিল।

পরেশের লোকজন যে সর্বত্র রয়েছে, তার টের পায় গদাইচরণ।

তার সেই চাপা-পড়া জ্বালাটা মাথা চাগাড় দিয়ে ওঠে। চুপ করে এই বাঁদরামি সে সহ্য করবে না। জিজ্ঞাসা করে গদাইচরণ,

—কী করছিলি এখানে?

হাসে কালীচরণ। বলে,

—আজ পরেশদা বলেছিল ফলো লিবি।

—পরেশ কোথায়?

এখুনি একটা হেস্তনেস্ত করতে চায় গদাইচরণ।

কালীচরণ জবাব দেয়—আপনার ওখান থেকে কোথায় গেল যেন!

গদাই মনস্থির করে ফেলে। ছোঁড়াটাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার। এমন শিক্ষা দেব যে, এখানে যেন আর থাকতে না পারে।

দু’জনে এগিয়ে আসে বড় রাস্তার দিকে।

পরেশও হাতে একটা করণীয় কাজ পেয়ে একটু খুশিই হয়েছে। সে ভালোভাবেই জানে, কাজ এলেই কিছু অর্থ আসবে, এবং চুপচাপ বসে থেকে সময় নষ্ট করার চেয়ে এ অনেক ভালো।

বস্তির মুখেই চায়ের দোকানটায় ওর আড্ডা। সেইখানে এসে জোটে দলের আরও অনেকে শলা-পরামর্শ, প্ল্যান-প্রোগ্রামও হয়।

দোকানদারও জানে ওদের কীর্তিকলাপ, কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে সাহস করে না। প্রথম গদাই সরকারের রক্ষিত ওরা, তারপর নিজেরাও সাবালক। দরকার হলে তার চায়ের দোকানের চেয়ার বেঞ্চিগুলো এক রাতেই সাফ করে দিয়ে তাকেও টেনে বের করে দিতে পারে পথে।

তাই ওদের জুলুম চুপচাপ সয়ে থাকে সে।

পরেশ চুপ করে বসে আছে। একটু আগেই দেখেছে, বাসন্তী আর সেই ছেলেটাকে ফিরতে। অন্যদিন অসীম একটু দাঁড়িয়ে পরেশের সঙ্গে দু’একটা কথাবার্তা বলে। চা-সিগারেটও খাওয়ায় আজ কোনো সাড়াই দিল না।

দুজনে চলেছে তো চলেছেই।

পরেশ যেন ফ্যালনা, দু-একবার ডেকে চুপ করে থাকে সে।

গজগজ করে পরেশ আপন মনে। বলে,

—পরেশকে চেনোনি!

গুম হয়ে এসে বসল পরেশ।

গ্যারেজের ড্রাইভার শশী বলে ওঠে,

—কী হল পরেশদা, মক্কেল ফিরেও তাকাল না যে?

তাহলে ওরাও দেখেছে ব্যাপারটা! গজরাতে থাকে পরেশ।

—চাইবে, চাইবে। এখন তো মুডে রয়েছে কিনা। দোব যখন টাইট, তখন বুঝবে বাছাধন এখন পরেশ তো ফ্যালনা। দে দিকি একটা বিড়ি। একটু চা দিতে বল গুপিকে।

পরেশ এককোণে জুতসই হয়ে বসে বিড়ি ধরাল।

এ সময়ে বাইরের খদ্দের বড়-একটা কেউ আসে না। ওরাই একসঙ্গে বসে আড্ডা জমায়। পরেশের মেজাজটা বেশ ভালো নেই।

হঠাৎ গদাই সরকারকে ঢুকতে দেখে ওর দিকে তাকাল পরেশ।

দোকানদার গুপিও নড়বড়ে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জমিদারের প্রতিভূ! দাঁত বের করে আপ্যায়ন করে সে।—আসুন সরকার মশাই। ওরে, ও মদনা, একটা মামলেট আর চা বানা দিকি।

গদাইচরণের মেজাজ আজ গরম হয়ে আছে। গুপির কথা, ওই আপ্যায়ন যেন তার কানেই যায় না।

ও-কোণে পরেশের কাছ ঘেঁষে গিয়ে বসল গদাইচরণ।

পরেশই বলে ওঠে,

—বলি গুপি, আমরা কি বানে ভেসে এসেছি? চা-মামলেট খেতে জানি না? খুব যে খাতির করছো সরকার মশাইকে? এত আমড়াগাছি কেন বাবা?

গদাই সরকার বলে ওঠে,

—বেশ, বেশ। দাও হে গুপি, এদেরও একটা করে মামলেট, আর চা।

পরেশ বেশ বুঝেছে, গদাই সরকার এইবার ঠেক খেয়েছে, আর ঠেক খেয়ে তার কাছে এসেছে।

পরেশ তাই বলে ওঠে,

গরিবের কথা বাসি হলে মিষ্টি লাগে সরকার মশাই। তখনই বলেছিলাম, শিকড় গজাবার আগেই দিই চারাগাছটাকে টুক করে তুলে। এখন যে শিকড় কেন, ডালপালাও গজাতে চলেছে! তা, আমরাও আপনার আপন-জন, কোনো ভাবনা নেই স্যার। তবে, মানে, কথাটা কি জানেন তো?

গদাইচরণ মাথা নাড়ে।

—সবই বুঝি। এখন ব্যবস্থা যা হয় করতেই হবে।

ইতিমধ্যে মামলেট এসে গেছে। পরেশ, কালীচরণ, শশী ড্রাইভার খেয়ে চলেছে।

গদাইচরণ কি যেন ভাবছে! মনস্থির করে বলে সে,

—একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব আজই, এভাবে ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না ব্যাপারটাকে।

জীবনবাবু বাড়ি ফিরে পায়চারি করছে গুম হয়ে।

যা দেখে এসেছে তাতেই বেশ বুঝেছে যে, সব মতলবই তার বানচাল হয়ে যাবে। মরার জন্য যে একদিন গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল, বাঁচতে চায়নি এক মুহূর্ত, সেই ছেলেটাই আজ বাঁচার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। মরার কথাও আর মনে আনবে না সে।

অথচ ও বাঁচলে আর-একজনকে নানা বিপদ আর অনাচারের চাপেই শেষ হয়ে যেতে হবে।

পরপর কয়েকটা দৃশ্য চোখের উপর ভেসে ওঠে জীবনবাবুর।

এরপর থেকে কি বিপদ ঘনিয়ে আসবে তার নমুনা খানিকটা টের পেয়েছে জীবনবাবু আজ বৈকালেই।

সেই আগা সাহেব আজ ফিরে গেছে, কিন্তু ওত পেতে থাকবে। ধরবেও তাকে একদিন।

মুদির দোকানেও দেনা রয়েছে, রাস্তার মধ্যে ধরেই অপমান করবে এইবার। চারিদিক থেকে অদৃশ্য অনেকগুলো হাত উদ্যত হয়ে আসছে তার কণ্ঠরোধ করতে। পিষে-টিপে মেরে ফেলবে তাকে।

শুধু বাঁচার তাগিদেই আজ সারা মন কঠিন নির্মম হয়ে উঠেছে জীবনবাবুর। বাঁচার জন্য তার কাছে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছুই নেই আজ।

তাই মনে মনে কঠিন হয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে জীবনবাবু। রাত হয়ে গেছে, তখনও ফেরেনি বাসন্তী আর অসীম। মেয়ের চিন্তায় তার মন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

যত দেরি হচ্ছে, বৃদ্ধ জীবনবাবু ততই চটে উঠেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত করবেই সে। মেয়েকেও বকুনি দেবে, জানিয়ে দেবে অসীমকে, এ বাড়িতে আইন-কানুন আছে। যা ইচ্ছে তাই করে বাস করা চলবে না এই বস্তি-বাড়িতেও। এখানেও সমাজ আছে, পাঁচজনের পাঁচকথায় কান দিতে হয় তাদের। মান-সম্মানও আছে।

বাসন্তীকে ফিরতে দেখে জীবনবাবু ফিরে তাকাল পায়চারি করা থামিয়ে।

ওর সাজ-পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকে জীবনবাবু।

বুড়ো কর্কশকণ্ঠে বলে ওঠে,

—অসীম কোথায়?

বাসন্তী বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখের চাহনিতে অতর্কিতে একটু দ্বিধা আর লজ্জায় ছায়া ফুটে উঠেছিল। পরক্ষণেই তা সামলে নিয়ে বলে ওঠে বাসন্তী,

—কই, সে কোথায় তা তো জানি না।

দপ্ করে জ্বলে উঠতে গিয়েও, পারে না জীবনবাবু। কোনোরকমে চেপে যায়। বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ। মেয়ে যে এতবড় মিথ্যা কথাটা সহজভাবে বলতে পারল তাকে, তা ভেবে অবাক হয়েছে জীবনবাবু।

এতদিন তাহলে ওরা দুজনে চক্রান্ত করেই তাকে পথে বসাবার তাল করেছে। কাবুলিওয়ালার লাঠির সামনে ঠেলে দিয়েছে বুড়ো বাবাকে। এতটুকু মায়া-দয়াও নেই ওদের।

সবাই চায় নিজের মতো পথ চলতে, নিজের জগতে বেঁচে থাকতে।

বাসন্তী ইতিমধ্যে ঘরের ভিতর কাপড়-চোপড় বদলাতে থাকে।

বৃদ্ধিটা তারই।

দুজনে অনেকটা কাছে এসে পড়েছে, হঠাৎ তার মাথাতেই বুদ্ধিটা আসে; অসীমকে সে-ই বাড়িতে একটু পরে আসতে বলেছে। দুজনকে একসঙ্গে বাড়িতে ঢুকতে দেখলে কে কি ভাববে? বাবাও যেন জানতে না পারে তাদের একসঙ্গে এই বেড়াতে যাওয়াটা।

অসীম হাসে।

তারও একটু কাজ আছে। বলে,

—বেশ, তুমি যাও। আমি ফিরছি একটু পরেই।

বাসন্তী একা ফিরে যেন বুদ্ধিমানের কাজই করেছে। তবু বাবার দিকে তাকিয়ে একটু ভয়ই পেয়েছিল। ওঁর কণ্ঠস্বরে কেমন একটা রুক্ষতা ফেটে পড়েছিল তা তার নজর এড়ায়নি।

বাসন্তী তাড়াতাড়ি করে কাপড় ছেড়ে রান্নার চালার দিকে এগিয়ে যায়। রাত হয়ে গেছে। এখনও চা-জলখাবার হয়নি, রাতের জন্য রুটির জোগাড়ও করতে হবে।

বাসন্তীর মনে তখনও সুরের একটা রেশ লেগে আছে।

উনুনটা ধরিয়ে একটু চায়ের উদ্যোগ করতে থাকে। সামান্য সুজি ছিল, সেই সঙ্গে একটু চা-ই করে দেবে ওদের। ওদিকে ও-বেলার ভাত-তরকারি আছে, তাই গরম করে দেবে।

দু’বেলা রান্না করার অভ্যাস নেই, ওতে খরচই বাড়ে। ডবল কাঠ-কয়লা খরচ হয়। সময় ও নষ্ট। তাই একবেলাতেই দু’বেলার ব্যবস্থা চালিয়ে নেয়।

জীবনবাবু ওকে হালুয়া চাপাতে দেখে একটু অবাক হয়।

বাজে খরচগুলো এইবার গায়ে লাগছে বেশ চিড়বিড় করে। যার জন্য এতসব, সে-ই যদি এমনি ভরাডুবি করতে পারে, তাকেও ছেড়ে কথা কইবে না জীবনবাবু।

মেয়েকে বলে ওঠে,

—ওসব আবার রাত-দুপুরে কী চাপালি বাসি?

বাসন্তী আমতা-আমতা করে জবাব দেয়,

—তোমাদের জন্যে…

অর্থাৎ অন্যজনের কথা বাদই দিতে চাইছে সে। আসলে মনের কোণে অসীমের জন্য একটা মমতা আর ভালোবাসার জন্ম নিয়েছে। সেটা অহরহ নীরব নিভৃত সুরে বাজছে, সেটাকে চাপতে পারে না বাসন্তী। সেই ভাবটা ওর কণ্ঠস্বরে, দু’চোখের চাহনিতে কেমন বারবার ফুটে ওঠে তার অজান্তেই।

জীবনবাবুর চোখেও তা এড়ায় না।

গজগজ করে বুড়ো। বলে,

—যত সব বাজে খরচ।

বাসন্তী বাবার কথায় কান দিল না। পাশের ঘরে কি করতে ঢুকল।

এই সুযোগই খুঁজছিল জীবনবাবু।

অনেক সহ্য করেছে, আর নয়। অসীমকে একটু শিক্ষা দিতে চায় ও। অন্তত ছোক্রা বুঝবে যে, এমনি করে চারিদিক দিয়ে একজনের সর্বনাশ করে নিরুপদ্রবে বাঁচা যায় না।

ফতুয়ার পকেটেই কৌটোটা রয়েছে।

চুপিসারে রান্নার চালা ঘরে গিয়ে জীবনবাবু কয়েকটি ছোট্ট আফিমের গুলি ফেলে দেয় ওই হালুয়ায়। তাপে আর ফুটন্ত পদার্থের মাঝে পড়ে কালো মটর দানার মতো গুলিদুটো মিশে গেল নিশ্চিহ্ন হয়ে।

বেশ জানে জীবনবাবু বাসন্তী এসব পদার্থ ছোঁয় না।

সবটাই খাবে ওই ছোক্বা একাই।

তারপর!

কী যেন ভাবছে জীবনবাবু!

এক ঢিলে দুই পাখিই মরবে হয়তো! ছোক্রা মরবে, আর তার কিছুদিন পরই সে পাবে কর্করে ওই তিরিশ হাজার টাকা।

রান্নার চালা থেকে সরে এল সে।

গুনগুনিয়ে বাড়ি ঢুকছে অসীম।

মনে তার খুশির সুর। জীবনবাবুই যেন ওর জন্যে এতক্ষণ অধীর আগ্রহে পথ তাকিয়েছিল।

ব্যাকুলকণ্ঠে বলে ওঠে,

—এসো বাবা! তা, এত রাত্তির করে ফেরো—মানে, নতুন জায়গায়, দিনকালও ভালো নয়। তাই ভাবনায় পড়ি।

হাসে অসীম, বলে—ভাবনার কিছু নেই।

বাসন্তীও বের হয়ে এসেছে।

জীবনবাবু তাগাদা দেয়,

—কই রে বাসি? চা-হালুয়া হোল তো দে অসীমকে। কখন বের হয়েছে, তুই তো কোনো খবরই রাখিস না। একা-একা রয়েছে, আর তুই রয়েছিস তোর মেজাজে।

বাসন্তী আর অসীমের মাঝে নীরব চাহনিতে কেমন যেন হাসির আভা খেলে যায় জীবনবাবুর মুখে। মুখ নামায় বাসন্তী।

অসীম বলে ওঠে,

—রাত হয়ে গেছে! হালুয়া-চা এখন থাক, বরং ভাতই থাকে যদি তাই দাও, খাব।

ব্যস্ত হয়ে ওঠে জীবনবাবু,

—সে কি! বাসন্তী এত কষ্ট করে তৈরি করল চা আর হালুয়া, সেটা না খেয়ে ‘ভাত’ খাবে!

বাসন্তী হালুয়ার কড়াটা নামিয়ে অসীমের দিকে একবার তাকাল।

অসীম বলে ওঠে,

—ও তো আর ফেলা যাবে না, কাল সকালেই না হয় খাব, এখন থাক।

বাসন্তী যেন একটু হতাশ হয়।

জীবনবাবুও হতাশ হয়েছে। একটা জব্বর চাল কেমন ফসকে গেল!

মহা ধূর্ত এই ছোক্রা। বারবার জাল কেটে পালাচ্ছে অতল জলে, ধূর্ত ঘেটো রুইমাছের মতো।

ওর চালটা জেনে ফেলেছে কিনা কে জানে!

অগত্যা বলে ওঠে জীবনবাবু,

—তাই রাখ ভালো করে বাসন্তী, কাল সকালেই দিবি অসীমকে। দেখিস, ইঁদুর-বেড়াল যেন না শেষ করে দেয়। ভীষণ দাম জিনিসের, অপব্যয় হলে কষ্ট হবে।

বাসন্তী ওটাকে প্লেট চাপা দিয়ে সরিয়ে রেখে রাতের খাবারের জায়গা করতে থাকে।

গদাই সরকার আজ সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

পরেশ, কালী, শশী ড্রাইভার সবাই রাজি হয়েছে, ওই অসীমকে এখান থেকে সরিয়ে দেবে! দরকার হলে হয়ত ওকে গুমই করে দেবে, কাকপক্ষীতে টেরও পাবে না।

অজানা, অচেনা একটি ছেলে ক’দিনের জন্য এই বস্তিতে এসেছিল, আবার তেমনি অপরিচিতের মত অন্ধকারে সে হারিয়ে যাবে, কে তার খবর রাখবে?

সব চাপা পড়ে যাবে দু’দিনেই।

গদাইচরণ সাবধানি-কণ্ঠে বলে,

—তাহলে আজ রাতেই সেরে ফেল ওটা।

কয়েকখানা দশটাকার নোট পকেটে গুঁজতে গুঁজতে বলে ওঠে পরেশ,

—ওসব তোমায় ভাবতে হবে না, গদাইদা! বাকি টাকাটা?

গদাইচরণ জবাব দেয়,

ওটা কাল সকালে কাছারিতে গেলেই পাবি বাপধন। কাজ করিয়ে গদাইচরণ দাম দেয় না, একথা কুন্ শ্লা-ও বলবে না।

হাসে পরেশ। বলে,

—ঠিক আছে। তবে পেট্রলের দামটা দিয়ে দাও। কিরে শশী?

শশীর একটা ধ্যাড়ধ্যাড়ে জিপ গাড়ি আছে। ওটা নিয়ে রাত-বিরেতে বের হতে হয় ওদের, অনেক কাজে লাগে ওটা।

আরও কয়েক টাকা বাধ্য হয়েই ওদের হাত তুলে দিতে হল গদাইকে।

রাত্রি হয়ে গেছে।

মনটা খানিক হাল্কা হয় গদাইচরণের।

ওদের ওপর তার বিশ্বাস আছে। পরেশের দল বেইমানি করবে না। কাল থেকেই মেঘমুক্ত হবে আকাশ—সে আকাশে একটা সূর্যই বিরাজ করবে, সে এই গদাইচরণ।

সঙ্গে সঙ্গে বাসন্তীর মুখখানা মনে পড়ে।

স্তব্ধ হয়ে এসেছে রাত্রির কলরব, বস্তির এদিকে-ওদিকে দু’একটা আলো জ্বলছে। আকাশের তারার চাইনির সঙ্গে বাসন্তীর শ্যামল সুন্দর দু’চোখের চাহনির কেমন যেন একটা মিল আছে।

কি ভেবে ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় গদাইচরণ।

দরজাটা খোলাই ছিল।

জীবনবাবু খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছে। সারা গা-হাতে-পায়ে কেমন টনটনে বেদনা। বুড়ো বয়সে আজ মাইল খানেক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে নাজেহাল হয়ে গেছে লোকটা। এত ভাবনা-চিন্তা সত্ত্বেও বিছানায় শুতেই ঘুম আসে।

ওপাশে অসীমও শুয়ে পড়ে ঘুমোবার ভান করছিল, তারও চোখ দুটো বুজে আসছে একটি মিষ্টি-মধুর স্বপ্নের আবেশে।

ভাবে একটা কাজকর্ম জুটে যাবে নিশ্চয়ই

বাসন্তীর সব ভার নেবে সে। বাঁচবে আবার নতুন করে।

জীবনের মাঝে আনন্দ আর সার্থকতার সুরটিকে সফল করে তুলবে সে।

বাসন্তী ঘরদোর গুছিয়ে বাসন-পত্র মেজে তবে শোবার অবকাশ পায়। ওদিকে বস্তির ঘরে তখনও বেসুরো গলায় হারমোনিয়াম টিপে কানা-চন্দন গান গাইছে।

গান গেয়ে ভিক্ষে করতে হয় চন্দনকে। কিন্তু তবু লোকটা গান ভালোবাসে। তার সুর জেগে ওঠে রাতের অন্ধকারে। ওর মনের কোণে একটা আশা জাগে, গান গেয়ে ভিক্ষে করতে হবে না তাকে চিরকাল, একদিন তার গান শুনবে লোকে মূল্য দিয়ে।

বাসন্তীরও মনে হয় বেশ গায় ও।

রাতের আঁধারে আজ ওই সুর বাসন্তীকে কেমন যেন আনমনা করে দেয়। অসীমের সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছিল আজ! বাইরের আলো আর আকাশের রং মুগ্ধ হয়ে দেখেছে বাসন্তী। চন্দনের গানেও সেই আবেশ খুঁজে পায় সে।

হঠাৎ গদাইচরণকে আবছা অন্ধকারে ঢুকতে দেখে ওর দিকে চাইল বাসন্তী।

গদাইচরণ এমনি অবকাশ বুঝেই এসেছে।

বাবাকে খুঁজতে আসেনি, তা বেশ ভালো করেই জানে বাসন্তী।

দাওয়ায় বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে গদাইচরণ। বাসন্তী জবাব দেয়,

—বাবার শরীরটা ভালো নেই, ঘুমিয়ে পড়েছে।

গদাইচরণ বলে ওঠে,—তাই তো! আচ্ছা থাক্, কাল সকালেই যেতে বলো একবার। একটু দরকারি কথা ছিল।

বাসন্তী চুপ করে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। গদাইয়ের টাক মাথায় দু-একগাছি চুল ফিনফিনে হাওয়ায় উড়ছে। এমনি নির্জন রাতে নিজেকেও কেমন যেন হারিয়ে ফেলে গদাইচরণ।

বাসন্তী ওর সামনে থেকে সরে পড়বার ছুঁতো খোঁজে। বলে,

—চা খাবেন একটু?

গদাই সরকারের খিদেও পেয়েছে। তাই এতরাত্রে শুধু চা খেতে মন চায় না।

ওটা বেশি খাওয়া অভ্যেস নেই তার। পেট খারাপ হয়।

তবু বাসন্তীর এই আমন্ত্রণ যেন উপেক্ষা করতে পারে না।

বলে ওঠে গদাইচরণ,

—চা! তা, বলছ যখন দাও একটু। রাত হয়ে গেছে কিনা—সেই বৈকালে একবার খেয়েছি।

বাসন্তী হাসে। কি ভাবছে যেন?

উনুনের নিভু-নিভু আগুনে কালিমাখা কেটলিটা চাপিয়ে দিয়ে হঠাৎ হালুয়ার কথা মনে পড়ে যায় বাসন্তীর।

—দাঁড়ান, হালুয়া আছে, তাই দিই। খালি পেটে চা খাবেন না।

খুশি হয়ে ওঠে গদাইচরণ, ওর যত্নের বহর দেখে। বলে,

—আবার কষ্ট দেব তোমাকে?

হাসে বাসন্তী–না, না। করাই রয়েছে, এতে কষ্ট কি আর বলুন? এটা তো সামান্য ব্যাপার!

সে হালুয়ার প্লেটটার ঢাকা খুলে একটা চামচ দিয়ে এগিয়ে দেয়, সেই সঙ্গে এনে দেয় একগ্লাস জল।

কৃতার্থ হয়ে ওঠে গদাইচরণ।

এত যত্ন করে তাকে অনেকদিন কেউ কিছু খেতে দেয়নি। বেশ আগ্রহ-ভরে খেয়ে চলে সুজিটা। কেমন একটু বিস্বাদ ঠেকে।

তবু খুশিতে মুখ তোলবার চেষ্টা ক’রে বলে গদাইচরণ,

—অমৃত! এ যে অমৃত রান্না করেছ বাসন্তী। যাক্, রান্নার হাতটা তোমার ভালোই। জানো, বাজে রান্না আবার আমি খেতে পারি না।

বাসন্তী ওর গদগদ ভাব দেখে একটু মজাই অনুভব করে।

তারপর চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় সে।

গদাই-এর দু’চোখে একটা তৃপ্তির নেশা। বলে,

—জানো বাসন্তী, বাড়িতেও আমার ঠাঁই নেই। ওরা সবাই চায় আপন আপন স্বার্থ। ওদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধই রাখতে চাই না আমি। তাই ত এখানে আসি অনেক আশা নিয়ে।

বাসন্তী ওর উৎসাহ আর ভাবের আতিশয্যে কেমন একটু ঘাবড়ে গেছে!

গদাইচরণ যেন স্বপ্ন দেখছে। কেমন নীল-হলুদ মেশানো স্বপ্ন

বাসন্তীর ওই কবোষ্ণ দেহের উত্তাপের স্বপ্নে হারিয়ে যেতে চায় গদাইচরণ। জীবনবাবুর আফিমের কাজ এবার শুরু হয়েছে।

স্বপ্নটা কেমন মিষ্টি, একটু আবেশের অতলে হারিয়ে যায়। ঢুলছে গদাই।

—সরকার মশাই!

বাসন্তীর ডাকে ওর দিকে তাকাল গদাই। বলে ওঠে,

—একটু ঝিমিয়ে নিয়েই চলে যাব বাসন্তী! তুমি ঘরে যাও।

বাসন্তী ওর দিকে চেয়ে থাকে।

কে জানে, লোকটা সারাদিন খেটে-খুটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, খাওয়া হয়নি, বাড়িতেও যায়নি! মায়া হয় ওই লোকটাকে দেখে।

—একটা বালিশ এনে দোব, একটা পাটি!

মাথা নাড়ে গদাইচরণ। খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে ঝিমুনির চেয়ে একটু ঘুম দিতে পারলে ভালো হতো।

রাত কত জানে না!

পরেশের দল এসে পড়েছে। জীর্ণ দরজাটা খোলা আর বন্ধ থাকা দুই-ই সমান। তবু দরজাটা বাতাসের বেগে দু’ফাঁক হয়ে খোলাই রয়েছে। অন্ধকারে জীবনবাবুর ঘরের উঠোনে ছায়ামূর্তিগুলো এসো ঢুকল একে-একে।

রাতের অন্ধকারে কার সন্ধান করছে তারা চুপিসারে।

পরেশ, কালী, আর কে কে যেন আছে। এদের কাজ-কর্ম রাতের গভীরেই শুরু হয়। খুঁজছে সেই লক্কা-ছেলেটিকে। আজ তাকে ওরা শেষ করে ফেলবে।

গদাই সরকারের টাকার জোর আছে। তার পথ থেকে কাঁটা সরাবার জন্যে কোনো আয়োজনই তারা বাকি রাখেনি।

বারান্দায় ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে সেই ছেলেটাই বোধহয়। ওদের অপেক্ষা করবার সময় নেই।

সেই অবস্থাতেই বারান্দায় মূর্তিটাকে মুখে—চাপা দিয়ে বেঁধে, একটা চটের থলেতে পুরে ফেলে ধরাধরি করে তুলে, চুপিসারে গলি পার হয়ে বস্তির বাইরে ঝুপসি বটগাছটার নিচে দাঁড়ানো জিপটায় তুলে ফেলল।

শশী ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এ বসেছিল।

ফিসফিসিয়ে তাকে বলে পরেশ,

—চালা, জোরসে চালা।

—তাহলে কাম ফতে?

শশীর কথায় পরেশ বলে ওঠে,

—দিইছি ব্যাটাকে দু’চার কোঁতকা। তারপরই ছালাবন্দি করে তুলে নিয়ে চলেছি, চ্যাঁচাবার পথও রাখিনি, ঠেসে কাপড়–পুরে দিইছি শা’র মুখে। নির্ভয়ে চালা, খাল পার হয়ে উই জলাটার দিকে।

শশী জানে, এসব কাজে নানারকম ঝক্কি।

জ্যান্ত মাল বওয়ার পয়সা অবিশ্যি কিছু বেশি মেলে, কিন্তু ধরা পড়লেই সমূহ বিপদ।

শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গাড়িটা ছুটে চলেছে। দু’পাশে খেত, আর বড় বড় শিরীষ গাছের সীমানা। অন্ধকারে আকাশ-ছোঁয়া দৈত্যের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।

এরপরই জলা, আর হোগ্‌গ্লাবনের শুরু হবে।

জলের বুকে মাথাসই সকলকে সবুজ পাতা মেলে এদিক থেকে ওদিক জুড়ে শুরু হয়েছে হোগ্‌গ্লাবনের সীমানা।

তারই মাঝে ওই বস্তায়বন্দি দেহটাকে ফেলে দিয়ে যাবে তারা।

স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ক’টি প্রাণী! সিগারেটের লালাভ-আলোয় ওদের আবছা মুখগুলো বীভৎস হয়ে উঠেছে।

একটানা মসৃণ শব্দ তুলে চলেছে গাড়িটা।

এদিকে গদাইচরণের দম বন্ধ হয়ে আসছে।

সেই রাত্রি বেলাতেই হালুয়া খেয়ে কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল, তারপর ঠিক মনে নেই সবকিছু।

বাসন্তীর হাসিটুকু আবছা ভেসে ওঠে তার মনে। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে জমাট-বাঁধা আঁধারে। গাড়িখানা এগিয়ে চলেছে।

ঝাঁকুনিতে নড়ছে ওর দেহ।

ঠিক বুঝতে পারে না, কোথায় কি একটা সাংঘাতিক কাণ্ড বেধে গেছে অন্ধকারে। এই চটের থলির মধ্যে কি করে ঢুকল সে, তাও ঠাওর করতে পারে না।

চিৎকার করবার চেষ্টা করে, কিন্তু মুখের মধ্যে কে যেন পুরু ন্যাকড়া পুরে দিয়েছে! কোনো রকমে দু’হাতের বাঁধন খুলে মুক্ত হবার চেষ্টা করে গদাইচরণ। কাদের ফিফিসানি কণ্ঠস্বর শোনা যায়?

ভয়ে-আঁতকে উঠেছে গদাই সরকার। তারও তাহলে শত্রু আছে!

বস্তাটা গড়িয়ে গড়িয়ে খোলা জিপের ধারে এসে ঠেকেছে। পিছনের দিকে ওদের নজর নেই। একটা বাঁকের মুখে জিপখানা জোরে ঘুরবার সময়ই ছিটকে পড়ে বস্তাটা, রাস্তার বাইরে, সেই জলা আর হোগ্‌গ্লাবনের ওপর সশব্দে

ওরাও টের পেয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে।

গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছে পরেশ, কালী, গুপি, আরও ক’জন।

একফালি চাঁদের আলো উঠেছে। জায়গাটা থমথম করছে।

এদিক-ওদিক খুঁজছে তারা।

বামাল এমনি করে রাস্তার ধারে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। খুঁজে বের করে তাকে দরকার হলে ঘা-কতক দিয়ে শেষ করে যেতে হবে।

গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ভারি দেহের ওজনেই হোক, বা গাড়ির গতিবেগের জন্যই হোক, ছালার মুখের বাঁধন খুলে যায়। গদাইও শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে চট-জড়ানো প্যাক-করা অবস্থাতেই হোলা বনে। আঘাত তেমন বিশেষ লাগেনি, তবে জলে-কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে সারা দেহটা।

উঠে আসবার জন্য চেষ্টা করছে গদাইচরণ, অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর কারা যেন। কিল, চড়, লাথি, রদ্দা চালাচ্ছে দমাদম। আর্তনাদ করছে গদাই প্রাণপণে

—হেই বাবা, ছেড়ে দে বাবা, পায়ে পড়ি তোদের বাবা।

হঠাৎ ওর-মুখে একঝলক টর্চের আলো পড়তেই আক্রমণকারীরা থেমে যায়। পরেশও এগিয়ে আসে।

অবাক হয়েছে সে।

—সরকার মশাই! আপনি!

শশীও উদ্যত রড্‌টা থামিয়ে বলে ওঠে,

—তাই তো রে!

কালী আপশোস করে ওঠে ব্যাপারটা বুঝে। বলে,

—বড্ড সেমসাইড হয়ে গেছে স্যার।

গদাই-এর কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেছে। জলে-কাদায় সর্বাঙ্গ মাখামাখি। কে জানে জোঁকই লেগেছে কিনা। পচা জলে পড়ে সর্বাঙ্গ পিট্ পিট্ করছে, চুলকোচ্ছে।

ইশারায় বলে ওঠে গদাইচরণ,

—একটু জল—জল খাওয়া দিকি!

পরেশ কোত্থেকে একটা পুরোনো মবিলের টিনে করে ওই পচা জলই তুলে আনে। ঢকঢক করে তাই খানিকটা খেয়ে সরকার মশাই দেহে জোর পায়। পথের ধারে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পড়ে আছে গদাই সরকার।

তখনও খাবি খাচ্ছে! সর্বাঙ্গ ওদের লাথি আর রুলের গুঁতোয় ব্যথা করছে। সরকার মশাই গজরাচ্ছে সমান তালে। বলে,

—আমাকেই গুম-খুনের মতলব? তোরা ভেবেছিস কী?

পরেশ আমতা আমতা করে। বলে,

—আপনি যে ওর-বারান্দায় কাপড়-মুড়ি দিয়ে পড়েছিলেন, আজ্ঞে, তা তো জানতাম না। রাত-বিরেতে ওখানে যে যান, কী করে জানব স্যার?

কী ভেবে গদাইচরণ চুপ করল। ·

মনে মনে বলে, মেয়েটাই বিচ্ছু। নইলে তাকে ওখানে পড়ে থাকতে হতো না সারারাত, আর এই দুর্ভোগও ভুগতে হতো না।

পরেশ বলে ওঠে,

—চলুন, এখানে বসে থেকে কী হবে! সত্যি বলছি এসব জানতাম না।

আস্তে আস্তে উঠল গদাই সরকার। ধীরে ধীরে মনের রাগটা হু-হু করে জ্বলে উঠছে। ওই বুড়ো জীবন যেমন বদমায়েশ, তেমনি হাড়-পাজি ওই মেয়েটা।

ওর জন্যই বাড়িতে অশান্তি এনেছে গদাইচরণ।

এইবার ওদের ঠাণ্ডা করবে গদাই সরকার।

মসৃণ গতিতে গাড়িটা আবার জলা-ধানখেতের সীমানা ছাড়িয়ে শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। ভোর হতে আর দেরি নেই।

জেগে উঠছে নিদ্রামগ্ন শহর! ধাপার দিক থেকে তরিতরকারি বোঝাই ঠেল-গাড়িগুলো কলকাতার দিকে আসছে।

চুপ করে বসে আছে গদাইচরণ। এখানে-ওখানে মারের চোটে থেঁতলে গেছে শরীরটা। রুদ্ধমুখে আগ্নেয়গিরির মতো বসে আছে সেই গাড়িতে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *