Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জীবন কাহিনি || Shaktipada Rajguru » Page 5

জীবন কাহিনি || Shaktipada Rajguru

গদাই সরকারের মাথায় তখনও ঘুরছে বাসন্তীর সেই মুখখানা। হাসি-ভরা একটা মুখ—দুটো কালো চোখের চাহনি তাকে কেমন আকুল করে তুলেছে। দিনরাত্রি ওকেই মনে পড়ে গদাই সরকারের।

গদাই-এর স্ত্রী জগদ্ধাত্রী ওর তুলনায় যেন বিশালদেহী একটা পেত্নিবিশেষ। তার ওপর ওই তর্জন-গর্জন যেন বিষময় ঠেকে গদাই-এর। মাঝে মাঝে মাথা গরম হয়ে ওঠে, কিন্তু চেপে থাকে কোনো রকমে।

এমনি করেই গদাই-এর দিন কাটে!

বস্তি থেকে বের হয়ে রাতের বেলায় বাড়ি ফিরেই দেখে জগদ্ধাত্রী যেন ওত পেতে ছিল। গিলে-করা পাঞ্জাবি আর দিশি ধুতি পরে গদাইকে ফিরতে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। গদাই-এর হাতে একটা গোড়ের মালা-জড়ানো।

ওর দিকে তাকিয়ে কি ভেবে জগদ্ধাত্রী গর্জন করে ওঠে,

—কোথায় গিয়েছিলে মরতে?

গদাই জবাব দেয়,—যমের বাড়ি। তোমার জন্য জায়গা দেখতে গিয়েছিলাম।

তারপরই জগদ্ধাত্রী যা উত্তর দেয় তা বিশেষ উপভোগ্য নয়, এমনকি অশাস্ত্রীয়ও। গদাইচরণের মনের আমেজটুকুও ছুটে যায়। চারিদিকে ওর শত্রু। এদিকে ওই চ্যাংড়া ছোঁড়াটা জুড়ে বসেছে জীবনের বাড়িতে, আর এদিকে জগদ্ধাত্রী সমানে কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে চলেছে! সে-গলা উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে তারায় উঠেছে।

জগদ্ধাত্রী তখনও চেঁচিয়ে চলেছে।

—যে চুলোয় গিয়েছিলে সেইখানে থাকলেই তো পারতে।

গদাইও গর্জন করে,

—তাই থাকব এবার থেকে। এখানে নো কনেক্‌শন্! সব অয়েল আমি শেষ করে দোব।

ঝগড়ার জের চলে রাতভোর, এমনকি সকাল অবধি।

চা-না খেয়ে গদাই বের হয়ে যায় কাছারির দিকে। চা-পর্বটা বাইরে কোনো দোকানেই সেরে নেবে, না হয় কাছারিতেই ওটা সারবে।

বাড়ির ওপর ঘেন্না ধরে গেছে তার।

সকালবেলায় মেজাজটা কেমন বিগড়ে যায় গদাইচরণের।

কাছারিতে ইতিমধ্যে লোকজন জড় হয়েছে। নানাজনের নানা কথা, নানা আর্জি। কেউ সস্তা সেলামিতে জমির কিছু বন্দোবস্ত চায়। কারও বা বাকি করের নালিশ চলেছে, তারই আপসের জন্যই এসেছে। কেউ বাজারে একটু বসবার জন্য দু’হাত জায়গা চায়।

নানান জনের নানা আব্দার

গদাইচরণ বিরক্ত হয়ে গজগজ করে।

—একি দানছত্র খুলেছেন বাবুরা যে, ওসব মাগ্‌না হবে! ফেলো কড়ি, মাখো তেল, তুমি কি আমার পর! ওসব কান্নাকাটি চলবে না এখানে। কই হে, তিন নম্বর যদু চক্কোত্তি লেনের—রেকত পড়চাটা বের করো তো পুলিন।

পুরো দমে কাজে মন দিতে চায় গদাইচরণ।

এমন সময় জীবনবাবুকে ঘরে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হয় গদাইচরণ। ধমক দিতে গিয়ে কি ভেবে থেমে যায়।

কাল রাতে বাসন্তীর হাসিটুকু মনে পড়ে। কেমন যেন গদাই-এর উদ্ধত মেজাজটাকে বশ করে ফেলেছে ওইটুকু মেয়েটা।

গদাইচরণ মনে মনে অনেক আশা রাখে।

টাক ঘামছে। গদাই কোনরকমে একটু হাত বুলিয়ে সামলে নিয়ে আপ্যায়ন করে জীবনবাবুকে।

—বসুন, বসুন। ওরে অ’ দামড়ি, থোড়া চা নিয়ে আয়, আর সিগারেট। তারপর, কি খবর বলুন?

জীবনবাবু তার কথাটা এত লোকের সামনে বলতে চায় না।

—একটা কথা ছিল যে! একটু ফাঁকা হলেই বলব।

খুশি হয় মনে মনে গদাইচরণ। কথাটা কি, তা যেন অনুমান করতে পারে সে। এই কাছারিতে বসে ওসব কথা না হওয়াই ভালো। পাঁচ-কান হলেই ওই শুভ কাজে বাধা পড়বে।

তাই বলে ওঠে গদাইচরণ,

—বেশ তো, আজ সন্ধেবেলাতেই যাব আপনার ওখানে!

জীবনবাবু ঘাড় নাড়ে। কি ভেবে বলে—বেশ।

চা খেয়ে, সিগারেট ধরিয়ে উঠতে যাবে, জীবনবাবুর হঠাৎ একটা তুচ্ছ কথা মনে পড়ে যায়। একটু ব্যস্ত হয়ে, ফিরে এসে বলে ওঠে জীবনবাবু,

—হঠাৎ গোটাকতক টাকার দরকার পড়েছে। মানে, দু-একদিনের জন্য নিতাম, কাল-পরশুই দিয়ে দোব।

গদাইচরণ দাদন দিয়ে ব্যবসা করতে জানে! ওর দিকে তাকাল সে।

ও-টাকা সে সুদে-আসলে অন্যভাবে আদায় করবে। জীবনে একটা দিকে অপব্যয় করেও আনন্দ পায় মানুষ। তাই, গদাই যেন দরাজ হাতেই আজ খরচ করতে চায়। উচ্চবাচ্য না করে ক্যাশবাক্স খুলে পাঁচখানা দশটাকার নোট ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে গদাইচরণ দরদ-ভরা কণ্ঠে,

—এই নিন।

টাকাটা হাতে পেয়ে জীবনবাবু আশ্বাস দেয়,

—কয়েকদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

গদাই আসল কথাটা মনে করিয়ে দেয়, আশার সুর বেজে ওঠে ওর কথায়। বলে চলেছে গদাইচরণ,

—আর এই যে কথাটা বললেন, আজ সন্ধ্যাবেলাতেই সেটা হবে তাহলে। সব কথা পরিষ্কার হওয়াই ভালো।

মাথা নাড়ে জীবনবাবু। কোনো রকমে পালিয়ে আসতে পারলেই যেন বাঁচে। কে জানে, যদি আবার কেড়ে নেয় টাকাগুলো! ওকে বিশ্বাস নেই।

আর কোনো কথা তার ছিল না।

নেইও। শুধু টাকা ক’টা বের করার জন্য ওই অন্য কথার ইঙ্গিত দেওয়াটা ছলনা মাত্র। পেয়ে যেতেই বের হয়ে আসে জীবনবাবু।

গদাইচরণ মনে মনে খুশিই হয়। একটা আশ্বাস পেয়েছে সে।

বাকি পথের কাঁটা ওই ছোঁড়াটা। জীবনবাবুকে হাত করতে পারলে ওই তুচ্ছ ছোঁড়াটাকে এক-ফুঁয়ে কুলেখাঁড়ার খাল পার করে রেখে দিয়ে আসতে পারে গদাই সরকার।

আর বাসন্তীরও বোধহয় তাকে মনে ধরেছে। নইলে তার সামনে এত মিষ্টি করে হাসত না।

গদাই সরকার কাজে মন দেয় আবার। গদাই দরদস্তুর করে পাইকেরদের সঙ্গে।

—কই হে, দোকান ইজারা নেবে বলছিলে? তা বাপু, মিষ্টি-টিষ্টি খাওয়াতে হবে তো? বাজারে বসতে দিচ্ছি—

লোকটা তা জানে।

তাই কোমরের গেঁজলা থেকে দলাপাকানো কয়েকটা নোট বাঁ-হাতে ধরে বাড়িয়ে দেয় গদাই-এর দিকে। গদাই আন্দাজে নোটগুলোর আকার দেখে বুঝতে পারে। নিমরাজি হয়েও ঠিক যেন দর-বাড়াতে চায় আরও কিছু।

–তাই তো হে! এত কমে সারবে?

মেজাজটা একটু বদলাচ্ছে গদাইচরণের। টেকো মাথায় ঘাম বন্ধ হয়েছে। বিরক্তির চিহ্ন মুছে গেছে মন থেকে।

হাসি-ফুটে ওঠে টাকার আনন্দে-সেই সঙ্গে বাসন্তীর মুখখানা মনে পড়ে, খুশি হয়ে ওঠে গদাই সরকার।

একটা হাল্কা সুরের মতো মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছে সে। সকালের মিষ্টি রোদের-আভায় বাইরের সবুজ মাঠ, গাছগাছালি সুন্দর হয়ে ওঠে।

অসীম বেরোবার মুখে জীবনবাবুর জন্য অপেক্ষা করছে।

জীবনবাবু জানে রসদ না জোগালো ছোক্রা হয়তো বা সরে পড়বে। তাই জো-সো করে শেষ অবধি গদাইচরণকে ঠকিয়েই টাকাগুলো এনেছে। জীবনবাবু বেশ বুঝেছে গদাই যা-তা পাত্ৰ নয়, কথার খেলাপ হলে তাকে বিপদে ফেলবে, কিন্তু এছাড়া তার পথও ছিল না।

বাড়ি ফিরে অসীমের হাতে দু’খানা করকরে দশটাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে আকুতি-ভরা কণ্ঠে বলে জীবনবাবু,

—আর নেই বাবা। ওই দিয়ে কোনরকমে চালিয়ে নাও

অসীম নোট দু’খানা পকেটে পুরতে পুরতে বলে,

—মাত্র এই!

জীবনবাবু ব্যাকুলভাবে ওর দুটো হাত ধরে বলে ওঠে,

—এটা বুকের রক্ত বাবা! বুড়োকে এইবার খ্যামা দাও। আর আজই তাহলে ধর সাতদিন

হয়ে গেছে।

অসীম বলে ওঠে,

—ওরা জন্য ভাববেন না আপনি।

আজ চুপ করে বসে পড়ে জীবনবাবু। ওর চোখের সামনে একটা চরম সর্বনাশ যেন ঘটতে চলেছে।

অসীম বের হয়ে গেল সেই কারখানার দিকে। আজ হয়তো একটা কথা পাবে সে। বাঁচার সেই আশ্বাসটুকুর জন্যই বের হয়ে গেল কোনো কথা না বলে।

জীবনবাবু ওর মরার কথাই ভাবে। ও না মরলে তার কি সর্বনাশ হবে, সেই ভাবনাতেই ভয় পেয়ে গেছে সে। তামাক খেতেও মন সরে না। চায়ের কাপটা সামনে নামানোই রয়েছে—চা খাওয়ার দিকেও মন নেই তার। বাসন্তী বাবাকে আনমনা দেখে বলে ওঠে,

—কি এত ভাবছ বাবা?

জীবনবাবু মেয়ের ডাকে ওর দিকে ফিরে তাকাল। কি করে জানাবে তাকে তার ভবিষ্যৎ চরম সর্বনাশের কথা।

বস্তির বাইরে বাজারের ওপাশে দেখেছে জীবনবাবু সেই মূর্তিমান যমদূতের মতো আগা সাহেবকে। ছাতুর দোকানের বাইরে চারপায়ায় বসে আছে সে, হাতে সেই বেঁটে লাঠিটা।

খুদে আগা সাহেব পিটপিটে দু’চোখ মেলে কার-সন্ধান করছিল। কাল ওর টাকা দেবার দিন, পার হয়ে গেছে। টাকা না দিতে পারলেও সুদটা দিতেই হবে। তারই সন্ধানে জাল ফেলে বসে আছে আগা সাহেব। বেলা যত বাড়বে, মাথায় বাঁধা পাগড়ির নিচে টাক ততই তেতে উঠবে! সেই সঙ্গে তেতে লাল হয়ে উঠবে তার মেজাজ—যেন বারুদ।

মেজাজটা তাহলে একটা দেশলাই-এর কাঠি জ্বালাবার যা দেরি। তারপরই বিস্ফোরণ ঘটবে!

এবার বিপর্যয় কি ঘটবে চার-চক্ষুর মিলন হলে, সেই দৃশ্যটাই কল্পনা করছে জীবনবাবু, আর ঘনঘন শিউরে উঠছে।

সেই বিপদের কথা মেয়েকে কি করে আর বোঝাবে! তাই আমতা-আমতা করে বাসন্তীর কথায়।

—না, কিছু না।

বাসন্তী তাগাদা দেয়,

—রান্না হয়ে গেছে। স্নান-খাওয়া সেরে নাও।

খেতেও ইচ্ছে নেই। দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে হাত-পা কেমন যেন জড়সড় হয়ে আসে। জীবনবাবু বাসন্তীকে জিজ্ঞাসা করে,

—হ্যাঁরে, অসীম তোকে কিছু বলেছে?

বাসন্তী বাবার প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়। অকারণেই তার গালে একটু লালিমা ফুটে ওঠে। সেই রক্তিম মুখের ভাবটা জীবনবাবুর চোখে পড়ে না।

ওসব দেখবার মতো অবস্থা তার নেই।

জবাব দেয় বাসন্তী—কই, না তো! কী কথা বাবা?

জীবনবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক বলতে পারে না, কি সেই গোপন কথা। নিজেরই মনে হয়, একজনের বিনিময়ে তার নিজের এই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখাও অন্যায়। সেকথা কাউকে বলাও যায় না। নিজের মেয়েকেও না।

তাই কথাটা ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করে। বলে,

—না, এমনি বলছিলাম। মানে, ছেলেটা ভালো কি মন্দ, বাজে মিথ্যে কথা বলে কিনা তাই শুধোচ্ছিলাম।

বাসন্তী জবাব দেয়,

—তা কি করে জানব। ওই সঙ্গে কতটুকুই বা কথা হয়।

—তা তো সত্যি। চল, স্নান করে নিই।

জীবনবাবু নেহাৎ অনিচ্ছাসত্ত্বে বহু কষ্টে স্নান-খাওয়া শেষ করেছে। তবু একটু বেরোবে, যদি কোনো কাজকর্ম হয়।

মাত্র ক’টা টাকা আর পড়ে রয়েছে—এরপর দুনিয়ায় আর কোথাও কিছু মিলবে না। একমাত্র অসীম দয়া করে যদি কথাটা রাখে তবেই ভাগ্য ফিরবে। নইলে? নইলে কি হবে কল্পনাও করতে পারে না, জীবনবাবু। সব ভাবনা-চিন্তা ফুরিয়ে যাবে যেন এইবার।

দুপুর হয়ে আসছে!

চাট্টি ভাত মুখে দিয়ে বের হয়েছে জীবনবাবু ছাতা বগলে, কেডস্ পায়ে। রোজের অভ্যাস, ওর জীর্ণ ডায়েরিতে লেখা সব নাম-ধামগুলোয় গিয়ে একবার করে ধর্না দেওয়া—ওই লিপিবদ্ধ প্রাণীদের কারও মতিগতি যদি বদলায় সেই আশায়। সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যবসাও করে সে। ওই ব্যাগে কিছু সস্তা তেলের-লেবেল লাগিয়ে মহাভৃঙ্গরাজ নাম দিয়ে বিক্রি করে।

কোনো মক্কেল যদি নতুন কেস না করতে চায়, নিদেন একশিশি তেল কেনার কথাও বলবে জীবনবাবু—যদি তাতেও কিছু আসে।

সারাটা দিন টহল দিয়ে মাত্র একশিশি তেল বেচেছে একজনের কাছে। দালালের হাত থেকে রেহাই পেতে ভদ্রলোক এক শিশি তেল কিনেছেন।

এছাড়া আর কোনো রোজগার হয়নি।

এদিকে সাতদিন পার হয়ে দশদিনে পড়তে চলল, অসীম কোনোকিছুই করতে পারেনি। আবার আগেকার সেই যন্ত্রণা আর দুশ্চিন্তাময় জীবনের মাঝেই এসে পড়েছে জীবনবাবু। সেদিন কিন্তু এত দেনা মাথায় ছিল না। আজ দেনা মাথায় নিয়ে পথে-পথে ঘুরছে লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে।

তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে। পকেটে মাত্র কয়েক আনা পয়সা, তা দিয়ে চা-খাবার প্রবৃত্তি নেই জীবনবাবুর।

ঝিমুনি আসছে। আফিম খাবার সময় হয়ে গেছে—অগত্যা শেষ সম্বল কয়েক আনা পয়সা দিয়ে চা-খাবার জন্যই একটা দোকানে ঢুকেছে।

ক্লান্ত শহর।

দুপুরের রোদ গাছগাছালির মাথায় ফিরে রঙের আভাস এনেছে।

মাঝে-মাঝে ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে যায় দু’একটা ট্রাম। এ সময়ও লোকজনের ভিড়ের কামাই নেই। বাসগুলো চলেছে রাস্তা কাঁপিয়ে। এদিকে জীবনযাত্রাও সহজ গতিতেই চলেছে।

দোকানে বসে জীবনবাবু আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।

গলার কাছে আফিমের বড়িটা চায়ের রসে ভিজছে—ক্লান্ত সারা শরীরে একটা স্তিমিত শান্ত-ভাব। ভাবনাগুলো একটুক্ষণের জন্যে যখন কমে যায়, তখন মনের মাঝে একটা আমেজ আসে।

এই প্রশান্তির মাঝেও একটা নীরব অন্ধকারের মত ওই আগত বিপদের ভয় কালো ছায়ার মতো জেগে রয়েছে।

হঠাৎ বাতাস কাঁপিয়ে একটা বাসের ব্রেক কষার শব্দ ওঠে। তাকে ছাপিয়ে উঠেছে কোলাহলটা। কোনো পথচারী বলে ওঠে—আহা! একেবারে পিষে গেছে।

কে যেন বাসের নিচে পড়েছে, একটা চাকায় পিষে গেছে তার দেহটা।

দেখতে দেখতে নিমেষের মধ্যে ভিড় জমে যায় সেখানে। রীতিমতো চক্রব্যুহ রচনা করেছে সমবেত জনতা, আর কৌতূহলী দর্শকের দল।

চায়ের দোকানের হ্যাংলো-প্যাংলা ছেলেটা লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ায় ঘটনাস্থলের দিকে। এদিক-ওদিক থেকে লোকজন সব দোতলা-তেতলা হতে দেখছে নীচের দিকে।

চারিদিকে একটা সমবেদনার ছায়া নেমেছে। সবাই বলছে,

—একেবারে তাজা জোয়ান ছেলেটা মরে গেল গা!

—স্পষ্ট্ ডেড্! ব্রাইট ইয়ং-ম্যান!

ওদের কথায় জীবনবাবুর ঝিমুনি স্রেফ ছুটে গেছে। একেবারে খুশিতে ফেটে পড়ে সে। চিৎকার করে ওঠে—মরে গেছে?

যেন আনন্দে চায়ের দোকান থেকে লাফ দিয়ে পড়ল রাস্তায় জীবনবাবু। ওর গলায় ছেঁড়া-নেকটাইটা জয়-পতাকার মতো উড়ছে বাতাসে পত্পত্ করে। হাতের ব্যাগটা আশমানে তুলে ছুটছে ওইদিকে জীবনবাবু।

এতদিনে অসীম তাহলে কথাটা ঠিক রেখেছে। জীবনবাবু সামনের ভদ্রলোককে শুধোয়,

—ইয়ং-ম্যান!

—হ্যাঁ মশাই, দামি প্যান্ট আর হাওয়াই-শার্ট পরনে। একেবারে স্পট্ ডেড! দেখুন দিকি, কি রকম রাফ্-ড্রাইভিং! জীবনবাবু ছাতাটা বগলে করে ভিড়ের মধ্যে একটু নজর দেবার চেষ্টা করে। মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে, এইবার তাকে পায় কে?

কে একজন দর্শক ধমকে ওঠে জীবনবাবুকে,

—ঘাড়ের ওপর দিয়ে কী দেখছেন স্যার? এখানে রথের মেলা বসেছে নাকি? যান এখান থেকে?

জীবনবাবুও বেশ ওজনের সঙ্গেই ধমকে ওঠে। ইতিমধ্যেই যেন কয়েক হাজার টাকার মালিক হয়ে গেছে সে।

—স্যাট্ আপ্! দেখতে দিন মশায়।

দেখবার সুযোগ না পেয়ে কাছাকাছি একটা লাইটপোস্টেই উঠতে থাকে ছাতা বগলে। ওরা জানে না, জীবনবাবুর মনে কি ব্যাকুলতা আর আবেগ ফুটে উঠেছে!

হঠাৎ নিচে একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে। কে যেন ভিড় সরাচ্ছে;

—সরে দাঁড়ান মশায়! ও বড়দা, হাওয়া আসতে দিন।

লাইটপোস্ট বেয়ে বেশ খানিকটা উপরে উঠছে জীবনবাবু, এমন সময় হঠাৎ অসীমকে সামনে দেখে একেবারে মিইয়ে যায়। হাত-পায়ে ঝিম ধরে আসে।

ভেবেছিল, আপদ চুকে গেছে একেবারে, এইবার দিন বদলাবে। তা, সেই আপদটা চাপা-পড়া তো দূরের কথা, রাস্তায় ভলেন্টিয়ারি করছে বহাল তবিয়তে, এটা ভাবেনি!

রাগে, হতাশায় সারা শরীর কাঁপছে জীবনবাবুর

হাতটা উত্তেজনার বসে আলগা হয়ে যায় এবং লাইটপোস্টের উপর থেকে ছিটকে পড়ে বগলদাবা করা ছাতাটা কার ঘাড়ে; তারপর নামতে গিয়ে নিজেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় দর্শকের ঘাড়ে।

কে যেন গর্জন করে ওঠে,

—ও মশাই, বলি, খেপে গেলেন নাকি? পড়ে মরবেন শেষতক? বুড়োর তো বেশ তেজ দেখছি।

অন্য দর্শকরাও ফোড়ন কাটে,

—দাও না দাদুকে ওই অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িতে তুলে। আরে, এই যে ছাতাটা পড়ে রইল… ও দাদু।

জীবনবাবুর হাতে একজন দয়া করে বাঁশের বাঁটের জিরজিরে ভাঙা ছাতাটা তুলে দেয়। ওটা হাতে নিয়ে কোনো রকমে জীবনবাবু সেখান থেকে চোরের মতো পালিয়ে আসতে পারলে যেন বাঁচে।

অসীম ওকে দেখেনি, তখন সেখানে মোড়লি করছে সে।

জীবনবাবু সেখান থেকে বের হয়ে একটু ফাঁকায় এসে দাঁড়াল। শরীর-হাত-পা সব কাঁপছে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। পয়সা নেই যে একটু চা খাবে। কিন্তু ভেবে সামনের কলেই মুখ-লাগিয়ে চোঁ-চোঁ করে জল খেতে থাকে।

অসীম আজ কারখানার ওদিক থেকে ফেরবার পথে এই ঘটনা দেখে দাঁড়িয়েছিল। ওসব চুকে যেতে এবার বাড়ির পথ ধরেছে।

ওর মনে আজ একটু আশার সুর জেগেছে।

সামনের সপ্তাহে একটা কাজ পাবে—এখানেই হোক, বা আগেকার সেই অফিসেই হোক। আজ মবলক কিছু রোজগার হয়ে গেছে অসীমের।

একটা গাড়ি এসেছে কারখানায়! তাকে ট্রায়াল দেবার জন্যই ম্যানেজার ওই গাড়িটা দেখতে বলে।

অসীমও পাকা মেকানিকের মতো গাড়ির বনেট খুলে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করে একবার স্টার্ট দেবার চেষ্টা করেই বুঝতে পারে গলদটা কোনখানে! স্রেফ ডিস্ট্রিবিউটারের গোলমাল। ঠিকমতো ফায়ারিং হচ্ছে না।

মালিকের সামনে মিস্ত্রি গাড়ি মেরামত করতে চায় না। কারণ, পাঁচ মিনিটের কাজে দশ টাকা চাইলে মালিকের চোখ টাটাবে, তাই এদিক-ওদিক নাড়াচাড়া করতে থাকে। এটা খোলে, সেটা খোলে। এখানে-ওখানে স্ক্রু-ড্রাইভার ঘোরায়। শেষতক গলদটায় হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়।

ছোট সাহেবও পাকা মেকানিক। দাঁড়িয়ে ছোক্রার কাজ দেখে ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু এই ছলনারও দরকার। এককথায় কাজ, আর কাজের ভড়ং দুই-ই জানে ছেলেটি।

কাজ করে স্টার্ট দিয়ে এসে দাঁড়াল অসীম সাহেবের সামনে!

সাহেব জিজ্ঞেস করে, কত দেব?

খরিদ্দার গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর, ছোট সাহেবই তাকে তুলে দেয় দশ টাকার নোটখানা।

-–নাও, এটা তোমারই।

আমতা-আমতা করে অসীম, টাকার তারও দরকার। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এটা নিতে তার বাধে।

—স্যার!

হাসেন ছোট সাহেব!

—ডোন্ট ওরি! টেক্ ইট্‌।

সামনের সপ্তাহে আসলেই বাঁধা কাজ হয়ে যাবে অসীমের। প্রথমে মাইনে অবশ্য কমই। কিন্তু চালু-কারখানা, কাজ শিখতে পারলে পয়সার অভাব নেই এ-পথে। পায়ের তলায় যেন মাটি পায় অসীম।

দশ-টাকার নোটখানা তখনও পকেটে।

মনটা তাই খুশিতে ভরে রয়েছে অসীমের।

বাড়িতে পা-দিয়ে দেখে, বাসন্তী তখনও ঘুমোয়নি! ওরই জামা-কাপড়ে সাবান দিচ্ছে। ওকে ঢুকতে দেখে একটু মুখ তুলে চায় সে।

অজ্ঞাতেই ওর দু’চোখে হাসির আভা ফুটে উঠেছে।

জলে আর ঘামে ওর কচি মুখখানা কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে। বলে,

—এত সকাল-সকাল ফিরলে যে?

হাসে অসীম। বলে—এমনি।

কলতলা থেকে উঠে এসে দাঁড়াল বাসন্তী।

কাপড়-জামাগুলো তাদের জানলায় শুকোতে দিতে থাকে। সব কাজ চুকিয়ে এসে কাছে দাঁড়িয়ে দু’চোখে কি একটা সুর তুলে প্রশ্ন করে বাসন্তী,

—কাজকর্মের ঠিক হল কিছু?

অসীম মাথা নাড়ে, বলে,—হয়ে যাবে নিশ্চয় সামনের সপ্তাহে

—তাই হোক। বাসন্তী সারা মন দিয়ে তাই-ই কামনা করে।

অসীম বলে ওঠে,

—চলো, আজ দমকা কিছু রোজগার হয়েছে; সিনেমায় যাব।

সিনেমা দেখা বাসন্তীর কাছে যেন একটা স্বপ্নই।

কালে-ভদ্রে আর পাল-পরবে কখনও সিনেমায় গেছে এ পাড়ার মালতী না হয় কদম পিসির সঙ্গে! তাও কোনো ঠাকুর-দেবতার ছবি দেখতে, সেই দোতলার ঝুপসিতে-ঢালা বেঞ্চে; মেয়েদের কলরবের মধ্যে বসে, ছবি দেখা একটা স্বপ্নের ব্যাপার।

এ যেন অন্য কোন্ জগতের আমন্ত্রণ।

বাসন্তী আজ এই বিচিত্র কথাটি শোনে। সারা মনে কেমন একটা আলোড়ন জাগে। ওই দ্বিধা আর সংশয় কাটিয়ে কি যেন বলবার চেষ্টা করছে সে।

অসীম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বাসন্তীর মুখ-চোখে কেমন একটা মধুর আবেশ-জড়ানো সজল আভাস।

বলে ওঠে অসীম,

—নাও, কাপড় বদলে নাও।

বাসন্তী এই প্রথম কারো সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। বস্তির সকলেরই দু’চোখ, দুটো কান ছাড়াও আরও চোখ-কান আছে। কিন্তু সবকিছুকেই কেমন অগ্রাহ্য করবার দুঃসাহস পেয়েছে আজ সে।

নতুন একখানা শাড়ি পরে আজ বের হবে বাসন্তী।

অসীমই বলে ওঠে—বাবা ফেরবার আগেই ফিরে আসব কিন্তু!

বাসন্তী আজ জীবনের একটা মাধুর্যের সন্ধান পেয়েছে। রিক্ত, ব্যর্থ জীবনের দিনগুলোও আজ মিষ্টি বলে মনে হয় তার।

জীবনবাবু তিক্ত-বিরক্ত হয়ে ফিরছে।

সারাদিনে রোজগার তো কিছু হয়নি, উপরন্তু রাস্তার সেই অ্যাকসিডেন্টটা যেন তাকে চরম আঘাত দিয়েছে।

অসীম এবার তাকে বিপদে ফেলতে চায়, এটা বেশ বুঝেছে জীবনবাবু।

ইচ্ছে করেই কেমন এড়িয়ে চলে তাকে, আর মিথ্যে কথা বলে।

সেই ভোর-রাতে কথা দিয়েছিল, বাঁচতে সে চায় না। বাঁচবে না এই পোড়া পৃথিবীতে আর-একটা দিনও। শুধু আটকে ছিল তাকে জীবনবাবুই। ক’টা দিনের জন্য থেকে চলে যেতে বলেছিল।

কিন্তু এবার অসীম কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।

গরমে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে জীবনবাবু। কোনোমতে পা-দুটো তুলছে আর ফেলছে, এই করেই দেহটাকে টেনে নিয়ে চলেছে জন্মগত অভ্যাসের মতো জীবনের বোঝা বয়ে।

রাস্তা দিয়ে কয়েকটা মোষের গাড়ি চলেছে মালপত্র নিয়ে। রোদে আর পড়ন্ত বেলার গরমে ধুঁকছে জীবগুলো, জিভ বের হয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে, চলতে পারে না তারা। পিঠে পড়ছে গাড়োয়ানদের চাবুক।

কোনোমতে চোখ-বুজে এদিক-ওদিক করে মুখ-চোখ বাঁচায়, আর মার খায়; মার খেয়ে আবার প্রাণের দায়ে চলতে থাকে সেই ঢিলে-তালা চালে!

তার নিজের অবস্থা ওই গাড়িটানা মোষগুলোর মতোই; কোনোমতে জীবনের বোঝটাকে টেনে নিয়ে চলেছে জীবনবাবু।

খাল-পুল থেকে ঢালু রাস্তাটা নিচে নেমে সমতলে মিশেছে বাজারের কাছে, তার ওদিকেই বস্তিটা। বাড়ি ফিরে একটু স্নান করে যাহোক চাট্টি মুখে দিতে পারলে তবু খানিকটা সুস্থ হবে।

বৈকাল হয়ে সন্ধ্যার দিকে চলেছে বেলা।

গাছগাছালির মাথায় রং বদলেছে দিনের আলোর।

হঠাৎ বস্তির মুখে বটগাছের কাছে কাকে দেখে থমকে দাঁড়াল জীবনবাবু।

যেন সাক্ষাৎ যমদূতকে দেখছে।

লম্বা দশাসই চেহারা! পরনে আস্ত বিশগজি থানের একটা পায়জামা, কফ্‌হাতা পাঞ্জাবি, বিশাল উদরের উপর টিংটিং করে ঝুলছে জরির কাজকরা বিবর্ণ একটা ওয়াশ-কোট, মাথায় একটা পাগড়ি, হাতে বেঁটে-খাটো লাঠি।

খুদে খুদে চোখ-দুটো মেলে আগা সাহেব ক’দিন থেকেই জীবনবাবুর খোঁজ করছে এদিকে-ওদিকে।

সুদ মেটাবার দিন পার হয়ে গেছে আগেই। আগা সাহেব ক’দিন ধরে গোরু-খোঁজা খুঁজছে জীবনকে। আর জীবনবাবুও সাবধানে গা-বাঁচিয়ে ফিরছে এখানে-ওখানে।

বাজারের দিকে আর যায়ও নি ওর ভয়ে।

কিন্তু আগা সাহেব শকুনির চেয়েও সন্ধানী ব্যক্তি। যেমন তেমন করে খোঁজ-খবর নিয়ে আজ ঘাঁটি আগলে বসে আছে। চোখ-দুটো মাঝে মাঝে সার্চ-লাইটের মতো ঘুরছে চারিদিকে, যেন আসল আসামি পালিয়ে যাবার সুযোগ না পায়। বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে আগা সাহেব, ওর পথের দিকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

হঠাৎ অস্পষ্ট আওয়াজ ওঠে যেন হাঁড়ির ভিতর থেকে, খানদানি আগা সাহেব একেবারে নাদব্রহ্ম থেকে পুকার তুলেছে,

—অ্যাঁই দীবন ধোন, দীবন ধোন…

জীবনবাবুর পিতৃদেব জীবনের সঙ্গে চরম রসিকতা করে গেছে ওই জীবনধন নাম রেখে। জীবন ধন-সম্পদ কিছুই পায়নি। উপরন্তু ওই নামের চমৎকৃত্য আজ তার বুকে হৃৎকম্প আনে।

বেশ জানে জীবনবাবু, আগা সাহেব একবার তাকে ধরতে পারলে একবারে খালপোষ করে ছেড়ে দেবে। তাই ওই বজ্রনাদ শুনে জীবনবাবুর অন্তরের সুপ্ত শক্তি জেগে উঠেছে এবং ভর করেছে লিকলিকে ঠ্যাং দু’খানায়।

দৌড়োচ্ছে জীবনবাবু—একেবারে ম্যারাথন রেসই বলা যেতে পারে। প্রাণের দায়ে দৌড়োনো শুরু করেছে।

তার পিছুপিছু রাস্তায় নাল-বাঁধানো কাবুলি চপ্পলের খটখট্ আওয়াজ তুলে দৌড়োচ্ছে আগা সাহেবও।

প্রাইভেট বাস, লরি, রিকশা কিছুই না মেনে, সারাদিন অর্ধাশনে থাকার পরও জীবনবাবুর শরীরে যে এতখানি শক্তি অবশিষ্ট ছিল, তা নিজেই কল্পনা করতে পারে না সে।

তবু যেন ধরে ফেলবে এইবার আগা সাহেব, কানে আসছে ওর জুতোর শব্দ, আর বিজাতীয় সেই হুঙ্কার।

—অ্যাই দীবন—খত্রা দীবন—বদমাস দীবন, বাগতা হ্যায় কাহে, বদমাস?

সব রকম বিশেষণই প্রয়োগ করে চলেছে আগা সাহেব।

যত কাছে আসছে ততই সেই হুঙ্কার গুরুগম্ভীর হয়ে উঠছে।

বড় রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছে জীবনবাবু এবং অতর্কিতে গিয়ে পড়েছে আঁস্তাকুড়ে বিশ্রামরত একটি বারোয়ারি ষাঁড়ের উপর

জীবনবাবু হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় ওপাশের রাস্তায়। কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে আবার দৌড়োচ্ছে। বাধা পেয়ে ষণ্ড-মহারাজও বিরক্ত হয়ে বিশাল বপু নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়া দিচ্ছে।

জীবনবাবু গলি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে চলেছে ফাঁকা মাঠের দিকে—ওদিকে নতুন লেকের সীমানা। কোনো গাছগাছালির আড়ালে লুকিয়ে পড়বে সে।

আগা সাহেবও জীবনের পিছুপিছু গলিতে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ওঠে।

মিশকালো যণ্ড-মহারাজ ততক্ষণে চট্‌কা ছাড়িয়ে নধর শিং দুটি বাগিয়ে মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে, ভাঁটার মতো লাল চোখ তার ঘুরছে বনবনিয়ে—সামনেই পড়েছে সেই আগা সাহেব।

ষণ্ড-মহারাজ একবার মাথাটা কাত করে ঠেলে তুলেছে আগা সাহেবকে আশমানে এবং পরমুহূর্তেই নেহাৎ অবহেলা ভরেই তাকে ওপাশে ফেলে দিয়ে আবার হেলে-দুলে সে বাজারের ওদিকে চলে যায়।

আগা সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছে। বিশগজি থানের পায়জামা হাঁটুর কাছ থেকে ছিঁড়ে ঝুলছে ওপাশে। লাঠিটা ছিটকে পড়েছে নর্দমায়। বেশ লেগেছে তার সর্বাঙ্গে।

ওদিকে আসামিও পলাতক, উপরন্তু হাঁটু ছিঁড়ে রক্তারক্তি।

আগা সাহেবের চারিদিকে ভিড় জমে গেছে।

কোনো রকমে উঠে আগা সাহেব মনের রাগ-চেপে ঘরেই ফিরে গেল সেদিন। জীবনবাবুকে একদিন না একদিন সে ধরবেই, সেদিন সেও এমনি আছাড় মারবে তাকে নির্ঘাৎ।

জীবনবাবু ছুটতে ছুটতে এসে কোনো রকমে লেকের ধারে একটা ঝোপের আড়ালে বসে পড়েছে জেরবার হয়ে।

হাঁপাচ্ছে।—জিভ বার হয়ে আসবে যেন।

ধড়াস ধড়াস করছে তার বুক, যেন জীর্ণ খাঁচা ছেড়ে আত্মা এইবার বোধহয় মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে পঞ্চভূতে।

চোখের সামনে তখনও আগা সাহেবের সেই মার-মূর্তি ভেসে ওঠে। সারা গা-দিয়ে ঘাম ঝরছে, মাঝে মাঝে পিছনে তাকিয়ে দেখে জীবনবাবু। না, আগা সাহেবের পাত্তা নেই। বোধহয় আজকের মতো মামলা মুলতুবি রেখে ফিরে গেছে সে। ভয়ে-চিন্তায় জড়সড় হয়ে যায় জীবনবাবু।

লেকের এদিকে-ওদিকে বেড়াচ্ছে রঙিন শাড়ি পরে মেয়েরা; একা ওরা নেই। জোড়ে জোড়েই আছে। এ জগতের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক নেই। কারও কথাই ভাবে না ওরা। বেশ আছে!

হঠাৎ ওপাশে কার-হাসির শব্দে চমকে ওঠে জীবনবাবু।

গুনগুনিয়ে গান গাইছে কে যেন ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে জলের ধারে বসে। চেনা কণ্ঠস্বর।

ঝোপের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখেই চমকে ওঠে জীবনবাবু।

বাসন্তী আর অসীম খুব কাছাকাছি বসে আছে।

বাসন্তী গান গাইছে।

জীবনবাবুর শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠে যায়।

ওদের জন্যই আজ এত বিড়ম্বনা সয়ে চলেছে সে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাড়া-খাওয়া কুকুরের মতো। আর ওরা কিনা লেকের ধারে জোড়ে বেড়াতে এসেছে, গান গাইছে আনন্দে।

খুনই করে ফেলবে দুটোকে। ওই বাউন্ডুলে ছেলেটাকে দুধ-কলা খাইয়ে কালসাপ পুষেছে ঘরে। নিজেরই হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে জীবনবাবুর।

কিন্তু এখানে কেলেঙ্কারি করে কোনো লাভ নেই।

একবার মনে হয়, দেবে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ছোঁড়াটাকে লেকের জলে ফেলে, তাহলেই সব কাজ সিদ্ধ হবে।

পরক্ষণেই কিন্তু থেমে যায় জীবনবাবু। পুলিশের হাতে পড়বে। শেষ পর্যন্ত সব ভেস্তে যাবে ব্যাপারটা।

সাত-পাঁচ ভেবে আর এগোল না জীবনবাবু। তাছাড়া ঘরের ঢেঁকি নিজের মেয়ে ওই বাসন্তী, সে এতবড় শত্রুতা করে তার সঙ্গে!

এতদিনে বেশ বুঝেছে জীবনবাবু, ওই ছোঁড়াটা কেন আর মরতে চাইছে না। মরবে কেন? বসে-বসে খাবার পাচ্ছে—হাতখরচাও মিলছে, তার ওপর আমার সঙ্গীও জুটেছে—মনের মতো সঙ্গী।

ওদের সব সাধ এবার ঘুচিয়ে দেবে জীবনবাবু।

কি ভেবে চুপিচুপি বের হয়ে পিছন দিকেই সরে গেল জীবনবাবু। বের হয়ে আসছে লেকের ওদিক থেকে। আবছা অন্ধকার, গাঢ়তর হয়ে উঠেছে, এককালে এর চারপাশে বাগান বাড়ি ছিল।

আজ পাঁচিল ভেঙে পড়ছে, বাগান বাড়ির সেই স্ফূর্তির আবহাওয়া কোনদিকে মিলিয়ে গেছে। বাতাসে ওঠে চাপা একটু সুর।

সেই অতীতের স্বেচ্ছাচারিতার আভাস যেন আজও তাই এর আকাশ-বাতাস থেকে মুছে যায়নি।

অভাব আর দারিদ্র্য বেড়ে চলেছে। বঞ্চিত ব্যর্থ জীবনের সব শূন্যতাকে ওরা ক্ষণিক পাওয়ার সার্থকতায় ভরে তোলবার বৃথা চেষ্টা করে।

বিষপাত্রই অমৃত বলে তৃষিত কণ্ঠের সামনে তুলে ধরে।

কোনো রকমে নির্জন ও ছায়ান্ধকার পরিবেশ থেকে সদ্য গড়ে ওঠা শহর অঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসছে জীবনবাবু।

ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট-এর দৌলতে দিন বদলেছে এই অঞ্চলের।

বস্তির পর বস্তি ছিল এখানে। জমাট বস্তি যাকে বলে। সেইসব ভেঙে চুরে তছনছ করে শহর এগিয়ে আসছে। এমনি একটি জায়গাতে বাড়ি করতে চেয়েছিল জীবনবাবু।

করতে পারত সে একটি ছোট্ট রাড়ি, কিন্তু ভাগ্য বিগড়ে চলেছে। সেই বিগড়ানো কলকে সামলাবার চেষ্টা সে করবে আজ। তাই সব দেখেশুনে চমকে উঠেছে জীবনবাবু।

নিজের মেয়ের বিয়ে দেবে একটি ভালো ছেলের সঙ্গেই। চাকরি-বাকরি করে, লেখাপড়া জানে এমনি ছেলেকে জামাই করতে চায় সে।

আর এই বাউণ্ডুলে বেকার অসীমকে জামাই হিসাবে ভাবতে চায় না জীবনবাবু। দরকার হয় চরম পথই বেছে নেবে সে।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছে জীবনবাবু।

আফিমের মৌতাতের সময় এসে গেছে, একটু চা পেলে ভালো হতো। তখনও বুক কাঁপছে অজানা ভয়ে; সেই আগা সাহেব কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে হয়ত, কে জানে!

পরেশ আর কালীচরণের দলের নজর সবকিছু।

তাছাড়া গদাই সরকারের মন রাখা তাদের দরকার। আর এসব কাজে তারাও বেশ পাকাপোক্ত। তাই হাতকাটা কালীচরণ আজ বৈকালের কাণ্ডটা দেখে বেশ চমকে উঠেছে।

বস্তির অনেককেই চেনে তারা।

কে কী করে তার খবরও রাখে কিছু কিছু।

এখানে দু’চারজন মেয়ে বৈকালের দিকে সেজেগুজে বই হাতে বের হয়।

কেউ কেউ সত্যিই স্কুল-কলেজে পড়তে যায়।

আবার দু’চারজন আছে তারা বই হাতে নিয়েই বের হয় লোকের চোখকে ফাঁকি দেবার জন্যই। তাদের অনেককেই দেখেছে পরেশ।

শিয়ালদহ-চৌরঙ্গী অঞ্চলে একটু বেশি রাত্রিতেও।

এদের এসব পথেও আনাগোনা করতে হয় বাধ্য হয়েই।

কেউ কেউ আবার আজকালকার গজিয়ে ওঠা রেস্তোরাঁয় কাজ করে কোনোমতে খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে।

কিন্তু বাসন্তীকে তারা বিশেষ সেজেগুজে কারো সঙ্গে রাস্তায়-মাঠে ঘুরতে কোনোদিনই দেখেনি।

সেদিন পরেশ বৈকালের দিকে কলতলার ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। ওরই পাশ দিয়ে বস্তি থেকে বাইরে যাবার রাস্তাটুকু চলে গেছে। কালী ওপাশে পদার পান-বিড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাগ্‌না পাওয়া বিড়িটা জুত করে টানছে, আর দোকানের আয়নায় নিজের মাথাটা বাঁ হাতে ধরা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। ডান হাতটা যাবার পর থেকে বাঁ-হাতেই সব কাজ রপ্ত করে নিয়েছে সে।

হঠাৎ ছোট্ট গলিটা থেকে ওই পড়ন্ত রোদে বাসন্তীকে অসীমের সঙ্গে বের হয়ে আসতে দেখে চমকে ওঠে পরেশ।

ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চিনতে দেরি হয় না।

সেইদিনেই সেই ছেলেটিকে সঙ্গে চলেছে বাসন্তী বেশ সেজেগুজে, কি যেন কথায় দুজনে মশগুল।

পরেশ আর হাতকাটা কালীর ওদিকে তাকাবার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। তাদের এ পাড়া থেকে অনেকেই এমন ভাবে যায়।

কিন্তু বাসন্তীর এভাবে যাওয়ার একটা বিশেষ কোনো অর্থ আছে এদের কাছে।

কালীচরণ কি ভেবে মুখ দিয়ে জোর একটা আওয়াজ করতে গিয়েও থামল পরেশের ইশারায়।

পরেশ মাথা নাড়ে—বুঝলি, সরকার মশাই তালে ডুবল এবার।

হাতকাটা কালী ব্যাপারটা বোঝে না।

বলে-কেন রে?

পরেশ ওদের চলে যেতে দেখে বলে ওঠে ইংরাজিতে,

—ফলো কর ওদের। দেখ কোথায় যায়! আমি ফটিকের গ্যারেজে আছি। যা শিগগির।

কালীচরণ এসব ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত।

মাঝে মাঝে কোনো ভদ্রলোকের অগোচরে তার পকেটের অস্তিত্বটুকুও সে নিঃশেষ করে দিত নিখুঁত ভাবে। হাতটা যাবার পর থেকে ওটা ছাড়তে হয়েছে, কিন্তু অন্যসব কাজগুলো ঠিকই পারে।

বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে কারো পিছু নিতে তার বাধে না। চলে গেল কালীচরণ ওদের পিছু পিছু নিস্পৃহ নিরাসক্ত দর্শকের মতো।

গদাই সরকার জমা-খরচের হিসাব ভালোই জানে।

মবলক এরই মধ্যে এই ভালোবাসার খাতে কত অপব্যয় হয়েছে, তা তো জানেই। তাছাড়া মনে মনে একটা আশাও রয়েছে তার। জীবনবাবুকে যার জন্য সেদিন এককথায় বিনা-সুদে পঞ্চাশ টাকা ধার দিয়েছে, সেটা আর ফেরত পাবার আশাও করে না। বাড়িতেও নানা অশান্তি বেড়েই চলেছে, চলেছে জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে তুমুল পর্ব।

ক’দিন বাড়িতে যায়, দু’কানে ওই আগুন-জ্বালানো কথা শুনে চুপ করে দুমুঠো গিলেই চলে আসে কাছারি বাড়িতে।

এইখানেই একটা থাকার ব্যবস্থা করেছে গদাইচরণ।

নিচের তলায় লম্বা টানা বারান্দা। রায়বাবুদের কাছারি বাড়ির খাতা-ঘর মাঝখানে পুজোর চণ্ডীমণ্ডপ, নাটমন্দির; তাছাড়া চারিদিকে সারবন্দি ঘর। ওপাশের একটা ঘরে ফরাসের উপর একরাশ জাবেদা খাতা লাল খেরোতে বেঁধে বালিশের মতো করে মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে আছে গদাই সরকার, মনের মাঝে নানা চিন্তা মাথায় ঝড় তুলেছে।

আলাদা বাসাই করবে, দ্বিতীয় সংসারই গড়ে তুলবে গদাই সরকার। এসব ঝকমারি আর তার ভালো লাগে না।

বাসন্তীর কচি মুখখানা মনে পড়ে বারবার গদাইচরণের। একটা মিষ্টি স্বপ্নের মতো ভাবতেও ভালো লাগে।

হঠাৎ খুঁজে-খুঁজে পরেশকে এইখানে আসতে দেখে একটু অবাক হয় গদাই সরকার। বিশেষ কোনো খবর বা দরকার না থাকলে ওখানে আসে না পরেশ।

ওকে দেখে উঠে বসল সরকার মশাই।

পরেশ বেইমানি কি জিনিস জানে না। নুন খায় সে গদাই সরকারের। দায়ে অদায়ে সেই-ই তাদের রক্ষা করে। ও-টাকাপয়সা দেয় ওদের বিশেষ ধরনের কাজ করার জন্য।

আজ সব সঠিক খবর নিয়ে এসেছে ওরা।

গদাই সরকারও জানে, ওদের খবর একেবারে ঘোড়ার মুখের খবরের মতোই সত্যি।

—কিরে, কি ব্যাপার? বোস।

ফরাসের এককোণে বসে গলা নামিয়ে বলে ওঠে পরেশ,

—খবর ভালো নয় সরকার মশাই। ওই যে জীবনবুড়ো সতেরো নম্বরের—

সরকার মশাই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে!

—কেন? কি হয়েছে? বুড়ো টেঁসে গেল নাকি রে?

পরেশ বলে ওঠে,

—আজ্ঞে না, তা নয়। তবে ওই ছোঁড়াটা ছিল না ওর বাড়িতে—

—হ্যাঁ। ঢোক গিলছে সরকার মশাই।

কেমন যেন হাত-পা হিম হয়ে আসে তার। ছেলেটাকে দেখেছে সরকার মশাই। কে জানে, মেয়েটা ওর সঙ্গে উধাও হল কিনা

জীবনবাবুও তাকে আশা দিয়েছে একরকম। বাসন্তীও তার সঙ্গে হেসে কথাবার্তা বলে। সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু গোল বাধাল তাহলে ওই ছেলেটা, কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

গদাই সরকার এখানকার মুকুটহীন সম্রাট! সে কিনা পিছিয়ে আসবে ওই কালকের ছেলেটার কাছে হার মেনে? এ হতে পারে না, লোক হাসবে। হাল-সাকিম নেই, টিকে ধরবার জামিন নেই, এমনি একটা ছেলে টেক্কা দিয়ে যাবে গদাই সরকারকে! পরেশ সরকারমশাই-এর দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখছে ওর মুখচোখের ভাবান্তর।

এদিকে টাক ঘামছে, আর কালো মুখখানা তামাটে হয়ে গেছে; ঝুলে পড়েছে টিকলো খাঁড়ার মতো নাকটা। কপালে চিন্তার রেখা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

পরেশ হাল-ফিল খবর সব বলে চলেছে!

অবিশ্বাস আর রাগ-মেশানো স্বরে বিড়বিড় করছে গদাই সরকার। বলে,

—সিনেমায় গেছে দুজনে?

—তাই তো দেখলাম। দেখেই এসেছি আপনাকে খবর দিতে।

চটে ওঠে গদাই সরকার। টাকাকড়িও হাত পেতে নিয়ে গেল জীবনবাবু এই তো সেদিন। জিজ্ঞাসা করে গদাই সরকার,

—বুড়ো বাড়িতে আছে?

—আজ্ঞে না। পরেশ লক্ষ্মীছেলের মতো জবাব দেয়।

চুপ করে বসে কি ভাবছে গদাই সরকার। পরেশ ওকে দেখছে, ওর মনের জ্বালাও বুঝতে পারে। ওকে উসকে দিলেই লাভ, অন্তত হাতে কিছু মাল-কড়ি আসবে। তাছাড়া সরকার মশাইকে হাতে রাখতেই হবে তাদের।

তাই বলে ওঠে পরেশ একটু কণ্ঠস্বর নামিয়ে,

—এত ভাবছেন কি সরকার মশাই, কুলে-পাড়ার পরশা কি মরে গেছে স্যার? এখনও মরিনি। তা, বানে-ভাসা ওই একটা চ্যাংড়া এখানে এসে ফাট্ নিয়ে বেড়াবে। শুধু একবার তাকিয়ে দেখুন না, এইসান্ টাইট দিয়ে দোব না স্রেফ গন্ উইথ দি উইন্ড। দেখেছেন তো রায়টের সময় স্যার? পরেশ এগিয়ে এসে স্যারের তক্তপোশের নিচে বিষ্ণুভক্ত গরুড়ের মতো বসল, যেন হুকুমের অপেক্ষায়, গদাই সরকারে হাঁ-বলতে যতটুকু দেরি, তাহলেই বোধহয় এখুনি ঘটে যাবে সাংঘাতিক একটা কাণ্ড।

পরেশ তখন, গুনগুন করছে,

তবে স্যার, ওই যে বল্লাম, একটু খরচের ব্যাপার। আর জানেন তো—এসব জানে গদাই সরকার।

এমন কাজ দু’একবার করিয়েছেও ইতিমধ্যে। তাছাড়া টুকটাক কাজ তো লেগেই আছে। একে বাড়ি ছাড়া করো, ও-বস্তি ভেঙে মাঠ বানাতে হবে! জমি-চড়া দরে বিক্রি হবে, দাও বস্তিতে আগুন, না হয় হাঙ্গামা বাধাও, এসব কাজ আগে করিয়েছে গদাই সরকার বহুবার। করতেও

অভ্যস্ত সে।

একটা বাজে ছোঁড়াকে শায়েস্তা করে উৎখাত করতে তাকে বেগ পেতে হবে না। ওর মোক্ষম অস্ত্র সময়মতো দরকার হলে ছাড়বে।

তার আগে ব্যাপারটা একটু নিজের চোখেই দেখতে চায় সে। তাই পরেশকে বলে ওঠে,

—ওসব এখন থাক পরশা।

পরেশ বলে চলেছে নীরসকণ্ঠে,

—কথাটা আমার মনে হয়েছে, তাই বলে গেলাম সরকার মশাই। ওসব কাঁটা তুলে ফেলাই ভালো। যাক্ স্যার, পরে দোষ দেবেন না কিন্তু।

গদাই সরকার ফতুয়ার পকেট থেকে ক’টা টাকা বের করে ওর হাতে দিতেই পরেশ একটু ঠাণ্ডা হয়। গলার সুর নামিয়ে বলে,

—দেখুন, বুঝে-সুঝে ডাকলেই আসব।

গদাই সরকার তাই ভাবছে।

বলে ওঠে—হ্যাঁ, পরে দেখা করিস্। আজ সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে থাকবি তো তোরা?

—হ্যাঁ!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *