জীবনের মোড়
জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় আসে, যখন আমরা উপলব্ধি করি কিছু সত্য, যা আমাদের জীবনকে বদলে দেয়। এসব উপলব্ধি আমাদের চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে সম্পর্কের গভীরতাকেও নতুনভাবে দেখতে শেখায়।
এই পরিবর্তনের বয়সে মানুষ তার ভেতরে শান্তি খুঁজে পায়, বাইরের জগতের অস্থিরতাকে এড়িয়ে এক নতুন বোধের জন্ম দেয়। গল্পের মতো এই উপলব্ধির ভেতর দিয়ে যাওয়া আসলে জীবনের গভীর শিক্ষা গ্রহণের সমান।
একবার সায়ন অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছিল। কথার মাঝখানে একজন বলে বসলেন, “পৃথিবী আসলে লম্বা, গোল নয়।” সায়ন প্রথমে প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। তিনি হেসে বললেন, “তোমার কথাটা বেশ মজার।”
বেশ কিছুদিন ধরে সায়নের ভেতরে একটা বদল এসেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, অকারণ তর্কে জড়ানোর চেয়ে হেসে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তর্ক করে কখনোই কারো চিন্তাভাবনা বদলানো যায় না। বরং এতে নিজেই অস্থির হয়ে পড়া ছাড়া কোনো লাভ হয় না।
এই উপলব্ধি সায়নকে অনেক শান্তি দিয়েছে। তিনি শিখে গেছেন, সবকিছুকে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক করার দায় নেই। প্রত্যেকে তাদের মতো করে ভাবতে পারে।
মেঘলা সবসময়ই ভাবতেন, তার স্বামী তাকে ঠিকমতো বোঝেন না। প্রতিদিন ছোটখাটো বিষয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হতো। একদিন মেঘলার মা তাকে বললেন, “তুমি যদি মনে করো সবাই তোমার মতো করে ভাববে, তাহলে তুমি সারাজীবনই কষ্ট পাবে। প্রত্যেকে তার নিজস্ব বিচারবোধ নিয়ে চলে।”
মায়ের এই কথাটি মেঘলা আগে বুঝতে পারেননি। তবে ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন, প্রত্যাশার ভার কমালে সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে যায়। স্বামীর প্রতি তার ক্ষোভ কমে গেল, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন যে মানুষ নিজস্ব উপায়েই ভালোবাসা প্রকাশ করে।
কিছু মানুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভালো হতে চায়। কিন্তু একসময় তারা বুঝতে পারে, এই বাড়তি ভালোবাসা বা ত্যাগের মূল্য অনেকেই দিতে জানে না।
রূপম তার বন্ধু অনির্বাণের জন্য সবসময় নিজের সাধ্যমতো করতেন। কিন্তু একদিন, যখন রূপম বিপদে পড়লেন, অনির্বাণ তাকে সাহায্য করল না। রূপম ভীষণ আহত হয়েছিলেন। পরে তিনি উপলব্ধি করলেন, অতিরিক্ত ভালো হতে গিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অর্থহীন।
তিনি শিখলেন, নিজের শান্তি বজায় রেখে যতটুকু করা সম্ভব, সেটাই করা উচিত। অতিরিক্ত কিছু করার দরকার নেই।
একটা বয়সে মানুষ শিখে নেয়, বাইরের জগতের মতামত তার জীবনের উপর আর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। কে কী বলল, কে কী ভাবল, তা নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে নিজের মনের শান্তি ধরে রাখাই আসল।
অনন্যা এই বয়সে পৌঁছে বুঝতে পেরেছিলেন, প্রত্যেক মানুষ নিজের ব্যক্তিত্ব এবং অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করে। অন্যের সমালোচনা তার ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে, তাকে নয়। এই উপলব্ধি অনন্যাকে আরও নিরাসক্ত করেছে।
মানুষের জীবনেও এমন সময় আসে, যখন একাকিত্ব তাকে আহত না করে বরং শান্তি এনে দেয়। চারপাশের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও, নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে শিখে যায়।
সুমিত্রা একসময় বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া বাঁচতেই পারতেন না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে সময় দিতে শুরু করলেন। প্রথমে একাকিত্ব যন্ত্রণাদায়ক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন যে নিজের সঙ্গই সবচেয়ে মধুর।
এই বয়সে মানুষ বাইরের কোলাহল এড়িয়ে নিজের ভেতরে ডুব দেয়। উৎসব, আড্ডা, বা জমায়েতের চেয়ে নিজের সঙ্গ তখন অনেক বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে।
অর্ঘ্য প্রতিদিন সকালে বাগানে বসে কিছু সময় একা থাকেন। এই সময়টা তিনি নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। বাইরের জগতের কোনো ঘটনা বা মানুষের মতামত তাকে আর প্রভাবিত করে না।
জীবনের প্রতিটি ধাপই আমাদের জন্য নতুন শিক্ষা নিয়ে আসে। তবে একটা বয়সে এসে আমরা উপলব্ধি করি, আসল সুখ আর শান্তি বাইরের জগতে নয়, আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে। নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজে পাওয়া এবং নিজের সঙ্গে ভালো থাকা— এটাই তখন জীবনের আসল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
এই বয়সে মানুষ বুঝে যায়, সম্পর্কের জটিলতা বা তর্কের অস্থিরতা তার জীবনের সীমানা নয়। বরং নিজের মনের মুক্তিই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।