জিজ্ঞাসা (চতুর্থ ভাগ)
সায়ন্তন এসেছিল প্রায় মাস দুয়েক পরে। একাই এসেছিল সে।
মলিনা দেবী ছেলের কাছে জানতে চায়: কিরে? বৌমা আর দাদাভাইকে আনলি না সাথে করে? কত বছর বাদে এলি মনে আছে তোর?
সায়ন্তন উত্তর দেয়: না মনে নেই। আর মনে করতেও চাই না মা। বাবা তো আমাদের এই পরিবারের কোনোদিন মনেই করেনি। আর সত্যি বলতে তোমার বৌমা এখানে আসতেও চায় না। যাক্ বাদ দাও এসব কথা। তোমার শরীর এখন কেমন আছে?
ওদের কথার মাঝখানে মায়া এসে বলে: মামু তোমার চা। খাবার বসিয়ে দিয়েছি একটু পরেই দিয়ে যাচ্ছি।
মায়াকে দেখে সায়ন্তন যেনো নিজের এতবছরের সব রাগ উগ্রে দিল: মা, এই মেয়েটা আমার সামনে কেনো এসেছে? এই মেয়েটার জন্য আমি আমার বাড়ি শহর সব ছাড়তে বাধ্য হয়েছি এই মেয়েটার জন্য বাবা কোনোদিন তার ছেলে বউ নাতি কাউকে নিজের বলে মনেই করলো না। আর এখন এসেছে আমাকে চা খাওয়াতে? চলে যাও আমার সামনে থেকে। জন্মে মা বাবাকে খেয়েছে, এখন আমার বাবাকে খেলো। এই মেয়ে শোনো তুমি আমার সামনে একদম আসবে না, তোমার কালো ছায়া যার উপরে পড়বে তারা কেউ ভালো থাকবে না। চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। বলে চায়ের কাপ ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয় সায়ন্তন।
থাম থাম, বাবু এসব তুই কি বলছিস? ওরে একটা বাপ মা মরা মেয়ে ওর কি দোষ বাবু ওকে বলিস না ওভাবে। ও তোর সামনে আর কোনোদিন আসবে না। বলে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মলিনা দেবী।
আমি নিজেই আর এখানে একদন্ড থাকতে চাই না। শুধু কোলকাতায় কাজে এসে তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করেছিল। আমি ভুলে গেছিলাম আমার বাবা মা আমার কোনোদিন ছিলই না। আমি আসছি।
তুমি যেও না মামু, তুমি যেও না আমি আর কোনোদিন আসবো না তোমার সামনে। বলে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে সরে যায় মায়া।
আমি আসছি মা। সাবধানে আর তোমার মেয়েকে নিয়ে ভালো থেকো। তোমার ছেলে আজ থেকে মৃত এটাই যেনো।
এভাবে বলিস না বাবু এভাবে বলিস না। বাবা তো হয়েছিস এটাও কি বুঝিস না সন্তানের জ্বালা বড় জ্বালারে? যাস না বাবু একটা রাত অন্তত থাক আমার কাছে। হাত ধরে সায়ন্তন কে আটকাতে চায় মলিনা দেবী। কিন্তু সায়ন্তন মায়ের কোনো কথাতেই কর্ণপাত করে না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে যায় সে।
ছেলে চলে যাবার বেশ কিছুক্ষন পর ও মায়াকে দেখতে না পেয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মলিনা দেবী মায়ার ঘরে যায়। মায়াকে তার বিছানায় শুয়ে কাঁদতে দেখে মলিনা দেবী বলে: কাঁদিস মা, ও একটু এমনই বড্ডো রকচটা তুই ওর কথায় কষ্ট পাস না।
মায়া তার মার দিকে তাঁকিয়ে বলে: না মা আমি আমার জন্য কাঁদছি না। মামাতো ঠিকই বলেছে যে মেয়ে জন্মাতে না জন্মাতেই মা বাবাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে হয় তাকে তো এগুলোই বলে মা। আমিতো কাদঁছি তোমার জন্য আমার জন্য তুমি, বাবা কেউ মামুর সাথে সম্পর্ক রাখতে পারলে না। মামুর তো তোমাদের উপর কোনো রাগ নেই। শুধু আমার উপর রাগে মামু তোমাদের সাথেও কোনো সম্পর্ক রাখলো না।
তুই থাম্, এসব বলিস না মা রে। তুই তোর বাবার কি ছিলি তা কি তুই জানিস না? এগুলো বলে ওকে কষ্ট দিস না। তোকে কষ্ট পেতে দেখলে ও যে ভালো থাকবে না। মায়া আর মলিনা দেবী দুজন দুজনকে ধরে কাঁদতে থাকে।
এরপর ভালো মন্দে কেটে যায় মাস ছয়। আজকাল মলিনা দেবীর শরীর ও ভালো যায় না। স্বামী মারা যাবার পর বড্ডো একা হয়ে পড়েছে সে। মায়া তার পড়াশুনা টিউশন এসব নিয়ে অনেকটাই ব্যাস্ত। তারমধ্যে ও সে সবসময় মায়ের খেয়াল রাখে মার কখন কি লাগবে কখন কি খাবে খুঁটিনাটি সব বিষয় তার নখদর্পণে থাকে। মায়ার চিন্তা আজকাল মলিনা দেবীকে বড্ডো ভাবায়। সে না থাকলে কি হবে মায়ার সমত্ত মেয়ে সে। এগুলো ভেবে আজকাল মলিনা দেবী প্রায়শই খুব অস্থির হয়ে পড়ে।
মুখার্জী গিন্নীরা কয়েকটা দিনের জন্য একটু বাইরে গেছিলেন কোনো এক আত্তিয়ের ছেলের বিয়ে তাই যেতেই হয়েছিল ওদের। এসেই বিকেলে দেখা করতে আসে মলিনা দেবীর সাথে। এসে সব জানতে পারে সায়ন্তনের আসার কথা সবই শুনলো যা ঘটেছিল।
মুখার্জী গিন্নী খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন: কি আর করবে? বাবুর ওই একরত্তি মেয়েটাকে নিয়ে কি সমস্যা যে শুরু থেকেই ছিল জানি না। তবে আমার মনে হয় মায়ার এখন একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা উচিত বয়স তো আমাদের সবারই হচ্ছে। বাকি পড়াশুনা যা করার বিয়ের পর করবে আজকাল তো সব মেয়েরাই করে। একটা ভালো ছেলে দেখে ওর একটা ব্যাবস্থা করে দিতে পারলে তুমিও একটু নিশ্চিন্ত হতে পারো।
এটা আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন। আমিও এই কথাটাই ভাবছিলাম। কিন্তু তেমন পাত্র পাবো কোথায় যে আমার মা বাপ মরা মেয়েটাকে নিজের থেকেও বেশি আগলে রাখবে? তুমি চিন্তা করো না । আমি ঘরে গিয়ে কথা বলছি, তুমি মায়াকে বুঝিয়ে বলো আগে, ওর এটা মনে না হয় তুমি বাবুর জন্য ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছো। এখন আমি আসি তাহলে, তুমি চিন্তা করো না আমরা সবসময় তোমার পাশে আছি।
সেতো আমি জানি দিদি আপনারা পাশে না থাকলে সব কিছু এমন করে গুছিয়ে উঠতে কি পারতাম? কিছু বলেই কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই।
এভাবে বলো না বড় পর পর শোনায়। আসি এখন আমি।
পরেরদিন রবিবার মায়ার কোথাও বেরোনোর তাড়া নেই। সেদিন একটু বেলা করেই ও ওঠে ঘুম থেকে। তারপর সকালে খাওয়ার টেবিলে মলিনা দেবী বলে: মায়া! মায়া উত্তর দেয়: হ্যাঁ মা বলো!!!! দেখ মা কতগুলো কথা বলি তোকে তুই কিন্তু আমাকে ভুল বুঝিস না মা। মায়ার যেনো মুখ থেকে কথা সরতে চাইলো না, তাহলে কি মা মামুর কথাতেই রাজি হয়ে গেলো? আর হবে নাই বা কেনো? একটা ছেলে আর কতদিন দূরে সরিয়ে রাখবে আর এখন বাবা ও নেই মার বয়স হয়েছে এখনতো ছেলের কথা মনে হতেই পারে মার।
কিরে মা? উত্তর দিলি না যে চুপ করে কেনো আছিস? মায়া আস্তে করে উত্তর দেয়: না মা ভুল কেনো বুঝবো? তুমি বলো না।
মলিনা দেবী বলতে শুরু করেন: দেখ মা তোর বাবা আমাদের হঠাৎ করেই ছেড়ে চলে গেলেন, এর জন্য তো আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না হয়তো সেটা কেউই থাকে ও না। কিন্তু আমার বয়স হচ্ছে আজ এটা কাল ওটা নিজেকে নিয়েও আর যেনো ভরসা পাচ্ছি না। মুখার্জী গিন্নী বলছিলেন এবার তোর একটা বিয়ের জন্য। আমার নিজের ও তাই মত। তোকে একটা দেখে রাখার লোক আছে দেখে যেতে পারলে আমার মরতেও ভয় নেই।
মায়া যেনো এতক্ষনে বুকে একটু জল পেলো এতক্ষন কতকিছু কথা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবীটাই যেনো ওর কাছে অচেনা।
মায়া উত্তর করে এসব তুমি কি বলছো মা? আমার বিয়ে হলে তোমাকে কে দেখবে? এই এতো বড় ফ্ল্যাটে তোমাকে কার ভরসায় ছেড়ে যাবো আমি? বাবা আমাকে যে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। না না তুমি এসব খেয়াল মাথা থেকে সরাও আমি তোমাদের ছেড়ে আমার এই বাড়িটা ছেড়ে কোথাও যাবো না কোথাও গিয়ে ভালো থাকতে পারবো না। না, মা তুমি চিন্তা করো না আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
কিন্তু সবাই মিলে বুঝিয়ে বলতে একপ্রকার নিম রাজি হয় মায়া। সেই মতো পেপার ও দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন। অনেক যোগাযোগ আসলেও কাউকেই খুব একটা পছন্দ হয় না মলিনা দেবীর। মায়ার পাত্র দেখা বলে কথা যার তার হাতে তো এমন সোনার প্রতিমা তুলে দেওয়া যায় না। অবশেষে ফ্ল্যাটেরই একজন বাসিন্দা তার খুড়তুতো ভাইরের ছেলের জন্য সম্মন্ধ নিয়ে আসে মলিনা দেবীর কাছে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে মায়াকে!!!!!! লম্বা ফর্সা সুঠাম দেহের অধিকারী মৃন্ময় চাকরি ও করে বড় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সংসারে মানুষ বলতে মা বাবা আর ছেলে। ওদের ও মায়াকে দেখে খুব পছন্দ হয়। সবকিছু দেখাশুনার পর মুখার্জী গিন্নী ও তার ছেলে মলিনা দেবীকে বলে আমাদের মায়ার জন্য একদম উপযুক্ত পাত্র , মুখার্জী গিন্নী বলে: তুমি আর না করো না এখানেই রাজি হয়ে যাও। ওদের মায়াকে
আরো পড়াশুনা করাতে ও কোনো আপত্তি নেই আর খুব বেশি দূরে ও না। মায়া সবসময় তোমার কাছে যাতায়াত করতে পারবে সহজে আর তাছাড়া এমন ছিমছাম সংসার।
শুরু হলো মায়ার সংসার জীবন বা বলা যেতে পারে ধ্বংসের জীবন।
শুভ দিনক্ষণ দেখে পাকা হয়ে গেলো মাত্র আঠারো বয়সি মায়ার বিয়ে। বিয়ের তোড়জোড় বেশ ভালো ভাবেই চলছে মুখার্জী গিন্নী ওনার ছেলে খুব সাহায্য করছে ওদের। বিয়ে বাড়ি ভাড়া খাবার দাওয়ারের আয়োজন সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে মুখার্জী গিন্নীর ছেলে।
একদিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ করেই মায়ার হবু শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসে হাজির মায়ার কি সব গয়নার মাপ নিতে হবে। মায়া সেইসময় টিউশন পড়াতে গিয়েছিল তাই কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ওদের আর তাই মৃন্ময়ের মা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বুঝতে পেরে মলিনা দেবী ওদের বলেন: আসলে আমাদের তো ঠিক জানা ছিলো না তাই ও পড়াতে চলে গেছে আসলে সামনেই সব পরীক্ষা তো তাই আর কি। আমি ফোন করে দিয়েছি সেখানে এখুনি চলে আসবে। মুখার্জী গিন্নীও ছিল ওদের চা বিকেলের জল খাবার দিতে মলিনা দেবীকে সাহায্য করার জন্য। এরমধ্যে মায়াও চলে আসায় ওদের কাজ ওরা করে নেয়। কাজ হয়ে গেলে ওরা মলিনা দেবীকে বলে: আজ তাহলে উঠি আমরা। আপনারা বিয়ের আগে আসবেন একবার। এখন তো আত্মীয়তা হয়েই গেছে যাতায়াত তো করতেই হবে। মায়ার শ্বাশুড়ী মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে: ” আমার ছেলে আবার আজকালকার ছেলেদের মতো একদমই নয়, তাই তোমাদের আর বিয়ের আগে দেখাসাক্ষাৎ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই”। বুজলেন দিদি এতো বড় হয়ে গেছে তাও মা বাবা যা বলবে তার উপর রা টুকু কাটে না আমার ছেলে নিজের ছেলে বলে বলছি না এমন ছেলে আজকালকার দিনে হাতে প্রদীপ নিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। সে যাই হোক আজ তাহলে উঠি। সাবধানে থেকো মা। বলে সেদিনের মতো বিদায় নেয় মায়ার হবু শ্বশুর শ্বাশুড়ি।
ওরা চলে যাবার পর মিলনা দেবী মায়াকে বলে: যা মা তুই গিয়ে এবার একটু ফ্রেশ হয়ে আয় যা। মায়া চলে গেলে মলিনা দেবী মুখার্জী গিন্নিকে বলে: দিদি মা মরা মেয়েটা আমার এখানে সুখী হবে তো? মহিলার এতো ট্যাকোস ট্যাকোস কথা খুব সহজ সাধা বলে মনে তো হচ্ছে না। মুখার্জী গিন্নী উত্তর দেয়: হ্যাঁ সে তুমি ঠিকই বলেছ, তবে কি শাশুড়িরা একটু এমনই হয় মায়া আমাদের বড় ভালো মেয়ে ও নিজের গুনে সবাইকে ঠিক আপন করে নেবে তুমি চিন্তা করো না সব ভালো হবে। তোমার জামাই ও তো কম ভালো মানুষ ছিল না তার মেয়ে সুখীই হবে তুমি ওতো চিন্তা করো না তো।
চিন্তা কি আর সাধে হয় দিদি? কতই বা বয়স মেয়েটার একেতে এত কাঁচা বয়স সংসারের মারপ্যাঁচে কতো টুকুই বা বোঝে ও ওর দাদু এখন থাকলে কিছুতেই ওর বিয়ে দিতেন না। একদম অসহায় করে চলে গেলো মানুষটা আমাকে।
তুমি এতো চিন্তা করো না বাবুর মা। দেখো, মায়া আমাদের খুব সুখী হবে ওর মতো ভালো মেয়ে
আজকাল কটা হয় বলতো? উত্তর দেয় মুখার্জী গিন্নী। কিন্তু আমি ভাবছি একটা অন্য কথা!!! কি কথা গো দিদি? জানতে চায় মলিনা দেবী। কথাটা অন্য কিছু না কিন্তু তুমি কি সায়ন্তনকে জানাবে এই বিয়ের ব্যাপারে?
না না দিদি ওকে কিছু জানানোর দরকার নেই, ও এই ব্যাপারে কিছু শুনতেও চাইবে না। মাঝখান থেকে মেয়েটাকে আবার কিছু বাজে কথা শোনাবে।
না না ওকে কিছু জানাতে হবে না।তোমরা তো আছো আমার ওতেই হবে গো দিদি।
বেশ বেশ যা তুমি ঠিক বোঝো সম্মত্তি জানায় মুখার্জী গিন্নী।
অবশেষে শুভদিনে চার হাত এক হয়। সমস্ত কাজ বেশ নির্বিঘ্নেই শেষ হয়। মলিনা দেবী নিজের সাধ্য মতো সব কিছু দিয়ে তার একমাত্র অবলম্বনকে গুছিয়ে দেবার চেষ্টা করে। অবশ্য মৃন্ময়দের বাড়ি থেকে কিছু দাবি দাওয়া ছিল না শুধু বলা হয়েছিল বরযাত্রী যারা আসবে তাদের অ্যাপায়নে যেনো কোনো ত্রুটি না থাকে। বিয়ের কাজ সব ভালোভাবেই মিটে গেছে। অবশেষে বিদায় বেলায় ও উপস্থিত। মলিনা দেবীর আর মায়ার চোখের জল যেনো বাঁধ মানছে না। দুজনের কেউ যেনো স্থির থাকতে পারছে না। সেই দুবছর বয়সে নিয়ে এসেছিল তারপর থেকে আর একদিনের জন্য কোনোদিন কাছ ছাড়া করেনি কেউ কাউকে এক মাত্র ছেলে শুধু এই কারণে বাবা মা সাথে সম্পর্কটা পর্যন্ত রাখলো না কিন্তু তাতেও তাঁদের দুজনার সিদ্ধান্তের কোনো বদল হয়নি। আজ সেই মেয়ে বরাবরের জন্য পরের ঘরে চলে যাচ্ছে কেমন থাকবে সে কেমন হবে তার নতুন ঘর সব চিন্তা যেনো মলিনা দেবীকে অস্থির করে তুলেছিল। মৃন্ময়ের হাতদুটো ধরে মলিনা দেবী তাকে বলেছিল: ” আমার সব থেকে দামি আর প্রিয় মানুষটাকে আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম, তুমি ওকে একটু দেখে রেখো ওর অযন্ত হতে দিয়ো না কখনো। অপর দিকে মায়া ও মুখার্জী গিন্নীর হাত ধরে বার বার শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো আমার মাকে একটু দেখে রেখো তোমরা। মাকে দেখে রাখার যে কেউ রইলো না।
বিয়ের পর মাস দুয়েক কেটে গেছে মায়া তার নিজের সংসারে ভালোমন্দ মিশিয়ে আছে। মৃন্ময় মায়ার সব কিছু খেয়াল রাখলেও মা বা বাবার ভুল কথার কোনো প্রতিবাদ সে করে না। মায়া কিছু বললে সে একটা কথাই বলে: বাবা মা আমাদের গুরুজন তারা যা করছে বা বলছে সেটা তাদেরই ভালো জন্য। মায়া যেনো এগুলো নিয়ে বেশি চিন্তা না করে আর সব মেয়েকেই একদিন না একদিন শশুর ঘরে আসতে হয় সংসার করতে সব মেয়ের বাবা মাকেই একদিন একা হতে হয় সেটা নিয়ে এতো উতলা হবার কিছু নেই। মায়া যেনো কলেজ বা পড়া ফেরত তার মার সাথে দেখা করে আসে মা যখন চাইছে না তখন সেখানে গিয়ে এখন থাকবার দরকার নেই।
সেদিন সকাল থেকেই মার জন্য মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে মায়ার, কাউকে কিছু না জানিয়েই সে মনে মনে স্থির করে আজ আর কলেজের পর সে কোথাও যাবে না সোজা যাবে মার কাছে মাকে দেখতে। সকাল থেকে উঠে সংসারের সব কাজ সামলে মৃন্ময়ের অফিস বেরোনোর সব গুছিয়ে রেখে সে তাড়াতাড়ি কলেজ এর জন্য বেরিয়ে পড়ে। আর ক্লাস শেষ হতেই সোজা চলে যায় তার মার কাছে।
মায়াকে দেখে মলিনা দেবী খুব খুশি!!!! ” কতদিন বাদে এলি মা তুই , বর পেয়ে বুঝি আর মার কথা মনে পড়ে না তোর?” কপট রাগ দেখায় মলিনা দেবী।
এভাবে বলো না মা , পৃথিবীতে এমন কেউ নেই কোনো সুখ নেই যেটা পেলে আমি আমার অস্থিত্ব আমার বাবা মাকে ভুলে যেতে পারি। একটু দেরী হলেই ওর মা এতো রাগারাগি করে আর ওকে বলতে গেলেও বলে বাবা মা আমাদের ভালোর জন্যই বলে । বলে চুপ করে যায় মায়া।
মায়াকে চুপ থাকতে দেখে মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মলিনা দেবী বলে: ঠিকই তো বলেছে মৃন্ময়। তোকে নিয়ে চিন্তা করে বলেই না বকাবকি করে? চুপ করে থাকে মায়া।
——— কিন্তু মা তুমি নিজের একি হাল করেছো মুখ চোখের একি অবস্থা তোমার? ওষুধপত্র ঠিকঠাক করে খাচ্ছো না তাই না? বলেই সে ওষুধের বাক্সো আনতে চলে গেলো।
মায়া শোন মা শোন আমি একদম সুস্থ আছি রে কতদিন বাদে এলি একটু আমার কাছে বস না মা।
মায়া!!!! একি মা তুমি তো দেখছি ওষুধ খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছ। দাঁড়াও তোমার সাথে কথা পড়ে বলছি আগে আমি ডাক্তার কাকুকে একটা ফোন করি। তোমার চোখ মুখ দেখেই আমি বুঝেছি।
হ্যালো, ডাক্তার কাকু আমি মায়া বলছিলাম।।
ফোনের ওপার থেকে ডাক্তার বাবু উত্তর দেন: হ্যাঁ বল। ডাক্তার সান্যাল ওদের হাউস ফিজিশিয়ান সুতরাং মায়াকে চিন্তে তার কোনো অসুবিধা হয়নি।
ডাক্তার কাকু মাকে আজকেই এখুনি একবার দেখাতে চাই। আমি মাকে নিয়ে আসছি তোমার চেম্বারে।
ফোনের ওপর থেকে ডাক্তার বাবু উত্তর দেয়: কিন্তু আমি তো আজ চেম্বারে নেই। আমি একটা কনফারেন্সে দুর্গাপুর এসেছি ফিরতে অনেকটাই রাত হবে। তুই বরং এক কাজ কর কাল সকালে মাকে নিয়ে ১০টার মধ্যে আমার চেম্বার আয় তারপর আমার আবার একটা অপারেশন আছে বুজলি? দেরী করিস না কিন্তু। By the way? কোনো সিরিয়াস কিছু নাতো? তাহলে আমি অন্য ডাক্তার সাজেস্ট করে দিচ্ছি?
না না কাকু সিরিয়াস না কিন্তু আমি আজ এসে দেখছি মা ওষুধ খাওয়া প্রায় বন্ধ করে বসে আছে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে মাকে। তাই একটু চেকআপ করিয়ে নিতে চাইছিলাম। ঠিক আছে কাকু আমি কাল সকালেই মাকে নিয়ে যাচ্ছি তোমার চেম্বারে তাহলে এখন রাখি? বলে ফোন কেটে দিয়ে মৃন্ময়কে ফোন করে মায়া।
” হ্যালো মৃন্ময় আমি মায়া, বলছি শোনো না মার শরীরটা ভালো নেই ডাক্তার আংকেলকে ও ফোন করেছিলাম উনি আজকে আউট অফ স্টেশন কাল সকাল সকাল নিয়ে যেতে বলেছে নাহলে উনি আর সময় দিতে পারবেন না ওনার আবার অপারেশন আছে। তাই বলছিলাম যে আজ রাতটা আমি মার কাছেই থাকবো কাল সকালে মাকে ডক্টর দেখিয়ে তারপর বাড়ি যাবো। তুমি প্লীজ একটু ম্যানেজ করে নাও”।
ফোনের ওপার থেকে মৃন্ময় বলে: আমি চেষ্টা করবো তুমি তো মাকে জানো নিয়মের ব্যাপারে মা করো কথা শোনে না। তাছাড়া ডাক্তার দেখানোর এতো কি তাড়া ছিল? আমি চেষ্টা করবো এখন রাখছি ফোন। বলে ফোন কেটে দেয় মৃন্ময়। মায়া বুঝতে পারে কাল বাড়ি ফিরলে তার খবর আছে। সে দেখা যাবে যা হয় হবে আগে মাকে তো সুস্থ করি। এমনিই সব করেও কতো কিছুই শোনাচ্ছে। না হয় আরো একটু বেশি বলবে সে বলুক গিয়ে।
মায়াকে চুপ করে ভাবতে দেখে মলিনা দেবী প্রশ্ন করে: কি রে? কি বললো মৃন্ময়, রাগারাগি করছে নাকি? তুই বাড়ি যা তাহলে আমি ভালো আছি তুই চিন্তা করিস না।
উফ্ফ্ , মা ও সে সব কিছুই বলেনি। ও বললো আমি যেনো আজকের দিনটা ভালো করে তোমার খেয়াল রাখি আর কালকে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর ফিরি ও ওদিকটা ম্যানেজ করে নেবে।
দাঁড়াও এবার আগে আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর দুজন মিলে জমিয়ে একসাথে চা খাবো। তুমি কিন্তু চা বসাবে না । কতদিন বাদে তোমার সাথে বসে চা খাবো এতো আনন্দ হচ্ছে আমার আজ কিন্তু রাতে আমি তোমায় জড়িয়ে ঘুমাবো।দাঁড়াও আগে আমি ফ্রেশ হই। মায়ার ছেলে মানুষি আনন্দের পিছনে কোথাও যেনো একটা যন্ত্রনার সুর উপলব্ধি করতে পারলো মলিনা দেবী। মা তো জন্ম না দিক কোলে পিঠে করে সব ঝড়ঝাপটা সহ্য করে সেইতো মেয়েটাকে এতো বড়টা করলো। তার সেই এক রত্তি মেয়ে আজ নিজের সব কষ্টগুলো লোকাতে শিখে গেছে। অব্যশ সেটা সে বরাবরই জানত।
চোখে জল এক কঠিন বাস্তব