জলছবি
রাত বারোটা । দেওয়ালের ঘড়ি সুরেলা আওয়াজে জানিয়ে দিল । ঋতুপর্ণার তন্দ্রার মতো লেগে গিয়েছিল । কিন্ত ঘুমটা গাঢ় হয়নি । বাইরে কিছু একটা শব্দ হল । বারান্দায় এসে লাইট জ্বালালো । না, কেউ নেই । ভাস্কর এখনো এল না । কিন্তু এত দেরি তো করে না । ন’টা দশ’টা নাগাদ ফিরে আসে । রেবেকাকে পৌঁছে দিয়ে কোনো কোনো দিন বসন্তবাবুদের ওখানে আড্ডা মেরে আসে ।
ভেতরের ঘরে ওদের একমাত্র ছেলে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে । শেষের দিকে ভাস্করের স্টাডি রুম । রুমে ঢুকে আলো জ্বালালো । এটাই বিখ্যাত চিত্রকর ভাস্কর পালের চিত্রশালার আতুর ঘর । দেওয়ালে কিছু ক্যানভাস ঝুলানো রয়েছে । একটি মোনালিসার বিখ্যাত ছবির প্রতিকৃতি । অন্য একটি ঋতুপর্ণার মুখের একপাশের ছবি । এদিক ওদিক ছড়ানো কিছু সাদা ক্যানভাস ।
ঘরের মাঝে অর্ধ সমাপ্ত একটি নারীর ছবি । ছবির সামনে এল ঋতুপর্ণা । স্পষ্টই বুঝা যায়, এটা রেবেকার ছবি । ইদানিং পাহাড়ী মেয়ে রেবেকা ভাস্করের ছবির মডেল । পাহাড়ী মেয়ের রূপ সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলছে ভাস্কর তার তুলির টানে । ক্যানভাসের চারপাশে রঙের কৌটাগুলো অগোছালো ভাবে ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক । আজকাল ভাস্করকে কেমন অচেনা মনে হয় । যেন সবসময় অস্থিরতায় ভুগছে । ঋতুপর্ণার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে না । বুবাইকেও সেভাবে আদর করে না ।
কলেজ জীবনে ভাস্কর ছিল তারুন্যের প্রতিমূর্তি । কি বিতর্কে, কি খেলাধুলায়, কি গানে, সে ছিল সবার সেরা । ওকে নিয়ে শিপ্রা, নীলাঞ্জনা, মেঘমালারা ঋতুপর্ণাকে হিংসা করতো । ওরা সবাই আর্ট কলেজে একই ব্যাচের । মাঝে মাঝে দল বেঁধে স্টাডি ট্যুরে বেরিয়ে পড়ত । কি মজাই না হতো । সেই সময়ে ভাস্কর ঋতুপর্ণার একটি পোর্টাইট আঁকছিল । ওরা ঋতুপর্ণাকে ক্ষেপাত, ওই তোর লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আসছে রে মোনালিসা । ঋতুপর্ণা রাগ করত । কিন্ত ভাস্কর মুচকি হেসে বলতো, বেহেলা বাদকের পদটা না হয়, তোদেরই দিলাম ।
এমনিভাবে কলেজের দিনগুলো হাসি ঠাট্টা আনন্দে কেটে গেল । কলেজের ফাইনালের পর ওরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল । ঠিক হয়েছিল, ভাস্কর স্বাধীন ভাবে ছবি আঁকবে, ঋতুপর্ণা চাকরি করবে । সেইমত ঋতুপর্ণা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে আর্ট টিচারের চাকরি নিয়ে এই মফস্বল শহরে এসেছে । ভাস্কর আজ এই অঞ্চলের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী । তার আঁকা ছবিগুলো চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায় । ঋতুপর্ণা, বুবাইকে নিয়ে ভাস্করের সুখের সংসার । কিন্তু সত্যিই কি তাই?
আজকাল ঋতুপর্ণা বেশ বুঝতে পারে, ভাস্কর তাকে এড়িয়ে চলে । ঋতুপর্ণা রেবেকার ছবির দিকে ভালোভাবে তাকায় । কি উদাস চাউনি । কিন্তু ভাস্কর ছবিতে এত রঙ চাপিয়েছে কেন? একটি ছবি হয় রঙের সিম্ফনিতে । অনেক চাপা রঙের বিভঙ্গে যেন দ্যুতি বিচ্ছরিত হয় । ভাস্করের ছবিতে যেন রঙের ভান্ড উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উজ্জ্বলতার আভা নেই । তবে কি ভাস্কর পিছন দিকে
ছুটতে শুরু করেছে । খুব বেশি স্বামীত্বের দাবি করে আজকাল । নিজের পরাজয়কে মেনে নিতে চায় না ।
সে এক অদৃশ্য যুদ্ধে মগ্ন । যে যুদ্ধে আত্মহুতি ছাড়া আর কোনো পথ নেই । রেবেকার ছবিটি খুঁটিয়ে দেখে ঋতুপর্ণা । রেবেকা এখানে প্রকৃতির কন্যা । প্রকৃতির কোলে এক চঞ্চলা হরিণী । কিন্ত ছবিতে নগ্নতা এত প্রকট কেন? বিষয়বস্তু নগ্নতা হতে পারে, কিন্তু তাতে অশ্লীলতা না থাকা সম্পূর্ণ সম্ভব । কিন্ত ভাস্করের ছবিটি চিত্রকলা না হয়ে ফটোগ্রাফ হয়ে উঠেছে ।
ঠক, ঠক. । দরজার কপাট খোলে দিতেই ভাস্কর টলমল পায়ে ঘরে ঢুকলো । মুখে মদের উগ্র গন্ধ ।
-তুমি মদ খেয়ে এসেছো?
– আমাকে ক্ষমা কর পর্ণা, রেবেকার মাঝে আমি অন্য কিছু খুঁজছিলাম । দেখলাম ও খুব সাধারণ ।
ভাস্কর কান্নায় ভেঙে পড়লো । একটা আশ্রয়ের খোঁজে ঋতুপর্ণার কোলে মুখ লুকালো । প্রথমে ঋতুপর্ণার রাগ হলো, তারপর মায়া হলো । ভাস্কর এখন বড্ড বেশি অসহায়, ও একটা আশ্রয়ের দরকার । ঋতুপর্ণা ভাস্করের মাথায় হাত রাখলো, আস্তে আস্তে চুলে বিলি কাটতে লাগলো ।