Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জয়দেবের জীবনযাত্রা || Tarapada Roy

জয়দেবের জীবনযাত্রা || Tarapada Roy

জয়দেবের জীবনযাত্রা

রাত পৌনে দশটার সময় এল জয়দেব। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, রাস্তায় হালকা জল জমেছে। দুদিন ভরা গুমোটের পর আজ একটু বৃষ্টি হল। তবে আরও বোধহয় হবে, আকাশে মেঘ থমথম করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাতাসও বেশ জোরালো।

এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমেছে, রাতে যদি আরও বৃষ্টি হয় কাল সকালে রাস্তায় অনেক জল থাকবে, দুধ আনা, বাজার করা–কাল সকালের হাঙ্গামাগুলো ভাবতে লাগলেন মহিমাময়।

গুমোট কেটে গিয়ে জোলো বাতাসে একটা আরামের ভাব। সেইসঙ্গে কাল সকালের চিন্তা জয়দেবের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন মহিমাময়।

দুপুরে অফিসে এসেছিলেন জয়দেব। চোখ লাল, এলোমেলো চুল, হাত পা টলমল, ভর দুপুরেই নেশা করেছেন। এসে দাঁড়াননি, বিশেষ বিরক্তও করেননি, শুধু বলেছিলেন, কাজের কথা আছে। এখানে হবে না, সন্ধ্যাবেলায় বাসায় থাকিস, যাব।

তা জয়দেব বলুন আর না বলুন, সন্ধ্যাবেলা মহিমাময় এমনিতেই কোথাও যান না। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে আসেন, বাসায়ই থাকেন।

আজও বাসায়ই ছিলেন মহিমাময়। জয়দেব আসবে বলেছে, সাধারণত নেশার মধ্যে কেউ কিছু বললে, যতক্ষণ নেশার ঘোর মাথার মধ্যে থাকে কথাটা তার মাথায় থাকে। সুতরাং জয়দেবেরও থাকতে পারে, এরকম একটা আশংকা সন্ধ্যা থেকেই মহিমাময় করছিলেন। কাজের কথা না কী বলবে জয়দেব, সেটা অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যে নয়, তার পুরনো বন্ধু আসবে বলেছে, আসুক।

আলমারির পেছনে কয়েকটা আধ-খাওয়া মদের বোতল আছে। ধুলো ঝেড়ে সেগুলো বার। করেছেন মহিমাময়, মদ পচে যায় না বরং যত পুরনো হয় ততই তার স্বাদ বাড়ে, জোর বাড়ে।

আগে মহিমাময় মদ খেতেন প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যাবেলা বাসায় বসে একা একা। এখন আর খুব একটা খান না। সন্ধ্যাবেলা খুব খিদে পায়। অফিস থেকে ফিরে তাই তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে নেন। তারপর আর মদ খেতে ইচ্ছে করে না, আর তা ছাড়া ভরপেট খেলেই মহিমাময়ের ঘুম পায়। তিনি শুয়ে পড়েন এবং ঘুমিয়ে পড়েন।

আজ জয়দেব আসবে বলে খুঁজে খুঁজে আলমারির পিছন থেকে তিনটে বোতল বেরিয়েছে। একটার মধ্যে অল্প একটু জিন আছে, সেটা রাতের বেলায় চলবে না। মদ ব্যাপারটা ফুলের ঠিক উলটো। কথাটা কোথায় যেন শুনেছিলেন মহিমাময়। সাদা ফুল ফোটে রাতের বেলায় আর দিনের বেলায় রঙিন ফুল। কিন্তু মদের বেলায় দিনে সাদা মদ, জিন, ভদকা ইত্যাদি, আর রাতে রঙিন মদ হুইস্কি, রাম, ব্র্যান্ডি। এটাই হল নিয়ম। এ নিয়ম যে মানতেই হবে এমন কোনও কথা নেই, কিন্তু মোটামুটি সবরকম মদ্যপই এই নিয়মটা মান্য করে। কেন করে কে জানে?

সে যা হোক, মহিমাময় জিনের বোতলটা আবার আলমারির পিছনে রেখে দিলেন। বাকি দুটো বোতলের একটায় সামান্য পরিমাণ রাম হয়েছে, প্রায় তলানিই বলা চলে, এক ঢোকের বেশি হবে না। তবে দ্বিতীয় বোতলটায় হুইস্কি বেশ কিছুটা আছে।

টেবিলের নীচে চেয়ারে পায়ের কাছে বোতল দুটো রেখে বাইরের ঘরে বসে জয়দেবের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মহিমাময়। জয়দেবের অবশ্য আসার কোনও ঠিকঠিকানা নেই, রাত দেড়টা এমনকী ভোর চারটেতেও আসতে পারে। সন্ধ্যা থেকে প্রতীক্ষা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন মহিমাময়। সাড়ে আটটা নাগাদ প্রতিদিনের মতো খিদেটা যখন জোর পেয়ে বসল তখন তিনি খিদের বদলে তৃষ্ণা নিবারণের দিকে জোর নিলেন। প্রথমে এক ঢেকে রামের তলানিটুকু নিট গিলে ফেললেন। অনেকদিন খাননি, একটা বড় হেঁচকি উঠল, তারপর কিছুটা বাদে ক্রমাগত হেঁচকির পর হেঁচকি, বিলম্বিত লয়ে হেঁচকি শুরু হল।

প্রথমে দু-চার গেলাস জল খেয়ে হেঁচকি কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার পর হুইস্কির বোতলটা খুললেন মহিমাময়। ইচ্ছে ছিল না খেতে, জয়দেব আসবে, তাকে কি শুকনো মুখে বসিয়ে রাখবেন? খাওয়া আরম্ভ করলে মহিমাময় খুব তাড়াতাড়ি খান, এখনই ফুরিয়ে যাবে সামান্য পানীয়টুকু।

তাই ফুরোল, নটা পঁচিশ নাগাদ শেষ বিন্দুটুকু গলাধঃকরণ করে যখন হেঁচকির টানটা সবে ছেড়েছে আর একটা গুমভাব এসেছে মনের মধ্যে সেই সময় জয়দেব এলেন। জয়দেবের সঙ্গে সঙ্গে এল জোর বৃষ্টি। মহিমাময়ের বাড়িটা রাস্তার উপরে, একতলায় তিন কোনাচে বাইরের ঘরটা। নেশা করলে জয়দেব রিকশায় যাতায়াত করেন। একলাফে বৃষ্টি বাঁচিয়ে জয়দেব রিকশা থেকে সরাসরি বাইরের ঘরে ঢুকলেন।

নেশা আরম্ভ করার প্রথম দিকে যেটুকু মাথা ঘোরে কিংবা পা টলে জয়দেবের, তারপর তিনি যত খান বেহুশ না হওয়া পর্যন্ত স্টেডি থাকেন। সেই স্টেডি ভাবটা এখন জয়দেবের মধ্যে এসেছে। জয়দেবকে লাফ দিতে দেখে মহিমাময়ের ভয় হয়েছিল ছিটকিয়ে পড়ে-উড়ে গিয়ে জখম না হয়। এরকম জখম হওয়া জয়দেবের পুরনো অভ্যেস। কিন্তু এখন জয়দেব সত্যিই স্টেডি।

ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনের চেয়ারে বন্ধুর মুখোমুখি বসলেন জয়দেব। তারপর জিজ্ঞাসা। করলেন, কীরে, নেই কিছু?

মহিমাময় এ প্রশ্নে একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। বললেন, তুই এত দেরি করলি! সামান্য একটু ছিল, তোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে শেষে আমি নিজেই খেয়ে ফেললাম। তারপর একটু থেমে বললেন, একটু জিন আছে, খাবি?

জয়দেব ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, জিন? জিন আবার ভদ্রলোকে খায় নাকি? তোর পাল্লায় যখন পড়েছি, সন্ধ্যাবেলা বাসায় আসতে বললি অথচ কিছু বন্দোবস্ত রাখিসনি!

মহিমাময় বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তো তোকে আসতে বলিনি। তুই-ই আসতে চেয়েছিস। তা বলে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে আলমারির পিছন থেকে জিনের বোতলটা বার করে নিয়ে এলেন।

বোতলটার মধ্যে পানীয়ের পরিমাণ স্বল্প। বড়জোর চারভাগের এক ভাগ হবে। তবে একজনের পক্ষে সেটা কম নয়। একে জিন, তারপরে সিকি বোতল-মহিমাময়ের এরকম ব্যবহারে জয়দেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, এসব চলবে না। পঞ্চাশটা টাকা বার করো, রিকশাওয়ালাকে দিয়ে একটা ছোট হুইস্কি আনাই।

মহিমাময় এরকম অবস্থার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে রিকশাওয়ালা কোথায় যাবে, এত রাতে সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, কোথায় পাবে মদ, তা ছাড়া পঞ্চাশ টাকাও কম কথা নয়!

মহিমাময় জয়দেবকে বললেন, পঞ্চাশটা টাকা যে দেব, তোর রিকশাওয়ালাকে বিশ্বাস কী?

মহিমাময়ের অবিশ্বাসী প্রশ্নে জয়দেবের আঁতে ঘা লাগল। জয়দেব চেঁচিয়ে উঠলেন, দ্যাখ মহিমা, তুই বড় নীচ। রিকশা চালায় বলে, গরিব বলে চুরি করবে? মদের টাকা মেরে দেবে?

মহিমাময় গম্ভীর হলেন। বললেন, এই রিকশার লোকটাকে চিনিস? নাম জানিস?

সঙ্গে সঙ্গে জয়দেব উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, রিকশাওয়ালার প্রসঙ্গ তাঁর বোধহয় সহ্য হল না। মহিমাময়ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, যাক খুব সহজে আপদ গেছে।

কিন্তু আপদ এত সহজে যাওয়ার নয়, দু মিনিটের মধ্যে জয়দেব ফিরলেন সঙ্গে রিকশাওয়ালা। তাকে একেবারে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। রিকশাওয়ালাকে মহিমাময়ের টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে জয়দেব বললেন, মহিমা, ভাল করে দ্যাখ লোকটাকে। বিকেল থেকে আমার সঙ্গে আছে। এর চেহারার মধ্যে একটা অনেস্টি রয়েছে। তোর মতো চোর চোর চেহারা নয়। আমি একবার দেখেই লোক চিনতে পারি। পঞ্চাশ, শুধু পঞ্চাশ কেন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েও এরকম লোককে বিশ্বাস করা যায়।

হাঁটুর ওপরে তোলা খাটো ময়লা ধুতি, খালি গা, কোমরে ঘন্টি, দেহাতি লোকটিও বোধহয় জয়দেবের সঙ্গে তাল দিয়ে দিয়ে বেশ নেশা করেছে, সে হাসিহাসি মুখে মহিমাময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মহিমাময় লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী?

সুখের বিষয় লোকটি বাংলা বোঝে, বোধহয় অনেকদিন কলকাতায় আছে, সে বলল, হুজৌর, মেরা নাম ঠকাই, ঠকাই সিং।

নাম শুনে মহিমাময় আতংকিত বোধ করলেন, লোকটিকে বললেন, তুমি বাইরে দাঁড়াও। লোকটি বেরিয়ে যেতে জয়দেবকে বললেন, দ্যাখ, জয়, আমি আর যাই করি এই এত রাতে ঠকাই। নামে এরকম একটা লোককে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বিশ্বাস করতে পারি না।

এবার জয়দেব ক্ষেপে গেলেন, উত্তেজিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ে চেয়ারের ওপর বাঁ পাটা তুলে দিলেন, তারপর ধীরে ধীরে প্যান্টের ঝুলটা হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুললেন। চাপা প্যান্ট নয়, আধুনিক ফ্যাশানের ঢোলা প্যান্ট, তাই বিশেষ অসুবিধা হল না। প্যান্ট তুলতে দেখা গেল হাঁটুর কিছু নীচে পায়ের সঙ্গে মোটা রবারের গার্ডার দিয়ে একটা একশো টাকার আর একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাঁধা।

একশো টাকার নোট যথাস্থানে রেখে, পঞ্চাশ টাকার নোটটা গার্ডার থেকে খুলে বার করে প্যান্টটা আবার নামিয়ে দিলেন জয়দেব, মুখে গজগজ করতে লাগলেন, দিনরাত মাতালদের সঙ্গে ওঠাবসা, ভদ্রলোকের মতো পকেটে টাকা রাখার জো আছে! গজগজ করতে করতে কটমট করে তাকাতে লাগলেন মহিমাময়ের দিকে।

এদিকে মহিমাময়ের ঠকাই সম্পর্কে আশংকা কিন্তু ঠিক মিলল না। দশ টাকা বখশিশের প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও ঠকাই এত রাতে এত বৃষ্টিতে মদ আনতে যেতে রাজি হল না। তা ছাড়া সে বলল, এসব খারাপ জিনিস কোথায় পাওয়া যায়, সেসব সে কিছু জানে না। আজ এই বড়বাবুর। পাল্লায় পড়ে জীবনে প্রথম নেশা করেছে। সে অত্যন্ত সাধু লোক, দৈনিক হনুমান পুজো করে, খইনি-বিড়ি পর্যন্ত খায় না।

অতঃপর বাধ্য হয়ে জয়দেব নিজেই বেরোতে গেলেন, কিন্তু বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে, বেরোনোর সাহস করলেন না। একটু নরম হয়ে মহিমাময়কে বললেন, তা হলে দে–জিনটুকু দে, ওটাই খেয়ে নিই।

মহিমাময় বন্ধুকে একটু বেশি করে এবং নিজে একটু কম করে জিন নিয়ে দুটো গেলাসে জল ঢেলে নিলেন। আস্তে আস্তে জয়দেবের মন খুশি হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি ধরে এসেছে, জিনও শেষ। চুপচাপ দুজনে পান শেষ করেছেন। এবার জয়দেব। উঠলেন, বললেন, অনেক রাত হয়েছে, এগারোটা বাজে। বৃষ্টিটা থেমেছে, এই ফাঁকে যাই।

বেরোনোর মুখে জয়দেবকে মহিমাময় প্রশ্ন করলেন, কী একটা কাজের কথা আছে বলেছিলি?

ঘুরে দাঁড়িয়ে জয়দেব বললেন, ভাল কথা মনে করেছিস। আসল কাজটাই ভুলে গিয়েছিলাম। কাল তো আমাদের বিবাহবার্ষিকী। তোরা রাতে আমাদের ওখানে খাবি।

মহিমাময়ের স্ত্রী ভিতরের ঘরে আনাগোনা করছিলেন। জয়দেবের নিমন্ত্রণ শুনে বাইরের ঘরে এসে বললেন, গতবারের মতো হবে না তো?

গতবারের ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। বেশি বর্ণনা না করে সংক্ষেপে বলা যায় গতবার নিমন্ত্রণ করে নিমন্ত্রণকর্তা জয়দেব নিজেই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা, রাত বারোটা পর্যন্ত জয়দেবের জন্যে অপেক্ষা করে সকলে ফিরে আসে।

মহিমাময়ের স্ত্রীর প্রশ্নে জয়দেব বললেন, আরে না না। লজ্জা দেবেন না। আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখন সোজা বাড়ি যাব। কাল আর বাড়ি থেকে বেরোব না।

মহিমাময় বললেন, বাড়ি থেকে বেরোবি না? তবে খাওয়াবি যে বাজার করবি না?

জয়দেব বললেন, হবে তো খিচুড়ি-মাংস আর আনারসের চাটনি। মাংস পাড়াতেই পাওয়া যাবে। আর আনারসটা বউ একসময়ে নিউমার্কেটে গিয়ে নিয়ে আসবে।

মহিমাময় মৃদু আপত্তি করলেন। ওই মাংস-খিচুড়িই যথেষ্ট। আমি এক বোতল হুইস্কি নিয়ে যাব। বউদিকে নিউ মার্কেটে গিয়ে আনারস কিনতে হবে না। আর এখন আনারসের খুব দাম, বাজারে ভাল করে ওঠেইনি।

খুব দাম কথা দুটো জয়দেবের কানে খট করে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া হল, তিনি ঘরের মধ্যে দু পা এগিয়ে এসে অভিযোগের ভঙ্গিতে বললেন, খুব দাম? আমি মদ খেয়ে পয়সা নষ্ট করি বলে তোরা ভাবি আমার আনারস কেনারও ক্ষমতা নেই?

মহিমাময় জয়দেকে অনন্তকাল ধরে জানেন, তিনি জানেন, এখন জয়দেবের সঙ্গে তর্কে প্রবেশ করা বোকামি। তাই সঙ্গে সঙ্গে কথার মোড় ঘুরিয়ে বললেন, না না, আনারসের চাটনি তাহলে করবি। এতে আপত্তির কিছু নেই। ভালই হবে।

জবাব শুনে জয়দেব বেরিয়ে গেলেন, ঠকাইয়ের রিকশায় উঠে হাত তুলে গুডনাইট বলে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে রিকশার টুং টাং শব্দ গলির মোড়ে মিলিয়ে গেল।

আধ ঘণ্টাখানেক বাদে সবে খাওয়া-দাওয়া সেরে মহিমাময় শুতে যাবেন এমন সময় গলির মোড় থেকে একটা রিকশার টুং টাং শব্দ এগিয়ে এসে মহিমাময়ের সদর দরজার সামনে থামল। কড়া নাড়তে দরজা খুলে মহিমাময় দেখলেন জয়দেব।

মহিমাময়কে দেখে জয়দেব বললেন, প্রায় বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলাম। ঠিক করে বল তো আনারসের চাটনি করব কি করব না!

মহিমাময় বললেন, সে তো আগেই বলে দিলাম। অসুবিধা যদি না হয় আনারসের চাটনি হলে তো ভালই।

জয়দেব আহত হলেন, সুবিধা অসুবিধার কথা আসছে কোথায়? ঠিক করে বল আনারসের চাটনি করব কি করব না।

কথা না বাড়িয়ে মহিমাময় বললেন, আনারসের চাটনি করবি।

জয়দেব আবার সেই ঠকাইয়ের রিকশায় উঠে চলে গেলেন। এবার দরজা বন্ধ করে মহিমাময় শুতে গেলেন। একতলাতেই পাশের ঘরে শোবার ঘর। রাস্তার ধারে মাথার কাছে জানলা। রাতে সে জানলাটা বন্ধ করে শোন মহিমাময়।

তখন আবছাতন্দ্রা মতো ঘুম এসেছে মহিমাময়ের। পাশে স্ত্রী গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন, হঠাৎ রিকশার টুং টুং এবং জানলায় ঠুকঠুক শুনে মহিমাময় জানলাটা একটু ফাঁক করলেন, আবার জয়দেব এসেছেন জানলার নীচে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, বোধহয় কাছেপিঠে কোথাও একটা চোলাইয়ের আড্ডা পেয়েছেন, সেখান থেকেই ঘুরেফিরে আসছেন।

জানলার ওপাশে অন্ধকারে মহিমাময়ের আবছা মুখটা দেখে জয়দেব জানতে চাইলেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা কী ঠিক হল? অনারসের চাটনি হবে কি হবে না?

ঘুম-চোখে মহিমাময় বললেন, আর জ্বালাস নে জয়দেব। আনারসের চাটনি হবে, হবে, হবে। আবার রিকশায় উঠে জয়দেব বিদায় নিলেন। কিন্তু পুরোপুরি বিদায় নয়। তিরিশ-চল্লিশ মিনিট পরপর ওই ঠকাইয়ের রিকশায় চড়ে ঘুরে ঘুরে আসতে লাগলেন, সঙ্গে ওই একই জিজ্ঞাসা, আনারসের চাটনি হবে কি হবে না?

রাত দুটো-আড়াইটা নাগাদ ব্যাপারটার একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে গেল। মহিমাময় আর জানলা বন্ধ করছেন না, জয়দেবও আর রিকশা থেকে নামছেন না। জানলার কাছে এসে ঠকাই ঘণ্টা টুং টুং করছে, রিকশা না নামিয়ে উঁচু করে ধরে রেখেছে সে, সেখানে হেলান দিয়ে বসে আছেন জয়দেব। টুং টুং শব্দ শুনে দুপাশ থেকে দুই বন্ধুতে প্রশ্নোত্তর হচ্ছে। ক্রমশ প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। জয়দেব প্রশ্ন করছেন, আনারস…? মহিমাময় উত্তর দিচ্ছেন, হবে।

সকাল সাড়ে চারটে নাগাদ সামান্য পটপরিবর্তন হল। রিকশায় টুং টুং শব্দ শুনে যথারীতি বিছানায় উঠে বসে মহিমাময় অবাক হয়ে দেখলেন, রিকশার সিটে ঠকাই বসে রয়েছে আর রিকশাটা চালাচ্ছেন জয়দেব। এখন অবশ্য চালাচ্ছেন না, পঁড়িয়ে রয়েছেন, তবে হাতের ঘন্টিটা খুব টুং টুং করে যাচ্ছেন।

মহিমাময়কে বিছানার ওপরে উঠে বসতে দেখে ঠকাই দাঁত বার করে হাসল, তারপর দেহাতি হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, আনারসকা চাটনি হোগা কি নেহি হোগা?

হতভম্ব মহিমাময় কী জবাব দেবেন বুঝতে পারছিলেন না। এর মধ্যে একটা অন্য রকম কাণ্ড ঘটল। ক্লান্তির জন্যেই হোক অথবা অনভ্যাসের জন্যেই হোক রিকশার হাতলটা হঠাৎ ছেড়ে দিলেন। জয়দেব। রিকশাটা উলটে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল ঠকাই। তার বিশেষ কিছু হয়নি। সে তাড়াতাড়ি ধুলো ঝেড়ে নিয়ে রিকশাটা সোজা করে নিয়ে জয়দেবকে ফেলেই দৌড়ে রওনা হল। জয়দেব পিছু পিছু চেঁচাতে লাগলেন, এই ঠকাই। দাঁড়া, দাঁড়া, তোর ভাড়া নিয়ে যা।

ঠকাই আর দাঁড়ায়। সে তখন রীতিমতো ছুট লাগিয়েছে। তার পেছনে ছুট লাগাতে লাগাতে জয়দেব একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে জানলার ওপ্রান্তে বিছানার উপর বসে থাকা বিস্ময়বিমূঢ় মহিমাময়কে বললেন, এখনও শেষবারের মতো অন্তত বলে দে মহিমা, আনারসের চাটনি হবে কি হবে না? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে ঠকাইয়ের রিকশার পেছনে প্রাণপণ দৌড় দিলেন জয়দেব।

মহিমাময় বিছানায় বসে বসে ভাবতে লাগলেন, তাহলে আনারসের চাটনি হবে কি হবে না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress