Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জমা খরচ || Shirshendu Mukhopadhyay

জমা খরচ || Shirshendu Mukhopadhyay

কী বুঝছ মুখুজ্জে? চল্লিশ পেরিয়ে জীবনের এক-আধটা হিসেব কষে ফেলা উচিত ছিল তোমার। একদিন ছুটি-টুটি দেখে বরং একটা খাতা নিয়ে বসে যাও। একদিকে লেখো জমা, অন্য ধারে খরচ। ওই যেমন অ্যাকাউন্ট্যান্টরা ডেবিট-ক্রেডিট লেখে আর কি?

জমার ঘরে প্রথমেই লেখো, জন্ম। ওটা প্লাস পয়েন্ট। একটা আর্নিং তো বটেই। কিন্তু আয়ুটাকে জমার ঘরে রেখো না। জন্মের পর থেকে আয়ু আর জমা হয় না। ওটা খরচ বলে ধরো।

ব্যালানস শিটটার দিকে একবার তাকাও, ভালো দেখাচ্ছে না? জমা, জন্ম। খরচ, আয়ু।

জন্মের পর একরোখা বহুদূরে চলে এসেছ। টর্চের আলোটা একটু পিছন দিকে ঘুরিয়ে ফেলবে নাকি? মগজের ব্যাটারি এখন আর তেমন জোরালো নয় হে। আলো একটু টিমটিমে। তবু দেখা যায়। একটা সাইকেল দেখতে পাচ্ছ, মাটির দাওয়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো? একটা লেবু গাছ! আর ওই মস্ত সেই নদী! শীতের দুধসাদা চর জেগে ওঠে বুকে, ভরা বর্ষায় রেলগাড়ির মতো বয়ে যায়!

এসব কোনও খাতেই লিখো না মুখুজ্জে। ওগুলো না জমা, না খরচ। ওই সেই বাঘের মতো রাগী লোকটা সন্ধ্যায় আবছায়ায় পুবমুখো মস্ত ডেক চেয়ারে বসে আছে বারান্দায়! চেনো তো! আর কারও বশ মানেনি, কখনও, কেবল তোমার কাছে মেনেছিল। তোমার ইস্কুলের হাতের লেখা পর্যন্ত চুপি–চুপি লিখে দিত, ভুলে গেছ? কোন খাতে ধরবে তোমার দাদুকে?

জমার ঘরে ধরলে? ভুল করলে না তো? একটু ভেবে দ্যাখো। বরং কেটে দাও। কোনও খাতেই ধোরো না।

ময়ুরটার কথা লিখবে নাকি? সত্যি বটে, গোলোকপুরের জমিদার বাড়ির মস্ত উঠোনে পাম গাছের নীচে ওকে তুমি বহুবার পেখম ধরে থাকতে দেখেছ। চালচিত্রের মতো রঙিন বিস্ময়। কিন্তু বলো, বিস্ময় আমাদের কোনও কাজে লাগে? আমাদের মূলধন জমার খাতে সৌন্দর্যের কোনও ভূমিকাই নেই।

বরং জমার খাতে ধরতে পারো তোমার জেঠিমার হাতে ডাল ফোড়নোর গন্ধটাকে। ওই অসম্ভব সুন্দর ডাল দিয়ে থাবাথাবি করে কতজন ভাইবোন মিলে এক থালায় ভাত মেখে খেতে।

আর বর্ষায় মুকুন্দর ঘানিঘরের পিছনে যে কদমফুল ফুটত! যদি খুব ইচ্ছে হয়, তবে ওটাকেও জমার ঘরেই ধরতে পারো। তবে আমি বলি ফুলটুল জীবনে খুব একটা কাজে লাগে না। কদম ফুল অবশ্য লেগেছিল। পাপড়ি ছিঁড়ে গোল মুণ্ডুটা দিয়ে তোমরা ফুটবল খেলতে শিখল।

প্রথম এরোপ্লেন দেখার কথা মনে পড়ে? টর্চটা ভালো করে ফেলো। দেখতে পাবে। ওই যে কলকাতার মনোহরপুকুরের সেই দোতলার ঘর? দেশের বাড়ি, নদী, লেবু বন, দাদু সবকিছু থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল তোমাকে। সারাদিন মন খারাপ। পৃথিবী জুড়ে তখন বিশাল এক যুদ্ধ চলছে। এরোপ্লেনের আওয়াজ পেলেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে তুমি। মাথাটা। উঁচুতে তুলতে। তুলতে-তুলতে মাথা লটকে যেত পিঠের সঙ্গে। এরোপ্লেন যেত ঝাঁক বেঁধে। তার মধ্যে একটা এরোপ্লেন দলছুট হয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিয়ে আবার উড়ে গেল।

তোমার শৈশব মাখামাখি হয়ে আছে রেলগাড়ি আর এরোপ্লেনে। তোমার ভিতরে জঙ্গল, পাহাড়, নদী, কুয়াশা, চা-বাগান ঢুকে পড়েছিল কবে! আজও তুমি তাই নিজের চারদিকটা স্পষ্ট করে দেখতে পাও না। মাঝে-মাঝে ঝুম হয়ে বসে থাকো। তোমার মাথার মধ্যে রেললাইন দিয়ে গাড়ি বহু দূরে চলে যায়, আকাশ পেরোয় বিষণ্ণ এরোপ্লেনের শব্দ, অবিরল নদী বইতে থাকে। তোমার সময় যায় বৃথা। মুখুজ্জে, এগুলো তোমার খরচের দিকে ধরে রাখো।

সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি বহুবার শুনিয়েছ লোককে। কাটিহারের সেই ভোরবেলা, শীতশেষের কুয়াশা মাখা আবছায়ায় শিমূল বা মাদার গাছের মগডাল থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠেছিল। সেই ডাকে অকস্মাৎ ভেঙে পড়ল শৈশবের নির্মোক। তুমি জেগে উঠলে। সত্যি নাকি মুখুজ্জে? ঠিক এরকম হয়েছিল?

সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি একদিন বড় হয়ে বলেছিলে তোমার ভালোবাসার যুবতীটিকে।

সে বলল , যাঃ।

সত্যি। তুমি বুঝবে না বুলু। এরকমই হয়েছিল।

কোকিলের ডাক আমি তো কত শুনেছি। কোনওদিন আমার সেরকম হয়নি তো।

আঃ, কোকিলের ডাকটাই তো আর বড় কথা নয়।

তবে?

সে যে সেই বিশেষ মুহূর্তে ডেকে উঠল সেইটেই বড় কথা।

বিশেষ মুহূর্তটা কীসের?

শিশু বয়সের অবচেতনার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ল যে।

যাঃ, বানানো কথা।

মুখুজ্জে, আজও তুমি ঠিক করতে পারোনি, কোকিলটাকে কোন খাতে ধরবে। কিন্তু কোনও-কোনও খাতে ধরতেই হবে যে, ওটা যে তোমার জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল।

ধরো, জমার খাতেই ধরো।

কোকিলের ডাকের পরেই এল মঞ্জু। মঞ্জুই তো? ঠিক বলছি না! মঞ্জুর মতো সুন্দর মেয়ে সেই বয়সে তুমি আর দ্যাখোনি। বব চুল, ফরসা, টুকটুকে, মেম ছাঁটের ফ্রক। এর কথাও তুমি বহুবার বলেছ।

মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতে। মঞ্জুও তোমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু সেই বয়সের টান কি সহজে ছাড়ে। ওদের বাড়ির আনাচকানাচ দিয়ে ঘুরতে, গুলতে পাখি মারবার চেষ্টা করতে, বড় গাছে উঠে যেতে। দেখানোর মতো এইসব বীরত্বই সম্বল ছিল তোমার।

তারপর একদিন নিজেদের বাগানে খেলতে-খেলতে মঞ্জু একদিন ফটকের কাছে ছুটে এসে ডাক দিল, রতু! এই রতু!

তুমি পালাচ্ছিলে ডাক শুনে। মঞ্জু ছাড়েনি তবু। ফটক খুলে পাথরকুচির রাস্তায় কচি পায়ের শব্দ তুলে দৌড়ে এসে হাত ধরল। বড়-বড় চোখে চেয়ে রইল মুখের দিকে, অবাক হয়ে।

এত ডাকছি, শুনতে পাওনি?

ডাকছিলে? ও, তাহলে শুনতে পাইনি।

ঠিক শুনেছ। দুষ্টু কোথাকার। ভারী ডাঁট তো তোমার।

তুমি কথা বলতেই পারোনি।

মঞ্জু হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তোমাকে, ওদের বাগানে। পরির মতো মেয়েরা খেলছে ওদের বাগানে, গাছে চড়ছে, হাসছে, চেঁচাচ্ছে। চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি।

মঞ্জু দৌড়ে একটা পেয়ারা এনে তোমার আড়ষ্ট হাতে গুঁজে দিয়ে বলল , খাও রতু।

খাবো?

তবে পেয়ারা দিয়ে কী করে লোকে? খায়ই তো!

কী যে সুগন্ধ মাখানো ছিল পেয়ারাটার গায়ে, আজও মনে আছে তোমার। হয়তো পাউডার বা স্নেয়ের গন্ধ, হয়তো তা মঞ্জুরই গন্ধ।

পেয়ারাটাকে কোন খাতে ধরবে মুখুজ্জে!

ইস্কুলে চোরের মার খেতে তুমি রোজ। মার খেতে খালাসিপট্টিতে, মেছোবাজারে, বাবুপাড়ায়। দুষ্টু ছিলে, দাঙ্গাবাজ ছিলে, তাই মার খেতে-খেতে বড় হলে। সবচেয়ে বেশি লেগেছিল একদিন। ইস্কুল থেকে ফেরার সময়ে খালাসিপট্টিতে একটা লোক হঠাৎ অকারণে কোথা থেকে সুমুখে এসে তোমার পথ আটকাল।

তুমি পাশ কাটাতে চেষ্টা করছিলে।

লোকটা হঠাৎ বলল ‘শুয়ারকা বাচ্চা’, তারপর বিনা কারণে তোমার কান ধরে গালে একটা চড় কষিয়ে দিল। সেই চড়টা আজও জমা আছে। কিছুতেই ভোলোনি। শোধ নেওয়া হয়নি। তুমি শোধ নিতে ভালোবাসো না কিন্তু আজও ভাবো, এই চড়টার শোধবোধ হওয়া দরকার। চড়টাকে কোন খাতে ধরবে মুখুজ্জে?

বড় একটা শ্বাস ফেললে। ফেল। তোমার অনেক নিশ্বাস জমা হয়ে আছে।

বেশ গুছিয়ে বসেছ। প্রথম যৌবনের ততটা টানাটানির সংসার আর নেই। দু-বেলা দুটো ভালোমন্দ খাও। ঘরে দু-চারটে দামি জিনিসপত্রও নেই কি? আর ছেলে, মেয়ে, বউ।

বউ সেই মঞ্জু নয়, বুলুও নয়। এ অন্য একজন, যাকে তুমি আজও চেনোনি।

বউ বলে, তুমি অপদার্থ, ভীতু। বদমাশ। কখনও বলে, তোমাকে ভালোবাসি।

এইসব কথাগুলো হিসেবে ফেলে দ্যাখো তো, কোনটা জমা, কোনটা খরচ।

পারছ না মুখুজ্জে, গুলিয়ে যাচ্ছে।

ওই যে একটা চিঠি এল তোমার নামে সেদিন। কী সুন্দর এক অচেনা মেয়ের চিঠি।

পড়ো মুখুজ্জে। লিখেছে : আপনার একটুখানি বেঁচে থাকা আমার কাছে অনেকখানি। প্রণাম করলাম।

কোন খাতে চিঠিটাকে ধরছ? জমা! হাসালে!

বড় জট পাকিয়ে যাচ্ছে হিসেব নিকেশ মুখুজ্জে। মেয়ে এসে গলা জড়িয়ে বলছে, বাবি, তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। অবোলা ছোট্ট ছেলেটা তোমাকে দেখলেই দুহাত তুলে ঝাঁপিয়ে আসে।

এগুলো জমার খাতে ধরবে না!

সুখ আর দুঃখগুলোকে আলাদা করে-করে আঁটি বেঁধে রেখেছ, কিন্তু কোন খাতে যাবে তা ধরোনি। সব সুখই তো আর জমা নয়। সব দুঃখই যেমন নয় খরচ।

কাঁদছ মুখুজ্জে! কাঁদ। এই মধ্য বা শেষ যৌবনে একটু-আধটু কাঁদতেই হয় মানুষকে। হিসেবের সবে শুরু কি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *