জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 05
স্কুল থেকে ফিরে আরাত্রিকা দেখল দাদা এসে গেছে। যোধপুরী পাজামা আর খাদি সিল্কের পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে। মায়ের মুখেও তাই একটু অন্যরকম হাসি। দাদার আসাটা আজকাল বেশ বিরল ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। ছুটি পড়লেই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কোথায় কোথায় ঘুরতে চলে যায়। আর নয় তো দেশ। এই নিয়ে কমলিকার খুব চিন্তা। এখানে সবাই ছেলেমেয়েদের যতদিন পারে বাড়িতে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। কাছছাড়া হয়ে গেলেই হাতছাড়া। কাছাকাছি তো কত য়ুনিভার্সিটি ছিল, কর্নেল, কলম্বিয়া, প্রিন্সটন, নিউ ইয়র্ক স্টেট য়ুনিভার্সিটি। ও জোর করে রয়ে গেল ক্যালিফোর্নিয়ায়। কমলিকা বেশি ভাবনা করলে সুদীপ বলেন, ‘তুমি বাবুর জন্য অনর্থক চিন্তাটা ছাড়ো। ও যথেষ্ট ম্যাচিওর।’
‘এই যে দিনের পর দিন বাড়ি আসে না, কোথায় কোথায় কার না কার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, এ নিয়ে তোমার নিজের চিন্তা হয় না?’
‘না। চিন্তাটা আমার বাবুকে নিয়ে আদৌ নয়।’ অর্থাৎ ওঁর চিন্তা মেয়েকে নিয়ে। সেটা সব সময়ে ভেঙে না বললেও বুঝতে পারেন কমলিকা।
দীপালি এসেছেন অনেকক্ষণ। দীপালি, বাবু আর কমলিকা মিলে অ্যাপার্টমেণ্টটার চেহারা পাল্টে ফেলেছেন। লিভিংরুম আর বাবুর ঘরের মধ্যেকার পার্টিশনটা গুটোনো। একটা চিকমিকে পর্দা সেখানে। ঘরভর্তি গোলাপ, টুকটুকে লাল সব। নতুন ব্যাপার হল, কাঠের একটা চৌকো বোর্ডে আলপনা দিয়েছেন কমলিকা। পিলসুজ-প্রদীপ, শঙ্খ এসেছে। দুর্গাপুজোর জিনিস এগুলো। দীপালির কাছে থাকে।
আরাত্রিকা চিত্রিত পিঁড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘এটা কী হবে দীপালিমাসি? পুজোটুজো আছে নাকি? শাঁখ, প্রদীপ কেন?’
দীপালি বললেন, ‘চালাকি নয়! কেক কেটে কেটে আর মোমবাতি জ্বেলে জ্বেলে ফোরেন বার্থ ডে আর চলবে না। এবার থেকে কষ্ট করতে হবে। সব্বাইকে হাঁটু মুড়ে খেয়ে তারপর বজ্রাসনে বসতে হবে। না হলে আর্থরাইটিস হয়ে মরবে বুড়ো বয়সে, তোমাদের জ্যোতিকাকু বলেছে।’
‘তো আলপনা দেওয়া পীসটা কি করবে?’
দীপালি বললেন, ‘তোর আজকে বিয়ের অ্যাপ্রেনটিসশিপ। বুঝতে পারছিস না? খাঁটি বৈদিক বিয়ে। আলপনা দেওয়া পিঁড়িতে বসবি, প্রদীপ জ্বলবে, শাঁখ বাজবে, তবে খেতে পাবি। “ভোজন আমার আহুতি প্রদান” এই স্পিরিটে খাবি, তোর বাবার হুকুম।’
কমলিকা বললেন, ‘অ্যান বেচারা কি করবে আমি শুধু তাই ভাবছি। ওইভাবে বসে খেতে বাধ্য করাটা ওর ওপর রীতিমত অত্যাচার বলে মনে হচ্ছে আমার।’
দীপালি বললেন, ‘ভেবো না। ক্যালিফর্নিয়ায় ও পাক্কা দেড়বছর সেতার শিখেছিল। পেরে যাবে।’
আজ আরাত্রিকার জন্য বাবা-মার উপহার পাটোলা শাড়ি।
দীপালি বললেন, ‘ওইটুকু মেয়েকে শাড়ি পরাচ্ছো, জড়িয়ে না পরে।’ কাঁথা-স্টিচ দিয়ে খুব সুন্দর একটা স্কার্ট করে এনেছেন তিনি আরাত্রিকার জন্য। খুব জমকালো। ইচ্ছে, সেটাই পরে।
কমলিকা বললেন, ‘উঁহু ওর বাবার মেয়েকে শাড়ি পরানোর শখ আজ। ভালোই হল। পাটোলা আমার ছিল না একটাও। ওর নাম করে হয়ে গেল।’
বয়স আন্দাজে আরাত্রিকা লম্বা খুব। দীপালি যখন ওকে শাড়ি পরিয়ে বার করলেন, দেখা গেল খুবই মানিয়েছে। প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘য়ু শিওর লুক লাইক আ ফেয়ারি প্রিন্সেস মণি!’
বাবু বলল, ‘প্রিয়াঙ্কা ইজ পুলিং ইয়োর লেগস মণি। আসলে তোকে খানিকটা কাকতাড়ুয়া-কাকতাড়ুয়া লাগছে। শাড়িটা কাঁধ থেকে কিরকম হেলপ্লেসলি ঝুলছে দেখ্। মুখটা তোর ভালো, কিন্তু টর্সোটা অবিকল স্কেয়ার-ক্রো।’
তানি বলল, ‘স্বদেশদা, তুই নিজে কি রে? চুলগুলো কতদিন কাটিসনি, দাড়ি রেখেছিস ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। একটু ট্রিম পর্যন্ত করিসনি। তুই-ই আসল স্কেয়ার-ক্রো।’
শশাঙ্ক জেঠু এসে পড়েছিলেন। বললেন, ‘উঁহু; মুশকিল আসান বইল্যা একটি খাঁটি আমাগো দ্যাশের চরিত্রের মতো দ্যাখায় উয়ারে। লাগব শুধু একখান কালো জুব্বা, আর একখান লম্ফ। কালিজুলিও কিছু মাখাইতে লাগব।’
আরাত্রিকা বলল, ‘সত্যি কিন্তু মা, এই ব্লাউসটা আমার ঠিক ফিট করেনি।’ সেলাই-ফোঁড়াই যা কিছু কমলিকা বাড়িতেই করেন। মেয়েও করে। নিজের বেশ কয়েকটা ড্রেস তৈরি করেছে ও। কিন্তু ব্লাউসের জন্য ঠিকমতো সাহায্য পাওয়া যায় না। একটু আলগা, স্কার্টের ব্লাউসের মতো ফিটিং হয়। কমলিকার নিজের একটা দেশ থেকে করিয়ে-আনা পেপার কাটিং আছে। তাইতে চলে যায়। কিন্তু আরাত্রিকার জন্য এখানকার ডিজাইনগুলোর ওপরই নির্ভর করতে হয়। কমলিকা তাকিয়ে দেখলেন কাঁধের ওপর ছোট্ট একটা করে টান পড়েছে। হাতার প্রান্তগুলো তিনকোণা হয়ে উঠে আছে। ইন্দিরা-গান্ধী ছাঁট। আসলে মণির কাঁধগুলো বেশ চওড়া, একটু চৌকো মতো। কাঁধে যেখানে পিন করেছে সেখান থেকে পেছনের আঁচল সামনে এসে ঝুলছে। তার ওপর মাথার খাটো সোজা চুল তুলে দীপালি কিরকম জাপানি-জাপানি হেয়ারস্টাইল করে দিয়েছে। ‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।’ কমলিকার চোখে মেয়েকে কোনও রোম্যান দেবীর মতো লাগছে। তাঁর নিজের ছাড়া আর কারো চোখে এই ভাস্কর্য ধরা পড়ছে না দেখে তাঁর একটু আশ্চর্যই লাগল। তানি পরেছে গলায় বুকে শলমার কাজ করা লম্বা লাল চুড়িদার। তানি দীপালির মতো জ্বলজ্বলে সুন্দরী নয়। জ্যোতির মতো ময়লা, ছোটখাটো মিষ্টি চেহারা। হঠাৎ দেখলে ওকে আরাত্রিকার চেয়ে ছোট মনে হয়। মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করলে তবে বয়সের পার্থক্য ধরা যায়। আরাত্রিকার মুখে একটা অকপট সারল্য, তানি বুঝি বুদ্ধি আর মিষ্টতা দিয়ে অনেক কিছু ঢেকে রেখেছে। ওকে দেখলে কেন কে জানে ছুটকির কথা মনে পড়ে তাঁর। প্রিয়াঙ্কা গুপ্ত ওর মায়ের মতো লম্বা। সুইডিশদের মতো চেহারা। বরফের মতো সাদা। পাতলা সোনালি ঠোঁট। চিবুকের কাছটা লম্বাটে। ঠোঁটটা সরলরেখার মতো। খড়ের রং ওর চুলে। অ্যানের চুল আরও গাঢ় সোনালি। সব মিলিয়ে প্রিয়াঙ্কাকে খুব বিবর্ণ লাগে। আজকে সবাই শাড়ি পরে এসেছে। অ্যান বললেন সুদীপ নাকি ফোনে রিকোয়েস্ট করেছেন, পুরোপুরি ইন্ডিয়ান স্টাইলে অনুষ্ঠান হবে, ইন্ডিয়ান ড্রেস পরে আসতে হবে।
এইগুলো কমলিকার বাড়াবাড়ি মনে হয়। তাঁকে বলেছেন, তিনি পিঁড়ি আলপনা প্রদীপ শঙ্খ এসবের ব্যবস্থা করেছেন। মেঝেতে কাঠের প্ল্যাংক পেতে খাওয়া হবে, পাগলামি যদিও, তা-ও নাহয় হল। পোলাও, পায়েস, চিংড়ির মালাইকারি, সুক্তো সব কিছু যেমন দেশে হয় তারই বন্দোবস্ত হয়েছে। ঠিক আছে, কিন্তু অতিথিদের ওপর এমন নিয়ম জারি করা কেন? অ্যান প্রিয়াঙ্কা দুজনেই একেবারে তুষারধবল। শাড়ি পরলেই কেমন শ্বেতি-শ্বেতি লাগে। যে যার পছন্দমতো পোশাক পরুক না কেন, ও যে কেন এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত অনুরোধ করে! দুর্গাপুজোর সময়েও ও সব্বাইকে গরদ পরিয়ে ছেড়েছিল। তাতে অবশ্য এদেশী ওদেশী সব মেয়েরই রূপ খুলে গিয়েছিল। খালি দীপালি খড়খড়ে গরদের মধ্য থেকে হাঁসফাঁস করেছিল। বেচারি! সুদীপের এই নিজস্ব সংস্কৃতি নিজস্ব সংস্কৃতি বাতিক একেক সময় অস্বাভাবিক মনে হয় কমলিকার। সংস্কৃতি কি কোনও স্থাবর, বদ্ধ জিনিস! বাঁচতে বাঁচতে যেসব নান্দনিক অভ্যাস আপনা থেকে গড়ে ওঠে, তাই-ই তো সংস্কৃতি! সুদীপের মনোভাব ঠিক হলে আদিবাসী কালচারকেই টিকিয়ে রাখা উচিত সর্বত্র। কোনরকম পরিবর্তন পরিবর্ধন না করে! পরো এখন সাঁওতাল রমণীদের মতো হাঁটুর ওপর কাপড়, টপলেস, বাঁকানো খোঁপায় গুঞ্জা ফুলের মালা, সন্ধে হলেই মাদলে চাঁটি, মেয়েপুরুষ সবাই মত্ত হয়ে নাচো!
অতিথিরা সবাই এসে গেছেন। অল্পই লোক আজ সুদীপের নির্দেশমতো। বাবু বলল, ‘মণি, তোর সেই বিশাল পিয়ার-গ্রুপটা ট্রমবোন বাজাতে-বাজাতে আসবে না?’ আরাত্রিকা রাগ-রাগ মুখে বলল, ‘তুই-ই বেশি মিস্ করছিস মনে হচ্ছে?’
শশাঙ্ক জেঠু বললেন, ‘তাইলে কথার পিঠে কথা, তার পিঠে কথা, তার পিঠে আরও কথা এইভাবেই কি চলব? না যে নূতন ম্যাজিকগুলান শো দেওনের কথা চিন্তা করছিলাম, সেগুলান দ্যাখবা?’
আরাত্রিকা বলল, ‘অ্যাটম-বুলেটকে ডাকি তাহলে?’
দীপালি বললেন, ‘থাক মণি, জানিসই তো ওরা কোন না কোনরকম অ্যাক্রোব্যাটিক্স্ ছাড়া থাকতে পারে না। শশাঙ্কদার ম্যাজিকের থলির বারোটা বাজিয়ে দেবে।’
নিজের ঘরে উঁকি দিয়ে আরাত্রিকা দেখল অ্যাটম এবং বুলেট পরস্পরের দিকে খুব রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে অবিরাম ডিগবাজি খেয়ে যাচ্ছে। রাগী-রাগী চোখ মানেই যে সত্যি-সত্যি লড়াই করবে তা কিন্তু নয়। আসলে খুব প্রতিযোগিতার মেজাজে আছে। কিসব রেকর্ড ভাঙাটাঙার কথা বলছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে।
শশাঙ্ক জেঠু বললেন, ‘ম্যাজিকের এট্টা কি বলে স্যাঙ্কটিটি আছে মণি, বালখিল্য দুইটার সে-সব গ্রাইহ্য নাই। আমি উয়াদের ম্যাজিক দেখাইতে উৎসাহ পাই না।’
বললে কি হবে, যে মুহূর্তে শশাঙ্কজেঠু তাঁর নানারঙের তালিমারা ম্যাজিশিয়ানের জোব্বা আর উল্টোনো তালপাতার বাঁশির মতো ট্যাম-ও-শ্যান্টার টুপি পরে ঝুলি থেকে তাস বার করেছেন। দুজনেই দেখা গেল ডিগবাজি ভুলে, কুইক মার্চ করে এসে ঘরের এক কোণে বসে গেছে আসনপিঁড়ি হয়ে। গালে হাত রেখে খুব তীক্ষ্ন চোখে নিরীক্ষণ করতে করতে বুলেট বলল, ‘কি রকম চীট করছে দেখেছিস এ যাদুকরটা! হার্টস-এর ওই তিরিটার মাঝখানের ফোঁটাটা লুস তো, টুক করে সরিয়ে ফেলবে, দেখবি দুরি হয়ে যাবে।’ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলবার চেষ্টা করলেও বুলেটের গলায় ষাঁড়ের জোর, বেশ ভালো করেই শোনা গেল ওর কথা।
শশাঙ্ক জেঠু কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ম্যাজিকের স্যাঙ্কটিটি নষ্ট হইয়া যায় দীপালি, তর বীজকলাইগুলান সামলা।’
দীপালি বললেন, ‘পাগলে কি না বলে শশাঙ্কদা। আমরা ওসব অপবিত্র কথা কানে তুলছি না। আপনি চালিয়ে যান।’
‘তাইলে আমি এবার ছুট্ট হইয়া যাওনের সেই খেলাটা দেখাই!’
‘সেটা আবার কী খেলা জেঠু?’ বাবু জিজ্ঞেস করল।
‘কি ব্যাপার সেইটা ঘটলেই দ্যাখা যাইব। অত ব্যস্ত কি? ওষুধ খাইয়া অ্যালিসের তালগাছের মত হওন, আবার ছুট্ট কুট্টিটি হওনের কথা তো আর ক্যারলসাহেবের বানানো না! ওসব ঘটে। তবে তোমারে এট্টু সাহাইয্য কইরতে লাগব। বাতিগুলান নিভাও। বাঁশি বাইজলেই জ্বালবা। আর তফাৎ থাকবা সব।’
ঘরের আলো নিভে গেল। ঘোর অন্ধকারে লম্বা ঘরের শেষ প্রান্তে সোফার পেছন থেকে রহস্যময় নানারকম আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা ভুতুড়ে শিস। বাবু শশাঙ্কজেঠুর নির্দেশমতো এদিকের একটা আলো জ্বেলে দিল। দেখা গেল সোফার মাথায় এক অদ্ভুত প্রাণী দাঁড়িয়ে। ছোট্ট কোট, ছোট্ট প্যান্ট, আর লম্বা লম্বা জুতো পরা ছোট্ট শশাঙ্ক জেঠু, চোখে প্যাঁশনে। ‘আবোল তাবোল’-এর কোনও খিচুড়ি প্রাণীর মতোই দেখাচ্ছে অবিকল।
তানি বলল, ‘ইস, কি প্যাথেটিক দেখাচ্ছে, না?’
জ্যোতি বললেন, ‘আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে ভাই। শশাঙ্কদাটা ওষুধ খেয়ে এরকম ‘ছোট্ট কুট্টিটি’ হয়ে গেল, আর কি আগের মতন হবে? আর কি ‘আমাগো তগো’ করবে?’
দীপঙ্কর আর জ্যোতি দুজনে মিলে শোকপ্রকাশ করতে লাগলেন। কখন যে অ্যাটম গুটিগুটি ওদিকে চলে গেছে কেউ লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ চিৎকার করে বলল, ‘ওমা! শশাঙ্কজেঠু হাতে জুতো আর প্যান্ট পরেছে। ছোট্ট হয়েছে না আরও কিছু। এই তো লম্বা লম্বা পা দুটোকে সোফার পেছনে গুটিয়ে রাখা হয়েছে। হাতকে পা বানানো হয়েছে! হুঃ!’
সোফার পেছন থেকে অসহায় যাদুকরকে টানাটানি করতে করতে দু ভাই বলতে লাগল, ‘তুমি একটা ফার্স্টক্লাস চিট। চোট্টামিতে গোল্ড মেডল পাবে। এসব চলবে না। চলবে না।’
ঘরভর্তি হাসি মধ্যে শশাঙ্ক সরকার ঘোষণা করলেন অদ্যই শেষ রজনী। এই বিচ্ছুদুটি থাকলে তিনি আজই তাঁর যাদুকর জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করছেন।
অ্যাটম বলল, ‘বেশ তো হুডিনির মতো আসল ম্যাজিক দেখাও না। তোমাকে আমরা একটা বাক্সে পুরে ঝপাং করে হাডসনের জলে ফেলে দেবো। তুমি গুনে গুনে সাড়ে সাতচল্লিশ মিনিট পরে উঠে আসবে।’
বুলেট বলল, ‘ওই আয়রন চেস্টের চাবিটা আমার কাছে থাকবে কিন্তু।’
শশাঙ্কজেঠু কাতর চোখে দীপালির দিকে চেয়ে বললেন, “আবোল তাবোল” পড়ছস?’
‘পড়েছি বোধহয়!’
‘“বাপ রে কি ডানপিটে ছেলে” মনে পড়ে? “কোনদিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে?” মহাপুরুষ আওনের বহু পূর্বেই বার্তা রটে দীপালি। কত বস্ছর পূর্বেই সুকুমার রায় মহাশয় তর মহাপুরুষ ছাওয়াল দুইটার আওনের কথা ঘোষণা করছেন, সাবধানে থাকস ভাই।’
কমলিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে বললেন, ‘আটটা বাজলো জ্যোতিদা একবার ইনস্টিট্যুটে ফোন করবে নাকি? আমাকে কিন্তু এবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
জ্যোতি বললেন, ‘তা করছি। কিন্তু খাওয়ার আগে একটু গান টান হবে না? প্রিয়াঙ্কা আরম্ভ করুক···’
নীচে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। বাবু এক দৌড়ে নেমে গেল। একটু পরেই কমলিকা অবাক হয়ে দেখলেন দু হাতে দুটো চামড়ার সেকেলে সুটকেস নিয়ে বাবু ঢুকছে। তারপরে ধবধবে ফর্সা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পেছনে আরেকটা সুটকেস হাতে সুদীপ।
হেসে কেঁদে কমলিকা বললেন, ‘মা! বাবা! তোমরা আসছ আমি কিছু জানতে পারিনি তো!’
সোমনাথবাবু বললেন, ‘সুদীপের তোকে সারপ্রাইজ দেবার শখ খুকি, চিঠিপত্র সব খালি ওর অফিসের ঠিকানায় দিতে বলে। আমিও বুড়ো বয়সে জামাইয়ের কথায় একটু লুকোচুরি খেলে নিলুম মেয়ের সঙ্গে। ও কি! কাঁদছিস কেন!’
কমলিকা ততক্ষণে বসে পড়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছেন। এ কান্না আনন্দের না অভিমানের তিনি জানেন না। সুদীপ হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘এবারের জন্মদিনে এই-ই তোমার আসল উপহার মণি।’ কমলিকার দিকে আড়চোখে চেয়ে বললেন, ‘এখন যে যতখুশি কাঁদতে পারে, কি বলো দীপালি! তবে আমার আর জ্যোতির ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ হলেই কিন্তু আমরা হাসতে থাকি।’ বলে সত্যি-সত্যি অট্টহাস্য করে উঠলেন সুদীপ। অর্কেস্ট্রার কনডাক্টরের মতো হাত ছুঁড়তে লাগলেন, ফলে সরু মোটা নানান গলায় হাসির শব্দ উঠল।
অ্যানও হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রিয়াঙ্কার ডরকার ঠাকছে না। মণি, এইটা টোমার প্রপার বার্থ ডে কনসার্ট হোছে।’
সম্মিলিত হাসির ঐকতানের মধ্য থেকে কমলিকার চোখে মুখেও হাসি, বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে দেখা গেল। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ প্রার্থনা করলেন, উত্তমর্ণ রক্ত এবার স্বাভাবিক নিয়মে তার নিজের পাওনা আদায় করে নিক। শ্বশুর-শাশুড়িকে ব্রুকলিনের পার্থিব সমৃদ্ধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার মাঝ মধ্যিখানে একটা জীবন্ত স্মারকলিপির মতো পেশ করা গেছে। যুক্তি দিয়ে যেখানে কিছু হয় না, বুদ্ধি দিয়ে যেখানে বোঝানো যায় না, রক্ত সেখানে নিজের নিয়মে ফুসফুসীয় ধমনীর দিকে বয়ে যায়। বিশুদ্ধায়নের পর হৃৎ-কেন্দ্রে এখন সেই রক্তের সঞ্চয় বাড়ছে। বাড়ুক। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন সেই শুভক্ষণটির জন্য যখন কমলিকার অন্তর হাহাকার করে বলে উঠবে, ‘আমাকে আমার নিজের সাগরে নিয়ে চলো।’
লিভিংরুমের কার্পেটের ওপর স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে ওরা। আদৌ শুতে যাবার ইচ্ছে ছিল না। দীপালিরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে পারেননি। প্রিয়াঙ্কা গেছে খুব অনিচ্ছুক মুখে। মণির দাদু-দিদিমা এসেছেন অতএব ওদেরও ভাগ চাই। আদর-টাদরের সম্ভাবনা দেখলেই সব কটা ছেলেমেয়ে বুভুক্ষুর মতো পাতা পেতে সেখানে উপস্থিত। সবাইকার জন্য উপহার এসেছে। জ্যোতির ছেলেমেয়েদের ভালোই চেনেন সোমনাথ-যূথিকা। ছবিতে-চিঠিতে দীপঙ্করের মেয়েও চেনা। জয়পুরী মিনের গয়না, র’ সিল্কের পীস, টাঙাইল শাড়ি। অনেকক্ষণ কাড়াকাড়ি হল সেগুলো নিয়ে। আরাত্রিকা দিদিমাকে ওদের হিউসটনের কালচার্যাল প্রোগ্রামের টেপ শোনাবেই।
কমলিকা বললেন, ‘ওসব শুনিয়ে কী হবে? ভালো ভালো ভজন আছে শুভলক্ষ্মীর, শুনবে মা?’
সোমনাথ বললেন, ‘ওসব তো শুনছিই। ওই নিয়েই তো আছি রে। আজ এখন তোদের শুনি।’
সুদীপ বললেন, ‘যা বলেছেন। এরা সব চব্বিশ ঘন্টা কোন না কোন নয়েজ ছাড়া থাকতে পারে না।’
সোমনাথ বললেন, ‘এটা খুব সম্ভব যুগেরই হাওয়া। আমাদের ওপর তলায় অবিনাশবাবুর নাতি-নাতনিরাও দেখি স্টিরিও চালিয়ে দিয়ে অঙ্ক কষছে। কখনও শুনেছো?’
‘আমরা সব পড়াশোনা করতুম পিন-ড্রপ সাইলেন্সে, বলুন বাবা?’ ছোটদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন সুদীপ।
অ্যাটম বলল, ‘মিউজিক হ্যাজ আ সুদিং এফেক্ট অন নার্ভস!’
সুদীপ বললেন, ‘আহা, কি মিউজিক রে! ঝমাঝ্ঝম্ জ্যাং ঝুং ঝাং, ঝুং ঝাং জ্যাম্। আসল কথা, তোদের নার্ভস্ নেই, ও সিস্টেমটাই তোদের বাদ। আমরা ছোটবেলায় কি সব শুনতুম আহা! সায়গল! আঙুরবালা! কি বলুন বাবা!’
সোমনাথবাবু সুদীপের মিটিমিটি হাসি দেখতে পাচ্ছিলেন না। স্মৃতিবিধুর গলায় বললেন, ‘রাধিকা গোস্বামীর গান তো আর শোননি সুদীপ! কি নাদ! কি গমক গলায়! সাবলাইম!’
অ্যাটম বুলেট তক্ষুণি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিল। ‘ঠিক আছে। জ্যাজ দাদুর ভালো না লাগতে পারে। কিন্তু ব্যারি মেনলো কি বারবারা স্ট্রাইসেন্ড শুনলে দাদু ফ্ল্যাট হয়ে যাবেন। যেতেই হবে।’
কমলিকা মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন, ‘এই ক’ বছরেই তোমার চেহারা এতো খারাপ হয়ে গেল কী করে মা? কী হয়েছে তোমার?’
‘বয়স হয়েছে কুমু, বয়স। আবার কী হবে? চেহারা কিছুই খারাপ হয়নি। আটষট্টি বছর বয়স হল। চামড়া কুঁচকোবে না? মোটা ছিলুম তো গুচ্ছের! ঢিলে হয়ে গেছে সব!’
‘পঁচাত্তরে যখন গেছি তখন তো এমন ছিলে না!’
‘মাঝখান দিয়ে ছ’ ছটা বছর কেটে গেছে। বুড়ো বয়সে ছ বছর কি কম?’
‘দাদার কী খবর?’
‘লালটু সাকেতে ফ্ল্যাট করেছে। ভালোই করেছে। কুড়িটা বচ্ছর তো কাজেকর্মে ওখানেই কেটে গেল।’
‘তা তোমরা তো দাদার কাছে চলে গেলেই পারো, মা! বুড়ো হয়েছ, একা-একা থাকার দরকার কি?’
যূথিকা চুপ করে রইলেন। সোমনাথবাবু বললেন, ‘বুড়ো বয়সে নিজের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার বড় অসুবিধে খুকি। তাছাড়া অবিনাশবাবুর ছেলেগুলি খুব ভালো হয়েছে। খুব দেখাশোনা করে।’
ঘূথিকা বললেন, ‘এই যে চলে এলুম চাবি ওদের কাছে। ঘরদোর খুলিয়ে রোজ ঝাড়পোঁছ করাবে, যখন ফিরে যাবো, সব টিপ-টপ পাবো। বউগুলিও যেমনি কাজের, তেমনি ভালো। বাড়িঅলা বলে মনেই হয় না। না রে, আমরা ভালোই আছি।’
কমলিকা নিঃশ্বাস ফেলে চুপিচুপি বললেন, ‘আমাদের জন্যে তোমার মন কেমন করে না মা? না, অভ্যেস হয়ে গেছে?’
যূথিকা বললেন, ‘এসব কি কখনও অভ্যেস হয় কুমু? আপন কেউ কাছে থাকে না। আমাদের বুড়ো-বুড়ির দিন কিভাবে কাটে আমরাই জানি। উনি আমায় সেঁক-তাপ দিচ্ছেন, আমি ওঁর বাতের তেল মালিশ করে দিচ্ছি। এই তো অবস্থা! তবে কি জানিস! তোরা সব যে যার জায়গায় সুখে আছিস, ভালো আছিস, এর চেয়ে সুখ আর আমাদের কিছুতে নেই!’
‘বারে’ আস্তে আস্তে বললেন কমলিকা, ‘আমরা সুখে থাকলেই তোমাদের সুখ! তোমাদের কোনও নিজেদের আলাদা আনন্দ আলাদা সুখ থাকবে না?’
সোমনাথবাবু বললেন, ‘না খুকি, ছেলেমেয়েরা নাতি নাতনিরা কাছে থাকলে তাদের জীবনে একটা আলাদা জীবন পাওয়া যায়। নইলে বৃদ্ধ বয়সের পৃথিবী বড় বিবর্ণ। জঞ্জাল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না মা। মৃত্যু ছাড়া কোনও প্রার্থনাও জাগে না আর। তবে, বুড়োবুড়ির মধ্যে যে আগে যাবে সুখে যাবে। কে পড়ে থাকবে সেই ভাবনা। তোদের শেষ দেখা দেখবার জন্যই তো আসা!’
মা বাবা ঘুমিয়ে পড়বার পরও অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না কমলিকার। দিনগুলো কিভাবে কেটে যায়! এই তো সেদিন মা না বলে বাথরুমে গেছেন বলে ছোট্ট কুমু পরিত্রাহি চিৎকার করছে। না বলে কয়ে বাথরুমে যাবারও উপায় ছিল না মায়ের। মেয়ের হাতে কি বন্দীদশা! চিন্তা করা যায় এখন? পেপার পড়তে পিট্সবার্গ গেলেন, ভেবেছিলেন মণিকে দীপঙ্করের বাড়ি রেখে যাবেন। চার বছরের মণি অনায়াসে ছোট্ট ছোট্ট হাতে তাঁকে টাটা করে দিল। পিটস্বার্গ হোটেল থেকে প্রথমেই বাড়িতে ফোন, সুদীপ বললেন, দুধের বোতল আর পুতুল নিয়ে সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে, খালি একবার জিজ্ঞেস করেছে, মা পড়া দিতে পারবে তো? মায়ের আঁচল মুখে পুরে ঘুমোবার বদভ্যাস ছিল কুমুর। রাতে ঘুম ভেঙে মাকে কাছে না পেলে সাংঘাতিক কাণ্ড হত! লোক না এলে মা যখন বাসন মাজতেন কুমুর বুকটা ফেটে যেত। আকুল হয়ে কাঁদতে থাকত, ‘ওসব থাকগে পড়ে, তুমি শীগগির চলে এসো।’
‘সে কি রে? বাসন না মাজলে তোরা খাবি কিসে?’
‘মেঝেতে খাবো।’
‘রাঁধতেও তো হবে। রাঁধবো কিসে?’
‘মেঝেতে রাঁধবে।’
বাড়িতে একটা স্থায়ী তামাশা হয়ে গিয়েছিল ‘মেঝেতে রাঁধা মেঝেতে খাওয়া।’ সেই কুমু আজ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার! সেই মা, সেই বাবা বৃদ্ধ, নির্বান্ধব। বাড়িঅলার ছেলে, ছেলের বউদের ভরসায় দিনযাপন করছেন। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে কমলিকার। কলেজ থেকে কাটা ফল খেয়ে এসে কলেরা হয়েছিল কমলিকার। মায়ের সে কী পরিশ্রম! উদ্বেগ! দাদার দুবার টাইফয়েড রিল্যাপ্স্ করল। বাঁচার আশা ছিল না। মা বাবার সেই অমানুষিক সেবা ছাড়া বাঁচা সম্ভব ছিল না। এতদিন এই কান্না কোথায় ছিল? নিজের ছেলে-মেয়ে-স্বামী বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে কমলিকা যখন কোনও রবিবার সন্ধ্যায় গান-হাসি হইহল্লা সহযোগে ইটালিয়ান লাজানিয়া খাচ্ছেন, লবস্টার ইন ব্ল্যাক বীন সস অনুপান আছে, মেয়েদের জন্যে জিন অ্যান্ড টনিক, ছেলেদের ভডকার সঙ্গে টোম্যাটো সস মিশিয়ে ব্লাডি মেরি, মাইনরদের কোক তখন ধোঁয়াশায় ভরা ভবানীপুরের গলির একতলায় মুখোমুখি বসে নিঃসঙ্গ মা বাবা। নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কমলিকা উঠে বাথরুমে গেলেন। ফিরে দেখেন সুদীপ বসে আছেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি ঘুমোও নি?’
সুদীপ বললেন, ‘তুমিও তো দেখছি জেগে আছো।’
কমলিকার মাথা সুদীপের বুকের ওপর। মাথার চুলে ঠোঁট রাখলেন সুদীপ, বললেন, ‘তুমি যে আমাকে থ্যাঙ্কস দিলে না?’
‘দিয়েছি ঠিকই। মুখে না বললে দেখছি আজকাল তুমি ধরতে পারো না।’
‘ঠিকই। আমি আজকাল ব্লান্ট হয়ে যাচ্ছি, তার মানে ফুরিয়ে যাচ্ছি, কমলিকা।’
সুদীপের কানের কাছে পাকা চুলগুলো টানতে টানতে কমলিকা বলেন, ‘এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেলে চলবে কেন? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না। ভাবতেও ভালো লাগে না।’
সুদীপ খুব মৃদু ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘বয়স তোমার ভালা লাগালাগি বিচার করে আসবে না কমলিকা। এজ ইজ রিয়্যালিটি। আর কে যে কখন ফুরিয়ে যাবে আগে থেকে বলা যায় না। তবে সারাজীবনই খুব হেকটিক লাইফ কাটিয়েছি। এই র্যাট রেস আমার আর ভালো লাগছে না। অনেক দিন যৌবন ভোগ করেছি, আমি এবার প্রৌঢ়ই হতে চাই। গত পনের বছরে কটা পেপার পাবলিশ করেছি হিসেব আছে? পনের দুগুণে তিরিশটা প্লাস পাঁচটা। এর মধ্যে গোটা বারো করেছি আমার নিজের আনন্দে, নিজের তাগিদে। বাকি সব ওই র্যাট রেস আমার ঘাড় ধরে করিয়ে নিয়েছে। এভাবে শুধু কাজের জন্য কাজ আমি আর পারবো না। এ অবস্থাটার চেঞ্জ হওয়া আমার পক্ষে ভয়ানক জরুরি। আমার পক্ষে, তোমার পক্ষে, ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখ চেয়ে, শুধু মেয়ে বড় হচ্ছে বলে নয়। যদিও সেটাও একটা বড় কারণ।’
সুদীপের কোলে মুখ গুঁজে কমলিকা বললেন, ‘তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো। আমি কিছু বলব না।’
‘তা হয় না কমলিকা। আমি যা ভালো বুঝি তা আমি মোটেই করব না। তোমার যদি ভেতর থেকে সম্মতি না আসে, এখানেই থেকে যাবো। হিউসটনে কেস করেছি, চেয়ারম্যানশিপ পাবার জন্যে। এখানে এসে আবার আবিষ্কার করলুম একই পোস্টে অ্যামেরিকানদের মাইনে আমার দেড়া। আলেকজান্ডারকে আমি এখনও রাজি করাতে পারিনি। বললেই বলে—‘তুমি তো চাওনি’। আসলে দরাদরিটা আমার গোড়াতেই করে নেওয়া উচিত ছিল। ও সেটারই সুযোগ নিচ্ছে। হিউসটনের মামলার পরও আমার সরল বিশ্বাস থেকেই গেছে। দেখো আমরা এশিয়ানরা আন্দোলন করে ‘মাইনরিটি স্টেটাস’ পেয়ে গেছি। তবু এই বৈষম্যময় আচরণ ওদের রক্তে। বাইরে থেকে কিচ্ছু বুঝবে না। আমি ওহায়োতে চিঠিপত্র লেখালেখি করছি। তুমি যদি ফিরতে রাজি না থাকো তো ওখানেই চলে যাবো। ওখানে না পোষালে অন্য কোথাও, এইভাবেই চলবে। তুমি যা বলবে।’
—‘আমি সত্যি সত্যিই মন থেকে বলছি, চলো আমরা ফিরেই যাই।’
—‘না কমলিকা, তোমার সম্মতিতে আন্তরিকতা নেই। তুমি আমার কথা ভেবো না, ছেলের কথা না, মেয়ের কথাও না। মনে করো আর তিন চার বছরের মধ্যে মেয়ে কলেজ হোস্টেলে, বলা যায় না হয়ত কোনও ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করছে, বাবু চাকরি করছে অন্য কোনও স্টেটে, কিম্বা দেশে ফিরে গেছে। তুমি এইরকম একটা কৌটোর মতো অ্যাপার্টমেন্টে একা। আমি····আমি হয়ত নেই আর····।’
কমলিকা সুদীপের মুখ চেপে ধরলেন। প্রথমটা কিছুই বলতে পারলেন না। অনেকক্ষণ পর স্বর ফিরে পেয়ে বললেন –‘তুমি আমাকে এইভাবে ভয় দেখাবে তাই বলে? আমি আন্তরিকভাবেই সম্মতি দিয়েছি। আর সত্যিই তো, যখন আসি থেকে যাবার প্ল্যান তো আমাদের ছিল না। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই, আবার পরিবর্তনে ভয় লাগে।’
সুদীপ বললেন ‘তোমার ভয় লাগার কোনও কারণ নেই। দেখো। মণির নাইনথ গ্রেডটা হয়ে যাক। ততদিন মা-বাবা এখানেই থাকুন। আমারও অনেক ব্যবস্থা করার আছে।’
দূরের ঘণ্টা বাজছে সুদীপ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। চুলে-ভরা মাথাটা কোলের ওপর পড়ে রয়েছে পরম ভরসায়। ছোট্ট একটা নিশ্বাস পড়ল শুধু। তাও খুব সন্তর্পণে।