জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 04
অ্যালাবামার একশ আঠার নম্বর গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে চলেছি। আমি আর কুপার। মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছি। আপাতত দু পাশে শুধু গাঢ় সবুজ প্রকৃতি। বাইরে প্রচণ্ড গরম বুঝতে পারছি। কুপারের ওল্ডসমেবিলটার ভেতরে বসে স্বভাবতই কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অ্যান মারের কানট্রি সঙ্ বাজছে। শুনতে শুনতে ভাবছি নার্ভ বাউল কিম্বা ভাটিয়ালি এই পরিবেশে কি রকম খাপ খেত। খুব সম্ভব কুপারের নার্ভ আরও শান্ত হয়ে যেত তাতে। পশ্চিমে সাধারণত প্রাচ্য সঙ্গীত পছন্দ করে না। সমারসেট মমের কোনও একটা গল্পে ব্রেন-ফিডার-বার্ড-এর একঘেয়ে ডাকের সঙ্গে প্রাচ্য সঙ্গীতের তুলনা পড়েছিলুম। কিন্তু ভাটিয়ালি বা বাউলের একটা আন্তর্জাতিক আবেদন থাকতে বাধ্য। সঙ্গীতের ভাষা এমনিতেই আন্তর্জাতিক। এবং ভাটিয়ালি যেহেতু নদীর ভাষা আর বাউল গ্রাম্য প্রকৃতির অন্তরতম সত্তার ভাষা তাই বাউল-ভাটিয়ালি সর্বত্র জয়ী হতে বাধ্য। গরমে একটা কাঁপা কাঁপা ধোঁয়া মাটি থেকে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। বেশি কিছু পরিকল্পনা না করেই বেরিয়ে পড়েছি। সঙ্গে কুপারের কলি কুকুর রোভার ছাড়া কেউ নেই। কুপার বলল, ‘ভীষণ তেষ্টা সডি, আর কতক্ষণ?’। ঠিক তখনই মাটি থেকে ওঠা তাপের কম্পমান শিখাটার পেছনে দোকানটা দেখতে পেলুম, ‘ফিলিপস মেমারি স্টোর।’ কাঠের তক্তা জুড়ে জুড়ে করা। যেন একখণ্ড ড্রিফ্টটড্ কেউ রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ওপরে লাল বোর্ডে লেখা কোকা-কোলা। নীচে লেখা ‘এনজয় সুগার-ফ্রি কোলা।’ ঠিক জায়গাতেই এসেছি। গাড়ি থামিয়ে আমরা ছুটে গেলুম। পৰ্চটা পার হয়ে, নীল ওভার অল পরা কৃষাণটিকে ছাড়িয়ে। কাউণ্টারের পেছনে মোটা সোটা মহিলাটির অবাক চোখের সামনে আমরা আমাদের ট্যাণ্টালাস বা অগস্ত্য-তৃষ্ণা মেটাতে লাগলুম। আধ গ্যালন কমলালেবুর রস, দুজনে মিলে চার বোতল কোক, আধ গ্যালন গ্রেপফ্রুট, এক গ্লাস করে ঠাণ্ডা দুধ, তারপর ঢকঢক ঢকঢক করে খালি জল। গ্যালন দুই তো হবেই। পেট জয়ঢাক একেবারে। একটা হোস টেনে নিয়ে রোভারের গায়ে জল ছাড়তে লাগল কুপার। রোভার গা ঝাড়ছে আরামে আর চারদিকে বাষ্পবিন্দু ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লম্বা দুটো স্টুল নিয়ে বসে পড়েছি দুজনে। রোভারটা জিভ বার করে সামনের প্যানে রাখা জল চাটছে। আর মাঝে মাঝে কুপারের দিকে চেয়ে জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে। ওকে এভাবে কষ্ট দেবার জন্যে কুপারকে জিভ ভেঙাচ্ছে কিনা বুঝতে পারলুম না।
জ্যাক কুপার একজন ভীষণ উদ্বিগ্ন মার্কিন যুবক। নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে কনেকটিকাটের গ্রীনিচ্ গ্রামে জন্ম। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার সঙ্গে আলাপ। এই প্রথম একজন আমেরিকানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল। কুপারের ব্যাপারটা হল অনেক দিন ধরেই ওর মার্কিন আত্মবিশ্বাসে চিড় খেয়ে যাচ্ছিল। ছাত্র আন্দোলন, শান্তি মিছিল, জাত নিয়ে হিংস্রতা, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারী এই সমস্তর মধ্যে দিয়ে ষাট সত্তর দশকে বেড়ে উঠেছে ও। ওর মনে হয়েছে ওর দেশ বুঝি অকূল পাথারে ভেসে যাচ্ছে। ভীষণ অশান্তি। রোজই রাত্তিরে এসে আমার ঘরে টোকা দিত। শেষে একদিন বলল, ‘সডি, নিজের দেশ নিয়ে চিন্তা হয় না তোমার?’
আমার দেশ? আমার দেশের অসুখ যে কত গভীরে কিভাবে আমি কুপার নামের এই বালকটিকে বোঝাই? ও শুধু ওর মায়ের স্কার্টে একটা ফুটো দেখেই এমন করছে যেন সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। শতচ্ছিন্ন আঁচলে লজ্জায় মুখ-ঢাকা আমার মাতৃভূমির কথা ও কি বুঝবে? বাবা-মা সব সময়ে যেতে না পারলেও আমি কিন্তু বারে বারে একা-একা ফিরে গেছি দেশে। দুর্নীতির কি পচা ঘা থিকথিক করছে ওপর তলায় নীচ তলায়! দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধি! দাদু বলছিল, মাসের শেষে স্যালারি চেক নিতে গেলে ঘুষ দিতে হবে। এমন দিন আসলেও অবাক হবো না। রাজনীতি আর শো-বিজে এখন কোনও তফাত নেই। নিজস্ব সংস্কৃতির নামে যে যার কায়েমি স্বার্থ আঁকড়ে আছে, দরকার হলে সংসার আলাদা করবে তবু সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়বে না। ভিন্ন দেশের গুপ্তচরবৃত্তি করবে তবু স্বদেশের সংবিধান-সিদ্ধ কাজে হাত মেলাবে না। আর ল্যাবরেটরীর নোংরা রাজনীতির সঙ্গে আপস করতে না পেরে পালিয়ে আসছে বিজ্ঞানীরা, প্রযুক্তিবিদরা। আমেরিকা তাদের চাঁদি দেখিয়ে ডাকছে। গ্রেনাডা-ক্যারিবিয়ান সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তী যা বলেছেন, প্রবাসী ভারতীয়দের সম্পর্কে সেই কথাগুলোই কেন জানি না আমার মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
এই দ্বীপে আছে আজো যারা ভারতীয়
আড়কাঠি সাম্রাজ্যের ছলনায় আনা
জায়ফল ঘন বনে ছায়া-প্রায় তারা সর্বহারা
ভাষা-সংস্কৃতিও ক্লিন্ন ক্ষীণ।
কে বা জানে তাদের নির্বিতি
ধিকি ধিকি আসবে কবে ইতিবৃত্ত ভোলা এ সংসারে;
দূরের ভারতবর্ষ আজো উদাসীন অসহায়।
টাকাকড়ির দিক দিয়ে তারা সর্বহারা নয় ঠিকই। কিন্তু ওইসব মূল্যবান মস্তিষ্ক যখন ফলপ্রসূ হবে হতভাগ্য ভারত জানতেও পারবে না। সে ফলের অংশীদার হওয়া তো দূরের কথা। স্বদেশের চিহ্ন এই ক্ষুদ্র সমাজে মেয়েদের শাড়ির বাক্সয়, কিছু পুরুষের রাত্রিবাসে, চোখমুখের আদলে বেঁচে আছে। আর একটা প্রজন্ম পরেই ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সেই জনের আত্মপরিচিতিহীন নিয়তির অন্ধকারে কিছু না জেনেই প্রবেশ করবে সে। ওই ক্ষীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে বাটিকের দুর্গাঠাকুর পুজো করে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বাংলা সাইক্লোস্টাইল পত্রিকায় বাঙালি আড্ডার ইতিহাস পর্যালোচনা করে। বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে। নিজমূল থেকে উৎপাটিত এই সংস্কৃতি পরের প্রজন্ম কখনও গ্রহণ করবে না। এসব বিদ্যা শিখতে হয় চীনেদের কাছ থেকে। যেখানেই যায় বানিয়ে নেয় চায়না টাউন। আমাদের একদেহে লীন হয়ে যাবার সহজ মন্ত্রটা জানা আছে। আত্মস্বাতন্ত্র্যের মশাল জ্বালিয়ে রাখবার কৌশলটা আমরা জানি না। লীন হয়ে গেলেই যে চমৎকার একটা বিশ্বজনীন সভ্যতার সব পেয়েছি জিমনাসিয়ামে ঢুকে পড়ে ইচ্ছেমতো খেলাধুলো করা যাবে তা কিন্তু নয়। প্রতি পদে আইডেনটিটির সঙ্কট আমাদের বিদ্ধ করবে, বধ করবে।
কুপারের সঙ্গে সেবার সেই আমেরিকা-আবিষ্কার যাত্রায় বেরিয়ে আমার কিন্তু একটা সত্যিকার লাভ হয়েছিল। ছোটবেলার মার্কিন পরিপার্শ্ব থেকে যে ঘৃণা সংগ্রহ করে বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছিলুম, তার অনেকটাই মুছে গিয়েছিল। নিউ অর্লীন্স থেকে যাত্রা শুরু করি। অ্যালাবামা নদীর যাত্রাপথ ধরে অরভিল, সেলমা, তারপর পুবদিকে সরে বার্মিংহাম, শেফীল্ড, সামারটাউন, রবিন্সভিল। সেখানে গাড়ি বিক্রি করে অ্যাপালেচিয়ান পর্বতশ্রেণীতে ট্রেকিং। ব্লুফিল্ডে ব্লিজার্ড। তারপর আবার সমতল, ছোট শেনানডোয়া নদীর নীলচে সবুজ জল। শেনানডোয়া ন্যাশনাল পার্কের প্রাণবন্ত সবুজ। তারপর পশ্চিমে বেঁকে ওয়াশিংটন ডিসি। ভাগনার্স গ্যাপে, প্রায় ১৪৭৯ ফুট উঁচুতে মাথার ওপর দিয়ে বুলেটের মতো ছুটে যাচ্ছিল হক আর ফক্ন্। সে যে কি দারুণ অভিজ্ঞতা! ফিলিপ’স মেমরি স্টোরের মোটাসোটা মালকিন ডরোথি এবং তাঁর স্বামী, ছেলে ফিলিপকে হারিয়ে তার স্মৃতিতে দোকান দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাদের মনের শান্তির জন্য প্রার্থনা করবেন। গাড়িতে ভরে দিয়েছিলেন কমলালেবুর রসের ক্যান, লাল চুনীর মতো জ্বলজ্বলে আপেল, জলপাই, অ্যাভোক্যাডো। অ্যাপালেশিয়ানে ওঠার আগে মার্ফি বলে একটা জায়গায় তিন চারদিন থেকে যেতে হয়, কুপারের পা মচকে গিয়েছিল। আমাদের আশ্রয় দেয় ‘টেক্সানা’ নামে এক কৃষ্ণগোষ্ঠীর একটি পরিবার। ওদের মেয়ে হল বংশের প্রথম কলেজ গ্র্যাজুয়েট। কুপার বলল—ওর বোনের নামও মেরি এলিজাবেথ। ‘মাই ব্ল্যাক সিসটার অ্যাণ্ড মাই হোয়াইট সিসটার’··ভাবে বুঁদ হয়ে থাকত তখন আমার বন্ধু কুপার। আমেরিকান ঐক্য, আমেরিকান সংহতির সন্ধান ও খুব সম্ভব এমনিভাবেই পায়। গ্রীনিচে ফিরে পাক্কা দেড়দিনের বিশ্রাম ঘুম নিয়ে কুপার বলল, ‘খবরের কাগজওয়ালারা, এমন কি সমস্ত মাস মিডিয়া যে একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যেবাদী এতে ওর কোনও সন্দেহই নেই। ওর মাতৃভূমির কোনও অসুখ নেই।
সেই থেকে কুপারের আর আমার নেশাই হয়ে গেল ঘোরা। ক্যানিয়নল্যাণ্ডটা পুরো হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখেছিলুম। প্রকৃতির অদ্ভুত সৃষ্টি কলোরাডো নদী খাত গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন। আমরা য়ুটার দিকে গিয়েছিলুম রক আর্ট দেখতে। ক্যানিয়নের বুকে আদি মানবদের শিল্পকীর্তি। কিছুটা বাদে বাদে লম্বা লম্বা ছায়া ছায়া মূর্তি সব। যেন প্রেত। প্রকৃতির কোলের এই লুভরে হোলি গোস্ট অ্যাণ্ড ফ্যামিলি নামে খ্যাত ত্রিমাত্রিক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল যারা এসব করেছিল, কোন সুদূর অতীত যুগে তারা বোধহয় মনুষ্যজাতির উৎসর আদিতত্ত্বটা জানত। কিছুই নেই থেকে সব কিছু এর মধ্যেকার মিসিং লিঙ্কটা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল।
এই বিশ্বজনীন মানবসভ্যতা, বিশাল ইতিহাস, অকল্পনীয় কীর্তি, ঐতিহ্য—এর উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা কিই বা করলুম? ছুটছি অথচ পৌঁছতে পারছি না, ছুটছি অথচ সোজা না গিয়ে নানান বাঁকা পথে দৌড়চ্ছি, সভ্যতার এই কালক্ষেপকারী ম্যারাথন দৌড় শেষ হবে কবে?
মা ফোন করেছিল মণির বার্থডে, যেতে হবে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। মণির বার্থডেতে আমাকে কেন? ওর পিয়ার-গ্রুপটা একেবারে যাকে বলে বিদঘুটে। মা-বাবাকে অনেকদিন আগেই বলেছি আমার মতো ওকে প্রাইভেট স্কুলে দিতে। ব্রুকলিনে একটা ফরাসী মিশনারি স্কুল আছে, সেটাতে অনায়াসেই দিতে পারত। পাবলিক স্কুলগুলোর সাঙ্ঘাতিক টাকা। স্টেট গ্রাণ্ট, এ গ্রাণ্ট, ও গ্রাণ্ট। সবই ট্যাক্সপেয়ারদের টাকা অবশ্য। কিন্তু তাই দিয়ে ওরা ভীষণ একটা ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দেয়। টিপিক্যাল মার্কিন মানসিকতা আর জীনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েগুলো। আমাকে বাবা হিউসটনে একটা মিশন স্কুলে দিয়েছিল। খুব শান্ত পরিবেশ। রক্ষণশীল। একটু বেশি ধর্ম-ধর্ম বাই। কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় নি। ক্রুস কাঠে ছেলেমানুষ যিশু বেচারার আত্মহত্যার দৃশ্যটা কল্পনা এবং চিন্তাশক্তিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। বাবা মণির বেলায় ভিন্ন নীতি নিল কেন জানি না, বোধহয় ঠিক করেনি।
ঘরোয়া বার্থ ডে ভালো। পারিবারিক বার্থ ডে। অনেক লাল গোলাপ নিয়ে মণির হাতে তুলে দিতুম। মা রান্না করত সেমুইয়ের পায়েস, তাতে কলার বড়া। সুক্তুনি বলে একটা জিনিস মা করে, দিদুর মতো পারে না কিন্তু অন্ততপক্ষে দিদুকে মনে তো করায়! টোম্যাটো-স্টাফ করতো মা চিংড়ি মাছের পুর দিয়ে। বাবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বলত, ‘শেম বাবু, এখনও তোকে বেল্ট দিয়ে ন্যাশন্যাল ড্রেস পরতে হচ্ছে?’ আমি বলতুম, ‘কেন বাবা “হাঁস ছিল সজারু ব্যাকরণ মানি না, হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না” ঠিক তেমনি বেল্ট দিয়ে ধুতি পরে, “অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি”। মা গম্ভীর হয়ে বলত, ‘একটা সামান্য সুবিধে অসুবিধের ব্যাপারকে তোরা তোদের সিনিসিজম দিয়ে কি বেঁকিয়েই দেখিস।’ আমি বলতুম, ‘না মা, আসল বকচ্ছপ আমি কলকাতার রাস্তাতেই দেখে এসেছি। অঙ্গে ফেডেড জীনস্, ওপরে চড়িয়েছে কাজকরা রঙিন লক্ষ্ণৌ পাঞ্জাবি, পইতের মতো করে পরা লেডিজ কাশ্মিরি স্কার্ফ, বেগুনি রঙ, ডান হাতে স্টিলের বালা, গলায় রুপোর চেন, চুলে বারান্দা কাট।’ মণি হাসতে হাসতে বলত, ‘কবে দেখলি? গত বছর? স্কেচ করে এনেছিস? বারান্দা কাট কি রে?’
আমাদের ঘরোয়া বার্থ ডে পার্টির চেহারা এই। কিন্তু মার কথা শুনে মনে হল বিগ পার্টি থ্রো করছে। তার মানেই লোক্যাল গ্রুপ। ডলারের হিসেব। বাড়ির হিসেব। গাড়ির হিসেব। ব্রুকলিনের ইহুদি গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিকতা আছে তারাও দারুণ কূপমণ্ডুক। তার চেয়ে আমার য়ুনিভার্সিটির পরিবেশ অনেক জীবন্ত। তিনটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হল সেদিন। লাইব্রেরিতে ছিলুম। কুপার টেনে আনল। বলল, ‘সডি, মিট সাম ইণ্টারেস্টিং পীপ্ল। ছেলে দুটি পুয়ের্তোরিকান, মেয়েটি আমেরিকান, নাম এডিথ। মেয়েটি বলল, ‘তুমি খুব অসুখী।’ আমার ভেতরের দ্বন্দ্ব মুখের ওপর ছাপ ফেলেছে ভেবে আমি তক্ষুনি মুখটা উদাস করবার চেষ্টা করছি। একটি ছেলে বলল, ‘বেট য়ু আর ট্রাইং টু পুট অন ইয়োর মাস্ক্।’ ক্লেভার গেস না সরল সাইকলজির জ্ঞান বুঝলুম না। অন্য ছেলেটি বলল, ‘নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো। তুমিও পারবে যদি টি. এম করো।’ এই টি. এম কথাটা এখন স্টেটস-এর শহরে শহরে ছড়িয়ে গেছে। ডাক্তাররা পর্যন্ত প্রেসক্রাইব করছে টি. এম। আমাকে এই প্রথম কেউ অ্যাপ্রোচ করল। ক্যারিয়িং কোল টু নিউকাস্ল্। ওদের বললুম না এটা আধুনিকতার মার্কিনি খোলস পরানো বিশুদ্ধ ভারতীয় ধ্যানতন্ত্র। যেন কতই কৌতূহলী এই ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কি করতে হবে। ওরা দুটো ফর্ম বাড়িয়ে দিল। নিজদের সম্পর্কে সব তথ্য লিখে দিতে হবে তাতে। সেই অনুযায়ী ওদের এক্সপার্টের কাছ থেকে একটা মন্ত্র পাবো। সেটা ধ্যান করতে করতে কিছুদিনের মধ্যেই এই অসুখী ভাবটা চলে যাবে। তারপর পরের ধাপ। ভাগ্যে থাকলে অ্যাসট্রাল বডিতে মহাকাশেও ঘুরে আসতে পারি। কুপার তৎক্ষণাৎ ফর্ম ভর্তি করতে বসে গেল। আমেরিকান সংহতি সম্পর্কে ওর প্রত্যয় এখনও যথেষ্ট দৃঢ় হয়নি দেখা যাচ্ছে। কিম্বা এ-ও হতে পারে, ও নিজের সিসটেমটাকেই দায়ী করছে এ জন্য। তাই ট্রানসেনডেনটাল মেডিটেশন-এর ব্যাপারে এত আগ্রহ। কিন্তু কুপারের স্থির হবার জন্য অস্থিরতাটাই এতো বেশি যে মনে হয় ও সব কিছুই চাখবে একটু একটু। মায়াপুর, নবদ্বীপে নাকি মার্কিন বৈষ্ণবদের বিরাট আখড়া বসেছে। সেইখানে সাহেব বৈষ্ণব হয়ে টার্ন আপ করবে দেখছি শেষপর্যন্ত। ভালোই। শতাব্দীর পর শতাব্দী খেতে পরতে দেবার চাকরি দেবার লোভ দেখিয়ে আমাদের ধর্ম-টর্ম কেড়ে নিয়েছ। এখন নিজেরাই আমাদের ধর্ম এবং তার বহুবিধ ডালপালা নিয়ে নাচো। দেখো বৈচিত্র্য সাধনে কি মুক্তি! তোমাদের ক্রিশ্চানিটি যতই বলো বড় একঘেয়ে ভাই!
কুপার ফর্ম ভরছে। এই সুযোগে আমি টুক করে কেটে পড়েছি। আমার গাড়িটা ক্যাথি নিয়েছে। ওর ফোক্সওয়াগনটা নিয়ে যাচ্ছি, একটা নোট লিখে রেখে গেলাম ঘরে। একলা একলা এইভাবে ড্রাইভ করতে আমার আজকাল বেশি ভালো লাগে। য়ুনিভার্সিটি থেকে সী বীচ। রাস্তাঘাটের জ্যামিতি পার হতেই দূরে আদি জননী সিন্ধু।
নীলচে সবুজ প্যাসিফিক। সাদা ঝালর। অনেক দূরে একটা ইয়াট ভাসছে। সমুদ্র, পাহাড়, আকাশ, অরণ্য, হাই-ওয়ে, মরুভূমি, জলপ্রপাত। জিজ্ঞাসায় কেউ অস্থির, কেউ স্থির।
আমাদের চেয়ে ভালো করে প্রশ্নগুলো করতে পারে বলেই উত্তরের জন্য ওদের কাছে আসা। এসে বসা। দাদু লিখেছেন: ‘তুমি যখন আসো, তোমার খুব কষ্ট হয় ভাই, আমার কিন্তু খুব আনন্দ হয়।’ কথাটা আমাকে কাল সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল। কষ্ট? হ্যাঁ কষ্ট আছে। পাওয়ার কাট, মশা, ড্রেনের দুর্গন্ধ, ব্যাকটিরিয়াভর্তি পানীয় জল। কার্বন মনোক্সাইড ভর্তি নিশ্বাসের হাওয়া, বাসে-ট্রামে ভিড়, নিঃসাড় টেলিফোন, কানের কাছে বিকট শব্দ লাউডস্পিকারে আজান, গ্রন্থসাহেব, গীতা। কষ্ট আছে। কিন্তু একজন বৃদ্ধ, দাদুর বোধহয় সত্তরের ওপর বয়স হল, এখানে দীর্ঘদিন থেকে বুঝেছি, এই রকম এক বৃদ্ধের কিছু থাকে না আক্ষেপ ছাড়া, সেই আক্ষেপেও কদাচ প্রাণ থাকে, তিনি আমার সান্নিধ্যে নির্ভেজাল আনন্দ পান। এই আনন্দ খুব দামী, সন্দেহ নেই। স্বার্থ চিন্তা নেই, প্রত্যাশা নেই, মানুষের বিশুদ্ধ সত্তার সঙ্গে বিশুদ্ধ সত্তার মুখোমুখি হওয়ার আনন্দ। কষ্টটার ওজন বেশি! না আনন্দটার? দিদুরও আমি আনন্দ ছিলুম। দিদুর মৃত্যুটা আমার কাছে এমন একটা শক যা বোধহয় আমি কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারব না। সাত বছর বয়সে চলে এসেছি। কিন্তু দু এক বছর পর পরই হয় শশাঙ্ক জেঠুর সঙ্গে, নয় জ্যোতিকাকাদের সঙ্গে ফিরে ফিরে গেছি। মা-বাবা বুঝত। আমাকে না পাঠিয়ে উপায় নেই। আমার শেকড় বউবাজারের বাড়ির উঠোনে প্রোথিত আছে। পুরোপুরি উপড়ে আনলে বাঁচানো যাবে না। যে ছোটবেলাটা বউবাজারে কাটিয়েছি সেটাতে মা-বাবা আগন্তুক, অতিথি। বাবার বাড়ি ফিরতে আটটা নটা। মা ইউনিভার্সিটির পর যেতো গানের ক্লাসে। আমি দিদুর পেছন পেছন ঘুরতুম আর গল্প শুনতুম। বোকা কুমির, বুন্ধু বাঘ, চালাক শেয়াল, দেড় আঙুলে, ঘুমন্ত রাজকন্যা, বুন্ধু ভুতুম, রঙিন মাছের গল্প আলাদীন, আলিবাবা। আমি পাঁচ বছর বয়সেই ভালো বাংলা পড়তে শিখে গিয়েছিলুম। কিন্তু দিদুর মুখের পানের রসে জারিয়ে না এলে গল্পগুলো যেন ঠিক জমত না। দিদু বলত, ‘তুই তো আমার আসল ছেলে, নাতি নোস তো! ছেলেদের কি আর আমি মানুষ করেছি। কত ছোটতে হয়েছে সব। ছেলে মানুষ করার কিই বা জানতুম তখন। তুই আমার সুদ নোস রে, সুদশুদ্ধ আসল।’ সেই আমি যখন দিদুকে ছেড়ে এলুম, কেউ জানে না, শুধু আমি জানি আর দিদু জানে আমাদের দুজনের কি ভীষণ লেগেছিল। উপায় ছিল না মা-বাবার, ছোট্ট মাথা দিয়ে বুঝতুম আমি তখনও। কিন্তু মা বাবাকে মনে হত অচেনা লোক, ধরে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেধরার মতো। ট্যাকসিতে ওঠানো যাচ্ছিল না আমাকে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। দিদু বলল, ‘যাও বাবু, যাও, আমি বলছি যাও।’ দু বছর পর ফিরে গিয়ে দেখলুম সে দিদু আর নেই। মুখে আঁচড়, চোখে কালি। আমার মুখে ‘দিদু’ ডাক শুনে কেমন চমকে উঠলো, আগে মা বলতুম তো। বললে, ‘না না, ঠিকই হয়েছে।’ দাদু ছিলেন, বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই সুন্দর।’ যে কদিন ছিলুম, বলতো, ‘আসবি তো ঠিক?’ গিয়েই তো ছিলুম। তবু ওই আকুতিতে দিদু কি প্রার্থনা রাখতো আমার কাছে ভালো করে বুঝতে পারতুম না।
দু বছর বাদে বাদেই ফিরে গেছি দিদুর কাছে। কত কথা বলতো দিদু। তখন তার কিছুই ভালো বুঝতে পারতুম না। এখন চিন্তা করলে কিছু কিছু বুঝতে পারি। তারপর একদিন বড় জ্যাঠার কাছ থেকে ফোন পেয়ে আমি আর বাবা ছুটে গেলুম। সোনারঙের দিদু এবার লাল-নকশা পাড় শাড়ি পরে শুয়ে রয়েছে। মুখের আঁচড় মিলিয়ে গেছে, কিন্তু আর কথা বলছে না। জমাট স্নেহ। ত্রিমাত্রিক ফ্রীজ শটে দিদুকে সেই শেষ দেখা, শেষ বোঝা। আমার ধারণা, মা বাবা কাকা কাকীরা এমন কি দাদুও ঠিক বুঝতে পারতেন না দিদুকে। আমাদের বউবাজারের পারিবারিক বাসগৃহে চীফ হলেন বড়দি। বাবাদের জ্যাঠাইমা। সবাই মানে, কথা শোনে, ভয় করে। এই বড়দিকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমার চোখ ফিরে গেল মহাসাগরে। গড়াতে গড়াতে চলে যাচ্ছে ঢেউ, ফিরে আসছে ঢেউ। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে দেখতে বিকেলটা বেশ গাঢ় হয়ে এলো। কাছাকাছি দু একজন বালির ওপর তোয়ালে পেতে শুয়েছিল। কখন উঠে গেছে। যারা আছে তারা বহু দূরে, বিন্দুর মতো। লাইফ-সেভারের স্ট্যাণ্ডটা খালি। আমার নিজের নিশ্বাসের ছন্দের মধ্যে দেখছি মহাসাগরের চলনের ছন্দ ঢুকে গেছে। এই ঢেউ-গড়া আর ঢেউ ভাঙা তাহলে সমুদ্রের নিশ্বাসপ্রশ্বাস! আমার বাইরে একটা সমুদ্র। ভেতরে আর একটা সমুদ্র। দুটো এখন সমান তালে দুলছে। হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে যা কিছু দেখছি বালুকণা, জল, বাতাস, নুড়ি সবই যে কম্পনশীল অণুর সমষ্টি—ফিজিক্সের এই মৌলিক তত্ত্বটা যেন আমার চোখের সামনের বিরাট প্রাকৃতিক ল্যাবরেটরিতে ডেমনস্ট্রেটেড হচ্ছে। সব কাঁপছে, যেমন আকর্ষণ তেমন বিকর্ষণ! শেষ বিকেলের আলোর দিকে তাকালুম—আবহমণ্ডলের ঠিক বাইরেটায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে মহাজাগতিক রশ্মি। গ্রাফ না, ডায়াগ্রাম না। গণিতের থিয়োরি না। প্রপাতের মতো আছড়ে পড়তে দেখলুম স্বয়ং শক্তিকে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে। ছন্দে ছন্দে। আমার ব্রুকলিনের ঘরে আছে আড়াই ফুট একটা পেতলের নটরাজ। বড় পিসি উপহার দিয়েছিল। সেই নটরাজই যেন বিরাট থেকে বিরাটতর আবার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে আমার চারপাশে আমাকে ভেতরে নিয়ে তার সৃষ্টির নাচ নাচতে লাগল। শুধু আমি নই, সকলকেই সেই নাচের বৃত্তে ঘূর্ণ্যমান দেখলুম। আমার বাবা, মা, বোন, আমার বন্ধুরা, মুখ চেনা কত লোক, বড়দি, জ্যাঠা, কাকা, ছোটকাকা, টুলটুল, দিদু, ক্যাথি, দিদিমা, দাদাই, কুপার—সব সব। এই নাচের তাল কাটলে ভয়ানক ব্যাপার হবে বুঝতে পারছিলুম। সমস্ত পদার্থ ভেঙে চুরচুর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তথাকথিত বিগ ব্যাং-এর ঠিক আগের মুহূর্তে ফিরে যাবো বুঝি। যাকে পৌরাণিক ভাষায় বলে, মহাপ্রলয়।
‘হা-ই! ফীলিং লোনলি?’ মেয়েলি গলার স্বর।
লোনলি! হায় রে। আমি এইমাত্র বিচরণ করছিলুম আসমুদ্র হিমাচল পৃথিবীর প্রতিটি অণুর সঙ্গে, আমায় বলছে লোনলি! গায়ে-পড়া আর হাই-ব্রাও এই দুয়ের মাঝামাঝি মার্কিন কি ওই ডিসকভারি যাত্রা ছাড়া আর মিলবে না! পাশে এসে বসেছে। বিশ্রী পোশাক। হঠাৎ আমাকে চমৎকৃত করে দিয়ে বলল, ‘হা-ই। তোমার মনে হয় না পৃথিবীটা গোল্লায় যাচ্ছে?’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আরও বলল, ‘সেই সঙ্গে তুমিও গোল্লায় যাচ্ছো!’
আমি বললুম, ‘আমি গোল্লায় গেলে তোমার এতো মাথাব্যথা কিসের? আর গোল্লায় যাবার কী কী লক্ষণ তুমি আমার মধ্যে দেখলে?’
হেসে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা। মণির থেকে হয়ত সামান্যই বড় হবে। নির্ঘাত টেনে এসেছে। চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি, বললে, ‘মিট লুসিয়ানা বয়।’ আশেপাশে আর তো কেউ নেই দেখি, তাহলে উনিই লুসিয়ানা। আবার বলল, ‘আমি এতদূর এগিয়ে এলাম (যেন আমি এগোতে বলেছি) তুমি তোমার নামটাও বলবে তো?’ তখনও চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘ওক্কে, আমি তোমার রিয়্যাল নামটা যখন জানিই তখন আর এ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কি! আমি অবাক। লুসিয়ানা আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোমার নাম গ্যালাহাড। এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিই। এক নম্বর, তুমি গোল্লায় যাচ্ছো এতে আমার খুব খারাপ লাগছে। অ্যাজ এ ফেলো হিউম্যান বীয়িং। আমি তোমাকে সেভ করে দিতে চাই। দু নম্বর, গোল্লায় যাচ্ছো তার সিমটম হল অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি। দেখছি তুমি ভীষণ মোরোজ। ডিপ্রেসড্।’ বলেই মেয়েটি সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। তারপর ক্রমশ ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে বহু দূরে চলে গেল। একটা সময় আমি বুঝতে পারলুম মেয়েটা ডুবে যাচ্ছে। তখন আমি ‘হেলপ হেলপ্’ করে ছুটোছুটি করে কোনমতে লাইফ সেভার আর একটা তাগড়া ট্রাক-ড্রাইভারকে যোগাড় করলুম। তিনজনে মিলে মেয়েটাকে বীচে এনে উপুড় করে দিতেই বেশ খানিকটা জল ওগরালো। বোধহয় বিশেষ কিছু হয়নি। ড্রাইভারসাব হিপ পকেট থেকে রামের বোতল বার করল। কয়েক ঢোঁক খেয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলল মেয়েটা, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বা-ই!’ টলতে টলতে চলে যাচ্ছে দেখে ড্রাইভারটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইদার য়ু ডু সামথিং অর আই ডু সামথিং অ্যাবাউট হার।’ ড্রাইভারটাকে গোড়া থেকেই ভালো লাগেনি। লুসিয়ানাকে একরকম জোর করেই গাড়িতে তুললুম। গাড়িতে জল গড়াচ্ছে। য়ুনিভার্সিটি ক্যামপাসে গিয়ে ওর ব্যবস্থা হবে। যদি খুব বেশি দূরে থাকে তো ক্যাথিকে বলব, ও ব্যবস্থা করবে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কোথায় থাকো!’
—‘বলব না।’
—‘সে কি?’
—‘বুঝতে পারছো না আমি পালাচ্ছি?’
—‘কোথা থেকে?’
—‘ফ্রম দেম?’ —‘কারা? কাদের কাছ থেকে’—এ নিশ্চয়ই কোনও বিপজ্জনক র্যাকেটের খপ্পরে পড়েছে।
—‘ফ্রম মাই পেরেণ্টস।’ মেয়েটা জবাব দিল।
—‘সে কি? কেন?’
—‘দে হ্যাভ আ ন্যাস্টি ডিজীজ।’
—‘কী হয়েছে?’
মেয়েটাকে জেরা করে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। কিছুদিন ধরেই চতুর্দিকে একটা নতুন রোগের নাম শুনতে পাচ্ছি। গে রিলেটেড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি। এটা নিয়ে আমাদের য়ুনিভার্সিটিতে কিছু কিছু ডাক্তার লেকচার দিয়ে গেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, টেক্সাস সর্বত্র নাকি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ।
সমকামীদেরই হয় বলে শুনেছিলুম প্রথমে। তারপরে শোনা গেল যৌন সংক্রমণ তো হয়ই। তাছাড়াও ব্লাড ট্রানসফিউশন, ইনট্রাভেনাস ইনজেকশন এ সব থেকেও হতে পারে।
বললুম, ‘মা বাবার দুরারোগ্য অসুখ করেছে, তুমি পালাবে? কীরকম মেয়ে তুমি?’
‘পালাবো না?’ মেয়েটা ফোঁস করে উঠল ‘যখন ইণ্ডিয়ান ইয়োগীটার কাছে দুজনে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিল আমার কথা কেউ ভেবেছিল?’
‘কী বলতে চাইছো?’
‘ইণ্ডিয়ান ইয়োগীটার ফলোয়ার্সরা সবাই মিলে একট অন্ধকার ঘরে বসে কী করত। বিকট বিকট জানোয়ারের মতো আওয়াজ আসত ঘরটা থেকে। আমি বাইরে থেকে শুনেছি। সেখান থেকেই নিয়ে এসেছে রোগটা।
‘কী করে জানলে সেখান থেকে?’
‘নিজেরাই তো ঝগড়া করতে করতে বলল সে কথা। মাম বলল ড্যাডকে, ড্যাড বলল মামকে। ড্যাড বলল, “আমি তোমাকে অনেকবার বারণ করেছিলাম এসব জায়গায় যেতে।” মাম বলল, “তুমি তো আমাকে ছাড়াই পরে যেতে শুরু করলে। কেন সে আমি জানি।” বলতে বলতে মাম কেঁদে ফেলল। এই পর্যন্ত শুনতে শুনতেই আমি প্যাক আপ করে ফেলেছি। ওদের বললাম, “উলরির বাড়ি থেকে কদিন ঘুরে আসছি।” তারপর ছুটতে ছুটতে বাস, তারপর এই সী-বীচ। নাউ, তুমি আমায় বলো পৃথিবীটা গোল্লায় যাচ্ছে কি না।”
আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম মা বাবাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া ওর উচিত হচ্ছে না। ও রোগ ওভাবে সংক্রামিত হয় না। কে কার কথা শোনে। ‘আই ডোণ্ট ওয়াণ্ট টু লিভ উইথ গ্রিড।’ ডাক্তার নাকি নিজে বলেছেন, এ রোগের চিকিৎসা নেই। তিলে তিলে মারা যাবে রোগী। শরীর ফুলে, মুখে চামড়ায় দুর্গন্ধ ঘা হয়ে।
মাঝ রাস্তায় খুব সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নামটা কি বলো তো?’
‘সেটা তো তুমি জেনেই গেছো।’
‘টাইটল কি তোমার?’
শুনে বলল, ‘ইণ্ডিয়ান। তুমি ইণ্ডিয়ান!’ ভয়ে দেখি ঠকঠক করে কাঁপছে—‘এদিকে আমি ভাবছি তুমি মেক্সিকান? হায় হায়! তুমি তো দেখছি নির্ঘাত সেই ইয়োগীটার চ্যালা! হ্যাঁ, এই তো স্যাফ্রন কালার্ড সার্ট পরেছো!’ বলতে বলতে আমার একটু অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হঠাৎ দরজা খুলে বিপজ্জনকভাবে দৌড় দিল মেয়েটা। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।
কী চায় এরা? এদের দেখে দেখে মনে হয় মানুষের আর কিচ্ছু হবে না। ইভলিউশন শেষ হয়ে গেছে। জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি বিজ্ঞান আর সম্পদ প্রতিদিন এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সোজা পথে উপভোগটা বড় সহজপ্রাপ্য হয়ে গেছে। তাই বক্ৰগতিতে চলেছে সব। ফলে তৈরি হচ্ছে অশান্ত কুপার, অবুঝ লুসিয়ানা, লুসিয়ানার হতভাগ্য মা বাবা। শেষ পর্যন্ত দেহের জ্বালায় জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মনের জ্বালায় উদ্দেশ্যহীন নেমে যাচ্ছে পথের ধারে। হিপি, পাঙ্ক! দা ম্যালাডি অফ সারফিট! আর আমার দেশ! শুধু দুটি খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতেই অর্ধেক মানুষের জীবন কাবার। বোধহয় সেই ভালো। সম্পদের শেষ চেহারাটা দেখা হয়ে গেলে বোধহয় আর কিছু থাকে না অধঃপাত ছাড়া। অন্তত সাধারণ মানুষের জন্যে না। প্রগতি। প্রগতি মানে তো শুধুই দৈহিক-বিলাসের বন্দোবস্ত। সম্পদ বৃদ্ধি। সম্পদ-বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু নয়।