জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 11
ফেব্রুয়ারির শেষ। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া। সহদেববাবু বৈঠকখানার ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে কাগজ পড়ছিলেন। ছাই রঙের আলোয়ানটা কাঁধ থেকে আলতো ঝুলছে। সকালে একবার এ-ঘরে আসে কাগজটা। কাগজঅলা এখানেই দিয়ে যায়। তারপর ভেতরে যায়। সুমিতের পড়া হয়ে গেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার সময় পান তিনি। বাড়ির ভেতর থেকে রান্নার শব্দ এবং গন্ধ মাঝে মাঝে তীব্রভাবে ভেসে আসে। ডালে সম্বরা দেবার গন্ধ। পাকা লঙ্কা ফোড়নের ঝাঁঝ। সদর দিয়ে একবার দুধ নিয়ে, আরেকবার বাজার নিয়ে চলে গেল দুই নাতি। নিস্তব্ধ সকালবেলা, দু’ চারটে শব্দের ফোড়নে যেন আরও শুনশান। সেন্টার স্প্রেডটা ভালো করে পড়া হয়ে গেল। কানট্রি নোটবুক। লেটার্স টু দি এডিটরে প্রায় লেখেন। সেই চিঠি নিয়ে বিকেলবেলা তুমুল আলোচনা হবে। আশুবাবু আসবেন, গৌতম চাটুজ্জে আসবে। আজও একটা বেরিয়েছে। আসাম-সমস্যা নিয়ে। আসামের সমস্যা তো পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা কিছু নয়! অথচ আগাপাশতলা অনুপ্রবেশকারী নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই বাসের মতো বিপজ্জনকভাবে এখনও তো পশ্চিমবঙ্গ চলছে! আর্তনাদ করছে কিন্তু কই রক্তচক্ষু তো দেখাচ্ছে না? তাহলে বাঙালির মধ্যেই কি শুধু মানবধর্ম বেঁচে আছে? নাঃ, ইংরেজিটা এখনও ভালোই লেখেন তিনি। লেখার মধ্যে বেশ জোর আছে। অল্পবয়সে রাজনৈতিক বক্তৃতা করেছেন তো ভেতরের এই শক্তির জোরেই! আহা! কি দেশ কি হয়ে গেল! কত আশা, কত ভরসার স্বাধীনতা! কিভাবে শুধু মুষ্টিমেয় কটা মানুষকে গদীতে বসাবার জন্যে ভারত ভাগ করলে এরা। মহাত্মাজীর নীরবতায় কি গভীর আঘাতই পেয়েছিলেন সেদিন! কথা দিয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভারত ভাগ হবে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের লজ্জা তাঁকে স্পর্শ করেনি? সেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরও তো রাজনীতিতে মাথা গলাতে ছাড়লেন না। কিভাবে আত্মকলহের সুযোগ নিল ইংরেজরা। ছি! ছি! এই কি এডমাণ্ড বার্ক, ডেভিড হেয়ার, উইলিয়াম জোনসের দেশের লোকের কাজ! একবার ভাগাভাগির পথটা দেখিয়ে দিয়েছে, আর···। সামনে ছায়া পড়ল। কে? সদর খোলা। রোদ এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্যে দীর্ঘ ছায়া। সহদেববাবু চোখ তুলে অবাক হয়ে গেলেন।
‘স্বদেশ নাকি? নাতিবাবু?’ উঠে দাঁড়ালেন সহদেবাবু। বাবু মাথা নীচু করবার আগেই তাকে ধরে ফেলেছেন। বিজয়া দশমীর কোলাকুলি করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন, সহদেব মুখার্জি। বড় আদরের দেশ তাঁর। দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত, সমস্যাপীড়িত, রুগ্ন তবু নিজের দেশ। ছেলেবেলার ভক্তি, যৌবনের ধ্যানজ্ঞান। নিজের এই দেশের কথা মনে করেই প্রথম নাতির নাম রেখেছিলেন। এই স্বদেশ যুবক, অকপট, বুদ্ধিমান। তেজস্বী অথচ নম্র। তাঁর দেশকে এই রকম চেহারায় আসতে দেখলে সুখে মরতে পারবেন।
বাবু হাসিমুখে বলল—‘দাদু, তোমার পাঞ্জা আগের মতন আছে তো? লড়ব কিন্তু।’
—‘তা লড়ো না ভাই। তবে জয়পত্রী আমি আগে থেকেই তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।’
সাড়া পেয়ে রীণা ভেতর থেকে উঁকি মেরেছে। হাতে মাছভাজার খুন্তি। শাড়ির খানিকটা মাথায়, খনিকটা কোমরে জড়ানো। বাবু বলল—আরে বাস, ন কাকিমা তুমি যে এখনও সুইট সেভেনটিনেই রয়ে গেছো। টুলটুল কোথায়? বাবলু? সুমন?’
—‘টুলটুল ভেতরে, পড়ছে। বাবলু কলেজ। সুমন কোচিংয়ে। তুই এরকম হঠাৎ।
—‘আমি এরকম হঠাৎই আসি।’
বাবু একলাফে রীণাকে পেরিয়ে গেল। জুতোটা খুলে দুতিন লাফে দোতলার সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদ। রীণা সিঁড়ির দিকে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে ছিলো, মুখে হাসি। বাবু তো তারও ছেলের মতো। মা-বাবা ছাড়া আমেরিকা থেকে যখন আসত তখন শাশুড়ি আর তার কাছেই তো থাকত।
চিলেকুঠুরিটা এককালে ঠাকুরঘর ছিল। তাছাড়াও আগে এ-ঘরে প্রচুর আচার আমসত্ত্ব থাকত। যমুনাপিসি বলে একজন পুরনো লোক ছিল এ-বাড়ির। সে সারা শীতকাল অজস্র আচার করত। এখন এখানে থাকে রাশি রাশি ঠাকুর দেবতার মূর্তি, মানুষেরও ছবি। পুজো হয় না, পরিষ্কারও হয় না, মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে সব। যে দু’ একটা মূর্তি পুজো করা অত্যাবশ্যক বলে মনে হয়েছে সেগুলো এখন বড়মার ভাঁড়ার ঘরে। এ-ঘরের দেবকুল, পিতৃকুল সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বাবু খুঁজতে লাগল। শীতলা, তারা, চতুর্ভুজ বিষ্ণু, রাধাকৃষ্ণ, সরস্বতীর পট, কমলে কামিনী, লক্ষ্মী। ওই তো পেছন দিকে বেঁকে রয়েছে দিদুর ছবি। এটা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সের। যে সময়ে ছ সাত বছরে বাবু তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরত। এই দিদুকে বাবু ভালো করে চেনে। মাথায় আধঘোমটা। একদিক থেকে চুলের রাশ বুকের ওপর এসে পড়েছে। কপালে সিঁদুর টিপ। শাড়ির পাড় লাল। রঙ করা ছবি। বুদ্ধিভরা, মায়াভরা চোখ দিদুর। চিবুকে কি গভীর মমতা। মা যাহা ছিলেন। বাবু ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ফিসফিস করে বলল—‘আমি এসে গেছি দিদু। একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু তুমি তো এখনও আছে, তাই না?’
—‘কে? কে ওখানে?’
চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে বাবু দেখল—ভীষণ ফ্যাকাশে, অদ্ভুত দর্শন এক মহিলা, মাথার চুলগুলো উঠে গেছে। কপাল অবধি ঘোমটা তুলে দিয়ে ঘরের দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘আমি বাবু, স্বদেশ। এ-ঘরে দিদুর ছবি খুঁজতে এসেছিলুম।’
—‘আমি তোমার বড় জ্যাঠাইমা। চিনতে পারছো না, না? কী করে পারবে? রোগে রোগে শরীর এমনি হয়েছে।’
পেছনে মেজজেঠী এসে দাঁড়িয়েছেন, বললেন,—‘থাক দিদি, সবে এসেছে। কী বলছো ওকে।’
হঠাৎ মনে পড়ল, নীচু হয়ে দুজনকে প্রণাম করল বাবু।
বড় জেঠিমা বললেন—‘আহা, কি সুন্দর ছেলে রে শান্তি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দ্যাখ শান্তি, কতদূর থেকে এসে ও আগে ঠাকুর পেন্নাম করছে। আমি ঠাকুরঘরের মোটে যত্ন নেইনি। তাই-ই বোধহয় আমার এ রোগ হল।’
বাবু বলল—‘কী বলছো জ্যাঠাইমা! এসব ভাবনার কোনও মানে হয়?’
মেজ জেঠিমা বললেন, ‘কতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে? নীচে চলো। তোমার বড়দির সঙ্গে দেখা করবে না?’
দুজনে আস্তে আস্তে ধরে ধরে বড় জ্যাঠাইমাকে নামিয়ে ওঁর ঘরে শুইয়ে দিল। বাইরে আসতে আসতে মেজ জেঠিমা বললেন—‘দিদির মাথাটাও আস্তে আস্তে কেমন হয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকেই আমায় বলবে ওপরে ঠাকুরঘরে নিয়ে যেতে। এইসব উল্টো-পাল্টা ভাবছে তা তো বুঝিনি। আসছে পুন্নিমেয় সত্যানারায়ণের শিন্নি দিতে বলছে।’
বাবু খুব অভিজ্ঞ লোকের মতো বলল—‘দাও না জেঠিমা, যাতে ওঁর মনে শান্তি আসে তাই করো। শান্তিটাই আসল।’
একটা বাড়ি এতো বিবর্ণ, প্রাণহীন হতে পারে, ভেতরকার আবহাওয়া এমনি কবরখানার মতো ভয়াবহ রকমের শীতল হতে পারে, না এলে, না দেখলে বিশ্বাস করতুম না। মণি লিখেছিল, কিন্তু মণি একেক সময় ভাবাবেগে বড্ড অতিকথন করে। তাছাড়া মণি হঠাৎ এখানে এসে এ-বাড়িতে প্রাণশক্তি অনুভব করবে এটা আশা করাও অন্যায়। ও তো এখানে আরোপিত! কিন্তু এখন দেখছি মণির কথাই ঠিক। আমার ছোটবেলার স্মৃতির বাড়ি, যেখানে আমি বারবার ফিরে এসেছি, সে অন্যরকম। অনেক বড়, অনেক খোলামেলা। রোদ, হাওয়া, ফুলগাছ। ঝারি করে জল দিতুম আমরা। আমি, সুনীলদা, শুচিদি। সবাই চলে গেছে। সুনীলদা ধানবাদে। শুচিদি মধ্যপ্রাচ্যে। বড়পিসি নিয়মিত আসে না। বাড়ি নদীর মতো। প্রিয় মানুষদের যাওয়া-আসা না থাকলে স্রোতহীন নদীর মতো মজে যায়। এ-বাড়িটাও বোধহয় তাই। বাড়িটা অনেকগুলো ভুল করেছিল, সেই ভুলের স্বরূপ কি আমি জানি না। কিন্তু সেই জন্যেই এ-বাড়ির স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে। ওপরের ওই ঠাকুরঘরটায় কিছু মূর্তি আর পট ছিল, নিয়মিত পুজো হত। তাই ঘরটা থাকত পরিষ্কার, ফুল ধূপ আর ধুনোর গন্ধে ভরপুর। ছাদে এলে কত কথা বলতেন দিদু। তিয়াত্তর সালে দিদুকে শেষ দেখেছি। বলতেন—‘জানিস বাবু, এই ঠাকুরঘরটা এক হিসেবে আমাদের জীবনের কেন্দ্র। কেন না এখানে আমাদের মনোযোগ, ধ্যান, ভক্তি আর প্রার্থনা আমরা সমর্পণ করছি। বদলে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস, শান্তি। ঠাকুর-দেবতারা নিজেরা, তাঁদের চারটে করে হাত, একাধিক মুখ, আয়ুধ এ সব আসল নয়। আসল হল এর পেছনে যে মহৎ কল্পনাশক্তি কাজ করেছিল সেটা, সেই ভাবটা। অন্যায়, অবিচার, হিংস্রতা, লোভ—এসবকে আমি হত্যা করছি, আকাশের মতো এক বিরাটত্বকে আমার মধ্যে আসন পেতে বসাচ্ছি—এই ভাবটা নিয়ে আমি এখানে বসি। আমার তো আর কিছু করার জো নেই! তোরা এগুলোকে হাতে-কলমে করবার সুযোগ পাবি।’ একটু মুখ উঁচু করে দিদু কথাগুলো বলতেন, আমার মনের মধ্যে কেটে কেটে বসে যেত কথাগুলো। হিউসটনে আমার মিশন স্কুলে যিশুকে কেন্দ্র করে কত কি-ই হত। যিশু একজন ঐতিহাসিক মানব। আর পাঁচজন মানুষের মতো, অথচ বড়। তাই আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগত দিদুদের এই অদ্ভুত দর্শন দেবতাদের পুজো করায়। দিদু ছোট বলে মোটেই আমাকে, আমার প্রশ্নকে তুচ্ছ করতেন না। এইভাবে উত্তর দিতেন। আমার মনে হত দিদুর আরও অনেক কথা বলার আছে, আমি বুঝব না বলে বলেন না। সেই না-বলা-কথাগুলো দিদুর কপালে, ঠোঁটে কি এক রহস্যময় আলো ফেলত। একমাত্র ছাদে বা ঠাকুরঘরেই এই দিদুকে দেখা যেত। নীচে নামলেই দিদু অন্যরকম। ঘোমটা-মাথায় এ-ঘর-ও-ঘর করছেন, রান্না করছেন, বড়দির ধমক খাচ্ছেন, আমি পেছন-পেছন ঘুরছি। দিদুর বাবা স্বাধীনতা-আন্দোলনে মারা যান। আমার দাদুও কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। দিদু বলতেন—‘তের বছর বয়সে নোলকপরা ছোট্ট পিতৃহীন মেয়েটি, সবাই বিয়ে দিয়ে দিলে। আরেকটা জীবন পেলে নিশ্চয় অন্যভাবে কাটাতুম।’ বড় পিসির ছেলে দীপকদা যখন নকশাল হয়ে গেল, দিদু ওকে চুপিচুপি টাকা দিতেন, ওর পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র নিজের তোরঙ্গে শাড়ির তলায় রেখে দিতেন আমি জানি। দীপকদা নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে, দিদু গুম হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বলতেন—‘দীপককে ওরা মেরে ফেলেছে এ কখনও সত্যি হতে পারে না। দীপকের মধ্যে আগুন আছে।’
দাদুকে দেখে আজ একটা কথা আমার মনে হল, দাদু খুব ভালো, কিন্তু দাদু একচক্ষু হরিণ। দেশের মুক্তির জন্য যারা লড়াই করে নিজেদের অন্তঃপুরের মানুষদের মুক্তির জন্য তারা একটু লড়াই করবে না? আর এ লড়াই তো বেশির ভাগটাই নিজের ভেতরকার স্বার্থপরতার সঙ্গে লড়াই! দিদুর দুহাতে একটা কিসের শৃঙ্খল ছিল, একটু ইচ্ছে করলেই দাদু সেটা ভেঙে দিতে পারতেন। এই যে বড়জেঠি, মেজজেঠি ওঁদের হাতেও শেকল। শেকল স্বভাবের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ওঁরা বোঝেন না, একটা বোবা কষ্টের মধ্যে থাকেন।
টুলটুল কথায় কথায় বলল—‘জানো বাবুদা, আমি এই অন্ধকার বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
টুলটুলের ওপর আমার অনেক ভরসা ছিল। ছোটবেলায় টুলটুলটা খুব জলি ছিল। ও আমি আর বাবলু মিলে দিদু আর কাকিমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। খুব দুরন্ত ছিল ও। আমাদের সঙ্গে সমান তালে ক্রিকেট-ফুটবল খেলত। এখন খুব শান্ত হয়ে গেছে। শান্তও না, মন মরা।
আমি বললুম—‘চাকরি-টাকরি করলে, আর্থিক স্বাধীনতা পেলে দেখবি সব অন্যরকম লাগবে।’
টুলটুল বলল—‘সে-ও তো আরেক রকমের দাসত্ব। তার চেয়ে আমার বাবাকে বলো বিয়ে দিয়ে দিতে।’ একটু লাজুক চোখে চেয়ে বলল—‘বিদেশ যাবার চান্স আছে এমন বর দেখতে বোলো, হ্যাঁ?’
আরে রাম রাম! এ বলে কি? আমরা, এতো কষ্ট করে শেকড় ছিঁড়ে-খুঁড়ে এদেশে এলুম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন হাওয়ার বেগে একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে দেবেন। আর এখানকার মেয়ে কি না বিদেশে পালাতে চাইছে!
টুলটুল আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল—‘তোমাদের পূর্বপুরুষেরা লোকের হাতের রান্না খেতে পারেন না। মা কতদিন মামার বাড়ি যায় না জানো? অত বাঁধাবাঁধি আমার ভালো লাগে না। বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের ডাকতে পারি না। দাদু এমন করে তাদের ঠিকুজি-কুলুজি নিতে শুরু করেন যে আমার লজ্জা করে।’
মাকে ফোন করে আমি ন কাকীর কাছে থেকে গেলুম দিনটা। মার বোধহয় অভিমান হল, ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিল।
এতগুলো বছর বিদেশবাসের পর, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সব চেয়ে মূল্যবান বলে চিনেছি। সেই হিসেবে এই নাগরিক সভ্যতায় ক্রমেই মরুভূমি তার জিহ্বা বিস্তার করছে। প্রাইভেসি-রক্ষার তাগিদে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে পরিবারের সীমা। শেষ পর্যন্ত শুধু একটি জীবনবিন্দু। বৃদ্ধাবাস। মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিস কি আর নেই। প্রোফেসর সোয়েনগার্টেন আর তাঁর স্ত্রী এলসা ছিলেন হার্ভার্ডে। আগেকার কালের গুরুপত্নীর মতো এলসা প্রোফেসরের সমস্ত ছাত্রের খোঁজ খবর রাখতেন। ফ্লু হয়েছে, মাথা তুলতে পারছি না, তিনদিন নিজের ঘরে বড়ি গিলে শুয়ে আছি। হঠাৎ জ্ঞান হতে দেখি এলসা গরম দুধের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। থিসিস শেষ হবার পর আমার সম্মানে পার্টি দিলেন প্রোফেসর। রবিনসভিলে নিজে হাতে কাঠের কুটির বানিয়ে থাকেন ন্যাচারর্যালিস্ট ডেরেক। নিজের আনন্দে নিজেই মগ্ন হয়ে আছেন, পুরো রবিনসভিল গ্রামটাই ওঁর পরিবার। ওঁর অসুখ করলে পুরো গ্রামটাই ওঁর দেখাশোনা করে। আমার বন্ধু কুপারের পরিবার ছিল অবিকল একটি হিন্দু যৌথ পরিবারের মতো। গ্রীনিচ্ গ্রামে বিশাল খামার ওদের। তিন ভাই তিনটে কটেজ। এক একদিন এক এক জনের কুটিরে খাওয়া-দাওয়া হয়। কুপারের মা ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ মহিলা!
আমি আপাতত এই ভূতের বাসায় থাকব। দেখব এদের অসুখটা কোথায়। কি অসুখে এত বড় বাড়ি মানুষ থাকলেও জনহীন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রাণ নেই। দাদু দেখছি নিজের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ নিয়েই মশগুল। একই সঙ্গে উনি সপ্তদশ আর বিংশ শতকে পা রেখে চলেছেন। চারপাশে যে কিছু প্রিয়জন রয়েছে, তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক যে কখনও বজ্ৰ-আঁটুনিতে, কখনও অতি-উদাসীনতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে চেতনা দাদুর নেই।
সন্ধেবেলায় মেজ জেঠু অফিস থেকে ফিরলে গল্প হল অনেক। আমাকে দেখে খুব খুশী। বললেন—‘আর কটা মাস পরেই রিটায়ার করছি, কি যে করবো!’
—‘সুনীলদার কাছে ধানবাদে চলে যাবে!’
—‘ওরে বাবা ওখানে যা ভয়াবহ গরম আর পাথুরে শীত! ও আমার সইবে না।—’
—‘তাহলে নেশা করো।’
—‘সে কিরে? ও কি বলছিস?’
আমি হেসে বললুম—‘ভ্রমণের নেশা। দুজনে মিলে থেকে থেকেই বেরিয়ে পড়বে। সব সময়ে যে খুব দূরে যেতে হবে তার মানে নেই। পশ্চিমবঙ্গ টুরিস্ট ব্যুরোতে খোঁজ নাও। অনেক ছোটখাটো জায়গা আছে কাছাকাছি।’
—‘এটা তো মন্দ বলিসনি? তবে তোর জেঠি পারবে না। সংসারও আছে।’
আমি বললুম—‘মেজজেঠিমার আবার সংসার কী? ওঁকে না নিয়ে গেলে তোমার ভ্রমণ নেশায় আমার আপত্তি আছে।’
—‘মাকে দেখাশোনা করবে কে?’
—‘বড়দি এখনো যথেষ্ট সক্ষম আছেন। নিজেরটা এখনও নিজে চালিয়ে নিতে পারেন।
—‘বউদি!’
—‘কেন বড়জ্যাঠা করবেন। দুচারদিনের জন্য সবাই পারবেন, পারতে হবে।—’
ছাত্রজীবনের কথা বলতে লাগলেন মেজজেঠু। বললেন, ‘জানিস। বাবার হাতে পায়ে ধরেছিলুম। এঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্যে। বলেছিলেন—মিস্ত্রি হবার জন্যে অত টাকা কে দেবে। ফিজিক্সে হাই সেকেন্ড ক্লাস পেলুম। বাবা এম-এস-সি পড়তে দিলেন না—চাকরি পাচ্ছো, ঢুকে যাও। ওই এক কথা। আমার সেই ফিজিক্সের ডিগ্রি মার্চেণ্ট অফিসের কোন্ কাজে লাগল? তোরা সুযোগ পাচ্ছিস। তোদের বাবারা তোদের জন্য করছে। তোদের ভাগ্যই আলাদা।’
জীবনের এতগুলো দিন কাটিয়ে এসেও এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না পারার দুঃখ মেজজেঠু বেচারির যায়নি।
আমি বললুম—‘আমার কিন্তু ছোট্ট একটু আনন্দের কারণ আছে। স্কুলের পর আর বাবা মার পয়সা খরচ করতে হয়নি আমার জন্য।’
—‘স্কলারশিপ পেতিস?’
—‘তা-ও পেয়েছি। চাকরিও করেছি। গ্যারাজে চাকরি করেছি। ব্যাঙ্কে করেছি। কুলির কাজ পর্যন্ত করেছি দরকার পড়লে।’
মেজজেঠু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ ওদেশে এরকম অনেকেই করে শুনেছি। ভালো ভালো। আমাদের এখানে কেউ ভাবতেও পারে না। সুনীলের জন্যে আমার হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। বিয়েতে কাকাবাবু পণটনও নিতে দিলেন না কিছুতেই যে পুষিয়ে নেবো।’
খুব হাসি পেয়ে গেল আমার। এইটা দাদুর বিংশ শতকে পা-রাখা চেহারা।
একটু পরে সুমন আর বাবলু এসে বসল। তক্তপোশের একধারে বসে মেজজেঠিমা উল বুনছেন। সুমনটা খুব ছেলেমানুষ। বলল—‘বাবুদা, তুমি কোথায় শোবে?’
আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললুম—‘বড়দির কাছে।’ ওর চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বড়দির কাছে যে কেউ স্বেচ্ছায় শুতে পারে ওর ধারণায় বোধহয় সেটা আসে না।
মেজজেঠিমা বলেন—‘তুই না হয় এ বেলা আমার কাছে খা।’
আমি বললুম, ‘এই দ্যাখো, মুশকিল করলে। নকাকিমা আবার সকালবেলায় নাকি জমিয়ে খাওয়াতে পারেনি, এবেলা কিসব রাজসূয় আয়োজন করেছে। কাল সকালে তোমার কাছে খাব এখন।’
—‘কি তুই ভালোবাসিস বল!’
‘এনিথিং অ্যান্ড এভরিথিং।’
‘তার মানেই আমাদের কিছুই তোর ভালো লাগে না।’
‘কী করে তুমি এমন একটা কনক্লুশনে এলে গো জেঠিমা। য়ু আর গ্রেট। তবে একটা জিনিস খাওয়াতে পারো। মানকচু আর নারকোল দিয়ে দিদু একটা কি ব্যাপার করত। দারুণ খেতে হত। ঝাল-ঝাল, মিষ্টি-মিষ্টি!’
‘ঠিক আছে দেখি পারি কিনা। তাছাড়া চেতল মাছ আনতে দেবো এখন। মুঠ খাবি চেতল মাছের।’
আমার মুখে এসে গিয়েছিল বাবলু, টুলটুল, আর সুমনও খাবে জেঠিমা। খুব সামলে নিয়েছি। ওঁদের একরকম ব্যবস্থা। স্বতস্ফূর্তভাবে যা করছেন তার ওপর কিছু চাপাতে গেলে হয়ত ওঁর আনন্দটুকু মাটি হয়ে যাবে। অতএব নিজের আনন্দ কুরবানি দিয়ে আমাকে এই ব্যবস্থাই মেনে নিতে হবে। যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি। চাকরি করছি। বাজার থেকে নিজেই মাছ-টাছ এনে বলতে পারতুম, ‘লাগাও জেঠিমা, ন কাকিমা, বুলবুল হাত লাগা, আমিও লাগাচ্ছি।’ কিন্তু মনে হচ্ছে ওরকম কিছু করতে গেলেই মেজজেঠু বলে উঠবেন, ‘চুপ করো জ্যাঠা ছেলে।’
টুলটুলের সঙ্গে গল্প করলুম রাত পর্যন্ত। ও এবার এম-এ ফাইনাল দেবে। রেজাল্ট বেরোতে এত দেরি করেছে যে ওর প্রায় দুবছর দেরি হয়ে গেল। ওর খালি এক কথা কিছুই ভালো লাগে না। ধমক দিলুম, এতো ডিপ্রেস্ড্ হয়ে থাকার জন্য। বলল, ‘ভালো লাগবে কী করে বলো তো? কিছুই তো পারি না। গান-বাজনা-খেলাধুলো কিচ্ছু না। কোনরকমে পাশ করতে পারি আর হাতা-খুন্তি নাড়তে পারি।’
টুলটুলটা বেঁচে থাকায় কোনও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের মধ্যে অস্তিত্বের কৈফিয়ৎ খুঁজছে। কি যে করা যায়! মস্ত বড় কিছু একটা করতে না পারলে জীবন বৃথা এই ধরনের একটা অবসেশন এদের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটা কাটাতেই হবে। ও ঘুমোতে চলে গেলে আমি উঠে পড়লুম। আমাকে যেন কিসের নেশায় পেয়েছে। যত রাত হয়, যত চারদিক নিঝুম হয় তত একটা অন্য শব্দ কায়াহীন বৃষ্টির মতো রিম্ঝিম্ করতে করতে ভাঙাচোরা চকমিলোনো বাড়িটার আনাচ-কানাচ থেকে ঝরে ঝরে পড়ে। কখনও মনে হয় অনেক ঘোড়ার খুরের শব্দ পাচ্ছি। হাওয়ায় তরোয়াল চালানোর শাঁই শাঁই শব্দ। কারা যেন হুড়মুড় করে পালাচ্ছে। দূরে কোথাও কামান গর্জন করে উঠল। ছপাৎ ছপাৎ করে জলে লাফিয়ে পড়ছে কারা। অস্পষ্ট সব শব্দ উড়ে বেড়াচ্ছে। দালানে, বড় হল ঘরটায়, শব্দ শুধু শব্দ। বড়দির পাশে একটা শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লুম। বড়দি শুধু একবার চেয়ে দেখলেন, কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ পরেও দেখি বড়দি বসেই আছেন, বসেই আছেন।
‘ঘুমোবে না বড়দি।’
‘ঘুম আসে না দাদা।’
‘তবে গল্প করো।’
‘গল্প কোথায় পাবো?’
‘তোমার ছোটবেলার গল্প করো।’
বড়দি হেসে উঠলেন, ‘আমার ছোটবেলা? আমি তো জন্ম থেকেই বুড়ি রে।’
‘বলো না বড়দি প্লীজ। ধরো তোমার বাবা-মার কথা, তোমার বিয়ের আগেকার কথা।’
‘তারাপ্রসন্ন আচার্যির নাম শুনেছিস?’
শুনিনি কিন্তু খুব উৎসাহের সঙ্গে বললুম—‘হ্যাঁ।’
‘সেই বাবু তারাপ্রসন্নর দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে ছিলুম। আট মহলা বাড়ি, মাটিতে পা পড়তো না, এ মহল থেকে ও মহলে যেতে পালকি আসত। গা ভরা ঝমর ঝমর গয়না। কোলে পুতুল। কাঁখে পুতুল। আমার মা ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী আর বিদূষী। সংস্কৃত জানতেন, ইংরেজি জানতেন। বাড়িতে টুলো পণ্ডিত রেখে, মেম রেখে শেখানো হয়েছিল সব। বাবা দুম করে মারা যেতে সব্বাই একধার থেকে বলল অত বিদূষী বলেই বেধবা হল। মারও মাথা মুড়িয়ে দিল, আমাকেও তোর বুড়ো দাদুর সঙ্গে বে দিয়ে দিল। ব্যস, ছেলেবেলা শেষ।’
‘বুড়ো দাদু কেন বড়দি? তোমার সঙ্গে যখন বিয়ে হয় বড়দার কত বয়স ছিল!’
‘আমার আট আর তার উনিশ।’
আমি হো হো করে হেসে উঠলুম—‘বাবলুর বয়সী এক ছোকরাকে তুমি বুড়ো বলছ?’
‘এই মোচ্ কুস্তিগীরের মতো চেহারা। চোখ যেন বাঘের মতো। বুড়ো বলব না? বুড়ো কি আর দেহে হয় রে? মনে হয়। রসকষ বলতে কিচ্ছুটি ছিল না। খালি শাসন খালি শাসন। পুতুল খেলনা আমার ছুঁড়ে ফেলে দিত। শাশুড়িকে সব সময় নালিশ। মা ব্যাটার কাছে আর ব্যাটা মায়ের কাছে সদাসর্বদা চুকলি কাটছে। ছোটটি পেয়ে তিনি কি মারটাই দিতেন। তার ওপর ছিল যখন তখন ছড়াকাটা।’
‘ছড়া? কীরকম ছড়া বড়দি?’
‘শুনবি? ‘বড় মানুষের কালো ঝি/ তার মুয়ে আবার এত বচন কি?
‘বড়মানুষের কালো বিটি/ তার অমন মুখে ঝাঁটা পিটি।’
‘রীতিমতো কবি ছিলেন তো দেখছি তোমার শাশুড়ি!’
ফোকলা মুখে দুষ্টু হাসি হেসে বড়দি বললেন, ‘আমিও ছড়া কাটতে কম যেতুম না। শুনবি?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ আমি উৎসাহের চোটে উঠে বসলুম।
বড়দি বললেন, ‘কটা মায়ের কটা ব্যাটা
হাতে আবার লাঠি সোঁটা
চোর পিট’ গে’, ডাকু পিট গে,’ গোরা পিট গে’ যা।
তা না মায়ের মুখে চুকলি খেয়ে বউয়ের পিঠে ঘা?’
দুজনে মিলে খুব খানিকটা হাসলুম।
বড়দি বললেন, ‘ছেলেমেয়ে কতকগুলো হয়ে হয়ে মরে গেল। শাশুড়ি বলতেন, ‘বাঁচবে কি? রাক্ষুসীর পুত রাক্ষুসী নিজেই গিলে খায়।’ ভয়ে কান্না পর্যন্ত গিলে ফেলতুম!’
‘কেন বড়দি? তোমার অত বিদূষী মা; তোমার অত ধনী বাপের বাড়ি কেউ দেখাশোনা করত না?’
‘ওরে না রে না, সেসব দিনে সব বউ ঝিকে শ্বশুরবাড়ির খোয়ার সহ্য করতে হত। আর মা যে এদের রকম সকম দেখে আমার এক সিন্দুক গয়না আটকে রেখেছিলেন! আমাকে খালি বলত—গয়নার বাক্সের চাবি দাও। আর আমি বলতুম, চাবি মায়ের কাছে। তাইতে তো আরও চটে যেত মায়ে ব্যাটায়। একে তো ওই খোয়ার, তার ওপর ইস্ত্রীধন গয়নাটুকু হাতে তুলে দিয়ে মরি আর কি!’
‘তবে তো তুমি খুব বড়লোক বড়দি!’
‘তা বই কি! দশ লাখ টাকার গয়না তো হবেই কমপক্ষে। বেশি তো কম নয়, বড়দি উদাস গলায় বললেন, বাউটি, পৈছে, বাজু, খাড়ু, মফ্ চেন, সীতে হার, কাঁকন, কণ্ঠী, চিক, সে কত! সোনাই তাল তাল, তা পরে ছিল হীরে, পান্না, চুনী, সব আলাদা আলাদা সেট।’
‘ছিল কেন বলছো, বড়দি। সব দিয়ে দিয়েছ?’
‘দিয়ে দিয়েছিই বটে, তোকে চুপিচুপি বলছি দাদা, কারুকে বলিসনি। আমার সে গয়না যে দিয়েছিল সেই গর্ভধারিণী মা-ই নিয়েছে।’
‘সে কি?’
‘আহা, মায়ের আমার শেষ জীবনে সে কি কষ্ট! জ্ঞাত-গুষ্টি যা ছিল সব লুটেপুটে নিচ্ছে। বিদ্যে থাকলে কী হবে? ভালোমানুষ বেধবা কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারতেন না। শেষ বয়সের আতপান্ন আর একটু দুধ-কলা। আফিম খেতেন। সেই আফিম, সে-ও বুঝি যোগাড় হয় না। আমার গচ্ছিত গয়না দিয়েই মার জীবন চলল। মা মরতে সিন্দুক খুলে দেখি ভোঁ ভাঁ। তা হয়েছে, হয়েছে বেশ হয়েছে। ও জন্যে আমি দুঃখু করি না।
আমি অবাক হয়ে রইলুম। এই বড়দি নাকি স্বার্থপর, দোর্দণ্ডপ্রতাপ! দজ্জাল! আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলুম—‘আমার দিদুর কথা বলো বড়দি!’
‘তোর দিদু ছিল রাঙা টুকটুকে। এই চোখ, এই নাক, এ-ই কোঁকড়া চুল। সে আসতে বুঝি তোর বড়দা আর তার মার দুঃখু ঘুচল। বড় হয়ে যখন ঘর করতে এলো চা দেবে ছোট বউমা, পান সেজে দেবে ছোট বউমা। আপিস থেকে ফিরে সে মানুষ আগে আদর করবে তোর বাবাকে। সে কি আদর! তোর বড়জ্যাঠা বললে—ডাক্তারি পড়ব, —না। মেজ বললে—এঞ্জিনিয়ারি পড়ব—না।’
আমার চোখের সামনে থেকে কুয়াশা সরে গেল। কালোকালো নোলকপরা বড়লোকের আদরের দুলালী। অনাদরে, অবহেলায়, অপমানে পাগল-পাগল, দু চোখে হিংসার পান্না ঝলসাচ্ছে। ভেতরে কঠিন সব সংকল্প জন্মাচ্ছে। দাঁতে দাঁত। প্রতিহিংসা। ছোট্ট এতটুকু সংসারের পরিসর। তারই মধ্যে সে ব্লাডি মেরি, ক্যাথারিন দা গ্রেট। কী করবে? যা পেয়েছে সুদসুদ্ধু তাকে তো তা ফেরত দিতে হবে! আমি বড়দির ফাটা পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলুম। চিরকালই একা ছিলেন, এখন আরো একা। দিদুর তবু আমি ছিলুম। সুনাম ছিল। বাড়িসুদ্ধু ছেলে-মেয়ে বউয়ের ওপর অধিকার আর শাসন জারি করেও বড়দি একেবারে নিঃস্ব। আস্তে আস্তে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। বড়দির ঘরে রাজ্যের পুরনো জিনিসের গন্ধ। এত জিনিস জমিয়ে রেখেছেন অথচ সুখস্মৃতির কোন সঞ্চয় নেই। তবু গন্ধটার একটা নিজস্ব আবেদন আছে। বুক ভরে সেই পুরনো-পুরনো একাকিত্বের গন্ধ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম। অন্ধকার দালানে আবার সেই ঝিন ঝিন ঝিন ঝিন শব্দ চারিদিকে। ফাঁকা মাঠ দিয়ে পালকি চলছে, রে রে করে যেন সশস্ত্র ডাকাত পড়ল। কারা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। খুব ঢাকঢোল বাজছে কোথাও, বাতাসে মানুষের চামড়া পোড়ার দুর্গন্ধ। বাইরের দিকে এলুম। কার্নিশে পায়রাগুলো বু বু বু আওয়াজ করছে। ওদিকের ঘর থেকে দাদুর কাশির শব্দ ভেসে এলো। দোতলায় চলে এলুম। তারপর ছাদ। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া। ভাগনার্স গ্যাপে মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার বাজপাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ছুটে চলেছে। ঠাকুরঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে আলো জ্বেলে দিলুম। ঝুল পড়া বাল্বটা থেকে আলোর চেয়ে ভুতুড়ে একটা আবছায়াই হল বেশি। লক্ষ্মীর পটের পেছন থেকে দিদুর চোখ আমার দিকে চেয়ে হেসে উঠল। বাঁ দিকের দেয়ালে বড়দাদু। ওপর দিকে মালা জপছেন একজন শুষ্ক বৃদ্ধা। নিশ্চয় দাদুদের মা।
বড়দাদু বললেন, ‘আমরা অনেক ভুল করেছি ভাই। তোমরা কোরো না।’
‘করেছ? স্বীকার করছো তাহলে?’
‘নিশ্চয়। অনেক অন্যায়, অনেক অবিচার করেছি। তাতে করে মানুষ পাল্টে গেছে। যার যা হবার কথা ছিল সে তা হয়নি।’
দিদুর দিকে চাইলুম। দিদু বললেন, ‘তুই আমার মুক্তি, তুই এদেরও মুক্তি বাবু। তোর ওপর থেকে আমি আমার একার দাবীর হাত তুলে নিলুম।’
নীচে নেমে এসে দাদুর পাশে শুয়ে পড়লুম। দাদু চিত হয়ে শুয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করছেন গলায়। আস্তে পাশ ফিরিয়ে দিলুম। ভোর রাত্রে খুব সুন্দর এক পশলা ঘুম হল। সকালে খেতে বসে দেখি টুলটুল, সুমন, বাবলুরও নেমন্তন্ন। কি আনন্দ! চার ভাইবোনে মেজজেঠিমাকে খুব শাবাশ দিয়ে খেলুম। তারপর দাদুকে নিয়ে বাড়ি।