Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জননী || Samaresh Majumdar

জননী || Samaresh Majumdar

তিন-তিনটে শকুন মাথার ওপর পাক খেয়ে গেল। খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল ওরা, ডানায় শব্দ তুলে ওপরে উঠে গেল, অনেকটা ওপরে। জলে পা ডুবিয়ে ভেজা বালিতে আধা শোয়া বিন্দু দেখল ডানা টানটান করে মুখ ঝুঁকিয়ে ওরা ওকে লক্ষ করছে।

আকাশটা আজ সকাল থেকেই এইরকম। আধপোড়া কাঠের মতো চেহারা। নামছে না একটা ফোঁটাও অথচ আলো বলতে যেটুকু মরা মাছের চোখেও বুঝি তার চাইতে বেশি চটক। কেমন থম ধরে আছে চারদিক। তিন-তিনটি দিন কাঁদিয়ে ভাসিয়ে আজ এ কেমন ধারা গো।

নদীটার অবস্থাও হয়েছে তেমনি। বুড়ো সাপের মতো গতর। মতলব বোঝে কার সাধ্যি। বৃষ্টি নামার আগে বিন্দুরা দল বেঁধে সাঁতরাতো। দলেরই কেউ হয়তো দেখেছে, হুই যে কালো মুখ উঁকি মারে জল সরিয়ে, দাও ঝাঁপ দাও ঝাঁপা পলকে কটা শরীর জলে পড়ে শব্দ করে। চালাকি চলবে না বাপু, বুঝেসুঝে হাত বাড়াও। একটু জোর খাঁটিয়েছ কি মারবে এমন থাপ্পড় যে দেখবে তুমি এই চত্বরের কোথাও নেই। বেয়াদপি করতে গিয়েছিল হারান সেনের ছোট ছেলেটা, ওর হাড়মাংসগুলো পাওয়া গেল কিং-সাহেবের ঘাট ছাড়িয়ে কাশবনের চড়ায়। অতএব জলের। যেদিকে মতি সেদিকেই চলো, মাছের মতো তারই মধ্যে একটু এপাশ ওপাশ হও, দেখবে বুড়ি তিস্তা তোমাকে নিয়ে যাবে সেইখানে যেখানে কালোমুখ নৃত্য করে। যার সাহস বেশি, বুড়ি তিস্তা যাকে একটু দয়া করবে, সেই দেবে হাত। তারপর শক্ত হাতে হাল হয়ে স্রোত ধরে চলো ওটাকে নিয়ে, এক সময় ঠিক চড়ার গিয়ে ঠেকবে। সঙ্গে যারা এল গেল, তারা জলে চোখ জবা করে। ফিরে যাবে আধ মাইল উজানে। আর যে পেল সে তো মহাখুশি। এখন শুকোক এ কাঠের গুঁড়ি। রোদ্দুর খাক দিনভোর। কোপ বসাও মনমতন, টাকায় দশ কিলো তো চোখ বুজে বিক্রি। সেই। সক্কাল থেকে আসে মেয়েগুলো, খ্যানপাড়ার যত রাজবংশী মেয়ের ঝাঁক ওত পেতে থাকে।

আজ তিন-তিনটে দিন জব্বর বৃষ্টি। এই যে বিরাট বালির চরটা, এখানে কেউ পা রাখবে বুকের পাটা কার! বুড়ি তিস্তা খেপলে তার নিশ্বাসের সামনে কে আসবে গো! এই যে বুড়োর দাড়ির মতো কাশফুলগুলো, একটারও ঘাড়ে মাথা নেই। এই তিন দিন তিন রাত সব্বাই যে-ার ঘরে। আজ সকালে যখন আকাশটা কেমন চুপচাপ, বিন্দু একাই দৌড়ে এল বাঁধের ওপরে। আর। এসেই শরীর হিম হল ওর। হা মা বুড়ি তিস্তা, তোমার এ কি চেহারা গো। মাটি খেয়ে-খেয়ে জলের রং এত কালো হয়। আই বাপ বুকে ভয় লাগে। আর কী মোটা হয়ে গেল নদীটা। নদীটারে বুড়ি কে বলবে এখন? স্রোতে কী ছোবল তার? ভর-বয়সের বিয়ের জল-খোঁজা হুঁড়ির মতো চনমনে।

আর তারপরেই চোখ পড়ল। এই তিন দিন ধরে বিন্দু ভাবছিল। বুড়ি তিস্তার যেখানে জন্ম, সেই পাহাড়ে তো এখন রাম-রাবণের যুদ্ধ হচ্ছে নিশ্চয়ই। হায় কত গাছ ভাঙল, কত মাঠ ভেসে গেল। আর এখন বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়েই ওর নজর গেল, স্রোতের টানে হাবুডুবু খেতে-খেতে চলেছে কালো মানিকের ঝাঁক। বিন্দুবাঁধ থেকে নেমে ছুটল। ভেজা বালিতে পা টানছে। ন-হাতি কাপড়টা সামলে ও হাঁপাতে-হাঁপাতে এসেছিল নদীর ধারে। বৃষ্টির আগে এর ডবল পথ হাঁটতে হত। কিন্তু কাছে এসে জলের গায়ে দাঁড়িয়ে বুকে থম ধরল বিন্দুর।

ও মাগো। বিন্দু বুকে হাত দিল। কী পাগলপারা ঢেউ গো। সেই সেবার রাক্ষুসী যখন চলে এসেছিল বাঁধ কেটে ওদের দাওয়ায়, সেবার চেহারা এমনতর ছিল। এটা কি বলে ফেলল ও, . রাক্ষুসী কেন বলল? হেই মা, হেই বুড়ি মা, তিন-তিনবার গড় করল বিন্দু। তুমি আমাদের খেতে দাও পরতে দাও জননী গো, পাপ নিও না মা। বিন্দু মনে-মনে বড়ঠাকুরের পা ছুঁয়ে নিল একবার।

কিন্তু এ জলে নামবে কে? এই শোঁ-শোঁ শব্দ, উথালপাথাল ঢেউ। বিন্দুনদীর ওপর দিয়ে তাকাল। ওপারে যেখানে বার্নিশ ঘাটের দোকানগুলো আছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিন্দুর চোখ বড় হল, বাপ, কি বড়-বড় কাঠের গুঁড়ি ঠিক মধ্যিখান দিয়ে যাচ্ছে গো। হাত-কামড়ানো কপাল-চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এদিকে ধারের জলের টান কম। গাছের বাকল, ভাঙা ডাল ঘুরপাক খাচ্ছে এদিকটায়। বিন্দুশাড়ি পেঁচিয়ে জলে নামল। বুড়ি মাগো, এক বুক যাব, তার বেশি নয়।

বুড়ি তিস্তার জল এমনিতেই মাঘ মাসের হাওয়ার মতো, কিন্তু আজ এত শীতল কেন? হাড়মাস। কেটে নিচ্ছে গো। কামটের মতো। জলের তলায় টুক করে আঙুল কেটে নিয়ে গেল, তুমি টেরও পেলে না। কাশফুলের মতো হালকা শরীর বিন্দুর, কোমর জলে ভাসালো। পাশের তলায় বালির গায়ে পলির সর জমছে, হাঁটবে সাধ্যি কি। আর সেই থেকে টুকরো কাঠ আর বাকল ধরেছে। কোমরজলে দাঁড়িয়ে আর জমা করেছে ভাঙা কাশ গাছের গোড়ায়। তা এই করতে-করতে দু প্রহর বেলা গেল গড়িয়ে, আকাশ দেখে বুঝবেটা কে? কাঠ জমেনি এমন কিছু। শেষপর্যন্ত হাঁপিয়ে গেল বিন্দু। চিত হয়ে শুয়ে রইল ভেজা বালির ওপর নিথর হয়ে। শুয়ে আকাশ দেখল। তিন তিনটে শকুন চক্কর কাটছে। হিম বাতাস বইছে এখন। ভেজা শাড়ি, অঙ্গজুড়ে রাজ্যির শীত আনছে। বিন্দু ভাবল, আর নয়, এবার ফিরতে হবে। খ্যানপাড়ার কোনও মেয়ে আজ আর আসেনি। এই জলে নামবে হিম্মত আছে কার? বাতাসে বিন্দুর শরীরে কাঁটা ফুটছিল। বিন্দু দেখল, খুব কাছাকাছি নেমে এসেছিল শকুনগুলো ডানার শব্দ তুলে, আবার ওপরে উঠে গেল।

আর এই সময়েই ওর চোখে পড়ল। পড়তেই তড়াক করে উঠে বসল ও। বেশ লম্বা, তা হাত দশেক হবে, বিন্দু আন্দাজ করল, একটা কাঠের গুঁড়ি এদিকে আসছে। আয়-আয় বাবা, এদিকে আয়। উত্তেজনায় বিন্দু উঠে দাঁড়াল, পাঁচ পয়সার বাতাসা মা, ও মাগো বুড়ি, মানত রইল, ঠেইলে দাও এদিকে, ঠেইলে দাও। গুঁড়িটা ঢেউ-এর তালে দুলতে দুলতে, কি আশ্চর্য, অল্প জলে চলে এল। সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁপ দিল বিন্দু। জল টেনে টেনে গা ভাসাল খানিক। গুঁড়িটা আর এদিকে আসছেনা। অনেকটা দূর চলে এসেছে বিন্দু। সমান্তরাল হয়ে চলছে গুঁড়িটার সঙ্গে। হেই মা বুড়ি, একি লোভ দেখালে মা, আমি ফিরব কেমন করে? এখনও অবশ্য বড় ঢেউ অনেক দূর। গুঁড়িটা এখটু এগিয়ে এসেছে। আহা বেশ মোটা গো। বিশ কিলো, না মণটাক তো হবেই। হাত। বাড়াল ও। বুকের কাপড় খুলছে ঢেউ। পাক খেলো পেটের তলায় আঁচলটা। টানের চোটে গুঁড়িটা একটু সরে এলো। না, হল না। মুখ দিয়ে জল ছিটোল বিন্দু। বুকভরে বাতাস নিল। তারপর। মরিয়া হয়ে আর একটু এগোল ও। এই-এই, ব্যস! হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। গুঁড়ি থেকে বেরুনো একটা ডাল এখন বিন্দুর মুঠোর ভিতরে। কী আরাম! বিন্দু চোখ বুজল। তারপর ডান হাতে জল কাটতে লাগল ও। একটু-একটু করে স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে-চলতে পায়ে বালি এল হঠাৎ। আঃ, বিন্দুদু-হাতে গুঁড়িটাকে টানতে লাগল। হেই বাপ, যা ভেবেছিলাম তা তো নয়। বিরাট বড়, সেই স্কুলবাড়ির গাছটার মতো গাছ হে। জল বলে টানা যায়। কিন্তু এখন এই যে চরে লেগে গেল তলাটা, এখন যে আর ওঠে না। প্রাণপণে শরীর বেঁকিয়ে কাদা মেখে খানিকটা ওপরে আনল বিন্দু। অর্ধেকের বেশি এখন জলে। বেশ গোটা গাছ। বিন্দুবালিতে উঠে এল। হঠাৎ একটা খসখস শব্দে তাকাতেই বিন্দু লাফিয়ে একমানুষ দূরে ছিটকে পড়ল। হাইবাপ। কালসাপ গো। বিন্দুর বুকটায় কোনও বাতাস নেই যেন। ফ্যালফ্যাল করে ও দেখল হেলতে-দুলতে একটা। কালো গোখরো গাছের পাতা সরিয়ে সরসর করে বালিতে নামল। তারপর ফণা তুলে বিন্দুকে একবার দেখল। শেষপর্যন্ত হেলতে-দুলতে বালির ওপর দিয়ে ভাঙা কাশফুলের জঙ্গলে ঢুকে গেল সাপটা।

বেশ কিছুক্ষণ বিন্দু পাথর হয়ে রইল। তারপর একটু ধাতস্থ হতে পায়ে-পায়ে গাছটার সামনে এসে দাঁড়াল। ওর মনে হচ্ছিল সাপটার নিশ্চয়ই একটা সঙ্গী আছে। কয়েকবার তালি বাজাল। মনসা গো, হেই মা মনসা, অস্তি, অস্তি-চেঁচাল বিন্দু। একটা সাহস পেয়ে কয়েক মুঠো বালি ছুঁড়ে দেখল কিছুনড়ে কিনা। যা পাতা গাছটার।

এখন হবেটা কি! এই গাছ ফেলে যাবেই বা কী করে! কমসে কম এক কুড়ি টাকার গাছ। সেই গেঁজেলটাকে একবার ডাকবে নাকি! বলবে নাকি, পোয়া ভাগ দাম দেব, একটু হাত লাগাও। না, সে গেঁজেল আসবে না। ঘরের উনুন জ্বলবে না? কেন, বিন্দু কোথায়। পরনে কাপড় চাই? বিন্দুরে বল। গাঁজার পয়সা? –ও বিন্দু বিন্দুমতি। কানের লতি গরম হয়ে গেল ওর। পুরুষমানুষ, জমি নেই, লাঙল নেই, কিন্তু তাই বলে গতরও কি থাকতে নেই! মোষের মতো তো চেহারা, গাঁজা খাবে আর ঝিমুবে। দুটো পাঁচটা কাজ বলো, ফেরিঘাটে মোট বইতে বলল, সে দুরের কথা, গতর থাকলে কি এই আট বছরে বিন্দুকে বাঁজা থাকতে হয়! মরণ-মরণ। হেই বুড়ি তিস্তা, তুমি তো। সবখাকী, ওটারে। চোখে জল এসে গিয়েছিল। একটা আক্রোশের বশে ও গাছটাকে নিয়ে টানাটানি করল খানিক। আর সেই সময়েই ওর নজর পড়ল।

নজর পড়তেই ও একদম সিধে, কলাগাছের মতো কাঁপন শরীরে। একি হল, হেই মা, এটা কি দিলে। বিন্দু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও ভয়ে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল। এখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিরাট তিস্তার চরটা জনমানব শূন্য। বিন্দুর গলার শব্দ বালির ওপর দিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে জলের সঙ্গে মিশে গেল। তিস্তার বুকে রাগী মোষের মতো অজস্র ঢেউ-এর গোঁ-গোঁ দাপানি। বিন্দু চোখ বড় করে দেখল, কেউ নেই। জলপাইগুড়ি শহরের গা ছুঁয়ে এলাকা ওদের, খ্যানপাড়ায় মানুষ নেই নাকি। একটু বাদে, বুকের শব্দটা কমে এলে ও জলে নামল। কোমরজলে যেতে হল না, তার আগেই ও পরিষ্কার দেখতে পেল। ঢেউ-এর তালে তালে শরীরটা এখন দুলছে না। শরীরটা নয়, শরীর দুটো। একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে মিশে রয়েছে। বিরাট গাছটার ডালপালায় শরীর দুটো ঢাকা। পুরুষটার দুটো হাতের মুঠিতে গাছের ডাল ধরা। মুখ বুকের ওপর গোঁজা। পুরুষটার শরীর ধরে ঝুলছে মেয়েছেলেটা, মুখ হাঁ করে। পুরুষটার বউ নাকি! বেঁচে আছে নাকি।

দাঁতে দাঁত চেপে বিন্দু পুরুষটার হাতের মুঠো গাছের ডাল থেকে টেনে ছাড়িয়ে আনল। কি শক্ত বাঁধন। হায় গো। তারপর জলের ওপর দিয়ে টানতে লাগল ও। পুরুষটাকে জড়িয়ে ধরেছে যে মেয়েটা তার হাতের বাঁধন একটুও আলগা হল না। বউটার মুখ জলে গোঁজা। কচুরিপানার। শেকড়ের মতো রাশরাশ চুল ভাসছে। পুরুষটাকে টানতে বউটাও উঠে আসছিল চরের দিকে, বিন্দুর বুকটা কেমন করছিল।

বালির ওপর ওদের এনে বিন্দু লাফিয়ে চলে এল পুরুষটার মাথার কাছে। তারপর ঝুঁকে পড়ে হাত নিয়ে এল পুরুষটার নাকের কাছে। না, বাতাস নেই। শরীরটা ফুলে ঢাক। জামাকাপড়ে মাংস চেপে বসেছে। কদিনের মড়া কে জানে। বউটার মুখ বালির ওপর পাশফিরে আছে। উপুড় হয়ে শোয়া। বউটার বয়স কম, সুন্দরই। বিন্দুর থেকে তো কম নিশ্চয়ই। মুখ চোখ দেখে তো সুন্দরই লাগে। বিন্দু দেখল, বউটার বাঁ-নাকের পাটায় ফুটো, আর তাতে একটা সুতো জড়ানো। অজান্তে নাকে হাত দিল বিন্দু। না, তার নাক সে ফুটোতে দেয়নি। এই নিয়ে মায়ের কি রাগারাগি। আট বছরের বিন্দু গোঁ ধরেছিল, না, আগে নাকছাবি এনে দাও তবে নাক ফুটোব। হলুদ সুতো পরব না। এখন এই বউটার জন্যে হঠাৎ মায়া হল। আহা বেচারি।

পুরুষটার হাত ধরে টানতে লাগল বিন্দু। হেই বাপ, কি ভারী শরীর। জলে বোঝা যায়নি। জলে শরীর খেয়ে নেয় যে। বিন্দু প্রায় ঝুঁকে পড়ে পুরুষটাকে টানতে লাগল। বলা যায় না, যদি সত্যি মরে থাকে। সেই সেবার কাকে যেন মড়া বলে জলে ফেলা হল, সাত বছর পরে সেই আবার বিড়ি ফুকতে–ফুকতে ফিরে এল। কথায় বলে জলের মড়া না মাটির সরা। মাটিকে জল দাও। গলে যাবে। কিন্তু মাটির সরায় প্রাণভর জল খাও, থাকবে। এও তেমন। জলে-জলে জীবন পায়। গোঁড়ালি বালিতে বসে যাচ্ছে বিন্দুর, কপালে ঘাম জমেছিল। বালিমাখা শরীর কাদাখোঁচা পাখির মতো কাঁপছিল। টানতে-টানতে ওদের অনেকটা উঁচুতে, প্রায় কাশফুলের জঙ্গলের গায়ে এনে ফেলল ও। বউটার হাতের বাঁধন একটুও আলগা হয়নি। বালির ওপর দুটো শরীর লাঙলের মতো মোটা দাগ কেটে এসেছে। বিন্দু হাঁপিয়ে পড়েছিল। ক্রমশ ওর কেমন ভয় করতে লাগল। এই নির্জন নদীতীরে দুটো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ও কেমন একা বোধ করতে লাগল। অথচ এই এতক্ষণ, জল থেকে ওদের টেনে তোলার সময় ওর মধ্যে এই ভয়টা ছিল না। বিন্দু মুখের কাছে দু-হাত মেলে দেখল। না, লেগে নেই। ওর শরীর হঠাৎ শিরশির করে উঠল। আর তারই দমকে বিন্দু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল বাঁধের দিকে, বাঁধের পেছনে একহাঁটু কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা খ্যানপাড়ার দিকে। নদীর বুক থেকে একরাশ ভিজে হাওয়া বিন্দুকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল যেন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

পাড়ার ভেতর এসে বিন্দু থমকে দাঁড়াল। বাইরে কেউ কোথাও নেই। বৃষ্টির জোর বাড়ছে। কাকে বলবে ও। সুরেন সেন পাড়ার মাথা। লোকটার চোখ সব সময় বিন্দুকে দেখলেই চকচক করে। নুলো হ। এখন তো সব যে-যার ঘরে। একবার চেঁচাবে নাকি? বিন্দুর চকিতে গাছের গুঁড়িটার কথা মনে পড়ে গেল। ভিড় জমলে তো আর পাঁচটা হাত গাছে পড়বে না। ক-জনকে সামলাবে ও। এই তিনদিন তো সবাই বেকার। মাছ জল ছেড়ে উঠে এসেছে। পাঁড়ার একহাঁটু কাদা ঠেঙিয়েও সবাই ছুটবে। না, চেঁচানো চলবে না।

বিন্দু কাপড় সামলে নিজের দাওয়ায় উঠে এল। বুড়ি শাশুড়ি তেমাথা হয়ে কোণায় বসে। বিন্দু দেখেও দেখল না। সোজা ঘরে ঢুকে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

হেই, উঠ উঠ উঠ না কেন। বিন্দু হাত ধরে ঝাঁকাল। বিন্দুর স্বামী হাঁ করে কী ভাবছিল, থতমত খেয়ে বউকে দেখল। তারপর কাদাবালি মাখা ভেজা শাড়ি জড়ানো অদ্ভুত চেহারাটাকে ভালো। করে নিরীক্ষণ করে মুখটাকে ছুঁচলো করল।

আঃ, মরণ আমার। একবার নদীর ধারে চল কেন। বিন্দু ছটফট করছিল।

বিরাট গাছ ধরেছি। এক কুড়ি টাকার গাছ। আর জোড়া বরবউ! মড়া।

মড়া? মড়া তুই পালি কোথা? এবার লোকটা উঠে বসল।

ওই গাছের সঙ্গে ছিল যে।

বিন্দু দেখল গেঁজেলটা কি ভাবল খানিক। তাকপর চল বলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এত সহজে ওকে ঘর থেকে আনতে পারবে, ভাবেনি বিন্দু। লোকটা এবার বৃষ্টি দেখল তারপর মাটিতে নামল। বিন্দুচকিত দেওয়ালে গোঁজা দা-টা টেনে নিয়ে স্বামীর পেছন ধরল। গাছটাকে কেটে-কেটে ছোট করতে হবে।

ওরা দুজন প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছিল। যদিও পাড়ার কেউ বাইরে নেই, তবু বিন্দুর সঙ্গে ওর স্বামীকে হেঁটে যেতে দেখলে অনেকের সন্দেহ হতে পারে। এ দৃশ্য খুবই অচেনা সবার। ওরা বাঁধের। ওপরে উঠে এলে বিন্দু দৌড় লাগাল। বাতাসে ওর চুল কাপড় উড়ছিল। ওর তর সইছিল না। বৃষ্টি মাথায় করে ও ছুটছিল নদীর দিকে ভেজা বালি মাড়িয়ে। ওর স্বামী দৌড়বার চেষ্টা করল না। মুখ বেঁকিয়ে দাঁত চেপে গজরাল, হেই বাঁজা মেয়েমানুষটা, দৌড়াস কেন রে, ফুর্তির পোকা মাথায়, অ্যাঁ!

বিন্দুর কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছিল। দৌড়ে ও যতই নদীর কাছাকাছি আসছিল ততই ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। নদীর গায়ে এসে ও থপ করে বালিতে এসে পড়ল না। গাছের গুঁড়িটা নেই। জল বেড়েছে, বেশ খানিকটা উঠে এসেছে। হেই মা বুড়ি তিস্তা, এটা কীরকম বিচার মা। পাঁচ পয়সার বাতাসা মানত দিলাম তোমারে। বিন্দু আশেপাশের জলে গাছটাকে খুঁজে পেল না। স্রোত কখন এসে টেনে নিয়ে গিয়েছে।

অবসন্ন হয়ে বিন্দু দেখল অনেক দূরে বালির ওপর দিয়ে ওর স্বামী আসছে। ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ওর। এই গেঁজেলটা ওর যম, ওর অপয়া। বিন্দুরাগে একদলা থুথু ফেলল বালিতে। তারপর মুখ তুলে দেখল মড়া দুটো কাশফুলের গোড়ায় তেমনি পড়ে আছে। আর হ্যাঁ, শকুন তিনটে খানিক। দূরে, যেন ওকে দেখেই সরে দাঁড়াল।

খানিক বাদে গেঁজেলটা এসে গেল। এসে কোমরে হাত রেখে মড়া দুটোকে দেখল। তারপর বলল, বাহা, বেশ ডাগর বউ হে! শরীরখানা জব্বর। সঙ্গে-সঙ্গে বিন্দুর মাথাটা ঘুরে গেল। যেন চৈত্তির মাসের ভরদুপুরে উনুনে হাত রাখল সে, দাঁতে ঠোঁট চাপল ও। মেয়েছেলের ন্যাংটো বুক দেখে নোলা ঝরছে। বিন্দুর হাতের মুঠো দা-এর বাঁটে শক্ত করে বসল।

জরিপ করছিল লোকটা। তারপর বলল, কী করবি লাশ দুটো নিয়ে, হ্যাঁ?

বিন্দু কোনও জবাব দিল না।

গেঁজেলটা ঠোঁট ছুঁচলো করে একবার চুকচুক শব্দ করল। তারপর চার পাশ দেখে নিয়ে এক গাল হাসল, তোর কাঠ কই, অ্যাঁ!

বিন্দুর বুকের মধ্যে যেন পোড়া কাঠের ঘেঁকা লাগছিল। ওর হাতের মুঠোয় ধরা দা-টা এখন কাঁপছে তিরতির করে।

গেঁজেলটা এবার মড়া দুটোর চারপাশে একবার চক্কর মেরে নিল। তারপর হাঁটু গেড়ে পুরুষটার পাশে বসে টেনে হিঁচড়ে বউটার হাতের বাঁধন খুলে এক পাশে সরিয়ে রাখল। পুরুষটা একটু কাত হয়ে গিয়েছিল। জলে ভিজে শ্যাওলা রঙের শরীর কেমন নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে, বেঢপ হয়ে। গেঁজেলটা এবার চটপট হাতে পুরুষটার জামা ধরে টানাটানি করতে-করতে কলার খোলার মতো শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর বিন্দুর দিকে তাকিয়ে হাসল, এর আর জামার কি দরকার বল। প্রাণ উড়ে গেলে শরীর মাটি হয়। বলে কোমরের কসি কাদামাখা খুলে ধুতিটাও সরসর করে খুলে নিল। ফুলে যাওয়া শরীর থেকে কী করে জামাকাপড় খুলে নিল গেঁজেলটা, বিন্দু চোখ চেয়েও বুঝতে পারল না।

একদম উদোম হয়ে পড়ে রয়েছে পুরুষটা। জল খেয়েছে জব্বর। জলে শরীর যেন শুষে নিয়েছে। গেঁজেলটার লোভ সারা অঙ্গে। বিন্দুদা হাতে উঠে দাঁড়াল। এই সুযোগ, কেউ নেই, ব্যাপারটার সাক্ষী কেউ নেই। হেই মা তিস্তা, পাপ নিও না গো।

জামাকাপড় থেকে ভালো করে জল নিংড়ে কাঁধে ফেলে বউটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল গেঁজেলটা। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বউটা। বুকের পাশে খুলে যাওয়া আঁচলটা তুলে গেঁজেলটা বলল, আই বাপ, নতুন কাপড় হে। বলে হিড়হিড় করে টান দিল, যেন নৌকোর গুণ টানছে। বিন্দু দেখল বউটার শরীর কয়েক পাক সরিয়ে কাপড়টা খুলে এল।

কাদামাখা শাড়িটা নিয়ে গেঁজেলটা দু-পা এগিয়ে এল, নে ধর, নতুন শাড়ি। হাই বাপ, মা কালীর মতো দেখায় যে তোরে। নে-নে পরে নে ক্যান। তারপর গোপন কিছু বলছে এমন মুখ করে। বলল, শুনিস নাই, মৈথুন সাপের অঙ্গছোঁয়া বস্ত্র খুব পয়মন্ত। এরাও তো সাপের মতো। জলে। ভেসে এল যে। বিন্দুর দিকে শাড়িটা ছুঁড়ে দিয়ে বাঁধের দিকে কয়েক পা হেঁটে মুখ ঘুরিয়ে বলল, লাশ দুটো জলে ফেলে দে রে, ভেসে যাক। শালা জবাব দিতে দিতে প্রাণ ভোর হয়ে যাবে কিন্তু।

কী বলল গেঁজেলটা? মৈথুন সাপের কথা বলল কেন? বিন্দু হতভম্ব হয়ে পড়ল। সত্যি নাকি? বিন্দু ভাবতে পারছিল না কিছু। যেভাবে ওরা জড়িয়ে ছিল–হেমা মনসা, তাই কি তুমি গাছ থেকে নেমে এলে? বিন্দু ক্রমশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিল।

শাড়িটা দেখল। নতুন শাড়ি। জলে ভিজে কেমন আঁশটে গন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্ষার দিয়ে কেচে নিলেই হবে। এই মুহূর্তে কাঠ হারাবার দুঃখও ভুলে গেল।

লাস দুটো পরে আছে। বিন্দু পুরুষটার পা ধরে আবার টানতে লাগল। টানতে-টানতে এক সময়। বালির ওপর থেকে নামিয়ে তিস্তার জলে ফেলল ও। এখন শরীরের দিকে তাকানো যায় না। ঘেন্না ঠিক নয়, কেমন লজ্জাই করে যেন। একবার যখন বউ-এর বাঁধন খুলেছে তখন আর কেন। পা। দিয়ে একটু ঠেলা দিতেই দূরে চলে গেল লাসটা। তারপর স্রোতের টানে ঘুরপাক খেয়ে পলকে। উধাও।

এত ভারী কেন বউটা। পুরুষটার চাইতে ভার বেশি। জল খেয়েছে খুব। বউটার শরীর ধরে বিন্দু এবার টানছিল। ওর কপালে সদ্য জাগা ঘাম বৃষ্টির জলে মুছে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হল ওর বউটাকে জলের কাছে আনতে। একটা হ্যাঁচকা টানে বউটাকে ও জলে নামিয়ে দিল। টানের চোটে ঘুরে গেল শরীরটা, ঘুরে চিত হল। আর তখনই বিন্দুর সারা শরীর থেকে একটা চিৎকার ছিটকে। বেরিয়ে এল। মুখে আঙুল দিয়ে ও কাঁপতে-কাঁপতে ঝুঁকে পড়ল। এতক্ষণ ও বুঝতে পারেনি, ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি। উপুড় হয়ে ছিল বলে নজরে আসেনি। এখন চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, ভর-মাসের পেট। হেই মা গো!

ওটা কি! বিন্দু দেখল নাইয়ের পাশে বউটার চামড়া টানটান, পেটটার একটা দিক খোঁচা হয়ে উঠে আছে। ভেতর থেকে সেটা ঠেলছে নাকি। বিন্দুর শরীরে লক্ষ কদমফুল চনবনিয়ে উঠল এবার, ওর কেমন ঝিমুনি এসে গেল। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে কান পাতল বিন্দু, যদি কোনও শব্দ হয়। না, নিথর একদম নিথর। বড়-বড় চোখে বিন্দু দেখল, নাই থেকে একটা কালো রেখা নিচে চলে গিয়েছে সোজা। এর মানে ছেলে হবে। পেটের ভেতর বন্দি থাকা সেই মাণিকটার এখন কি করে! হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ও।

তারপর বিন্দু যখন এক সময় হাত সরিয়ে নিল তখন বউটার শরীর দুলতে-দুলতে জলের তালে সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ নজরে পড়ল, সেই তিনটে শকুন যেন নাচতে-নাচতে বালির ওপর দিয়ে এগোচ্ছে পাখা ফুলিয়ে। তারপর তিনজনেই আলতো উড়ে গেঁজেলটার মতো একটা চক্কর কেটে বউটার শরীরে গিয়ে বসল।

বিন্দু চিৎকার করে উঠল। এখনই ঠোকরাবে গো। হেই বুড়ি তিস্তা, ওরে ডুবায়ে দাও, জননী গো। হাঁটুজলে নেমে মুঠোয় ধরা কাপড়টা ছুঁড়ে মারল বিন্দু। ওই গেঁজেলটা–আমার পাপ। আবরণটা থাকত, একটু আড়াল। না, বিন্দু দেখল, শাড়িটা বউটার শরীর পর্যন্ত পৌঁছল না।

শকুন তিনটে দেখছে এক চোখে। জলের কিনার ধরে বিন্দুদা-টা মাথার ওপর তুলে হেই-হেই শব্দ করে ছুটছিল। বউটার নাই-এর পাশে বসেছিল যেটা, আলতো করে এবার ঠোকর বসাল। আর বিন্দু তখন তীব্র চিৎকার তুলে হাতের দা-টা ছুঁড়ে মারল শকুনগুলোর দিকে। শনশন শব্দ তুলে হাওয়া কেটে বউটার পেটে গিয়ে বিঁধল সেটা। আচমকা আক্রমণে শকুনগুলো লাশ ছেড়ে উঠল ওপরে। উঠে ঘুরপাক খেতে লাগল।

দা-টা বিধে যেতেই বিন্দুর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল। টানটান পেটে দা-টা কি সহজে ঢুকে গিয়ে অনেকখানি চামড়া চিরে ফেলেছিল। আর তার ফাঁক দিয়ে সেই খোঁচা হয়া জায়গাটা যেন লাফিয়ে বেড়িয়ে এল। বিন্দু দেখল একটা প্রায় পুরুষ্ট হাত সোজা পেট থেকে উঠে এসেছে। তার মুঠো যেন আকাশের দিকে বাড়ানো।

বউটার শরীর এবার স্রোতের টান পেল। সেই নির্মল হাতটার দিকে বিন্দু লোভীর মতো তাকাল। শকুন তিনটে ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে।

একটা গাছের গুঁড়ির মতো সেই নির্জনে নদীতীরে দাঁড়িয়ে বিন্দু দেখল, একটা নরম নিটোল হাত আকাশটাকে মুঠোয় করে কী গভীর সুখে বউটাকে পালের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress