Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জনক ও কালোকফি || Syed Shamsul Haque » Page 3

জনক ও কালোকফি || Syed Shamsul Haque

স্বপ্নের মতো জ্যোছনা নেমেছে

স্বপ্নের মতো জ্যোছনা নেমেছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা অস্পষ্ট গাছ আর বাড়িগুলো ক্রমাগত ঘুরছে, যেন একটা বাধনে আটকা পড়ে গেছে ওরা এই বিশ্বের সঙ্গে। সে বাঁধন কিছুতেই আর খোলা যাচ্ছে না। তাই বারবার, গ্রামে গ্রামে, অন্ধকারে অন্ধকারে ফিরে আসছে, গাছ, আবার গাছ, বাড়ি, আবার বাড়ি।

চীনে দোকানে যখন খাচ্ছিলাম আমরা, নিশাত বলছিল, আমার মা থাকলে খুশি হতো। ভাইজানও হবেন।

বিকট হুইসিল দিল আমাদের ট্রেন। গলা বাড়িয়ে দেখি ব্রীজ আসছে। জ্যোছনার মধ্যে অতিকায় একটা খেলনার তো দেখাচ্ছে। এইতো নিচে ছবির মতো দুধে ভরা নদী, নদীর পরে একটা কালো নৌকা, এতটুকু। উদ্দাম শব্দ উঠছে। রাতের স্তব্ধতা খানখান করে লোহার কড়ি বরগায় প্রতিধ্বনি তুলে, দার করে চলেছে আমাদের ট্রেন। একটা শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাত্রা ওপরে স্বচ্ছ আকাশ, নিচে অতল নদী, আকাশটা স্বচ্ছ আর ভঙ্গুর, আর কাছে অথচ দূরে, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো, লাফিয়ে উঠলে পৌঁছে যাবো বেহেশতের দরবারে।

আমার তখন ভয় করল খুব। যেন পড়ে যাবো। আমাদের ট্রেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তলিয়ে যাবে নদীর অতলে।

মা-র সঙ্গে আর দেখা হবে না আমার।

সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যেতে লাগল প্রতিধ্বনিগুলো, পিছিয়ে যেতে লাগল। চাকার নিচে আবার মাটির স্পর্শ বুঝতে পারছি। আবার দুপাশের থোকা থোকা অন্ধকার–মানে গাছ, সবুজ বাতি, আশেপাশে আরো অনেকগুলো লাইন, চিকচিক করছে, জীবন্ত স্রোতের মতো ওরা সচল, মন্থর হয়ে আসছে আমাদের ট্রেন।

আসলো। যেন প্লাটফরমে নামলেই দেখতে পাবো মাকে। উৎসুক হয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই বুকের ভেতরটা থমথম করে উঠল আমার। এ যে কী অনুভূতি না ভয়, না আনন্দ, না বেঁচে থাকা, না কিছু। কিছু না, এবং একসঙ্গে সবকিছু।

নিশাত আমার বউ হবে এই আনন্দটার মতো স্পন্দিত বিশাল যেন আর কিছু হয় না। সে রাতে শুয়ে শুয়ে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। যেন এক্ষুণি একটা বিকট চিৎকার চিরে ফেলবে আমার হৃদয়টাকে।

আমার সমস্ত কিছু যেন আরেক জীবনে, অন্য কারো জীবনে ঘটে গেছে। অতীতের কিছুই আমার নয়, তবু সেই অতীতটা দুঃসহ বেদনার মতো পাকিয়ে পাকিয়ে, মৃত্যুমুখে অজগরের মতো আছড়াতে আছড়াতে আমার ভেতরে মাথা কুটে মরছে।

কুলির মাথায় সুটকেস দিয়ে পথ জিগ্যেস করে পথ চলতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের জন্যে জ্যোছনা ঢাকা পড়েছে শাদা মেঘে। আমার খুব শীত করছে। জাম্পারটা পরেছি, তবু।

কে জানে কীভাবে আমাকে ওরা নেবে। চিঠি লিখে দিয়েছিলাম। কাজেই আচমকা হাজির হবার নাটকীয়তা থেকে বাঁচা গেছে। তবু ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান কি সহজ হয় এত সহজে? মাকে আমি বলব নিশাতের কথা। আমার ওপরে কেউ নেই, আমার অপেক্ষা করতে হবে না কারো মতামতের। তবু স্বাধীনতা শূন্য ঠেকল, নিশাত যখন বলল আমার বউ হবে। কেউ থাকুক যার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আমি বলতে পারি–এই করছি, আমাকে নিষেধ করো যদি ভালো না লাগে; বলতে পারি–আমাকে দোয়া করো, যদি ভালো মনে হয়।

সেদিন সারারাত মা-র কথা আমার মাথায় ঘুরেছে অন্ধ একটা পাখির মতো, কিন্তু বুঝতে পারিনি। সকালে যখন উঠলাম তখন চোখ খচখচ করছিল। কাজি সাহেবকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাবার কথা, তাঁকে বলা হলো না। নিশাতের সঙ্গে বসে বিস্তারিত আরো অনেক কিছু কইবার শোনবার কথা, তাও হয়নি। সবার চেয়ে বড় হয়ে, বড় করে দেখা দিলেন আমার মা। যেন তাকে যতক্ষণ না বলতে পারছি, তার মতামত না শুনতে পারছি, তাঁর দোয়া না পাচ্ছি, ততক্ষণ আমার আর স্বস্তি নেই।

দেখা হলো অনেক পরে। অন্ধকারের ভেতরে বসে থাকতে থাকতে যখন আমি আর বুঝতে পারছিলাম না আমার জীবন্ত অস্তিত্বকে, তখন মা এসে দাঁড়ালেন আমার স্বপ্নের ছবিকে খানখান করে।

বাড়ির সামনে বিরাট আঙ্গিনা। একপাশে পুকুর। ঘাটে শান বাঁধানো বসবার জায়গা। চৌচির হয়ে ফেটে আছে, আর ভেতরে শুয়ে আছে কালো রেখার মতো অন্ধকার। পুকুর থেকে উঠে আঙ্গিনা পেরিয়ে বাড়ির দিকে মুখ করলে বড় বড় চালাঘর চোখে পড়ে। খড়ে ভর্তি। গন্ধটা সুন্দর। খসখস করছে। ভূতের মতো শুয়ে আছে তার পরে লোক।

এরকম দুটো চালার পরে কয়েকটা মাথা ঝকরা আম গাছ। সেই গাছের ফাঁক দিয়ে গেলে ভেতর–বাড়ি।

প্রথমে যাকে দেখলাম, আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান এক সেকেণ্ডে দৌড়ে পার হয়ে যেন মার সামনে দাঁড়ালাম। আমার মাথার ভেতবটা ঝিমঝিম করতে লাগল, স্মৃতির মধ্যে বুককাঁপানো ট্রেনের হুইসিল শুনতে পেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। সে আমার মুখের কাছে হারিকেন তুলে নিঃশব্দে নিরিখ করতে লাগল। কথা বলল না, নড়ল না; স্তম্ভিত সময়ের মধ্যে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে রইলাম।

অবিকল যেমন আমি ভেবেছিলাম। সেই দুঃখী, নির্বাক, মলিন মুখ। অবিকল সেই নীল তাঁতের ময়লা শাড়ি পরনে, মাথার পরে একটুখানি ঘোমটা, খালি পা, রূপোর হাঁসুলি গলায়, শিথিল, শ্যামল, পুঞ্জীভূত অবোধ মমতার মৃত রেখায় গড়ে ওঠা একটি মুখ। হারিকেনের নিস্তেজ আলোয় যেন আরো কাছে দেখাচ্ছে তাকে। যেন আরো করুণ হয়ে উঠেছে তার অস্তিত্ব।

আমি একটা কিছু বলতে যাবো, ঠিক তখন সে হারিকেনটা নামিয়ে চলে গেল বাড়ির মধ্যে। এতক্ষণ যে আমগাছগুলোর কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম আবার তারা সহাস্যে অন্ধকারে আমার বন্ধু হবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। কুলিটাকে বিদেয় করলাম আমি।

তারপর আবার এলো সে। বলল, কী বলল অস্ফুট কণ্ঠে আমি বুঝতে পারলাম না। আমার সুটকেশ পড়ে রইলো বা পাশে একটা বড় টিনের ঘরের দাওয়ায়। সেদিকে আমি হাত বাড়াতেই শুনলাম, থাইক। আনবনে। আমি তার পেছনে চললাম। যেন আমি পায়ে পায়ে এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমার ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছি। যেন আমি আগেও কতবার এসেছি এ বাড়িতে, যদিও সত্যি তো আমি কোনদিন আসিনি। যেন এইবার আঙ্গিনা থেকে ভেতর–আঙ্গিনায় যাওয়া, খড়ের দুর্মর দুর্বোধ্য সুবাস, পাতার মধ্যে থোকা থোকা অন্ধকার, দূরের থেকে থেকে হারিয়ে যাওয়া, কাউকে হাটের পথে ডেকে ডেকে ফেরা, ঐ হারিকেনের চলমান আলো, পায়ের নিচে তকতকে মাটি–সব আমার চিরদিনের চেনাশোনা। দূরে দূরে, আঙ্গিনায় চারদিকে থমথমে বাতি নেভা ঘরগুলো, তাদের চালে তারা ও জ্যোছনার অস্পষ্ট বার্নিশ –দুপা এগোতেই ওপাশে অন্ধকারের মধ্যে গণগনে চুলোর লাফানো আগুন আর কাঠ পোড়ার পটপট শব্দ, কয়েকটা মুখ তাকাল আগুনের পটভূমিতে আমার দিকে।

বারান্দায় উঠে একটা চেয়ার দেখিয়ে সে বলল, বসেন। আম্মা আসতেছে।

আমি চোখ তুলে তাকালাম। বুঝতে পারলাম, আমি ভুল করেছি। এতে আমার মা নয়। স্বস্তিতে সুন্দর লাগল ভেতরটা। এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিলাম, নিঃশ্বাস পড়ল।

হারিকেনটা নামিয়ে রেখে গেছে। তার আলোয় পায়ের কাছটা আলো হয়ে আছে আমার। ভারী অচেনা লাগছে। অপলক তাকিয়ে আছি আমার জুতোর দিকে। জুতোর দুপাশে কাঁচা এঁটেল মাটি লেগেছে, অদ্ভুত দেখাচ্ছে, যেন আর কারো জুতো পরে বসে আছি আমি।

অনেকক্ষণ পরে একটা অব্যক্ত মৃদু ধ্বনি উঠল আমার পেছনে। অন্ধকারের ভেতর থেকে। আমার সমস্ত পিঠে ছড়িয়ে পড়ল উজ্জ্বল আলো। তাকিয়ে দেখলাম, প্রথমে সেই যে আমাকে হারিকেন দেখিয়েছিল সে তার হাতের আলো তুলে ধরে আছে, তার আলো যাকে আলোকিত করে তুলেছে তাকে স্বপ্নেও আমি কোনদিন দেখিনি।

আমার মা।

না বিস্ময়, না ভীতি, না কিছু। চেনাও মনে হলো না, অচেনাও নয়। দূরেও না, কাছেও না। সারা অঙ্গে ঝলমল করছে অলঙ্কার। পদ্মপাড় শাড়ি পরনে। শাদা। অত্যন্ত ফর্সা, আর ভারী, থলথলে একটি মুখ। ঠোঁটের পরে খয়েরি রেখা পানের।

আমি কদমবুসি করলাম। নিঃশব্দে তিনি সেটা গ্রহণ করলেন। তারপর নির্লিপ্ত কণ্ঠে অনাবশ্যক প্রশ্ন করলেন, কখন আসছ?

এইমাত্র।

ভালো আছো না?

জি।

ঢাকা-ই থাকো?

হ্যাঁ। ওখানে ওকলতি করি।

বাসা নিয়া?

জি–ঐ আর কী–।

মা তখন পাশ ফিরে বললেন, ওরে পানি দিছাস? গামছাটা বাইর কইরা দে। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ফিরোজার বাপ কইলো তুমি কাইল আইসবা।

একদিন আগে হয়ে গেল। আমি বললাম।

আইচ্ছা। তুমি বসো।

তিনি চলে গেলেন। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলাম। একটা ঝড়ের মতো দৃশ্যের অবতারণা হবে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু তার বদলে দেখলাম ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত একটি মানুষকে। তার সঙ্গে আমার রক্তের নয়, যেন লৌকিকতার সম্পর্ক। তার সঙ্গে কেবল কুশালাচার বিনিময় আর সাংসারিক উন্নতি–অবনতির সংবাদ ছাড়া আর কিছুই দেয়া নেয়া যেন চলতে পারে না। আমি তার ছেলে নই, অন্য কেউ, অন্য কোনো জন। এমন একজন, যাকে ভেতর বাড়ি পর্যন্ত আসতে দেয়া চলে, বারান্দায় তার বসবার আসন হয়, বাড়ির গিন্নী তার সঙ্গে এক–আধ মিনিট আলাপ করতে পারেন দরোজায় দাঁড়িয়ে। ঐ পর্যন্ত।

মনটা বিষিয়ে উঠল আমার। অনুতাপ হলো। কেন আমি আসতে গেলাম এখানে? কে আমাকে বলেছিল? কী দরকার ছিল। আমার যেন মনে হলো, যার সংগে এক মুহূর্ত আগে খুচরো আলাপ করলাম, তিনি আমার মা নন। আমার মা আছেন অন্য কোথাও, অন্য কোনো গ্রামে। এখান থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে যে–কোনো দিকে কয়েক মাইল হেঁটে গেলেই তার দেখা পাবো; যিনি দেখা হলে আমাকে কিছুই বলবেন না। কোনো কথা হবে না, এবং আমার মনে হবে, আমি তাঁর দেখা পেয়েছি।

আমি কিছুদিন থেকেই লক্ষ করছি আমার মনটা মাঝে মাঝে আমার হাতের বাইরে চলে যায়। সে যা খুশি তা করতে থাকে, তার খেয়াল খুশি নির্বিবাদে অনুগত ক্রীতদাসের মতো তামিল করে আমার জীবন্ত দেহটা, আমি কিছু করতে পারি না। যেমন, আমি যখন রাগ করি, তখন হয়ত রাগতে মোটেই চাই না। যখন একজনকে ভালো লাগে তখন আসলে হয়ত তাকে ঘৃণা করতেই চাই। এ এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। এর কিসসু বোঝা যায় না। রুমিকে দেখলে আমার গা শিরশির করে; শিউরে উঠি, কিন্তু হেসে কথা বলি। আদালতে যে আসামির ওপরে অসীম করুণা হয়, তাকেই নিষ্ঠুর তরবারির মতো জেরার আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত, অবসন্ন, পরাজিত করি। অথবা বিয়ের কথা বলব নিশাতকে, আমার মনের মধ্যে এক দ্বিতীয় মন কেবলি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, ছুঁতো খুঁজে দেরি করিয়ে দেয়। শিশিরে ভেজা ঢিলে–ঢালা ঘুড়ির মতো শিথিল ঠেকছে ভেতরটা। এ কোন অচেনা এসে দাঁড়াল আমার সমুখে মা বলে? যেন যাবার জন্যে, আমি উঠে দাঁড়ালাম।

সেদিন রাত্তিরের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হলো। মা, মার দ্বিতীয় স্বামী খোরশেদ সাহেব, তার আগের পক্ষের বিধবা বড় মেয়ে ফিরোজা আর তার ছেলে রিয়াজ; এ পক্ষের আমার সৎ ভাই–বোন আটজন। একে একে তারা এসে দাঁড়াল আমার সমুখে। চোখে তাদের অনিশ্চয় সন্দেহের ঠাণ্ডা দ্যুতি, দ্বিধার থরথর হাওয়া। বোনগুলো ছোট ছোট; তাদের গায়ের নীল কী হলুদ একরঙা কী ছোট ছোট প্রিন্ট ফুল করা জামা থেকে উঠছে জ্বালাকর গন্ধ, মুখে গৃহপালিত জন্তুর ছায়া। তার মধ্যে একজনের মুখ অবিকল আমার মতো। তার নাম জিগ্যেস করলাম, বলল না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। যেন বুঝতে পারল না আমার কথা। ওদের বাবা তখন বললেন, অর নাম নীলা।

খানিকক্ষণ গল্প করে উঠে গেলেন খোরশেদ সাহেব। তার বুকের মধ্যে জমে থাকা কাশির প্রবল উঠে আসবার চেষ্টা আর খড়মের আওয়াজ অন্ধকারকে ঠুকতে ঠুকতে চলে গেল। যেমন শুনেছিলাম ঠিক তেমনি এই মানুষটা। যতটুকু না করলে নয় মেহমানকে, তার বেশি কিছুই পেলাম না তাঁর কাছ থেকে। পেলে কি খুশি হতাম? তাই কি আশা করেছিলাম? কী জানি। এটুকু কেবল মনে আছে, আমার বড় ভয় করছিল। যেন আমি একটা বিরাট অপরাধ করেছি এবং যে–কোনো মুহূর্তে তিনি তার কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন। চলে যখন গেলেন, স্বস্তি পেলাম।

ফিরোজা এলো। এসে বলল, বিছানা কইরা দিছি।

তারপর হাতের লণ্ঠনটা রেখে বলল, শ্যাষ রাইতে ঠাণ্ডা পড়ে। গায়ে দেওয়ার কিছু আনেন নাই?

আমি বললাম, তাই নাকি? নাতো।

খ্যাতা দেই একখান? বলে সে চলে গেল, হয়ত কাঁথা আনতে। তখন সুন্দর লাগল ফিবোজাকে। ও আমার কেউ নয়, আমার মা–র রক্ত নেই ওর শরীরে, অথচ আমরা ভাইবোন। শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল, যেন কোথাও কিছু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, প্রবল মায়া করছে ফিরোজার জন্যে। কয়েক ঘণ্টা আগেও যাকে জানতাম না, যাকে দেখিনি, সে-ই যেন কতবালের চেনা মনে হচ্ছে। শ্যামল মুখ ওর চিকচিক করছিল আলোয়। নিরাভরণ বাহু, কণ্ঠ, কর্ণমূল যেন হাহাকার করছে। মনে হচ্ছে, ফিরোজার জন্যে কোন উপকার যদি আমি করতে পারতাম তো পরম শান্তি মিলতো।

পায়ের শব্দে ফিরোজাকে টের পেলাম। ভালো করে তাকাতে পারলাম না ওর দিকে। হাত বাড়িয়ে কাঁথাটা দিল ও। চুপ করে থাকা যায় না আর। বললাম, কে সেলাই করেছে? মা?

না, আমি।

চলে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়ি: হাসল নিঃশব্দে। বলল, আপনের কথা আম্মা একদিন কইছিল। আমি কই, বাঁইচা থাকলি একদিন দেখমু।

এলাম তো তাই।

রাইত হইছে, যাই।

আমার মায়ের জন্যে অবাক লাগছিল সবচে বেশি। এই যে মেয়েটা আমাকে কোনদিন দেখেনি, সেও কত আপন হয়ে উঠছে। অথচ মা এলেন না একবারও। যেন আমার আসা ফিরোজাদের জন্যে। দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে বুঝতে পারলাম ছাব্বিশ বছরে রক্তের সর্বশেষ ধারাটা নিঃশেষে শুকিয়ে গেছে, মরে গেছে বন্ধন, হারিয়ে গেছে স্মৃতি। এখন আর কিছুতেই আমি তাকে কাছে পাবো না, না তিনি আমাকে। আমার চলে যাওয়াই ভালো।

ভাগ্যি ভালো নিশাতকে বলে আসিনি কোথায় যাচ্ছি। তাহলে তাকে আর মুখ দেখাতে পারতাম না। ইচ্ছে থাকলেও অবশ্যি বলা হতো না। কারণ, ওকে বলেছি, আমার মা নেই। নিশাত–ফিরে গিয়েই নিশাতকে ডাকতে হবে। ওর ভাইজানকে বলতে হবে। বিয়ের তারিখটা ঠিক করে ফেলতে হবে।

আসলে, মরে গেলেই ভালো ছিল আমার। মা যদি সত্যি সত্যি মরে যেতেন তো এই ভীষণ আঘাতটা আমাকে পেতে হতো না। অন্ধকারে শুয়ে আছি, এখন তো আর নিজের মনের কাছে কিছুই লুকোনো সম্ভব নয়। আমি খুব আহত হয়েছি মা–র ব্যবহারে। কিছুতেই মেলাতে পারছি না, কী করে এমন হতে পারে? ছেলেকে রেখেও নির্বিকার মুখ করে চলে যেতে পারে মা? নাড়ির সঙ্গে টান থাকে নাকি মায়েদের। মিথ্যে কথা। আমি শুধু কল্পনাই করতে জানি, বাস্তব যে কত নিষ্ঠুর তা বুঝি না। যে মাকে মনে মনে কতদিন দেখেছি, তার একেবারে বিপরীত ছবি দেখে তাহলে আমাকে এত কষ্ট পেতে হতো না। পাগলের মতো ঢাকা থেকে এতদূর ছুটে আসার মতো বোকামিও করতাম না আমি।

বরং ফিরোজাকে আমার আপন মনে হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে কে জানে? আমি চাই না, তবু। তাই আরো রাগ হচ্ছে নিজের ওপর, আমার মা–র ওপর। আক্রোশে আঙ্গুলের ডগাগুলো লাল হয়ে উঠছে। উঠে পায়চারি করতে ইচ্ছে করছে আমার। রাত্রির নিস্তব্ধতা থেকে ঝি ঝি ডাকছে ঝিম–ঝিম ঝি–ঝি করে। থেকে থেকে একটা বাতাস দিচ্ছে। সারাদিন ট্রেন চলার ক্লান্তিতে নিস্তেজ নিরুৎসাহ লাগছে ভেতরটা। যেন আমি মরে যাচ্ছি। বা আজ রাতেই যাবো।

ফিরোজার কাছে মা আমার গল্প করেছিলেন বিদ্যুতের মতো মনে পড়ল কথাটা। কী বলেছিলেন যে, ফিরোজা ভেবেছিল, বেঁচে থাকলে আমাকে একদিন দেখবেই? হয়ত ফিরোজার ছেলে রিয়াজকে দেখে মনে পড়েছে আমাকে। হয়ত রিয়াজকে কোলে করে বসেছিল ফিরোজা, তখন আচমকা মা–র মনে হয়েছে আমার কথা। ফিরোজার যদি আবার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে রিয়াজ বড় হবে আমার মতো। তা কেন? নিজের ভাগ্য সবার কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইছি আমি। রিয়াজকে নিয়েই তো দ্বিতীয় সংসার করতে পারে ফিরোজা। হয়ত তারা খুশি হয়েই কোলে নেবে তাকে। মানুষ করবে নিজের ছেলের মতো। রিয়াজ কেন আমার মতো হতে যাবে? আমার মাথার কিছু ঠিক নেই। ফিরোজারই বা আবার বিয়ে হতে যাবে কেন? আমার মা ছিলেন গরিবের মেয়ে, রূপ ছিল, যৌবন ছিল হয়ত.–বোমার মতো বিপজ্জনক একটা বস্তু অভাবের সংসারে। তাই তার না হয় হয়েছে, ফিরোজার কেন হতে যাবে? আমাকে যদি দিত, আমি রিয়াজকে নিয়ে যাই ঢাকা। আমার কাছে থেকে পড়বে, বড় হবে। কাল বলব ফিরোজাকে? আশ্চর্য তো, ফিরোজা আমার কে?

এখানে, এ বাড়িতে আসবার পরমুহূর্ত থেকেই আমার মন যেন সহস্র চক্ষু হয়ে উঠেছে এইমাত্র সেটা টের পাচ্ছি। সব কিছুর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি অর্থ, সব কিছুকে নিজের অংশ করে তোলার প্রচণ্ড টান বোধ করছি। যেন এমনি করে আমার ব্যর্থতা, ক্ষয়, স্মৃতি সমস্ত কিছুর ওপরে গড়ে উঠবে অসামান্য সুন্দর সৌধ। আসলে সব কষ্টের মূলে রয়েছে মানুষের এই কষ্ট পাবার ক্ষমতাটা। আমার মন যদি পাথরের হতো, আমার চোখ যদি দৃষ্টির অতীতে কিছু না দেখতো, তাহলে চমৎকার দিন কাটতো আমার। কিন্তু কোথায় যে কবে কুড়িয়ে পেলাম এই স্বভাবটা ঘুরে ফিরে উলটে পালটে একটা ছবি, একটা মুহূর্ত, কী একটা অনুভূতিকে না দেখতে পারলে যেন শান্তি হয় না। নিশাত বলে, আমার আইন না পড়ে সাহিত্য কী দর্শন পড়া উচিত ছিল।

হয়ত আগাগোড়াই আমি ভুল করে এসেছি। জীবনে যা করা উচিত ছিল, যা করলে আমার সুখে সম্মানে দিন কাটতো, তা করিনি। ঝোঁকের মাথায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখার প্রবল ইচ্ছেটা যদি না থাকত, তাহলে আজ আমি আদৌ আসতাম না মাকে দেখতে। নিশাতকে যদি ভালো না বাসতাম তাহলে আসতাম না।

অথচ এমনিতে আমি খুব হিসেবি। অন্তত সবাই তাই বলে। জালাল এ নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করে। জালালের বউ খোঁচা দেয়। নিজেকে যারা এমনি ক্রমাগত বিশ্লেষণ করে চলে তাদের কি সতর্ক পুরুষ বলে? বলে হিসেবি লোক? বৈষয়িক লোক?

মা-র ছবিটা কালো মনে হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ। যে মহিলাকে দেখলাম ভরা মুখ, অলঙ্কারে আভরণে সম্ভ্রম ছড়ানো, ফর্শা তার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছি না ছাব্বিশ বছর আমার স্বপ্ন–জাগরণে দেখা মাকে। খোরশেদ সাহেবের স্ত্রী হিসেবে তাকে কোনদিন ভাবতে পারিনি বলেই কী এই কষ্ট আমার? এই ছবি না মেলার দুঃখ?

কাল সকালেই চলে যাবো। এই সিদ্ধান্তটা নেবার সঙ্গে সঙ্গে মনের সমস্ত মেঘ যেন কেটে গেল, ভালো লাগল ভেতরটা। শীত শীত করছে। ফিরোজা ঠিকই বলেছিল। কথাটা টেনে নিতেই পুরনো সুতোব আচ্ছন্ন করা ঘ্রাণে ঘুম এলো। যেন পুরনো রোদ–বৃষ্টির গন্ধ সঞ্চিত হয়ে আছে এই কথাটায়। টুপটাপ করে শিশির পড়তে শুরু করেছে। চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ।

ঘুমের মধ্যে মনে হলো সুন্দর রোদের মধ্যে গা খুলে বসে আছি আমি। খুব আরাম লাগছে। হাত পা টান–টান করে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চোখ মেলে দেখি, সেই মুখ, সেই অলঙ্কারের শব্দ, ফর্সা চাঁদের মতো। আমার মা।

চমকে উঠে বসতেই একেবারে বুকের মধ্যে পড়লাম গিয়ে তার। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। হাত বুলোতে গিলেন মাথায়, চুলের ভেতরে, আমার পিঠ ঘষতে লাগলেন যেন প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে আমার ওখানে।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটলো এক পলকের মধ্যে। আমার ঐ রোদের আমেজ থেকে তার কান্না পর্যন্ত। হতবাক হয়ে পড়ে রইলাম আমি। যেন স্বপ্ন দেখছি, আর কিছু না।

তারপর আস্তে আস্তে বোধ ফিরে এলো। টের পেলাম, রাত এখন অনেক। চোরের মতো মা এসেছেন আমার ঘরে। খুব করুণা হলো তাঁর জন্যে। ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। তখন ফিসফিস করে মা জিগ্যেস করলেন, গ্যাদা আইছস ক্যান?

কী জবাব দেব এর? মা আবার নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। এত দূর মনে হলো তাকে যে বাধা দিতে পারলাম না। তিনি আবার জিগ্যেস করলেন, টাকা পয়সা দরকার? কয় ট্যাকা?

না, না।

আমি বিব্রত হয়ে পড়লাম তাঁর কথা শুনে। তিনি কি মনে করেছেন, টাকার দরকার পড়েছে বলে আমি এসেছি? পৃথিবীতে এত কথা, এত কারণ থাকতে, আমার মার কেন মনে হলো টাকার কথা? বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে।

অন্ধকারে তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। চৌকির পর আধো উঠে বসেছেন, কোলে লুটিয়ে পড়েছে আঁচলটা। অদ্ভুত অর্থহীন কয়েকটা ভাজ সৃষ্টি হয়েছে আঁচলে। আমার চোখ স্থির হয়ে রইল সেখানে। যেন সমস্ত কিছুর ব্যাখ্যা লুকানো রয়েছে, আমার দৃষ্টি ওখানে খুঁজছে সেই চাবিকাঠি।

বললেন, ফিরোজার বাপ কত রাগ কইলো। কয়, ছাওয়াল আইছে ক্যান? কী চায় তারে জিগ্যাস করো নাই?

আমি কী ক্ষতি করেছি খোরশেদ সাহেবের যে তিনি না দেখেই আমার শত্রু হয়ে আছেন বুঝতে পারলাম না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা হলো এসেছি, এর মধ্যে এত কথাই বা কখন হলো, তাও ঠাহর করতে পারলাম না। মনটা বিষিয়ে উঠল। তেতো গলায় বললাম, সে কথা তিনি জিগ্যেস করলেই পারতেন।

চুপ করে রইলেন মা। একটা নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর। বললেন, তার মাথার উপর কত ঝামেলা–এত বড় সংসার যে কী কইরা চালায় তা সে জানে আর উপরে আল্লাহ জানে। আমার কথার পিঠে এ কথার মানেটা স্পষ্ট হলো না। আরো রোখ চেপে গেল আমার। দাতে দাঁত চেপে বললাম, টাকার দরকার, ছি-ছি, তাই হলে আপনার কাছে আসতাম না, ছাব্বিশ বছরে একটা খবর নিয়েছেন আপনি আমার? আপনাকে মা বলে কে? যান আপনার ছেলে–মেয়েদের কাছে। লজ্জা করে না লুকিয়ে আসতে? ভালো মানুষী দেখাতে?

আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না, কী ধরনের পরিস্থিতি হলে মানুষ তার মাকে এ রকম কথা বলতে পারে। আমি যদি নিজেই একথা শুনতাম, হেসে উড়িয়ে দিতাম একটা অলীক গল্প বলে। কিন্তু জীবনটা অলীকের ঊর্ধ্বে, অসম্ভবের হাতে, এক দুর্বোধ্য ঘটনা–প্রবাহ ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তাই জীবন নতুন নতুন চমক দিতে পারে আমাদের।

মা তখন আবার নতুন করে কাঁদতে বসলেন। কঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালেন অনিশ্চিতভাবে। তার কান্নাটাকেও মেকি মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে, নিজের জন্যে নয়, আমার জন্যে নয়, এক অর্থহীন অভিনয়ের অঙ্গ হিসেবে কেঁদে চলেছেন তিনি।

কিন্তু আসলে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছি। ওরকমভাবে কথাগুলো না বললেই পারতাম। কাল সকালেই তো চলে যাবো, কী লাভ হলো মনটাকে তেতো করে? আরেক মুহূর্ত হলে হয়ত আমিও উঠে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে ক্ষমা চাইতাম, কেঁদে ফেলতাম। চোখে পানি এসে গিয়েছে আমার টের পাচ্ছি। তার আগেই মা বললেন, মাইনষরে শান্তি দিলি না তুই। তুই তো কবিই। তুই কবি না? বাপেরে জানে মারলি, সে সম মনে আছিল না? এখন আইছস মায়ের জল্লাদ হইয়া? যে কথা কাউরে কই নাই, তাই আমি আইজ চিল্লাইয়া কমু। তর জন্যে আইজ আমার এই শাস্তি। তুই, তুই মারছস তর বাপেরে।

তাঁর চাপা চিৎকারে শিউরে উঠলো অন্ধকার। এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল আমার আত্মা। কালো একজোড়া হাত যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। শুকনো গলায় ঢোক গেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে জিগ্যেস করলাম, আমি, আমি মেরেছি মানে?

সে মানুষটা সাঁতার জানতো না। আজরাইল হইয়া আইছিলি তুই মনে নাই? গাঙের পাড়ে খাড়াইয়া আছিল, ধাক্কা দিয়া তারে ফালাইলি। ভরা বর্ষার ঢল থিকা আর সে উইঠল না। আমার কপাল ভাইঙা এখন আমারেই শাসাস? কমুই তো, তর সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? আমি চিল্লাইয়া কমু।
একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ণ তরবারি দিয়ে কে যেন আমার হৃদপিণ্ডটা উপড়ে নিয়ে চলে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress