জঙ্গলে, চাঁদের আলোয়
মানুষ-নেকড়ে, অথবা নেকড়ে-মানুষ—ওরা যখন-তখন চেহারা পালটে ফেলতে পারে। এটাই ওদের ছদ্মবেশ। তবে ওদের চোখের তারায় থেকে যায় হিংস্র দ্যুতি আর ওত-পেতে-থাকা অপেক্ষার ছাপ। সবাই সে-দৃষ্টি চিনতে পারে না। যারা পারে তারা পারে। রাতের আকাশে চাঁদ ওদের আরও ক্ষুধার্ত, আরও উতলা করে তোলে। তখন ওরা ভদ্র-সভ্য ছদ্মবেশের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়…পাগলের মতো নাচে…এই কাহিনির মতো।
শেষ কবে যে মানুষের স্বাদ পেয়েছি তা প্রায় ভুলেই গেছি। তা ছাড়া গ্রামের একেবারে শেষে মাঠঘাট পেরিয়ে কোনও মানুষ কখনও এই পুরোনো বাড়িটায় আসে!
প্রায় মাসখানেক আগে, ঝাপসাভাবে মনে পড়ছে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসেছিল গুঁড়ো সাবান বিক্রি করতে। তখন সন্ধে হয়-হয়। শিবনাথ বুদ্ধি দিল ওদের চা-জলখাবার দিয়ে আটকে রাখতে। তারপর সন্ধে একটু বাড়তেই আমরা চারজন ওদের দিয়ে জলখাবার সেরে নিলাম। শিবনাথ পাগলের মতো খাচ্ছিল। ওর আবার খিদে একটু বেশি—আর অপেক্ষা করার ধৈর্যও বড় কম।
বাড়িটায় আমরা চারজন আস্তানা গেড়েছি। আমি, শিবনাথ, রমা আর বিনোদ। তার আগে, টিলার ওপাশে, আমি আর শিবনাথ জোড় বেঁধে বেশ ছিলাম। একদিন রাতে, পুকুরে জল খেতে গিয়ে রমা আর বিনোদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। ওরা দুজন খুশিমতন চেহারা পালটাচ্ছিল আর এ ওর ঘাড় কামড়ে ধরছিল, ফষ্টিনষ্টি করছিল।
আমরা ওদের চিনতে পেরেছিলাম, ওরাও আমাদের চিনতে পেরেছিল। তারপর থেকে আস্তানা খুঁজতে-খুঁজতে শেষে এই খাঁ-খাঁ করে পুরোনো বাড়িটায়। খিদে পেলে খাবার খুঁজতে চলে যাই টিলার ওপাশে, জঙ্গলে—অথবা, নদীর কিনারায় ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকরে।
এমনিতে মানুষ সেজে থাকতে আমাদের খারাপ লাগে না। লোকজনের সঙ্গে একটু-আধটু মিশে, ভাত-ডাল-পাঁউরুটি-বিস্কুট খেয়ে দিন কেটে যায়। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ভেতরের লুকোনো জন্তুটা অস্থির হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন পাগলের মতো লাগে। রক্তের নেশাটা ভুলে থাকার জন্যে শিবনাথ তখন আমার ঘাড় কামড়ে আমাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে। ওই খিদে-তেষ্টার মধ্যেও বেশ টের পাই আমি আসলে রমণী।
এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে শিবনাথ আজ আবার ওর পুরোনো পথ বেছে নিয়েছে। আমাকে ঘরের কোণে কোণঠাসা করে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে প্রাণপথে। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিনোদ তেষ্টার চোখে আমাদের দেখছে। রমা আশেপাশে নেই—বাইরে কোথায় খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে।
এমনসময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল, সেইসঙ্গে স্পষ্ট চিৎকার: ‘মাসিমা, মাসিমা!’
রাত প্রায় আটটা বাজে। কে ডাকতে এল এই অসময়ে?
শিবনাথ তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ষাট-পেরোনো মোটাসোটা টাক মাথা এক প্রৌঢ়ের চেহারা নিল। বিনোদ সেজে গেল তার পঞ্চাশ-বাহান্নর গিন্নি। মুখে একগাল হাসি, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, পরনে লালপেড়ে তাঁতের শাড়ি।
আমি হাঁপাতে-হাঁপাতে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। চট করে হয়ে গেলাম বছর কুড়ির সুন্দরী তরুণী, সতেজ ফুলের মতো ফুটফুটে। শিবনাথ আমার এই চেহারাটা বেশি পছন্দ করে। কিন্তু উত্তেজনার সময়, মনের স্বাভাবিক আবেগগুলো যখন স্বাধীন হয়ে পড়ে, তখন আর ছদ্মবেশটা ঠিকঠাক ধরে রাখা যায় না।
ঠিক সেইরকম রমা পেছনের খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকল। ওর গায়ে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ।
আমাদের দেখেই ও বুঝতে পারল কী করতে হবে।
বাইরে থেকে আবার ডাক এল ‘মাসিমা, দরজা খুলুন—।’
রমা পালটে গেল। ও হয়ে গেল আমার ছোট ভাই। বয়েস বারো বছর, গোলগাল ফরসা চেহারা—অল্পেতেই অভিমান করে ঠোঁট ফোলায়।
আমরা চারজনে এখন সুখী পরিবার।
বিনোদ এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলল।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুজন যুবক। একজনের হাতে দুটো ভারি ব্যাগ। আর-একজন বোধহয় এই এলাকারই ছেলে। মুখটা চেনা-চেনা।
বিনোদকে দেখে ছেলেটি বেশ আশা নিয়ে বলল, ‘মাসিমা, একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট ছিল। মানে—’ সঙ্গের ব্যাগওয়ালা যুবককে দেখিয়ে সে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘এর নাম জিতেন দাস। চালাবাজারের মাঠে আজ রাত থেকে যাত্রা আছে। এ ইলেকট্রিকের লাইন করতে এসেছিল। ফেরার সময় ইস্টিশানে গিয়ে দেখে কেস জন্ডিস—লাস্ট ট্রেন মিস। তা রাতটা কোথায় এস্টে করাব…আমাদের তো জায়গা-ফায়গা নেই। তার ওপর বৃষ্টি হলেই কেস ক্যাচাল। তো লালটু বলল, আপনাদের বাড়িতে হেভি জায়গা আছে—মানে, রাতে এস্টে করা যায় তাই একে নিয়ে এলাম—শুধু আজকের রাতটা একটু শেলটার দিন। কাল ভোরেই এ চলে যাবে…।’
বিনোদের উত্তর দিতে একটু দেরি হল। কারণ, সব শুনে, আর ওদের শরীরের লোভনীয় গন্ধে ওর কথা বোধহয় জড়িয়ে যেতে চাইছিল।
শিবনাথ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল দরজার কাছে। গলাখাঁকারি দিয়ে বিনোদকে সামান্য পাশে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘নো প্রবলেম—তুমি শুধু আজ রাতটা কেন, দু-চারদিনও থেকে যেতে পারো আমাদের সঙ্গে।’
বিনোদ সাত-তাড়াতাড়ি সায় দিল ‘স্বামী’-র কথায়: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। তুমি অনায়াসে থাকতে পারো। ‘তুমি’ বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো!’
অভিনয়ের ব্যাপারে বিনোদ একেবারে জিনিয়াস। ওর শেষ কথাটার আগাপাস্তলায় মাতৃস্নেহ একেবারে উথলে উঠছিল।
সুতরাং ওর ভারী-ভারী ব্যাগসমেত জিতেন দাস ঢুকে পড়ল আমাদের বাড়িতে। ওর সঙ্গী ছেলেটি ‘থ্যাঙ্ক ইউ মাসিমা’ বলে এক কাঁধ বেঁকিয়ে হাঁটা দিল যাত্রার আসরের দিকে।
বিনোদ আমাকে ডেকে বলল, ‘রিনি, জিতেনকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দে—’ তারপর জিতেনকে লক্ষ করে বলল, ‘তুমি বাবা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। ইচ্ছে হলে স্নানও করতে পারো। আর রাতে আমাদের সঙ্গে দুটি খেয়ে নিয়ো।’
জিতেন বিব্রতভাবে বলল, ‘না, না, মাসিমা, আমি রাতে কিছু খাব না—খেয়ে এসেছি—।’
‘সে পরে দেখা যাবে’খন।’
আমি জিতেনের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও কি আমার ফেরোমোনের গন্ধ পাচ্ছে? আমি কিন্তু অন্যরকম একটা গন্ধ পাচ্ছি।
আমি জিতেনকে দেখছিলাম।
ছিপছিপে ফরসা চেহারা। তবে পাতলা হাওয়াই শার্টের নীচে শক্তিশালী পেশি টের পাওয়া যায়। গাল সামান্য ভাঙা। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। চোখ টানা-টানা। সারাটা মুখে কেমন এক মমতা মাখানো।
আমি অদ্ভুত এক আকর্ষণ টের পাচ্ছিলাম। অথচ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, শিবনাথ আর রমার ঠোঁটের কোণে লালা গড়াচ্ছে।
আমি তাড়াতাড়ি জিতেনকে নিয়ে ভেতরে চলে যেতে চাইলাম। ওরা কি আজ রাতেই ওকে শেষ করে দেবে?’
‘আমার সঙ্গে আসুন—’ জিতেনকে নরম গলায় ডেকে নিলাম।
ও লাজুক মুখে আমাকে অনুসরণ করল। একবার শুধু বলল, ‘আপনারা খুব ভালো। নইলে অচেনা-অজানা লোককে কে আর থাকতে দেয়…।’
ওর কথায় আমার নবীন সমাজদারের কথা মনে পড়ে গেল।
নবীন সমাজদার স্কুল-মাস্টার ছিল। গত বছর বর্ষার সময় এক দুর্যোগের রাতে আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে-ও ঠিক এই কথাই বলেছিল, ‘আপনারা খুব ভালো লোক—’ আর সেই রাতেই আমরা ওকে খতম করেছিলাম।
সাধারণত কোনও শিকারকে খতম করার আগে তাকে ঘিরে আমরা পাগলের মতো নাচি। তখন ভয়ে-আতঙ্কে তার চিৎকার করার মতো অবস্থাও থাকে না। কিন্তু নবীন মাস্টার হঠাৎই এক চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। তখন শিবনাথ আর রমা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারপর সব শেষ।
তার কিছুদিন পরে কী করে যেন নবীন মাস্টারের বউ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল। মেয়েটার সে-কী বুকফাটা কান্না! সে-কান্নার মানে আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি।
বউটাকে তো কোনওরকমে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরই এল পুলিশ আর ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোক। আমাদের নানাভাবে জেরা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি। ডেডবডির কোনওরকম চিহ্ন না-পাওয়াতে ওরা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। সন্দেহের হাত থেকে আমরা একটুর জন্যে বেঁচে গিয়েছিলাম। কে জানে, পুলিশ এখনও ব্যাপারটা নিয়ে লেগে রয়েছে কি না!
আজও ঠিক ওই কথাটাই বলল জিতেন, ‘আপনারা খুব ভালো।’
জিতেনকে ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে বসবার ঘরে ফিরে এলাম। সেখানে তখন আমার ‘মা’, ‘বাপি’ আর ‘ভাই’ জিতেনকে নিয়ে আলোচনায় মশগুল।
রমা ওর গোলগাল বাচ্চা-বাচ্চা মুখ নিয়ে একেবারে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। বারবার শুধু বলছে, ‘আমি আর ওয়েট করতে পারছি না…।’
ও যে আর অপেক্ষা করতে পারছে না সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে । ও কিছুতেই ওর ছদ্মবেশ ধরে রাখতে পারছে না। থেকে-থেকেই ওর চোয়ালটা লম্বা হয়ে সামনে এগিয়ে আসছে, হাত-পায়ের লোম বড়-বড় হয়ে যাচ্ছে, কথাগুলো জড়িয়ে গিয়ে চাপা-জান্তব গর্জন বেরিয়ে আসছে, আর ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা গড়াচ্ছে।
শিবনাথের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। ছদ্মবেশটাকে কোনওরকমে সামলে রেখে ও বলল, ‘রিনি, চেয়ার-টেবিলগুলো সরিয়ে ঘরটা ফাঁকা করে দাও। তারপর ও এলেই আলোগুলো নিভিয়ে দেবে…।’
তা হলে জিতেন এ-ঘরে আসামাত্রই শুরু হবে আমাদের কাজ। কিছুতেই কি আর দু-চারটে দিন আমরা অপেক্ষা করতে পারি না? জিতেনকে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ওর চেহারায় এমন নিষ্পাপ একটা ব্যাপার আছে যে, আমার সেই বালিকা বয়েসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সুবীরদার কথা মনে পড়ছে। ওকে দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠত। সুবীরদা আমেরিকায় পড়াশোনা করতে চলে গেছে। কত বছর আগের কথা, তবুও মনে হয় এই তো সেদিন! বিদেশ যাওয়ার আগে একদিন আমি সুবীরদার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। সেদিন লোডশেডিং ছিল, বাড়িতে আর কাউকে চোখে পড়েনি। সুবীরদা কখনও আমাকে আশাকারা দেয়নি, কিন্তু আমার কী যে হয়েছিল। সেইদিন সুবীরদা আমাকে নিয়ে যা-খুশি করতে পারত। আমিও মনে-মনে সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু সুবীরদা আমাকে বকুনি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, জীবন এত সহজ-সরল নয়।
আমি সেদিন সে-কথার মানে বুঝিনি। পরে, নিজের জীবনটা যখন হাতের বাইরে চলে গেল, অনেক জটিল হয়ে গেল, তখন বোধহয় খানিকটা বুঝতে পেরেছিলাম।
কিন্তু আজ, জিতেনকে দেখার পর থেকে, আমার নিজের কেমন অন্যরকম লাগছে।
আমার ছদ্মবেশটা ঠিকঠাক রেখে সিরিয়াস গলায় ওদের বললাম, ‘আজ রাতেই কিছু করাটা ঠিক হবে না। নবীন সমাজদারের ব্যাপারটা কি তোমরা এত সহজে ভুলে গেলে! পুলিশ হয়তো কেসটা নিয়ে এখনও লেগে আছে। কে জানে, জিতেনকে ওরা টোপ হিসেবে এখানে পাঠিয়েছে কি না !’
‘তা হলে তোমার কী মত?’ বিনোদ জানতে চাইল।
‘আমার ইচ্ছে দু-চারদিন অপেক্ষা করা—।’
শিবনাথ ওর ছদ্মবেশের ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘দু-চারদিন কেন, একটা দিন ওয়েট করলেই তো হয়!’
সমর্থনের আশায় ও বাকি দুজনের দিকে তাকাল।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘না! তাড়াহুড়ো করলে চলবে না…।’
এমনসময় পায়ের শব্দ পেলাম।
চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি জিতেন দাস আসছে। এরই মধ্যে ও স্নান-টান সেরে পরিপাটি। মুখটা এখন আরও বেশি ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ লাগছে।
সুখী পরিবার একজন অতিথিকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানায় সেভাবেই আমরা জিতেনকে খাওয়ার টেবিলে সাদরে আমন্ত্রণ জানালাম।
‘মা’ গরম ভাত, মুগের ডাল, মোচার ঘণ্ট আর মুরগির মাংস সাজিয়ে রাখল খাওয়ার টেবিলে। তারপর আমাদের পরিবেশন করতে লাগল। মুরগির ঠ্যাং রমার খুব প্রিয়। মানে, মুরগি হোক আর যা-ই হোক, ঠ্যাং হলেই হল। ও বারবার বায়না করছিল।
‘বাপি’ জিতেনকে বলল, ‘লজ্জা করে খেয়ো না। ঘরের ছেলের মতো চেয়ে-চেয়ে খাও।’
আমি বললাম, ‘বাপি, আমাদের বাড়ির ওয়্যারিংগুলো তো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। জিতেনবাবুকে যখন হাতে পেয়েছি তখন ওগুলো পালটে ঠিকঠাক করে নিলেই তো হয়।’
‘মা’, ‘বাপি’, আর ‘ভাই’ সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল। ইলেকট্রিকের ওয়্যারিং বদলানোর নাম করে আমি কি জিতেনকে বেশ কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি?
শিবনাথ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘তা ঠিকঠাক করে নিলেই হয়। কিন্তু ওর কি সময় হবে?…ব্যস্ত মানুষ, কাজের মানুষ…কাল ভোরেই চলে যাবে বলছে…।’
আমি উজ্জ্বল চোখে জিতেনের দিকে তাকালাম।
লাজুক ছেলেটা আমার দিকে আড়চোখে দেখল, তারপর বলল, ‘না, না—ব্যস্ত আর কীসে—এটাই তো আমার কাজ। তা হলে কাল সকালে বাড়িতে একটা এস. টি. ডি. করে দেব। তারপর গোটা বাড়ির ওয়্যারিংগুলো একবার ভালো করে টেস্ট করে নেব। যদি কেউ সঙ্গে থেকে একটু দেখিয়ে-টেখিয়ে দেয়…’ আমার দিকে আবার তাকাল জিতেন। তারপর: ‘তারপর একটা এস্টিমেট দিয়ে কাজ শুরু করে দেব।’
জিতেনের তাকানোর ব্যাপারটা ওরা তিনজনেই খেয়াল করেছিল। ‘মা’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘কোনও চিন্তা নেই। রিনিই তোমাকে সব দেখিয়ে দেবে। ও এসব একটু-আধটু বোঝে—ফিউজ হয়ে গেলে ও-ই ফিউজ তার পালটে ঠিক করে দেয়—।’
জিতেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও অপ্রস্তুত হাসলাম।
খাওয়া-দাওয়া সেরে জিতেন নিজের ঘরে শুতে চলে গেল। আমি ওকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভোর সাড়ে ছ’টায় চায়ের কাপ নিয়ে গিয়ে আমি আপনার ঘুম ভাঙাব। সাড়ে ছ’টায় ঘুম থেকে ওঠেন তো?’
ও অদ্ভুতভাবে হাসল, বলল, ‘এমনিতে উঠি না—তবে আপনি ডাকলেই উঠে পড়ব।’
যখন আবার খাওয়ার ঘরে ফিরে এলাম তখন ‘মা’ টেবিল পরিষ্কার করে গুছিয়ে ফেলেছে, ‘বাপি’ খড়কে দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে, আর ‘ভাই’ মুখ গোঁজ করে বসে আছে।
আমাকে দেখেই ‘ভাই’—মানে, রমা—একেবারে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল: ‘ভেবেছিস ওকে একা খাবি? সেটা কিছুতেই হতে দিচ্ছি না।’
‘আমার ওকে খাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই।’
‘তা হলে তোমার মতলবটা কী? ওকে এরকম আগলে-আগলে রাখছ কেন?’ প্রশ্নটা করেছে শিবনাথ। ওর খিদে রমার চেয়ে কিছু কম নয়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম, ‘জিতেনকে তোমরা যা করার কোরো। তার আগে আমি শুধু একবার ওকে চেখে দেখতে চাই…।’
‘তার মানে?’ ‘মা’ বিনোদ অবাক হয়ে জানতে চাইল।
আমি হেসে বললাম, ‘ওর গায়ে আমি অন্যরকম একটা গন্ধ পেয়েছি। আমার পুরোনো সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে খুব ইয়ে করতে ইচ্ছে করছে।’
রমা একইরকম দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘মানুষের সঙ্গে আমাদের আবার ইয়ে কী! এমন ইচ্ছে তো আমাদের কখনও হয় না! আসলে তুই ওকে একা খাওয়ার প্ল্যান করেছিস—।’
কথা বলার সময় রমার চোয়াল লম্বা হয়ে যাচ্ছিল, হাত-পায়ের নখ বেরিয়ে আসছিল, শরীর লোমশ হয়ে উঠেছিল।
আমি শান্তভাবে বললাম, ‘আমার ওসব কোনও প্ল্যান নেই। জিতেন আমাকে পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ওকে একবার চেখে দেখতে চাই….’
আমার গলায় এমন কিছু একটা ছিল যে, ওরা তিনজন চুপ করে গেল।
একটু পরে ‘মা’ রমাকে বলল, ‘তুই আর-একটু চিকেন কারি খাবি? এখনও অনেকটা আছে—।’
রমা একই ভঙ্গিতে বলল, ‘চিকেন কারি না—আমি জিতেন কারি খাব।’
এ-কথা শুনে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম বাইরে।
মাঝরাত থেকেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছিল।
এমনিতেই রাতে আমাদের ভালো করে ঘুম আসে না, তার ওপর বৃষ্টি আর জিতেন আমাদের জাগিয়ে রাখল।
একসময় জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনই গাছপালা আর বৃষ্টির আড়াল ভেদ করে শিবনাথ আর রমাকে দেখতে পেলাম। ওরা বোধহয় শিকার ধরতে বেরোচ্ছে।
অন্ধকারে আমাদের দেখতে অসুবিধে হয় না। তাই ওরাও আমাকে দেখতে পেল। চাপা গর্জন করে শিবনাথ একবার আমাকে ডাকল। আমি সাড়া দিলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে জিতেনের কথা ভাবতে লাগলাম। ওর জন্যে কেন যে এমন অদ্ভুত টান টের পাচ্ছি কে জানে! আমি জানি এটা ভালোবাসা নয়। কারণ, আমাদের মধ্যে ভালোবাসা, মমতা, ঈর্ষা—এইসব মানবিক বোধ নেই। এককালে যে ছিল সেটাই কোন যুগে ভুলে গেছি।
চোখের সামনে বৃষ্টি নিয়ে নিজেকে ঘৃণা করতে চাইলাম। যদি আমি জিতেনের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতাম তা হলে কত ভালো হত! কিন্তু বহুবছর আগে রাতের ট্রেনে আমি পালটে গিয়েছিলাম মানুষ থেকে অমানুষে।
কলকাতা থেকে পুরুলিয়ায় মাসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলাম। রাত বারোটার পরই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল—বাঙ্কে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মাঝরাতে হঠাৎই একটা অদ্ভুত যন্ত্রণায় ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই সামনে একরাশ অন্ধকার।
ট্রেন মাতালের মতো ছুটছে। চাকায় শব্দ উঠছে ঝমাঝম।
তখনই খেয়াল করলাম, অন্ধকারের মধ্যে দুটো আলোর বিন্দু—ক্ষুধার্ত, হিংস্র, পাশবিক।
চিৎকার করতে গিয়ে আমি চিৎকার করতে পারিনি। কোনওরকমে সামনে হাত বাড়িয়েছিলাম। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি ছুঁয়ে ফেলেছিলাম লোমশ এক শরীর।
পরক্ষণেই সব ঝাপসা হয়ে এসেছিল। আলোর বিন্দু দুটো সরে গিয়েছিল চোখের সামনে থেকে।
একটু পরেই আমার চেতনা ফিরে এসেছিল। কিন্তু এ কোন নতুন চেতনা—যা মানুষের চেতনার থেকে শতযোজন দূরের!
মাসির বাড়ি আমার আর যাওয়া হয়নি। রাতের অন্ধকারে কোন একটা স্টেশনে যেন আমি নেমে পড়েছিলাম। তারপর হারিয়ে গেছি অন্য জগতে। চিরকালের জন্যে।
ওই পশুটাকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করি। তেমনি ঘেন্না করি নিজেকেও। শিবনাথ, রমা, বিনোদকেও। কিন্তু আমার শরীরটা ওদের মতো বলে ওদের পছন্দের কাজ আমাকে করতে হয়। আমার মনটা যে পুরোপুরি এখনও ওদের মতো হয়ে ওঠেনি সেটা বেশ বুঝতে পারি।
একটা চাপা গর্জন কানে এল। চমকে উঠে দেখি শিবনাথ আর রমা ফিরে এসেছে। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলছে।
আর তখনই খেয়াল করলাম, আমার সারা গায়ে বড়-বড় কুৎসিত লোম, আর চোয়ালটাও নেকড়ের মতো লম্বা হয়ে গেছে।
আমি এ-ঘর থেকেই জিতেনের গন্ধ পাচ্ছিলাম—অন্যরকম গন্ধ। সেই গন্ধে পাগল হয়ে বাকি রাতটুকু ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে ছুটোছুটি করে কাটিয়ে দিলাম।
ভোর হতেই টের পেলাম খিদেয় আমার পেট জ্বলছে। তাই ছদ্মবেশ ধরে চলে গেলাম বাড়ির বাইরে।
বৃষ্টি এখন আর নেই। তবে এখানে-ওখানে জল জমে আছে। গাছের পাতায়, ঘাসে, জলের ফোঁটা।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে টিলার ওপারে চলে গেলাম। কিছুক্ষণের চেষ্টায় একটা বনবেড়ালকে দেখতে পেলাম। ওটাকে তাড়া করে শেষ পর্যন্ত একটা পাথরের খাঁজে কোণঠাসা করে ফেললাম। বনবেড়ালটা মরিয়া হয়ে থাবা বাগিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে। আমি থাবা দিয়ে সপাটে এক থাপ্পড় কষাতেই ওটা ঘাড় মটকে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
ভোরের প্রথম আলোয় খিদে মিটিয়ে নদীতে হাত-মুখ ধুয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরে এলাম, জিতেন তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছে।
আমাকে দেখেই ও জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার, মর্নিংওয়াকে গিয়েছিলেন বুঝি?’
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘কাল আমাকে নিয়ে যাবেন?’
আমি ঘাড় নাড়লাম।
জিতেন গলা বাড়িয়ে থুথু ফেলল ঘাসের ওপর। তারপর বলল, ‘সাড়ে ছ’টায় আমাকে ডাকবেন বলেছিলেন—দেখুন, তার আগেই আমি উঠে পড়েছি।’
খিদের চোটে ব্যাপারটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। চমকে হাতঘড়ি দেখলাম: সবে সাড়ে ছ’টা বাজে।
জিতেন আড়চোখে আমার বুকের দিকে দেখছিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
আমি বললাম, ‘আপনার চা-বিস্কুট নিয়ে আসছি—।’
‘হ্যাঁ, চা-টা খেয়েই ফোন করতে বেরোব। তারপর এসে ওয়্যারিংগুলো চেক করতে শুরু করব।’ একটু থেমে আমাকে দেখে নিয়ে: ‘আপনি আমার সঙ্গে থেকে হেল্প করবেন কিন্তু—।’
আমি ওর গন্ধ পাচ্ছিলাম। শরীরটা কেমন অবশ লাগছিল। ছদ্মবেশ ধরে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
ওর কথার উত্তরে ছোট্ট করে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
তারপর ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভেতরে।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি ‘মা’ উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছে। জিগ্যেস করে জানলাম ‘বাপি’ আর ‘ভাই’ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।
সারাটা দিন আমার জিতেনের সঙ্গে কাটল।
ও প্রত্যেকটা ঘরের ওয়্যারিং টেস্ট করে দেখছিল, আর আমি পাশে-পাশে থেকে ওকে সাহায্য করছিলাম।
ভাঁড়ার ঘরের ওয়্যারিং টেস্ট করতে-করতে জিতেন বলল, ‘ম্যাডাম, আপনাদের ওয়্যারিং-এর আর কিছু নেই। তারের রবারগুলো একেবারে নরম হয়ে গেছে। সব চেঞ্জ করে দিলে ভালো হয়—।’
আমি বললাম, ‘আমার নাম ম্যাডাম নয়—রিনি। তা ছাড়া আমি আপনার চেয়ে বেশ ছোট।’
‘দশ ঘণ্টার আলাপে নাম ধরে ডাকব?’ হাসল জিতেন: ‘তাতে আর কেউ কিছু মনে করতে পারে…।’
‘আমার বাপি-মা খুব ভালো। ওরা কিচ্ছু মনে করবে না।’
জিতেন একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে ওয়্যারিং দেখছিল। হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো—বোধহয় ব্রিটিশ আমলের। কিন্তু তোমরা বেশ মডার্ন— মানে, ডাইনিং-টেবিল, টিভি এইসব আর কী।’ একটু চুপ করে থেকে তারপর: ‘তোমরা এ-বাড়িতে ক’বছর আছ?’
আমি ভয় পেলাম। কী করে বলব, একটা পড়ে-থাকা-বাড়ি আমরা জবরদস্তি করে দখল করেছি। আমাদের কথাবার্তা, চালচলন যে এই বাড়ির চেহারার সঙ্গে খাপ খায় না সেটা ও এই অল্প সময়েই টের পেয়েছে। ভাগ্যিস রমা, বিনোদ, শিবনাথরা এখন আশেপাশে নেই! থাকলে হয়তো বলত, ‘দেরি করে কোনও লাভ নেই। আজ রাতেই…’
আমি কোনওরকমে একটা গল্প বানিয়ে ওকে বললাম। আমার ‘বাপি’র এক জ্যাঠামশাই বছরচারেক আগে মারা যান। তিনি বিয়ে-থা করেননি। তাই এই বাড়ি, বাগান, আর ছ’বিঘে ধান জমি ‘বাপিকে’ দিয়ে গেছেন। ‘বাপি’ রিটায়ার করার পর আমরা কলকাতা ছেড়ে এখানে চলে এসেছি।
জিতেন হঠাৎই টুলটার ওপরে বসে পড়ল, বলল, ‘রিনি, একটানা কাজ করতে ভালো লাগছে না। এসো, দু-মিনিট গল্প করি।’
জিতেন ওর নানা কথা বলছিল। আমি স্বপ্ন দেখার মতো ওকে দেখছিলাম, ওর কথা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে শুনছিলাম।
কলকাতায় গড়িয়াতে ওর বাড়ি। বাড়ি মানে ভাড়া করা একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেখানে ওর বুড়ি মা আছে, আর আছে ছোট দু-বোন—ঝুমপা আর টুমপা। ওর বড়দা কেশব ভালো চাকরি করত। কিন্তু বছরদশেক আগে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে! বাবা রিটায়ার করার পর হার্টের অসুখে মারা যান। মাত্র একবছরের মধ্যে দুজনেই চলে গেছে। তারপর থেকে জিতেন একা সংসারের হাল ধরেছে। ছোট্ট একটা ইলেকট্রিকের দোকান আছে ওর। সেটাকে আঁকড়ে ধরেই অভাবের সঙ্গে ওর লড়াই। ওর খুব সাধ ভালো ঘরে দু-বোনের বিয়ে দেবে। তারপর ও নিজের বিয়ের কথা ভাববে—যদি অবশ্য তখনও ওর বিয়ের বয়েস থাকে।
জিতেনকে দেখে আমার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছিল। ওর মধ্যে এত আকাঙক্ষা, এত স্বপ্ন…অথচ…।
ভাবলাম, ওকে বলি, ‘তুমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাও—’ কিন্তু তাতে কোনও লাভ নেই। শিবনাথরা সহজে ওকে ছাড়বে না। ওকে তাড়া করবে। দরকার মতো ছদ্মবেশ পালটে-পালটে ওকে অনুসরণ করবে। তারপর প্রথম সুযোগেই। ওকে খতম করবে।
আমার ভীষণ মনখারাপ লাগছিল—সুবীরদা আমেরিকা চলে যাওয়ার সময় যেরকম মনখারাপ লেগেছিল।
কথা বলতে-বলতে জিতেন কতবার যে বলল, ‘রিনি, তোমরা খুব ভালো। কত সহজে অচেনা লোককে আপন করে নাও।’
জিতেন আমাকে নানা কথা জিগ্যেস করছিল। ‘বাপি’ কোথায় চাকরি করত, ‘ভাই’ কোন স্কুলে পড়ে, আমি কলকাতার কোন স্কুলে পড়তাম, কোন কলেজে পড়তাম, লেখাপড়া ছেড়ে দিলাম কেন, কলকাতার কোথায় আমরা থাকতাম, আমাদের আত্মীয়স্বজন কোথায়-কোথায় থাকে—এরকম আরও কত প্রশ্ন।
আমি ওর প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিচ্ছিলাম। ঠিকমতো গল্প বানাতে না-পারলে পাশ কাটানো জবাব দিচ্ছিলাম।
আমরা যখন ‘বাপির’ শোওয়ার ঘরের লাইন টেস্ট করছি তখন শিবনাথ কোথা থেকে এসে ঘরে ঢুকল। ওর হাতে সিগারেট। গলাখাঁকারি দিয়ে ও বলল, ‘আজ বাজার থেকে বড়-বড় পাবদা মাছ নিয়ে এসেছি। বলেছি পাবদা মাছের ঝাল রান্না করতে। জিতেন, তুমি পাবদা মাছ খাও তো?’
জিতেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল রমা। ‘বাপি’কে জড়িয়ে ধরে আদূরে গলায় বলল, ‘বাপি’, পাবদা মাছের ঝালের নাম শুনে আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে।’
‘বাপি’ রমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘খাবি, খাবি—সময় হোক, খাবি—’
কথাটা বলার সময় ‘বাপি’ জিতেনের দিকে তাকিয়ে ছিল, যাতে আমি অন্তত তার কথার ঠিকঠাক মানে বুঝি।
রমা বলল, ‘আমি আর ওয়েট করতে পারছি না—গন্ধে আমি পাগল হয়ে যাব।’
রমা একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ছদ্মবেশ ধরে থাকতে রমার এখন কষ্ট হচ্ছে। তাই জিতেনের সামনে থেকে ও পালাল।
এরপর শিবনাথ জিতেনের সঙ্গে ওয়্যাংরি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। জিতেন কাগজ-পেন বের করে ‘বাপি’কে কী-সব হিসেব বোঝাতে লাগল।
একটু পরে ‘বাপি’ চলে যেতেই জিতেন আবার ওর কাজ শুরু করল, আর আমিও ওকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে লাগলাম।
কাজ করতে-করতে যখন বেলা একটা বাজল তখন আমি জিতেনকে স্নান করতে যাওয়ার তাড়া দিলাম।
ও আমার দিকে কেমন একটা চোখে তাকাল। তারপর বলল, ‘খেয়েদেয়ে আবার শুরু করব, কেমন?’
আমি ঘাড় নাড়লাম।
আমি ক্লান্ত পায়ে বসবার ঘরে আসতেই ওরা তিনজন আমাকে ছেঁকে ধরল।
রমা হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর সাধ মিটেছে? আমরা আর ওয়েট করতে পারছি না।’
শিবনাথ বলল, ‘শুধু-শুধু দেরি-করেই বা লাভ কী! আজ রাতেই তো সেরে ফেললে হয়…’ ও সমর্থনের আশায় বিনোদের দিকে তাকাল।
বিনোদের গায়ে পলকের জন্যে বড়-বড় লোম দেখা গেল, তারপরই আবার ও গিন্নিবান্নি চেহারার ‘মা’ হয়ে গেল। ও মেয়েলি গলায় আমাকে বলল, ‘রিনি, তোমার যা করার আজ সন্ধের মধ্যে সেরে নাও। জিতেন বেশিদিন আমাদের এখানে থাকলে সবাই সন্দেহ করবে…’
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম ওদের খিদের সঙ্গে আমি পেরে উঠব না। জিতেন যে কেন মরতে আমাদের বাড়িতে এল।
খাওয়া-দাওয়ার পর কাজ শুরু করতে-করতে প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেল। আকাশে তখন আবার মেঘ জমেছে, ঝিরঝির করে বৃষ্টিও পড়ছে।
জিতেনের কাছে আসার আগে ওরা তিনজন আমাকে আবার তাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে রমা তো বলতে গেলে আমকে একরকম শাসিয়েছে। বলেছে, আমার যদি অন্য কোনও মতলব থাকে তা হলে বিশেষ সুবিধে হবে না।
জিতেনকে যে-ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই ঘরটায় কাজ করছিলাম আমরা।
আশ্চর্য! একটা দিন এখনও পুরো হয়নি, এরই মধ্যে জিতেনের গন্ধে ঘরটা টইটম্বুর।
জিতেন একটা চেয়ারের ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে লাইন টেস্টার দিয়ে লাইনটা টেস্ট করছিল। হঠাৎই টাল সামলাতে না-পেরে ওর দেহটা নড়ে উঠল। ও পড়ে যেতে পারে ভেবে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার হাত-মুখ-বুক সব ওর শরীরে লেপটে গেল। জিতেন খানিকক্ষণ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু আমি গালে টের পাচ্ছিলাম, ওর শরীর আয়তনে বাড়ছে।
জ্বর হওয়া গলায় জিতেন বলল, ‘কেউ এসে পড়বে…।’
‘না, কেউ আসবে না।’
জিতেন তখন সাহস করে আমার বাঁধন ছাড়িয়ে নেমে পড়ল চেয়ার থেকে। লক্ষ করলাম, ওর শরীর কাঁপছে।
ও কোনওরকমে দরজার কাছে গেল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই ফিরে এল আমার কাছে। আমাকে এক ঝটকায় জাপটে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। আমাদের শরীরের তাপ বিনিময় হতে লাগল। আমার ছদ্মবেশ ধরে থাকার ক্ষমতা বোধহয় শিথিল হয়ে আসছিল। কারণ হঠাৎই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ছোট্ট এক টুকরো চাপা গর্জন।
জিতেন চমকে উঠে আমাকে ছেড়ে দিল, অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।
আমি ছদ্মবেশ সামলে নিয়ে জড়ানো গলায় বললাম, ‘আমি আর পারছি না…’
জিতেনের অবাক ভাবটা পুরোপুরি মিলিয়ে গেল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ‘এখানে আমার ভয় করছে, রিনি। যদি কেউ হুট করে এসে পড়ে!’
ওকে বলতে পারলাম না যে, কেউ আসবে না। কিংবা এলেও কোনও ক্ষতি নেই। তা হলে ও নির্ঘাত সন্দেহ করবে।
তাই বললাম, ‘সন্ধে হলে আমরা বাইরে কোথাও চলে যাব।’
জিতেন সায় দিল।
সন্ধের অন্ধকার নেমে আসতেই আমি জিতেনকে নিয়ে বেরোলাম। বেরোনোর সময় শিবনাথ আমাকে আলাদা ডেকে নিল, বলল, ‘বেশি দেরি কোরো না কিন্তু—।’
রমা বলল, ‘উলটোপালটা কোনও মতলব ভেঁজে সুবিধে হবে না।’
আমি বললাম, ‘কোনও ভয় নেই। তোমরা ওকে আস্তই পাবে—।’
তারপর দুজনে বেরিয়ে পড়লাম।
জিতেন কেমন একটু থম মেরে ছিল। বোধহয় আগামী উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ ওর বুকের ভেতরে পাক খাচ্ছিল। ও বারবার মুখ ফিরিয়ে আমাকে দেখছিল।
বৃষ্টি এখন আর নেই। কিন্তু চারপাশে বৃষ্টির আদরের ছোঁওয়া লেগে রয়েছে। গাছের পাতায়, ঘাসে, মাটিতে, আকাশে, বাতাসে—কোথায় নয়!
মেঘ সরে গেছে একপাশে। চাঁদ আবার দেখা দিয়েছে—চতুর্দশীর কিশোরী চাঁদা। গত দু-দিন ও গা-ঢাকা দিয়েছিল।
চাঁদ দেখলে আমাদের কেমন পাগল-পাগল লাগে। আমি জানি, বাড়িতে শিবনাথরা এখন চাঁদ দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার ভেতরে এখন সেই অস্থির ব্যাপারটা টের পেলাম না। আমি জিতেনের হাত ধরে ছিলাম। সেই ছোঁওয়া আমাকে পালটে দিচ্ছিল। টের পেলাম, ওর গায়ে কেমন একটা জ্বর-জ্বর ভাব।
ভিজে মাটিতে পা ফেলে গাছপালার ফাঁক দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। অন্ধকারে আমার দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল না। জিতেনকে বললাম, ‘আমার হাত ধরে এসো—কোনও ভয় নেই।’
দুটো ধান খেত পেরিয়ে কয়েকটা বড় গাছের জটলার নীচে আমরা দুজনে পাশাপাশি বসলাম।
হঠাৎ একঝলক বাতাস গাছের পাতায়-পাতায় শব্দ তুলল। রাতপাখির ডাক শুনতে পেলাম। আর কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপরে আমরা ভালোবাসাবাসি শুরু করলাম।
জিতেন দিশেহারা হাউইয়ের মতো আমাকে এলোমেলো আদর করতে লাগল। মরণাপন্ন দানব যেভাবে প্রাণভোমরা আঁকড়ে ধরতে চায়, ও পাগলের মতো আকুল হয়ে সেই প্রাণভোমরা খুঁজতে লাগল আমার শরীরে।
জিতেন হাঁফাচ্ছিল, দাপাদাপি করছিল, কিন্তু ক্লান্ত হয়নি এতটুকু। ছদ্মবেশ ধরে রাখতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মাঝে-মাঝেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল চাপা গর্জনের টুকরো। কিন্তু জিতেন সেগুলোকে তৃপ্তির শব্দ বলে ভাবছিল।
পশুপ্রবৃত্তি আমাকে পেয়ে বসল। কোনওরকমে শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে উলটোদিকে ঘুরে গেলাম। তাতে জিতেনের যেন সুবিধেই হল। ও পেছন থেকে আমাকে আদর করতে লাগল। আর আমি যেন শূন্যে ভেসে যেতে লাগলাম।
চূড়ান্ত মুহূর্তে জিতেন এক ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠল। তখন ওকে হঠাৎই শিবনাথ বলে মনে হল। দু-চারটে পাখি ডেকে উঠল গাছের আড়াল থেকে। আর আমরা আনন্দে কুটিকুটি হয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ আমরা অন্ধকারে চোখ মেলে শুয়ে রইলাম। তারপর জিতেন আমাকে পরম যত্নে চুমু খেতে লাগল। বারবার বলতে লাগল, ‘রিনি, আই লাভ ইউ। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না….’
আমার কান্না পেল। কারণ, শিবনাথ-রমাদের কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু চোখে আমার জল এল না। একটা নাম-না-জানা কষ্ট ভেতরে-ভেতরে মাথা খুঁড়ে মরছিল।
আরও কিছুক্ষণ পর আমরা উঠলাম। আমি মানুষ না অমানুষ সেটাই আমার কাছে গুলিয়ে যাচ্ছিল। জিতেন আমার এই জঘন্য জীবনে একটা নতুন মানে জুড়ে দিয়েছে।
অন্ধকারে গাছপালার আড়াল দিয়ে ফিরতে-ফিরতে নানা কথা মনে হচ্ছিল। জিতেনের গলায় দাঁত বসিয়ে আমি কি ওকে আমাদের একজন করে নিতে পারি না? তা হলে অন্তত ও প্রাণে বেঁচে থাকবে। কিন্তু তখন যে ও সারাটা জীবন আমাকে ঘেন্না করবে, যেমন রাতের ট্রেনের ওই শয়তানটাকে আমি ঘেন্না করি। ওর ঘৃণা সহ্য করে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তার চেয়ে এই ভালো—আমরা দুজন-দুজনকে ভালোবাসি—এটাই শেষ সত্যি হয়ে থাক জিতেনের কাছে।
যখন আমরা বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে পড়লাম, তখন জিতেনকে বললাম, ‘তুমি আগে চলে যাও। দুজনে একসঙ্গে গেলে মা-বাপি সন্দেহ করবে।’
জিতেন কপট ভয়ের সুরে বলল, ‘ওরে বাবা! এসব জানতে পারলে তোমার বাবা আমাকে খেয়ে ফেলবে।’
জিতেন বুঝতে পারল না, ও কতবড় সত্যি কথাটা বলল।
ওকে বললাম, ‘তুমি বলবে, রিনি গাছপালার আড়ালে কোথায় হারিয়ে গেল। ওকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে আমি চলে এসেছি। তা হলেই হবে—।’
ও আমার ঠোঁটে গভীর চুমু খেল। তারপর বলল, ‘বেশি দেরি কোরো না, তাড়াতাড়ি চলে এসো…।’
আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম।
জিতেন অন্ধকার থেকে এগিয়ে গেল আলোর দিকে। সেখানে ওর জন্যে নতুন এক অন্ধকার অপেক্ষা করছে।
এইবার আমার কান্না পেল। আকাশের চাঁদের দিকে তাকালাম। ছদ্মবেশের নিয়ন্ত্রণের কথা ভুলে গিয়ে চারপায়ে দাঁড়ালাম। আমার বুকফাটা হাহাকার জন্তুর গর্জন হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। একে কি কান্না বলে? আমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষটার জন্যে কান্না?
ওই বাড়িতে আমি আর ফিরতে পারব না। আমি জানি, সব আলো নিভিয়ে দিয়ে শুরু হয়ে গেছে ওদের নাচ। ওরা পাগলের মতো জিতেনকে ঘিরে নাচছে। আর জিতেন সাদা, ফ্যাকাসে মুখে ওই ভয়ঙ্কর তিনটে প্রাণীর দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরিয়ে আসতে পারছে না। তবে ওর নিশ্চয়ই বৃদ্ধা মায়ের কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে ছোট-ছোট দুটো বোনের কথা—যাদের ও ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল।
আচ্ছা, জিতেনের আমার কথাও একটু-একটু মনে পড়ছে তো?