Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জংলী মেয়ে || Romena Afaz

জংলী মেয়ে || Romena Afaz

গহন জঙ্গলের মধ্যে একটা পর্ণকুটিরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো জংলী মেয়ে চম্পা।

বনহুর আর বিজয়া তাকে অনুসরণ করে এসেছে, তারাও এসে দাঁড়ালো চম্পার পাশে। এতটা পথ একটানা চলে আসার পর অত্যন্ত হাঁপিয়ে পড়েছিলো বিজয়া, তার পা দু’খানা যেন টলছে।

চম্পা বললো–তোদের খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

হেসে বললো বনহুর–না, আমার কোনো কষ্ট হয়নি, খুব ভাল লাগছে। ওর কষ্ট হয়েছে, বেশি হাঁটার অভ্যাস নেই কিনা। বিজয়াকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বললো বনহুর।

চম্পা বললো-তোরা এখানে দাঁড়া, আমি আসছি।

চলে গেলো চম্পা।

বনহুর বললো–বিজয়া, এ কোথায় এলাম! এখানে আমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে কে জানে।

বিজয়া বললো–তুমি সঙ্গে আছো, ভাগ্যে যা ঘটে সব মাথা পেতে গ্রহণ করবো তিলক।

বনহুর আর বিজয়া যখন কথা হচ্ছিলো তখন চম্পা কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে একটা খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে তার উপর অনেকগুলো ফলমূল সাজিয়ে রাখে। তারপর বেরিয়ে আসে বাইরে। বনহুর আর বিজয়াকে লক্ষ্য করে বলে-আয়, তোরা ভিতরে আয়।

বনহুর আর বিজয়া এবার চম্পার সঙ্গে তার কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

অবাক হলো বনহুর আর বিজয়া–এত ফলমূল চম্পা পেলো কোথায়? খুশি হলো তারা মনে মনে, কারণ বনহুর আর বিজয়া উভয়ে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলো।

চম্পা যেন জানতে পরদেশী বাবু ফল খেতে ভালবাসে, তাই যেন সে তার পছন্দমত ফল থরে থরে সাজিয়ে রেখেছিলো।

বনহুর আর বিজয়া চম্পার কথা মত খেজুর পাতার চাটাই-এর উপরে বসে পড়লো।

গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো বনহুর। দুহাতে ফলমূল তুলে মুখে গুঁজে দিতে লাগলো সে।

বিজয়াও খাচ্ছে।

হঠাৎ বনহুর দৃষ্টি চলে গেলো চম্পার মুখে অবাক হলো বনহুর, চম্পা নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই চম্পা বেরিয়ে যায় কুটিরের মধ্য হতে।

বনহুর ভাবে কোথায় যেন সে এই চোখ দেখেছে কিন্তু স্মরণ করতে পারে না।

খাওয়া শেষ হলো। তারপর প্রতীক্ষা করতে লাগলো ওরা চম্পার জন্য কিন্তু বহুক্ষণ কেটে গেলো চম্পা আর ফিরে এলো না।

এক প্রহর দু’প্রহর করে কয়েক প্রহর কেটে গেলো তবু ফিরে এলো না চম্পা।

এদিকে বনহুরের আর বিজয়া যখন চম্পার প্রতীক্ষা করছিলো তখন চম্পা ফিরে গেছে তার কুটিরে। বনের এক নিভৃত জায়গায় তার সেই কুটির, যেখানে নূরীকে রেখে এসেছিলো।

চম্পা আসতেই নূরী ছুটে আসে চম্পার পাশে। ব্যাকুল আগ্রহে বলে-তুমি যে কাজে গিয়েছিলে তা সমাধা করতে পেরেছো চম্পা? পেয়েছে তাকে?

চম্পার মনে আজ জয়ের আনন্দ, খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল। হৃদয়ের আনন্দাবেগ ফুটে উঠেছে তার দু’নয়নে, নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে–হাঁ, তাকে পেয়েছি…….

কথা শেষ হয় না চম্পার, নূরী ওর বাহুবন্ধন মুক্ত করে নিয়ে বলে উঠে-কোথায়, কোথায় সে? …… ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলো নূরী, চম্পা ওর হাত চেপে ধরে–শশা! যানে শো!

না না, আমাকে ওর কাছে যেতে দাও চম্পা দিদি।

ওকে এখন তুই পাবিনে নূরী।

হঠাৎ নূরীর মুখখানা কালো হয়ে উঠে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, অসহায় চোখে তাকায় চম্পার মুখে। দমকা হাওয়ায় প্রদীপ যেমন দপ্ করে নিভে যায় তেমনি নূরীর মন থেকে সব আনন্দ নিভে যায় নিমিষের মধ্যে।

চম্পা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে—পাবি কিন্তু ………

বলো চম্পা দিদি, কিন্তু কি?

হেসে বলে চম্পা তোর জিনিস তোরই আছে–থাকবেও, তবে পাবি দেরীতে……

চম্পা দিদি, আমি যে তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না, আমার হুকে আমি পাবো তো?

বললাম তো পাবি কিন্তু দেরী হবে।

ও তবে আসেনি তোমার সঙ্গে?

এসেছে।

তবে কোথায় বলো না চম্পা দিদি?

সব বললো।

কবে বলবে আমি যে ধৈর্য ধরতে পারছি না।

এবার চম্পার মুখে একটা গাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ে, কি যেন ভাবে সে, তারপর বলে-নূরী, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বলবি?

বলবো।

তোর হুর তোকে খুব ভালবাসে বুঝি?

সে আমাকে ভালবাসে কিনা জানি না তবে আমি তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি।

চম্পা ছোট্ট একটা শব্দ করলো।

নূরীর মন বড় অস্থির হয়ে পড়েছে, সে ব্যাকুলভাবে বলে—ওকে না দেখলে আমি বাঁচবো না চম্পা দিদি, তুমি ওকে এনে দাও।

তোমাকে কথা দিয়েছি তোমার হুরকে তুমি পাবে।

সত্যি পাবো?

হাঁ।

কিন্তু আমার মন কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছে। কোথায় সে?

বলেছি তো আছে।

এমন সময় কয়েকজন ভীল যুবক বাইরে এস দাঁড়ায়।

চম্পা বেরিয়ে যায় কুটিরের মধ্য থেকে।

নূরী বিষণ্ণ মনে বসে থাকে। কত কথা আজ তার মনে উদয় হতে থাকে–বনহুরের সঙ্গে আস্তানার কত কথা! সহচরী নাসরিনের কথা, আর সব সময় মনকে অস্থির করে তোলে তার নয়নের মণি জাভেদের কথা। না জানি শিশু জাভেদ কেমন আছে, ভাল আছে না কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে কে জানে। নূরী ভাবে, সমস্ত পৃথিবী যদি চলে যায়, তবু তার এতটুকু কষ্ট হবে না যদি সে ফিরে পায় তার হুরকে।

চম্পা বেরিয়ে যেতেই ভীল যুবকদল তাকে নত মস্তকে কুর্ণিশ জানালো।

চম্পা বললো–যা বলেছিলাম সেইভাবে কাজ করেছে?

হাঁ, আপনার কথামত কাজ করেছি। আমাদের জাহাজ নীলদ্বীপ ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ছোট দু’খানা জাহাজ নোঙ্গর করা আছে, দু’খানাই প্রস্তুত আছে। নৌকাও প্রস্তুত আছে।

রাণাসিংকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বল–সে যেন নৌকাতেই থাকে।

আচ্ছা রাণীজী।

চম্পা যখন কুটির থেকে বেরিয়ে এসে ভীল যুবকদের সাথে কথা বলছিলো, তাদের দু’একটা কথা নূরী শুনতে পেলো। কৌতূহলবশতঃ সে উঠে গিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো আর দেখছিলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় নূরী—ভীল যুবকগণ চম্পার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিলো। নূরী বুঝতে পারে–চম্পা আসলে ভীল যুবতী নয়, সে একজন বীরাঙ্গনা তাকে কোনো সন্দেহ নেই। এ সন্দেহ নুরীর মনে পূর্ব হতেই দানা বেঁধেছিলো, কারণ তার কার্যকলাপ অন্যান্য নারীর মত ছিলো না।

চম্পা যুবকদের বিদায় করে দিয়ে ফিরে আসে আবার কুটিরে।

নূরী পুনরায় তার পূর্বের জায়গায় গিয়ে বসেছিলো, চম্পা যেন বুঝতে না পারে।

চম্পা নূরীর মনকে স্বচ্ছ করার জন্য বলে–আয়, বনে হরিণ শিকার করে আসি।

হরিণ শিকারের কথা শুনে নূরীর মনে নতুন এক উন্মাদনা জাগে, ক্ষণিকের জন্য তার মন চলে যায় দূরে বহু দূরে তার চির পরিচিত সেই ঝাম জঙ্গলে।

নূরী কোনো জবাব দিচ্ছিলো না, সে আনমনা হয়ে ভাবছিলো তার হুরের সঙ্গে কতদিন সে হরিণ শিকার করতে গেছে। হুর নিরীহ হরিণ শিকার করতো না, হরিণ শিকারে গিয়ে হিংস্র জন্তু শিকার করতো সে। একদিনের কথা আজও মনে পড়ে নূরীর……… হুর আর সে গিয়েছিলো জঙ্গলে হরিণ শিকার করতে। অনেক খুঁজেও সেদিন একটি হরিণও নজরে পড়লো না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো সেদিন নুরী, বনহুরও কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়েছিলো। ফিরে আসবে আস্তানায়, এমন সময় হঠাৎ তাদের নজরে পড়লো একজোড়া হরিণ মনের সুখে ঘাস খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নূরী আনন্দধ্বনি করে উঠেছিলো এবং সে তীর-ধনু উঁচু করে লক্ষ্য করছিলো। যেমনি সে তীর নিক্ষেপ করতে যাবে অমনি বনহুর ওর হাত থেকে তীর নামিয়ে দিয়ে বলেছিলো, থাক, ওদের জুটি নষ্ট করো না নূরী। বড় সুন্দর লাগছে ওদের দুটিকে। নূরী সেদিন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলো, সেকি, কত খোঁজাখুজির পর দুটি হরিণ পেলাম আর তুমি মারতে দেবে না? বলেছিলো বনহুর, আমরা দুজন আছি, যদি আমাদের একজনকে কেউ হত্যা করে তখন আমাদের একজনের কি অবস্থা হবে বলোতো? বনহুরের কথায় নূরীর মনটা কেমন যেন চড়াৎ করে উঠেছিলো, পারেনি সে হরিণ লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে। নূরীকে অভিমান করতে দেখে বলেছিলো বনহুর, এক্ষুণি তোমাকে খুশি করবো নূরী। নূরী বলেছিলো, না, তুমি আমাকে পারবে না খুশি করতে। বনহুর বলেছিলো, নিশ্চয়ই পারবো। বলো ঐ হরিণের পরিবর্তে তুমি কি চাও? নূরী বলেছিলো, আমি বলবো না, যে জিনিস আমার মনকে আনন্দ দেবে তাই দাও। বেশ তুমি এখানে অপেক্ষা করো আমি আসছি। বনহুর। চলে গিয়েছিলো কিছুক্ষণ পর ফিরে এসেছিলো সে বিরাট একটি ব্যাঘ্ৰ শিকার করে নিয়ে। নূরী বাঘ শিকার খুব পছন্দ করতো তাই সে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিলো…….. আজও সব কথা স্পষ্ট মনে আছে নূরীর।

নূরীকে আনমনা হয়ে ভাবতে দেখে চম্পা বলে- কি ভাবছিস্ নূরী?

কিছু না। কথাটা নূরী অভিমানভরা গলায় বলে।

চম্পা হেসে বলে- আমি জানি তুই কি ভাবছিস। তোর হুরের কথা, তাই নারে? তারপর আপন মনেই বলে উঠে চম্পা তোর হুরকে যে একবার দেখেছে সেই তাকে ভালবেসে ফেলেছে–তাকেই ভাবতে হয়েছে। তুইও ভাবছিস ওর কথা! নূরী, চল যাই আমরা।

চম্পা আর নূরী শিকারীর পোশাক পরে নিলো।

অবশ্য জংলী শিকারী নারী ড্রেস।

পিঠে তীর-ধনু বেঁধে বেড়িয়ে পড়লো ওরা দু’জনা।

বন-বাদাড় অতিক্রম করে এগিয়ে চললো চম্পা আর নূরী। চম্পাকে নূরী যত দেখছে ততই বিস্মিত হচ্ছে, কারণ ভীল যুবতী চম্পা অদ্ভুত এক মেয়ে যে মেয়ে শুধু বুদ্ধিমতিই নয়, অসীম শক্তির অধিকারিণী; আবার তেমনি ছলনাময়ী।

চম্পার সঙ্গে এগিয়ে চলে নূরী।

ঘন জঙ্গল ছেড়ে একটা নদী তীরে এসে দাঁড়ায় চম্পা। নূরীকে লক্ষ্য করে বলে–খুব হাঁপিয়ে পড়েছিস না?

সত্যি নূরী বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, কারণ অনেকটা পথ তাদের হেঁটে আসতে হয়েছে। নূরী তবু কিছু বলেনি, নীরবে অনুসরণ করেছে চম্পাকে।

ওরা নদীতীরে পৌঁছতেই একটা নৌকা এগিয়ে এলো। খুব বড়সড় নৌকা, কয়েকজন মাঝি রয়েছে; তারা দাঁড় টেনে এগিয়ে এলো তাদের দিকে।

চম্পাকে ওরা সম্মানে মাথা নত করে কুর্ণিশ জানালো। মাঝিদের শরীরে ছিলো ভীল জংলীদের ড্রেস। প্রত্যেকটি মাঝি বলি জোয়ান।

নূরীর সন্দেহ জাগলো, কেমন যেন ভয় হলো তার মনে।

চম্পা বললো-আয়, আমরা নৌকায় উঠি।

নূরী বললো–তুমি না বলেছিলে শিকার করবে?

নৌকায় চেপে ওপারে যাবো, ওপারে অনেক শিকার আছে।

নূরী ভয় পেলেও আপত্তি করলো না, কারণ সে জানে, তার কোনো কথাই টিকবে না চম্পার। কাছে।

চম্পার হাত ধরে নৌকায় চাপলো নূরী।

নৌকার ভিতরে প্রবেশ করতেই স্তম্ভিত হলো সে। অতি সুন্দর করে সাজানো-গোছানো মনোরম একটি কক্ষ বলে মনে হলো তার।

নূরী বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে দেখছে। চম্পা বললো তুই এখানে বিশ্রাম কর নূরী, আমি ছৈ-এর বাইরে অপেক্ষা করছি।

চম্পা বেরিয়ে গেলো।

নূরী-এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো। তাকে চম্পা কোথায় নিয়ে চলেছে কে জানে? সুকোমল বিছানা পাতা ছিলো, নুরী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বিছানার উপরে বসে পড়লো।

নৌকা ছুটে চলেছে।

নির্জন কুটিরের মধ্যে শুধু দু’জনা–দস্যু বনহুর আর বিজয়া। বহুক্ষণ প্রতীক্ষা করছে চম্পার জন্য কিন্তু এখনও সে ফিরে আসেনি।

বনহুর খেজুর পাতার চাটাইটার উপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় শয়ন করে পাশের ফলের থাল থেকে আংগুরের ঝোপা থেকে তুলে নিয়ে মুখে পুরছিলো।

বিজয়া বসে ছিলো তার পাশে।

বনহুর বললো–আর কতক্ষণ ওর প্রতীক্ষা করতে হবে কে জানে?

বিজয়া বললো—মেয়েটা বড় আশ্চর্য!

ঠিক বলেছো বিজয়া, আমাদের এভাবে এখানে এনে খেতে দিয়ে ও গেলো কোথায়? মনে হচ্ছে ভেগেছে।

সত্যি, আমার মনেও কেমন সন্দেহ জাগছে।

ভয় হচ্ছে বুঝি?

ভয়কে জয় করেছি তিলক। যে বিপদ থেকে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছো তেমন বিপদ বুঝি আর কোনোদিন আমার ভাগ্যে আসবে না। তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

ছিঃ তুমি রাজকন্যা আর আমি একজন সামান্য ভীল যুবক……

বিজয়া বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়, তারপর অভিমানভরা কণ্ঠে বলে–তিলক, তুমি কেন নিজকে সব সময় অমন করে নগণ্য মনে করো, আমার কাছে এখনও কি তুমি নিজের পরিচয় গোপন রাখবে?

বিজয়া, আমি তো তোমার কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখিনি। আমি একজন মানুষ এই তো আমার পরিচয়।

বনহুর আর বিজয়া কথা হচ্ছিলো, এমন সময় এক বুড়ী এসে পড়ে আচমকাভাবে। এসেই সে বনহুর আর বিজয়াকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠে–তোমরা কারা? কি জন্য আমার কুটিরে এসেছো? কে তোমাদের এখানে এনেছে, বলো? বের হও, বের হও বলছি…….

বিজয়া তো ভয় পেয়ে গেলো, সে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে পড়লো।

বনহুর কিন্তু ঘাবড়ালো না একটুও, সে বৃদ্ধাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো—দেখো বুড়ীমা, রাগ করো না; আমরা নিজে আসিনি, একটা যুবতী আমাদের এখানে এনেছে। এবার চলে যাচ্ছি। এসো বিজয়া।

বনহুর দরজার দিকে পা বাড়াতেই বিজয়াও তাকে অনুসরণ করে। অমনি বৃদ্ধা বলে উঠে– দাঁড়াও, যাচ্ছো কোথায়?

বনহুর দাঁড়িয়ে পড়লো যন্ত্রচালিত পুতুলের মত।

বৃদ্ধা বললো–এবার বুঝেছি, এ আমার মেয়ে চম্পার কাজ। বেটি তোমাদের সঙ্গে নিয়ে। এসেছে।

বনহুর এবার বলে উঠে—হা বুড়ীমা, তোমার মেয়ে চম্পাই আমাদের এখানে এনেছে।

সত্যি যা ভেবেছিলাম হলো ঠিক তাই। কার হুকুমে চম্পা তোমাদের এখানে এনেছে? আমি ওকে হত্যা করবো।

বনহুর বলে উঠে এবার–না না, ওকে হত্যা করো না। তার চেয়ে তুমি আমাদের হত্যা করো।

বুড়ী আবার বলে উঠে–তোমাদের হত্যা করবো কোন দুঃখে। দোষ কি তোমাদের। যত দোষ ঐ শয়তানী চম্পার। ও যদি তোমাদের নিয়ে না আসতো তাহলে তো তোমরা আসতে না।

তাহলে আমরা চলে যাই? বললো বনহুর।

বুড়ী হা হা করে বলে উঠলো–যাবে কোথায়? এসেছো যখন তখন থাকো।

বনহুর আর বিজয়া এবার কতকটা আশ্বস্ত হলো। একবার উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিলো আলগোছে।

বুড়ী বললো–শয়তানী তোমাদের রেখে বুঝি হাওয়া খেতে গেছে! বসো, এই চাটাইটার উপরে বসে থাকো তোমরা। আমি তোমাদের জন্য খাবার আনছি।

বনহুর আর বিজয়া একসঙ্গে বলে উঠলো—আমরা অনেক খেয়েছি, খাবার আর আনতে হবে না।

খেয়েছো? এবার তাহলে বসো। বুড়ীর মুখে এখন হাসি ফুটেছে।

অনেকটা নিশ্চিন্ত এখন বনহুর।

বিজয়াও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

বুড়ীকে প্রথমে যতখানি কঠিন মনে হয়েছিলো ঠিক ততখানি নয় সে। বুড়ীও বসলো তাদের ওপাশে। আপন জনের মত বললো–কোথা থেকে তোমরা এসেছো বাছা?

বনহুরই জবাব দিলো–বহু দূরদেশ থেকে।

ও এবার বুঝেছি, জাহাজডুবি হয়েছিলো। মেয়েটা তোমার বৌ। বাঃ বেশ মেয়েটি তো সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের দুজনাকে। থাকো, যতদিন খুশী থাকো তোমরা। চম্পা বড় শয়তান মেয়ে, একদণ্ড ঘরে থাকে না।

বুড়ী আপন মনে সব বলে চলেছে, বনহুর কিংবা বিজয়া কোনো কথা বলার সুযোগ পায় না।

বুড়ী বলে চলেছেলে নেই, ঐ একটা মেয়ে, তাই কিছু বলি না, নাহলে কবে আমি ওকে খুন করে ফেলতাম। মেয়ে ছেলে একদণ্ড ঘরে থাকবে না, এটা কেমন কথা! এই দেখো না তোমাদের দু’জনাকে বসিয়ে রেখে কোথায় যে গেছে–আজ ফিরবে কিনা তাইবা কে জানে। আমি যদি না আসতাম তাহলে কি হতো বলো তো?

বনহুর বুড়ীর কথাগুলো শুনেই যাচ্ছিলো, কি জবাব দেবে ভেবে পায় না।

বিজয়া মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলো। বুড়ীর কথা তার মনে বিরক্তি সৃষ্টি করছিলো। বনহুর বুঝতে পারে বিজয়ার মনোভাব, তাই সে বলে–বুড়ীমা, বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খেতে দাও না।

বুড়ী ব্যস্ত হয়ে পড়লো, কি বললে–খিদে পেয়েছে তোমার?

হাঁ বুড়ীমা, বড্ড খিদে……. বনহুর পেটে হাত বুলায়।

বুড়ী একটা ঝুড়ি হাতে বেরিয়ে যায়।

বিজয়া হাঁফ ছেড়ে বললো–যা বাঁচলাম! তুমি আমাকে বাঁচালে তিলক।

আমার কাছে বুড়ীকে বেশ ভালই লাগছে।

আমার কাছে অসহ্য।

বনহুর হেসে বলে-কেন?

জানা নেই শোনা নেই, তোমার-আমার সম্পর্কটা কেমন জড়িয়ে নিলো।

বলেছে, দোষ কি তাতে! যাক, কয়েক দিনের জন্য একটা আশ্রয় মিললো। বনহুর একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর খেজুর পাতার চাটাইটার উপরে আরাম করে শুয়ে পড়লো সে, যেন সুকোমল বিছানায় শয়ন করেছে তেমনি সমস্ত শরীর ছড়িয়ে চীৎ হয়ে শুলো।

বিজয়া হেসে বললো–তিলক, তোমার ঘেন্না করছে না?

ঘেন্না, কি যে বলো বিজয়া! এত সুন্দর আরামের বিছানা পাবো তা ভাবতে পারিনি। তা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না? একপাশে শুয়ে বিশ্রাম করো, অনেক পথ হেঁটেছে।

বিজয়ার মুখ রাঙা হয়ে উঠে, কি করে তিলকের পাশে শোবে ভাবে সে।

বিজয়ার লজ্জারাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে বনহুর। ভাবে সে, পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের লজ্জা এত বেশি কেন? তার পাশে শোবে এতে দোষ কি? শুধু বিজয়ার বেলায় নয়, সে আরও বহুদিন বহু মেয়ের মধ্যে এটা লক্ষ্য করেছে। বহুদিন বহু মেয়ে তার সঙ্গে মিশবার জন্য, তাকে নিবিড় করে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে কিন্তু সে এগুলেই ও কুঁকড়ে গেছে কেঁচোর মত। জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। বনহুর তখন মনে মনে হেয়েছে। বনহুর মেয়েদের নিয়ে যখনই ভেবেছে বিস্মিত হয়েছে; কারণ মেয়েরা যতই লজ্জাহীনা হোক তবু পুরুষদের কাছে তাদের বিরাট একটা দুর্বলতা রয়েছে।

মেয়েদের এই লজ্জাতুরা মধুময় ভাবটা বনহুরের কাছে বড় ভাল লাগতো, সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখতে তখন তাকে।

বনহুর ভাবতো যে মেয়ের লজ্জা নেই সে মেয়ে মেয়েই নয়।

বিজয়া তখনও বসে আছে চুপচাপ।

বনহুর উঠে পড়লো–তুমি বিশ্রাম করে বিজয়া, আমি ততক্ষণ বাইরটা একবার ঘুরে আসি।

বিজয়া কিছু বলার পূর্বেই বেরিয়ে যায় বনহুর।

বিজয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, সে খেজুর চাটাইটার উপরে শুয়ে পড়লো এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।

বনহুর বেরিয়ে এলো কুটিরের বাইরে। চারিদিকে ঘন বন, মাঝে কোথাও একটু-আধটু ফাঁকা জায়গা আছে। কোথাও বা জলাশয়। বনহুর পা পা করে এগুতে লাগলো। মুক্ত হাওয়ায় বেশ ভালই লাগছে তার। ঘুরেফিবেনটাকে দেখছে সে মনোযোগ সহকারে। বনটা ঘন হলেও বেশ পরিষ্কার; আগাছা বা ঝোঁপঝাড় তেমন নেই। শুধু নানা ধরনের বড় বড় গাছপালা প্রহরীর মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

বনহুর তাকালো উপরের দিকে–ঘন বনের ফাঁকে আকাশ তেমন দেখা যায় না, সামান্য একটু-আধটু নজরে পড়ে মাত্র।

বনহুর যখন ঘুরেফিরে দেখছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে তার কানে। বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর বলে মনে হয় তার। একদণ্ড বিলম্ব না করে বনহুর ছুটতে শুরু করে যেদিক থেকে আর্ত-চিৎকারটা এসেছিলো।

বন-বাদাড় ভেংগে ছুটে চললো বনহুর।

কিছুটা পথ এগুতেই বনহুরের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো অদূরে একটা জলাশয়ের পাশে, মাটিতে পড়ে আছে সেই বৃদ্ধাটি আর একটি বিরাট অলুক তাকে আক্রমণ করেছে। বৃদ্ধা অবিরত আর্তচিৎকার করে চলেছে।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে ভলুকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বৃদ্ধাকে ছেড়ে দিয়ে ভল্লুকটি এবার আক্রমণ করলো বনহুরকে।

ভল্লুক আর বনহুরের মধ্যে শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ।

বৃদ্ধার শরীরের তেমন কোনো আঘাত লাগেনি, তাই সে উঠে পড়লো ধীরে ধীরে। তাকিয়ে দেখলো লোকটার সঙ্গে ভল্লুকটার ভীষণ লড়াই চলেছে। বৃদ্ধা হাঁপাচ্ছে রীতিমত আর খোদার নাম স্মরণ করছে। বৃদ্ধার আকুল কণ্ঠ কানে গেলো বনহুরের—-হে ঈশ্বর, ওকে বাঁচাও, আমার প্রাণ রক্ষাকারীকে বাঁচাও….. হে ঈশ্বর…….।

বনহুরের হাতে কোনো অস্ত্র না থাকায় ভল্লুকটিকে কাবু করতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। দেহের নানা স্থানে আঁচড় লেগে রক্ত ঝরছিলো ঝরঝর করে। বনহুর প্রাণপণে ভল্লুকটার চোয়ালে মুষ্টিঘাত করে চলেছে।

ভীষণভাবে আঘাতের পর আঘাত খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভল্লুকটা কাবু হয়ে পড়লো। দু’হাতে চোয়াল ধরে চীরে ফেললো বনহুর জন্তুটাকে।

বৃদ্ধার দুচোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। সে স্তব্ধ নিশ্বাসে দেখছিলো এই অদ্ভুত লড়াইটা। মানুষ আর জন্তুর এমন যুদ্ধ সে দেখেনি কোনোদিন।

বনহুর ভল্লুকটাকে ঘায়েল করে ফিরে এলো বৃদ্ধার পাশে, বললো–তোমার খুব লেগেছে বুঝি?

বৃদ্ধা বনহুরের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যথা ভুলে গিয়েছিলো, বললো–আহা বাছা, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার কি অবস্থা হলো বলো তো!

বনহুর হাতের পিঠে কপালের রক্তগুলো মুছে ফেলে বললো–তেমন লাগেনি বুড়ীমা।

সে তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। চলো বাছা ঘরে চলো, ঔষধ আছে লাগিয়ে দেবো। তারপর এগিয়ে গেলো মরা ভল্লুকটার দিকে। নিকটে গিয়ে ভল্লুকটার শরীরে পা দিয়ে বারবার লাথি মেরে গালাগালি করলো।

বৃদ্ধা এমনভাবে ভল্লুকটাকে গালি দিচ্ছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো ভল্লুকটা যেন তার সব কথা শুনতে পাচ্ছে। এতে দুঃখেও হাসি পাচ্ছিলো বনহুরের।

বনহুরসহ বৃদ্ধা ফিরে এলো সেই কুটিরে যেখানে বিজয় নিদ্রিত ছিলো।

বনহুর চলে যাবার পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো বিজয়া। কিন্তু বেশীক্ষণ সে ঘুমাতে পারেনি—হঠাৎ তার ঘুম ভেংগে গেলো, গাটা কেমন ছমছম করে উঠলো। চারদিক নির্জন নিস্পন্দ, ভয় হলো, কোনো জীবজন্তু এসে পড়বে কি না কে জানে। কুটিরের বাইরে এসে এদিক ওদিক সে তাকিয়ে বনহুরের অন্বেষণ করছিলো, এমন সময় বৃদ্ধার সঙ্গে ফিরে এলো বনহুর।

বিজয়া বনহুরকে দেখামাত্র দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো এবং আর্তনাদ করে উঠলো– উঃ……

বনহুর আর বৃদ্ধা ততক্ষণে কুটিরের দাওয়ায় উঠে এলো।

বিজয়া হাত সরিয়ে তাকালো বনহুরের দিকে, ভয়-বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। তারপর কম্পিত-ভয়াতুর কণ্ঠে বললো–তিলক, তোমার এ অবস্থা কেন?

বনহুর কুটিরের দাওয়ার উপর বসে পড়ে হাত দিয়ে ক্ষত স্থানের রক্ত মুছে ফেলছিলো। সুন্দর মুখমণ্ডলে একটা বেদনাক্লিষ্ট ছাপ ফুটে উঠছিলো। বনহুর কিছু বলার পূর্বেই বলে উঠে বৃদ্ধা–আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ওর এ অবস্থা হয়েছে। ঈশ্বর ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো তাই আমি রক্ষা পেয়েছি।

বৃদ্ধার কথা শুনে বিজয়ার মনে কৌতূহল জেগেছিলো তবু সে তখন নীরব রইলো, কারণ প্রথমে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। পরে সব শুনলেই চলবে। বিজয়া বলে উঠলো এখন কি করা যায় বলোতো বুড়ীমা? এখানে তো আর ডাক্তার নেই যে ঔষধ পাবো!

বিজয়ার কথা শুনে বললো বৃদ্ধা–মা, ঔষধের জন্যে ডাক্তার লাগবে না। আমার কাছে সব রকম ঔষধ আছে। আয় বাছা, ভিতরে আয়।

বিজয়া বনহুরের হাত ধরে বললো–চলো তিলক, ভিতরে চলো।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো।

বৃদ্ধা ঔষধ আনতে চলে গেলো বনের মধ্যে।

বিজয়া বনহুরকে খেজুর পাতার চাটাইটার উপরে শুইয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসলো। খানিকটা আঁচল ছিঁড়ে ফেললো সে, তারপর সেই কাপড় দিয়ে রক্ত মুছে দিতে লাগলো যত্ন সহকারে।

বিজয়া যখন মনপ্রাণ দিয়ে বনহুরের সেবা করে যাচ্ছিলো তখন সে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখছিলো-ভাবছিলো মেয়েদের দয়ামায়া এত বেশী! তারা শুধু দিয়েই যায়, প্রতিদান চায় না। আরও ভাবে কত কথা বনহুর।

বিজয়া তখন বনহুরের ক্ষতস্থানের রক্ত মুছে দিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছিলো। বনহুর বললো বিজয়া, তুমি রাজকন্যা হয়ে এত সেবা শিখলে কি করে?

বিজয়া একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো—এসব মেয়েদের শেখাতে হয় না, সব ঈশ্বরের দান।

সত্যি বিজয়া। একটু হেসে বললো বনহুর-তোমরা মায়ের জাত, তোমাদের দয়া-মায়া, স্নেহ ভালবাসাই পুরুষ জাতিকে জীবিত রেখেছে, নইলে তারা নিষ্প্রাণ হয়ে পড়তো।

বিজয়া এবার বনহুরের হাতে পট্টি বাঁধতে বাঁধতে জবাব দিলো—পুরুষদের দানও কম নয়। তিলক। তোমরা যদি মেয়েদের ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা স্বচ্ছ মনে গ্রহণ না করতে তাহলে তাদের জীবনটাও যে ব্যর্থতার হাহাকারে ভরে উঠতো।

বিজয়ার কথা শেষ হয় না, বৃদ্ধা কিছু গাছ-গাছড়ার রস নিয়ে হাজির হলো। রীতিমত হাঁপাচ্ছে বৃদ্ধা।

এবার সে বনহুরের পাশে বসে গাছের রসগুলো অতি যত্নে বনহুরের দেহের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিতে লাগলো।

বিজয়া বুড়ীমাকে সাহায্য করে চললো।

এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলে চম্পা দিদি? নূরী চারদিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।

চম্পা হেসে বললো–নূরী, তোমার চম্পা দিদিকে বিশ্বাস করো, সে কোনোদিন তোমার মন্দ করবে না।

নুরী আবার বললো–তুমি না বলেছিলে শিকার করতে যাচ্ছো?

শিকার! শিকার করাই বটে। তোমার হুরকে তোমার নতুন করে শিকার করতে হবে, কারণ সে এখন তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে।

চম্পার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না নূরী। তার হুরকে নতুন করে শিকার করতে হবে……. সে তার কাছে থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে…. কেমন যেন এলোমেলো লাগে সব কথাগুলো।

চম্পা তখন ভাবছিলো অন্য কথা, নূরীর মুখে সে যা শুনেছিলো তাতে সে জানে নূরী আর বনহুর দু’জনা এক প্রাণ, এক মন, কিন্তু বনহুরের সঙ্গে মেয়েটি কে? চম্পা দেখেছে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে সেই তরুণীকে রক্ষা করেছে বনহুর। তরুণীর সঙ্গে বনহুরের কি সম্বন্ধ এটাই সে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। তাই চম্পা নূরীকে সরিয়ে নিলো দূরে।

নূরীকে যে স্থানে আনা হয়েছে সে জায়গাটা বড় নির্জন, চারদিকে বন আর মাঝখানে প্রান্তর। প্রান্তরের মাঝে একটি বাংলা প্যাটার্নের বাড়ি। বাড়িটা ইটের তৈরি নয়, সম্পূর্ণ পাথর কেটে এ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে।

নূরীকে এই বাড়িতে রাখা হলো।

চম্পা আর নূরী, আর দু’জন পাহারাদার ছিলো। তারাও ভীল যুবক।

এই পাহারাদারদ্বয় তীর-ধনু হাতে বাড়িটার চারপাশে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো রকম হিংস্র জীবজন্তু যেন বাড়ির আশেপাশে আসতে না পারে।

নূরী দেখলো বাড়িটার মধ্যে দু’খানা ঘর। একটিতে নূরীকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চম্পা, অপরটিতে থাকে সে নিজে।

ঘরগুলো সুন্দর পরিচ্ছন্ন, শ্বেত পাথরে তৈরি। উঁচু একটা জায়গায় সুন্দর শয্যা পাতা। একপাশে পাথরের তৈরি কাপড়-চোপড় রাখার আলনা। নানারকম অস্ত্রশস্ত্র সাজানো রয়েছে। কক্ষের চারপাশে।

নূরী চম্পার আচরণে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে পড়েছে, তাকে সে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। চম্পার ব্যবহার তাকে কখনো হতবাক কখনো বাক-মুখর করে তুলেছে। চম্পা কখনো নূরীর সঙ্গে সখীর মত মিশেছে, কখনো বা বড় ভগ্নীর মত, কখনো আবার স্নেহময়ী জননীর মত। নূরী ভেবে পায় না চম্পা তাকে নিয়ে এমন খেলা খেলছে কেন? কি তার উদ্দেশ্য? হুর এসেছে কিন্তু কোথায় তাকে লুকিয়ে রেখেছে? সত্যি না মিথ্যা? হয়তো বা হুরকে চম্পা খুঁজেই পায়নি। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বুঝি চম্পার এত ছলনা। তবে কি তার হুর জীবিত নেই? নূরীর মন অস্থির হয়ে উঠে।

সমস্ত রাত ঘুমাতে পারে না নূরী, বনহুরের কথা স্মরণ করে নীরবে রোদন করে সে। কখনও বা মনে পড়ে তার শিশু-সন্তান জাভেদের কথা, নাসরিনের কাছে সে কেমন আছে কে জানে!

রাত বেড়ে আসছে, বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে নূরী। হঠাৎ তার কানে গেলো একটা অপরিচিত চাপা কণ্ঠস্বর; শুধু তাই নয়, আর একটি কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে, সে স্বর তার অতি পরিচিত–এ যে চম্পার কণ্ঠস্বর! নূরী শয্যা ত্যাগ করে চুপি চুপি বাইরে বেরিয়ে আসে– বাইরে তখন জমাট অন্ধকার; সে অতি গোপনে এগিয়ে যায় যেদিক থেকে চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিলো সেদিকে।

কিছুটা এগুতেই তার কানে গেলো চম্পার ব্যস্তকন্ঠ–ভীষণভাবে আহত হয়েছে?

হ রাণীজী।

কিভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটলো মাইদি বুড়ী?

রাণীজী, আমার জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে; আমি ঝুমুর নদীর দিকে যাচ্ছিলাম–সেখানে আমাদের নৌকা বাঁধা ছিলো, নৌকা থেকে কিছু ফলমূল আনতে যাচ্ছিলাম; ঠিক সেই সময় একটা বিরাট ভল্লুক আচমকা আমাকে আক্রমণ করে বসে। আমি কোনো উপায় না দেখে আর্তচিৎকার করে উঠি।

চম্পার কণ্ঠ—তারপর?

ভল্লুকটা আমার দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার দেহে নখের আঁচড় দিয়ে চলেছে। আমি প্রাণরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম আর চিৎকার করছিলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম পরদেশী বাবু কোথা থেকে ছুটে এসে ভল্লুকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

চম্পার গলার আওয়াজ-কি বললি মাইদি বুড়ী, পরদেশী বাবু ঝুমুর নদীর কাছে গিয়েছিলো?

হাঁ, কি করে যে ওখানে পরদেশী বাবু হাজির হয়েছিলো জানি না। দেখলাম পরদেশী বাবু আর ভল্লুকটা ভীষণ লড়াই শুরু হয়েছে। পরদেশী বাবুর হাতে কোনো অস্ত্র ছিলো না, তবু সে লড়ে চলেছে।

আর তুই দাঁড়িয়ে দেখছিলি?

রাণীজী, আমার দেহের অনেক জায়গায় ভল্লুকটার নখের আঁচড়ে ক্ষত হয়েছিলো, তাই যন্ত্রণায় আমি কাঁদছিলাম।

চম্পার কণ্ঠ–নির্বোধ, তোমার কাছে কোনো অস্ত্র ছিলো না?

না রাণীজী, আমার কাছে কোনো অস্ত্র ছিলো না।

এ জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে মাইদি বুড়ী।

রাণীজী! অপরিচিত কণ্ঠস্বর কোনো বৃদ্ধার বলে মনে হচ্ছে নূরীর।

নূরী নীরবে কান পেতে শুনছিলো, বুকটা তার ধধ করছে। পরদেশী বাবু কে, কি তার নাম কে জানে! মনোযোগ সহকারে শোনে নূরী।

চম্পার গলা–তারপর কি হলো বলো?

এবার অপরিচিত বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর–রাণীজী, বহু জোয়ান দেখেছি এমন লোক কোনোদিন দেখিনি। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম, ভাবছিলাম ভল্লুকটার কবল থেকে পরদেশী বাবু আর রক্ষা পাবে না। কিন্তু আশ্চর্য, পরদেশী বাবুর কাছে অল্পক্ষণেই ভল্লুকটা কাবু হয়ে পড়লো। পরদেশী বাবু ভুলুকটার চোখেমুখে চোয়ালে অবিশ্রান্ত ঘুষি মেরে চলেছে, একসময় নেতিয়ে পড়লো ভলুকটা। আমি তখনো ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে চলেছি।

ব্যস্ত কণ্ঠস্বর চম্পার–পরদেশী বাবুর কি হলো বলো?

আমি তো ভেবেছিলাম পরদেশী বাবু হয়তো বা ভীষণভাবে কাইল হয়ে পড়েছে, সে বুঝি উঠতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্য হলাম পরদেশী বাবু এতটুকু কাবু হয়নি, সে আমার সামনে এসে বললো, বুড়ী মা, তুমি কেমন আছো? খুব আঘাত লাগেনি তো? আমি তাকিয়ে দেখলাম পরদেশী বাবুর সমস্ত শরীর দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরে পড়ছে।

পরদেশী বাবু তাহলে গুরুতরভাবে ঘায়েল হয়েছে? তাকে ঔষধ দাওনি?।

ঘায়েল গুরুতরভাবেই হয়েছে কিন্তু পরদেশী বাবু কাইল হয়নি। ঔষধ দিয়েছি। রাণীজী, আপনি কখন যাবেন?

যাবো। তুই এখন যা-দেখিস নূরী যেন জানতে না পারে। পরদেশী বাবুর অসুস্থতার কথা সে জানতে পারলে খুব কান্নাকাটা করবে। হাঁ, মেয়েটি তার সঙ্গে আছে তো?

আছে, মেয়েটি বাবুর সেবা-যত্ন করছে।

চম্পার কণ্ঠ-তাই নাকি?

হাঁ।

কান্নাকাটি করেনি সে?

করেছিলো। সব সময় বাবুর পাশে বসে তাকে দেখাশোনা করছে।

হু। চম্পার গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ হলো।

বৃদ্ধার কণ্ঠ-আমি রাত্রেই চলে যাবো রাণীজী?

এবার চম্পার ক্রুদ্ধ কণ্ঠ-যাবে না তো কি থাকবে! এক্ষুণি চলে যাও।

আর আপনি?

আমিও এই মুহূর্তে যাবো।

বৃদ্ধা চলে গেলা, তার পায়ের শব্দ শুনতে পেলো নূরী। নূরীর বুকটা থরথর করে কাঁপছে, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার হুরের কৃথাই ওরা বলছে। তবে কি চম্পা তার হুরের কাছেই যাবে? বৃদ্ধা কে? কিই বা তার পরিচয়? চম্পা যে তার রাণীজী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে যা ভেবেছিলো তাই, চম্পা সাধারণ মেয়ে নয়। কিন্তু কে সে?

বেশীক্ষণ নূরী দাঁড়াতে পারলো না, অস্থির মন নিয়ে সে নিজের ঘরে ফিরে এলো। সে নিজ কক্ষ থেকেই বুঝতে পারছে চম্পা তার কক্ষমধ্যে ড্রেস পরিবর্তন করে নিচ্ছে। নূরী সব টের পেলেও কিছু করতে পারছে না বা বলতে পারছে না। সে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিজকে সংযত করে রাখে। কিন্তু পরদেশী বাবু যদি তার হুর হয় তাহলে তার সঙ্গে মেয়েটি কে যে মেয়েটি পরদেশী বাবুর সেবা-যত্ন করে চলেছে? নূরীর মনে নানা রকম আশঙ্কা দোলা দিতে থাকে। এতটুকু স্বস্তি সে পায় না, কি অমঙ্গল তার জন্য অপেক্ষা করছে কে জানে!

চম্পা যখন তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো তখন নূরী দরজার আড়াল থেকে সব দেখছিলো।

চম্পা যখন বাইরে বেরিয়ে এলো তখন তার শরীরে অদ্ভুত ড্রেস। বিস্ময়ে নূরী স্তম্ভিত হলো, এমন ড্রেস সে তো কোনোদিন দেখেনি। জমকালো ড্রেস ঠিক কতকটা পুরুষদের ড্রেসের মত।

অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো চম্পা।

নূরী নীরবে ফিরে এলো তার শয্যায়।

চম্পার অশ্ব তীরবেগে ছুটে চলেছে।

অন্ধকারে পথ চিনতে তার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বন–প্রান্তর ছেড়ে একসময় নদীতীরে এসে পৌঁছলো চম্পা।

অদূরে নদীবক্ষে একখানা বড় নৌকা বাঁধা।

নদীতীরে চম্পার অশ্ব পৌঁছতেই কয়েকজন মাঝি নৌকা থেকে নেমে কুর্ণিশ জানালো।

চম্পা অশ্ব ত্যাগ করে নৌকায় চেপে পড়লো।

চম্পা অশ্ব থেকে নামতেই দু’জন বলিস্ট লোক অশ্বটিকে ধরে ফেললো।

চম্পা নৌকায় দাঁড়িয়ে তীরস্থ লোক দুটিকে লক্ষ্য করে বললো-তোমরা ফিরে যাও।

একজন বললো–কাল কখন আবার ঘোড়া নিয়ে হাজির হবো রাণীজী?

কাল দুপুর বেলা তোমরা এখানে আসবে।

আচ্ছা। কুর্ণিশ জানালো ওরা তীর থেকে।

চম্পা এবার নৌকা ছাড়ার আদেশ দিলো।

মাঝিরা সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলো। নৌকা চলতে শুরু করলো।

চম্পা এবার নৌকার ছৈ-এর মধ্যে প্রবেশ করে তার আসনে বসলো। এ নৌকাখানা চম্পার নিজস্ব নৌকা। এতে সে ছাড়া আর কারো চাপার অনুমতি নেই। ভিতরে সুন্দর করে সাজানো চম্পার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। একপাশে সুন্দর করে শয্যা পাতা রয়েছে। এক পাশে আসন, কতকটা চেয়ারের মত। আসনটি হাতীর হাড়ে তৈরি। অতি মূল্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নৌকার মধ্যে চম্পার নানা ধরনের পরিচ্ছদ সাজানো রয়েছে।

চম্পা আসনে বসতেই দু’জন তরুণী এসে দাঁড়ালো তার দু’পাশে। চম্পার দেহ থেকে সেই অদ্ভুত ড্রেস খুলে নিলো, তারপর তাকে সম্পূর্ণ ভীল তরুণী বেশে সজ্জিত করলো ওরা।

এই মুহূর্তে চম্পাকে একেবারে ভালবালা বলেই মনে হচ্ছিলো।

এলোমেলো চুলগুলো বামপাশে ঝুটি করে বেঁধে দিলো ওরা। খোঁপায় একটা রক্তজবাও খুঁজে দিতে ভুললো না তারা। হাতে বালা, পায়েও মল পরিয়ে দিলো তরুণীদ্বয় যত্ন সহকারে।

নৌকা এপারে পৌঁছতে প্রায় ভোর হয়ে এলো।

চম্পা যখন তার সেই কুটিরে পৌঁছলো তখন বেলা হয়েছে।

কুটিরে প্রবেশ করেই চম্পা বনহুরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, অস্ফুট কন্ঠে বললো বাবু, তোর কি হয়েছে বাবু?

বৃদ্ধা বসেছিলো বনহুরের পাশে, সে খেঁকিয়ে উঠলো– শয়তানী, সেই যে কাল দুপুরে গিয়েছিলি আর আজ ফিরছি। কোথায় গিয়েছিলি বল? আজ তোকে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেলো। বৃদ্ধা একটা লাঠি হাতে তেড়ে এলো চম্পাকে মারতে।

বিজয়া পাশেই ছিলো, সে কিছু বলতে গেলে কিন্তু তার পূর্বেই বনহুর বৃদ্ধার হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে বলে উঠে–থাক বুড়ীমা, ওকে মেরো না। ও বোধ হয় হাওয়া খেতে গিয়েছিলো।

ওর হাওয়া খাওয়া বের করে দেবো, কোথায় গিয়েছিলি ব? বল্ শয়তানী…….

চম্পা কম্পিত ভীত কণ্ঠে বলে-আমার সখীর বাড়ি গিয়েছিলাম, সে আমাকে আসতে দেয়নি তাই…. কিন্তু পরদেশী বাবুর কি হয়েছে মা?

সে কথা পরে শুনবি, এখন কাজ কর। যা, পরদেশী বাবু আর পরদেশী বাবুর বৌ-এর জন্য খাবার নিয়ে আয়।

চম্পা বেরিয়ে যায়। যাবার সময় একবার করুণ চোখে তাকিয়ে দেখে বনহুরকে।

অল্পক্ষণ পর চম্পা ফিরে আসে একগাদা ফলমূল নিয়ে। বনহুরের পাশে এসে বসে সে : বাবু, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?

হাঁ চম্পা।

বাবু, আমার মা যে ঔষধ তোর শরীরে লাগিয়ে দিয়েছে সে ঔষধ খুব ভাল, তুই চটপট সেরে। উঠবি। এক ঝোপা আংগুর নিয়ে বনহুরের মুখে দিতে থাকে চম্পা-বাবু খা।

বনহুর চম্পার হাত থেকে আংগুর খেতে থাকে।

বিজয়াও তখন পাশে ছিলো, সে গম্ভীর হয়ে পড়ে। চম্পার আচরণে সে মোটেই খুশী নয় তা বেশ বুঝা যায়।

চম্পা নিজ হাতে বনহুরের মুখে আংগুর তুলে দিচ্ছিলো, তখন তার মুখমণ্ডল দীপ্ত উজ্জ্বল লাগছিলো। পরদেশী বাবুকে সে নিজের হাতে খাওয়াতে পারবে এ কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

বনহুর কিছুক্ষণ নিৰ্ণিমেষ নয়নে চম্পার মুখে তাকিয়ে কিছু লক্ষ্য করছিলো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কি যেন খুঁজে ফিরছিলো চম্পার মুখে।

বিজয়ার মন অভিমানে ভরে উঠে। সে ভাবে একটা ভীল যুবতী এসে তার তিলককে দখল করে নিচ্ছে। ওর সঙ্গে কি সম্বন্ধ আছে তার?

ঠিক্ চম্পার মনেও ঐ সন্দেহ, বারবার চম্পা লক্ষ্য করছিলো বিজয়ার মুখ। বিজয়ার মুখমণ্ডল বেশ গম্ভীর লাগছিলো। চম্পা বনহুরের পাশে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো, ক্ষতস্থানগুলো সে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। চম্পার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিলো সে যেন তার কত আপনজন!

বিজয়া তখন রাগে ফুলছিলো, বেরিয়ে গেলো সে কুটিরের মধ্য থেকে।

বনহুর বিজয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো।

চম্পা বনহুরের কপালের ক্ষতটার পাশে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–বাবু, তোর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কেমন করে তোর এমন দশা হলো বাবু?

যদিও চম্পা পূর্বেই বৃদ্ধার মুখে সব শুনেছিলো তবু সে এই প্রশ্ন করলো।

বনহুর সব কথা বললো, আরও বললো সে—চম্পা, তোমার মাকে বাঁচাতে পেরেছি সেটাই আমার পরম সৌভাগ্য।

বৃদ্ধা নিকটেই ছিলো সে নতুন ঔষধ তৈরি করছিলো। কোনো কারণে সে তখন বাইরে চলে গেলো।

চম্পা বললো–বাবু, সত্যি তুই বড় উপকার করেছি। তোকে আমি একটা জিনিস দেবো, নিবি বাবু?

বনহুর হেসে বললো— নেবো।

আজ না, দেবো একদিন।

কি দেবে তাতে বললে না চম্পা?

যেদিন দেবো সেদিন দেখবি। তোর বড় পিয়ারা জিনিস বাবু।

আচ্ছা চম্পা, কাল আমাদের রেখে তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে বলো তে? সত্যি করে বলবে।

ঐ তো মায়ের কাছে বললাম তুই কি শুনতে পানি বাবু?

পেয়েছি কিন্তু..

হেসে উঠলো চম্পা খিল খিল করে, তারপর বললো–বিশ্বাস হয়নি, এই তো? আচ্ছা আমার সখীর ওখানে তোকে নিয়ে যাবো একদিন। যাবি তো বাবু?

ঠিক যাবো, আগে সেরি উঠি।

হাঁ বাবু, শীগগীর সেরে উঠবি তুই। আমার মা তোকে খুব ভাল ঔষধ দিয়েছে। বাবু, তুই সেরে উঠলে চলে যাবি না তো?।

এমন সময় বিজয়া কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে বলে উঠে সেরে উঠলেই আমরা চলে যাবো। এখানে আমার একটুও ভাল লাগছে না।

চম্পা উঠে এলো এবার বিজয়ার পাশে, বললো–তুই চলে যাবি? পরদেশী বাবুকে নিয়ে চলে যাবি?

বিজয়া রাগতভাবে সরে গেলো চম্পার কাছ থেকে।

বনহুর মৃদু হাসলো।

কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলো বনহুর। বৃদ্ধার ঔষধ বড় ভাল ছিলো, বেশিদিন ভুগতে হলো না তাকে। চম্পা প্রায়ই আসতত বনহুরকে দেখতে, আবার মাঝে মাঝে কোথায় চলে যেতো।

বিজয়ার মনে ঈর্ষা জাগলো, চম্পা যখন বনহুরের পাশে আসতো তখন সে মুখ ভার করে বসে থাকতো, বনহুরের কাছে সে সহজে আসতে চাইতো না।

চম্পা বলতো–বাবু, তুই বড় ভাল, তোর বৌ বড় রাগী, আমাকে দেখলে কেমন কটমট করে তাকায়।

বনহুর হেসে বলে-চম্পা, তুমি এবং তোমার মা ভুল করছো, বিজয়া আমার বৌ নয়।

চম্পা গালে হাত রেখে অবাক হয়ে বলে–তাই নাকি, ঐ মেয়ে তোর বৌ না?

না।

তবে তোর সঙ্গে ওর কি সম্বন্ধ বাবু?

ও এক রাজার মেয়ে আর আমি একজন সাধারণ মানুষ।

বিস্মিত কণ্ঠে বলে চম্পা-ও রাজার মেয়ে?

হা চম্পা।

কিন্তু তোর সঙ্গে কেন?

সে অনেক কথা, তুমি বুঝবে না চম্পা। আমি একজনকে হারিয়েছি, তাকেই খুঁজে ফিরছি। ও আমাকে ভালবাসে তাই আমার সঙ্গে এসেছে।

তুই যাকে খুঁজছিস তাকে পাসনি বাবু?

না চম্পা। জানি না সে কোথায় আছে, কেমন আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বনহুর।

চম্পার বড় হাসি পায়, কারণ সে জানে যার জন্য পরদেশী বাবু আজ এমন উড্রান্ত সে তারই কাছে রয়েছে। পরদেশী বাবুকে একটু নাকানি-চুবানি খাওয়ানোই তার উদ্দেশ্য।

হঠাৎ চম্পা হেসে উঠে খিল খিল করে।

বনহুর অবাক হয়ে বলে—হাসছো কেন চম্পা?

বাবু, তোর কষ্ট দেখে হাসছি।

কি বললে আমার কষ্ট?

হাঁ বাবু।

চম্পা!

বল্ বাবু?

আমার কষ্ট দেখে তোমার হাসি পায় বুঝি?

খুব হাসি পায়।

কেন?

আজ না বাবু, বলবো একদিন।

কবে সেদিন আসবে?

বাবু, একটা কথা আমি তোকে জিজ্ঞেস করবো, জবাব দিবি বাবু?

বল দেবো।

তুই যাকে খুঁজছিস তাকে পেলে চলে যাবি না তো?

বনহুর বিস্ময়ভরা নজরে তাকালো চম্পার মুখে।

চম্পা তখন ছুটে পালিয়ে গেছে সেখান থেকে।

বনহুর পিছনে তাকিয়ে দেখে বুড়ীমা দাঁড়িয়ে আছে। বনহুর তাকাতেই বলে উঠে—ও বড় শয়তানী মেয়ে, ওর কথা বিশ্বাস করিস না বাবু।

বৃদ্ধা আসতেই বনহুরের অন্যমনস্কতা কেটে গিয়েছিলো। বললো বুড়ীমা, তোমার চম্পা বড় দুষ্টু মেয়ে।

হাঁ বাছা, ঠিক বলেছিস।

এমন সময় বিজয়া এসে পড়লো সেখানে। চোখেমুখে তীব্র অভিমানের ছাপ বিদ্যমান। সে এতক্ষণ আড়াল থেকে চম্পা আর বনহুরের সব কথাবার্তা শুনছিলো।

বনহুর বিজয়ার মুখোভাব লক্ষ্য করে মৃদু হাসে। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

বিজয়া বলে–তিলক, এবার ফিরে চলল, এখানে আমার মোটেই ভাল লাগছে না।

বৃদ্ধা বলে উঠলো–মা, তোর এখানে ভাল লাগবে না, এটা যে বন। চম্পা বড় শয়তানী, ও তোর সঙ্গে মিশতেই চায় না।

আসলে কিন্তু বৃদ্ধার কথা ঠিক উল্টো ছিলো। চম্পা বিজয়ার সঙ্গে মিশবার জন্য সব সময় চেষ্টা করতো, বিজয়াই মিশতে চাইতো না চম্পার সঙ্গে। চম্পা যখন তার কুটির আসতো তখন বিজয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে পড়তো, চম্পার সঙ্গে সে কিছুতেই কথা বলতো না।

চম্পা অবশ্য বিজয়ার গায়ে পড়েই মিশতো।

অন্য আর একদিনের কথা।

বিজয়া বসে ছিলো একা একা।

হঠাৎ চম্পা পিছন থেকে ওর চোখে দুটো ধরে ফেলে চুপি চুপি।

চমকে উঠে বিজয়া, তিলক তো কোনোদিন তার সঙ্গে এভাবে আলাপ করে না–তবে কে? প্রকাশ্যে বললো–তিলক।

চম্পা হাত সরিয়ে নিয়ে হেসে উঠলো খিল খিল করে।

বিজয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে পড়েছে, রাগতকণ্ঠে বললো–চম্পা, আর কোনোদিন আমার সঙ্গে এ ধরনের আলাপ করবে না। যাও এখান থেকে।

এমন সময় বনহুর সেখানে এসে পড়ে, সব শুনে বলে সে–ছিঃ বিজয়া অমনভাবে রাগ করতে নেই। তারপর চম্পাকে লক্ষ্য করে বলে—-চম্পা, ওর কথায় কিছু মনে করো না। ওর হয়ে আমি তোমার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।

চম্পার মুখে এতটুকু রাগ বা অভিমান দেখা যায় না, সে পূর্বের মতই হাসিমুখে চলে যায়, সেখান থেকে।

চম্পা চলে যেতেই বনহুর বলে–বিজয়া, ও তোমার মতই মানুষ। ওকে তুমি কেন ঘৃণা করো বলো তো?

বিজয়া কোনো জবাব দেয় না।

বনহুর বলে আবার–তুমি রাজার মেয়ে আর চম্পা জংলী মেয়ে, এইতো পার্থক্য? ওর শরীরে যেমন রক্ত-মাংস রয়েছে, তোমার শরীরেও তেমনি রয়েছে। তোমার যেমন মনপ্রাণ আছে, ওরও আছে; তবে কেন তুমি ওর সঙ্গে স্বচ্ছমনে মিশতে পারো না বিজয়া। জানি তুমি ওকে সহ্য করতে পারছো না; কিন্তু ওকে তোমার সহ্য না করে উপায় নেই, কারণ আমরা এখন বিপদগ্রস্ত। উপায়হীন হয়েই আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। সুযোগ এলেই চলে যাবো।

বিজয়া বনহুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো, সে কোনো উত্তর দিলো না, সত্যি সে মনে মনে লজ্জিত হচ্ছিলো নিজের আচরণের জন্য।

বনহুর যখন কথাগুলো বলছিলো তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো চম্পা।

কথা শেষ হলে সে আস্তে সরে পড়ে সেখান থেকে। একটা দীপ্ত-উজ্জ্বল ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে।

আজ তোমাকে বড় আনন্দমুখর লাগছে চম্পাদি? কি পেয়েছে যার জন্য এত খুশী তোমার? কথাগুলো বললো নূরী।

চম্পা গুন গুন করে গান গাইছিলো আর একটা আসনে বসে পা দোলাচ্ছিলো। নূরীর কথার জবাব না দিয়ে সে নূরীর চিবুক ধরে নাড়া দেয়।

নুরী বলে-তোমার খুশীর কারণ বলবে না আমাকে?

এবার কথা বলে চম্পা, বলে–আজ আমার পরাজিত জীবনের জয় হয়েছে নূরী। যাকে খুঁজে ফিরেছি এতদিন তাকে খুঁজে পেয়েছি। নূরী, আজ আমার বড় আনন্দ, বড় আনন্দ।

চম্পাদি, তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আজ বুঝতে পারবি না, যেদিন বুঝবি সেদিন আমি হারিয়ে যাবো তোদের কাছ থেকে।

সেকি চম্পাদি, তুমি হারিয়ে যাবে!

চিরদিন কি তোরা আমাকে ধরে রাখতে পারবি?

সত্যি চম্পাদি, তোমাকে মাঝে মাঝে বড় অদ্ভুত বলে মনে হয়, বুঝতে পারি না তুমি কেমন মেয়ে।

চম্পা কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্য অন্য কথা তোলে, বলে সে–নূরী, আজ তোকে একটা গল্প বলবো, শুনবি?

নূরী গল্পের কথায় খুশী হয়ে উঠে, বলে-গল্প বলবে? শুনবো বলো?

তবে তৈরি হয়ে নে, গল্প বলবো এখানে নয়, নদীর বুকে আমার বজরায় বসে।

নূরীর আনন্দ আর ধরে না।

সে তখনই ছুটলো প্রস্তুত হবার জন্য।

চুম্পা হাসলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নূরী তৈরি হয়ে ফিরে এলো।

চম্পা নূরীসহ অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো।

কিছু সময়ের মধ্যেই তারা এসে পড়লো একটি নদীতীরে। চম্পা এদিকে আসেনি কোনোদিন। তাকিয়ে দেখলো নদীতীরে একটি বজরা বাঁধা।

বজরাখানা অতি সুন্দর করে সাজানো।

চম্পা বললো–আয় নূরী।

এগিয়ে চললো চম্পা।

নূরী তাকে অনুসরণ করলো।

বজরায় উঠে ওরা দু’জনা। অতি সুন্দর বজরাখানা। নূরী মুগ্ধ হলো বজরাখানা দেখে। এমন। সুন্দর বজরা সে অনেকদিন দেখেনি।

বজরায় পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। আকাশে ফুটে উঠলো অসংখ্য তারার মালা।

চম্পা আর নূরী বজরার ছাদে এসে বসলো।

পাশাপাশি বসলো ওরা।

নরী তাকিয়ে দেখছে, অপূর্ব এক পরিবেশ চারিদিকে ছাড়িয়ে আছে। তারা যে শয্যায় বসে আছে সেটা অতি মূল্যবান মখমলের গালিচা। গালিটার উপরে কয়েকটা বালিশ ছড়ানো আছে বালিশগুলোতে মখমলের কভার। কয়েকটা ফুলদানী সাজানো রয়েছে, ফুলদানীগুলোতে অজানা কতকগুলো ফুল সাজানো রয়েছে। চম্পা আর নূরী আসন গ্রহণ করার পর দু’জন দাসী দু’খানা। রেকাবীতে নানারকম ফলমূল এনে সাজিয়ে রাখে।

চম্পা ভীলকন্যা অথচ তার কথাবার্তা, চালচলন নূরীকে বিস্মিত হতবাক করে তোলে, সে ভেবে পায় না তার ভিতরের গভীর রহস্য কি–কে এই নারী? কিই বা এর আসল পরিচয়?

নূরীকে লক্ষ্য করে বলে চম্পা-খেয়ে নে, অনেকটা পথ এসেছিস, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিস।

চম্পার কথা ফেলতে পারে না নূরী। সে রেকাবী থেকে ফুল তুলে খেতে শুরু করে।

চম্পাও খেতে থাকে।

পূর্বদিক আলো করে তখন চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।

নদীর বুকে রূপালী পানি কল কল করে ছুটে চলেছে। চাঁদের আলো যেন হাসছে।

চম্পা এবার বলতে শুরু করলো—হীন্দ জঙ্গল নামে এক জঙ্গল আছে, নীল নদের দক্ষিণে সে জঙ্গল। এই জঙ্গলে বাস করতো এক ডাকু, নাম তার হীরাজ। যেমন ভয়ঙ্কর তার চেহারা তেমনি তার শক্তি। বিশ্বের কোনো দস্যু এই ডাকুর সঙ্গে পেরে উঠতো না। হীরাজ নীলনদের তীরস্থ সমস্ত বনভূমির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেছে। নীলনদ দিয়ে যেকোন জাহাজ স্টিমার যেতো কোনোটাই তার কবল থেকে রক্ষা পেত না। জাহাজ বা স্টিমারের লোকজনকে সে হত্যা করতো, তারপর সমস্ত ধন-সম্পদ লুটে নিতো। এই দুর্দান্ত ডাকুর ভয়ে যে কোনো সওদাগর এই পথে যেতে কুণ্ঠা বোধ করতো। শুধু লোকহত্যা আর লুণ্ঠন নয়, যে কোনো নারীকে ধরে এনে তার ইজ্জত নষ্ট করতে সে এবং তার অনুচরগণ।

চম্পা গল্প বলে চলেছে।

নূরী বিস্ময়ভরা নয়ন মেলে তাকিয়ে আছে চম্পার মুখের দিকে। অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে সে তার কথাগুলো।

বজরা ভেসে চলেছে, চারজন মাঝি বজরার বৈঠা মারছে। ফুরফুরে বাতাসে চম্পার এলায়িত চুলগুলো উড়ছে। নূরীর আঁচলখানা দোলা খাচ্ছে। চাঁদ এখন আরও উপরে উঠে এসেছে।

চম্পা বলে চলেছে-সেই দুর্দান্ত ডাকুর একটি দুটি নয়, অনুচর ছিলো একশোর বেশি। এক একটি অনুচর ছিলো এক একটি জীবন্ত শয়তান। যেমন চেহারা তেমনি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। ডাকু হীরাজ মনে করতো তার চেয়ে বড় ডাকু এ পৃথিবীতে আর বুঝি দ্বিতীয় জন নেই। কিন্তু সে জানতো না তার চেয়েও বড় ডাকু আছে। একটু থামলো চম্পা।

নূরী একটু নড়ে বসলো।

ফুরফুরে বাতাসে নূরী বেশ আরাম বোধ করছিলো। চম্পার কণ্ঠে গল্পটা ভারী ভাল লাগছিলো তার। নিশ্চয় গল্পটা অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ হবে। বলে নূরী-তারপর?

চম্পা বলে চলে—-একদিন তার সঙ্গে সাক্ষাত হলো আর একজন ডাকুর। তার নাম সিরাজ। সিন্দ নামে এক জঙ্গল আছে, সে জঙ্গলের অধিপতি ছিলো সিরাজ। সিরাজ আর হীরাজ উভয়ে জানলো উভয়ের কথা। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারলো না। দুই ডাকুর মধ্যে বাঁধলো ভীষণ যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়ী হলো সিরাজ। বন্দী হলো হাজ। হীরাজ বন্দী হয়ে হিংস্র জন্তুর মত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। সিরাজ হীরাজকে বন্দী করার পর তার জেদ পূর্ণ হলো। সে হীরাজকে মুক্তি দিলো বন্ধুত্ব মনোভাব নিয়ে। ফল হলো বিপরীত, সিরাজের মন ছিলো কিছুটা ভাল উন্নত ধরনের, সে মনে করলো হীরাজ এবার থেকে তার বশ্যতা মেনে চলবে।

তারপর?

কিন্তু হীরাজ ছাড়া পেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। সে সদাসর্বদা সিন্দারাজকে কৌশলে বন্দী করে হত্যার চেষ্টা করতে লাগলো। হীরাজের এই কৃতজ্ঞতাহীন আচরণের কথা তার একমাত্র কন্যা চন্দ্রার কানে গেলো। চন্দ্রা ডাকু হীরাজের একমাত্র কন্যা। হীরাজ কন্যাকে অত্যন্ত স্নেহ করলেও চন্দ্রা তার পিতাকে ঘৃণা করতো।

নূরী বলে উঠে–কন্যা তার পিতাকে ঘৃণা করতে?

হাঁ, এবং চরমভাবে সে তার পিতাকে ঘৃণা করতো। শুধু তাই নয়, নিজের জীবনকে সে ধিক্কার দিতে কারণ তার পিতা মানুষ নামে কলঙ্ক ছিলো। চন্দ্রা বড় হবার পর থেকে তার পিতার কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলো। সর্বক্ষণ তাই সে পিতার পাশে পাশে থাকতো ছায়ার মত। হীরাজ কিন্তু কন্যাকে অবিশ্বাস করতো না, সে মনে করতো তার কন্যা চন্দ্রা তার হিতাকাঙ্ক্ষী এবং সে কারণে সে চন্দ্রাকে নিজের সব কাজে কাছে কাছে রাখতো। এমন কি তার কোনো গোপন কাজেও চন্দ্রা বাদ যেতো না।

চম্পার গল্প অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনে যাচ্ছিলো নূরী। বড় অদ্ভুত লাগছিলো গল্পটা তার কাছে।

চম্পা মাঝে মাঝে ফল চিবুচ্ছিলো আর গল্পটা বলে যাচ্ছিলো। সে বলে বলেছে-চন্দ্রা পিতার গোপন আড়ার গোপন পরামর্শ শুনতো এবং সে গোপনে পিতার কুকর্মের বাধা হয়ে দাঁড়াতে। তবে প্রকাশ্যে নয়, আত্মগোপন করে চন্দ্রা পিতার কাজে প্রতিবাদ করতো। কখনো কখনো সে পিতার সম্মুখে হাজির হতে, হীরাজ কিন্তু কন্যাকে তখন চিনতে পারতো না।

নূরী বলে উঠে–সে কি রকম?

কারণ চন্দ্রা তখন স্বাভাবিক ড্রেসে থাকতো না। তার দেহে থাকতো জমকালো আলখেল্লা, যার নীচে ঢাকা থাকতো চন্দ্রার আসল রূপ।

থামলো চম্পা।

নূরীর মনে তখন জানার বিপুল উন্মাদনা। গল্পটার শেষ কি জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সে, চম্পাকে থামতে দেখে বলে উঠে নূরী–তারপর কি হলো বলো চম্পাদি?

হাঁ বলছি, কিন্তু রাত ভোর হয়ে যাবে, ততক্ষণ জেগে থাকতে পারবি তো?

নূরী আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে উঠে–পারবো।

বেশ আমি বলছি, শোন্।

বলো?

এমন সময় একটা মাঝি এসে রেকাবীতে কিছু আংগুর ফল রাখলো।

চম্পা বিরক্ত কণ্ঠে বললো–তোমাকে কে এখানে ফল আনতে বললো, বলো?

কেউ বলেনি, আমি নিজেই এসেছি, কারণ গল্প বলতে বলতে আপনার গলা শুকিয়ে গেছে কিনা……

মুহূর্তে চম্পার মুখ গম্ভীর হয়ে পড়লো, আজ পর্যন্ত কোনো অনুচর তার মুখের সামনে এমন করে কথা বলতে পারেনি, এ এমন করে কথা বললো কোন সাহসে! ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো চম্পা,— আর এখানে আসবে না।

মাঝি কুর্ণিশ জানিয়ে বললো-আচ্ছা, আর আসবো না।

চম্পা আবার গল্প শুরু করে-চন্দ্রা পিতার সম্মুখে তার মন রেখে চলতো কিন্তু অন্তরালে সে তার পিতার বিপক্ষে কাজ করতো। পিতার কুকর্মে সে কোনো সময় সহযোগিতা করতো না। সে। বিক্ষিপ্ত উল্কার মত ছুটাছুটি করে বেড়াতো। দুর্দান্ত ডাকুর কন্যা হলেও তার ন্যায়নীতি ছিলো ধর্ম। পিতা এবং পিতার অনুচরদের কাউকে সে ভাল নজরে দেখতো না, যদিও তাকে তাদের সঙ্গে মিশতে হতো সদা-সর্বদা ঘনিষ্ঠভাবে। চন্দ্রার মন ছিলো স্বচ্ছ-নির্মল-পবিত্র, সে কোনো সময় কুচিন্তা করতো না। সেই চন্দ্রাকে একদিন প্রেম নিবেদন জানালো তার পিতারই প্রধান সহচর শয়তানটি। অবশ্য সে অনেকদিন থেকেই চন্দ্রার পিছু লেগেছিলো, চন্দ্রা তাকে গ্রাহ্যই করতো না বা তার কোনো কথা কানে নিতো না। সেদিনের প্রেম নিবেদনও চন্দ্রা উড়িয়ে দিলো অবহেলা করে কিন্তু মনে মনে চন্দ্রা ভীষণ রেগে গেলো। মুখে কিছু না বললেও তার এই কথার প্রতিশোধ নেবার জন্য চন্দ্রা ক্ষেপে রইলো ভিতরে ভিতরে। দিন গড়িয়ে চলেছে, সিন্দারাজকে কাবু করতে চাইলেও তাকে হীরাজ কাবু করতে পারলো না। একদিন সিন্দারাজ পরপারের ডাকে চলে গেলো। যেখানে এ পৃথিবীর কোনো কোলাহল গিয়ে পৌঁছতে পারবে না। কেউ সূচ পরিমাণ ক্ষতি করতে পারবে না আর তার। হিন্দরাজের প্রতিশোধ নেওয়া আর হলো না, সমস্ত প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেলো। হিন্দুরাজ কিন্তু দমলো না, সিরাজের উপরে যে রাগ ছিলো সেই রাগ গিয়ে পড়লো সিরাজের পুত্র জয়রাজের উপর।

নূরী বলে উঠলো–সিন্দরাজের পুত্র জয়রাজ?

হাঁ, জয়রাজ সিরাজের পুত্র। সে পিতার চেয়েও দুর্দান্ত শক্তিশালী দস্যু। হিন্দরাজের রাগ গিয়ে পড়লো জয়রাজের উপর। জয়রাজকে কাবু করতে পারলে তবে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে, মনের ঝাল মিটবে। হিন্দরাজ কি করে জয়রাজকে কাবু করতে পারবে, এই নিয়ে সে উন্মাদ হয়ে উঠলো। তার প্রধান অনুচর এ ব্যাপারে হিন্দুরাজকে সদা-সর্বদা উৎসাহিত করে চলেছিলো। জয়রাজকে কি করে কাবু করা হয়, এ নিয়ে প্রায়ই হিন্দরাজের দরবারে গোপন বৈঠক বসতো। এ বৈঠকে সাধারণ অনুচর স্থান পেতো না। যারা হিন্দরাজের বিশ্বস্ত অনুচর এরাই এ বৈঠকে স্থান। পেত। চন্দ্রা অবশ্য সর্বক্ষণ এ বৈঠকে পিতার পাশে থাকতো। জয়রাজ সম্বন্ধে যেসব আলোচনা হতো তা শুনে তার মনে একটা শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাব জেগে উঠতো। জয়রাজকে স্বচক্ষে দেখার এবং তার সম্বন্ধে জানবার জন্য চন্দার মনে বিপুল আলোড়ন জাগতো। হিন্দুরাজ আর তার অনুচরদের আলোচনার মধ্যে জয়রাজ সম্বন্ধে যত মন্দই বলা হোক তাকে, চন্দ্রার মনে এক নতুন উন্মাদনা জাগে। একদিন গোপনে সে বেরিয়ে পড়ে জয়রাজের সন্ধানে।

নূরী বলে উঠলো আবার—চন্দ্রা জয়রাজের দেখা পেয়েছিলো?

হাঁ, পেয়েছিলো কিন্তু বহু সাধনার পর। একটু থামলো চম্পা, তারপর আবার বলতে শুরু করলো–যা সে কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি তেমনি এক অপূর্বরূপে দেখা পেয়েছিলো তার। চন্দ্রার সমস্ত হৃদয় অভূতপূর্ব এক অনুভূতিতে ভরে উঠেছিলো……।

জয়রাজ চন্দ্রাকে দেখতে পায়নি? বললো নূরী।

চম্পা বললো–জয়রাজ চন্দ্রাকে দেখেছিলো কিন্তু ছায়া রূপে…

হঠাৎ চম্পার দৃষ্টি চলে যায় পিছনে, দেখতে পায় সেই মাঝি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ক্রুদ্ধ। কণ্ঠে বলে উঠে–সেকি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো এখনো?

মাঝি বলে উঠেকই, আপনি তো আমাকে যেতে বলেননি, তাই দাঁড়িয়ে আছি।

চম্পার মুখমণ্ডল রাগে রাঙা হয়ে উঠলো, তীব্র কণ্ঠে বললো–জানো তোমার কি শাস্তি হতে পারে?

জানি রাণীজী।

তবু……

আসতে বারণ করেছেন আর আসবে না।

যাও।

এবার যাচ্ছি।

চলে গেলো মাঝিটা।

চম্পা আবার বলতে শুরু করলো-চন্দ্রা জয়রাজকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালবাসলো। শুধু তাই নয়, তার মনপ্রাণ সমর্পণ করেছিলো তাকে কিন্তু উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে দূরে বহু দূরে।

নূরী আগ্রহভরা কণ্ঠে বললো–তারপর?

হিন্দুরাজ যখন জয়রাজকে কৌশলে বন্দী করে হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছো তখন চন্দ্রা গোপনে জয়রাজকে সাবধান করে দিতে লাগলো। তবু একদিন জয়রাজ বন্দী হলো, হিন্দরাজের বাসনা চরিতার্থ হলো, হিন্দরাজের প্রধান অনুচর জয়রাজের মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করলো। তাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হবে তারই আয়োজন হলো।

জয়রাজকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করার আয়োজন করা হলো?

হাঁ, প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে বাধা অবস্থায় জয়রাজকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মৃত্যু তার অনিবার্য, ঠিক সেই মুহূর্তে চন্দ্রা জানতে পারলো জয়রাজকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হচ্ছে। চন্দ্রা ছদ্মবেশে ছুটে এলো সেখানে, তীরবিদ্ধ করে হত্যা করলো হিন্দরাজের প্রধান অনুচর শয়তানটিকে। তারপর জয়রাজকে সে মুক্ত করে দিলো অগ্নিকুণ্ডের মধ্য হতে।

জয়রাজ তাহলে বেঁচে গেলো চম্পাদি?

হাঁ, চন্দ্রা জীবিত থাকতে সে জয়রাজকে মরতে দিতে পারে না। তারপর থেকে চন্দ্রা জয়রাজের সঙ্গে ছায়ার মত থাকতো, সর্বক্ষণ অনুসরণ করতে সে তাকে।

জয়রাজকে মৃত্যুর কবল থেকে বহুবার চন্দ্রা বাঁচিয়ে নিলো তা হলে চম্পাদি?

হা।

জয়রাজ কি জানতে চন্দ্রা তাকে ভালবাসে, তাকে রক্ষা করার জন্য সে সর্বক্ষণ তার পাশে ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করছে?

জয়রাজ জানে না, আজও সে চন্দ্রাকে চিনতে পারেনি কে সে, কি তার আসল পরিচয়। হঠাৎ চমকে উঠে চম্পা, কে যেন ছায়ার মত সরে গেলে বজরার সিঁড়ির পাশ থেকে।

নূরী চম্পার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। সে বললো-চম্পাদি, তোমার গল্প শেষ হলো না তো?

হবে কিন্তু আজ নয়। দেখছো না আজ রাত ভোর হয়ে গেছে। চম্পা মাঝিদের আদেশ করে বজরা ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।

বজরার মাঝিগণ চম্পার আদেশ পালন করে।

ভোরে ঘুম ভাংতেই বিজয়ার নজরে পড়ে অদূরে একটা খেজুর পাতার চাটাই-এর উপরে। অঘোরে ঘুমুচ্ছে তিলক। ভোরের সূর্যের আলো কুটিরের বেড়ার ফাঁকে এসে পড়েছে তার মুখে। বিজয়া ভালভাবে লক্ষ্য করলো বুড়ীমা কোথায়। বুড়ীমার শয্যা খালি, বিজয়া বুঝতে পারলো সে তাদের প্রাতঃ ভোজের আয়োজনে বেরিয়েছে। বিজয়া নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তিলকের দিকে।

এমন সময় বুড়ীমা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে।

বিজয়া চমকে ফিরে তাকায়।

বৃদ্ধা বলে উঠে-ঘুম ভেংগেছে বাছা?

হাঁ বুড়ীমা, কিন্তু ওর ঘুম ভাংগেনি।

বৃদ্ধা বলে উঠলো—ওকে ঘুমাতে দাও! চলো মা, তুমি বাইরে চলো, মুক্ত বাতাসে শরীর ভাল হবে।

বিজয়া শয্যা ত্যাগ করলো।

বৃদ্ধার সঙ্গে সে বেরিয়ে এলো বাইরে।

ভোরের আলোতে বনভূমি ঝলমল করছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো এসে পড়েছে বনভূমির মধ্যে। পাখীর কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিক। মুগ্ধনয়নে বিজয়া এসব লক্ষ্য করছিলো। রাজপ্রাসাদে কেটেছে তার আজীবন, এমন দৃশ্য সে দেখেনি কোনোদিন। অবাক হয়ে দেখছে সব।

বৃদ্ধ বললো–বাছা, এখানে তোমার কেমন লাগছে?

খুব ভাল লাগে বুড়ীমা কিন্তু বাবা-মার জন্য মনটা বড় অস্থির লাগছে।

হাঁ, তা লাগবেই তো। রাজার মেয়ে তুমি, আর এখানে এই কুটিরে থাকবে কি করে?

আমি রাজার মেয়ে এ কথা জানলে কি করে? কে তোমাকে একথা বলেছে বুড়ীমা?

কেউ বলেনি, তোমাকে দেখলে আপনা-আপনি বুঝা যায়।

তাই নাকি?

হাঁ বাছা।

বিজয়া একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। বৃদ্ধাও তার পাশে পাশে এগিয়ে এলো।

বিজয়া বলে-বুড়ীমা, তুমি সব সময় আমার কাছে কাছে থাকো কেন বলো তো?

বিজয়ার কথায় হেসে বলে বৃদ্ধা–তোমাকে আমি আমার মেয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসি, তাই সব সময় তোমার পাশে পাশে থাকি।

বিজয়া ভাবে, সত্যি বৃদ্ধা তাকে ভালবাসে এবং সে কারণেই সে সদা-সর্বদা তার কাছে কাছে থাকে। তাকে ভাল ভাল ফলমূল খেতে দেয়। যখন বিজয়া ঘুমায় তখন পাশে থাকে সে।

কিন্তু মাঝে মাঝে বিজয়ার মনে কেমন যেন সন্দেহ জেগেছে, হঠাৎ বিজয়া দেখতে পেয়েছে বৃদ্ধা তার অলক্ষ্যে তার দিকে চুপি চুপি তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। এমনকি তিলকের সঙ্গে সে যখন নিভৃতে কোনো আলাপ-আলোচনা করছে তখন দূর থেকে বৃদ্ধা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিজয়ার সূঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই বৃদ্ধা সরে গেছে সেখান থেকে।

বিজয়া সময় সময় বিরক্তি বোধ করতো, বৃদ্ধার আচরণে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতো।

বনহুর বুঝতে পেরে বলতো-ওরা বনের মানুষ, তোমার মত সুন্দরী মেয়ে ওরা দেখেনি। তাই অমন অবাক হয়ে দেখে।

বিজয় বনহুরের কথা বিশ্বাস করে, ভাবে তাই হবে।

আজও বিজয়া বৃদ্ধার কথায় মনে মনে খুশী হয়, বলে বিজয়া–বুড়ীমা, চলো এবার ফিরে যাই।

চলো মা।

বুড়ীমা আর বিজয়া ফিরে আসে তাদের কুটিরে।

বিজয়া অবাক হয়–এখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে তিলক!

বুড়ীমা ডাকলো-বাছা, এবার উঠো; বেলা যে অনেক হয়ে গেছে।

গা মোড়া দিয়ে উঠে বসলো বনহুর।

হাই তুলে বললো-তাই তো, অনেক বেলা হয়ে গেছে দেখছি।

বুড়ী ওপাশ থেকে ফলমূলের ঝুড়ি নিয়ে ফল বাছতে বাছতে বললো–এবার মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নাও বাছা। মা-মনিও এতক্ষণ কিছু মুখে দেয়নি।

বনহুর বললো-বিজয়া, তুমি খাওনি কিছু?

বিজয়া বললো–তুমি ঘুমাবে আর আমি খাবো? তা হয় না তিলক।

কেন হয় না, আমি যদি সারা দিন ঘুমাতাম?

আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষা করতাম।

বৃদ্ধা এক ঝুড়ি ভাল ফল এনে বিজয়া আর বনহুরের সম্মুখে রেখে বেরিয়ে গেলো।

খেতে খেতে বললো বিজয়া-তিলক!

বলো?

এবার চলো আমরা ফিরে যাই।

বড় খারাপ লাগছে তোমার জানি। একটু থেমে বললো-আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো বিজয়া, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।

তিলক, তুমি যাকে খুঁজে ফিরছো তার সন্ধান আর করবে না?

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে বনহুর—জানি না বিজয়া, তাকে আর পাবো কি না!

কথার ফাঁকে বনহুর আনমনা হয়ে যায়।

বিজয়া বনহুরের ভাবাপন্ন ভাব লক্ষ্য করে বলে-তিলক, কি ভাবছো?

ভাবছি তাকে আর পাবো কি না!

বিজয়া বললো–পাবে! আমার মন বলছে পাবে কিন্তু……

বলো কিন্তু কি বিজয়া?

তিলক, যেদিন থেকে তুমি তোমার প্রিয়াকে পাবে সেদিন থেকে তুমি দূরে সরে যাবে। আমি হারিয়ে ফেলবো আমার জীবনসর্বস্ব……

বিজয়া, এসব কি বলছো তুমি?

তিলক, জীবন দিয়ে আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম, তোমাকে পাবো না জেনেও আমি তোমাকে ভালবেসেছি। চিরদিন ভালবাসবো।

বনহুর বিজয়ার হাতখানা মুঠার মধ্যে টেনে নেয়, বলে–বিজয়া, তুমি রাজার মেয়ে হয়েও তোমার মধ্যে নেই এতটুকু অহঙ্কার। তুমি মহৎ হৃদয়া নারী, সেই কারণে আমিও তোমায় ভালবাসি।

বিজয়া আত্নহারা হয়ে যায়, সে কোনোদিন তিলকের মুখে এ কথা শোনেনি। আজ সে মুগ্ধ অভিভূত হয়ে পড়ে, তিলকের বুকে মাথা রেখে বলে-তিলক!

বিজয়া, তুমি তো জানো আমার জীবন স্বাভাবিক নয়। তাই চাই না আমার জীবনের সঙ্গে তোমাদের সুন্দর ফুলের মত জীবনকে জড়িয়ে বিনষ্ট করি।

বিজয়া বনহুরের প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে কিছু ভাবে, তারপরে সোজা হয়ে বসে বলে তিলক, আমি জানি তোমার জীবনের মত সুন্দর জীবন আর নেই। তাই তুমি সবার কাছ থেকে দূরে থাকো। তিলক, তুমি তুলনাহীন……

বিজয়ার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কুটির মধ্যে প্রবেশ করে চম্পা। উচ্ছল ঝর্ণার মত এসে দাঁড়ায় সে বনহুর আর বিজয়ার সামনে। বলে উঠে চম্পা-পরদেশী বাবু, তুই ভাল আছিস তো?

বনহুর হেসে বলে-হ, ভাল আছি। তুমি ভাল আছো তো চম্পা?

হা বাবু।

এবার চম্পা বনহুরের হাত ধরে বলে-চল বাবু, বাইরে চল। শিকার করতে যাবি বাবু?

বিজয়া ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো, বনহুর কিছু বলার পূর্বেই বলে উঠে সেনা, ও যাবে না! তুমি চলে যাও চম্পা।

চম্পা বলে উঠে-বাবুকে তুই ধরে রাখতে পারবি না, বাবু যাবেই যাবে।

না, আমি ওকে যেতে দেবো না।

এমন সময় বুড়ীমা ভিতরে আসে, সে কিছুক্ষণ পূর্বে বাইরে কোনো কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলো। এসেই বলে বুড়ীমা–এসেছিস্ শয়তানী, আজ তোকে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেবো।

বুড়ী একটা লাঠি হাতে এগিয়ে আসতেই বনহুর বাম হাতে তার লাঠিসহ হাতখানা ধরে ফেলে, তারপর বলে-থাক, ওকে মেরো না বুড়ীমা! বৃদ্ধা খেঁকিয়ে উঠে—মারবো না, একশোবার মারবো। সারাটাদিন বেটি থাকে কোথায়? আমি বুড়ো মানুষ একা একা থাকি। কবে আমাকে বাঘ-ভালুক খেয়ে ফেলবে তখন শয়তানীকে দেখবে কে? আবোল-তাবোল বলে চলে বুড়ী।

বনহুর বলে—চলো বিজয়া, আমরা বাইরে যাই। ওরা মা-মেয়ে ঝগড়া করুক।

বিজয়া এবার খুশী হয়, বলে–তাই চলো।

বনহুর আর বিজয়া বেরিয়ে আসে বাইরে।

কুটিরমধ্যে তখন বৃদ্ধা ও তার কন্যা চম্পা মিলে ঝগড়া বেধে গেছে।

বনহুর আর বিজয়া এগিয়ে চলেছে, চারদিকে তাদের লক্ষ্য রয়েছে। আজ নতুন তারা বনভূমি দর্শন না করলেও এ বনভূমি তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। বিজয়া ভয় পাচ্ছিলো কখন কোন্ হিংস্র জন্তু এসে পড়বে।

বনহুরের মনে কিন্তু ভয়-ভীতি কিছু নেই, সে দীপ্তমুখে অগ্রসর হচ্ছে। বিজয়া তার পাশে পাশে। এমন গহন বন বিজয়া এর পূর্বে দেখেনি, কেমন যেন বিস্ময় লাগছে তার কাছে। আজ বিজয়ার পাশে বনহুর না থাকলে সে কিছুতেই এক পা এগুতে সাহসী হতো না।

বিজয়া এগুতে এগুতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠে, সে দেখতে পায় সামনে মস্তবড় একটা অজগর সাপ পড়ে আছে।

বনহুর সাপটাকে লক্ষ্য করে হেসে বলে–এই সাপটা দেখে এত ভয় পেয়েছে বিজয়া? দাঁড়াও আমি ওটাকে শেষ করে ফেলছি।

বিজয়া কিছু বলার পূর্বেই বনহুর একটা গাছের মোটা ডাল ভেংগে নিয়ে সাপটাকে হত্যা করে ফেলে।

বিজয়ার দু’চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠে, মস্তবড় সাপটাকে এত সহজে সে কি করে হত্যা করলো! শুধু আজ নয়, বিজয়া বনহুরের আরও বহুদিনের বহু কাজে বিস্মিত হতবাক হয়ে গেছে, আশ্চর্য হয়ে গেছে সে।

বিজয়া বনহুরকে যত দেখে তত অবাক হয়, ততই মুগ্ধ হয় সে। যেদিন বনহুর জংলীদের কবল থেকে বিজয়াকে উদ্ধার করে আনলো সেদিন বিজয় কি বলে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে ভেবে পায়নি। আজও বিজয়া ভাষা খুঁজে পায় না বনহুরকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে।

সাপটাকে হত্যা করে বনহুর ফিরে এলো বিজয়ার পাশে, হেসে বলে–খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, না?

বিজয়া ভুলে যায় সবকিছু, দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বনহুরের গলা–তিলক, তুমি বীর পুরুষ! অদ্ভুত মানুষ তুমি।

এমন সময় খিল খিল করে কে যেন হেসে উঠে তাদের পিছনে। চমকে ফিরে তাকায় বিজয়া আর বনহুর। দেখতে পায় তাদের পিছনে অদূরে দাঁড়িয়ে চম্পা। চম্পার হাসির শব্দই তারা শুনতে পেয়েছে।

বিজয়া চম্পাকে দেখামাত্র বনহুরের গলা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছিলো। বিজয়া চম্পাকে দেখে অবাক হয়ে গেছে, কারণ সে ভাবতে পারেনি চম্পা তাদের অনুসরণ করে এখানেও চলে এসেছে।

বনহুরও কিছুটা অবাক হয় কিন্তু সে কিছু না বলে বাম হাতের পিঠে কপাল থেকে ঘাম মুছে ফেলতে থাকে।

চম্পা ততক্ষণে বিজয়া আর বনহুরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, দু’চোখে বিস্ময় টেনে বলে– বাবু, তুই খুব হিম্মৎওয়ালা। এত বড় সাপটাকে মেরে ফেলেছি। সেদিন মস্তবড় ভল্লুকটাকে মেরে আমার মাকে বাঁচিয়ে ছি। তোকে আমি একটা ভাল জিনিস বখশিস দিবো।

বনহুর হেসে বললো–কই তোমার বখশিস? রোজ বলো কিন্তু দেবে কবে শুনি?

দেবো বাবু দেবো। আয়, তোদের একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই। চম্পা বনহুরের হাত ধরে ফেলে।

বিজয়া চম্পার এ ব্যবহারে ভিতরে ভিতরে ভীষণ রেগে যায়, বনহুরের দিকে তাকিয়ে বলে—-চলো ফিরে যাই।

বনহুর বলে উঠলো—চলো না দেখা যাক ও কোথায় নিয়ে যায়।

চম্পা বলে–হা বাবু চল।

বিজয়া বাধ্য হয় বনহুর আর চম্পাকে অনুসরণ করতে।

বিজয়া গম্ভীর মুখে অগ্রসর হচ্ছিলো।

চম্পা পথ চলছিলো আর মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলো। বড় চঞ্চল মেয়ে চম্পা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

হঠাৎ থেমে পড়ে চম্পা, সম্মুখে একটা ফলের গাছ দেখে এগিয়ে যায়। গাছটার উঁচু ডালে কতকগুলো ফল ঝুলছিলো। চম্পা লাফ দিয়ে ফল ছিঁড়তে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এবার চম্পা এগিয়ে আসে বনহুরের পাশে, আব্দারের সুরে বলে–বাবু, দু’টো ফল পেড়ে দে। দিবি বাবু?

বিজয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে–চলো তিলক, ও ফলে কাজ নেই, চলো……

চম্পা বলে আবার-বাবু, দুটো ফল পেড়ে দে বাবু।

বনহুর বিজয়াকে লক্ষ্য করে বললো–একটু অপেক্ষা করো বিজয়া, আমি ওকে দুটো ফল পেড়ে দিই। বিজয়া কিছু বলার পূর্বেই বনহুর গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালো। অল্প চেষ্টায় সে কয়েকটা ফল পেড়ে আনলো। চম্পার হাতে ফলগুলো দিয়ে বললো–এবার খাও।

চম্পা একটা ফল খেতে শুরু করে, আর একটা ফল বিজয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরলো—নে তুই খা।

বিজয়া মুখ ভার করেই ছিলো, বললো—আমি ও ফল খাই না।

বনহুর হাত বাড়িয়ে বললো–দাও, আমি খাবো।

চম্পা ফলটা বনহুরের হাতে দিলো।

বনহুর ফলটাতে কামড় দিয়ে বললো-বাঃ চমৎকার তো। বিজয়া একটা খেয়ে দেখো। বনহুর চম্পার হাত থেকে আর একটা ফল নিয়ে বিজয়ার মুখের কাছে ধরে বলে-নাও, খেয়ে দেখো বিজয়া।

আমি খাবো না।

তাহলে আমিও খাবো না। বনহুর নিজের অর্ধভক্ষণ করা ফলটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে যায়।

এবার বিজয়া বলে উঠে-দাও খাচ্ছি।

বনহুর ফলটা বিজয়ার হাতে দেয়।

আবার এগুতে থাকে ওরা।

চম্পা বনহুরের দক্ষিণ পাশে, বামপাশে এগুচ্ছে বিজয়া। বনপথে চলতে গিয়ে বিজয়ার বড় কষ্ট হচ্ছিলো।

বনহুর মাঝে মাঝে বিজয়ার হাত ধরে তাকে সহায়তা করছিলো।

ঘন বনের ফাঁকে কোথাও কোথাও সূর্যের আলো ছড়িয়ে আছে। তাই চারদিক তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো। আজ চম্পাকে বড় আনন্দমুখর লাগছিলো, সে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিলো। চম্পার পায়ের মলের ঝুমঝুম শব্দ আর শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজ মিলে এক মধুময় পরিবেশ সৃষ্টি করে চলছিলো।

আজ বনহুরকেও বড় আনন্দমুখর দেখাচ্ছে। তার মুখে নেই কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ।

শুধু বিজয়াকে গম্ভীর লাগছিলো।

এত পথ বিজয়া হাঁটেনি কোনোদিন, সে অত্যন্ত হাঁপিয়ে পড়েছিলো।

বনহুর বললো–চম্পা, তুমি আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছো বলো তো?

চম্পা হেসে বলে–বাবু, ভয় নেই; আমি তোদর কোনো খারাপ জায়গায় নিয়ে যাবো না।

বিজয়া বলে উঠে–আমি যাবো না, তুমি যাও তিলক।

বনহুর বললো–তা হয় না বিজয়া, তোমাকে এখানে একা রেখে আমি যেতে পারি না।

চম্পা বলে–আর বেশীদূর তোমাদের যেতে হবে না বাৰু। ঐ যে বনের মধ্যে একটা কুটির দেখতে পাচ্ছিস ওখানে যাবো।

বনহুর আর বিজয়া তাকিয়ে দেখলো সত্যিই বনের ফাঁকে দূরে অনেক দূরে একটা কুটির দেখা যাচ্ছে।

বনহুরের মনেই শুধু নয়, বিজয়ার মনেও বিস্ময় জাগে। চম্পা তাদের এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ও কুটিরখানাই বা কার?

একটা বিপুল আগ্রহ নিয়ে চলে বনহুর চম্পার সঙ্গে। ঐ কুটিরের মধ্যে কি বা কে আছে দেখতে চায় সে। বিজয়া বিরক্ত হলেও সে কোনো কথা না বলে বনহুরের সঙ্গে এগিয়ে চলে।

চম্পা বলে-বাবু, জঙ্গলে তোদর খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

না চম্পা, কোনো কষ্ট হচ্ছে না, তবে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। বিজয়াকে লক্ষ্য করে কথাটা বললো বনহুর।

এ-কথা সে-কথা বলতে বলতে তারা একসময় সেই কুটির খানার নিকটে এসে পড়লো।

চম্পা কুটিরের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো, বললো-বাবু, তোরা এখানে দাঁড়া, আমি এক্ষুণি আসছি।

চম্পা চলে গেল কুটিরের মধ্যে।

বিজয়া আর বনহুর দাঁড়িয়ে রইলো কুটিরটার সম্মুখে।

চম্পা কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে একটা ঘোমটা ঢাকা মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, ওর কানে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললো—সে এসেছে, কিন্তু সাবধান! এসো আমার সঙ্গে।

ঘোমটা ঢাকা মেয়েটি এগিয়ে বললো চম্পার পিছু পিছু, অতি সন্তর্পণে ধীর পদক্ষেপে চম্পার পাশে এসে দাঁড়ালো।

বনহুর আর বিজয়া অবাক হয়ে তাকালো চম্পার পাশে ঘোমটা ঢাকা মেয়েটির দিকে।

চম্পা বলে উঠলোবাবু, এই আমার সখী যার কাছে রোজ আমি আসি। এর নাম কি জানিস বাবু? আমি তোকে এর নাম বলছি–এর নাম হলো হীরা। বাবু, আমার সখী খুব ভাল। মেয়ে।

বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে মেয়েটির পা থেকে মাথা অবধি লক্ষ্য করে, তারপর হঠাৎ হেসে উঠে-হাঃ হাঃ হাঃ…….

চম্পা বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ভরা নয়নে। বনহুর যখন হাসছিলো তখন তার মধ্যে চম্পা নতুন একরূপ দেখতে পায়, অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো তখন তাকে।

চম্পার বান্ধবী ততক্ষণে ছুটে পালিয়ে গেছে সেখান থেকে।

বনহুর হাসি বন্ধ করে বলে উঠে—চম্পা, তোমার সখী বড় লজ্জা পেয়ে গেছে!

হাঁ বাবু, ও বড় লাজুক মেয়ে, ভাবলাম তোদের সাথে ওর মিলজিল করে দেবো কিন্তু…..

বনহুর হেসে বললো—থাক আর মিলজিলে কাজ নেই।

বিজয়া মুখ ভার করে বললো-এইজন্য এতটা পথ আমাদের কষ্ট করে নিয়ে এলে চম্পা, তোমার যদি একটু বুদ্ধিশুদ্ধি থাকতো……

বনহুর বলে-তাতে কি আছে, বনটাতো ঘুরে দেখা হলো।

বিজয়া রাগত কণ্ঠে বললো—তিলক, এতদিন বনে বনে কাটিয়ে তবু তোমার বন দেখার সখ মিটলো না। চলো এবার ফেরা যাক।

বিজয়ার কথায় বনহুর রাজী হলো, বললো—তাই চলো।

চম্পা পথ আগলে দাঁড়ালোবাৰু, তোরা এসে এমনি করে চলে গেলে আমার সখী খুব রাগ করবে। বাবু, তুই এখানে বস্। তারপর বিজয়াকে লক্ষ্য করে বললো–আয় বোন, তুই ভিতরে আয়।

বনহুর বসে পড়লো দাওয়ায় মাটির মধ্যে।

বিজয়া চম্পার সঙ্গে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

কুটিরে প্রবেশ করেই বিজয়ার দৃষ্টি পড়লো সেই মেয়েটির মুখে, একটু পূর্বে যে মুখ ঘোমটায় ঢাকা ছিলো সেই মুখ এখন উন্মুক্ত।

বিজয়া বিস্ময়ভরা নয়নে দেখলো অপূর্ব সুন্দর সে মুখ। স্তব্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো বিজয়া সেই মুখের দিকে।

চম্পা কিছু ফল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

সুন্দরী তরুণীটিও বিজয়ার দিতে তাকিয়ে আছে নির্বাক দৃষ্টি মেলে।

চম্পা বনহুরকে ফল খেতে দিয়ে বললো-তুই খা বাবু।

বনহুর খুশী হয়ে ফল খেতে শুরু করলো।

চম্পা চলে যাচ্ছিলো, বনহুর বললো-চম্পা শোনো।

চম্পা দাঁড়ালো।

বনহুর বললো—চম্পা, তোমার বান্ধবীকে আমার শুভেচ্ছা বলো।

আচ্ছা বাবুজী।

চম্পা চলে যায়।

কিছু পরে বিজয়া সহ চম্পা ফিরে আসে।

এবার বিজয়া আর বনহুর চম্পার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

চলতে চলতে বলে বনহুর-কুটিরের মধ্যে কি দেখলে বিজয়া?

বিজয়া বলে—অদ্ভুত এক নারীমুখ দেখলাম তিলক।

থমকে দাঁড়িয়ে পরে বলে বনহুর-অদ্ভুত এক নারীমুখ–তার মানে?

যে মুখ ঘোমটায় ঢাকা ছিলো আমি সেই মুখ দেখেছি তিলক। সত্যি বলছি, এমন সুন্দর মুখ আমি এর পূর্বে আর দেখিনি। অপূর্ব সুন্দরী…

চম্পার বান্ধবী?

কিন্তু আশ্চর্য, চম্পা যেমন চঞ্চল উচ্ছল, ওর বান্ধবী ঠিক তার উল্টো।

তুমি সত্যি কথা বলছো তিলক। মেয়েটি সুন্দরী বটে কিন্তু বোবা।

বোবা?

হা, কারণ সে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি।

ও সেই কারণেই বুঝি আমাদের সামনে অমন করে মুখে ঘোমটা টেনেছিলো।

বিজয়া আর বনহুর কথাবার্তা বলতে বলতে এগিয়ে চললো।

নূরী, সত্যি তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার অসীম ধৈর্যবল দেখে। প্রিয়কে সম্মুখে পেয়েও তুমি নিজকে সংযত রাখতে সক্ষম হয়েছে। কথাগুলো বলে থামলো চম্পা।

নূরীর মুখেচোখে উচ্ছল আনন্দ, আজ সে তার জীবনসর্বস্ব প্রিয় হুরের সাক্ষাত লাভ করেছে। কথা দিয়েছিলো চম্পার কাছে, সে বনহুরের সম্মুখে যাবে অথচ তার সামনে সে নিজকে কঠিনভাবে সংযত রাখবে। সে পরীক্ষায় জয়ী হয়েছে কিন্তু একটা ব্যথা দূরীর মনে দারুণ কষ্ট দিচ্ছে তা হলো বনহুরের সঙ্গের মেয়েটা। কে সে মেয়েটি? বনহুরের সঙ্গে কি তার সম্বন্ধ? এত আনন্দের মধ্যেও নূরীর হৃদয়ে কাঁটার মত খচ খচ করছিলো, সে যেন শান্তি পাচ্ছিলো না মনে।

নূরীর মনের কথা বুঝতে পারে চম্পা। মৃদু মৃদু হাসে সে।

বজরাখানা তখন ঢেউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।

চম্পা নূরীর চিবুকে একটুখানি নাড়া দিয়ে বলে–নূরী, তুই কিছু ভাবিসূনে, তোর স্বামীর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তার মত পুরুষ আর হয় না। যে মেয়েটিকে ওর সঙ্গে দেখলি সে এক রাজার মেয়ে। ভালবেসেছিলো ওকে কিন্তু পারেনি ওকে জয় করতে। নূরী, তোর মত ভাগ্যবতী মেয়ে……

হঠাৎ চম্পা চমকে উঠে কখন যে সেই মাঝি এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে তারা কেউ টের পায়নি। চম্পা মাঝখানে কথা বন্ধ করে ফেলায় নূরীও ফিরে তাকায়, মাঝিটিকে লক্ষ্য করে সেও বিস্মিত হয়। আরও অনেক দিন সে লক্ষ্য করেছে এই মাঝিটি প্রায়ই তাদের কথাবার্তা চলার সময় আশেপাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কেমন যেন সন্দেহ জাগে নূরীর মনে।

চম্পা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–হরিনাথ, তোমাকে বার বার বলেছি এখানে আসবে না।

হরিনাথ হাত কচলায়–রাণীজী এবারের মত মাফ করে দেন, আর আমি আসবো না।

চম্পা রাগত কণ্ঠে বলে উঠলো-মাফএবার মাফ করবো না। হাতে তালি দিলো চম্পা, সঙ্গে সঙ্গে তিনজন বলিষ্ঠ লোক এসে দাঁড়ালো।

চম্পা আদেশ দিলো–একে নিয়ে যাও-বন্দী করে রাখো, পরে বিচার করবো।

সঙ্গে সঙ্গে বলিষ্ঠ লোকগুলো মাঝি হরিনাথকে ধরে ফেললো।

চম্পা বললো–নিয়ে যাও।

হরিনাথ মাঝিকে নিয়ে চলে গেলো ওরা।

চম্পা আর নূরী আবার গল্প শুরু করলো।

লোক তিনজন হরিনাথকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো, যেমনি তাকে বজরার পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অমনি হরিনাথ প্রচণ্ড এক ঝাঁকি দিয়ে নিজকে ছাড়িয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে বজরার বিপদ সংকেত শব্দ ধ্বনি হতে শুরু হলো।

চম্পা ছুটে গেলো সেই দিকে যেদিক থেকে সংকেত ধ্বনি আসছিলো।

নুরীও চম্পার পিছনে এগিয়ে চললো।

সেই বলিষ্ঠ লোক তিনটির নিকট পৌঁছে চম্পা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। চম্পা কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলো–কি করে পালালো?

বলিষ্ঠ লোকগুলোর একজন রাণীজী, হরিনাথ আমাদের কাবু করে পালিয়েছে। ঐ যে নদীর মধ্যে সাঁতার কেটে যাচ্ছে।

নূরী বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–এমন বলিষ্ঠ জোয়ান তিনজন লোককে কাবু করে পালাতে পারলো আশ্চর্য বটে।

ততক্ষণে একজন লোক তীর ধনু উঁচু করে ধরলো-রাণীজী বলো খতম করে দেই?

চম্পা বাধা দিয়ে বললো–থামো।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তীর-ধনু নীচু করে নিলো কিন্তু মুখখানা তার গম্ভীর হয়ে পড়লো। চম্পা হঠাৎ তার কাজে বাধা দিলো কেন ভেবে পেলো না।

নূরীও অবাক হলো।

চম্পার গোটা মুখে একটা গভীর চিন্তার ছাপ ছড়িয়ে পড়েছে। কুঞ্চিত করে কিছু ভাবতে লাগলো সে।

নূরী চম্পার পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো চম্পার মুখোভাব। নূরীর মনে চম্পাকে নিয়ে বড় সন্দেহ, ওকে যত সে দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। চম্পা ভীল যুবতী, তাকে দেখলে ভীল যুবতীই বলে মনে হয় কিন্তু তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার অতি বিস্ময়কর। নূরী যতক্ষণ চম্পার পাশে থাকে ততক্ষণ তাকে দেখে আর ভাবে কত কথা।

বজরা ফেরাবার আদেশ দেয় চম্পা।

এবার চম্পা আর নূরী বজরার ছাদে এসে বসে।

চম্পাকে ভাবাপন্ন দেখে বলে নূরী–চম্পাদি, হঠাৎ কি হলো তোমার বলো তো?

কিছু না।

হঠাৎ তোমাকে বড় গম্ভীর লাগছে কেন চম্পাদি?

জানি না বোন, কি যেন হলো।

সত্যি তুমি আশ্চর্য মেয়ে!

হাঁ, সে কথা সত্যি।

তুমি সাধারণ মেয়ে ও তাও সত্য।

নূরী!

হাঁ চম্পাদি। দেখো আমার কাছে তুমি নিজের পরিচয় যতই গোপন রাখো, আমি জানি তুমি ভীলকন্যা নও। আজ তোমাকে বলতে হবে কি তোমার পরিচয়, কে তুমি…

আজ নয় বোন, একদিন তোর কাছে আমার পরিচয় স্বচ্ছ হয়ে যাবে।

নূরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে–সেদিন যে গল্প বললে কই তা তো শেষ করলে না চম্পাদি।

শেষ……..।

হাঁ, শেষ আমি শুনতে চাই।

যেদিন আমার পরিচয় পাবে সেদিন আমার গল্পের শেষও জানতে পারবে।

আর কতদিন প্রতীক্ষা করতে হবে চম্পাদি?

বেশি দিন নয়।

চম্পাসহ নূরী ফিরে আসে তাদের নদীপারের বাড়িখানায়।

যে যার কক্ষে শয়ন করতে চলে যায়।

চম্পা নিজের ঘরে প্রবেশ করে হঠাৎ হেসে উঠে খিলখিল করে। অদ্ভুত সে হাসির শব্দ। পাশের পক্ষে নূরীর কানে গিয়ে পৌঁছায়। নূরী শয্যায় শুয়ে ভাবতে থাকে অবাক হয়ে।

কখন যে নূরী ঘুমিয়ে পড়ে খেলায় নেই।

হঠাৎ কারো নিশ্বাসের শব্দে ঘুম ভেংগে যায় নূরীর। চোখ মেলে তাকায়, কক্ষ অন্ধকার। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে নূরী এ নিশ্বাসের শব্দ কার। কোনো পুরুষের নিশ্বাসের শব্দ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিউরে উঠে নূরী, তবে কি কেউ তার ঘরে প্রবেশ করেছে?

বুকটা টিপ টিপ করছে নূরীর। নিশ্বাসের শব্দ অতি নিকটে, ঠিক তার বিছানার পাশে মনে হচ্ছে।

স্তব্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে নূরী একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্য। এবার নিশ্বাসের শব্দ ঠিক তার বিছানায় ঝুঁকে এলো। সে কি জেগে না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ঠিক বুঝতে পারছে না। হাত পা যেন কেমন অবশ মনে হচ্ছে। চোখ দুটো ভয়ে বন্ধ হয়ে আসছে আপনা আপনি।

এমন সময় কেউ যেন তার কানের কাছে ঝুঁকে এলো বলে মনে হলো নূরীর।

ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে দরজা খোলার শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে তার কক্ষমধ্য হতে কেউ দ্রুত উন্মুক্ত জানালাপথে বেরিয়ে গেলো বুঝতে পারলো নূরী।

চম্পা প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

নূরীর এতক্ষণে সাহস হলো, সে শয্যা ত্যাগ করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো চম্পাকে– চম্পাদি……

চম্পা নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো–কি হয়েছে নূরী, বলো?

কে যেন আমার ঘরে প্রবেশ করেছিলো।

হাঁ, আমারও সেইরকম সন্দেহ হয়েছিলো।

চম্পাদি, আমাকে তুমি একা এ ঘরে রেখো না। কোনো শয়তান লোক আমার ঘরে প্রবেশ করেছিলো। ভাগ্যিস, তুমি এসেছিলো তাই রক্ষা…

চম্পা নূরীর ভয়াতুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, বলে–এই সাহস নিয়ে তুমি দস্যু বনহুরের জীবন-সঙ্গিনী হয়েছে? বেশ, আজ থেকে তুমি আমার ঘরে আমার কাছে শোবে।

চম্পাকে আজ আরও গম্ভীর ভাবাপন্ন বলে মনে হচ্ছে।

নূরী ভেবে পায় না চম্পার কি হয়েছে?

নূরী একসময় বলে বসে–চম্পাদি, বলতে পারো কাল রাতে কে আমার ঘরে এসেছিলো?

চম্পার মুখখানা কেমন যেন ভাবপূর্ণ হয়ে উঠলো, একটু হেসে বললো–পারি।

তবে কেন তাকে এতক্ষণ পাকড়াও করে এনে শাস্তি দিচ্ছো না?

তাকে পাকড়াও করবো বলেই তো আমার এত প্রচেষ্টা কিন্তু পারছি কই! একটু থেমে বললো চম্পা—ঐ হরিনাথ মাঝি তোমার ঘরে প্রবেশ করেছিলো।

যে কাল মাঝনদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়েছিলো।

হা। বললো চম্পা।

মুহূর্তে নূরীর মুখ কালো হয়ে উঠলো, একটা ভীতি ভাব ছড়িয়ে পড়লো তার সারা অন্তরে। নূরীর মনে পড়লো আরো অনেক দিনের কথা। লোকটা প্রায়ই তার দিকে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করেছে। যখনই একা তাকে দেখেছে তখনই একটা ভয়াতুর ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে তাড়াতাড়ি সরে পড়েছে সেখান থেকে। লোকটাকে প্রথম থেকেই নূরীর সন্দেহ হয়েছে।

নূরী বলে উঠলো—চম্পাদি, তুমি ওকে মারতে দিলে না কেন? লোকটাকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করাই উচিত ছিলো।

চম্পা শুধু হাসলো।

খেজুর পাতার চাটাই-এর উপরে শুয়ে শুয়ে ভাবছে বনহুর সেই নারীর কথা, যে নারীর কাছে সে সর্বতোভাবে ঋণী। তাকে বহুবার এই নারী শত্রুর কবল থেকে কৌশলে উদ্ধার করে নিয়েছে। বহুবার বহু বিপদ থেকে তাকে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু কে সে? আজও সেই নারী তার কাছে নিজকে গোপন রেখেছে। কিন্তু কেন? কেন সে তার কাছে এমনভাবে আত্নগোপন করে থাকে– আর কেনই বা তাকে নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, কি লাভ তার এতে!

শুধু আজ নয়, অবসর মুহূর্তে প্রায়ই তার মনে সেই অজানা নারীমূর্তির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। অনেক চেষ্টা করেও সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না সেই ছবি।

চির উচ্ছৃঙ্খল বনহুর তখন কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ে। গভীরভাবে তলিয়ে ভাবতে চায় মেয়েটির কথা। কিন্তু বেশিক্ষণ কিছু ভাবার সময় থাকে না বনহুরের। নানা চিন্তা উঁকি দেয় তার মনে।

আজও বনহুর তাই শুয়ে ভাবছিলো সেই নারীটির কথা, কে এই নারী যার নাম আশা। যে আশা তাকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করে চলেছে……

বনহুরের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, চম্পা কখন তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে; ডাক দেয় সে–বাবু?

বনহুর চোখ তুলে তাকায়, বিস্মিত দৃষ্টিতে চম্পার মুখে তাকিয়ে বলে–চম্পা!

হ বাবু।

বসো।

চম্পা আজ বিনা দ্বিধায় বসে পড়ে বনহুরের পাশে। বলে চম্পা-বাবু, ও কোথা গেছে?

কার কথা বলছে, বিজয়ার কথা?

হা।

বুড়ীমার সঙ্গে বাইরে গেছে।

তুই একা একা শুয়ে আছিস বাবু?

একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে বলে বনহুর-হাঁ, বড় একা। তুমি এসেছো ভালই হলো, একটা গল্প বলো চম্পা?

গল্প?

হা।

আমি কি গল্প জানি বাবু?

তবু, যা জানো বলো।

বাবু, তোর বৌ বড় রাগী মেয়ে?

কে আমার বৌ চম্পা?

ঐ যে বিজয়া?

না, ও আমার বৌ নয়।

তাহলে তোর সাথে থাকে কেন?

চম্পার এ প্রশ্নের জবাব চট করে দিতে পারে না বনহুর, একটু হেসে বলে–একদিন ওকেই একথা জিজ্ঞেস করো চম্পা।

চম্পা বলে উঠে–আমি বাৰু সব জানি। ও তোকে বহুৎ পিয়ার করে। আচ্ছা বাবু, তুই ওকে পিয়ার করিস না?

এবার বনহুর হেসে উঠে–হাঃ হাঃ হাঃ, তারপর হাসি থামিয়ে বলে–পিয়ার! চম্পা, আমি কাউকে পিয়ার করি না।

কেন বাবু? তুই এত নিষ্ঠুর কেন?

হাঁ চম্পা, আমি বড় নিষ্ঠুর।

চম্পার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, অতি সন্তর্পণে চেপে গেলো চম্পা নিশ্বাসটাকে।

বনহুর বললো–চম্পা, এবার আমার বিদায় নেবার সময় এসেছে, তুমি যে বলেছিলে কি একটা জিনিস আমাকে পুরস্কার দেবে, কই দিলে না তো?

বাবু, ঠিক তোকে একটা জিনিস দেবো কিন্তু আমাকে তুই কিছু দিবি না বাবু?

বনহুর এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলো, চম্পার কথায় সে শয্যা ত্যাগ করে উঠে বসে, স্থির নয়নে তাকায় ওর মুখের দিকে।

বনহুরের তীক্ষ্ণ সুন্দর দুটি চোখের কাছে চম্পার চোখ দুটো নত হয়ে আসে।

বনহুর চম্পার মুখখানা আজ নিজের হাতে তুলে ধরে, কিছুক্ষণ নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে দেখে সে চম্পার মুখ, তারপর বনহুর অট্টহাসিতে ভেংগে পড়ে-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ……

বনহুরের হাসির শব্দে বনভূমি যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠে। হাসি থামিয়ে কুঞ্চিত করে বলে–চম্পা, কি চাও তুমি আমার কাছে?

যা চাই দিবি বাবু?

বলো?

তোর বুকে একটু মাথা রাখতে চাই…..

চম্পা!

হাঁ বাবু, কতদিন থেকে আমার এ আশা……চম্পার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।

বনহুর নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর কিছু বলতে চায়।

চম্পা তার পূর্বেই নত হয়ে মাথাটা বনহুরের বুকের মধ্যে খুঁজে দেয়, আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলে–বাবু!

বনহুর চম্পার মাথায় হাত রাখে, এমন সময় বাইরে বুড়ীমা আর বিজয়ার কণ্ঠস্বর শোনা

চম্পা এবার ছুটে বেরিয়ে যায় কুটিরের মধ্য হতে।

বনহুর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে চম্পার চলে যাওয়া পথের দিকে।

বুড়ীমা বিজয়াকে কুটিরে পৌঁছে দিয়ে তার কাজে চলে যায়।

বিজয়া চম্পাকে বেরিয়ে যেতে দেখে গম্ভীর হয়ে পড়ে।

কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে রাগত দৃষ্টি মেলে তাকায় বনহুরের দিকে।

বনহুর নিজকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে ততক্ষণে।

বিজয়ার মুখোভাব লক্ষ্য করে মৃদু হাসে বনহুর। সে কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ শুয়ে থাকে। দেখতে চায় বিজয়া কিছু বলে কিনা, কারণ বিজয়া চম্পাকে কুটির হতে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলো এবং সেই কারণেই মুখখানাকে গম্ভীর করে ফেলেছিলো। চম্পার আচরণে মোটেই খুশী ছিলো না বিজয়া।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।

বিজয়া পারে না বেশিক্ষণ নিশ্চুপ থাকতে, এক সময় এসে বসে বনহুরের পাশে।

বনহুর বলে কিছু বলবে বিজয়া?

চম্পা কেন এসেছিলো?

বনহুর অবাক কণ্ঠে বললো–ওরই ঘরে ও কেন এসেছিলো, এ প্রশ্ন করা তোমার উচিত হয় না বিজয়া। কারণ এ ঘর ওদের……

বিজয়া এ কথার পরে কোনো কথা বলতে পারে না।

বনহুর একটু থেমে আপন মনেই বলে উঠলো নারীজাতি বড়ই রহস্যময়ী……তাদের বুঝা বড় মুস্কিল।

বিজয় চোখ তোলে।

বনহুর হেসে বলে–বলো বিজয়া সত্যি কিনা?

এবার বিজয়া না হেসে পারে না।

বনহুর বিজয়ার হাতখানা তুলে নেয় হাতের মুঠায়, তারপর বলে–আমার জন্য তুমি অনেক। কষ্ট করলে বিজয়া, তোমাকে আমি পারলাম না কিছু দিতে। বিজয়া?

বলো তিলক?

আজ তুমি আমার পাশে থেকে আমাকে অনেক সহায়তা করেছো, অনেক সাহস দিয়েছো কিন্তু আমি বড় নিষ্ঠুর, কোনোদিন বুঝলাম না বা বুঝতে চেষ্টা করলাম না তোমার মনের কথা।

বিজয়ার মুখখানা ম্লান হয়ে আসে, সে জানে তিলক সাধারণ মানুষ নয়, তাকে জীবনে পাবার আশাও নেই কারণ সে বলেছে সে বিবাহিত–তার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। তবু বিজয়া ভালবেসেছিলো ওকে, যার জন্য সে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে চলে এসেছিলো তিলকের সঙ্গে কিন্তু বিজয়া ওকে কোনোদিন ঘনিষ্ঠভাবে পায়নি কাছে। যখনই সে তিলকের কাছে নিবিড় হয়ে এসেছে। তখনই তার মধ্যে একটা অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ্য করেছে। আজ তিলকের হাতের মুঠায় বিজয়ার হাতখানা শিথিল হয়ে আসে, হৃদয়ে একটা অভূতপূর্ব অনুভূতি নাড়া দিয়ে যায়। বিজয়া নিজকে সামলে নেয়, কারণ নিজের দুর্বলতা তিলকের কাছে ধরা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি সরে যায় সে ওর কাছ থেকে।

বনহুর আপন মনেই হেসে উঠে, কারণ সে বুঝতে পেরেছে বিজয়া ভয় পেয়ে গেছে হঠাৎ যদি তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। মেয়েরা যতই সহজ হোক পুরুষদের দুর্বলতা লক্ষ্য করলে তারা তখন সজাগ হয়ে উঠে, একটা কঠিন মনোবল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তাদের মধ্যে। কোন নারীই চায় না নিজের নারীকে বিসর্জন দিতে। বিজয়ার আচরণে বনহুর খুশী হয়।

এই ঘটনার পর বিজয়া প্রায়ই বনহুরকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। পূর্বের মত সে আর সহজভাবে আসে না তার কাছে।

পর পর কয়েকদিন নূরী চম্পার কক্ষে ঘুমিয়েছে। গভীর রাতে কার নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পেয়েছিলো, তারপর থেকে সে একা ঘুমাতে সাহসী হয়নি।

চম্পাও ওকে একা থাকতে দেয়নি পাশের ঘরে। তা ছাড়া রাতে একটি দিনও চম্পা নূরীকে ছেড়ে যায়নি কোথাও। সব সময় চম্পা নূরীর পাশে পাশে থাকে, বিশেষ করে রাতের বেলায়।

অন্যান্য দিনের মত আজও চম্পা আর নুরী এক শয্যায় পাশাপাশি শুয়েছিলো।

গভীর রাত।

হঠাৎ ঘুম ভেংগে যায় নূরীর, চমকে উঠে সে–কই, পাশে তো চম্পা নেই। ভাল করে হাতড়ে দেখে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে নূরী, একটা ভীত ভাব তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কক্ষটা জমাট অন্ধকারে ঢাকা, কিছুই নজরে পড়ছে না।

একদণ্ড দু’দণ্ড করে কয়েক দণ্ড কেটে যায়।

ঘুম আর আসছে না নূরীর চোখে, চম্পা তাকে এমন করে রেখে কোথায় চলে গেছে কে জানে! নূরী গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।

হঠাৎ একটা শব্দ হলো, কেউ যেন প্রবেশ করলো তার কক্ষমধ্যে। পদশব্দ বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, তার বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে কেউ অতি সন্তর্পণে।

স্তব্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে নূরী কোনো এক ভীষণ মুহর্তের।

পদশব্দ ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে।

নূরী কোনো দিন এত ভীত ছিলো না, আজ তার সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। তাকে এখন একা ফেলে মোটেই চম্পার চলে যাওয়া উচিত ছিলো না, ভাবছে নূরী। সেই নিশ্বাসের শব্দ, কাছে আরও কাছে সরে আসছে ক্রমান্বয়ে।

নূরী চিৎকার করবে কিনা ভাবছে ঠিক সেই দণ্ডে বাইরে কারো পদশব্দ হলো।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষমধ্য হতে কেউ যেন দ্রুত বেরিয়ে গেলো পাশের দরজা দিয়ে।

নূরী দেখলো, দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলো চম্পা। তার পিছনে একজন বৃদ্ধা। বৃদ্ধার হাতে লণ্ঠন থাকায় নূরী সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

চম্পা কক্ষে প্রবেশ করতেই নূরী শয্যায় উঠে বসলো, তারপর কাঁদো কাদো কন্ঠে বললো– চম্পাদি, তুমি আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে? আজ আবার সেই শব্দ……সেই নিশ্বাসের শব্দ…উঃ কি সর্বনাশ, ভাগ্যিস, তুমি এসে পরেছিলে তাই রক্ষা।

চম্পা হাত তালি দিলো।

তৎক্ষণাৎ কক্ষে প্রবেশ করলো একটি লোক।

চম্পা বললো–তোমাকে না পাহারায় রেখে গিয়েছিলাম, কে এসেছিলো এ কক্ষে?

লোকটা হাত কচলে বললো–বড় শীত, তাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম।

নূরী তাকিয়ে দেখলো লোকটা একটি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঠকঠক্ করে কাঁদছে।

চম্পা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো-এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।

মাথা নীচু করে রইলো লোকটা।

চম্পা ধমক দিলো–বেরিয়ে যাও।

লোকটা দ্রুত চলে গেলো।

নূরীর কেমন যেন সন্দেহ হলো লোকটাকে, কিন্তু সে কোনো কথা বললো না।

চম্পা বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বললো-প্রথমেই বলেছিলাম, আমি গেলেই এমনি একটা বিভ্রাট ঘটবে! যাও তুমি এবার।

বৃদ্ধা চলে গেলো।

চম্পা নূরীর পাশে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো–আমি জানতাম এমনি একটা কিছু হবে তবু না গিয়ে পারিনি, কারণ আমার মা হঠাৎ এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো। তা ভয় নেই, আর কেউ আসতে পারবে না। চলো নূরী, এবার আমরা ঘুমাই।

নূরী নীরবে শয্যা গ্রহণ করলো কিন্তু তার কানে তখনও সেই নিশ্বাসের শব্দ বাজছিলো।

সমস্ত রাত আর ঘুম এলো না নূরীর চোখে, কে সেই লোক যে একদিন নয়, পর পর দুদিন তার কক্ষে প্রবেশ করেছিলো। কি উদ্দেশ্য ছিলো তার, নিশ্চয়ই সৎ মতলব নিয়ে কেউ তার কক্ষে প্রবেশ করেনি।

নূরীর আর ভাল লাগে না, মনটা তার বিদ্রোহী হয়ে উঠে। চম্পার কি উদ্দেশ্য, তার হুরকে সে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করে এনেছে কিন্তু কেন তার কাছ থেকে ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, কিছুই বুঝতে পারে না নূরী।

যত ভাবে সে ততই সব যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে আসে।

এরপর আরও কয়েকদিন কেটে যায়।

বনহুরের জন্য অস্থির হয়ে উঠে নূরীর মন।

চম্পা বুঝতে পারে, সে সব সময় নূরীকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। কোনোদিন ওকে সঙ্গে করে শিকারে যায়, কোনোদিন বজরায় নদীবক্ষে ভেসে চলে, প্রাকৃতির দৃশ্য উপলব্ধি করে ওরা অন্তর দিয়ে।

সেদিন নূরী ঘুমের ভাণ করে শুয়ে ছিলো।

রাত গভীর।

চম্পা মনে করে নূরী ঘুমিয়ে পড়েছে।

দরজার বাইরে একটা শব্দ হলো।

চম্পা শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো।

নূরী রুদ্ধ নিশ্বাসে লক্ষ্য করছে কি করে চম্পা বা কোথায় যায় সে।

চম্পা শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো, তারপর এগিয়ে চললো দরজার দিকে। দরজার পাশে এগুতেই দরজা আপনা আপনি খুলে গেলো।

চম্পা বেরিয়ে গেলো বাইরে।

নূরীও চম্পাকে অনুসরণ করলো অতি সন্তর্পণে। অন্ধকারে আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো সে।

চম্পা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই দু’জন বলিষ্ঠ লোক সসম্মানে তাকে অভিবাদন জানালো। আজও সেই বৃদ্ধাকে দেখতে পেলো নূরী। বৃদ্ধা চম্পার পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে।

নূরীও অতি সতর্কতার সঙ্গে চম্পাকে অনুসরণ করে চলেছে।

চম্পা কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটা বড় গাছের নিকটে এসে দাঁড়ালো।

অনুচরদ্বয় গাছের গুঁড়ির পাশে একটা জায়গায় মাটিতে আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো, গাছের দেহটা ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেলো। ঠিক একটি সুড়ঙ্গপথ বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।

এবার চম্পা সেই সুড়ঙ্গপথে ভিতরে প্রবেশ করলো। তার অনুচরদ্বয়ও চম্পাকে অনুসরণ করলো। বৃদ্ধাও প্রবেশ করলো সর্বশেষে।

ওরা চলে গেলো কিন্তু সুড়ঙ্গপথ ঠিক পূর্বের মত উন্মুক্ত রইলো।

নূরী এগুবে সেই মুহূর্তে একটি ছায়ামূর্তি সকলের অগোচরে সুড়ঙ্গমধ্যে ঢুকে পড়লো।

বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নূরী। অন্ধকার হলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, চম্পাকে সেই শুধু অনুসরণ করেনি আরও কেউ তাকে লক্ষ্য করছে এবং সে চম্পা ও তার অনুচরদের অনুসরণ করে সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করেছে। নূরীর মন থেকে সব ভয়-ভীতি উবে যায়, সেও দ্রুত সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করে।

সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করে অবাক হয় নূরী, কারণ কোন্ দিকে কোথায় বা পথ সে বুঝতে পারে না। কোন্ দিকেই বা গেলো তারা। তবু সে হাতড়ে হাতড়ে এগুতে লাগলো।

বেশ কিছুক্ষণ এগুনোর পর হঠাৎ একটু আলোর রশ্নি দেখতে পেলো। এবার নূরী সেই আলোকরশ্নি লক্ষ্য করে এগুতে লাগলো।

নূরীর বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করছে। না জানি আজ সে কি দেখতে পাবে।

কিছুটা এগুনোর পর হঠাৎ নূরী থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, সম্মুখে বিরাট একটা প্রশস্ত জায়গায় একটি স্বর্ণ আসনে জমকালো ড্রেস পরিহিত অবস্থায় বসে আছে চম্পা। নূরী বিস্ময়ভরা নয়নে দেখলো এখনকার চম্পা আর সে চম্পায় যেন অনেক পার্থক্য।

চম্পা স্বর্ণ আসনে উপবেশন করেছে। তার সম্মুখে অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরা প্রায় পঞ্চাশ জন লোক অস্ত্রশস্ত্র হস্তে দণ্ডায়মান রয়েছে। চম্পার দু’পাশে দু’জন অদ্ভুত পোশাক পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতেও মারাত্নক অস্ত্র।

আজ নূরী চম্পার চোখেমুখে এক কঠিন ভাব লক্ষ্য করে। মশালের উজ্জ্বল আলোতে তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে। নূরী অবাক হয়ে দেখতে থাকে।

যে জায়গায় নূরী দাঁড়িয়ে ছিলো সে জায়গাটা গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সুড়ঙ্গপথের একটা বাকের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো সে।

নূরীর অদূরে আর একটা টিপির আড়ালে আরো একজন আত্নগোপন করে দাঁড়িয়ে দেখছিলো চম্পার কার্যকলাপ। নূরী তাকে দেখতে পায়নি, সেও দেখতে পায়নি নূরীকে।

নূরী চম্পার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। চম্পা যে একজন অসাধারণ নারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে সে? ভীল যুবতী চম্পাই কি তার আসল রূপ?

চম্পা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো-মাহমুদ আলী।

সঙ্গে সঙ্গে একজন সরে এলো দলের মধ্য হতে, চম্পার সম্মুখে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালো, তারপর লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

চম্পা বললো-কি সংবাদ মাহমুদ আলী?

নীল নদের প্রবেশপথে অসংখ্য পুলিশ পাহারারত রয়েছে। যে কোনো জাহাজ ঐ পথে অগ্রসর হলে সে জাহাজকে আটক করা হচ্ছে এবং কান্দাই-এর পুলিশ সুপার মিঃ জাফরী নিজে খানা-তল্লাশী চালাচ্ছে।

চম্পা এবার হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে দাঁতে দাঁত বিষে বললো–আমি জানি, পুলিশ সুপার মিঃ জাফরী নীল নদের প্রবেশপথে কড়া পাহারা নিযুক্ত করেছে, বনহুরকে গ্রেপ্তার করে দু’লাখ টাকা পুরস্কার নেবে আর তার সঙ্গে সুনাম। কিন্তু আমি সব জানতে পেরে মিঃ জাফরীর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছি। মাহমুদ আলী, তোমরা কোন পথে এখানে পৌঁছলে?

রাণীজী, আমরা নীলনদের পথে না এসে জঙ্গীনদের মধ্য দিয়ে এসেছি, সেই কারণে এত বিলম্ব হয়েছে।

হীরালাল ও তার দলবলকে দেখছি না কেন?

এবার মাহমুদ আলী তার বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তারপর বলে হীরালাল তার দলবলসহ নীল নদের প্রবেশপথে কান্দাই পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে

চম্পা গর্জন করে উঠে–কি বললে মাহমুদ আলী, হীরালালকে কান্দাই পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার করেছে?

হাঁ রাণীজী।

আমি এরকমই অনুমান করেছিলাম। হীরালালের দলে কতজন ছিলো?

পঞ্চাশ জন আমার সঙ্গে, পঞ্চাশ জন হীরালালের সঙ্গে তার জাহাজে ছিলো।

সে কি করে ধরা পড়লো মাহমুদ আলী?

আপনার আদেশ অনুযায়ী আমরা নীল নদের প্রবেশপথের সীমানা ছাড়িয়ে নদের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম কিন্তু কান্দাই পুলিশ জাহাজ সমস্ত নীল নদে ছড়িয়ে ছিলো, তারা কৌশলে হীরালালের জাহাজখানাকে আটক করে ফেলে।

আর তুমি কি করে রেহাই পেলে?

আমার জাহাজ হীরালালের জাহাজের অনেক পিছনে ছিলো তাই আমি রক্ষা পেয়েছি। হীরালালের জাহাজখানাকে যখন পুলিশ জাহাজ আটক করে তখন আমরা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে পাই এবং সাবধান হই। সঙ্গে সঙ্গে আমার জাহাজখানাকে পিছু হটে যাবার নির্দেশ নেই। তারপর জঙ্গীনদ হয়ে তবে এখানে পৌঁছতে সক্ষম হই।

আর একটা বিপদ মাথায় বয়ে নিয়েই এসেছো, হীরালাল তাহলে পুলিশ সুপার মিঃ জাফরীর হাতে বন্দী হয়েছে।

হাঁ রাণীজী।

যাক, সে চিন্তা আমি পরে করবো। এখন যে কারণে আমি তোমাদের ডেকেছি শোন।

বলুন রাণীজী?

তোমরা জানো, দস্যু বনহুর এখন আমাদের এই সূরজ দ্বীপে রয়েছে। শুধু সেই নয়, তার সঙ্গিনী নূরীও রয়েছে আমার কাছে। আমি চাই না এদের কোনো অমঙ্গল হয় এবং সেই কারণেই আমি তোমাদের ডেকেছি।

আদেশ করুণ রাণীজী?

হীরালাল বন্দী, কাজেই তোমাকেই সব কাজ করতে হবে। বনহুর ও নূরীসহ কান্দাই-এর পথে রওনা দেওয়া দরকার কিন্তু তার পূর্বে নীলদ্বীপে যেতে হবে তোমাদের, কারণ নীলদ্বীপের রাকজনা বিজয়াও আছে এখানে।

আপনার কথামত কাজ করবো কিন্তু কিভাবে আমরা রওয়ানা দেবো জানতে চাই রাণীজী।

সে কথা পরে বলবো। আজ তোমরা যাও বিশ্রাম করোগে।

মাহমুদ আলী চম্পাকে অভিবাদন জানিয়ে দলবলসহ চলে যায়। সুড়ঙ্গপথে বাইরে না গিয়ে। তারা ভিতর পথে কোথায় যে অদৃশ্য হয় নূরী আর তাদের দেখতে পায় না।

এবার নূরী ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে জানে চম্পার কাজ শেষ হয়েছে, এবার সে সুড়ঙ্গ হতে বেরিয়ে যাবে। কাজেই তাকে তার পূর্বেই সরে যেতে হবে কিন্তু চম্পার আসন ত্যাগ করার লক্ষণ দেখা গেলো না।

দরবার-স্থান শূন্য হলেও বৃদ্ধা তখনও দাঁড়িয়েছিলো আর দাঁড়িয়েছিলো কয়েকজন পাহারাদার যারা মারাত্নক অস্ত্র নিয়ে চম্পার আসনের পিছনে প্রতীক্ষা করছিলো।

চম্পাকে লক্ষ্য করে বললে বৃদ্ধারাণীজী, দস্যু-সম্রাটকে আপনি একেবারে হাবাগোবা বানিয়ে তাকে বোকা বানিয়ে রেখেছেন। আর কতদিন দু’জনাকে দু’জনার কাছ থেকে সরিয়ে রাখবেন?

চম্পা তার পাহারাদারগণকে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দিল।

ওরাও চলে গেলো, এবার দরবারে শুধু চম্পা আর বৃদ্ধা।

চম্পা এবার বলে—দুজনাকে সরিয়ে রাখার পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিলো, কারণ নূরীকে পেলেই বনহুর বিদায় নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আমি বা কেউ তাকে ধরে রাখতে পারবো না। কিন্তু তার পূর্বেই আমি জানতে পেরেছি, কান্দাই পুলিশ বাহিনী কোনো ক্রমে জানতে পেরেছে দস্যু বনহুর নীলনদ হয়ে নীলদ্বীপ অভিমুখে এসেছে, তাই তারা অসংখ্য পুলিশ বাহিনী সহ বেশ কিছু জাহাজ নিয়ে সমগ্র নীলনদে রীতিমত পাহারা দিচ্ছে। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা তাদের উদ্দেশ্য এবং জীবনপণ করে তারা সতর্ক পাহারায় রয়েছে। আমি তাই আমার লোকজন ও জাহাজ আনয়ন করলাম আর সেই কারণেই উভয়কে উভয়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু……আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় চম্পা।

সেই অবসরে নূরী অন্ধকারে সরে পড়ে সেখান থেকে।

অতি সন্তর্পণে নিজের শয্যায় এসে শুয়ে পড়লো। জমাট অন্ধকারে বুকটা তার ধক ধক করছিলো, তবুও একটা আনন্দ তার সমস্ত অন্তরে ফুলের সুবাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সে জানতে পেরেছে চম্পার উদ্দেশ্যের কথা। তার প্রিয়ের কাছ থেকে কেন তাকে এমনভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

দু’চোখ বন্ধ করে বনহুরের কথা ভাবতে থাকে নূরী।

হঠাৎ পিছনের জানালা খুলে যায়, কেউ যেন প্রবেশ করে তার কক্ষমধ্যে।

চমকে উঠে নূরী, শিউরে উঠে তার শরীর। একখানা ঝাপসা মুখ ভেসে উঠে তার চোখের সামনে, সে মুখখানা মাঝি হরিনাথের। মাথায় পাগড়ির মত করে একটা গামছা জড়ানো, মুখে গালপাট্টা বাধা। শুধু চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো সেদিন, কেমন যেন কটমট করে তাকাচ্ছিলো তার দিকে। ভীত ভাব নিয়ে অন্ধকারে তাকায় নূরী যেদিক থেকে পদশব্দটা আসছিলো সেইদিকে।

শব্দটা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে।

স্তব্ধ নিশ্বাসে নূরী প্রতীক্ষা করছে, আজ তার রক্ষা নেই, শয়তান হরিনাথ তাকে আক্রমণ করে বসবে। চম্পাতো এখনো এলো না, সে এসে পড়লে তবু তার রক্ষা ছিলো।

কিন্তু ভাবার সময় আর কই, নূরীর শয্যার অতি নিকটে পদশব্দের সঙ্গে একটা নিশ্বাসের শব্দও কানে আসে তার।

নূরীর সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে, মনে মনে সে খোদাকে স্মরণ করে চলে।

জমাট অন্ধকারে নূরী তাকালো কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না, শুধু একটা ছায়ামূর্তি তার শয্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

নূরী তীব্র চিৎকার করে উঠলো–বাঁচাও……।

সঙ্গে সঙ্গে একটা বলিষ্ঠ হাত তার মুখের উপর এসে পড়লো।

কিন্তু মুহূর্ত মাত্র, নূরীর চিৎকার শুনে দু’জন পাহারাদার ছুটে এলো আলো হাতে।

দরজার বাইরে আলো ছটা দেখে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই নূরীর মুখখানা মুক্ত হয়ে গেলো। ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে দরজা খুলে যাবার আগেই, কারণ পিছনের জানালা মুক্ত ছিলো।

পাহারাদারদ্বয় আলো হাতে কক্ষমধ্যে এসে দাঁড়াতেই তাদের পিছনে এসে দাঁড়ালো চম্পা। চোখেমুখে তার বিস্ময়, বললো-কি হয়েছে?

নূরী চম্পার দিকে তাকিয়ে দেখলো তখনকার চম্পা আর এখনকার চম্পার মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ। এখন তার দেহে নেই সেই অদ্ভুত জমকালো ড্রেস। চোখে নেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গঝরা দৃষ্টি।

চম্পা নুরীর পাশে গিয়ে কাঁদে হাত রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো—কি হয়েছে নরী?

নূরী ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো–সেই নিশ্বাসের শব্দ, সেই ছায়ামূর্তি আজ আবার এসেছিলো। তুমি কোথায় গিয়েছিলে চম্পাদি?

একটু বাইরে গিয়েছিলাম। আজ আবার সে আসবে জানতাম না।

নূরীর মুখ থেকে তখনও ভীতি মুছে যায়নি। সে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো–শয়তানটা বড় ভয়ঙ্কর। কি ভীষণ চেহারা……

চম্পা তার লোকদের আদেশ দিলো–যাও সমস্ত বাড়িখানা তল্লাশী চালাও।

সবাই বেরিয়ে যায়।

চম্পা বলে–শুয়ে পড়ো নূরী।

চম্পাদি, তোমার ভয় করছে না?

ভয়……খিল খিল করে হেসে উঠে চম্পা, তারপর হাসি থামিয়ে বলে-ভয় করববা! জঙ্গলে আমার জন্ম। হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে আমার বসবাস। শয়তান লোকদের নিয়ে আমাকে সময় কাটাতে হয়, কাজেই ভয় আমি কাউকে করি না।

নূরীও চম্পার চেয়ে কম নয়, সে যে দস্যু কন্যা এবং দস্যুর স্ত্রী তবু তার মনে দুর্বলতা, কারণ সে নারী। জীবন-মন দিয়ে সে একজনকে ভালবেসেছিলোতাকেই সে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছে, তার সব কিছু সমর্পণ করেছিলো তাকে। কোনোদিন সে অপর জনকে চিন্তা করেনি, তাই অপর জনকে এত ভয় তার।

নূরী এটুকু জানে, সতীত্বই নারীর জীবনের পরম সম্পদ। যে সম্পদ একবার নষ্ট হলে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ফিরে পাওয়া যায় না।

চম্পা নূরীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়ে পড়ে, তারপর বলে–খুব ভয় পেয়েছিলে বুঝি?

হাঁ খুব।

চম্পার পাশে শুয়ে নূরী বড় অস্বস্তি বোধ করছিলো। আজ সে ওর আসল রূপ দেখতে পেয়েছে। চম্পাকে অন্যান্য দিনের মত আজ স্বচ্ছমনে গ্রহণ করতে পারে না নূরী। সে নিশ্চুপ শুয়ে থাকে। চম্পা নূরীর মনোভাব বুঝতে পেরে মৃদু মৃদু হাসে।

সম্মুখের টেবিলে ম্যাপখানার উপরে নজর রেখে কিছু অন্বেষণ করে চলেছেন মিঃ জাফরী। পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ ইলিয়াস এবং আরও দু’জন পুলিশ অফিসার। সকলের চোখেমুখেই একটা দারুণ উৎকণ্ঠা ভাব। ম্যাপখানায় দৃষ্টি রেখে কিছু সন্ধান করে চলেছেন তারা।

মিঃ ইলিয়াস কান্দাই পুলিশ গোয়েন্দা। তিনি পূর্বে গোয়েন্দাগিরিতে বহু সুনাম অর্জন করেছেন। জীবনে বহু চোর, ডাকু-বদমাশকে তিনি কৌশলে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। দস্যু বনহুর গ্রেফতারেও তিনি বহুদিন হতে প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন কিন্তু সফলতা অর্জন করতে পারেননি। এবার মিঃ ইলিয়াস মিঃ জাফরীর সঙ্গে নীলনদে এসেছেন। অবশ্য দস্যু বনহুর যে নীল নদ হয়ে নীলদ্বীপ অভিমুখে রওনা দিয়েছিলো, এ কথা গোপনে সংগ্রহ করেছিলেন মিঃ ইলিয়াস

মিঃ ইলিয়াসের বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনাই মিঃ জাফরীর মনে নতুন আশা সৃষ্টি করেছিলো। অবশ্য তাঁর নিজের ইচ্ছাও কম ছিলো না। দস্যু বনহুর গ্রেফতার ব্যাপার নিয়েই তিনি কান্দাই এসেছিলেন এবং সে কারণেই বহুদিন তিনি কান্দাই রয়ে গেছেন! দস্যু বনহুরের কাছে মিঃ ইলিয়াস নাকানি-চুবানিও কম খাননি এবং সেই কারণেই তার এত আক্রোশ যেমন করে হোক দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে তাকে কাইল করবেন।

কোনো এক পুলিশ গুপ্তচরের কাছেই দস্যু বনহুরের নীলনদে গমনের সংবাদ সগ্রহ করে মিঃ জাফরী এবং মিঃ ইলিয়াস বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ-ফোর্স নিয়ে আজ চল্লিশ দিন ধরে তল্লাশী চালান, কারণ বনহুর সবার চোখে ধূলো দিতে পারবে কিন্তু জাফরীকে সহজে ধোকা দিতে পারবে না।

মিঃ জাফরীকে নীলদ্বীপ পুলিশ বাহিনীও সাহায্য করছে। মারাত্নক অস্ত্রশস্ত্র এবং বহু পুলিশ ফোর্স দিয়েছেন নীলদ্বীপ সরকার।

নীলদ্বীপের মহারাজ হিরন্ময় কিন্তু এব্যাপারে মোটেই অবগত ছিলেন না, কারণ তিনি তখন কোনো কারণে রাজ্যের বাইরে অবস্থান করছিলেন।

মিঃ জাফরী চল্লিশ দিন অবিরাম পরিশ্রম চালিয়েও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হননি। এতদিনে তারা কয়েক শত জাহাজে খানা তল্লাশী চালিয়ে হয়রান পেরেশান হয়েছেন। অবশ্য কয়েকটি জাহাজে সন্দেহজনক কিছু জিনিসপত্র এবং লোকজনকে পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছেন।

গত পরশু মিঃ ইলিয়াস কিছুসংখ্যক পুলিশ-ফোর্স নিয়ে একটি জাহাজ আটক করেছেন এবং জাহাজের পঞ্চাশ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছেন।

মিঃ জাফরী গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাপখানা লক্ষ্য করছিলেন। এবার তিনি ম্যাপখানার এক জায়গায় আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলে উঠলেন–এই সেই জঙ্গীনদের মোহনা, যে পথে আর একখানা জাহাজ উধাও হয়েছে।

মিঃ ইলিয়াস ঝুঁকে পড়লেন, ম্যাপখানায় নজর দিয়ে বললেন–ঠিক বলেছেন স্যার, দ্বিতীয় জাহাজখানা ঐ পথেই অদৃশ্য হয়েছে।

মিঃ জাফরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করে চলেছেন, তাঁর চোখে মুখে একটা কঠিন ভাব ফুটে উঠেছে।

দণ্ডায়মান একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন–স্যার, আমার মনে হচ্ছে দস্যু বনহুরের অনুচর এরা। একখানা জাহাজ আমাদের কবলে আটকা পড়েছে আর একখানা পালাতে সক্ষম হয়েছে।

অপর অফিসার বলে উঠলেন—আমারও ঐ রকম মনে হচ্ছে স্যার।

মিঃ জাফরী বললো–এ জাহাজে কতজন লোক ছিলো?

মিঃ ইলিয়াস বললেন—জাহাজের মাঝি-মাল্লাসহ প্রায় চুয়ান্ন জন হবে। কিন্তু পঞ্চাশ জন লোকের একই রকম ড্রেস এবং তারা অতি বলিষ্ঠ চেহারার লোক। একজনকে দলের নেতাবলে মনে হলো। স্যার, আপনি এদের পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, কারণ এদের মধ্যেও দস্যু বনহুর আত্নগোপন করে থাকতে পারে।

মিঃ জাফরী ম্যাপখানাকে ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বললেন–এদের কত নম্বর জাহাজে বন্দী করে রেখেছেন?

এবার জবাব দিলেন মিঃ জাফরীর সহকারী মিঃ গুহ–স্যার, ৩নং জাহাজে এদের আটক করে রাখা হয়েছে।

আজই আমি পরীক্ষা করে দেখবো। দস্যু বনহুরকে আমি নিশ্চয়ই চিনতে পারবে। তবে এদের মধ্যে দস্যু বনহুর নেই কারণ দস্যু বনহুর এত সহজে ধরা দেবার বান্দা নয়।

মিঃ জাফরীর কথা শেষ হতে না হতে ক্যাবিনে প্রবেশ করেন মিঃ লেহরী। ইনি পুলিশ ইন্সপেক্টার। আপাততঃ মিঃ জাফরীর সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ক্যাবিনে প্রবেশ করে অভিবাদন জানিয়ে বললেন—স্যার, সেই লোকটা ভেগেছে…

কোন্ লোকটা? বললেন মিঃ জাফরী।

যে জাহাজখানা আটক করা হয়েছে সেই জাহাজের দলে যাকে দলের সর্দার বলে সন্দেহ করা হয়েছিলো সেই লোক।

মিঃ জাফরী এবং ইলিয়াস একসঙ্গে অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন–দলের সর্দার পালিয়েছে?

মিঃ গুহ এবং মিঃ হরেশ যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা বিস্ময়ে চমকে উঠলেন।

মিঃ হারেশ বললেন–কিভাবে সে পালাতে সক্ষম হলো? তাকে তো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিলো?

মিঃ লেহরী বলে উঠেন–আশ্চর্যভাবে লোকটা পালিয়েছে স্যার। শিকলের সঙ্গে একখানা হাত তার এখনও ঝুলছে।

কি বললেন মিঃ লেহরী? মিঃ জাফরী যেন অদ্ভুত শব্দ করে উঠলেন।

মিঃ লেহরী বললো–চলুন দেখবেন স্যার বিস্ময়করভাবে পালিয়েছে লোকটা।

মিঃ জাফরী দলবলসহ চললেন।

৩নং জাহাজখানা তখন ১ নং জাহাজের সঙ্গে এসে ভিড়েছে। সাঁকো ফেলা হয়েছে। মিঃ জাফরী, মিঃ ইলিয়াস এবং অফিসারদ্বয় সাঁকো বেয়ে ৩ নং জাহাজে গেলেন। মিঃ লেহরী ছিলেন তাঁদের সঙ্গে, তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।

মিঃ জাফরী বিশাল বপু নিয়ে সাঁকো পার হয়ে ওপারে এলেন। তাঁর দলবলও এসে পড়লো ৩নং জাহাজে।

মিঃ লেহরী সহ মিঃ জাফরী ৩ নং জাহাজের বন্দীশালার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

বৃহৎ আকার বন্দীশালায় বন্দী করে রাখা হয়েছে হীরালালের সবগুলো অনুচরকে। আর হীরালালকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো পাশের ক্যাবিনে। তার হাতে লৌহশিকল আটকানো ছিলো।

মিঃ জাফরী দলবলসহ ক্যাবিনে প্রবেশ করে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলেন। তারা দেখলেন ক্যাবিনের গায়ে লৌহশিকলের সঙ্গে ঝুলছে একখানা রক্তাক্ত বলিষ্ঠ হাত। হাতখানা কোনো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে ক্যাবিনের মেঝেতে! কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য!

মিঃ জাফরী বলে উঠলেন-সাংঘাতিক।

মিঃ লেহরী বললেন-লোকটাকে দেখলে স্যার যে কোনো মানুষের মনে ভয় জাগবে।

মিঃ ইলিয়াস গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–কতখানি ভয়ঙ্কর হলে এমন দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে তা বুঝতেই পারা যাচ্ছে।

মিঃ গুহ বললেন–লোকটা দস্যু বনহুর না হয়েই যায় না, কারণ তাকে কেউ বন্দী করে রাখতে সক্ষম হয়নি কোনোদিন।

মিঃ জাফরী বললেন–দস্যু বনহুর কোনো সময় নিজের অঙ্গহানি করে পালাবে না, তবে অনুচর হবে নিশ্চয়ই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিঃ লেহরীকে লক্ষ্য করে বললেন মিঃ ইলিয়াস-লোকটা পালালো কোন পথে?

মিঃ লেহরী আংগুল দিয়ে ক্যাবিনের পিছন দিকের একটা ভেন্টিলেটার দেখিয়ে দিয়ে বললেন-স্যার, ঐ দিক দিয়ে লোকটা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

মিঃ জাফরী, মিঃ ইলিয়াস ও অফিসারদ্বয় দেখতে পেলেন ক্যাবিনের পিছন দিকে রক্তের ধারা চলে গেছে ভেন্টিলেটার টার দিকে। রক্তের ধারা জমাট বেঁধে আছে, লোকটা ঠিক ভোর রাতের দিকে পালিয়েছে।

বিস্ময়ে স্তব্ধ-হয়ে গেছেন সবাই, তারা বহুদিন বহু বন্দীকে আটক রেখেছেন, পালাতেও দেখেছেন অনেককে কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা তারা দেখেননি কোনোদিন। লোকটা কতখানি ভয়ঙ্কর ছিলো তার কল্পনা করা যায় না।

মিঃ জাফরী তাঁর সহকারিগণসহ এবার বন্দীদের ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন।

সবাই অবাক হয়ে দেখলেন কি ভয়ঙ্কর এক-এক জনের চেহারা। কিন্তু সকলের দেহে একই রকম পোশাক।

মিঃ জাফরী সবাইকে তীক্ষ্ণ নজরে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। তিনি জানেন, এদের কিছু প্রশ্ন করে কোনো ফল হবে না, কেউ সত্য কথা বলবে না এই মুহূর্তে।

মিঃ ইলিয়াস বললেন–এদের কান্দাই জেলে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। জাহাজ থেকে এরা যে কোনো মুহর্তে পালাতে পারে।

মিঃ জাফরী বললেন–হ এদের কান্দাই জেলে পাঠানোই দরকার।

কথাগুলো অবশ্য নিম্নস্বরে বলছিলেন তারা যাতে বন্দীরা শুনতে না পায়ে।

বন্দীদেরকে জানানো হলো না তাদের দলপতি সম্বন্ধে কোনো কথা। বন্দীদের ভালভাবে লক্ষ্য করার পর ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন সবাই।

সঙ্গে সঙ্গে মিঃ জাফরী অন্যান্য জাহাজে এই সংবাদ ওয়্যারলেসে জানিয়ে দিলেন। নীল নদে প্রত্যেকটা জাহাজে পুলিশ বাহিনী যেন অনুসন্ধান চালায়।

মিঃ জাফরীর আদেশ পাওয়ামাত্র পুলিশ বাহিনী অস্ত্র-শস্ত্র বাগিয়ে নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনুসন্ধান চালিয়ে চললো।

সমস্ত জলরাশি সার্চলাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে। বন্দী পালিয়েছে, তার একখানা হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন, কাজেই সে সাঁতার কেটে সাগর পাড়ি দিতে পারবে না।

এখানে মিঃ জাফরী এবং তার দলবল যখন হীরালালকে নীলনদের গভীর জলে অনুসন্ধান করে চলেছে তখন হীরালাল ৩ নং জাহাজের পিছনে গোপন এক অংশে জলে দেহখানাকে ভাসিয়ে রেখেছে, যেমন করে হোক তাকে সূরজ দ্বীপে পৌঁছতে হবে।

চম্পা তার স্বর্ণ আসনে উপবিষ্ট।

সম্মুখে দণ্ডায়মান মাহমুদ আলী ও তার দলবল। মাহমুদ আলী এবং তার দলবলের দেহে একই পোশাক, হাতে মারত্নক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে।

চম্পার দেহে জমকালো অদ্ভুত ড্রেস, চোখে-মুখে তার একটা দীপ্ত ভাব ফুটে উঠেছে। মাহমুদ আলীকে কোনো কাজের নির্দেশ দিচ্ছিলো চম্পা।

সুড়ঙ্গ মধ্যে অন্ধকারে আরও একজন গোপনে লুকিয়ে দেখছিলো সব। অতি সন্তর্পণে চম্পার কথাবার্তা সবকিছু শুনছিলো সে।

চম্পার স্বর্ণ আসন মশালের আলোতে ঝকমক করে জ্বলছে। আসনের পাশেই দণ্ডায়মান সেই বৃদ্ধা। আরও দুটি নারী দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখে মুখেও উত্তেজনার চিহ্ন।

চম্পা মাহমুদ আলীকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে রক্তাক্ত দেহে ভিজে চপসে যাওয়া শরীরে একটি লোক দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে এলো। লোকটার দিকে নজর পড়তেই সুড়ঙ্গ মধ্যে দরবারকক্ষের সকলে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো।

চম্পা অস্ফুট আওয়াজ করে উঠলো—হীরালাল।

আড়ালে দণ্ডায়মান ছায়ামূর্তিও হীরালালকে দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো। হীরালালের দেহ থেকে একখানা হাত উধাও হয়েছে, রক্তের মত লাল টকটকে কিছু মাংস ঝুলে আছে দেহের এক অংশে। সমস্ত দেহখানা হীরালালের রক্তে আর ভিজা কাদাতে বীভৎস আর বিকৃত হয়ে উঠেছে।

লোকটার দেহ অতি বলিষ্ঠ, চোখেমুখে যদিও বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে তবু সে মুখে নেই কোনো ক্লান্তির বা অবসাদের চিহ্ন। লোকটা দক্ষিণ হস্ত দিয়ে দেয়াল আঁকড়ে ধরে এগিয়ে এলো।

চম্পা আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো-হীরালাল, তোমার এ অবস্থা কেন?

মাহমুদ আলী ততক্ষণে হীরালালকে ধরে ফেলেছে।

চম্পার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো হীরালাল–রাণীজী, পুলিশ বাহিনীর বন্দী জাহাজ থেকে পালিয়ে এসেছি..

তোমার হাতের এ অবস্থা কেন? বললো চম্পা।

হীরালাল তার রক্তাক্ত হাতের শেষ অংশের দিকে একবার তাকিয়ে বললো–লৌহশিকলে আটকানো হাতখানাকে ছিঁড়ে তবেই পালাতে সক্ষম হয়েছি রাণীজী।

কি সংবাদ বলো? তোমার সঙ্গীদের অবস্থাই বা কি? প্রশ্ন করলো চম্পা।

হীরালাল বললো–রাণীজী, আমার দলবল সকলেরই একই অবস্থা। সবাইকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমাকে ৩নং পুলিশ জাহাজের ভিন্ন এক ক্যাবিনে রাখা হয়েছিলো, আমি নিজের হাতখানাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পালিয়ে এসেছি।

পুলিশ জাহাজগুলো এখনও কি নীলনদে প্রবেশ পথে অবস্থান করছে?

হাঁ রাণীজী, যতক্ষণ না তারা দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে পেরেছে ততক্ষণ তারা এইভাবে নীলনদের প্রবেশ মুখ আগলে রাখবে বলে মনে হলো।

পুলিশ বাহিনীদের জাহাজের সংখ্যা কত হবে?

আন্দাজ তিনি কিংবা চারখানা তার বেশিও হতে পারে। প্রত্যেকটা জাহাজে বিশ জনের বেশি পুলিশ ফোর্স রয়েছে। ১নং জাহাজে থাকে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাগণ……

চম্পার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো, হীরালালের কথার শেষ অংশ তার কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে। চম্পা বলে উঠলো-সাবাস হীরালাল। যাও এবার তোমার ছুটি। তারপর মাহমুদ আলীর দিকে তাকিয়ে বললো-হীরালালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দাও। আর ওকে এক লাখ স্বর্ণমোহর দিয়ে দাও ওর হাতখানার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ।

মাহমুদ আলী বললো—আচ্ছা রাণীজী।

চম্পা আবার বললো আমাদের জাহাজ প্রস্তুতি সমাপ্ত হয়েছে?

হাঁ রাণীজী।

কোন্ পথে যাওয়ার সাব্যস্ত করেছো মাহমুদ আলী?

জঙ্গীনদের দ্বিতীয় মোহনা দিয়ে আমাদের জাহাজ নীলদ্বীপের দিকে রওনা দেবে ঠিক করেছি।

চম্পা বলে উঠলো–পুলিশ বাহিনী যদি সেই পথের সন্ধান পেয়ে থাকে তাহলে?

মাহমুদ আলী বললো–যুদ্ধ ছাড়া কোনো উপায় নেই রাণীজী, কারণ জঙ্গীনদের তিনটি মোহনা,-একটি দক্ষিণ দিকে অপর দুটি মোহনা ঠিক পাশাপাশি পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকেই এগিয়ে গেছে।

চম্পার ভ্রূকুঁচকে গেলো, একটু ভেবে বললো–যেমন করে হোক রওনা দিতেই হবে। নীলদ্বীপের রাজকন্যা বিজয়াকে তার পিতামাতার কাছে পৌঁছে দিয়ে কান্দাই-এর দিকে যাত্রা করবো।

হীরালালের দলবলদের উদ্ধারকার্য নিয়ে কবে চিন্তা করবেন রাণীজী?–বললো মাইদি বুড়ী।

চম্পা বললো—সূরী আর বনহুরকে কান্দাই পৌঁছে দেবার পর সে চিন্তা করবো।

হীরালাল বলে উঠলো-রাণীজী, আমার মনে হয় পুলিশ বাহিনী বন্দীদের সমুদ্রমধ্যে বেশিদিন রাখবে না। তাদের কান্দাই জেলে পাঠাবে।

চম্পা বলে উঠলো–তার পূর্বেই আমরা বন্দীদের উদ্ধার নিয়ে প্রচেষ্টা চালাবো। যাও মাহমুদ আলী, যাত্রার আয়োজন করো গে।

মাহমুদ আলী দলবল এবং হীরালাল সহ চলে গেলো।

চম্পা দরবার কক্ষের সবাইকে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দিলো।

রাণীজীর আদেশে বেরিয়ে গেলো সবাই।

শুধু মাইদি বুড়ী রইলো চম্পার পাশে।

নিম্ন-স্বরে কিছু আলাপ চললো দু’জনার মধ্যে।

আড়ালে দাঁড়িয়ে ছায়ামূর্তি এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিলো। চম্পা যে একটি অসাধারণ নারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই-হীরালালের একখানা হাতের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ যে একলাখ স্বর্ণমোহর দিতে পারে! ছায়ামূর্তির চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলছে যেন।

এবার কথা শেষ হলো চম্পার, মাইদি বুড়ি বেরিয়ে গেলো সোজা পথ দিয়ে।

চম্পা এগিয়ে চললো তার গোপন পথে।

এগুতেই অন্ধকারে পথ আগলে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি।

চম্পা চমকে উঠলো, বললো–কে?

ছায়ামূর্তি এবার কথা বললো তুমি কে আগে সেই পরিচয় দাও?

আমি চম্পা।

না–তুমি চম্পা নও।

তুমি কে? আর আমার এ গোঁপন সুড়ঙ্গ পথে কি করেই বা প্রবেশ করলে?

যে পথে তুমি প্রবেশ করেছ।

এবার চম্পা অন্ধকারেই হেসে উঠলো–খিলখিল করে তারপর বললো–জানো তুমি কোথায় প্রবেশ করেছো?

জানি।

তুমি জানো না এখানে যে প্রবেশ করে সে আর কোনদিন ফিরে যেতে পারে না। তুমি আমার বন্দী..

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ছায়ামূর্তি-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ……

সে হাসির শব্দে সমস্ত সুড়ঙ্গমধ্যে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। চম্পা অন্ধকারে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, দু’চোখে তার রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ছে–অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে- তুমি!

হাঁ, চিনতে পেরেছো?

এখানে কেন এসেছো তুমি?

তোমার আসল পরিচয় জানতে……

বাবু…….

বাবু নই-বলো বনহুর!

তুমি……তুমি……

সব আমি জানি, তোমার আসল পরিচয়ও আমার অজানা নেই—আশা…….

মুহূর্ত বিলম্ব হয় না একটা শব্দ শোনা যায়, বনহুর অবাক হয়ে দেখে তার সম্মুখে চম্পা নেই। এক নিমিষে সে যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। বনহুর শুধু অনুভব করলো তার পায়ের নিচে মাটিখানা একটু দুলে উঠলো যেন।

বনহুর আর দাঁড়ালো না, সে দ্রুত বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গ হতে।

চমকে উঠে নূরী, ঘুম ভেংগে যায় তার। সেই শব্দ, ধীরে ধীরে কেউ যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে।

নূরী শিউরে উঠে, চম্পা আজ তার পাশে নেই। সে আজ দুদিন হলো কোথায় যে উধাও হয়েছে তাকে নুরী আর খুঁজে পায়নি। মাঝে মাঝে মাইদি বুড়ি আসে সেই খোঁজ খবর নিয়ে যায়। আর খাবার দিয়ে যায়। নূরীর বড় একা একা লাগছে, তাছাড়া ভয়ও লাগছে তার। না জানি কখন কোন বিপদ এসে পড়ে।

সবচেয়ে রাতের বেলায় নূরীর বড় ভয় লাগে, বিছানায় শুলেই তার কানে যেন ভেসে আসে সেই নিশ্বাসের শব্দ, ভারী পায়ের লঘু আওয়াজ। নূরীর বুক দূরু দূরু করে কেঁপে উঠে। সমস্ত রাত সে এক রকম প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয়

নূরীর ধৈর্য থাকছে না, তার হুরের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আর কতদিন চম্পা তাকে তার বনহুরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। নূরীর মোটেই ভাল লাগে না। যতরাগ হয় তার চম্পার উপর, কেননা সে তার হুরের কাছে তাকে নিয়ে যাচ্ছে না। অনেক দিন অনেক প্রশ্ন করেছে নূরী কিন্তু চম্পা তাকে সঠিক কোন জবাব দেয়নি।

নুরী চম্পাকে যত দেখেছে ততই আশ্চর্য হয়েছে, সে যেন এক বিস্ময়- কর নারী। এমন গহন বনে সে বাস করে অথচ শহরের অট্টালিকার মত তার বাসস্থান। কিন্তু তার পোশাক পরিচ্ছন্ন ভীল কন্যার মত। চাল চলনে ধরা পড়ে আভিজাত্যের ছাপ। নুরীর মনে সন্দেহের দোলা, কে এই নারী?

নূরীর মনের কথা বুঝতে পারতো চম্পা, মৃদু মৃদু হাসে আরও নিজকে রহস্যময়ী করে তোলার চেষ্টা করে সে। চম্পার মনোভাব নূরী বুঝতে পারে না কারণ সে সরল সহজ মেয়ে।

মাঝে মাঝে নূরী যখন অত্যন্ত চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়তো তখন চম্পা তাকে বোনের মত স্নেহ দেখাতো। কত কাহিনী শোনাতে তাকে নানা ছলনায়, যাতে সে ভুলে থাকে তার বনহুরকে।

কিন্তু নূরীর মনে যে সদা বনহুরের চিন্তা। বনহুরের জন্য সে নিজের শিশু সন্তানের মায়া বিসর্জন দিয়েছে, ছুটে এসেছে কোন অজানা অচেনা দ্বীপে। এখানে এলে সে তার বনহুরকে পাবে এটাই তার বড় কামনা।

নূরী একা একা সে কথাই ভাবছিলো তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল ছিলো না, ভেংগে যায়, শুনতে পায় সেই নিশ্বাসের চাপা শব্দ। সজাগ হয়ে উঠে সে, আজ বুঝি তার রক্ষা নেই।

ঠিক তার বিছানার পাশে এসে থামলো কে যেন।

অন্ধকারে ছায়ার মত লাগছে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নূরী। দু’খানা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। নূরী চোখ মুদে ফেললো।

দুখানা বলিষ্ঠ হাত ততক্ষণে নূরীকে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে।

চিৎকার করে উঠলো নূরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *