ধৃতি মদের ভক্ত নয়
০৩.
ধৃতি মদের ভক্ত নয়। কোনও গোঁড়ামি নেই, কিন্তু মদ খেলেই তার নানারকম শারীরিক অসুবিধে হতে থাকে। কখনও আধকপালে মাথা ধরা, কখনও পেটে প্রচণ্ড গ্যাস জমে, কখনও দমফোট হয়ে হাসফাস লাগে। কাজেই পারতপক্ষে সে মদ হেয় না।
অফিস থেকে আজ একটু আগে আগে কেটে পড়ার তালে ছিল সে। ছটায় ইউ এস আই এস অডিটোরিয়ামে গ্যারি কুপারের একটা ফিল্ম দেখাবে। ধৃতি কার্ড পায়। প্রায়ই ছবি দেখা তার হয়ে ওঠে না। কিন্তু এ ছবিটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার।
আজ চিফ সাব-এডিটার তারাপদবাবু কাজে বসেছেন। বয়স্ক লোক এবং প্রচণ্ড কাজপাগল। কোন খবরের কতটা ওজন তা তার মতো কেউ বোঝে না।
ধৃতি গিয়ে বলল, তারাপদা, আজ একটু আগে আগে চলে যাব।
যাবে?– বলে তারাপদবাবু মুখ তুলে একটু হেসে ফের বললেন, তোমার আর কী? কর্তারা। ফিচার লেখাচ্ছেন তোমাকে দিয়ে। তুমি হলে যাকে বলে ইম্পর্ট্যান্ট লোক।
এটা অবশ্য ঠেস-দেওয়া কথা। কিন্তু তারাপদবাবুর মধ্যে হিংসা-দ্বেষ বড় একটা নেই। ভালমানুষ রসিক লোক। তাই কথাটার মধ্যে বিষ নেই।
ধৃতি হেসে বলে, ইম্পর্ট্যান্ট নয় তারাদা, আমি হচ্ছি আসলে ইম্পোটেন্ট।
তারাপদবার মুখখানা খুব কেজো মানুষের মতো গভীর করে পিন আঁটা একটা মোটাসোটা খবরের কপি ধৃতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এ খবরটা করে দিয়ে চলে যাও। এটা কাল লিড হতে পারে। বেশি বড় কোরো না।
ঘড়িতে চারটে বাজে। কপি লিখতে ধৃতির আধঘণ্টার বেশি লাগবে না। তাই তাড়াহুড়ো না করে ধৃতি নিজের টেবিলে কপিটা চাপা দিয়ে রেখে সিনেমার ডিপার্টমেন্টে আড্ডা মারতে গেল।
কালীবাবু চুলে কলপ দিয়ে থাকেন। চেহারাখানা জমিদার-জমিদার ধরনের। ভারী শৌখিন লোক। এক সময়ে সিনেমায় নেমেছিলেন, পরে কিছুদিন ডিরেকশন দিলেন। তিন-চারটে ছবি ফ্লপ করার পর হলেন সিনেমার সাংবাদিক। এখন এ পত্রিকার সিনেমার পাতা এডিট করেন।
ধৃতিকে দেখে বলেন, কী ভায়া, হাতে নাকি একটা ভাল মেয়েছেলে আছে! থাকলে দাও না, সিনেমায় নামিয়ে দিই। বাংলা ছবিতে নায়িকার দুর্ভিক্ষ চলছে দেখছ তো?
ধৃতি অবাক হয়ে বলে, ভাল মেয়ে। আমার হাতে কোত্থেকে মেয়ে থাকবে কালীদা?
কেন, এই তো সৌরীন বলছিল তুমি নাকি একটা ঘ্যাম মেয়েছেলের ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছ!
ওঃ! বলে ধৃতি বসে।
দাও না মেয়েটার ঠিকানা। তোমার রিলেটিভ হলেও ক্ষতি নেই। আজকাল লাইন অনেক পরিষ্কার, কারও চরিত্র নষ্ট হয় না।
সেজন্য নয়। অন্য অসুবিধে আছে।
কেন লেজে খেলাচ্ছ ভাই?
সৌরীন কিছু জানে না। শুধু ছবিটা দেখেই উত্তেজিত হয়ে এসে আপনাকে বলেছে।
অসুবিধেটা কী?
যতদূর ছি মেয়েটা বেঁচে নেই।
ধৃতি দ্বিধায় পড়ে যায়। জয়ন্ত সেন বার বার বলেছিলেন, শি ইজ ভেরি মাচ অ্যালাইড। সে কথাটা মনে পড়ে যায়।
ধৃতি বলল, ঠিক চিনি না। তবে জানি। মরার খবরটা অবশ্য উড়ো খবর।
কালীবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন, সুন্দরী মেয়েরা মরবে কেন?
সেটাই তো প্রবলেম।
মোটেই কাজটা ভাল নয়। সুন্দরী মেয়েদের মরা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
ধৃতি একটু মৃদু হেসে বলে, এ মেয়েটাকে নিয়ে একটি মিষ্ট্রি দেখা দিয়েছে। জয়ন্তদা ছবিটা দেখে বললেন, মেয়েটা নাকি মরেনি। অথচ আমার কাছে খবর আছে
দেখি ছবিটা। আছে? বলে হাত বাড়ায় কালীবাবু।
ছবিটা আজকাল ধৃতির সঙ্গেই থাকে। কেন থাকে তা বলা মুশকিল। কিন্তু এ কথা অতি সত্য যে ধৃতি এই ছবিটার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সব সময়ে তার মনে হয় এ ছবিটা খুব মারাত্মক একটা দলিল। কালীবাবু ছবিটা নিয়ে দেখলেন। সিনেমা লাইনের অভ্যস্ত প্রবীণ চোখ। উলটে-পালটে দেখে ছবিটা টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে বলেন, মেয়েটার নাম-ঠিকানা দিতে পারো?
নাম টুপু। ঠিকানা মুখস্থ নেই, তবে আছে বাড়িতে। এলাহাবাদের মেয়ে।
ও। একটু দূর হয়ে গেল, নইলে আজই বাড়িতে হানা দিতাম গিয়ে।
কেমন বুঝছেন ছবিটা?
খুব ভাল। তবে সিঙ্গল ফোটোগ্রাফ নয়।
তার মানে?
মানে এটা একটি জোড়ার ছবি। এর পাশে কেউ ছিল। কিন্তু নেগেটিভ থেকে আলাদা করে শুধু মেয়েটার ছবি প্রিন্ট করা হয়েছে।
ধৃতি অবাক হয়ে বলে, কী করে বুঝলেন?
কালীবাবু হেসে বলেন, যা বলছি তা হানড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট বলে ধরে নিতে পার। ছবিটা আবার ভাল করে দেখলেই বুঝতে পারবে।
ধৃতি ছবিটা ফের নেয়। এ পর্যন্ত অসংখ্য বার দেখেছে তবু বুঝতে পারেনি তো।
কালীবাবু বুঝিয়ে দেন, এই ডান পাশে মেয়েটার হাত ঘেঁষে একটু সাদা জমি দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ। ওটা তো ব্যাকগ্রাউন্ড।
তোমার মাথা।
তবে কী ওটা?
ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে লাইট অ্যাশ কালার, এই সাদাঁটা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আলাদা। ভাল করে দ্যাখো, দেখছ?
হ্যাঁ।
মানুষের কাঁধের ঢালু বুঝতে পারো না? সাদার ও অংশটা একটু বেঁকে গেছে দেখছ?
হ্যাঁ।
অর্থাৎ মেয়েটির পাশে সাদা বা লাইট রয়ে কোনও জামা পরা এক রোমিও ছিল। এ ছবিটায় তাকে বাদ রাখা হয়েছে। মেয়েটাকে তুমি একদম চেনো না?
না।
তবে এ ছবিটা এল কোথা থেকে।
এল।
খোঁজ নাও। এ মেয়েটা ফিল্মে এলে হইচই পড়ে যাবে।
খোঁজ নিতে তো এলাহাবাদ যেতে হয়!
যাবে। আমি ফিনান্স করব।
ধৃতির ফের মনে পড়ে, চিঠিটা এলাহাবাদ থেকে আসেনি, এসেছে কলকাতা থেকে। মনে পড়ে, জয়ন্ত সেন বলেছিলেন, ট্রাকটা স্রেফ বেশি হতে পারে।
ধৃতি নড়ে চড়ে বসে বলে, আম কালীদা, আমার কি মনে হয় মেয়েটা বেঁচে আছে?
কালীবাবু ছবিটা ফের দেখছিলেন হাতে নিয়ে। পুরুমার কাঁচের ভিতর দিয়ে চেয়ে বললেন, থাকাই উচিত। মরবে কেন হে।
ছবিটা দেখে কিছু বুঝতে পারেন? মানে কোনও ফিলিং হয়?
খুব হয়? একটাই ফিলিং হয়। বলে কালীবাবুশের মতো হেসে বলেন, সেন্স জেগে ওঠে।
দূর। কোনও আনক্যানি ফিলিং হয় না?
তুমি একটা বুদ্ধ। সুন্দরী মেয়েছেলে দেখে আনক্যানি ফিলিং হতে যাবে কোন দুঃখে?
যাই, কপি পড়ে আছে।-বলে ধৃতি উঠতে বলি।
আরে বসো বসো। চা খাও। রাগ করলে নাকি? আমি আবার একটু পষ্ট কথা বলি তোর বলে কালীবাবু ধৃতিকে বসিয়ে টেলিফোনে তানিকে চা পাঠাতে বলেন।
ধৃতি সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে বলে, আপনারা আমাকে জরী মুশকিলে ফেললেন দেখছি।
কী রকম?
আমাকে মেয়েটার মা জানিয়েছিল যে, টুপু মরে গেছে। আমিও তাই ধরে নিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর জয়ন্তবাবু ছবিটা দেখে বললেন তার মনে হচ্ছে যে মেয়েটা বেঁচে আছে।
বটে।
তার কথা উড়িয়েও দিতে পারছি না। তার কারণ হল চিঠিটা এলাহাবাদ থেকে আসার কথা, কিন্তু এসেছে কলকাতা থেকে।
ভারী রহস্যময় ব্যাপার তো।
আরও রহস্য হল যে আপনি আবার মেয়েটার পাশে এক অদৃশ্য রোমিওকে আবিষ্কার করলেন। তার মানে আরও জট পাকাল। মেয়েটার মা চেয়েছিল আমি মৃত্যু-সংবাদটা কাগজে বের করে দিই।
খবরদার ওসব কোরো না।
কেন?
সুন্দরীরা মরে না। তারা অমর। স্ত্রীলিঙ্গে বোধহয় অমরা বা অমরী কিছু একটা হবে।
সে যাই হোক, খবর বের করার এক্তিয়ার আমার নেই। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও মানে হয় না। কিন্তু আমি বেশ ফাপড়ে পড়ে যাচ্ছি ক্রমে।
ফাঁপরের কী আছে? খোঁজ নাও। তবে পুলিশ কেস হলে গা বাঁচিয়ে সরে এসো। ছবিটার মধ্যে একটু বদ গন্ধ আছে।
তার অর্থ?
অর্থাৎ মেয়েটা খুব ইনোসেন্ট নয়। চোখ-মুখ যত সুন্দরই হোক, এর মধ্যে একটা ইনহেরেন্ট দুষ্টুমি আহে। অ্যাডভেনচারাস টাইপ। পাশের হোকরাটিকে দেখতে পেলে হত। যাক গে, তুমি গা বাঁচিয়ে চলবে।
ধৃতি উঠতে যাচ্ছিল। কালীবাবু হাত তুলে থামিয়ে ফের বললেন, সিনেমায় নামাটা তেমন কোনও ব্যাপার নয়। ভেবো না যে সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আমি তাকে সিনেমায় নামাবার জন্য পাগল হই।
বুঝলাম।
কালীবাবু, একটু হেসে বলেন, আসলে জয়ন্তই আমাকে ব্যাপারটা বলছিল গতকাল। তখন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে ডেকে একটু ওয়ার্নিং দিই।
ওয়ার্নিং কেন?
তুমি কাঁচা বয়সের ছেলে, কোথায় কোন ঘুচক্করে পড়ে যাবে। মেয়েছেলে জাতটা যখন ভাল থাকে ভাল, যখন খারাপ হয় তখন হাড়বজাত।
তাই বলুন। জানতেন।
জানতাম। আর এও বলি যে টুপুর মা ফের তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
তা করবে।
তুমি একটু রসের কথা-কথা বোলো। সিমপ্যাথি দেখাবে খুব। যদি দেখা করতে চায় তো রাজি হয়ে যেয়ো।
আচ্ছ।
ধৃতি উঠল।