Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছড়ার ছররা || Sankar Brahma

ছড়ার ছররা || Sankar Brahma

ছেলেবেলার মা-ঠাকুমাদের মুখে ছড়া শুনে আমরা বড় হয়েছি। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ভারতে ছড়া চর্চা হয়ে আসছে। সেই সময়ের অধিকাংশ ছড়াই ছিল নীতিকথা বা উপদেশমূলক কিংবা ভবিষ্যৎ গণনার নির্দেশিকা হিসাবে, যেমন,খনার বচন। এছাড়াও বাঙালির নিজস্ব বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠান, ব্রত-পার্বণ উপলক্ষে বিশেষত নারীদের রচিত রচনাগুলির মধ্যেও ছড়ার উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যে’গুলি লোকসাহিত্যের অন্তর্গত।
মানুষ যখন থেকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছে তখন থেকেই নানান ছড়ার সৃষ্টি হয়েছে। শব্দের ব্যবহার এখানে স্বতঃস্ফূর্ত। যুগ থেকে যুগান্তরে এইসব ছড়াগুলি মুখে মুখে চলে এসেছে। রচয়িতার নাম অজানা হলেও, তাঁদের সৃষ্টি রয়ে গেছে আজও। গ্রামীণ জীবনের সরল সাধারণ মানুষ, তাদের চারপাশে দেখা জগৎ থেকেই জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি সৃষ্টি করেছেন। লোকের মুখে মুখেই ছড়াগুলি প্রচারিত হয়ে এসেছে। এগুলির কোনও লিখিত রূপ তখন ছিল না। ফলে এগুলির কিছু রাপান্তরও ঘটেছে। অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন জায়গায় একই ছড়ার বিভিন্ন পাঠও প্রচলিত ছিল। যখন থেকে এগুলি লিপিবদ্ধ করা শুরু হল, তখন থেকে এই রূপান্তরের পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং ধীরে ধীরে কম জনপ্রিয় পাঠগুলি যায় হারিয়ে।
অনেকের মতে, ১৮৭৩ সালে ভাষাতত্ত্ববিদ ‘স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন্’ ইংরাজি অনুবাদসহ যে বাংলা ছড়া-সংগ্রহ প্রকাশ করেন তার ‘দুগ্ধ মিঠা, চিনি মিঠা, আরো মিঠা ননী…’ ছড়াটিই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম ছড়ার সংগ্রহ। তবে ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিক্রম’ নাটকে ছড়াটি পাই – ‘নিম তিতো, কল্লা(করলা) তিতো, তিতো মাকাল ফল।/ তা হইতে অধিক তিতো দু’সতীনের ঘর।।’ এর থেকে বোঝা যায়, ১৮৬৫ সালে দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃত ছড়াটিই বাংলাভাষায় প্রাচীনতম মৌখিক ছড়া।

বহুল প্রচলিত একটি ছড়া –

“খোকা গেল মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে
মাছ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে
ছিপ নিয়ে গেল চিলে।”

আমরা যারা বোকা খোকারা, কাছের জলের নদী ছেড়ে,
ক্ষীর নদীর কূলে মাছ ধরতে যাই (আরও বেশী সুখের সন্ধানে), কোলা ব্যাঙে মাছ নিয়ে চলে যায় আর ছিপ নিয়ে যায় চিলে, মানে ঘটি-বাটি দুই-ই হারাতে হয়।

এই ভাবে প্রাচীন প্রচলিত ছড়াগুলির আধুনিক ব্যাখ্যা, ভাবা যেতে পারে।

অন্য আর একটি ছড়া –

“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরল, পান ফুরল খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিঁয়াজ গেছে পচে সর্ষে ক্ষেতে জল।
খরা-বন্যায় শেষ করিল বর্ষ এর ফসল।।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি সব শুধু খালি।
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে শত শত তালি।।”

ছড়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আঠারো শতকে মারাঠাদের বাংলা আক্রমণের ইতিহাস। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত একাধিকবার বাংলায় লুটতরাজ চালায় মারাঠা বর্গিরা। এই বর্গি শব্দটির অর্থ ‘অশ্বারোহী মারাঠা যোদ্ধা’। বাংলায় তখন চলছে আলিবর্দি খাঁ’র শাসন। মারাঠা আক্রমণ ঠেকাতে তিনি ব্যর্থ হন। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গিরা বাংলায় নিরীহ মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের নামে জোর করে তারা লুঠতরাজ করত। ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে’ — এখানে সেই লুঠতরাজ ও খাজনার কথাই বলা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যও তখন মন্দা অবস্থা, তার সাথে অজন্মা আর খরা মিলে অবস্থা আরও ভয়াবহ উঠেছিল, সেই বর্ণনাও পরের লাইনগুলোয় আমরা পাই। বলে রাখা ভালো, এই মারাঠা বর্গিদের ঠেকাতেই কলকাতায় ‘মারাঠা খাল’ কাটা হয়। তা’তেও বাংলা থেকে তাদের তাড়ানো যায়নি, শেষে ১৭৫১ সালে আলিবর্দি খাঁ সন্ধিচুক্তি করে মারাঠাদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেন এবং বাংলা নিস্তার পায় বর্গি জুলুমের হাত থেকে। পরে ‘মারাঠা খাল’ ভরাট করে ‘আপার চিৎপুর রোড’ তৈরী করা হয়। বর্তমানে তার নাম ‘চিত্তরঞ্জন এভিনিউ'(সেন্ট্রাল এভিনিউ)। বর্গিদের আক্রমণের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, বর্গি হানার সেই ভয়াবহ স্মৃতি বাংলার ছড়া গানেও ঠাঁই পেয়ে গেছে।

ছোটোবেলায় বন্ধু-বান্ধব বা ভাই-বোনেরা মিলে আঙুল গুনে-গুনে ‘ইকিড়-মিকিড়’ আমরা অনেকেই খেলেছি।

“ইকিড় মিকিড় চামচিকির
চামে কাটা মজুমদার।
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়িকুড়ি
দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।
চাল কুড়িতে হল বেলা
ভাত খায়নি দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা
খ্যাঁকশিয়ালের মাথা।”

এখানেও ধরা আছে বাংলা ইতিহাসের একটি অনালোচিত পর্ব ধরা আছে। ১৫৯৯ সালে প্রতাপাদিত্য বাংলার একজন স্বাধীন রাজা হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠান প্রতাপাদিত্যকে শায়েস্তা করতে। জলঙ্গি নদী পার হতে গিয়ে মানসিংহ ঝড়ের কবলে পড়েন। এই সময় মানসিংহকে সাহায্য করেন বাংলার তিন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, তাদের সকলেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’ – লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, ভবানন্দ মজুমদার আর জয়ানন্দ মজুমদার। ভবানন্দ মানসিংহকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাতির-যত্ন করেন, তার বিশাল সেনাবাহিনীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন এবং নৌকা জোগাড় করে দিয়ে তাকে নদী পার হতেও সাহায্য করেন।

প্রথম লাইনে ‘চামচিকির’ কথার অর্থ চামার। পরের লাইনে ‘চামে কাটা’ কথার মানে ‘গায়ে চামড়া নেই’ যার অর্থাৎ নির্লজ্জ–বেহায়া। আর দামোদরের বন্যা তো সেই সময় প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। বর্ষায় তার ফুঁসে ওঠা দামোদরের সেই ভয়ঙ্কর রূপে ধেয়ে আসার সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে। এখানে ঝড়বৃষ্টির রাতে ফুঁসে ওঠা জলঙ্গিকেই দামোদরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে মনেহয়। ভবানন্দ মজুমদার প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর তোষামোদ করলেও তার কর্মচারী বা রাঁধুনি-ঠাকুররা কেনই বা বাংলা আক্রমণ করতে আসা দুর্বৃত্তদের সেবাযত্ন করবেন! তাই বাধ্য হয়েই এতোজনের খাবার আয়োজন করতে গিয়ে তাদের বেলা গড়িয়ে যেত। এভাবেই বাংলায় মুঘল আক্রমণের ঘটনা ও সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথাও উঠে এসেছে এই ছড়ায়।

আরও একটি সুপরিচিত ছড়া –

“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।
কমলাফুলির টিয়েটা।
সুয্যিমামার বিয়েটা।।
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
এক খিলি পান কিনে খাই।।
পানের ভিতর ফোঁপড়া।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
মামার নামে টগর ফুল।।”

প্রাচীনকালে, অভিজাত পরিবারের বিয়ের শোভাযাত্রা যুদ্ধযাত্রারই মতোই ছিল। কারণ একটা সময় পর্যন্ত জোর করে তুলে আনা বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করতো বিজয়ী গোষ্ঠীর ছেলেরা, এমনটাই নিয়ম ছিল। ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-তে দেখা যায় তখনকার বিয়েতে জয়ঢাকও বাজানো হত। এই ছড়াটিতে তেমনই একটি বিবাহযাত্রার কথা বলা হয়েছে। মূল ছড়ার প্রথম অংশটি ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা।

সপ্তগ্রামের বাগদি রাজা হরিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তাঁর ছিল বাগদি আর ডোম সেনা। বাগদি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে, আর ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। রাজনগরের সামন্তরাজাদের এবং বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের এই ডোম সেনা ছিল। এখানে ‘আগডোম’ মানে অগ্রবর্তী ডোম সেনাদল, ‘বাগডোম’ মানে পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা আর ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী ডোম-সেনাদল। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেই এই ডোম-সেনারা আগে গিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে আসতেন, পথ তৈরি করতেন এবং ঘোড়ায় চড়ে সমস্ত পরিস্থিতি নজরে রাখতেন আর সেই খবর পৌঁছে দিতেন রাজাকে। এরা হলেন রাঢ় অঞ্চলের অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যাদের নির্ভীক আত্মবলিদানের জোরেই সমাজের ওপর তলার রাজা-মহারাজারা যুদ্ধজয় করছে। ইতিহাসে রাজারাজড়ার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের মতো মাঠে নেমে যুদ্ধ জেতানোর কারিগরদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি সেখানে। তাদের বীরত্বের কথা, যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কথা তুলে ধরা আছে এই সব ছড়ায়, প্রবাদে, বাংলার লোকসঙ্গীতে আর লোকগাথায়।

দেশে ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পর বাংলার একান্ত নিজস্ব ছড়াগুলিতে বিদেশি শব্দ, বিশেষতঃ ইংরাজি শব্দের অনুপ্রবেশও ঘটেছে। এমনই একটি পরিবর্তিত রূপ নীচে দেওয়া হল। এটিও আমাদের খুব চেনা একটি ছড়া, তবে ইংরাজি কথাগুলো বোঝার সুবিধার্থে ইংরাজি হরফেই লেখা হল, যা থেকে এর অর্থ খুব সহজেই অনুধাবন যোগ্য হয় –

“I COME, ভাই COME তাড়াতাড়ি,
যদু MASTER শ্বশুরবাড়ি।
RAIN (/RAIL) COME ঝমাঝম,
পা পিছলে আলুর দম”।

সময়ের চালচিত্র এভাবেই ধরে রেখে আমাদের সমাজজীবনের জীবন্ত দলিল হয়ে আছে এইসব ছড়াগুলি।
—————————————————————-
তথ্যসূত্র :
বাংলার লোকসাহিত্য (দ্বিতীয় খণ্ড) – ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *