চোরাই ধন – ষষ্ঠ অংক
ষষ্ঠ অংক
সুনেত্রা, সুধীর
সুধীর– সুনি, ও সুনেত্রাদেবী কোথায় গেলে? এদিকে এসো।
সুনেত্রা– বলো, এখন সন্ধ্যাবেলা… বেড়োচ্ছ?। হাঁক ডাক করছ কেন?
সুধীর– আরে না , ঐ শৈলেন এসেছে মানে আমিই ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
সুনেত্রা–ও
সুধীর– শৈলেনকে বললাম, গণিতে আমার যে টুকু দখল আছে তাতে হাল আমলের ফিজিক্সের তল পাই নে। তাই আমি ও অরুণা…
সুনেত্রা– বুঝেচি, ধরেই নিয়েছ শৈলেন তোমার মেয়ের উপযুক্ত কান্ডারী। তাই ত?
সুধীর– মন্দ কি, হা হা হা তবে আমারও কোয়ান্টাম থিওরী একটু বুঝে নিতে চাই অরুণার সাথে সাথে।
সুনেত্রা– অরুণা আমারও মেয়ে।
সুধীর– হা হা হা, মিটিয়রলজিস্ট তোমার মুখ দেখলে ঝড়ের সিগনাল দিতো।
সুনেত্রা– ঠাট্টা করো না, কেন তুমি শৈলেনকে অমন করে প্রশ্রয় দাও বারে বারে?
সুধীর –প্রশ্রয় দেবার লোক অদৃশ্যে আছে ওর অন্তরাত্মায়।
সুনেত্রা– ওদের দেখাশোনাটা কিছুদিন বন্ধ রাখতে পারলে এই ছেলেমানুষিটা কেটে যেতো, আপনা হতেই।
সুধীর– ছেলেমানুষির কসাইগিরি করতে যাবই বা কেন। দিন যাবে, বয়স বাড়বে, এমন ছেলেমানুষী আর ত ফিরে পাবে না কোন কালে।
সুনেত্রা– তুমি গ্রহ নক্ষত্র মানো না, আমি মানি, ওটা না মিললে,ওরা মিলতে পারে না।
সুধীর– গ্রহ নক্ষত্র কোথায় কিভাবে মিলেছে চোখে পড়ে না, কিন্ত ওরা দুজনে যে মিলেছে অন্তরে অন্তরে সেটা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্ট করে।
সুনেত্রা– তুমি বুঝবে না আমার কথা, যখনই আমরা জন্মাই, আমাদের যথার্থ দোসর ঠিক হয়ে থাকে।
সুধীর — ও বটে, তাই?
সুনেত্রা– হু মশাই। মোহের ছলনায় যদি আর কারোকে স্বীকার করে নিই তবেই ঘটে অজ্ঞাত অসতীত্ব।
সুধীর– যথার্থ দোসর চিনব কি করে?
সুনেত্রা– নক্ষত্রের স্বহস্তে সাক্ষর করা দলিল আছে যে।
সুধীর– নাঃ। আর লুকোনো যাবে না।
সুনেত্রা– মানে?
সুধীর– আজ একুশ বছর আমরা নানা সুখে দুখে জীবন কাটিয়ে এসেছি। আমরা কি পরস্পরকে ভালবেসে থাকি নি?
সুনেত্রা– আহা। এটা আবার কি কথা ?
সুধীর– এটাই মূল কথা।
সুনেত্রা– মানে? এর অর্থ কি?
সুধীর– সুনি , তুমি আমাকে যথার্থ দোসর বলে মানো ত?
সুনেত্রা– তা আর বলতে মশাই। আবার প্রশ্ন ! উত্তর দিতে হবে নাকি? হা হা হা…
সুধীর– তোমার গ্রহতারা যদি না মানে?
সুনেত্রা– নিশ্চয়ই মানে। আমি বুঝি জানি নে।
সুধীর– এতদিন ত একসঙ্গে কাটল, কোন সংশয় কী জেগেছে মনে?
সুনেত্রা– দেখো,অমন সব বাজে কথা জিজ্ঞেস করো যদি, রাগ করব, বলে দিচ্ছি
সুধীর– আমাদের আটমাসের ছেলেটি মারা গিয়েছিল, দাদা, বাবার উইল জাল করে সব সম্পত্তি দখল নিলেন।কত অঘটন গেছে।
সুনেত্রা– এসব কথা কেন?
সুধীর– তুমি ত আমার দেহসৌষ্ঠবে মুগ্ধ ছিলে, বলো? যদিও এখন আর তা নেই।
সুনেত্রা– আচ্ছা…
কি বলতে চাও বলোত?
সুধীর– যদি বলি, আমাদের গ্রহ নক্ষত্রের কোন মিল ছিল না বিবাহের পক্ষে!
সুনেত্রা– উঃ, বললেই হলো। বাবা নিজে মিলিয়েছেন। তা ছাড়া আমিও দেখে বিবাহে মত দিয়েছিলাম।
সুধীর– ব্যাপার হলো, আমাদের বিবাহ সংঘটনে তোমার মায়ের ইচ্ছা ও আশীর্বাদ সবচেয়ে প্রধান ছিল, না হলে হতো না।
সুনেত্রা– বুঝলাম না , আমার মা?
সুধীর– হ্যাঁ, হ্যাঁ,তোমার মা– স্বর্গীয়া বিভাবতী দেবী।
সুনেত্রা– মা!!! মা ত গ্রহ নক্ষত্র মানতেন না, শুধুমাত্র ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করতেন।
সুধীর– হ্যাঁ,তাই, সেটাই ত।
সুনেত্রা– তাহলে। মায়ের কথা কেন? এখানে আমাদের বিবাহে মায়ের ভূমিকা কোথায়?
সুধীর– অন্তরে, সহ্য করতে পারবে চরম সত্যটা, সুনি?
সুনেত্রা– কি সত্য?পারব। তুমি বলো।
সুধীর–আগে বলো, সব দুঃখ-দুর্লক্ষনের চেয়ে ভালবাসা যে বড়ো, আমাদের জীবনে তার কি প্রমাণ হয় নি?
সুনেত্রা– নিশ্চয়ই, নিশ্চয় তা হয়েছে।
সুধীর– তবে আসল কথাটি শোনো, যদি আমাদের গ্রহ নক্ষত্রের মিল না হতো, তুমি বিবাহ করতে না, ঠিক ত?
সুনেত্রা– হু, হয়ত ঠিক। কিন্ত বাবা ও আমি বার বার মিলিয়ে যে রাজযোটক পেয়েছি। বিবাহ তাই ত হয়েছে। আজ এ প্রশ্ন কেন?
সুধীর– মা বিশ্বাস করতেন তাঁর ইষ্টদেবতাকে, আর জানতেন আমাদের পরস্পরের ভালবাসা , আর…
সুনেত্রা– থামলে কেন, বলে যাও।
সুধীর– তিনি তোমার ঠিকুজি গোপনে দিয়েছিলেন আমায়, আর….
সুনেত্রা– মা? মা দিয়েছিলেন তোমায়, কিন্ত কেন?
সুধীর– না। চমকে যেয়ো না, আসলে চোর আমি।
সুনেত্রা– চোর? কি যে বলছ সব, এর অর্থ কি?
সুধীর– মা গোপনে তোমার ঠিকুজির খসড়া এনে আমায় দিয়ে বলেছিলেন, এর সাথে রাজযোটক মিল করে তোমার ঠিকুজি করে আনো। তাই আমার ঠিকুজি ছিল নকল–যা তোমরা মিলিয়েছিলে।
সুনেত্রা– (হাসি) ও ….মানে আমার ঠিকুজি মা তোমাকে দিয়েছিলেন। কিন্ত এ ত শুধু চুরি নয়। এর সাথে জালিয়াতি,ছলনাও আছে!!!
সুধীর — হাসছ তুমি সুনি!!
সুনেত্রা–আজ এতদিন বাদে সত্যি হাসি পাচ্ছে। আমার স্বামী একজন চোর , জালিয়াত। হা হা হা।
সুধীর– হ্যাঁ। ছলনা করেছি, শুধুই তোমাকে পাবার জন্য।
সুনেত্রা– হ্যাঁ, ছলনা ত বটেই, তবে মায়ের ইষ্ট দেবতার ইচ্ছেতেই।
সুধীর– কিন্ত বলো , বলো আমরা কি অসুখী আজ পর্যন্ত।
বলো বলো সুনি….
সুনেত্রা– না আর কিছু বলতে হবে না। কিন্ত — না বললেই পারতে।
সুধীর– কেন?
সুনেত্রা– এখন থেকে আমায় সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে।
সুধীর– কিসের ভয়?
সুনেত্রা– ভয়? বৈধব্যযোগের।
সুধীর– ওঃ ,রাগ করলে, আমার অপরাধ ক্ষমা করে দাও সুনি।
সুনেত্রা–না, আর রাগ, ভয় কিসেরই বা, আমি যদি তোমাকে ফেলে আগে চলে যাই তাহলে আমার মৃত্যু হবে দ্বিগুণ মৃত্যু।
সুধীর– ক্ষমা করো আমার এ অপরাধ ক্ষমা করে দাও সুনি।
সুনেত্রা– অপরাধ। (হাসি), একটা চোরের উপর রাগ করে কি আমি মাটিতে ভাত খাবো?
সুধীর– আমার চোরাই ধন ত বাড়িতেই আছে । চোরের বউ তুমি। মাটিতে ভাত খাবে কেন?
সুনেত্রা– থাক অনেক হয়েছে। শোনো, তুমি বরং শৈলেনকে বলো, আজ রাতে এখানেই খেয়ে যাবে, এ আমার হুকুম।
সুধীর– হা হা হা, তাহলে শৈলেনকে তুমিও প্রশ্রয় দিচ্ছো সুনি?
সুনেত্রা– অ্যাঁ। হ্যাঁ, প্রশ্রয়। তা এখন তুমি বলতে পারো।
সুধীর, সুনেত্রা– এক সঙ্গে হাসি….
[গান–আজ আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও….]