চুয়াচন্দন – পর্ব ৮
রাত্রি তিন প্রহরে, চুয়ার বাড়ির দালানে পাইক দুই জন বসিয়া বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। একজন দেয়ালে ঠেস দিয়া পদযুগল প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল। দ্বিতীয় ব্যক্তি ঘুমের ঘোরে কখন কাৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল; তাহার নাসারন্ধ্র হইতে কামারের হাপরের মতো একপ্রকার শব্দ নির্গত হইতেছিল।
চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার; কিন্তু অন্ধকারে চক্ষু অভ্যস্ত হইলে কিছু কিছু দেখা যায়। চন্দনদাস নিঃশব্দে ছায়ার মতো দালানে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বাঁ হাতে সেই ক্ষুদ্র ছোরা। কিয়ৎকাল মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া সে পাইকের নাসিকাধ্বনি শুনিল তারপর দালানের গাঢ়তর অন্ধকারের ভিতর তাহার চক্ষু বস্তু নির্বাচন করিতে আরম্ভ করিল।
যে পাইকটা বসিয়া বসিয়া ঘুমাইতেছে, তাহার পদদ্বয় ঠিক দরজার সম্মুখে প্রসারিত; ভিতরে প্রবেশ করিতে হইলে তাহাকে লঙ্ঘন করিয়া যাইতে হইবে। তা ছাড়া দরজার কবাট ভেজানো রহিয়াছে, ভিতর হইতে অর্গলবন্ধ কি না বুঝা যাইতেছে না। চন্দনদাস ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে হাত বাড়াইয়া কবাট একটু ঠেলিল। মরিচাধরা হাঁসকলে ছুঁচার ডাকের মতো শব্দ হইল। দরজা ঈষৎ খুলিল।
হাঁসকলের শব্দে পাইকের হাপর হঠাৎ বন্ধ হইল। চন্দনদাসস্পন্দিত-বক্ষে ছোরা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিন্তু পাইক জাগিল না, আবার তাহার নাক ডাকিয়া উঠিল।
চন্দনদাস তখন আবার কবাট একটু ঠেলিল, কবাট খুলিয়া গেল। এবারও একটু শব্দ হইল বটে, কিন্তু কেহ জাগিল না। তখন চন্দনদাস ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করিয়া নিঃশব্দে পাইকের পদযুগল লঙ্ঘন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
আঙ্গিনায় উপস্থিত হইয়া চন্দনদাস চারিদিকে চাহিল। সম্মুখে কয়েকটা ঘর অস্ফুটভাবে দেখা যাইতেছে। কিন্তু কোন্ ঘরে চুয়া ঘুমাইতেছে? চাঁপাও বাড়িতে আছে; চুয়াকে খুঁজিতে গিয়া যদি চাঁপা জাগিয়া উঠে, তবেই সর্বনাশ। চন্দনদাস কি করিবে ভাবিতেছে, এমন সময় তাহার হাতে মৃদু স্পর্শ হইল।
চন্দনদাস চমকিয়া উঠিয়া অজ্ঞাতসারেই ছোরা তুলিল। এই সময় তাহার কানে কাছে মৃদু শব্দ হইল, “এসেছ?”
“চুয়া!” কোমরে ছোরা রাখিয়া চন্দনদাস দুই হাতে দুয়ার হাত ধরিল, বলিল, “চুয়া! এসেছি।”
চুয়ার নিশ্বাসের মতো মৃদু চাপা স্বর থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল; সে বলিল, “তুমি আসবে বলেছিলে, তাই আমি তোমার জন্য সারা রাত জেগে আছি।”
অন্য সময় কথাগুলি অভিসারিকার প্রণয়বাণীর মতো শুনাইত; কিন্তু বিপদের মাঝখানে দাঁড়াইয়াও চন্দনদাসের মনে হইল, এত মধুর শব্দসমষ্টি সে আর কখনও শুনে নাই। চুয়ার মুখখানি দেখিবার জন্য তাহার প্রাণে দুর্দমনীয় আকাঙ্খা জাগিতে লাগিল। অথচ অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। চন্দনদাস চুয়ার কানে কানে বলিল, “চুয়া, একটা আলো জ্বালতে পারো না? তোমাকে বড় দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
দু’জন অন্ধকারে হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, চুয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, “আচ্ছা, এসো।”—বলিয়া হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। চন্দনদাস তেমনই মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “চাঁপা কোথায়?”
“ঘুমুচ্ছে।”
“ঠান্দি?”
“ঠান্দিও ঘুমিয়ে পড়েছে।”
গোহালের মতো একটা পরিত্যক্ত ঘরে লইয়া গিয়া চুয়া চকমকি ঠুকিয়া আলো জ্বালিল। তখন প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে চুয়ার মুখ দেখিয়া চন্দনদাস চমকিয়া উঠিল—চোখ দুটি জবাফুলের মতো লাল, চোখের কোলে কালি পড়িয়াছে; আশা, আশঙ্কা ও তীব্রোৎকণ্ঠার দ্বন্দ্বে চুয়ার অনুপম রূপ যেন ছিঁড়িয়া ভাঙ্গিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে।
চন্দনদাসের বুকে বেদনার শূল বিঁধিল, সে বাষ্পাকুল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “চুয়া!”
চুয়া মাটিতে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল; রোদনরুদ্ধ স্বরে বলিল, “তোমার নৌকো চলে গেছে শুনে এত ভয় হয়েছিল!”
চন্দনদাস চুয়ার পাশে বসিয়া আর্দ্রকণ্ঠে বলিল, “চুয়া, আর ভয় নেই। তোমার উদ্ধারের সমস্ত ব্যবস্থা করেছি।”
চুয়া চোখ মুছিয়া মুখ তুলিল, “কি?”
চন্দনদাস বলিল, “বলছি। আগে বলো দেখি, তুমি সাঁতার কাটতে জানো?”
অবসাদ-ভরা সুরে চুয়া বলিল, “জানি। তাই তো ডুবে মরতে পারিনি। কতবার সে চেষ্টা করেছি।”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইল, চুয়াকে বুকে জড়াইয়া লইয়া সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সে লোভ সংবরণ করিল, বলিল, “ও কথা ভুলে যাও, চুয়া, বুকে সাহস আলো। আমি এসেছে দেখেও তোমার সাহস হয় না?”
চুয়া কেবল তাহার কালিমালিপ্ত চোখ দুটি তুলিয়া চন্দনদাসের মুখের পানে চাহিয়া রহিল; হয়তো নিজের একান্ত নির্ভরশীলতার কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে চাহিল, কিন্তু বলিতে পারিল না। চন্দনদাস তখন সংক্ষেপে প্রাঞ্জলভাবে উদ্ধারের উপায় বিবৃত করিয়া বলিল; চুয়া ব্যগ্র বিস্ফারিতনয়নে শুনিল। শুনিতে শুনিতে তাহার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগল।
চন্দনদাসের বিবৃতি শেষ হইলে চুয়া কিছুক্ষণ হেঁটমুখে নীরব হইয়া রহিল। লজ্জা করিবার সে অবকাশ পায় নাই,—হৃদয়ের তুমুল আন্দোলনের মধ্যে এই তরুণ উদ্ধারকর্তাটিকে সে যে কি দৃষ্টিতে দেখিয়াছে, তাহা নিজেই জানিতে পারে নাই। তাই উদ্ধারের আশা তখন সংশয়ময় চিত্তে আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, চন্দনদাসের পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়িল। দুই হাতে পা জড়াইয়া কাঁদিয়া কহিল, “একটা কথা বলো।”
চন্দনদাস চুয়ার মুখ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টার করিতে করিতে বলিল, “চুয়া, চুয়া, কি কথা?”
“বলো, আমায় বিয়ে করবে? তুমি আমায় প্রবঞ্চনা করছ না?”
চন্দনদাস জোর করিয়া চুয়ার মুখ তুলিয়া তাহার চোখের উপর চোখ রাখিয়া বলিল, “চুয়া, আমার মায়ের নামে শপথ করছি, তোমাকে যদি বিয়ে না করি, যদি আমার মনে অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকে, তবে আমি কুলাঙ্গার।”
চুয়ার মাথা আবার মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। তারপর সে চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল, বলিল, “তবে আমাকে এখনই নিয়ে যাচ্ছ না কেন?”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইতেছিল, এখনই এই কারাগার হইতে চুয়াকে মুক্ত করিয়া লইয়া পলায়ন করে; কিন্তু সুবুদ্ধি নিষেধ করিল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে, ধরা পড়িবার সম্ভাবনা বড় বেশি। সে মাথা নাড়িয়া বলিল, “না—এখন ভরসা হয় না। বাড়ির দোরে পাহারা—যদি ওরা জেগে ওঠে।—কিন্তু আমার এখানে আর থাকা বোধ হয় নিরাপদ নয়—চাঁপার ঘুম ভাঙতে পারে।”—বলিয়া চন্দনদাস অনিচ্ছাভরে উঠিয়া দাঁড়াইল।
চুয়ার মনে আবার ভয় প্রবেশ করিল। সম্মুখে সমস্ত দিন পড়িয়া আছে; কি জানি কি হয়! সে ভয়-কাতর চক্ষু দুইটি তুলিয়া বলিল, “যাচ্ছ?—কিন্তু—“
“কোনও ভয় নেই, চুয়া।”
“কিন্তু—যদি বিঘ্ন হয়—যদি—একটা জিনিস দিতে পারবে?”
“কি?” একটু বিষ। যদি কিছু বিঘ্ন হয়—“
চন্দনদাস কিছুক্ষণ শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে নিজের চুল হইতে সেই কাঁটা বাহির করিয়া দিল। গাঁঢ়স্বরে বলিল, “চুয়া, যদি দেখ কোনও আশা নেই তবেই ব্যবহার করো, তার আগে নয়।”—বলিয়া কাঁটার ভয়ংকর কার্যকাতিতা বুঝাইয়া দিল।
এতক্ষণে চুয়ার মুখে হাসি দেখা দিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রোজ্জ্বল চক্ষে বলিল, “আর আমি ভয় করি না।”
চন্দনদাসের মুখে কিন্তু হাসির প্রতিবিম্ব পড়িল না। সে চুয়ার দুই হাত লইয়া বুকের উপর রাখিয়া বলিল, “চুয়া—“
বাক্পটু চন্দনদাস ইহার অধিক আর কথা খুঁজিয়া পাইল না।
চুয়া অশ্রু-আর্দ্র হাসিমুখ একবার চন্দনদাসের বুকের উপর রাখিল, অস্ফুটস্বরে কহিল, “চুয়া নয়—চুয়া বউ। এই আমদের বিয়ে।”
ঘরের বাহিরে আসিবার পর একটা কথা চন্দনদাসের মনে পড়িল, সে বলিল, “ঠান্দির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তাকে ব’লো—কাল সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে পালিয়ে যেন নিমাই পণ্ডিতের বাড়িতে যায়। সেখানে দু’-এক দিন লুকিয়ে থাকবে, তারপর আমি তাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।”
গ্রীষ্মের হ্রস্ব রাত্রি তখন শেষ হইয়া আসিতেছে। কাক-কোকিল ডাকে নাই, কিন্তু বাতাসে আসন্ন প্রভাতের স্পর্শ লাগিয়াছে। পূর্বাকশে শুকতারা দপ্ দপ্ করিয়া জ্বলিতেছে।
আঙ্গিনায় দাঁড়াইয়া চন্দনদাস আর একবার চুয়ার দুই হাত নিজের বুকে চাপিয়া লইল। তারপর যে ভাবে আসিয়াছিল, সেই ভাবে ছায়ামূর্তির মতো বাহির হইয়া গেল।
পাইক দুই জন শেষ রাত্রির গভীর ঘুম ঘুমাইতে লাগিল।