চিলেকোঠার ভূত
বিশাখাপত্তনমে পৌঁছাতে প্রায় ভোর ছ’টা বেজে গেল । মোটঘাট নিয়ে গৌরকিশোর চললেন সমুদ্রের ধারের ভাড়া বাড়িতে । সাথে স্ত্রী মালতী, আর মেয়ে সবিতা। আর দুই ছেলে,পাটাই আর নিতাই। ভজহরি ও সাথে আছে । বহুদিনের কাজের লোক ভজহরি । কাজের লোক হলেও গৌরকিশোর এর ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী । বিশাখাপত্তনম এ ঘরের ব্যবস্থা করেছেন পাড়াতুতো দাদা নন্দলাল বসু । থাকেন বিশাখাপত্তনমে। নন্দলাল দা কে লিখেছিলেন গৌরকিশোর। – নন্দ দা, তোমার বৌমার শরীর খারাপ। বায়ু পরিবর্তন দরকার । ওখানে একটা ঘরের ব্যবস্থা করো। সেই কথায় কাজ হয়েছে । ঘর জোগাড় হয়েছে । স্টেশন এ ওদের নিতে এসেছেন। নন্দলাল অবিবাহিত থেকে বছর আটের বড় হয়ে ও ছেলেমেয়েদের কাকুই রয়ে গেছেন । ছেলেমেয়েদের মুখের ঐ কাকু ডাক টা ওদের দিদিমা সইতে পারতেন না তাই রাগ করে বলতেন। কাকু কস কেন দাদু “ক” । নাইলে জ্যাঠা “ক” । দিদিমার কথায় ফোড়ন কেটেছে সবিতা । – দাদু মানে তো তোমার বর । তার মানে নন্দকাকুকে তোমার পছন্দ। দিদিমা হেসে মুখ ভেংচেছেন। – আঁ -হাঁ -কি একখান কথা ! ভাড়া বাড়িতে পৌঁছে সকলেই খুশী । ফরাসী আমলের বাড়ি । লালচে রংয়ের আর্চ করা দোতলা বাড়ি । দোতলার বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে । হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল ছেলেমেয়েদের। ভজু বাদে সকলের ‘মন পসন্দ ‘ এ বাড়ি । ভজুর না পছন্দ হবার কারণ ভজুই বলেছে ।- এত বড় বাড়ি এখানে কি হবে ?পরিস্কার করা কি চাট্টিখানি কথা ! ওর কথায় গৌরকিশোর বললেন- কোলকাতায় তো এত বড় বাড়িতে থাকতে পাস না । থাকতেন না এখানে । তারপর সবিতা কে বলেছেন- সবিতা, ভাইদের দেখাশোনা করা তোমার দায়িত্ব। কখনও ছাতে যাবে না,আর সমুদ্রের ধারে ও যাবে না । কুবুদ্ধির রাজা পাটাই। তা জেনেই সবিতা বলেছে- পাটাই, নিতাই যদি কথা না শোনে ?
– তখন আমায় বলবে । নিতাই, পাটাই দিদির কথা শুনবে। পুরনো বাড়ি তাই জানালা দরজার অবস্থা ভাল নয় । ছেলেমেয়েরা সমুদ্রের ধারের থেকে ঘুরে এসেই চিৎকার শুরু করেছে- ও ভজুদা, খেতে দাও ।
ঘুলঘুলির ভুত
বেশ কিছুদিন পরের কথা । সবিতা দুপুরে একখানা গল্পের বই হাতে শুয়েছে । নিঝুম দুপুর । গা ছম্ ছম্ করা একখানা গল্পের বই হাতে ।বইয়ে ডুবে গেছে সবিতা । এমন সময়ে কানে এল পাটাই এর গলা
– এই দিদি, ছাতে যাবি ? এই পাটাই! ঘুমাস নি এখনও? বাবা বকবে।
– নারে দিদি, বাবা জানতেই পারবে না । ভাই এর অনুরোধ আর ছাত থেকে সমুদ্র দেখার লোভেই রাজি হয়েছে সবিতা । দুজনেই তর তর করে উঠে গেছে সিঁড়ি ধরে ।
– একি! পাটাই, দরজা তো পেরেক পুঁতে বন্ধ করে রেখেছে।
– এই দ্যাখ্, আমি খুলে দিচ্ছি ।
– তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে ? বহুদিন ধরেই বন্ধ হয়ে আছে দরজাটা ।
– হোক না। “না পেরু পাটাই “। অর্থাত আমার নাম পাটাই । পাটাই এর গলার স্বরে চমকে উঠেছে সবিতা ।
– এ ভাষা তুই কোথায় শিখলি রে ? এটা তো তেলেগু ভাষা ।
– বলব কেন? কথা বলতে বলতেই একটানে দরজা খুলে ফেলেছে পাটাই । সবিতা পাটাই এর দরজা খোলার ভঙ্গী দেখে আশ্চর্য । আশ্চর্য হয়েই পাটাই কে বলেছে।
– তুই তো ভেল্কি দেখাচ্ছিস পাটাই!!দরজা টা কি খোলাই ছিল? কোন উত্তর না দিয়েই পাটাই ছাতের এক কোন থেকে আর এক কোনে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল। পাটাই যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছে । সবিতা চিৎকার করে বলল। – কি হচ্ছে পাটাই !!
ছাতের চিলেকোঠায় অনেক গুলো চোরাকুঠুরি। সেই চোরা কুঠুরিতে অসংখ্য ঘুলঘুলি রয়েছে । পায়রা গুলো ডানা ঝটপটিয়ে উড়ছে । আবার ঢুকে যাচ্ছে ঘুলঘুলিতে । একটা কুঠুরি তে ঢুকে আবার আর একটা কুঠুরিতে ঢোকা যায় । সবিতার গা ছম্ ছম্ করে ওঠে । ভাবে নেমে যাবে । কিন্তু বের হতে পারে না । এ কি গোলকধাঁধা রে বাবা ! বাবার কাছে শুনেছিল লক্ষৌ -এর ভুলভুলাইয়া-র কথা । এ তো তেমন ই মনে হচ্ছে, ভয়ে চিৎকার করে উঠল সবিতা ।- পাটাই, তুই কোথায় ? সে কথা পাটাই এর কানে গেল কিনা কে জানে! এই কুঠুরি থেকে সেই কুঠুরি ঘুরতে ঘুরতে সবিতার দম বন্ধ হবার জোগার । হঠাৎই কানে এল চিঁ চিঁ শব্দ ।
– আক্কা, নেনু ইক্কড়া । ইদি চুড়ু । অর্থাত দিদি আমি এখানে। এই দেখ। সবিতার নজর ওপরের ঘুলঘুলিতে । কেমন ছোট্ট হয়ে বসে আছে পাটাই । সবিতা চিৎকার করে ওঠে- পাটাই নাম বলছি । বাবাকে বলে দেব। আবার ও সেই চিঁ চিঁ শব্দ। ভর দুপুর তখন। হঠাৎই মনে হল রাত হয়ে গেল। আলো জ্বলে উঠল । গলা শুকিয়ে কাঠ সবিতার। গোঁ গোঁ করে শব্দ হতে থাকে সবিতার মুখ দিয়ে। মায়ের ধাক্কায় চোখ মেলল সবিতা ।
– কি হয়েছে মা ?
– তুই কি স্বপ্ন দেখছিলি? গোঁ গোঁ করছিলি।
গৌর হরি বলেন- ভজুর যতো সব কান্ড। ভুতের গল্প করে এই করেছে । নজর গেল বাবা আর মায়ের দিকে । দুজনেই ঝুঁকে পড়েছে সবিতার মুখের ওপরে। বিছানায় শুয়ে আছে সে । সবিতার চোখে মুখে জল দিয়েই পাটাই আর নিতাই এর কাছে এসেছে। পাটাই নিতাই কে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এই যদি হবে তাহলে ছাতের পাটাই কে? ওটা কি সত্যিই পাটাই না ? সত্যিই কি সবিতা স্বপ্ন দেখছিল। সিঁড়ি টাই দেখা যাক না । এগিয়েছে সিঁড়ির দিকে, ওমা ! এতো সেই দেখা দরজার মতোই দরজা । কিন্তু এখন কথা কারোকে বলা যাবে না। তাহলে ভাই রা ভয় পাবে। সবিতা ফিরে এসেছে সিঁড়ির থেকেই। ভয়ে ঘাড় শিরশির করেছে। পায়রার ঝটপটানি শুনেই,তরতরিয়ে লাফিয়ে নেমেছে দোতলায় । স্বপ্ন দেখেনি । এ বাড়িতে ভুত আছে। মায়ের শরীর খারাপ ।ভজুদার পেট পাতলা ।তাই মুখ বন্ধ করতে হয়েছে । তাতে সবিতার মন দুর্বল হয়ে পড়েছে । একটা ভয় জুজুর মতো তাড়া করেছে সব সময়েই। মেয়ের শুকনো মুখ দেখে মায়ের জিজ্ঞাসার উত্তর মেলেনি ।
বিড়াল খেঁকো ভুত।
বেশ কিছুদিন পর গৌরকিশোর ছেলেমেয়েদের জন্য সুন্দর সুন্দর পাথরের পুতুল নিয়ে এলেন । একটা বিকট মুখের পুতুল দেখিয়ে সবিতা বলল ।- বাবা এটা কিগো?
– দক্ষিণ ভারতের লোকেরা এটা ঘরে রেখে দেয় । যাতে কারো কু দৃষ্টি না পড়ে সেই জন্য। সবিতা ভাবল, ভাল ই হলো আজ থেকে এই বিভৎস মূর্তিটাই ওদের রক্ষা করবে। মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে সবিতা । মূর্তি নয় , একটা বিকট মুখ । মাথার চার পাশে সূর্যের ছটা। গজাল দাঁত আর ইঁয়া বড়া গোঁফ। তার রক্তাভ চোখ দেখলে ভয় হবে। পুতুল টায় নিমগ্ন হয়ে গেছে সবিতা । বাবার ধমক কানে এল।
– কি হল পাটাই? ঝগড়া করছ কেন?
– দেখো না বাবা, দাদা ঐ ঘোড়সওয়ারী পুতুল টা দিচ্ছে না ।
– পাটাই , ভাই কে দিয়ে দাও। পাটাই- না ,আমি ওটা নেব । গৌরকিশোর- ঠিক আছে, কারো কে ই নিতে হবে না। বলেই এক টানে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঐ পুতুল টা ,একেবারেই জঙ্গলের দিকে। পাটাই এর চোখে জল এসে গেল অমন একটা পুতুল হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায়। নিতাই এর ও কষ্ট হল পুতুল টা না পেয়ে । কিন্তু দাদা ওটা পায় নি তাতেই কষ্ট টা লাঘব হল। এ দিকে ঐ মূর্তিটা থাকায় সবিতার সাহস বেড়েছে । ভূতের ভয় কমেছে । তবুও অন্ধকারে ভূতের ভয় কমেছে। খাটের নিচে মনে হয় ভূত লুকিয়ে আছে । ভয়ে পা গুটিয়ে বসে। সেদিন পড়তে পড়তে বেশ একটু রাত হয়ে গেল। ভজহরি দুধ হাতে নিয়ে দাঁড়াল । হাত বাড়িয়ে বলল – এই নাও, দুধ টা খেয়ে নাও।
সবিতা বলল- ভজুদা ,তুমি একটু বসবে ? আমার একা ভয় করছে ।
– কেন ভয় করতিছে? আচ্ছা বসছি। তুমি পড় । বেশ মন লাগিয়ে পড়ছে সবিতা । হঠাৎই কেমন যেন খৎ খৎ শব্দ হল। সবিতা দেখে ভজহরির জায়গাতে পাটাই বসে আছে ।
– এই পাটাই ভজুদা কোথায় গেল রে?
– নেনু ভজহরি ,ইদি চুড়ু । পাটাই বেলপোইন্দি ।অর্থাত আমি ভজহরি,এই দেখ, পাটাই চলে গেছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে সবিতার। হ্যাঁ ঠিকই তো !ঐ তো ভজহরি ঝিমুচ্ছে। এ কি দেখছে সবিতা ! তবে কি নিজেই ঘুমোচ্ছে ? চিৎকার করে ডাকে- ও ভজু দা । সবিতার ডাকে ভজহরি মুখ ফেরাল সবিতার দিকে । আঁতকে উঠল সবিতা । এ কোন ভজহরি ! গালের মাংস ঝুলে পড়েছে । হিঁ হিঁ করে হাসছে ।সাপের মতোই লকলকে তিন খানা জিভ্। মুখ থেকে বেরোচ্ছে আর ঢুকছে । হঠাৎই একখানা বিড়াল ছানা বের হল মুখ থেকে । ম্যাঁ ও করে হাঁটতে হাঁটতে এগুলো । লক লকে জিভ্ বার করে সু-ত করে বিড়াল ছানাকে মুখে টেনে নিল ভজহরি । গজ দন্ত দিয়ে বিড়াল এর পেট ফুটো দিল । এরপর বিড়াল এর পেঁচানো পেঁচানো নাড়ি ভুড়ি ঝুলতে লাগল ভজহরির মুখ থেকে । বিড়াল এর মাথাটা হাতে রেখে সমস্ত দেহ টা খেয়ে ফেলল। হাতের মাথাটা সবিতাকে দেখিয়ে বলল- তিন্টোয়া ? অর্থাত, খাবে? সকালে জ্ঞান ফিরতে, দেখল বাবা আর মা ওর মাথার কাছে বসে। ভজহরির দিকে নজর পড়তেই আবার জ্ঞান হারিয়েছে সবিতা । অসুস্থ সবিতার ঘরে পাটাই আর ভজহরির ঢোকা বারণ । দিদি ঘুমালে পাটাই দিদির মাথার কাছে বসেছে । ছেলের চোখের জল দেখে মালতী সান্ত্বনা দিয়েছেন- যা ,শুয়ে পড় গিয়ে । দিদি ভাল হয়ে যাবে । ক্রমে ক্রমে স্বাভাবিক হয়েছে সবিতা ।
ঘোড়সওয়ারী ভূত
একমাস ও পেরোয় নি। আবার আর এক কান্ড । দুপুরে বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। গরম হাওয়া বইছে । ঘুম আসেনা নিতাই এর। মনে হচ্ছে সেই ঘোড়সওয়ারী পুতুল টার কথা । খুঁজলে কেমন হয় ? দাদা কে ডাকলো। – এই দাদা,জঙ্গলে ঐ ঘোড়সওয়ারী পুতুল টা খুঁজতে যাবি?
– না । আবার তুই ঝগড়া করবি ।
– সত্যিই বলছি ,আর ঝগড়া করব না । তুই নিয়ে নিস।
– বাবা যদি টের পায় ?
– চুপ করে যাব আর আসব। নিঃশব্দে খিড়কির দোর ভেজিয়ে ভেজিয়ে বেড়িয়ে গেছে ওরা দু’জনে । জংলায় ভরা মাঠ। সেখানেই ওদের বাবা ছুঁড়ে ফেলেছিল পুতুল টা । খিড়কির দোর থেকে একটা পাক খেয়ে তবে এই জঙ্গলে আসতে হয়েছ । – এইদাদা, কী সুন্দর ঘাস ওখানটায়। ঐ দ্যাখ্ একটা ছোট্ট ছেলে । ও মা ! কি সুন্দর একটা কালো ঘোড়া ।
– ওটা কে বলে টাট্টু ঘোড়া । মায়ের কাছে গল্প শুনিস নি ? চল ওর সাথে কথা বলি । দুজনেই এগিয়ে গেছে ঘোড়ার কাছে । পাটাই প্রশ্ন করেছে- তুমি কোথায় থাক গো ? ছেলেটি হাত নেড়ে বুঝিয়েছে যে, সে ওখানেই থাকে । অর্থাত সে ঐ মাঠে থাকে । নিতাই তাজ্জব বনে গেল। মাঠে কি কেউ থাকতে পারে ? ঐ ছেলের হাতে কাজু ফুল । কামরে কামরে খাচ্ছে কাজু ফুল ।
– তুমি কি খাচ্ছো গো ?
– কাজু ফুল ।
– কেমন খেতে গো ? পাটাই ধমক দিয়েছে নিতাই কে ।- হ্যাংলা কোথাকার। ও কি খাচ্ছে তাতে তোর কি ? ভাই কে সে কথা বললেও নিজে সে কথা বললেও নিজে এগিয়ে গেছে ঐ ছেলেটির দিকে । ঘোড়ার লোভে ই গেছে । জিজ্ঞেস করেছে- ঘোড়া কি তোমার ?
– না কু । হ্যাঁ আমার ।
– কি সুন্দর ঘোড়া । তাই নারে দাদা। পাটাইয়ের চোখে খুশির দৃষ্টি । মুখে বলে- হ্যাঁ। এবার আলাপ জমানার ইচ্ছায় ঐ রামনের কাছ ঘেঁষেছে দুজনে । কিন্তু রামন বাংলা জানে না । হিন্দি তেই কথা শুরু করল দুজনেই । বাকি টা অঙ্গ ভঙ্গী দিয়ে বোঝায় ।
– তোমার নাম কি?- পেরু।
– না পেরু রামণ । আমার নাম রামন। হাসতে হাসতেই পাটাই বলে- না পেরু পাটাই । মেরা ভাই, নিতাই । রামন হাসে পাটাইয়ের কথায় । তারপর বলে- বাই কাদু , তমরু। না তমরু, তেসিন্দা? ওর কথায় পাটাই বুঝে নেয় যে “তমরু” মানে ভাই । আর তেলসিন্দা মানে -” জান ” । রামন দারুণ খুশি । সেই জন্য নিজের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো ওদের সাথে । রামন পাটাই তুমি ঘোড়া চড়তে জান?
– না ভাই । কাছে থেকে কখনও ঘোড়া দেখিনি ।দূর থেকে ঘোড়ায় চড়া দেখেছি । তুমি ঘোড়ায় চড়তে জান ?
রামন- কেন জানবো না ? এই দেখ । হঠাৎই রামন ঘোড়ায় চেপে বসল । সাঁ সাঁ করে তীর বেগে ছুটল। ঘাসের সবুজ গালিচা থেকে একবারে শূন্যে উঠে গেল আকাশ পথে ।
নিতাই- এই দাদা, ঘোড়া টা হাওয়ায় পা ফেলে ছুটছে রে । তোর ভয় করছে না ?
পাটাই- তুই একটা ভীতুর ডিম । ঝাঁসির রাণীর ঘোড়ায় চড়া ছবিতে দেখিস নি ? মনে হয় না শূন্যে লাফিয়ে ছুটছে?
নিতাই- সে তো ছবিতে । দাদা, মাঠে এত ঘাস কোথা থেকে এলো রে ? একটু আগেও তো ছিল না রে!!
পাটাই- ঘাস, মাটিতে থাকবে না তো কোথায় থাকবে? বোকা কোথাকার! দাদার কথায় নিজে কে বোকা করে নি নিতাই । বরং মাথায় অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেমন যেন গা ছমছম এ ভাব এই দুপুরে । কেমন যেন একটা অজানা জায়গাতেই চলে এসেছে ওরা । কিছু পরে রামন ঘোড়া নিয়ে নিচে নেমে এসেছে । সেই একই রকম সাঁ সাঁ করে । নিতাই চকচকে ঘোড়া তে হাত লাগাবার লোভ সামলাতে পারেনি । তাই রামন কে বলে- ভাই তোমার ঘোড়ায় একটু হাত দেই?
– কেন দেবে না ? দাও না । ঘোড়ায় চড়বে ?
– নানা। একটু হাত দেব। নিতাই ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেছে। ঘোড়ার পিঠে হাত ছোঁয়াতে ই ভয় পেয়েছ নিতাই। হিম বয়ে গেছে শিরদাঁড়ায়। এ আবার কেমন ঘোড়া ! পাথরের মতো শক্ত শরীর ঘোড়ার। আবার বরফের মতো ঠান্ডা । জ্যান্ত ঘোড়ার শরীর এমন ঠান্ডা হতেই পারে না । নিতাই এর গলার স্বর কেঁপে উঠেছে ।
– এই দাদা,বাড়ি চল । বাবা জানলে কিন্তু মেরে ফেলবে।
পাটাই- এত তাড়া হুড়ো করছিস কেন ? ঘোড়ায় চড়ব না ?
নিতাই- না চড়বি না । দাঁড়া বাবাকে বলছি । বলেই নিতাই ঘরের দিকে ছুটতে থাকে ।
পাটাই- চলি, রামন। কাল আসবো। পাটাই ও ছুটেছে নিতাই এর পিছু পিছু । ধরে ফেলেছে ভাই কে । ধমকে ছে নিতাই কে ।
– তুই কেমন বল তো? যদি বা একটা বন্ধু জুটলো, দিলি তো বাগড়া । দিদির শরীর ভাল নেই বলে একে মন ভাল নেই।
নিতাই- তুই তো ঘোড়া ঘোড়া করছিস । একবার ও পুতুল ঘোড়ার টার কথা বললি ?
পাটাই- ঠিক বলেছিস তো ! যাক গে কাল আবার আসব । রামনের ঘোড়ায় চড়বো ।
নিতাই- না ।চড়বি না । ওটা ভাল ঘোড়া না ।
পাটাই- আমি চড়বোই চড়বো ।
নিতাই- ঠিক আছে আমি বাবাকে বলে দেব ।
পাটাই- আমিও বাবাকে বলে দেব তুই পুতুল ঘোড়া খুঁজতে আমাকে ডেকে এনেছিলি । খিড়কির দোরে ঝগড়া থেমেছে । পাটাই- নিতাই চল শুয়ে পড়ি নইলে ভজুদা জেনে যাবে। দু ভাই ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিতাই পা নাড়ছে।
পাটাই- নিতাই, পা নাড়িস না ।ঘুমালে কি কেউ পা নাড়ে? ভজহরি ছেলেমেয়েদের ভাল বাসে । ছেলেমেয়েরা ও ভজুদা কে ভালোবাসে। তাই ভজহরিকে নিয়ে ওদের ভ্যংচানোয়, ভজহরি উপভোগ ই করে সেই হাসি ঠাট্টা। ভজহরির বলা কথা গুলো কে নকল করে হাসে ওরা। ভজহরি পেঁয়াজ কে বলে হেয়াইজ। আর বৌ-ঠাকররণ কে বলে বৌ-ঠাওরণ । তা শুনলেই ওরা খিলখিলিয়ে হাসে । আবার সব আবদার ভজুদার কাছে ।সবিতার সব দিকেই নজর । গেল শীতে ভজু দার সোয়েটার পাতলা হয়ে গেছে । অমনি বাবার একখানা সোয়েটার পড়িয়ে দিয়েছে ভজহরি দা কে। লজ্জায় গলে গেছে ভজহরি ।
– দ্যহ দ্যহ কি করে । দ্যেহ কথাটাও ভজহরির নিজস্ব ভাষা । মেয়ের জোর জুলুমে বাবার ও সায় আছে দেখে সবিতার জুলুম করা আরও বেড়েছে । সেই সবিতা অসুস্থ হওয়ায় ভজহরির মনটা খারাপ হয়ে গেছে । এসব ভাবতে ভাবতেই পাটাই আর নিতাই এর ঘরে ঢুকেছে। হাতে হরলিক্স এর গ্লাস ।
– পাটাই, নিতাই উইঠে পড় । তবুও নিঃশব্দ দুই ভাই । এমন টা তো হয় না ! অন্য দিনে ভজহরির অপেক্ষায় থাকে । তবে দুজনেই মার পিট এ ব্যস্ত থাকে । সন্দেহ হল ভজহরির । নজরে পড়েছে দুজনের কাদা মাখা পায়ের দিকে । অমনি বলে ভজহরি ।
– তোরা কোথায় গেছিলি?
– কোথাও না । কাঁদো কাঁদো গলা নিতাই এর।
– আমরা তো ঘুমাচ্ছিলাম। ভজহরি চেঁচিয়ে বলে- সত্য কইরে ক । কোথায় গেইছিলি?
– তাহলে পা য়ে কাদা কোথা র থেইকে এল।?দাদা বাবুরে ডাকি । ভয় পেল দু ভাই । বলেই ফেলে সত্যি কথাটা । তবে আসল কথা না বলে নকল ঘোড়ার কথা বলল। ভজহরি- ভর দুপুরে বেম্যদত্তি থাকে তা জানিস । ওর কি করে? ভয়ে নিতাই এর মুখ শুকিয়েছে । আসল ঘোড়ার কথা ভজুদাকে বলতে গেছে। অমনি দাদার চিমটি । থেমে গেছে নিতাই।
– কি কচ্ছিলি রে নিতাই? কোন ঘোড়া ?
– ঐ পাথরের ঘোড়া ।
– তাই বল ।আমি ভেইবেছি অন্য কিছু । যা ,পা ধুয়ে আয়। রাজ্যের কাদা নিয়ে বিছানায় উইঠেছে । ভজহরি চলে যেতেই দাবড়ে উঠল পাটাই ।
– তুই একটা গাধা ।
– আমি গাধা ।
– ঐ ঘোড়ার কথা ভজুদাকে বলে?
– ঠিক আছে ,তুই পন্ডিত। যা না ঘোড়ায় চড় । ওটা তো ঘোড়া না ,ভুত। নইলে ঘোড়া কখনও ঠান্ডা আর শক্ত হয়!
– তুই দাঁড়িয়ে দিদির মতো স্বপ্ন দেখছিলি ।
– ভাল। যা তোর সাথে যাব না । তোকে ঘোড়া ভুত ধরুক।
মার খাওয়ার ভয়ে দৌড়ে পালায় মায়ের কাছে।