Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিত্রাঙ্গদা || Rabindranath Tagore » Page 3

চিত্রাঙ্গদা || Rabindranath Tagore

মণিপুর। অরণ্যে শিবালয়অর্জুন
অর্জুন।কাহারে হেরিনু? সে কি সত্য, কিম্বা মায়া?
নিবিড় নির্জন বনে নির্মল সরসী–
এমনি নিভৃত নিরালয়, মনে হয়,
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সেথা বনলক্ষীগণ
স্নান করে যায়, গভীর পূর্ণিমারাত্রে
সেই সুপ্ত সরসীর স্নিগ্ধ শষ্পতটে
শয়ন করেন সুখে নিঃশঙ্ক বিশ্রামে
স্খলিত-অঞ্চলে।
সেথা তরু-অন্তরালে
অপরাহ্নবেলাশেষে, ভাবিতেছিলাম
আশৈশবজীবনের কথা; সংসারের
মূঢ় খেলা দুঃখসুখ উলটি পালটি;
জীবনের অসন্তোষ, অসম্পূর্ণ আশা,
অনন্ত দারিদ্র৻ এই মর্ত মানবের।
হেনকালে ঘনতরু-অন্ধকার হতে
ধীরে ধীরে বাহিরিয়া, কে আসি দাঁড়াল
সরোবর-সোপানের শ্বেত শিলাপটে।
কী অপূর্ব রূপ। কোমল চরণতলে
ধরাতল কেমনে নিশ্চল হয়ে ছিল?
উষার কনক মেঘ, দেখিতে দেখিতে
যেমন মিলায়ে যায়, পূর্ব পর্বতের
শুভ্র শিরে অকলঙ্ক নগ্ন শোভাখানি
করি বিকাশিত, তেমনি বসন তার
মিলাতে চাহিতেছিল অঙ্গের লাবণ্যে
সুখাবেশে। নামি ধীরে সরোবরতীরে
কৌতূহলে দেখিল সে নিজ মুখচ্ছায়া,
উঠিল চমকি। ক্ষণপরে মৃদু হাসি
হেলাইয়া বাম বাহুখানি, হেলাভরে
এলাইয়া দিলা কেশপাশ;মুক্ত কেশ
পড়িল বিহ্বল হয়ে চরণের কাছে।
অঞ্চল খসায়ে দিয়ে হেরিল আপন
অনিন্দিত বাহুখানি– পরশের রসে
কোমল কাতর, প্রেমের করুণামাখা।
নিরখিলা নত করি শির, পরিস্ফুট
দেহতটে যৌবনের উন্মুখ বিকাশ।
দেখিলা চাহিয়া নব গৌরতনুতলে
আরক্তিম আলজ্জ আভাস, সরোবরে
পা-দুখানি ডুবাইয়া দেখিলা আপন
চরণের আভা। বিস্ময়ের নাই সীমা।
সেই যেন প্রথম দেখিল আপনারে।
শ্বেত শতদল যেন কোরকবয়স
যাপিল নয়ন মুদি–যেদিন প্রভাতে
প্রথম লভিল পূর্ণ শোভা, সেইদিন
হেলাইয়া গ্রীবা, নীল সরোবরজলে
প্রথম হেরিল আপনারে, সারাদিন
রহিল চাহিয়া সবিস্ময়ে। ক্ষণপরে,
কী জানি কী দুখে, হাসি মিলাইল মুখে,
ম্লান হল দুটি আঁখি; বাঁধিয়া তুলিল
কেশপাশ; অঞ্চলে ঢাকিল দেহখানি;
নিশ্বাস ফেলিয়া, ধীরে ধীরে চলে গেল;
সোনার সায়াহ্ন যথা ম্লান মুখ করি
আঁধার রজনীপানে ধায় মৃদৃপদে।
ভাবিলাম মনে, ধরনী খুলিয়া দিল
ঐশ্বর্য আপন। কামনার সম্পূর্ণতা
চমকিয়া মিলাইয়া গেল। ভাবিলাম
কত যুদ্ধ, কত হিংসা, কত আড়ম্বর,
পুরুষের পৌরুষগৌরব, বীরত্বের
নিত্য কীর্তিতৃষা, শান্ত হয়ে লুটাইয়া
পড়ে ভূমে, ওই পূর্ণ সৌন্দর্যের কাছে;
পশুরাজ সিংহ যথা সিংহবাহিনীর
ভূবনবাঞ্ছিত অরুণচরণতলে।
আর এক বার যদি–কে দুয়ার ঠেলে!
দ্বার খুলিয়া
এ কী! সেই মুর্তি। শান্ত হও হে হৃদয়।
কোনো ভয় নাই মোরে বরাননে। আমি
ক্ষত্রকুলজাত, ভয়ভীত দুর্বলের
ভয়হারী।
চিত্রাঙ্গদা।আর্য, তুমি অতিথি আমার।
এ মন্দির আমার আশ্রম। নাহি জানি
কেমনে করিব অভ্যর্থনা, কী সৎকারে
তোমারে তুষিব আমি।
অর্জুন।অতিথি-সৎকার
তব দরশনে, হে সুন্দরী! শিষ্টবাক্য
সমূহ সৌভাগ্য মোর। যদি নাহি লহ
অপরাধ, প্রশ্ন এক শুধাইতে চাহি,
চিত্ত মোর কুতূহলী।
চিত্রাঙ্গদা।শুধাও নির্ভয়ে।
অর্জুন।শুচিস্মিতে, কোন্‌ সুকঠোর ব্রত লাগি
জনহীন দেবালয়ে হেন রূপরাশি
হেলায় দিতেছ বিসর্জন, হতভাগ্য
মর্ত্যজনে করিয়া বঞ্চিত।
চিত্রাঙ্গদা।গুপ্ত এক
কামনা-সাধনা-তরে একমনে করি
শিবপূজা।
অর্জুন।হায়, কারে করিছে কামনা
জগতের কামনার ধন। সুদর্শনে,
উদয়শিখর হতে অস্তাচলভূমি
ভ্রমণ করেছি আমি; সপ্তদ্বীপমাঝে
যেখানে যা-কিছু আছে দুর্লভ সুন্দর,
অচিন্ত্য মহান্‌ সকলি দেখেছি চোখে;
কী চাও, কাহারে চাও, যদি বল মোরে
মোর কাছে পাইবে বারতা।
চিত্রাঙ্গদা।ত্রিভুবনে
পরিচিত তিনি, আমি যারে চাহি।
অর্জুন।হেন
নর কে আছে ধরায়। কার যশোরাশি
অমরকাঙ্খিত তব মনোরাজ্যমাঝে
করিয়াছে অধিকার দুর্লভ আসন।
কহো নাম তার, শুনিয়া কৃতার্থ হই।
চিত্রাঙ্গদা।জন্ম তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিকুলে,
সর্বশ্রেষ্ঠ বীর।
অর্জুন। মিথ্যা খ্যাতি বেড়ে ওঠে
মুখে মুখে কথায় কথায়; ক্ষণস্থায়ী
বাষ্প যথা উষারে ছলনা ক’রে ঢাকে
যতক্ষণ সূর্য নাহি ওঠে। হে সরলে,
মিথ্যারে কোরো না উপাসনা, এ দুর্লভ
সৌন্দর্যসম্পদে। কহ শুনি সর্বশ্রেষ্ঠ
কোন্‌ বীর,ধরণীর সর্বশ্রেষ্ঠ কূলে।
চিত্রাঙ্গদা।পরকীর্তি-অসহিষ্ণু কে তুমি সন্ন্যাসী!
কে না জানে কুরুবংশ এ ভুবনমাঝে
রাজবংশচূড়া।
অর্জুন।কুরুবংশ!
চিত্রাঙ্গদা। সেই বংশে
কে আছে অক্ষয়যশ বীরেন্দ্রকেশরী
নাম শুনিয়াছ?
অর্জুন। বলো, শুনি তব মুখে।
চিত্রাঙ্গদা।  অর্জুন, গাণ্ডীবধনু, ভুবনবিজয়ী।
সমস্ত জগৎ হতে সে অক্ষয় নাম,
করিয়া লুন্ঠন, লুকায়ে রেখেছি যত্নে
কূমারীহৃদয় পূর্ণ করি। — ব্রক্ষ্ণচারী,
কেন এ অধৈর্য তব?
তবে মিথ্যা এ কি?
মিথ্যা সে অর্জুন নাম? কহো এই বেলা–
মিথ্যা যদি হয় তবে হৃদয় ভাঙিয়া
ছেড়ে দিই তারে, বেড়াক সে উড়ে উড়ে
শূন্যে শূন্যে মুখে মুখে, তার স্থান নহে
নারীর অন্তরাসনে।
অর্জুন।অয়ি বরাঙ্গনে,
সে অর্জ্জুন, সে পাণ্ডব, সে গাণ্ডীবধনু,
চরণে শরণাগত সেই ভাগ্যবান।
নাম তার, খ্যাতি তার, শৌর্যবীর্ষ তার,
মিথ্যা হোক, সত্য হোক, যে দুর্লভ লোকে
করেছ তাহারে স্থানদান, সেথা হতে
আর তারে কোরো না বিচ্যুত, ক্ষীণপূণ্য
হৃতস্বর্গ হতভাগ্যসম।
চিত্রাঙ্গদা।তুমি পার্থ
অর্জুন।আমি পার্থ, দেবী, তোমার হৃদয়দ্বারে
প্রেমার্ত অতিথি।
চিত্রাঙ্গদা। শুনেছিনু ব্রক্ষ্ণচর্য
পালিছে অর্জুন দ্বাদশবরষব্যাপী।
সেই বীর কামিনীরে করিছে কামনা
ব্রত ভঙ্গ করি! হে সন্ন্যাসী, তুমি পার্থ!
অর্জুন।তুমি ভাঙিয়াছ ব্রত মোর। চন্দ্র উঠি
যেমন নিমেষে ভেঙে দেয় নিশীথের
যোগনিদ্রা-অন্ধকার।
চিত্রাঙ্গদা।ধিক্‌, পার্থ, ধিক্‌!
কে আমি, কী আছে মোর, কী দেখেছ তুমি,
কী জান আমারে। কার লাগি আপনারে
হতেছ বিস্মৃত। মুহূর্তেকে সত্যভঙ্গ
করি অর্জুনেরে করিতেছ অনর্জুন
কার তরে? মোর তরে নহে। এই দুটি
নীলোৎপল নয়নের তরে; এই দুটি
নবনীনিন্দিত বাহুপাশে সব্যসাচী
অর্জুন দিয়াছে আসি ধরা, দুই হস্তে
ছিন্ন করি সত্যের বন্ধন। কোথা গেল
প্রেমের মর্যাদা? কোথায় রহিল পড়ে
নারীর সম্মান? হায়, আমারে করিল
অতিক্রম আমার এ তুচ্ছ দেহখানা,
মৃত্যুহীন অন্তরের এই ছদ্মবেশ
ক্ষণস্থায়ী। এতক্ষণে পারিনু জানিতে
মিথ্যা খ্যাতি বীরত্ব তোমার।
অর্জুন।খ্যাতি মিথ্যা,
বীর্য মিথ্যা, আজ বুঝিয়াছি। আজ মোরে
সপ্তলোক স্বপ্ন মনে হয়। শুধু একা
পূর্ণ তুমি, সর্ব তুমি, বিশ্বের ঐশ্বর্য
তুমি–এক নারী সকল দৈন্যের তুমি
মহা অবসান, সকল কর্মের তুমি
বিশ্রামরূপিণী। কেন জানি অকস্মাৎ
তোমারে হেরিয়া, বুঝিতে পেরেছি আমি
কী আনন্দকিরণেতে প্রথম প্রত্যুষে
অন্ধকার মহার্ণবে সৃষ্টিশতদল
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মেষিত হয়ে
এক মুহূর্তের মাঝে। আর সকলেরে
পলে পলে তিলে তিলে তবে জানা যায়
বহু দিনে; তোমাপানে যেমনি চেয়েছি
অমনি সমস্ত তব পেয়েছি দেখিতে,
তবু পাই নাই শেষ। কৈলাসশিখরে
একদা মৃগয়াশ্রান্ত, তৃষিত, তাপিত,
গিয়েছিনু দ্বিপ্রহরে কুসুমবিচিত্র
মানসের তীরে। যেমনি দেখিনু চেয়ে
সেই সুরসরসীর সলিলের পানে,
অমনি পড়িল চোখে অনন্ত-অতল।
স্বচ্ছ জল, যত নিম্নে চাই। মধ্যাহ্নের
রবিরশ্মিরেখাগুলি স্বর্ণনলিনীর
সুবর্ণমৃণাল-সাথে মিশি নেমে গেছে
অগাধ অসীমে, কাঁপিতেছে আঁকি বাঁকি
জলের হিল্লোলে, লক্ষকোটি অগ্নিময়ী
নাগিনীর মতো। মনে হল ভগবান
সুর্যদেব সহস্র অঙ্গুলি নির্দেশিয়া
দিলেন দেখায়ে, জন্মশ্রান্ত কর্মক্লান্ত
মর্তজনে, কোথা আছে সুন্দর মরণ
অনন্ত শীতল। সেই স্বচ্ছ অতলতা
দেখেছি তোমার মাঝে। চারি দিক হতে
দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায়ে দিতেছে
মোরে, ওই তব অলোক-আলোক-মাঝে
কীর্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণ নির্বাপণ।
চিত্রাঙ্গদা।আমি নহি, আমি নহি, হায় পার্থ, হায়,
কোন্‌ দেবের ছলনা। যাও যাও ফিরে
যাও, ফিরে যাও বীর। মিথ্যারে কোরো না
উপাসনা। শৌর্য বীর্য মহত্ব তোমার
দিয়ো না মিথ্যার পদে। যাও, ফিরে যাও।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress