Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চারমিনার || Sanjib Chattopadhyay

চারমিনার || Sanjib Chattopadhyay

চারমিনার

দূরের ওই বাড়িগুলো কোন জায়গায়?

ওই দিকটা হল বানজারা হিলস। হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে বড়লোকদের এলাকা।

আর ওই দিকটা? ওই যে রাস্তাটা নীচু হয়ে একটা বিশাল দরজার ওপাশে যেন হারিয়ে গেছে।

অনেকটা গড়ে ঢোকবার জায়গার মতো?

ওটা একটা স্টুডিয়ো। হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে বড় ফিলম স্টুডিয়ো।

আজকের দিনটা ভারী সুন্দর তাই না? বেশ মেঘলা মেঘলা, বেশি গরম নেই।

এখানকার আবহাওয়াটাই এইরকম। সমুদ্র থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে এই শহর, বছরের এই সময়টা এখানে লাল আঙুর পেকে ওঠে। আঙুর খেয়েছেন একদিনও?

না এখনও খাইনি। এলোমেলো হাওয়ায় সঞ্জয়ের মাথার চুল উড়ছিল। ইন্দিরার গাঢ় নীল রঙের আঁচল কিছুতেই বুকের ওপর তার হাতের শাসন মানছিল না। তার চুলে উঁই ফুলের মালা জড়ানো। দক্ষিণী মেয়েরা ফুল ভালোবাসে।

সঞ্জয় এসেছে সুদূর কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদের এই ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং নিতে। ইন্দিরা তার সহপাঠী। নিজামের আমলের বিশাল বাগানবাড়িতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবাসিক। কোর্সের আজই শেষ দিন। একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে—শিক্ষান্তিক সমাবেশে অধ্যক্ষ সার্টিফিকেট বিতরণ করে পাঠ্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন। ছাত্রছাত্রীদের একটি মিলনোৎসব হবে। এর পরই বিদায় নেওয়ার পালা। এইসব অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে একটু সময় পাওয়া গেছে। একটু আগে ডাইনিং হলে বিদায়ী ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ লাঞ্চ শেষ করেছেন। ইন্দিরা সঞ্জয়কে নিজে হাতে মিষ্টির ডিশ পরিবেশন করেছেন। কোর্স ডিরেকটার বিষ্ণু তখন পাশেই ছিলেন। মৃদু হেসে ইন্দিরাকে যেন সাবধানের সুরে বলেছিলেন, ডোন্ট প্যামপার সঞ্জয়।

ইন্দিরা উত্তরে মাথা দুলিয়ে হেসেছিল। চুলে বাঁধা ফুলের ঝুমকো দুলে উঠেছিল। বিরিয়ানি প্রভৃতি সুখাদ্যের গন্ধকে ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ফুলের গন্ধ। ফরসা টুকটুকে মুখ একটু লাল হয়েছিল কি? কপালে চাঁদের মতো গোল টিপ কি একটু কেঁপে উঠেছিল? আহার শেষে ছোট্ট একটু উগার তুলে সঞ্জয় বলেছিল—এইবার আমরা কী করব?

শর্মা বলেছিল, ঘণ্টা দুয়েক সময় হাতে আছে, আমরা একটু হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে পারি। শর্মা এসেছেন ইন্দোর থেকে। শর্মা আর সঞ্জয় একই ঘরে থাকছেন। পাশের ঘরে প্রকাশ। প্রকাশ বলেছিলেন,

সঞ্জয় এখন বিশ্রাম করার মুডে নেই। সঞ্জয় অন্য কিছু করার কথা ভাবছেন। শর্মা হো হো করে হেসে উঠলেন। তাহলে সঞ্জয়কে আমরা আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিতে পারি।

অন্য কিছুটা কী, শিকার-টিকার নাকি এখানে তো ওয়াইল্ড লাইফ নেই।

কিন্তু অনেক রকম পাখি আছে। শর্মার কথার জের টেনে প্রকাশ বলেছিলেন, দুপুরটা পাখি দেখে কাটানো ভালো। বিশেষত এমন সুন্দর মেঘলা দিনে। হালকা মেঘের ভেলা ভাসছে আকাশের নীল গাঙে।

সঞ্জয় না বোঝার ভান করে বলেছিল,

এত কিছু করার থাকতে পাখি দেখার কথা আসছে কী করে?

পাখি যখন মানুষকে দেখে, মানুষ তখন পাখি দেখতে বাধ্য হয়।

ডাইনিং হলের সামনে ছোট্ট গোলাপ বাগান! সঞ্জয় গোলাপ বাগানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। রইল। শর্মা আর প্রকাশদুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন। সঞ্জয় বিশেষ কিছু ভাবছিল না। একটিমাত্র লাল গোলাপ ফুটে আছে, মেঘলা আকাশের নীচে। মেটে সিঁদুরের মতো রং। মানুষের মনে বিশেষ কোনও কোনও মুহূর্তে কোনও চিন্তাই স্থান পেতে চায় না। চিন্তাহীন। শূন্যতায় মন স্থির হয়ে থাকে। অধ্যাপক বিষ্ণু তাঁর অফিসের দিকে যেতে যেতে সঞ্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে গেলেন,

প্রকৃতি দর্শন শেষ হলে আমার ঘরে এসো, কিছু কাজের কথা হবে। পর মুহূর্তেই ইন্দিরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সঞ্জয় কিছু একটা বলা উচিত বলেই বলেছিল—রোজ ইজ এ রোজ ইজ এ রোজ।

আপনি গোলাপ ভালোবাসেন?

সঞ্জয় খুশি করার জন্যে বলেছিল,

গোলাপ কে না ভালোবাসে?

ফুল কিন্তু অনেকে ভালোবাসে না।

দেন দে আর ফুলস। সঞ্জয়ের কথার মোচড়ে ইন্দিরা ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল। আপনি কিন্তু ফুল ভালোবাসেন। আপনার চুলের ফুলের মালা আপনার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।

সব মেয়েই নিজের সৌন্দর্যের প্রশংসায় একটু লাজুক লাজুক হয়ে যায়। ইন্দিরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, চলুন ওই অফিসবাড়ির ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। অনেকটা উঁচু থেকে চারপাশ ভালো দেখা যায়।

সঞ্জয় এইরকম একটা আমন্ত্রণের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। ক্লাসে ইন্দিরাকে সে লক্ষ করেছে। তার চালচলনে, আড়ষ্টতাবর্জিত কথাবার্তায়, যুক্তিতর্কের ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছে, প্রশংসা করেছে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার মানসিক ইচ্ছাকে ভদ্রতার লাগাম পরিয়ে বাধ্য রেখেছে। ইন্দিরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার জন্যে শর্মা আর প্রকাশের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় মজা পেয়েছে। সে দূরেই। থাকতে চেয়েছে। মানুষের সমস্ত ভালো লাগাকে আশকারা দিতে নেই, এ শিক্ষা তার জীবন। থেকে নেওয়া। সব পথই যেমন একই মন্দিরে পৌঁছে দেয় না, সব জীবনই তেমনি সব জীবনে স্থান পায় না। ইন্দিরার হঠাৎ আমন্ত্রণে সঞ্জয় উল্লসিত হয়েছিল। বিশাল একটি দুর্গ দখলের পর সৈনিকদের যেমন আনন্দ হয় সেই রকম আনন্দের অনুভূতিতে পুলকিত হয়েছিল।

সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি বিশাল বাড়ি। একদা কোনও নবাবের বাগানবাড়ি ছিল। বিশাল চওড়া সিঁড়ি ঘুরে দূরে দিকদৌড় ছাদে গিয়ে উঠেছে। ইন্দিরা অনেকটা পথপ্রদর্শক গাইডের মতো আগে। আগে উঠছিল, পেছনে সঞ্জয়। হালকা শরীরে জড়ানো নীল শাড়ি। এলোচুলে সাদা ফুলের মালা দুলছে। সিঁড়ির ওপরের ধাপে একটু জল পড়েছিল। ইন্দিরা পা রেখেই পিছলে পড়ে যাবার মতো হয়েছিল। সঞ্জয় কোমরে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইন্দিরার পতন সামলে নিয়েছিল। ইন্দিরার মাথা সঞ্জয়ের বুকে। সঞ্জয়ের নাক ইন্দিরার চুলে। যে সান্নিধ্য স্বাভাবিকভাবে সম্ভব ছিল না অদৃশ্য বিধাতার নির্দেশে সামান্য একটা দুর্ঘটনায় তা পলকে সম্ভব হল। দুজনে পাশাপাশি ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চারিদিকে দাক্ষিণাত্যের শিলাময় পাহাড়। পথ প্রসারিত এদিকে-ওদিকে। বাগান বাগিচা।

দেখছেন একটা লরি কীরকম ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠেছে। ওখানে একটা কেয়ারি আছে। ভীষণ ভালো লাগে দেখতে। সারাদিন পাথরের সঙ্গে মানুষের লড়াই। মাঝে মাঝে ডিনামাইট দিয়ে। পাথর উড়িয়ে দেওয়া হয়। ইন্দিরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। সঞ্জয় ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া শিলাভূমি কয়েকদিন থেকেই তার বাংলোর পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রভাতে দেখেছে। বড় বড় পাথরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পথ এগিয়ে গেছে। কল্পনায় মনে হত এই বুঝি কোনও অশ্বারোহী মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতা থেকে দ্রুতগতিতে নেমে আসবে, কিংবা চম্বলের একদল দুর্ধর্ষ ডাকাত।

আসলে একটা কেয়ারি সঞ্জয় যেন জোরে স্বগতোক্তি করল।

ইন্দিরা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ ওটা কোয়ারিই তো। কেন?

না আমি ভেবেছিলুম। সঞ্জয় প্রাণখোলা হাসি হেসে, এলোমেলো চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে কথাটা মাঝপথেই অসম্পূর্ণ রাখল।

বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? ইন্দিরা একটু অভিমানীর গলায় বলল।

বিশ্বাস হবে না কেন? আমি ভাবতুম, সঞ্জয় তার কল্পনার কথা আরও কাল্পনিক করে ইন্দিরাকে শোনাল।

বাঃ, আপনি একজন কবি। আপনি কবিতা লেখেন না?

লিখি না তবে ভাবি লিখব। আপনি লেখেন না?

ইন্দিরা মৃদু হেসে সুদূরে চোখ রেখে সলজ্জভাবে বললেন, হ্যাঁ আমি লিখি। বিষ্ণুও লেখেন। খুব ভালো কবিতা লেখেন।

হায়দ্রাবাদ বড় সুন্দর শহর।

ঘুরে দেখেছেন?

দেখব কখন? সবসময় ক্লাস। তা ছাড়া আমি কিছুই চিনি না। একলা একলা কোথায় হারিয়ে যাব!

সঞ্জয়ের এই কথার মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আন্তরিকভাবেই বলেছিল। অযথা পৌরুষ দেখাবার জন্য বলতেই পারত-হাতে আর একটা দিন সময় আছে বা সম্পূর্ণ একটি ছুটি আছে, সকাল থেকে সন্ধে সে একাই ঘুরে বেড়াবে সারা শহরে।

ইন্দিরা খুব আস্তে করে বলল, কাল সকালে আমাদের গোলকুণ্ডা রোডের বাড়িতে চলে আসুন না—আমি, রূপা, আর আপনি তিনজনে সারাদিন যে কটা দর্শনীয় জায়গা পারি ঘুরে ঘুরে দেখব।

সঞ্জয় এতটা ঠিক আশা করেনি। দূর থেকে মানুষ এতটা সহজে কাছাকাছি চলে আসতে পারে, তার ধারণা ছিল না। শর্মা আর প্রকাশ যখন ইন্দিরার কাছাকাছি আসার জন্য প্রতিযোগিতা করছিল তখন তার ইচ্ছে হয়েছিল নারীর হৃদয়ে প্রবেশ করার শক্তিটা একবার যাচাই করে নেবে। শর্মা তার চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান, সুন্দর, সুসজ্জিত। প্রকাশ যথেষ্ট মার্জিত এবং ব্যক্তিত্বে আদরণীয়। এমনকী কোনও কোনও সময় তার মনে হয়েছে অধ্যাপক বিষ্ণুরও ইন্দিরা সম্পর্কে কিছু দুর্বলতা আছে। পুরুষ এবং নারীর মন নিয়ে সেই চিরন্তন খেলা। যে খেলায় মানুষ জয়ের আশা না নিয়েই খেলতে নামে, সে খেলায় মানুষ বোধ হয় এমনি সহজেই বিজয়ী হয়।

সঞ্জয় অনেকক্ষণ ইন্দিরার কাজল আঁকা চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কৃতজ্ঞতা জানাবে, না তার হাত দুটো বুকের কাছে ধরে বলবে, তুমি আমার বিশ্বাসের প্রতিবিশ্বাস, তুমি আমার শক্তির প্রতিশক্তি, আমার ভরসার ভরসা, ভেবে পেল না। মেঘলা আকাশের নীচে চারিদিকে অসমতল ভূখণ্ডের বৈচিত্র্যের মাঝে দাঁড়িয়ে দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে ভাষাতীত স্বাচ্ছন্দ্য বিনিময়ের সুযোগ করে নিল।

সেই ভালো, আপনারা আমার সঙ্গে এই অচেনা শহরে থাকলে আমি আর হারিয়ে যাব না। সঞ্জয় মৃদু হেসে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল।

আপনার সম্পর্কে আমার চেয়েও রূপার কৌতূহল বেশি।

রূপা ইন্দিরার সহকর্মী। রূপাকে দূর থেকে সঞ্জয় এ ক-দিনে বার কয়েক দেখেছে। ইন্দিরার চেয়ে অনেক বেশি আধুনিকা। দুজনের দুরকম ব্যক্তিত্ব। সেই রূপার কৌতূহল অনেক বেশি! কৌতূহলী হয়ে ওঠবার মতো কী এমন আছে সঞ্জয়ের চরিত্রে। মহিলার চোখে কোনও পুরুষ যে কখন কী মর্যাদা পেয়ে যায়! তাদের চোখে হঠাৎ কেউ রাজা হঠাৎ কেউ প্রজা। এই নায়ক, এই আবার ভিলেন।

রূপা বলছিল বাংলা শিখে সে আপনার সমস্ত লেখা পড়বে। আপনার জীবনদর্শনের সে ভক্ত হয়ে পড়েছে।

কী করে? আমার কথা তো তাকে আমি কিছু বলিনি।

আমি বলেছি। এতদিন ক্লাসে আপনি যেভাবে বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন, সব আমি রূপাকে বলেছি। ইন্দিরা মাথা নীচু করল আর সেইভাবেই বলল, আপনি একটি আকর্ষণীয় চরিত্র। কালকে আপনাকে তাই আমরা কাছে পেতে চাই।

সঞ্জয়ের খুবই ইচ্ছে করছিল ইন্দিরার আনত মুখের চিবুকটা ধরে উঁচু করে তুলে মনের সমস্ত অনুরাগ উজাড় করে ঢেলে দিয়ে বলে, তোমাকে আমার জীবনে খুব পেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! ইন্দিরা যদি হঠাৎ বলেও ফেলে, আমার আপত্তি নেই, সঞ্জয়ের পক্ষে নতুন করে জীবনের আর একটি অধ্যায় খুলে ফেলা সম্ভব হবে না। প্রবাহের পথে ভাসতে ভাসতে, ঢেউয়ের ধাক্কায় তটভূমিতে সাময়িকভাবে কোনও তমাল কুঞ্জে আশ্রয় মিলতে পারে, কিন্তু স্থায়ী জীবন সেখানে শুরু করা যায় না। স্রোতের উজানে যাকে ভাসতে হবে প্রতিটি মুহূর্তের অনুভূতি তার। কাছে বিভিন্ন।

নিভৃতে আরও কিছু ঘটার আগে শৰ্মা ছাদে উঠে এলেন। ভালো জিনিস স্বার্থপরের মতো একা একা উপভোগ করা ঠিক হচ্ছে কি? আমাকেও তো একটু অংশ দেওয়া যায়। শর্মা হাসতে হাসতে বললেন।

সঞ্জয় বলল, আসুন না। সুউচ্চ ছাদে দাঁড়িয়ে হায়দ্রাবাদ দর্শন। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীমতি ইন্দিরা। ইন্দিরা একটু ভদ্রতার হাসি হাসলেন কিন্তু শর্মাকে দৃশ্য পরিচিতি দিতে তেমন উৎসাহ দেখালেন না। বরং বললেন, অনেকক্ষণ উপরে এসেছি চলুন, এবার যাওয়া যাক, বিষ্ণু আপনাকে ডেকেছিলেন না!

২.

ভ্যালিডিকটারি ফাংশান শেষ হয়ে গেল। অধ্যক্ষ দু-চার কথায় তাঁর ভাষণ শেষ করলেন। সার্টিফিকেট বিতরণ শেষ হল। ছাত্ররা দু-চার কথা বললেন। হলের বাইরে এসে সবাই দাঁড়ালেন। সূর্য্যাস্তের আকাশে ঘরে ফেরা পাখির দল। বিষ্ণু সঞ্জয়ের সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে বললেন, সঞ্জয় আই উইল মিস ইউ লাইক এনেথিং। ইন্দিরা গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। যাবার আগে কানে কানে বলে গেলেন, কাল সকালে।


শর্মা, প্রকাশ আর সঞ্জয়, আঠারো এবং উনিশনম্বর ঘরের আবাসিক তিনজন, পড়ন্ত বেলার, আকাশ পাহাড় আর গাছের সারিকে সামনে রেখে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল। সকলেই কিছু বিষণ্ণ। কয়েকটা দিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবন আবার ফিরে পাওয়া গিয়েছিল। প্রাত্যহিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে এই মেলামেশা, ভাবনাশূন্য, চিন্তাশূন্য, অর্থনৈতিক মর্যাদাশূন্য বিদ্যাপীঠের অধ্যয়নং তপঃ জীবনের এইবার অবসান। আবার ফিরে চলো যে যেখানে ছিলে সেইখানে। যেসব ইউনিফর্ম, যেসব খোলস খুলে রেখে এসেছিলে আবার তার মধ্যে প্রবেশ করো।

শর্মা বললেন, অনেকে আজকেই চলে যাচ্ছেন। আমি রিজার্ভেশান পেলাম না। পেলে আজই চলে যেতে পারতুম। সেই কাল সন্ধে অবধি অপেক্ষা করে থাকতে হবে।

আমি আজই চলে যাচ্ছি, একটু পরেই গাড়ি আসবে, যতক্ষণ না আসে, বসে বসে গল্প করি। প্রকাশ এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে বসলেন। শর্মা ও সঞ্জয়ও বসলেন।

প্রকাশ হাসতে হাসতে বললেন,

সঞ্জয় বোধ হয় হায়দ্রাবাদেই থেকে যাবে। হৃদয় ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সঞ্জয়ের হৃদয় থাকবে এখানে, শরীর থাকবে কলকাতায়, তা কী করে সম্ভব!

কখনওই তা সম্ভব নয়। এটা হল হৃদয় চুরির কেস। স্টোরি অফ এ মিসিং হার্ট। শর্মা সমর্থন করলেন প্রকাশকে।

আপনি একটা হোপলেস, কিছুই করতে পারলেন না, আর চুপচাপ উদাসীন মানুষটি নগর জয় করে নিল। হিরো অফ দি সিন।

সঞ্জয় চুপ করে থাকা ঠিক নয় বলেই যেন বলল, এর মধ্যে জয়-পরাজয়ের কথা আসে কী করে। আমি জয় করতে আসিনি, পরাজিত হতেও আসিনি।

শর্মা কিন্তু বেশ গায়ে মাখার মতো করেই বললেন, আমি পরাজিত। শুধু পরাজিতই নই, আহতও।

আহত কেন? সঞ্জয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

ইন্দিরা আমাকে অপমান করেছে। অভদ্র ব্যবহার করেছে।

সঞ্জয় খুব অবাক হয়ে গেল, অভদ্র ব্যবহার করার মতো মেয়ে তো ইন্দিরা নয়। যথেষ্ট ভদ্র, মার্জিত, সংস্কৃতিবান।

আপনার এখন সেই রকমই মনে হবে। প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়।

প্রেমের কথা আসছে কী করে! আমরা কয়েকজন মধ্যবয়সি মানুষ। সংসারী। এখানে লেখাপড়া করতে এসেছি। কাফলাভের বয়স কুড়ি বছর পিছনে ফেলে এসেছি। এখন আর প্রেম হবে না। হবার উপায় নেই। এ হল ভালো লাগার ব্যাপার।

সঞ্জয় আপনি ভুল বলছেন। প্রেমের কোনও বয়স নেই, পরিবেশ নেই, জাতি নেই, ধর্মও নেই।

হতে পারে তবে এখানে আমরা কেউই অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা লুটে নিয়ে যাবার জন্যে আসিনি ভাই।

রাজকন্যা যদি ঘাড়ে চেপে বসে তখন তাকে ঘাড় থেকে নামাবার ক্ষমতা ক-জন রাখে! প্রকাশ হঠাৎ তালি বাজিয়ে ব্র্যাভো ব্র্যাভো করে উঠল। শর্মার কথা ভালো লেগেছে।

লাঞ্চের পর ইন্দিরা আমাকে একটু সময় দেবে বলেছিল। সে তার অঙ্গীকার রাখেনি। বরং সে তখন আপনাকে ছাদে নিয়ে গেছে। আমি যখন জোর করে ছাদে গিয়ে উঠেছি, সে অভদ্রের মতো নেমে এসেছে। আমার সেন্টিমেন্টের কোনও মূল্য দেয়নি। একে আপনি কী বলবেন?

সঞ্জয় শর্মাকে শান্ত করার জন্যে বলল, আই অ্যাম সরি। আমি জানতুম না ইন্দিরার সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। জানলে অবশ্যই আমি ছাদে যেতুম না।

আপনি বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধে অপরাধী। উদাসীনতার মুখোশ পরে তলে তলে ঘনিষ্ঠ হবার কসরত চালিয়েছেন। অথচ প্রথম থেকে আমরা তিনজনে একটি ইউনিটের মতো হয়ে উঠেছিলুম। ডিনার টেবিলে পাশাপাশি বসেছি, পাশাপাশি বিছানায় শুয়েছি, ছুটির পরে বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ আপনি আলাদা হয়ে গেলেন।

শর্মার অভিযোগে সঞ্জয় স্তম্ভিত হয়ে গেল। প্রকৃত এত সব সে ভাবেনি! এই দুজন মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়ার খবর সে রাখেনি। সমস্ত জিনিসটাই তার কাছে ছিল একটা খেলার মতো।


দুরের গেট দিয়ে একটা সাদা স্টেশন ওয়াগন ঢুকতে দেখা গেল। প্রকাশ উঠে দাঁড়ালেন, আমার গাড়ি এসে গেছে। ঘর থেকে সুটকেসটা বের করে আনিয়ে তিনজনেই প্রকাশের ঘরের দিকে চললেন। প্রকাশ প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে থাকেন। শহরের এক প্রান্তে স্থানীয় সরকারি অফিসে চাকরি করেন। স্থানীয় মানুষ প্রকাশের জিনিসপত্র কিছুই নেই। একটি ব্রিফকেস একটি। পাউডারের কৌটো। নিয়মমাফিক বাংলো তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ কিন্তু রাত্রিবাস করত বাড়িতে।

প্রকাশ গাড়িতে ওঠার সময় বললেন, শহর পর্যন্ত লিফট দিতে পারি। চলে যাবার আগে আপনাদের যদি কিছু কেনাকাটার থাকে করে নিতে পারেন। শর্মার রিজার্ভেশনের জন্যে স্টেশনে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। সঞ্জয়ের প্রয়োজন ছিল বাড়ির জন্যে সামান্য কিছু কেনাকাটার। দুজনেই গাড়িতে উঠলেন। শৰ্মা গম্ভীর প্রকাশ কিন্তু স্বাভাবিক। গাড়ি ইনস্টিটিউটের গেট ছাড়ানো মাত্রই প্রকাশ তাঁর কদিনের ছাত্রজীবন, ইন্দিরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, আলাপ-পরিচয় করা নিয়ে পারস্পরিক রেষারেষি সব যেন ভুলে গেলেন। ওই দরজার ওপাশে রইল পড়ে জীবনের কটা দিন, কিছু চপলতা, ফিরে পাওয়া ছাত্রজীবনের স্মৃতি। সঞ্জয়ের প্রতি প্রকাশের বিদ্বেষ নেই, প্রতিযোগিতার ভাব নেই। আছে দুজন বয়স্ক মানুষের পারস্পরিক পরিচয়, ভদ্রতা, বন্ধুত্ব। শর্মা কিন্তু তখনও আহত মন নিয়ে বসে আছেন।

শহরে পৌঁছে শর্মা আলাদা হয়ে গেলেন। সঞ্জয় ভেবেছিল, প্রকাশ চলে যাবেন। সে আর শর্মা। অনেক রাত পর্যন্ত শহরে ঘুরবে। তারপর একসঙ্গে ফিরে আসবে হস্টেলে। শর্মা কিন্তু ইচ্ছে। করেই সঞ্জয়কে এড়িয়ে গেলেন। সঞ্জয় প্রথমে একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। রাতের হায়দ্রাবাদ তার কাছে নিতান্তই অপরিচিত। অপরিচিতের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার মধ্যে আনন্দ নেই বরং ভীতি আছে। ফেরার বাস সবসময় পাওয়া যায় না। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে ফিরে যাওয়ার জন্যে।

প্রকাশ কিন্তু অনুভব করতে পেরেছিলেন সঞ্জয়ের নিঃসঙ্গতা। চলুন আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ ঘুরি। বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। প্রকাশের বন্ধুবাৎসল্যে সঞ্জয় মুগ্ধ হয়েছিল। দুপুর থেকে সে যেন এক প্রচণ্ড পাগলামির পরিবেশে পাগল হয়ে যেতে বসেছিল। এতক্ষণে সে বোধহয় সুস্থতায় মুক্তি পেল।

হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে বড় কেনাকাটার জায়গা আবিদস-এ প্রকাশ এসে বললেন, চলুন একটু কফি খাই। বিশাল দোকানে দুজনে মুখোমুখি বসলেন কফি নিয়ে।

চারমিনারে যাবেন না স্ত্রী-র জন্যে চুড়ি কিনতে?

কতদূর?

বাসে পনেরো মিনিট।

গোলকুণ্ডা রোড এখান থেকে কতদূর!

শহরের ও তল্লাটে। বেশ কিছুটা দূর!

যাবেন নাকি? কে থাকে ওখানে?

ইন্দিরা। কাল সকালে আমাকে যেতে বলেছে।

গণেশ চতুর্থীর নিমন্ত্রণ?

গণেশ চতুর্থী দাক্ষিণাত্যের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বাংলার দুর্গাপূজার মতো?

না, চতুর্থীর নিমন্ত্রণ নয়। হায়দ্রাবাদ শহর ঘুরে দেখার নিমন্ত্রণ। ইন্দিরা আমার গাইড।

বাঃ, ইন্দিরাকে সঙ্গী করে নিজামের শহরে ঘুরে বেড়ানোর মতো রোমান্স আর কী আছে। আমি আপনাকে সাহায্য করব। কাল সকালে পাবলিক গার্ডেনে আরকিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের সামনে আমি থাকব। আপনি আসুন, তারপর আপনাকে গোলকুণ্ডার হিরের খনিতে পৌঁছে দেবার ভার আমার।

প্রকাশ কিছুতেই সঞ্জয়কে কফির দাম দিতে দিলেন না।

ক্ষণিকের বন্ধুর প্রতি ক্ষণিকের বন্ধুর ভালোবাসার আপ্যায়ন। স্টপেজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারমিনারের বাস আর এল না। প্রকাশ যদিও অধৈর্য হলেন না, সঞ্জয়ের ধৈর্য কিন্তু হার মানল। চলুন, চারমিনার আর যাওয়া হল না আজ। এতটা পথ আবার ফিরে যেতে হবে।

যাক কালকেই যাবেন চারমিনার, সঙ্গে থাকবে মিষ্টি সঙ্গী। চুড়ি কেনার হাতের মাপও পেয়ে যাবেন। প্রকাশ উদাস গলায় হেসে উঠলেন।


শর্মা ফিরে এলেন অনেক রাতে। সঞ্জয় তখন ডিনার শেষ করে শুয়ে পড়েছে। ঘুম আসছিল না। সব ঘরই প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। সন্ধের ট্রেনে অনেকেই বাড়ির পথে। সকলেই প্রায় হোমসিক। শর্মা একদিন বলেছিলেন, সংসারী মানুষ সংসার ছেড়ে দীর্ঘদিন বাইরে থাকতে পারে না। যত দিন যায় বাড়ির আকর্ষণ বাড়তে থাকে। প্রতিদিন শোবার আগে, শুয়ে শুয়ে দুজনে অনর্গল কথা বলে যেত—পাড়ার কথা, অধ্যাপকদের কথা, সহপাঠীদের কথা এবং ইন্দিরার কথা। ইন্দিরা কেন শর্মার কথার জবাবে এই কথা বলল ওই কথা বলল। কোন মনস্তাত্বিক কারণে ইন্দিরার। বিশেষ কিছু মন্তব্য, শর্মার বিশ্লেষণ চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে যে-কোনও একজন ঘুমিয়ে পড়লেই ঘরে স্তব্ধতা নেমে আসত। শর্মা ফিরে এসেছেন হতাশ হয়ে, রিজার্ভেশনে নাম তাঁর। ওয়েটিং লিস্টে। কাল সকালে আবার যেতে হবে। আর কোনও কথা হল না। ডিনার না খেয়েই শর্মা শুয়ে পড়লেন। ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত। বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে।


পরের দিন সকাল। শর্মা রোজ দেরিতে ওঠেন। সেদিন উঠলেন খুব ভোরে। সঞ্জয় জেগেই ছিল। রাতে ঘুমোতে পারেনি। অজস্র চিন্তার জটিল আবর্তে ঘুম পথ হারিয়ে ফেলেছিল। ইন্দিরার সঙ্গে ছাদের দুপুরের কয়েকটি মুহূর্তের সঙ্গে সময়ের ব্যবধান যত বাড়ছে, জীবনের অন্য এক সত্য যেন ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সারারাত চোখের ওপর হাত রেখে সঞ্জয় সেই সত্যকে খুঁজে। পেয়েছে। জীবনে পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার পরিমাণটাই বেশি। একটা পুরোনো জামা সহজেই পালটে ফেলে নতুন জামা পরা যায়। পুরোনো জীবনকে হঠাৎ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন জীবন। কিন্তু শুরু করা যায় না, অনেকটা প্রাচীন বৃক্ষের মতো। যে জমিতে তার মূল, শিকড়, যে জমি। থেকে তার প্রাণরস সংগ্রহের ভবিষ্যৎ, সেই জমি থেকে তাকে উৎপাটিত করলে গাছ বাঁচে না। চারাগাছ একাধিকবার ভূমি নেড়ে বসানো চলে। ইন্দিরাকে তার মনে লেগেছে। এ কথা সত্য। ইন্দিরার মেধা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির মধ্যে সে তার জীবনকে আরও বেশি প্রস্ফুটিত করার সম্ভাবনা দেখেছে। তার জীবনের মূল শিকড় ইন্দিরার প্রাণরসে আরও পুষ্ট হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা একতরফা নয়। নতুন জমিতে সে মূল ছড়াতে চাইলেও জমির উপযুক্ত বৃক্ষ কি না এ বিচারের ভার জমির মালিকের। ইন্দিরার সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় নিজের জীবনসত্যটিকে আবিষ্কার করে ফেলেছে, সে একটি অসম্পূর্ণ মানুষ। জীবনে তার ক্ষোভের আর অসঙ্গতির পরিমাণ বিশাল। তার মন, তার মেধা উপবাসী। সে যদি তৃপ্ত হত তাহলে হঠাৎ অকারণে এতটা উল্লসিত হত না। সে কোনওদিনই কমেডির নায়ক হতে পারবে না। জীবনের গতিই তাকে ট্র্যাজেডির হিরো করেছে।

প্রত্যুষের প্রতিশ্রুতিকে অস্বীকার করা যায় না। কাঁচা সোনার মতো রোদ, হালকা ঠান্ডা আঙুর পাকানো হাওয়া। দূরে কোয়ারির দিকে ফৌজি মাঠে কুচকাওয়াজ, ফায়ারিং রেঞ্জে মেশিনগানের শব্দ। শর্মার দাড়ি কামানো স্বাস্থ্যবান তাজা ফরসা মুখ। সামনের রাস্তায় গুজরাতের ছেলে ভিয়াসের প্রাণোচ্ছল হাঁটা চলা। সঞ্জয় নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। ব্রেকফাস্ট সেরে, আর টি সির বাস ধরে সে আর শর্মা শহরে যাবে। শর্মা স্টেশনে, সঞ্জয় মিউজিয়ামের সামনে।


শর্মা ইতিমধ্যে সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার জিনিসপত্র সুটকেসে ভরে ফেলেছে। ওয়ার্ডরোব থেকে সমস্ত জামাকাপড় ভরে ফেলেছে। বাথরুমে তার সাবান পড়ে নেই। বিদায়ের জন্যে সে আংশিক প্রস্তুত। সঞ্জয়ের হাতে এখন পুরো একটা দিন। শর্মা তাকে ছেড়ে চলে যাবে এই বেদনা কিন্তু তাকে ভেতরে ভেতরে বিমর্ষ করে তুলেছে। রাতে তার পাশের বিছানা খালি পড়ে থাকবে। গোটা একটা ওয়ার্ডরোব ফাঁকা হুহু করবে। সারা ঘরের কোথাও শর্মার কোনও স্মৃতিচিহ্ন পড়ে থাকবে না। সে যে সময় একা ঘরে শুয়ে থাকবে, শর্মা তখন ইন্দোরের পথে অনেকটা এগিয়ে যাবে। আর কোনওদিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। একই ঘরে পাশাপাশি শোয়া হবে না। শুয়ে শুয়ে গল্প হবে না। একই টেবিলে বসে খাওয়া হবে না। সময়ের কোনও এক জলাশয়ে দুজনে অবগাহন করে উঠে গেল। এর পর দুজন পরস্পরের থেকে বহুদূরে ধীরে ধীরে বুদ্ধ হবে, কিছু আগে-পরে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। বিষণ্ণ কোনও সন্ধ্যায় মনে হতে পারে— সঞ্জয় ছিল না? এখন কোথায়, কেমন? শর্মা ছিল না? ইন্দোরের কোনও রাস্তায় সে হয়তো বেড়াচ্ছে। চোখে ভালো দেখতে পায় না। নাতি কিংবা নাতনির হাত ধরে টুক টুক করে হাঁটছে। কিংবা কোনও এক শীতের হাড়কাঁপানো রাতে সে ঝরে গেছে।

ইন্দিরা নয়, শর্মার চলে যাবার বেদনা সঞ্জয়ের সকালের মেজাজ তৈরি করে দিল। জীবনের। প্রচণ্ডতম সত্যের মুখোমুখি হল। চলে যায়! আজ যে আছে কাল সে থাকবে না। সময়ে সবকিছু ভাসমান। ইন্দিরার সঙ্গে তার দেখা হোক না হোক, ছাদে একসঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবার মুহূর্ত স্মৃতি হয়ে রইল সঞ্জয়ের কাছে। সে যেখানেই থাকুক না কেন, ইন্দিরা আরও বড় হবে। তার জীবনের ধারা পালটাবে। বিয়ে হবে। সন্তানের জননী হবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে জীবনের পরিণতির দিকে এগিয়ে চলবে। যৌবনের শক্তিতে সে সবকিছু ভুলে যাবে, অস্বীকার করবে, তারপর বয়সের কোনও এক সময়ে যখন পিছনে তাকাবার সময় আসবে তখন হয়তো স্মৃতির পর্দায় হঠাৎ কোনও পুরোনো মুখ ভেসে উঠবে।


মিউজিয়ামের সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর প্রকাশ এলেন স্কুটারে। গণেশ পুজো সারতে দেরি হয়ে গেছে। অজস্রবার ক্ষমা চাইলেন। চলুন, আপনি অটোরিক্সায় উঠুন, আমি স্কুটারে অনুসরণ করি। গোলকুণ্ডা এস রোড। ঠিকানাটা কী?

প্রকাশ, শুনুন আমি আর ইন্দিরার কাছে যাব না। আপনার যদি সময় থাকে চলুন একসঙ্গে কয়েকটা জায়গা ঘুরি—চারমিনার, সালার জং, ওসমান সাগর, গোলকুণ্ডা ফোর্ট।

যাবেন না কেন?

ছেলেমানুষির বয়স গেছে প্রকাশ। কী হবে এক তরুণীর মনের খবর নিয়ে, এই প্রৌঢ় বয়সে। বরং শর্মা স্টেশনে আছে। চলুন ওকে ধরে তিনজনে দিনটা নিজেদের খেয়ালখুশিতে ভরে দিই।

প্রকাশ একটু অবাক হলেও, রাজি হলেন।

তা হলে লাঞ্চ করতে হবে আমাদের বাড়িতে।

শর্মাকে স্টেশনে ধরা গেল। ইউসুফনগরে প্রকাশের বাড়ি লাঞ্চ। সারাদিন প্রচণ্ড রোদে ঘোরা, অবশেষে অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে বিকেলে ফিরে আসা। শর্মার ট্রেন সাতটায়। আমির গেট থেকে প্রকাশ বিদায় নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, আর হয়তো দেখা হবে না।


শৰ্মাদু-হাতে সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরে যাওয়ার আগে বলে গেলেন—একটা রাত দেখতে দেখতে কেটে যাবে। কাল অন্ধকার ভোরে আপনিও বাড়িমুখো। এখানে পড়ে থাকল আমাদের এই কটা দিন। ভবিষ্যতে দেখা হবে, যোগাযোগ থাকবে এমন আশা করি না। বিদায় বন্ধু!

বাংলোর পিছন দিকের দরজাটা, যেটা কমই খোলা হত, অথচ যেটা খুললে ফাঁকা মাঠ, কোয়ারি, ফৌজি সীমানা দেখা যায়, সেই দরজাটা খুলে, পড়ন্ত বেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় সন্ধেটা কাটিয়ে দিল। গণেশ পুজোর মাইকে দক্ষিণী গান ভেসে আসছে।

রাতভোরে বেরোতে হবে বলে সঞ্জয় প্রায় সব জিনিসই গুছিয়ে নিল সুটকেসে। শর্মার ওয়ার্ডরোবটা খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সারি সারি জামপ্যান্ট ঝুলত। তলার তাকে রাখত সাবান, সেভিং সেট, মাথার তেল, চিকি সুপুরির কৌটো। সাবান মোড়া কাগজটা খালি। পড়ে আছে। কাগজটা হাতে নিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল—শর্মা নামক কোনও ব্যক্তি এক সময় এই ঘরে অধিবাসী ছিলেন।

শর্মার টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে দেখল, শর্মার কোনও স্মৃতি যদি পড়ে থাকে। না কিছু পড়ে নেই। দুটো বাসের টিকিট পড়ে আছে—আবদিস থেকে আমির গেট। টিকিট দুটো সঞ্জয় পকেটে রেখে দিল।


রাতে ডাইনিং হল প্রায় খালি। সেখানের সবাই প্রায় চলে গেছেন। সঞ্জয়ের আহারে তেমন রুচি ছিল না। একলা একটা টেবিলে কোনওরকমে কিছু খেয়ে নিল। অন্যদিন মিষ্টির ডিস শর্মা নিয়ে আসতেন। সঞ্জয় মিষ্টি খেল না। এই প্রতিষ্ঠানে এই তার শেষ আহার।

মেঘলা আকাশ থমকে আছে মাথার ওপরে। সাদা পিচের রাস্তা একটা মোচড় মেরে সোজা

এগিয়ে গেছে তাদের ছোট ছোট কটেজের দিকে। ওয়ার্ডেনের অফিসের ছাদের ওপর লতিয়ে লতিয়ে উঠে গেছে টিকোমা জেসমিন। থোকা থোকা সাদা সাদা ফুল ঝুলছে। দেয়ালে চিঠি ফেলার লেটার বক্স।

সঞ্জয় ধীরে ধীরে হাঁটছে। বড় শান্ত চারপাশ। কেন যেন কানে সে চুড়ির শব্দ পাচ্ছে। কাচের চুড়ি। চোখের সামনে উড়ছে নীল শাড়ির আঁচল। আজকের দিনটা তার অন্যরকম হতে পারত! ইন্দিরা, রূপা আর সে তিনজনে চারমিনারের উঁচু মিনারে। সালারজং মিউজিয়ামে, গোলকুণ্ডা ফোর্টে! পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ। কথা, গান, ধোসা, কফি। কত কী হতে পারত! রূপা বলেছিল তার খুব ড্রাগস খেতে ইচ্ছে করে। শুনেছে, কলকাতার কলেজের ছেলেমেয়েরা নাকি স্বপ্নের জগতে চলে যায়। সে নাকি এক অদ্ভুত অনুভূতি। রূপা এমনই এক ছেলেমানুষ।

একটা বই, হঠাৎ যেন তার মলাট দুটো বন্ধ হয়ে গেল। অনেক দূর এগোতে পারত এই কাহিনি। কত রাত, কত গান, কত কথা। রয়ে গেল দুই মলাটের ভেতরে। রইল। হয়তো আবার খোলা। হবে কোনওদিন। আবার না-ও হতে পারে।

এক্সপ্রেস ছেড়ে গেল হায়দ্রাবাদ স্টেশন থেকে। ভীষণ তার গতি। নায়কের শেষ চরিত্র ক্রমশই চলেছে দূর থেকে দূরে—জীবনের আর এক ঠিকানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *