১১-১২. অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা
হৃষীকেশ থেকে যে অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা এসেছিল, সেটাকে সম্ভবত হোটেলের অমিতাভই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে মানা করেছিল। চন্দ্রবদনীদের বাড়িতে যেতে হলে যেখানে বড় বাস্তা ছেড়ে দিয়ে চড়াইয়ে উঠতে হয়, সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল গাড়িটাকে সে।
চন্দ্রবদনার সঙ্গে তার ঠাকুর্দা কেশর সিং সাহেব এবং চামৌলির বড়ি বুয়ার আশীর্বাদ নিয়ে নেমে এসে গাড়িতে যখন উঠল চারণ, তখন আলো ফুটে গেছে, তবে রোদ আসেনি। পাহাড়তলিতে তো বটেই, অলকানন্দাতেও।
নদীরও রূপ, সমুদ্রেরই মতন, দিনে রাতের প্রহরে প্রহরে যে কত বিভিন্ন হয়, তা এই সব অঞ্চলে এসে লক্ষ করে ও অবাক হয়েছে।
নদী তো এর আগেও কতই দেখেছে! কিন্তু যেখানেই গেছে এর আগে বেড়াতে, সেখানেই হয়তো ওর কলকাতার মনটা আর চোখদুটিকে কলকাতার অনুষঙ্গের সঙ্গে সাথী করে বয়ে নিয়ে গেছে। এই বোধহয় প্রথমবার নিজের উপরে নিজে তিতিবিরক্ত হয়ে, নিজের জীর্ণ, মলিন, অভ্যেসে-অভ্যেসে পরাভূত আমিটার ভিতর থেকে ওর অন্য আমিকে নিয়ে এই দেবভূমিতে এসেছে। অন্যত্র যখা গেছে এর আগে চোখ দিয়ে দেখেছে অনেক কিছুই। কিন্তু আবার দেখেওনি। মানে, চোখ দিয়ে দেখেছে, মন দিয়ে দেখেনি। তাই এবারের চারণের জন্যে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন চমক উপস্থিত হচ্ছে। চারণের জীবন সাম্প্রতিক অতীত থেকেই কোনও এক আশ্চর্য যাদুকরের যাদুদণ্ডের পরশে সত্যিই নতুন হয়ে উঠেছে। নিজেই চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছে ও। প্রতিমুহূর্তে।
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। অলকানন্দার উপরের ছোট ব্রিজ পেরিয়ে এখন চলেছে অলকানন্দাকে ডানপাশে রেখে শ্রীনগরের দিকে। দেখতে দেখতে জিম করবেট-এর রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা শিকারের জায়গাটাও পেরিয়ে এল ওরা। পাটনের বর্ণনা-দেওয়া সেই বোর্ডটিও দেখল। এক ঝলক মাত্র, চলন্ত গাড়ি থেকে।
চন্দ্রবদনী বলল, দিনের এই সময়টুকুকে ভারী ভাল লাগে আমার।
তাই?
হুঁ।
পউরিতে যাওয়ার কি অন্য কোনও পথ নেই?
এখান থেকে? না, এখান থেকে একটিই পথ।
শ্রীনগর হয়ে?
হ্যাঁ।
শ্রীনগরের উচ্চতা কত?
শ্রীনগর উপত্যকায়। সমতলও। তবে সমুদ্রতল থেকে দুহাজার ফিট মতন হবে। কেন? দেবপ্রয়াগ থেকে আসবার সময়েতো শ্রীনগর হয়েই এসেছিলেন! লক্ষ করেননি বুঝি!
ফিট কেন? মিটার নয় কেন?
বলেই বলল। আমরা অবশ্য সতেরোশ ষাটগজে মাইল এই হিসেবই জেনে এসেছি। আমি গোঁড়া মানুষ। ক্যালকুলেটরও ব্যবহার করতে পারি। পারি না, না। অথবা করি না।
বাঃ।
বাঃ কেন?
আমিও পারি না।
চন্দ্রবদনী বলল, লজ্জিত না হয়েই। কম্পুটারের যুগে যে-মানুষ ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারে না তার অবশ্যই লজ্জা হওয়া উচিত। তবু হয় না দেখেই লজ্জিত হয়।
চারণ শুধোল, এই জায়গাটির কি নাম?
চান্টিখাল।
তারপরই বলল, আশ্চর্য! দেখতে দেখতে আমরা দশ মাইল চলে এলাম।
অর্থাৎ ষোলো কিমি মতন?
হবে।
রুদ্রপ্রয়াগের উচ্চতা কত?
দুহাজার ফিট মতো।
এই চান্টিখাল থেকে শ্রীনগর কতদূর পড়বে?
বারো-তেরো মাইল হবে।
শ্রীনগর থেকে কোনদিকে যাব আমরা?
আপনি পাটনের সঙ্গে যে পথ দিয়ে এসেছেন, দেবপ্রয়াগ হয়ে, অলকানন্দার বাপাশ থেকে ডানপাশে নতুন সেতু পেরিয়ে, সেই পথে না গিয়ে আমরা চলে যাব শ্রীকোট হয়ে পউরি। চীর, পাইন, দেওদার-এর সুগন্ধি বনের মধ্যে দিয়ে প্রায় খাড়া চড়াইয়ে। পউরির উচ্চতা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফিট মতন।
আপনার পউরিতে কি কাজ?
কাজ তো তেমন কিছু নেই! আমার শাশুড়ি ওখানে এসে রয়েছেন ট্যুরিস্ট লজ-এ। চেঞ্জের জন্যে। প্রতি বছরই এখানে এই সময়ে এসে থাকেন দিন পনেরো।
ও।
চারণের মনে নানারকম ভাবনা এল। চন্দ্রবদনী, তার বাড়ি, তার ঠাকুর্দা, তার বড়িবুয়া পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। যদিও চুকারের সঙ্গে দেখা হল না। কিন্তু চন্দ্রবদনীর চলে যাওয়া স্বামীর মায়ের কাছে, কাছে মানে, তার শাশুড়ির কাছে তাকে হাজির করানোর পেছনে কি অভিপ্রায় থাকতে পারে, তা ভেবে পেল না চারণ। চন্দ্রবদনী স্থানীয় মেয়ে এবং অত্যন্ত সপ্রতিভ, শিক্ষিত মেয়ে। তার পক্ষে রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে পউরি একা একা যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। অথচ পাটন কেন যে চারণের জিম্মায় দিল তাকে, তা কে জানে! এর পেছনেও কি কোনও চক্রান্ত আছে? He can very well small a rat। সে কি জ্যোতি বসু হয়ে যাবে? চতুর্দিকেই, তাঁর নিজ মতে, গভীর চক্রান্ত-বেষ্টিত?
মুখে সে প্রসঙ্গে কিছু না বলে, চারণ বলল, পউরি জায়গাটাতে কী আছে? দেখার মতন কিছু আছে?
দেখার মতন কিছু আছে কি নেই সে কথা তো যে দেখে তার চোখ, আর যাকে বা যা দেখে, তার গুণপনার উপরেই নির্ভর করে। তৃতীয় জনের কি কোনও এক্তিয়ার আছে সে বিষয়ে মন্তব্য করবার? তবে?
পউরি, জওহরলাল নেহরুর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা হিসেবে। এখান থেকে যে কতগুলি বরফাবৃত চুড়ো পরিষ্কার দেখা যায়, তা বলার নয়! ট্যুরিস্ট লজ-এর বাগানে রোদের মধ্যে চেয়ার পেতে বসে থাকলেই দিন কেটে যায়। সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে মার্চ পর্যন্ত তো এই দৃশ্যের কোনও তুলনাই নেই।
কোন কোন পিক দেখা যায়?
কত নাম বলব? যেমন, স্বগরোহিনী, চৌখাম্বা, হাতিপর্বত, ত্রিশূল, নীলকণ্ঠ, কামলিং..
বা বাঃ। আপনিও ভুগোলের দিদিমণি হয়ে গেলেন দেখছি!
আরও আছে।
যেমন, সুমেরু পর্বত, খচাকুণ্ড। কেদারনাথ তো আছেই! এ ছাড়াও আছে বান্দরপুঞ্ছ, ভৃণ্ডপন্থ, জৌনলি, গঙ্গোত্রী গ্রুপ ইত্যাদি।
এ সবই শৃঙ্গ?
হ্যাঁ।
এত শৃঙ্গর মধ্যে বাস করে কেউ? শৃঙ্গবিদ্ধ হয় না?
চন্দ্রবদনী হেসে বলল, যাদের মধ্যে বিদ্ধ হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, তারা হয়তো হয়।
চারণ হেসে বলল, বাবাঃ এক নাগাড়ে ট্যুরিস্ট গাইডেরাও এত নাম আউড়াতে পারবে না।
হাসল, চন্দ্রবদনী।
রোদে এখন চারপাশ ঝলমল করছে। রোদ এসে পড়েছে চন্দ্রবদনীর কোলে।
হালকা ছাই-রঙা একটি শান্তিপুরী শাড়ি পরেছে ও। সাদা ব্লাউজ। শাড়ির পাড় গাঢ় খয়েরি। চুলে একটি সাদা চন্দ্রমল্লিকা খুঁজেছে। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের মতন কার্তিকের প্রথম চন্দ্রমল্লিকা। আ লিটল আর্লি ফর দ্যা সিজন, দো। গায়ে একটি ছাইরঙা পশমিনা শাল। তার শরীর থেকে ফিরদৌস আতরের হালকা খুশবু উড়ছে। কেন জানে না, ভারী ভাল লাগছে চারণের। এত ভাল বহুদিন, বহু বছর লাগেনি। তুলির কাছাকাছি যখন থাকত, তখন ছাড়া। তাও শেষের দিকে তুলির সঙ্গও তেমন ভাল লাগত না।
এই মূহুর্তে, এক গভীর কারণহীন প্রশান্তি তার মনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছে। কেন জানে না, বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে শরীর পৌনঃপুনিক ভাবে এসে গেলেই সম্পর্কর জেল্লাটা সম্ভবত চটে যায়। শারীরিক ব্যাপার মাত্রই বোধহয় স্কুল। কিংবা কে জানে! চারণের মানসিকতাটাই বোধহয় অস্বাভাবিক সুশ্ন। সবরকম স্থূলতার সঙ্গেই তার জন্মবিরোধ। আর সে জন্যেই তো এত এবং এতরকম কষ্ট ওর! জয়িতার মানসিক সঙ্গয় ও খুবই আনন্দ পেত, কিন্তু যে মুহূর্তে চারণ বুঝে গেছিল যে, জয়িতা তাকে ভালবাসে না, ভালবাসা ভালবাসা খেলা করে মাত্র, ধড়িবাজ বেড়াল যেমন ইঁদুরের সঙ্গে খেলে, সেই মুহূর্তেই জয়িতার প্রতি সব দুর্বলতাই আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছিল। তবু, জয়িতার মধ্যেও ভাললাগার মতন অনেক কিছুই ছিল। প্রতিরাতেই জয়িতাকে ফোন করত একবার করে পুরনো অভ্যেসের বশে। কোনও কোনও উইক-এন্ডে বা রবিবার তাজ-বেঙ্গলে কী ওবেরয় গ্রান্ডে কী অ্যাম্বারের দোতলাতে বা বেঙ্গল-ক্লাব বা স্যুইমিং ক্লাবে খেতে যেত ওকে নিয়ে। একদিন পিয়ারলেস ইন-এর আহেলীতে গিয়ে বাঙালি খানাও খেয়েছিল। কিন্তু সেই সব ক্ষিদেহীন খাওয়া, প্রেমহীন কাম এরই মতন মনকে আলোড়িত করত না আদৌ। সেই সব outing-ও অভ্যেসেই পর্যবসিত হয়ে গেছিল। চারণের মতনই হয়তো অনেক আধুনিক, শিক্ষিত, কৃতী মানুষই বোঝেন যে, জীবনে অন্য অনেক বিপদের হাত থেকেই বাঁচা যায়, বাঁচা যায় না একঘেয়েমি, অভ্যেসের দাগা আর জরার হাত থেকে। অমন জীবন, মৃত্যুর চেয়েও অনেকই বেশি অনাকাঙিক্ষত।
চন্দ্রবদনীর মধ্যে শতকরা কুড়ি ভাগ তুলির, তুলির শর্তহীন সমর্পণ-তন্ময়তা, কুড়িভাগ জয়িতার চাকচিক্য, সমাজে প্রেজেন্টেবিলিটি এবং ষাট ভাগ চন্দ্রবদনী আছে। ওরিজিনাল। তার কোনওই প্রোটাটাইপ বা বিকল্প নেই। চন্দ্রবদনীর মতন মেয়ে হয়তো ভারতবর্ষে একটিই। গাড়োয়াল হিমালয়ের বরফাবৃত একমাত্র শৃঙ্গ, কুঞ্জাপুরী থেকে দেখা চন্দ্রবদনীরই মতন।
লোকজন গাড়িঘোড়া দেখছি আজ শ্রীনগরে এখনও খুবই কম। ভালই হল। আমরা ফাঁকায় ফাঁকায় পউরির রাস্তাতে উঠে যেতে পারব।
চন্দ্রবদনী বলল।
প্রায় আটটা তো বাজে। শহর যেন সত্যিই আজ একটু বেশি ঘুমঘোরে আছে বলে মনে হচ্ছে। আসবার সময়ে এগারোটা নাগাদ এসে পৌঁছেছিলাম। তখন প্রায় কলকাতা শহর বলেই মনে হয়েছিল।
চারণ বলল।
চন্দ্রবদনী বলল, এই শ্রীনগরই তো ছিল আগে গাড়োয়াল রাজ্যের রাজধানী। শ্রীনগর চিরদিন শহরই ছিল। গোখাদের আক্রমণে সন্ত্রস্ত হয়ে ব্রিটিশের সাহায্য নেওয়ার সময়ে গাড়োয়ালের আধখানি ভেট দেন গাড়োয়াল রাজ। গাড়োয়াল যে দুভাগ হয় শুধু তাইই নয়, দুটি আলাদা নামও হয়, গাড়োয়ালের। তেহরি গাড়োয়াল আর পউরি গাড়োয়াল। গাড়োয়ালরাজ-এর রাজধানী শ্রীনগর থেকে তেহরিতে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর পউরি গাড়োয়ালের পুরোটাই চলে যায় ব্রিটিশের তাঁবে।
চারণ বলল, সেই জন্যই জিম করবেট-এর লেখাতে পড়েছি পউরির ডিভিশানাল কমিশনার, করবেট-এর বন্ধু ইটসন সাহেব থাকতেন পউরিতে। জানতাম না যে পউরি, পউরি-গাড়োয়ালের হেড-কোয়াটাসও ছিল পউরিতে। উঁচু জায়গা। সুন্দর নিসর্গ। সাহেবদের বেশ হোম হোম লাগত বোধ হয়, তাই ডিভিশানাল কমিশনার সেখানেই থাকতেন।
হয়তো তাই।
চন্দ্রবদনী বলল। অবশ্যই ওটি ছাড়াও আরও নানা কারণ ছিল।
তারপরই বলল, আজ কী বার? রবিবার কি?
না তো!
একটু পরেই জেগে উঠবে শহর রইরই করে। শহর জেগে ওঠার আগেই আমরা পেরিয়ে যাব শ্রীনগর। ও, জানি না পাটন আপনাকে বলেছে কি না, এই শ্রীনগরেই কিন্তু গাড়োয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ও। উত্তরাখণ্ড নিয়ে যে আন্দোলন তার Epicentre হচ্ছে শ্রীনগরের বিশ্ববিদ্যালয়।
একটু চুপ করে থেকে বলল, আর বিখ্যাত কমলেশ্বর মন্দিরও এখানেই। মানুষে বলেন, এই মন্দিরেই নাকি রামচন্দ্র হাজার পদ্মফুল নৈবেদ্য দিয়েছিলেন মহাদেবকে। কমল-এর অর্ঘ্য দান করেছিলেন বলেই এই শিবের নাম কমলেশ্বর শিব। কমলেশ্বর মন্দির ছাড়াও অনেক মঠ-মন্দিরও আছে কাছাকাছি।
শ্রীনগর থেকে রুদ্রপ্রয়াগ কত কিমি?
চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে।
এবারে গাড়িটা বাঁদিকে মোড় নিল।
আমরা এবারে, দেবপ্রয়াগের পথ ছেড়ে দিলাম। দুকিমি এসেছি শ্রীনগর থেকে এবারে ক্রমশই চড়াইয়ে উঠবে গাড়ি। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফিট উঠবে তো। মাত্র তিরিশ কিমি পথ বেয়ে এতখানি উঁচুতে উঠতে হলে চড়াই ভাল খাড়া হবেই।
চন্দ্রবদনী বলল।
তা ঠিক।
দেখতে দেখতে আবহাওয়াও বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। দুপাশের গাছগাছালির প্রকৃতি বদলে যেতে লাগল। ডানদিকে খাদ আর বাঁদিকে ঘন বনে ঢাকা প্রায় খাড়া পর্বত। চীর, পাইন, দেবদারু, হর্স-চেস্টনাট, ওক।
মিনিট পনেরো পর যখন কিছুটা উঠেছে উপরে, চারণ ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি রোকোতো জারা।
গাড়ি দাঁড় করালে, গাড়ি থেকে নেমে জোরে শ্বাস নিল। বাঁদিকের খাড়া পাহাড়ের উপরে গ্রাম আছে। গরু চরাচ্ছে কোনও রাখাল ছেলে। গরুর গলার ঘণ্টা বাজছে। দুটি ছেলে কাছে দূরে কথা বলছে। ভারী শান্তি এখানে। নির্মল পরিবেশে, নীলাকাশে, দূষণমুক্ত এইরকম কলুষহীন ভূখণ্ড যে আজও আছে এই পৃথিবীর বুকে, তা জেনেই আনন্দ হচ্ছে চারণের।
হাওয়া নেই কিন্তু এক আশ্চর্য পবিত্র সুগন্ধ চারদিকে, গাছ-গাছালির, ঘাস-পাতার। গন্ধটা পুজোর ঘরের গন্ধের মতন। কে জানে! এই জন্যেই হয়তো এসব দেবভূমি।
গাড়ির ভিতরেই বসে চন্দ্রবদনী চারণের পাগলামি দেখে হাসছিল।
চারণ ঘাড় উঁচু করে উপরে চেয়ে দেখছিল।
চন্দ্রবদনী বলল, সব পর্বতকেই মনে হয় অগম্য না হলেও দুর্গম। উতুঙ্গ। কিন্তু সেটা আপাত দৃষ্টিতে। এই খাড়া পর্বত-এর উপরে উঠতে পারলে দেখবেন সেখানে সবই আছে। মানুষের পা পড়েনি এমন জায়গা ত্রিলোকেই খুব বেশি নেই। এটা মন্দ যেমন, আবার ভালও। মালভূমি আছে, গোচারণ-ভূমি, গ্রাম, ছোট ছোট জনপদ দু-পাঁচ ঘরের। উপরে উঠলে দেখা যাবে আমাদের গ্রামেরই মতো সেখানেও রোদে লেপ শুকোতে দেওয়া হয়েছে, গরু-ছাগল চরছে, শিশুর চিৎকার, নারীর হাসি, বৃদ্ধর কাশি। এইসব নিয়েই হয়তো প্রকৃতি সম্পূর্ণ হয়। মানুষ বা বিধাতার নিজের হাতে গড়া কোনও কিছু দ্বারা প্রাণিত না হলে প্রকৃতি যেন অসম্পূর্ণ থাকে।
চারণ মুখে কিছু বলল না। কিন্তু মনে মনে বলল, তা কেন! গাছ-গাছালির, পাখ-পাখালির, পোকা-প্রজাপতি, ঝিঁঝিপোকা-নীলমাছির কি প্রাণ নেই। প্রাণ তো সর্বত্রই। প্রকৃতি সবসময়েই অন্য কারো চেষ্টা ব্যতিরেকেই প্রাণিত।
ও ভাবছিল, আশ্চর্য! খাড়াই চড়ছে, উঠেও এসেছে প্রায় পাঁচ কিমি মতো অথচ উলটোদিক থেকে একটি গাড়িকে নামতে দেখল না। এখন পর্যন্ত। উলটোদিক থেকে আসা কোনও ট্রাফিক নেই বলেই ড্রাইভার একটু অমনোযোগী হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। অদৃশ্য বাঁকে হর্ন দিচ্ছে না। এমন পাহাড়ি পথেও যতখানি উচিত ততখানি পথের বাঁদিক ঘেষে গাড়ি চালাচ্ছে না। যে কোনও মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অভ্যেস বসে চারণ প্রতি বাঁকের আগে থাকতেই তাকে বলে চলেছে হর্ন বাজানা। হর্ন বাজানা!
এই ড্রাইভারটি আড়িয়া পাঞ্জাবি। সম্ভবত দিল্লি বা হরিয়ানাতে বাড়ি। কথায় কথায় হাজি, হাজি করে বটে কিন্তু বিনয়ী আদৌ নয়। বেশ দুর্বিনীত। অথবা কানে কম শোনে। কানে কী একটা ওষুধও লাগাচ্ছিল রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বেরোবার আগে। ডান কানের ফুটোতে ওষুধটা বিল্ট-ইন ড্রপারে করে ঢেলে, ডান কানের পাতা ধরে এমন টানাটানি করছে তখন থেকে একটু সুযোগ পেলেই যে, চারণের মনে হচ্ছিল কানের পাতাটি বোধহয় স্থানচ্যুতই হবে। মানুষটার নাক চিবুক কাটাকাটা হলে কী হয়, বুদ্ধিটা সম্ভবত ভোঁতা : কথা বললে, বুঝতে সময় নেয় এবং শুধু সময়ই নেয় না, কথা ঠিকমতো বোঝেও না। আর যখন বোঝেও, তখনও তা শোনে না। অবাধ্য এবং গোঁয়ার। একটি বিস্কিট-রঙা ফুলহাতা সোয়েটার পরে, ডানদিকে বেঁকে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে, মুখে এমনই এক ভাব ফুটিয়ে বসে রয়েছে, যেন চারণদের বৈতরণীই পার করাচ্ছে সে।
নাম ক্যা হ্যায় তুমহারা?
জী?
তুমহারা নাম ক্যা?
রওনাক সিং।
বাঁতে তো শুনা করো।
আপ বহতই জাদা বাঁতে করতেঁ হ্যায়। বেকারকি। বাঁতে শুননা, না গাড়ি চালানা?
চারণ, চন্দ্রবদনীর সামনে অপ্রতিভ হল।
ভাবল, ঠিক আছে। মওকা আসুক। তোমাকে কি করে কড়কাতে হয় তখন দেখাব।
মুখে বলল, হর্ন বরাবর হর-টার্নিহিমে বাজাতে চলনা।
রওনাক সিং উত্তর দিল না কোনও। বাঁ হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান কানটা নিয়ে আবার টানাটানি করতে লাগল।
এবারে অনেকখানি উঠে এসেছে ওরা। সত্যিই আশ্চর্যের কথা। এতখানি পথ এল অথচ একটিও প্রাইভেট গাড়ি, বাস, জিপ বা ট্রাক উঠতে কী নামতে দেখল না এই পথ বেয়ে। পউরি শহরটা কি এমনই নির্জন, নিরুপদ্রব? এখনও? তাহলে প্রতি বছর ছুটিতে এখানে এসেই থাকবে এবার থেকে। জওহরলাল নেহরু হয়তো এই কারণেই আসতেন এখানে ঘন ঘন।
রাস্তাটা বাঁয়ে একটা মোড় নিতেই চারণ স্বতঃস্ফূর্ত, উচ্ছ্বসিত স্বগতোক্তি করে উঠল। বাঃ। অপূর্ব।
চন্দ্রবদনী স্মিতহাসি হাসছিল, মুখে কথা না বলে।
ডানদিকে পর্বতশ্রেণীর অতগুলি চুড়ো সকালের রোদে একেবারে ঝকমক করে উঠল। আব চুড়ো বলতে সাধারণত মানুষে যা বোঝে তেমন চুড়োও নয়। সবকটি চুড়োই বরফাবৃত তো বটেই পর্বতের শরীর থেকে এবং হাঁটু পর্যন্ত সবটাই বরফে মোড়া। পুরো পর্বতমালাই বরফাবৃত। কোন চুড়ো ফেলে কোন চুড়োকে দেখবে?
চারণ বলল, কী যেন সব নাম বলেছিলেন আপনি? আর একবার বলুন না? মিলিয়ে নিই। এক এক করে।
চন্দ্রবদনী হেসে বলল, সত্যি সত্যিই আবার বলতে হবে?
সত্যি সত্যিই?
তবে বলছি আবার মিলিয়ে নিন।
বলতে যাওয়ার আগেই পথটা বাঁদিকে আর একটা বাঁক নিতেই সবগুলো ঝকঝকে শৃঙ্গ একইসঙ্গে মিলিয়ে গেল।
চারণ বলল, একী লুকোচুরি!
চন্দ্রবদনী হাসছিল। বলল, সমস্ত প্রার্থিত জিনিসই যদি অত সহজে পাওয়া যেত তাহলে তার দাম থাকত না কানাকড়িও। তাছাড়া যা প্রার্থনার, তা পাওয়া হয়ে গেলেও পাওয়ার ঘরে বেশিদিন কখনওই লাগাতার তাকে রাখতে নেই।
তাই? বলেই, চারণ অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
মিনিট পাঁচেক পরেই আবার পথটা একটা বাঁক নিতেই সবকটি শৃঙ্গ একই সঙ্গে আবারও ঝকঝক করে উঠল।
পাহাড়ে, আদেখলা বাঙালি চারণ, গাড়োয়ালকন্যা চন্দ্রবদনীকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ওই যে সবকটা দেখা যাচ্ছে আবার।
চন্দ্রবদনী হেসে বলল, সব নয়। আধেক ধরা পড়েছে আপনার চোখে, আধেক এখনও বাকি আছে। এখান থেকে প্যানোরোমিক ভিউ তো পাওয়া যাচ্ছে না।
তবু, নামগুলো আরেকবার বলুনই না। আপত্তি আছে?
চারণ স্কুলের ছাত্রর মতন ছটফট করতে করতে বলল।
চন্দ্রবদনী হাসতে হাসতে বলল, নাম বলছি। কিন্তু কোনটা কি তা পউরিতে পৌঁছে ট্যুরিস্ট লজ-এর বাগানে বসে চিনিয়ে দেব আপনাকে। নামগুলো এখন উলটোপালটা হয়ে যাবে, মানে যেমন দেখতে পাচ্ছেন চোখে তেমন ক্রমানুসারে হবে না।
নাই বা হল। বলুন!
স্বগরোহিনী, চৌখাম্বা, হাতিপর্বত, ত্রিশূল, নীলকণ্ঠ, কামলিং…
তারপর?
সুমেরু পর্বত, খর্চাকুণ্ড, কেদারনাথ, বান্দরপুঞ্ছ, ভৃগুপন্থ, জৌনলি, গঙ্গোত্রী গ্রুপ এইসব।
আচ্ছা, সত্যিই কি মানে, মহাপ্রস্থানে-আসা পাণ্ডব লক্ষ্মণ হনুমানজির লেজে পথ আটকে থাকাতে, যেতে বাধা পেয়েছিলেন?
চন্দ্রবদনী হাসল।
বলল, আপলকে কে বলল?
বলেছিলেন, হৃষীকেশের কাছে কুঞ্জাপুরীর মন্দিরের পুরোহিত কুঁয়ারসিংজী।
তাই?
তারপর বলল, দেখুন, আমি যেমন আমার দাদুর গৌতম বুদ্ধকেও চোখে দেখিনি তেমন হনুমানজিকেও চোখে দেখিনি। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই যে মহাবীব, মহম্মদ, যিশুখ্রিস্ট, শ্রীকৃষ্ণ, মহাদেব ইত্যাদি ইত্যাদি ধর্মগুরুকে মেনে নিয়ে, তাঁদের অনুশাসন মেনে নিয়ে, তাদের নিজের নিজের জীবনে শুদ্ধতা, ন্যায়, নীতি আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, বর্তমান সময়ের সর্বজ্ঞ এই বিষম ভূঁইফোড় অবিশ্বাসীদের মধ্যে বাস করেও, সেটাই বা কম কি? পৃথিবীর কোনও ধর্মই, কোনও ধর্মগুরুই তো কোনও মানুষকে খারাপ কিছু করতে বলেননি এ পর্যন্ত। যা-কিছুই মানুষকে ন্যায় বা শুভবোধের প্রতি মনোযোগী করে তোলে, সে সবকে খারাপ আখ্যা দেওয়ার কি দরকার? লক্ষ্মণ যদি হনুমানজির লেজ এ পথ আটকেই গিয়ে থাকেন এবং হনুমানজি যদি পরে দয়াপরবশ হয়ে নিজেই তাঁর লেজকে সরিয়ে লক্ষ্মণের চলার পথ সুগম করে দিয়ে থাকেন, অন্তত তেমন করেছিলেন বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, তাতে আমার আপনার কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটছে কি? কোনও ধর্মে আর এইরকম কাহিনী নেই?
চারণ চুপ করে গেল। বুঝল যে, তার প্রশ্নটিই বোকার মতন হয়েছিল।
বেশ অনেক উপরে উঠে Snow-line-এর অনেক নীচে, পাদদেশে, বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে। পউরিতে কি পৌঁছে গেল ওরা?
ভাবছিল চারণ। একটু পরই প্রায় খাড়া পথটি একটি সমকৌণিক বাঁক নিয়েছে বাঁয়ে। গাড়িটিও বাঁক নিতেই ওরা চমকে উঠে দেখল প্রায় শ দুই ছেলে, তাদের মধ্যে দু-তিনজন মেয়েও ছিল, একটা সমতল জায়গাতে, পথ অবরোধ করে জমায়েত হয়েছে। জায়গাটি পাহাড়ি শহরের ম্যাল-এর মতন। বাজার, বাসস্ট্যান্ড সবই সম্ভবত এখানে। কিন্তু সব কিছুই বন্ধ রয়েছে। থমথমে ভাব
এতখানি পথ এসে এই অবরোধ! কী ব্যাপার, কে জানে!
ওদের গাড়ি দেখেই ছেলেরা তিনদিক দিয়ে তেড়ে এল ভীষণ রাগের সঙ্গে চিৎকার করতে করতে। বলতে লাগল, রোকো। গাড়ি রোকো!
বুদ্ধিহীন, গোঁয়ার রওনাক সিং গাড়ি জোরে চালিয়ে আরও উপরের ট্যুরিস্ট লজ-এর দিকে যেতে চেষ্টা করছিল মুখের মতন ওই উত্তেজিত জনতাকে অগ্রাহ্য করে, প্রায় তাদের চাপা দিয়েই।
চারণ, আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করল।
ছেলেরা, গাড়ির বনেটে, দরজায়, ছাদে জোরে জোরে থাপ্পড় এবং লাথি মারছিল। ব্যাপারটা কি? তা ভাল করে বোঝবার আগেই ইডিয়ট মাথা-মোটা রওনাক সিং গাড়িটা চড়িয়ে দিল জনতার উপরে। যদিও তখন গাড়ি প্রায় গতিরহিত হয়ে গেছিল। বুদ্ধিভ্রংশ হয়েই করল, না ভয়ে, বোঝ গেল না। চড়িয়েই, স্বগতোক্তি করল কী যেন বিড়বিড় করে। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে।
পাছে, জনতা চন্দ্রবদনীর কোনও ক্ষতি করে সেই চিন্তাতে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নীচে নামতে গেল চারণ। বিপদের সময় যা ঘটে, বিপদের উপর বিপদ, দরজা হঠাৎ খুলতেই, পাশে দাঁড়ানো ছেলেদের কারও কারও গায়ে দরজাটা গিয়ে ধাক্কা দিল। আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই চার-পাঁচজন ছেলে উড়ে এসে পড়ল চারণের উপরে। কিল-চড়-ঘুষি বৃষ্টির মতন পড়তে লাগল।
চন্দ্রবদনীকে দেখে গাড়োয়ালি বলে আদৌ মনে হয়নি। তার গড়ন তার মায়ের মতন। তাই বাঙালি বলেই মনে হয়। কিন্তু সে যখন বাঁদিকের দরজা খুলে নেমে গলা তুলে সেই জনতাকে ভর্ৎসনা করল গাড়োয়ালিতে তখন জনতার মধ্যে অধিকাংশ যুবকই শান্ত হল কিন্তু যারা মাটিতে ফেলে চারণকে মারছিল তারা মেরেই চলল। উন্মত্ত, ক্ষিপ্ত জনতার ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিবেক বা কাণ্ডজ্ঞান বলে থাকে না কখনওই কিছুমাত্র। প্রত্যেক জনতারই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং ক্ষিপ্ততা দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে, নিয়ন্ত্রণবিহীন হয়ে।
তখন জনতার মধ্যে যে দু-তিনটি মেয়ে ছিল তারা এসে চন্দ্রবদনীর কাছে দাঁড়াল। গাড়োয়ালি এবং ইংরেজিতে কথা বলল তারা চন্দ্রবদনীর সঙ্গে। এবং মেয়েদের মধ্যে একজন গিয়ে উন্মত্ত ছেলেগুলিকে থামাল। চারণের গায়ের উপর সালোয়ার-কামিজ পরা সেই মেয়েটি শুয়ে পড়ল। চারণকে বাঁচাবার জন্যে। তা করতে গিয়ে সেই মেয়েটিও উন্মত্ত ছেলেগুলির হাতে মার খেল। মেয়েটি একটা সালোয়ার কামিজের ওপর Shocking Pink রঙা ফুলহাতা সোয়েটার পরেছিল। তার খোঁপাটি থাপ্পড়ের চোটে খুলে গেল। চুল ছড়িয়ে গেল পিঠময়।
শকিং-পিঙ্ক রংটি চারণের চিরদিনের অপছন্দ। কিন্তু সেই মুহূর্তে রংটিকে বড় সুন্দর বলে মনে হল ওর। মনে হল, তা ওর জীয়নকাঠির রং।
উত্তেজনা প্রশমিত হলে জানা গেল যে, সমস্ত পাহাড় ও উপত্যকাতে আজ ভোর থেকে বন্ধ ডাকা হয়েছে। চারণেরা কেন সেই বন্ধ অমান্য করে নীচ থেকে এত দূরে এসেছে? এটা কি স্বেচ্ছাকৃতভাবে বন্ধু-কে অমান্য করা নয়?
কেন বনধ ডাকা হয়েছে তা চন্দ্রবদনী জিগ্যেস করাতে জনতা বলল, যে পুলিশ কাল রাতের কোনও সময়ে উত্তরাখণ্ড আন্দোলনের দুজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে গুলি করে মেরে দিয়েছে। আজ ভোরে তাদের লাশ নাকি ভাসতে দেখা গেছে অলকানন্দার হিমশীতল খরস্রোতা জলে এবং সেই লাশ ছাত্ররা উদ্ধার করেছে।
চারণ ভাল করে লক্ষ করে দেখল যে, ছেলেগুলি সকলেই ছাত্র এবং শিক্ষিত। মুহূর্তের মধ্যে চারণের মনে পড়ে গেল গত পরশু পাটনের করা ভবিষ্যদ্বাণী।
শাস্তি অবশ্য চারণের যথেষ্টই হয়েছে। একটা ভুরু কেটে চোখ ফুলে যাওয়াতে চোখে কিছু দেখতেই পাচ্ছে না। নীচের ঠোঁটটিও কেটে গেছে প্রায় দুফাঁক হয়ে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, জামা কাপড় ভেসে যাচ্ছে। জনতার রোষ তখনও পুরো প্রশমিত হয়নি। চন্দ্রবদনী যদি গাড়োয়ালিতে কথা না বলত সময়মতন, তবে কী যে হত তা বলা যায় না। হয়তো সে মারাই যেত!
জনতা তখনও গাড়ির সামনেটাতে অবরোধ করে দাঁড়িয়েই ছিল। ইডিয়ট রওনাক সিং দু-চারটে লাথি-কিল-চড় হজম করে নিয়েছে। ভরপেট খাওয়ার পর মানুষে যেমন হজমিগুলি খায়, তেমনই মানসিকতাতে। জাঠেরা ওইরকমই হয়, তাই ভাল সৈন্যও হয় তারা। একটি ছেলে রওনাক সিং-এর ফুলহাতা সোয়েটার ধরে জোরে টানাতে, মেশিনে-বোনা সোয়েটারটার সেলাই কিছুটা ছিঁড়ে গেছে কাঁধের কাছে। ব্যসস। ক্ষতি বলতে ওর ওইটুকুই। অথচ গাড়িটা যদি সে ক্ষিপ্ত জনতার উপরে অমন বে-আক্কেলের মতন চড়িয়ে না দিত তবে হয়তো শিক্ষিত ছাত্রেরা অতখানি ক্ষিপ্ত হত না। দরজা খুলে চারণ চন্দ্রবদনীর বিপদের কথা ভেবেই নামতে গেছিল। তার যে অমন প্রতিক্রিয়া ঘটাব তা তো জানেনি আগে।
চন্দ্রবদনী যখন মেয়েদের বুঝিয়ে বলল যে, ওরা কিছুই জানত না এসব, তবে সারা পথে এবং শ্রীনগরেও সুনসান ভাব দেখে সন্দেহ অবশ্যই হয়েছিল যে কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু সেটা যে কী…
আশ্চর্য! শ্রীনগরে রওনাক সিং একটি পেট্রল পাম্প থেকে পেট্রলও নিয়েছিল। সেখানেও কেউই কিছু বলল না, সাবধান করল না। সত্যিই কোনও দোষ ছিল না ওদের।
চন্দ্রবদনীর অনুরোধে জনতা পথ ছাড়ল উপরের ট্যুরিস্ট লজে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু শাসিয়ে দিল যে, নীচে নামা চলবে না কোনওমতেই। আজ এবং কালকেও ব উঠবে সে কথাও বলা যাচ্ছে না। লাগাতার বনধ চলতে পারে অনির্দিষ্টকাল, কর্তৃপক্ষ উত্তর প্রদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা না নিলে!
চন্দ্রবদনী চারণের জন্যে ডাক্তারখানা বা হাসপাতালের কথা বলতে গেলে, জানা গেল, সব বন্ধ। তখন চন্দ্রবদনী গাড়িতে উঠে বলল, ট্যুরিস্ট লজে চলুন। সেখানে আমার শাশুড়ি আছেন। তিনি খুব ভাল পারেন এসব। ট্যুরিস্ট লজে ডেটল, ব্যান্ডেজ ইত্যাদিও থাকার কথা।
গাড়িটা ওই ম্যাল মতন জায়গাটা পেরিয়ে কিছুটা গিয়েই আবারও চড়াই চড়তে লাগল। মনে হল, ট্যুরিস্ট লজটা শহরেব সবচেয়ে না হলেও, বেশ উঁচু জায়গাতে হবে নিশ্চয়। যাতে তুষারাবৃত পর্বতমালা সবচেয়ে ভাল দেখা যায়।
গাড়িটা যখন উঠছে তখন দেখল একদল ছেলে উপর থেকে নেমে আসছে। ওরা যখন কাছাকাছি এসেছে গাড়িব, চন্দ্রবদনী গাড়ির কাঁচ নামাল ওর দিকের। ভিড়ের মধ্যে একটি ছেলে হঠাৎ বাংলাতে বলল, আপনারা বাঙালি?
চন্দ্রবদনী বলল, হ্যাঁ।
কী করে হল এমন?
প্রশ্ন করেই উত্তরটাও বুঝতে পারল। তারপর স্বগতোক্তি করল, টেনশান অ্যান্ড একসাইটমেন্ট ইজ রানিং ভেরি হাই। আই ডোন্ট ব্লেম দেম। উত্তেজিত হবার কারণ তো ঘটেছেই।
রক্তাক্ত চারণ ওর দিকের কাঁচ নামাল। কিন্তু কথা ও বলতে পারল না।
ছেলেটি বলল, আমি এখানের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
টুরিস্ট লজে।
সেখানের গেটে তো তালা বন্ধ। আমি তো সেখান থেকেই আসছি। সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর হতে পারে, আগুনও লাগতে পারে, তাই।
সে কী! একজনের সঙ্গে তো দেখা করতেই এলাম আমি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে। ওঁর তো ওখানেই থাকবার কথা!
ম্যানেজার নেই, স্টাফ নেই, শুধু চৌকিদার আছে। তাকে জিগ্যেস করবেন, সে বলতে পারবে। লজ-এ তো কোনও ট্যুরিস্ট নেই, কেউই নেই। আমি যতদূর জানি। থাকবে কি করে? কোনও স্টাফই যদি না থাকে?
তারপর ছেলেটি বললেন, আপনাদের কিন্তু এখুনি চলে যাওয়া উচিত। এই বনধ কতদিন চলবে কে জানে! সিচুয়েশান কোনদিকে টার্ন নেবে, কে বলতে পারে!
তারপর অন্যদের সঙ্গে সামান্য পরামর্শ করে বললেন, শ্রীনগরের দিকে যাবেন না। সেখানেই তো আসল গণ্ডগোল। তাছাড়া ম্যালই পেরোতে পারবেন না। গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে কি ভাল হবে?
চন্দ্রবদনী বলল, তবে যাব কোনদিক দিয়ে?
ওই ছেলেটি এবং আরও দুজনে বললেন, বাবুখাল, পিপলিপানি, ঘুমখাল হয়ে কোটঘরে পৌঁছে চলে যান। কোটদ্বারে কোনও গোলমাল নেই। কোটদ্বার তো সমতলে। গণ্ডগোল যত সব তো পাহাড়েই। বনধও থাকবে না সেখানে। আর যদি সেরকম অবস্থা বুঝে পথেই কোথাও থেকে যেতে চান, তাহলে ল্যান্সডাউনেও থাকতে পারেন। পথ ছেড়ে কিছুটা ভেতরে যেতে হবে অবশ্য।
তারপর ছেলেটি শুধোল, আপনারা যাবেন কোথায়? দিল্লি?
হ্যাঁ। আমি দিল্লি যাব, উনি যাবেন…
বলেই, চন্দ্রবদনী চুপ করে গেল।
চারণ কোথায় যাবে, তা চন্দ্রবদনী কী করে জানবে?
চারণ ভাবছিল যে, ও নিজেই কি জানে! সে ত গন্তব্যহীন। তৈলাক্ত বাঁশে চড়তে গিয়ে কোটদ্বার থেকে কি আবারও পরিক্রমা শুরু করবে নতুন করে?
এঁর একটু চিকিৎসা-শুশ্রূষা কি কোথাও হতে পরে?
ছেলেরা এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
তারপর সেই বাঙালি ছেলেটি বলল, আজ যে সবই বনধ।
একশিশি ডেটল, একটু তুলো, কোনও পেইনকিলার ট্যাবলেট কিছুই কি পাওয়া যাবে না?
ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি স্থানীয় ছেলে ইংরেজিতে বলল, আপনারা টুরিস্ট লজ-এর দিকেই যান, সেখানে যাঁর খোঁজ করছেন তাঁর খোঁজ করুনই না হয় একবার গিয়ে। করে, যখন নেমে পিপলিপানির পথের দিকে যাবেন, আমি মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকব তুলল আর ডেটল নিয়ে। আমার মায়ের কাছে একস্ট্রা-স্টক রাখা থাকে।
চন্দ্রবদনী তাকে গাভোয়ালিতে ধন্যবাদ দিল। ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, আপনি তো চমৎকার গাড়োয়ালি বলেন।
চন্দ্রবদনী ওই বিপদগ্রস্ত অবস্থাতেও হাসল। কী করে হাসল, ওই জানে। ভারী সুন্দর আশ্বাস ও স্বস্তিবাহী সেই হাসি। বলল, আমি গাড়োয়ালিই। আমার বাড়ি রুদ্রপ্রয়াগে।
তাই?
অবাক গাড়োয়ালি ছেলেটি। বাঙালি ছেলেটিও কম অবাক হল না!
তারপরে বলল, আপনারা এগোন। ওই ছেলেটিও বলল, আমি এগিয়ে যাই। মা যদি বাড়ি থেকে কোথাও গিয়ে থাকেন তাহলেই মুশকিল হবে। কোথায় যে ওসব রাখেন, তাও জানি না আমি!
ট্যুরিস্ট লজ-এর সামনেটায় ষাট ডিগ্রি কোণে গেট-এর কাছে গাড়িটিকে যখন দাঁড় করাল রওনাক সিং তখন বাঁদিকে তাকিয়ে তার সব শারীরিক কষ্ট ও মানসিক উত্তেজনা ভুলে গেল চারণ। ঝকঝক করছে রোদে সারি বাঁধা শৃঙ্গের পর শৃঙ্গ। জওহরলাল নেহরু কেন বারবার এখানেই ছুটি কাটাতে যে আসতেন তা বুঝতে পারল ও।
রওনাক সিং হর্ন বাজাল। চন্দ্রবদনী নামল। তারপর হেঁটে, তালা বন্ধ গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চারণও নেমে ওই তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর দিকে তাকিয়ে রইল।
হর্ন-এর শব্দ শুনে চৌকিদার হেলতে-দুলতে এল। মুখে বিরক্তি নিয়ে। দূর থেকেই বলল, হাত নেড়ে, খোলা যাবে না।
চন্দ্রবদনী, সে গেট-এর কাছে এলে, গাড়োয়ালিতে তার সঙ্গে কী সব বলল। চৌকিদার মাথা নাড়ল। নেতিবাচক। তারপর হাত দিয়ে একটা ভঙ্গি করে কী যেন বলল। কিছু একটা দিলও চন্দ্রবদনীর হাতে। আরও কী সব বলল, গাড়োয়ালিতে। বুঝল না চারণ।
চন্দ্রবদনী, চিঠির মত কোনও কিছু পড়ল গেট-এর সামনে দাঁড়িয়ে। চৌকিদার তাহলে একটা চিঠিই দিয়েছিল ওকে।
চন্দ্রবদনী ফিরে এসে গাড়িতে উঠল। চারণও এসে বসল। বলল, ইচ্ছে করছে না এই স্বর্গ ছেড়ে চলে যেতে।
কোনও স্বর্গেই তো চিরদিন থাকা যায় না! চন্দ্রবদনী যেন একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল।
যায় না?
কথা বলতে ভীষণই কষ্ট হচ্ছে চারণের। রক্তে মুখের ভিতরটা ভরে গেছে। থকথকে হয়ে গেছে মেটের মতন। বমি পাচ্ছে ওর। মাথাতে, বুকে পেটেও অসহ্য লেগেছে। আগে ব্যথাটা বোঝেনি। এখন আস্তে আস্তে ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছেয়ে যাচ্ছে।
চন্দ্রবদনী বলল, আপনাকে একটি এ টি এস দেওয়ানো দরকার ছিল। ডাক্তারখানা কি আর খোলানো যেত না! কিন্তু যেখানেই যেতে চাই, ছেলেরা সেখানে জমায়েত হয়ে আছে, তাদের পেরিয়েই যেতে হবে। পউরি শহরে ঢোকার প্রবেশদ্বার বলতে যা বোঝায়, ওই জায়গাটি তাই।
তারপরই স্বগতোক্তি করল, যাকগে। ডেটল আর তুলো পেলে উডসগুলো ড্রেস তো করে দিতে পারতাম!
আপনার শাশুড়ি-মায়ের কী হল? এখানে আসেননি? চৌকিদার কী বলল?
এসেছিলেন। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কেউ গতকাল ভোরেই নাকি শ্রীনগর থেকে ফোন করে ওঁকে ব্রেকফাস্টের পরে পরেই বেরিয়ে পড়ে কোটদ্বার হয়ে দিল্লী পৌঁছতে বলেছিলেন।
তারপর বলল, সেই অ্যাডভান্স ওয়ার্নিং পেয়ে নিশ্চয়ই প্রাইভেট ট্যাক্সিতে বা বাসে করে ফিরে গেছেন। ওঁর তো এখান থেকে নামবার কথা ছিল আগামী পরশু। ভারী আশ্চর্য তো! স্বজনেরা আমার চলে-যাওয়া এবং স্বল্পকালীন স্বামীর মায়ের প্রতি যতখানি মনোযোগী আমার প্রতি ততখানি নয়। আমাকেই জানাল না কেউ কিছু। অথচ সকলেই ভাল করেই জানত যে আমি আপনার সঙ্গে আজ ভোরে পউরির দিকে বেরোব।
কে খবর দিলেন?
জানি না। তাই তো ভাবছি।
আমার একমাত্র ননদিনীটির উপরে চুকারের চোখ আছে। ওরা একই সঙ্গে পড়ত দিল্লীর জে এন ঊ্যতে যদিও আলাদা বিষয়ে। মেয়েটি ভাল। তা ভাল হোক গে। তার ভাবী শাশুড়ির জন্যে চুকার ভেবে মরে গেল আর দিদির কথা একবারও ভাবল না! এই তো দুনিয়া!
আপনি এত সব খবর জানলেন কি করে?
হাতের মধ্যে মুঠো করে রাখা একটি খাম দেখাল চন্দ্রবদনী। বলল, আমার থটফুল, হাইলি কনসিডারেট শাশুড়ি এই চিঠিটি আমার জন্যে রেখে গেছিলেন। চৌকিদারকে মোটা বকশিশও করে গেছিলেন যাতে আমার হাতে ওই চিঠিটি সে দেয়। সে তখন বাংলোতে না থাকলে তার বৌ যেন দেয়, সে কথাও বলে গেছিলেন। চিঠিময় অ্যাপলজি। লিখেছেন, কোটদ্বারে গিয়ে ডিসাইড করবেন সোজা দিল্লি যাবেন না হরিদ্বারে কাটিয়ে যাবেন দু-তিনটি দিন। যদি হরিদ্বারে যান তবে সেখানের হোটেলের নাম-ঠিকানাও দিয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলার মতন ওয়েল-অগানাইজড দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ খুব কমই হয়।
চারণের মন বলল যে, চন্দ্রবদনী ওঁর সঙ্গে আলাপ করাবার জন্যেই যেন সঙ্গে করে এনেছিল চারণকে।
মন বলল। যা বলল, তা ভুলও হতে পারে। মন যাই বলে তাই তো আর ঠিক হয় না। সবসময়।
ট্যুরিস্ট বাংলোর গেট-এর সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে যে, আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দেখল চারণ, তা দেখে যে আঃ উচ্চারণ করবে তেমন অবস্থাও ছিল না। উকারান্ত ছাড়া অন্য কোনও শব্দই ঠোঁটের বীভৎস অবস্থার কারণে ওর পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। নিজের জন্যে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল।
একটা ব্যাপার লক্ষ করে খুবই অবাক হচ্ছিল চারণ। ছেলেগুলো যে ওকে অমন বিনা দোষে মারল, তাতে তাদের কারও ওপরেই ওর আদৌ কোনওরকম ব্যক্তিগত আক্রোশ জন্মায়নি। বরং প্রতিদিন তারই মতন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শয়ে শয়ে যে সমস্ত মানুষ বিনা দোষে মার খায় ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত জনতার হাতে, তাদের প্রতি তার নিজের অসহায়তার মধ্যে এক গভীর সমব্যথা ও সমবেদনা বোধ করল ও। উত্তেজিত জনতার মধ্যে প্রত্যেক মানুষই একই সঙ্গে একইরকম অবুঝ, যুক্তিহীন এবং অনেকই সময়ে অন্যায় আচরণও করেন পৃথিবীর সর্বত্রই। সেই সব মুহূর্তে, মনে হয়, জনতার মধ্যের প্রত্যেকটি ব্যক্তির মানসিকতা একীভূত হয়ে যায়। তাঁদের নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব কোনও দানবের হাতে চলে যায় নিজেদের অজান্তে। যুক্তিহীন, বিচারহীন, বিবেকহীন যার সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ড। কিন্তু আসলে বোধহয় তা হয় না। ভাগ্যিস হয় না। জনতার মধ্যে থেকেও, ক্ষিপ্ত, উন্মত্ত, অন্ধ মানসিক অবস্থাতে সামিল হয়েও বিভিন্ন মানুষের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হয়। প্রহার করলেও সেই প্রহারের তীব্রতার রকমও অবশ্যই বিভিন্নরকম হয়। জনতারই কেউ কেউ জনতাকে প্রতিরোধ করার, বোঝানোর চেষ্টা করেন।
নিজের অত্যন্ত ক্লিষ্ট শারীরিক অবস্থাতেও ও ওর কষ্টকে যে এমন নৈর্ব্যক্তিক ভাবে নিতে পেরেছে তা জেনে একরকমের ভাললাগাতেও সিক্ত হল ও। মানুষ হিসেবে ও যে আর দশজনের মতন সাধারণ নয়, তা জেনে ন্যায্য কারণে শ্লাঘাও বোধ করল একটু।
রওনাক সিং গাড়িটা ঘুরিয়ে এবারে উতরাইয়ে নামতে লাগল। চারণের ভয় করছিল যে নীচের ম্যালে জমায়েত হওয়া ছেলেরা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ না শুনে ফেলে। তারা তো আদেশ করেছিল ওদের ট্যুরিস্ট লজেই থাকতে। সেখান থেকে না নামতে। তবে, যে পথ দিয়ে ওদের যেতে বলল একটু আগেই ছাত্রদের অন্য একটি দল, বাঙালি ছেলেটিও, সেই পথটি গেছে ম্যাল-এর উলটোদিক দিয়ে। শহরের বাইরে দিয়ে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলে ওদের রোষে পড়তে হবে না হয়তো। দেরি করলে, কী হবে তা বলা যায় না।
সেই ছেলেটি কিন্তু ঠিকই দাঁড়িয়েছিল টুরিস্ট লজের সামনে থেকে পথটি যেখানে নেমে প্রধান পথের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে। গাড়ি সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই সে তাড়াতাড়ি তুলোর একটি প্যাকেট আর ছোট্ট এক শিশি ডেটল হাত বাড়িয়ে দিল, চন্দ্রবদনী কাঁচটা নামাতেই। বেশ ঠাণ্ডা ছিল। নভেম্বর মাস, তায় এত উঁচু জায়গা!
চারণ, পকেটে হাত দিল টাকা বের করার জন্যে। তার আগেই চন্দ্রবদনী একটি একশ টাকার নোট বের করে হাত বাড়িয়ে ছেলেটিকে দিতে গেল। সে প্রথমে বিরক্ত হল। তারপর হাসল। বলল, এসব তো বাড়িতেই ছিল। দাম দিতে হবে না, মাকে আমি কিনে দেব আবার। তাছাড়া, চারণের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ আপনাকে অন্যায় রাগে মেরেছে। আমি না হয় তাদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তই করলাম একটু।
তারপরই বলল, আপনারা আর দেরি করবেন না। পথে আবার কোথায় কি হয়? বেরিয়ে যান। তাড়াতাড়ি। চড়াই পড়বে এরপরেই কিছুটা। বাবুখাল ছ-হাজার ফিট মতন উঁচু।
চন্দ্রবদনী কাঁচ তুলতে তুলতে সামান্য উদ্বিগ্ন গলাতে বলল, কোটদ্বার কখন পৌঁছব?
তা তিন-চারটে হবে। গুড লাক।
চারণ ভাবছিল, চন্দ্রবদনীর মতন কোনও বিধুমুখী সঙ্গে থাকলে শ্মশানকেও স্বগোদ্যান বলে মনে হয়, পৃথিবীর সব মানুষই বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।
এতকিছু যে ঘটে গেল, রওনাক সিং-এর কিন্তু কোনওই বিকার নেই। নিজের দোষেই যে সে চারণকে মার খাওয়াল এবং নিজেও কিঞ্চিৎ মার খেল, তার সোয়েটারের সেলাই চড়চড় শব্দ করে ছিঁড়ে গেল, তাতে তার কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হল না। ভাবখানা Its all in the game! মাঝে মাঝেই ডান হাত দিয়ে তার লম্বকর্ণর মতন ডানকানটিকে টানাটানি করা ছাড়া তার মধ্যে এইসব দুর্ঘটনা ও বাধা সম্বন্ধে অন্য কোনওরকম ক্রিয়া-বিক্রিয়া আদৌ না দেখতে পেয়ে অবাক হল চন্দ্রবদনী এবং চারণও। ভাবখানা যেন এই জাঠ তনয়কে স্বয়ং শ্রীশ্রী গীতাই প্রসব করেছেন। কর্মণ্যেবোধিকারান্তে মা ফলেষু কদাচন-র এমন জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত এর আগে দেখেনি। রওনাক সিং-এর কাছে বহু সাধু-সন্ন্যাসীরাও তুচ্ছ।
গাড়িতে দুবোতল মিনারাল ওয়াটার ছিল বিসলেরির। এখন শহুরে এবং ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রাও আমেরিকানদের মতনই শরীর-স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। এবং আমেরিকান এবং অন্য বিদেশীরাও যেহেতু কেদার বদ্রী এবং অন্যান্য জায়গাতে আসেন, এই সব পথের পান-সিগারেটের দোকানেই মিনারাল-ওয়াটার পাওয়া যায় আজকাল।
বড়ি বুয়াই সব বন্দোবস্ত করে বেতের একটা চারকোণা বাস্কেটে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে ফেস-টাওয়েল, ন্যাপকিন সব দিয়েছিলেন পরিপাটি করে। সঙ্গে খাবারও নিশ্চয়ই কিছু আছে। পুরনো দিনের মানুষেরা ওরকমই ছিলেন। যাত্রামাত্রই যে অগ্যস্তযাত্রা এমন মনে করাই তাঁদের অভ্যেস ছিল। পথে কোথায় কোন বিপদ ঘটে, খাওয়ার পাওয়া যায় কী না যায়, এই ভেবে সবসময়েই বারণ না শুনে কিছুনা কিছু সঙ্গে তাঁরা দিয়ে দিতেনই।
গাড়িটা, পউরির এলাকা ছাড়িয়ে এল মিনিট দশেকের মধ্যে। এরকম পাহাড়ি পথে যতখানি জোরে চালানো সম্ভব গাড়িকে, তাই চালাচ্ছিল রওনাক সিং। অথচ এদিকে আগে সে এসেছে বলে মনে হল না। সম্ভবত সে সমতলে দিল্লি-হৃষিকেশই করে থাকে। হয়তো কেদারবীর পথেও এসেছে দু-একবার কিন্তু এদিকে যে সে আসেনি কখনও তা প্রতি মোড়ে পৌঁছেই বোঝা যাচ্ছিল। না-আসাতে, তার কোনওই ভয় বা বৈকল্য নেই। স্টিয়ারিং-এ দুটি হাত রেখে, বেঁকে বসে, সে মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। মুখে একটিও কথা নেই। তার প্যাসেঞ্জারেরা তার সম্পূর্ণই অযোগ্য তাই সম্ভবত কথা বলার কোনও তাগিদই সে অনুভব করছিল না।
অর্জুনের মতন গাড়ি চালাচ্ছে এখন রওনাক সিং।
গাড়িটা একবার দাঁড় করাতে বলল, রওনাক সিংকে, চন্দ্রবদনী।
গতি কমিয়ে এনে বাঁদিকে দাঁড় করাল গাড়িটা সে, একটা মস্ত বড় প্রাচীন ওক গাছের কাছে। বাঁদিকে গভীর উপত্যকা। গহন জঙ্গল সেখানে। হাওয়া নেই, কিন্তু এই রোদ-ঝলমল সকালে, কুঁতে-নীল আকাশ আর এই কলুষহীন ক্লোরোফিল উজ্জ্বল ঝকঝকে গাছ-গাছালি ঘাস-পাতা থেকে আশ্চর্য সুন্দর এক মিশ্র গন্ধ উঠছে।
চন্দ্রবদনী বলল, চারণকে, আপনি নেমে, ঐ কালভার্টটার উপরে বসুন।
উ’কারান্ত একটি শব্দ করল চারণ, তারপর বাধ্য ছেলের মতন বসল নেমে গিয়ে, পাথরের কালভার্ট-এর উপরে।
জলের বোতল বের করে, ডেটলের শিশি খুলে, একটি ফেস-টাওয়াল বের করে নিজের কাঁধ ও বুকে অ্যাপ্রনের মতন ছড়িয়ে নিয়ে অন্যটা চারণের বুকে জড়িয়ে দিল, পাছে জল না পড়ে তার বুকে। তারপর আস্তে আস্তে ওর ক্ষতস্থানগুলি ধুয়ে, ডেটল-মাখানো তুলো জলে সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে, বুলিয়ে দিতে লাগল। জ্বালাতে মুখ বিকৃত করে ফেলল চারণ।
তারপর বলল, মুখটা কুলকুচি করে নিন।
কুলকুচি করবে কি! মুখের মধ্যে রক্ত জমে তো মেটের মতো থকথকে হয়ে গেছে। নিজেরই বমি-বমি পাচ্ছিল। না জানি ওর ঐ চেহারা দেখে চন্দ্রবদনীর কি মনে হচ্ছে! নিশ্চয়ই গা গোলাচ্ছে।
ভাবছিল ও।
তবে, দু-তিনবার কুলকুচি করাতে মুখের ভেতরের আড়ষ্টতা যেন কমল একটু। তবে সব ক্ষতস্থানেই ডেটল পড়াতে জ্বালাও করছিল প্রচণ্ড।
জল খাবেন? চন্দ্রবদনী শুধোল।
মাথা নাড়ল চারণ। নিজের কেটে-যাওয়া ঠোঁটটাকে সেলাই করে, বন্ধ করে দেওয়া এখুনি দবকার। সেখানে থেকে, পরিচর্যা করার পরে আবারও একটু একটু রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
জল খেয়ে মিনারাল ওয়াটারের বোতলটা ফেরৎ দিল চন্দ্রবদনীকে। চন্দ্রবদনী নিজের হাত ব্যাগ থেকে একটি ডিসিপিরিন ট্যাবলেট বের করে বলল, এটা খেয়ে নিন তো। ব্যথার হয়তো সামান্য উপশম হবে।
ভাবল, ও। কোটদ্বার কি সমতলে? ভাবলই। কিন্তু জিগ্যেস করতে পারল না। কবে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারবে, কে জানে।
গাড়ি চলতে লাগল, ঘুরে ঘুরে, যেন উড়ে উড়ে, স্বর্গলোকের দিকে। এখানেও কোনও যানবাহন নেই, আপ অথবা ডাউন এও। যাকে বলে সর্বাত্মক, স্বতঃস্ফুর্ত বন্ধ, তাই হয়েছে। মনে হচ্ছে, এরা পাহাড়ে ওঠার সব মুখগুলিতেই পাহারা রেখেছে তাই কোনও গাড়ি উঠে আসতে পারছে না।
নামছে তো নাই। তাহলে কোটদ্বার এও কি বন্ধ থাকবে?
কথা যা বলার তা চন্দ্রবদনীই বলছিল। চারণ শুনছিল আর ভাবছিল।
চন্দ্রবদনী বলছিল, অনুতাপের গলাতে, আমার ছোট ভাই তার বন্ধুবান্ধব সমবয়সীরা যে আন্দোলনে নেমেছে তার ফল কি হবে জানি না। তবে দুটি ছেলে মারা গেছে কাল পুলিশের গুলিতে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও মারা যাবে। যারা মারা গেল, তারা কারা, কে জানে। কোন মায়ের কোল শুন্য হয়ে গেল তা কালকের আগে জানা যাবে না। তারপর হয়তো পুলিশও মরবে। তারও পর হয়তো নাগাল্যান্ড, মণিপুর, গোখাল্যান্ড, কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ড-এর মতন চিরস্থায়ী গণ্ডগোলের জায়গা হয়ে যাবে যুগযুগান্ত ধরে শান্তির নীড় হয়ে থাকা এই সমস্ত অঞ্চল। দেবভূমি। দেবতাদের সঙ্গে অসুরেরা কোনওদিনও সহাবস্থান করতে পারেনি। আর এখন মানুষমাত্রই অসুরই হয়ে উঠেছে।
চারণ তো চুপ করেই ছিল কিন্তু তার মস্তিষ্ক তো চুপ করে ছিল না। নানা ভাবনা ভাবছিল তা!
উত্তরাখণ্ডকে আলাদা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া কখনই উচিত নয়। ভাবছিল চারণ। দিলে, মণিপুর, গারো হিলস, খাসী হিলস, গোখাল্যান্ড, এবং অনেক রাজ্যের অনেক অংশ নিয়ে পুরো ঝাড়খণ্ড এলাকাকে স্বীকৃতি না দিলে চলবে না। কোনও স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল ও নেতা হয়তো উত্তরাখণ্ডকে স্বীকৃতি দিয়েই দেবেন তাঁর নিজের দল ও তার গদি সুরক্ষিত করার জন্যে। এখন স্বার্থই তো বুদ্ধির সমতুল। নিজ-স্বার্থহীন বুদ্ধিকে আর বুদ্ধি বলে কোথাওই মান্য করা হচ্ছে না। বুদ্ধিরও তো কইরকম থাকে। এখন বুদ্ধি মানেই দুবুদ্ধি, তা জনস্বার্থ, দেশের স্বার্থ, সবকিছুরই বিরোধী হলেও কোনও ক্ষতি নেই। নেতার স্বার্থ এবং পাটির স্বার্থ নিশ্চিত হলেই, সেই স্বার্থে মগ্ন হলেই নেতাদের চলে। Immediate Gainটাই সব।
চন্দ্রবদনী বলল, আপনাকে একটু চা খাওয়াতে পারলে হয়তো আপনার ভাল লাগত। ব্যথা কি বেড়েছে?
চারণ পেটে আর বুকে হাত দিয়ে দেখাল, তার ব্যথার স্থান। মানে, ব্যথা যেখানে বেশি। চোখের উপরেও অনেকখানি কেটে গেছে।
চারণ ভাবছিল, যেসব ব্যথা বাইরে থেকে দেখা যায় না, যে আঘাতে বাহ্যিক ক্ষতর সৃষ্টি হয় না, বাইরে থেকে অন্যের চোখে যা বীভৎস বলে মনে হয় না, সেই ব্যথা যে কারও আদৌ আছে বা থাকতে পারে, এই সত্যই বুঝতে পারে না অন্যে। একের পেটের খিদে, পিঠের আঘাত, অতি সহজেই বোঝা যায় কিন্তু হৃদয়ের খিদে, হৃদয়ের আঘাত হয়তো সেজন্যেই অন্যের পক্ষে বোঝা এত কঠিন। যা কিছুই এই সংসারে বাহ্য, তাই সহজে গ্রাহ্য। অব্যক্ত, অন্তর্লীন কথা কেউই বোঝে না। অন্তর্মুখী মানুষ-মানুষীর তাই বোধহয় এত দুঃখ এই পৃথিবীতে।
গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই! তবে পথের দুপাশের দৃশ্যে চারণ এরকম শারীরিক অবস্থাতেও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পথ কেবলই পাহাড় চড়ছে, পাহাড় নামছে। কার্তিকের গায়ের গন্ধমাখা নিবিড় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে যে সব খরস্রোতা নদী, গভীর জঙ্গলাকীর্ণ, গাঢ় সবুজরঙা গিরিখাত দিয়ে বইছে সব। নদীকেই সম্ভবত এই অঞ্চলে খাল বলে।
মনে হল চারণের।
অমনই একটি খাল পেরুনোর পরেই দেখা গেল পথের উপরে আড়াআড়ি করে গোছ গোছ তার ফেলা আছে পথপাশের জয়েন্ট পোস্ট থেকে। গাড়িকে যেতে হলে, সেই তারের জটলার উপর দিয়েই যেতে হবে এবং তা গেলেই গাড়ি এবং আরোহীরাও তড়িদাহত হবে। সেই উদ্দেশ্যেই বোধহয় ফেলে রাখা হয়েছে তারগুলি।
গাড়িটাকে সে জায়গা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে দিল রওনাক সিং। দিয়েই বলল, ম্যায় যা কর, উঠাকে ফেকতা।
চন্দ্রবদনী হায়! হায়! করে উঠল।
চারণও চঞ্চল হয়ে উঠল মুখে কিছু বলতে না পেরে। সর্বনাশ হবে এই শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে শুধু দুটি চকারান্ত অস্ফুট শব্দ বেরোল তার মুখের রক্তাক্ত অভ্যন্তর থেকে।
এমন সময়ে দেখা ও শোনা গেল তিন-চারটি যুবক বড় বড় পা ফেলে উতরাই-এর পথ বেয়ে পেছন দিক থেকে নেমে আসছে। পাহাড়ি মানুষেরা যেমন নাচতে নাচতে উতরাই নামে তেমনি করে তো বটেই, আরও জোরে ওরা নেমে আসছে।
ওরা জোরে জোরে কথা বলতে বলতে আসছিল। রাস্তা, পায়ে হেঁটে পেরোতে হলেও ঐ ভূপতিত তারমণ্ডল সম্বন্ধে ওদেরও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ, তারগুলি যে বা যারাই বিচ্ছিন্ন করে রাস্তা জুড়ে ফেলে রেখে থাকুক, তারা এমন করেই ফেলে-ছড়িয়েছে, যে তা পেরিয়ে কোনও ইঁদুরের পক্ষেও যাওয়া সম্ভব নয়, মানুষ তো দূরস্থান।
এ ছেলেরা কারা?
আবারও মারবে না তো চারণকে?
ভাবল, ক্লিষ্ট-স্নায়ু চারণ।
চারণকে গাড়িতেই বসে থাকতে বলে, চন্দ্রবদনী নেমে ওদের সঙ্গে গাড়োয়ালিতে কথাবার্তা বলতে লাগল, ওরা কাছে এলে।
ছেলেদের মধ্যে একজন বলল, এগুলি বিজলীর তার নয় বোধহয়। নিশ্চয়ই টেলিফোন বা টেলিগ্রাফের তার?
রওনাক সিং, যে, সকাল থেকে কিল-চড় ছাড়া আর কিছুই খায়নি, সে কিন্তু কেবলি তড়পে তড়পে এগিয়ে যাচ্ছিল তারগুলি তুলে ধরে পথপাশে ছুঁড়ে ফেলবে বলে। চন্দ্রবদনী আর চারণই তাকে এতক্ষণ আটকে রেখেছিল। এখন আটকাল ছেলেগুলিও। অথচ রওনাক সিং-এর ঝুঁকি নেবার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। সে ভাড়ার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে হৃষীকেশ থেকে। গাড়ি না চললেও তার মালিক ভাড়া পাবে দিন হিসেবেই। সেও দানাপানির টাকা পাবে। মাইনে তো পাবেই। যারা উত্তরাখণ্ড-এর জন্য আন্দোলন করছেন সেই ছেলেরা এবং উত্তরাখণ্ড যার পিতৃভূমি, সেই চন্দ্রবদনীও এমন পথে-ফেলে রাখা তার ছুঁয়ে Noticed by a few and utterly unpublicised মৃত্যুবরণ করতে আদৌ রাজি নয় বলেই মনে হল। সাংবাদিকদেল ক্যামেরা, দূরদর্শনের ক্যামেরা সামনে থাকলে, অনেক জন্মভীতুও সাহসী হয়ে উঠে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। প্রচারের মহিমা আর তার লোভ বড় লোভ, যদিও বড় নীচ ও ইতর লোভ। অনেক বড় তাবড় মানুষও এই রোগে যে পুরোপুরিই আক্রান্ত তা তো সকাল সন্ধে কলকাতাতে চারণ দেখেই।
প্রচারের কোনও লোভ চারণের ছিল না কখনওই। তাছাড়া ওই পুঞ্জীভূত তার সরানোর কোনও দায়ও ছিল না তার। মনে মনে বেশ বিরক্ত ছিল সে। ভাবল, যা করবার তা চন্দ্রবদনীই করুক। তার ভায়েদেরই তো আন্দোলন!
তারপরই এ কথা মনে হয়ে নিজেই কষ্ট পেল যে মানুষ হিসেবে সে সম্ভবত খুব উচ্চস্তরের নয়। চন্দ্রবদনী তো তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারও খেয়েছিল পউরিতে।
তারের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় কুড়ি মিনিট। আলোচনা, পরামর্শ চলছেই। মাঝে মাঝে একমাত্র রওনাক সিংই সেদিকে এগিয়ে যেতে চাইছে আর চন্দ্রবদনী চেঁচিয়ে বলছে নেহি, নেহি, মত যানা। প্রায় মত যা, মত যা, মত যা যোগীরই মতন শোনাচ্ছে সেই মত যানা। আর ছেলেরা
রওনাক সিং-এর বিস্কিট কালার ফুলহাতা সোয়েটারটা ধরে টেনে তাকে বার বার আটকাচ্ছে। পউরিতে সোয়েটার ধরে টানাটানি করেছিল এদেরই দোস্ত-বিরাদরেরা রওনাককে প্রাণে মারবার জন্যে, আর এরা টানাটানি করছে তাঁকে প্রাণে বাঁচাবার জন্যে।
কেয়া চক্কর। ভাবল, চারণ।
এই কেয়া চক্কর শব্দটা পাটন মাঝে মাঝেই হৃষীকেশ ও দেবপ্রয়াগে ব্যবহার করত। আর নিচ গলাতে হেসে বলত, এই চক্কর থেকেই যাবতীয় চকাস্তর পায়া হয়েছে। বুঝলে গো চারণদা।
হঠাৎই পাটনের কথা মনে পড়ে গিয়ে, মনটা খারাপ হয়ে গেল চারণের। খুবই মিস করছে ওকে। পাটনের কাছে চারণের কৃতজ্ঞতার কোনও শেষ নেই। অনেকই কারণে। দারুণ একটা ছেলে বটে। ওরিজিনাল। ওই ওর তুলনা!
ইতিমধ্যে হঠাৎই গাড়ির সামনে একটা ধ্বস্তাধস্তির আওয়াজ শোনা গেল এবং রওনাক সিং হা হা করে হাসতে হাসতে দৌড়ে গেল রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকা তারগুলোর দিকে। তারপর প্রায় সেগুলির উপরেই দাঁড়িয়ে পড়েই নিচু হল। আরও নিচু, আরও, এবার দুহাত দিয়ে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরবে ও তারগুলোকে। ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠল। চন্দ্রবদনী শঙ্কিত, ভয়ার্ত একটি শব্দ নিক্ষেপ করল। বি শাপ-এ। এবং পরক্ষণেই দুহাতে, তার বুকের কাছে তারের কুণ্ডলী পাকিয়ে নিয়ে পথের তুপীকৃত তারেরই উপরে পড়ে গেল সে।
চারণের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপরই পাশের নদী আর সামনে-পেছনের পাহাড় রওনাক সিং-এর হা-হা হাসির প্রতিধ্বনি তুলল। হাসির হররা ফুটে উঠল, ছুটে গেল পাহাড়ে, জঙ্গলে এবং নদীতে।
না। মরে নি রওনাক। যদি মরতও ও তবুও যারা সেই মৃত্যুর সাক্ষী তাদের কাছে অমর হয়েই রইত।
তারগুলি বিজলির তার নয়।
ঐ ছেলেগুলি ওদের গাড়িতে লিফট চাইল, সামনের জনপদ অবধি। সামনেই বসল তারা তিনজনে চাপাচাপি করে, রওনাক-এর সঙ্গে। রহস্যভেদ হওয়াতে, অপেক্ষা শেষ হওয়াতে এবং পথের কাঁটা অপসারিত হওয়াতে সকলেরই মেজাজ বহুত খুশ ছিল। মূল সমস্যা, আন্দোলনের কারণ, এসব কিছুরই চেয়ে পথের উপরে ফেলে রাখা ভূপীকৃত তারই বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল এতক্ষণ। এমনই হয়তো হয় সংসারে। কাছের তুচ্ছ জিনিস দূরের জিনিসকে আড়ালে ফেলে দেয়, তা সেই দূরের জিনিস যত বড়ই হোক না কেন!
চন্দ্রবদনীর প্রশ্নের উত্তরে ছেলেরা বলল, সামনেই ঘুমখাল পাবেন। সেখানেই আমরা নেমে যাব। সেখানেও যদি বন্ধ না থাকে তবে ডাক্তারখানা, হোটেল সব পাবেন।
কিন্তু সব জায়গাতেই বনধ আর ঘুমখাল কি ভোলা থাকবে?
চন্দ্রবদনী জিগ্যেস করল ওদের।
থাকতে পারে। কারণ, দুপাশের মুখই তো বন্ধ। পাহাড়ে কোনও গাড়ি উঠতেও পারছে না, পারছে না নামতেও। মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে তো আন্দোলনকারীদের মাথাব্যথা নেই। তাদের বন্ধু তো সফল হয়েছেই। দেখাই যাক। একটু পরেই তো পৌঁছে যাব।
একটি ছেলে রওনাক সিংকে বলল, আররে! আপ তো অজীব আদমী হেঁ ভাই। উও খতরনাক তারোঁকি উপ্পর কুদকে চড় গ্যায়ে।
হিন্দি ছবির আর যাই কুপ্রভাব পড়ক না কেন সমাজের উপরে, ভারতের একীকরণের কাজে এই মাধ্যমটি একটি বড় কাজ করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সকলেই এখন হিন্দি ছবির ডায়ালগ বলার মতন করে ডায়ালগ বলে। এটা সার্বিক ভাল অবশ্যই নয়। তবে আংশিক ভাল তো বটেই।
অনেকক্ষণ পরে রওনাক সিং তার ডান কানের কল্যাণে, আবারও লেগে পড়ে, দার্শনিকের মতন হেসে বলল, আররে সাহাব, সবহি খাতরেকে পর ওইসেহি কুদকেই চড়না পড়তা হ্যায়। আইস্তা আইস্তা চলনেসে খতরা জবরদস্ত বন যাতা হ্যায়। কোঈভি খাতরে জবরদস্ত বননেকি পাহিলেহি উসকি বুতানা চাহিয়ে।
চারণ ভাবছিল, এই জন্যেই হয়তো জাঠ-এরা এত ভাল সৈন্য হয়। সেনাবাহিনীর জাঠ রেজিমেন্ট একটি প্রাইজ রেজিমেন্ট। ক্লাবে প্রায়ই বলেন মেজর জেনারেল ঝান্টুমারি।
ঘুমখালে এসেই জানা গেল যে, পউরির ছেলেরা যা বলছিল তা ঠিক নয়। কোটদ্বার-এও বনধ আছে। ভোরের প্রথম প্রহরে যে কয়েকটি প্রাইভেট গাড়ি ও বাস উঠে আসতে পেরেছিল কোটদ্বার থেকে ঘুমখাল অবধি তাদের মুখেই শুনেছে স্থানীয় দোকানিরা।
দুপুরের বাজার এখানে চকমক করছে। সব দোকানই খোলা। মোড়ে পৌঁছে দেখে বাঁয়ে একটি পথ চলে গেছে। সরু। নিশ্চয়ই অভ্যন্তরের কোনও অনামি জায়গাতে পৌঁছেছে গিয়ে সেই পথ। চারণের ভারী ইচ্ছে করে এইরকম কোনও জায়গাতে, কোনও নাম-না-জানা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের বাড়িতে থাকতে। তবেই না তাদের জানা যায়, তাদের বোঝা যায়। এমন মনোভাব সমতলের সব মানুষেরই যদি থাকত, তবে হয়তো আজ উত্তরাখণ্ড নিয়ে আন্দোলন করে ছাত্রদের বুকের রক্ত ঝরাতে হত না।
এই আমাদের দোষ। ভাবছিল চারণ। যতটুকু, যে সময়ে করলে হয় তা, কখনওই করি না আমরা। তার ফলে যে সমস্যাটা Molehill ছিল তাই একদিন সত্যিই Mountain হয়ে ওঠে। প্রথম থেকে কুমায়ু ও গাড়োয়ালের মানুষদের অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে দরদের সঙ্গে অবহিত যদি হত দিল্লি, তবে এই আন্দোলনের মিটিমিটি আগুন আজ এমন হাওয়া পেয়ে দাবানলের মতন পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে যেত না।
এসব ভেবে চারণের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলির নির্দেশে ওষুধের একটি বড় দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল রওনাক সিং।
বেশ ছেলেগুলি। একজন শ্রীনগরে পড়ে, একজন পউরিতে, আরেকজন ডালহাউসিতে। তারা সক্রিয় রাজনীতি করে বলে মনে হল না কিন্তু তাদের এই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে, কথাবাতাতে মনে হল। এতবছর স্থানীয় মানুষদের উন্নতিকল্পে উত্তরপ্রদেশ সরকার না কি কিছুমাত্রই করেননি, এমনই ওদের মত।
চারণ ভাবছিল যে, এরা হয়তো জানে না তথাকথিত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক অবনতির বীজও রোপিত হয়ে যায়ই। চৌপাই পুরনো হলেই যেমন তাতে ছারপোকা হয়ই, প্রশাসন পুরনো হলেই, তাতে দুর্নীতি এবং আরও নানা অবক্ষয় বাসা বাঁধে। দিল্লী যেমন উন্নতি করেছে তেমন উন্নতি নিশ্চয়ই এদেরও কাম্য নয়। আর্থিক সচ্ছলতা অনেকই ক্লেদ ও গ্লানি inject করে দেয় মানুষের ও সমাজের মধ্যে। তখন রোদে পিঠ দিয়ে পা-ছড়িয়ে বসে ভাবতে হয়, গরীব থাকাই ভাল ছিল। না, এমন মূল্য দিয়ে বড়লোক হওয়া।
.
শেষপর্যন্ত ওরা কোটদ্বোয়ার না যাওয়াই মনস্থ করল, ঘুমখালে দোকানদার এবং বাস-ট্রাক-ড্রাইভারদের কাছে নানারকম পরস্পরবিরোধী কথা শুনে।
কেউ কেউ বলল, কোটদ্বোয়ার-এ বনধ থাকার কথা নয়। কেউ কেউ বলল, অবশ্যই আছে। একজন বলল, আমি সকাল আটটাতে যখন কোটদ্বোয়ার ছেড়ে বেরিয়ে আসছি তখনই বহতই মুশকিলের সঙ্গে এসেছি। প্রায় আটকেই পড়েছিলাম। কোটদ্বোয়ার তো পাহাড়ি এলাকারই ঘোয়ার। সেখানে গাড়ি না আটকালে কোথায় আটকাবে?
হয়তো বন্ধ নেই সেখানে অথবা হয়তো বন্ধ সকালে ছিল। এখন উঠে গেছে কিন্তু শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে অবসন্ন অবস্থাতে ওইরকম ঝুঁকি নেওয়ার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিল চন্দ্রবদনী। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কতটাই বা এসেছে। অতি সামান্যই পথ।
পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু না চললেই চারণ একেবারে ল্যাজেগোবরে হয়ে যায়। পঞ্চাশ মাইল পথকে পাঁচশ মাইল বলে মনে হয়। তাছাড়া, আহত সে, রীতিমতো অসুস্থই। আঘাতটা কী রকম তা তো শরীরের নানা জায়গার এক্সরে না করলে বোঝা যাবে না। আঘাতের যেটুকু চিহ্ন বাইরে দৃশ্যমান সেটুকুর যন্ত্রণাও আদৌ কম নয়। রাতে যে অবশ্যই বাড়বে আরও, সে বিষয়েও কোনওই সন্দেহ নেই।
ঘুমখাল-এর তিনমাইল পরেই একটি মোড়। সেই মোড়ে পৌঁছে ডানদিকে ঘুরতে বলল চন্দ্রবদনী রওনাক সিংকে। সেই সুন্দর চীর, দেওদার, পাইন, ওক, বার্চ-এর ছায়ায় ছায়ায় চলে-যাওয়া সুগন্ধি পথ বেয়ে এগারো-বারো কিমি এসে ল্যান্সডাউনে পৌঁছনো গেল।
ল্যান্সডাউনে যখন পৌঁছল রওনাক সিং-এর গাড়ি তখন বেলা তিনটে বাজে। শীতের দিন। সূর্য তখনই কমজোর। মরা-মরা। তার তেজ কমে এসেছে। ঘণ্টাখানেক পরেই ঠাণ্ডাটা পাখা ঝাঁপটে পড়বে ল্যান্সডাউনে, যেমন ফলভরা লিচুগাছের উপরে বাদুড়েরা সন্ধে নামলেই পড়ে।
ভাবল, চারণ।
এই শহর, মনে হল, চন্দ্রবদনীর চেনা শহর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়োয়াল রেজিমেন্টের হেড কোয়াটার এই ল্যান্সডাউনেই। যেখানেই সেনাবাহিনী, সেখানেই নিয়মানুবর্তিতা। সবকিছুই ঝকঝক তকতক করছে। চমৎকার রাস্তা ঘাট। সৈন্যদের পোশাকে, বাড়িতে, ফলকে এবং কামানের গায়ে অফিসারস মেস বা রেজিমেন্টাল হেড কোয়াটাস, যেখানেই যা কিছু তামা বা পেতল আছে, রোদ পড়ে তাই চকচক করছে। তাদের জেল্লা রোদে বিকীরিত হচ্ছে। ইস্ত্রি করা পোশাক পরে, নিখুঁত ভাবে দাড়ি কামিয়ে, চকচকে করে পালিশ করা বুট পরে জওয়ান, ল্যান্স নায়েক, নায়েক, জমাদার, সুবেদাররা সবাই সপ্রতিভতার সংজ্ঞার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কিং-লট-এ এমনভাবে ট্রাকগুলো বা জিপগুলো দাঁড় করানো আছে যে, তা দেখেও ভাল লাগে। মনে হচ্ছে, ট্রাক বা জিপ বা অফিসারদের গাড়ি, তারাও যেন ড্রিল-এ সামিল হয়ে অ্যাটেনশন-এ দাঁড়িয়েছে সার সার।
সিভিলিয়ানদের অনেক কিছুই শেখার আছে সেনাবাহিনীর কাছে। একটু কষ্ট করে এই নিয়মানুবর্তিতা শিখে নিতে পারলে প্রত্যেক মানুষের তো বটেই, পুরো সমাজের ও জাতিরই অনেকই উন্নতি হত। বিশেষ করে আমাদের দেশের।
এই ল্যান্সডাউন, চেনা শহর, চন্দ্রবদনীর।
অস্ফুট, স্বগতোক্তি করল চন্দ্রবদনী, কতদিন পরে এলাম! বাবা, যখন এখানে প্রথমে পোস্টেড হন তখন আমি পাঁচ বছরের এবং চুকার এক বছরের ছিল। এখানের আর্মি স্কুলে পড়তাম আমি। চুকার একদিন হারিয়ে গেছিল এখানে, যখন ওর বয়স তিন। সে অনেক লম্বা গল্প।
চারণের, কথা বলতে গেলেই কষ্ট হচ্ছে এখনও। তাই কথোপকথন আজ হচ্ছে না। চন্দ্রবদনী একাই বলছে যা বলার।
চন্দ্রবদনীই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। প্রধান সড়কের উপরে তো নয় ল্যান্সডাউন! তার উপর ফৌজি এলাকা। তাই নিয়মকানুন অত সহজে শ্লথ হবার নয়। সেনাবাহিনী যেখানে থাকে, সেখানের জীবনযাত্রার উপরে তাদের শুভপ্রভাব পড়ে অজানিতেই। অনবধানে সেখানের মানুষ অনেক নিয়মনিষ্ঠ হয়ে ওঠে সম্ভবত।
হর্ন দিতেই গেট খুলল চৌকিদার দৌড়ে এসে। চন্দ্রবদনী নেমে রিসেপশানে গিয়ে কথাবার্তা বলল গাভোয়ালিতে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুজন বেয়ারা এসে ওদের মালপত্র নামিয়ে নিল। এতক্ষণ একইভাবে বসে থাকাতে চারণ অনুমানও করতে পারেনি আদৌ যে, তার শরীরে এত ব্যথাবেদনা।
পেছনের সিটের দরজা খুলে একজন বেয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল তার নামার অপেক্ষাতে কিন্তু চারণ নিজ চেষ্টাতে নামতে পারল না। পা অসাড়। সারা শরীরে বিষের মতন ব্যথা।
চন্দ্রবদনী ওদিক থেকে তাড়াতাড়ি এসে চারণের হাত ধরল। অন্য হাত ধরল একজন বেয়ারা।
চারণের মনে হল, যেন অন্য কারো পায়ে ভর করে ও হেঁটে চলেছে। পা দুটো যেন কোমরের নীচ থেকে উধাও হয়ে গেছে। নাকের কাছে এখন আর ডেটল অথবা রক্তের গন্ধ নেই। চন্দ্রবদনীর শরীরের খুব কাছে থাকাতে, সকালে-লাগানো পারফুম-এর গন্ধ পেল। যদিও গন্ধ অনেকই হালকা হয়ে গেছে দিনশেষে। তবু নাক ভরে গেল ভাললাগাতে। গন্ধটি কি শুধু চন্দ্রবদনীর পারফুমেরই? না তার শরীরেরও? প্রত্যেক নারীর গায়েই তার এক নিজস্ব গন্ধ থাকে। হয়তো পুরুষের শরীরেও থাকে। নারীরাই জানবেন। সব নাকও সব গন্ধের জন্যে নয়। সব গন্ধ সব নাকে পৌঁছয়ও না। চারণের নাকে কিন্তু পৌঁছয়, বহু দূর থেকেই, নদীর গন্ধ, নারীর গন্ধ, ফুলের গন্ধ, পথের গন্ধ। এই সবই যযাজনগন্ধা, চারণের কাছে।
নিজের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে একবার বাথরুমে গেল। চন্দ্রবদনী বসে রইল চেয়ারে। তারপর বেয়ারাকে বলল, আরও দুটি বালিশ নিয়ে আসতে, যাতে ও আরাম করে শুতে পারে। নিজে হাতে, চারণের ওভারনাইটার খুলে পায়জামা পাঞ্জাবি আর বাড়িতে পরার চটি বের করে দিল। তারপরে বেয়ারাকে বলল, বাথরুমের গিজারটা অন করে দিতে।
চমকে উঠল চারণ। গিজার! কতদিন হয়ে গেছে। শব্দটা যেন অচেনা। মানুষ সত্যিই অভ্যেসের দাস। কলকাতাতে মনে হত, শীতের দিনে যেখানে গিজার নেই সেখানে থাকা অসম্ভব। অথচ দেবপ্রয়াগে থাকার সময়ে বুঝেছিল যে কোনও কিছু না হলেই দিব্যি চলে যায়, যদি মন সজীব থাকে। রুদ্রপ্রয়াগের হোটেলেও অবশ্য গিজার ছিল।
ঘর ছেড়ে যাবার আগে চারণকে বলল চন্দ্রবদনী, গরম জলে চান করে নিলে ফ্রেশ লাগবে। ম্যানেজার সাহেবকে বলে আমি হসপিটালের একজন ডাক্তার অথবা কম্পাউন্ডারকে আনার বন্দোবস্ত করছি। প্রয়োজনে বাবার পরিচয় দেব। তাঁরা এসে, আপনাকে ফ্রেশ করে দেবে। যদি আসা না সম্ভব হয় তবে আপনাকেই নিয়ে যাব। গাড়ি তো আছেই। গাড়িতে নিয়ে এলে হয়তো ওদের আসতে অসুবিধা হবে না।
তাছাড়া, ওষুধপত্র যা খাবার, ইনকুডিং পেইনকিলার, তারও বন্দোবস্ত করছি। ততক্ষণে চা খান। একপট চা পাঠিয়ে দিচ্ছি বিস্কিটের সঙ্গে।
একটু থেমে বলল, রাতে কি খাবেন?
চারণের মুখ যেন কেউ অ্যারালডাউট দিয়ে সেঁটে দিয়েছে।
সে বলল, মানে বলতে গেল যে, কিছুই খাবে না কিন্তু তার মুখ দিয়ে শকুন বাচ্চার চাপা কান্নার মতন একটা সংক্ষিপ্ত আওয়াজ বেরোল শুধু।
কিন্তু তাতেই চন্দ্রবদনী বুঝল, যা বোঝার।
যে বুঝতে চায়, সে মুখ দেখেই বোঝে। কথা না বললেও চলে।
ভাবছিল, চারণ।
চন্দ্রবদনী বলল, কিছুই না খেয়ে থাকলে হবে না। রাতের উপোসে হাতি মরে। আমার মা বলতেন। এখন চা-টা খান, তারপর আমি পাতলা করে মসুর ডালের খিচুড়ি কবতে বলছি। তার আগে এক পেগ ব্রান্ডি খান গরম জল দিয়ে। আমার সঙ্গে আছে। বাবার ট্রেনিং। শিশুকাল থেকে দেখেছি, বাবা যেখানেই আমাদের নিয়ে যেতেন, সঙ্গে এক বোতল ডকটরস ব্রান্ডি থাকতই। সর্বরোগহারী। আমার বুকে কফ বসল তো চামচে করে খাইয়ে দিলেন, মায়ের গোড়ালি মচকে গেল তো একটু মালিশ করে দিলেন, চুকারের আঙুল কেটে গেল তো সেখানে একটু লাগিয়ে দিলেন।
তারপরই বলল, দেখেছেন। আমার সঙ্গেই ছিল কিন্তু একবারও মনে পড়েনি। এসব দেবভূমিতে কেউ ওসব খায়টায় না। পছন্দও করে না। গরম জলের সঙ্গে দিলে এতক্ষণে চাঙ্গা হয়ে যেতেন। ক্ষতস্থানে লাগিয়েও দেওয়া যেত অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে।
ঘর ছেড়ে চলে যেতে যেতে, যেন চারণের অনুচ্চারিত প্রশ্ন বুঝে নিয়েই, হেসে বলল, না। আমার বাবা কিন্তু টীটোটালোর। অ্যালকোহল তো খানই না, কোনওরকম নেশাই নেই।
চন্দ্রবদনী আবারও এগিয়ে এবার চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারণের আরেকটা অনুচ্চারিত অনুবোধ বুঝে নিয়ে বলল, রওনাক সিং-এর থাকার এবং খাওয়া-দাওয়ার সব বন্দোবস্ত হচ্ছে। চিন্তা করবেন না কোনও।
ও ফাইন্যালি ঘর ছেড়ে চলে গেলে বালিশে মাথা নামিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে চারণের মনে হল কালকে ভোর থেকে আজকের এই প্রাক-সন্ধ্যা পর্যন্ত চন্দ্রবদনী যেন তার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হও উঠেছে। প্লান্ট লাইফে যাকে সিমবায়োসিস বলে। যেন, কতদিনের চেনা। যেন, সে ক আপনজন। সে ঘর থেকে চলে যাবার পরই যেন এই বোধটা অত্যন্ত স্পষ্ট হল। অথচ চন্দ্রবদন তার কেউই নয়। কেউই নয়! কেউ হবেও না।
বাইরে তক্ষক ডাকছিল টাকটু-উ-টাকটু-উ করে। অন্ধকার হয়ে আসছিল। দিনশেষের নান আওয়াজ কানে আসছিল। ভোরের উপত্যকা থেকে উঠে-আসা কুয়াশারই মতন যেন ভেদে আসছিল চারদিক থেকে সেই সব স্পষ্ট ও অস্পষ্ট আওয়াজ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষের নাড়ি বাঁধা সূর্যের সঙ্গে। তাই আজ সভ্যতার এত হাজার বছ পরেও, বিজলী আলো আবিষ্কারের এতবছর পরেও, জলে, স্থলে, অরণ্যে পর্বতে সূর্য যখনই ডোন তখনই এমন জানান দিয়ে ডোবে। পাখি দ্রুত উড়ে ফেরে নীড়ে, মা ডাকে ছেলেকে, কা চেলা করা শেষ করে গৃহস্থ তাড়াতাড়ি, উঠোনে আগুন করবে বলে বা ফায়ার-প্লেসে দেবে বলে একটু উষ্ণতার জন্যে। সূর্যর সঙ্গে উষ্ণতা এবং সূর্যর অভাবে উষ্ণতার অভাব বড় গভীরভাবে অনুভূত হয় বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির পরেও। শরীর এবং মনেরও উষ্ণতা! কী আশ্চর্য।
বাইরে বেলা মরে আসছে। ঘরের আলো এখনও জ্বালাতে হয়নি। কিন্তু হবে একটু পরই। সূ তো অবশ্যই প্রাণবাহী। হেমন্ত আসা মানেই প্রাণের প্রাচুর্যের হ্রাস। তাই সবদেশের মানুষই বি ছায়ারা দীর্ঘ হলে অথবা শীতাভাসে, ব্যস্ত হয়ে পড়ে সব কাজ সেরে ফেলতে? বাইরে থেকে আ নানা শব্দমঞ্জরীর মধ্যে বসে চারণের মনে হচ্ছিল একেই কি পশ্চিমের দেশগুলিতে Autum Solistice বলে? রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মাধ্যমে যে কথাকটি আশ্চর্য সুন্দর করে বলেছিলেন সেই গানও তো Autumn Solistice-এরই গান।
করো ত্বরা, করো ত্বরা
কাজ আছে মাঠ ভরা।
দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার করে
..এল যে শীতের বেলা বরষ পরে।
চারণ সবিস্ময়ে এবং হয়তো সভয়েও লক্ষ করছিল যে, তার মধ্যে, তার সেই পরম-প্রিয় এবং একই সঙ্গে পরম-ঘৃণ্য পরনির্ভরতাটা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে, দ্রুতপক্ষ পরিযায়ী পাখি মতন। তার হৃদয়ের পথ নির্ভুলে চিনে।
তার আপন জগতের মানুষেরা, অবশ্যই সে বেশ বড়, এমনকি পূর্ণ-যুবক হয়ে ওঠার পরও তা মায়ের উপর পরম-নির্ভরতা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে এসেছেন চিরদিনই। তার বাবাও ঠাট্টা করতেন। বলতেন তুই একটা মেয়েলি পুরুষ। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা ব্ৰজেন জ্যাঠা বলতেন, তুই একখান মাইয়া। তাদের বাড়ির চল্লিশ বছরের পুরোনো কাজের লোক, ওড়িশাবাসী রতিকান্ত বলত, তুম্ব গুট্টে মাইচা হ্যালা। মেয়েলি, মাইয়া আর মাইচার নামাবলিতে সে মোড়া ছিল।
চারণ জানত যে, নিজের মায়ের তো অবশ্যই, শিশুকাল থেকেই নারীদের প্রভাব তার জীবনে অসীম। সববয়সী নারীদেরই। তাদের উপরে সে চিরদিনই নির্ভর করে এসেছে জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো বটেই কোনও কোনও নৈর্ব্যক্তিক ব্যাপারেও। বহির্জগতের অনেক ব্যাপারেও। এবং তাঁদের উপর নির্ভর করে সে যতখানি নিন্দামন্দজনিত কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে অনেকই বেশি পেয়েছে আনন্দ। যার বা যাদের উপরে শতকরা একশভাগ নির্ভর করা যায় এমন মানুষের সংখ্যা তো সংসারে কোনওদিনও বেশি ছিল না। সংসারে বেশি না থাকলেও চারণের জীবনে, মানে জীবনের বিভিন্ন বয়সে তেমন নারীর সংখ্যা নেহাৎ কমও ছিল না। নিজের সব ভালো অন্যের উপরে পরম নিশ্চিন্ত হয়ে চাপিয়ে দিয়ে সে খুবই হালকা বোধ করেছে চিরদিনই। নিজের মামাতো দিদি, কাজরী, তার চেয়ে মাত্র দুবছরের বড় ছিল সে, যার সঙ্গে কৈশোরের দিন থেকে এবং কাজরী দিদির বিয়ে না-হওয়া পর্যন্ত এক মিষ্টি রোম্যান্টিক সম্পর্কও ছিল। সে, তুলি এবং আর কয়েকজন তার জীবনকে কখনও পুরোপুরি আবার কখনও আংশিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। নিয়ন্ত্রিত হতে, জীবনের কোনও কোনও ক্ষেত্রে, কোনও পর্যায়েই সে কখনওই আপত্তি তো করেইনি বরং আহ্লাদিতই হয়েছে। জীবনে অনেক হারের মধ্যে যে জয়ের অনেক আনন্দর চেয়েও গভীরতর আনন্দ আছে, এই সত্যটা ও খুব কম বয়সেই হৃদয়ঙ্গম করেছিল।
গতকাল সকাল থেকেই সে লক্ষ করছে যে চন্দ্রবদনী ধীরে ধীরে তার উপরে এক আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে। সেটা সে অবধানে করছে কি অনবধানে, তা ঠিক জানে না চারণ। কিন্তু সন্দেহ নেই, যে করছে। এবং চারণ খুশি হয়েই তার রাশ চন্দ্রবদনীর হাতে তুলে দিচ্ছে। ও.তো নিয়ন্ত্রিত হতেই চায়। এই পরম পরাভবের সুখের খোঁজ কজন রাখেন?
ও জানে না কেন, হৃষীকেশে চন্দ্রবদনী নামটি ওর কানে আসা মাত্রই নামটি এমন এক অনুরণন তুলেছিল ওর মধ্যে যে, তা বলার নয়। জয়িতার সান্নিধ্য, তা যত তীব্রভাবেই চারণ কামনা করে থাকুক না কেন, কখনও এমন সার্বিক প্রার্থনা জাগায়নি প্রার্থিতাকে পাওয়ার জন্যে। জয়িতাকে পাওয়ার জন্যে, হয়তো শুধু শারীরিকভাবে পাওয়ার জন্যেই ওর যে আর্তি, তার সঙ্গে সস্তা আতরের তীব্র ও কটু গন্ধের তুলনা যদি করা চলে, তবে চন্দ্রবদনীর জন্যে প্রার্থনার সঙ্গে তুলনা করতে হয় এই দেবভূমির উপত্যকায় এবং গিরিখাদের গভীর জঙ্গলে ফুটে থাকা শ্বেতা ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা ফুলের গন্ধের সঙ্গে। সেই সুগন্ধ, কোনও সুরঋদ্ধ গায়কের গলার গানের সুরের আরোহণ অবরোহণের মতনই চারণকে আচ্ছন্ন করে তোলে।
আর কী আশ্চর্য! চন্দ্রাবনীকে যেমন কল্পনা করে ছিল বাস্তবে তা পুরোপুরি মিলে গেছে। মিলেও গেছে। মনের মধ্যে এক শর্তহীন জলধারা যেমন ঢাল পেলেই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মে গড়িয়ে যায় এবং গড়িয়ে গিয়ে অন্য জলধারার সঙ্গে মেশে, চারণও অনবধানে তেমনই গড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল মনে মনে, চন্দ্রবদনীর দিকে কুঞ্জাপুরীর সেই মন্দিরের সুন্দর, নিষ্কলুষ, পরিবেশে সামনের কালো পাথরের চাতালে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে সেই সকালে দূরের নগাধিরানি চন্দ্রবদনীর দিকে চাইবার পরমুহূর্ত থেকেই। এতসব কথা ভাবতে ভাবতে বালিশের উপরে মাথা রেখে চারণের চোখ বুজে আসছিল। কিন্তু মনের মধ্যে এক আশ্চর্য আনন্দময় শান্তির বাতাবরণ অনুভব করছে সে কাল সকাল থেকেই। সেই বাতাবরণ তার শারীরিক সব কষ্ট ও অস্বস্তিকে যেন ভুলিয়ে দিয়েছিল। ও যেন একটা ঘোের, একটা spell-এর মধ্যে আছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে তার ঈশ্বরের কাছে, তিনি যেন তার এই ঘোর না কাটিয়ে দেন। এই ঘোর যেন চিরদিনই থাকেই।
চিরদিন?
হ্যাঁ। চিরদিন! চিরদিন!
যদি চিরদিন বলে আদৌ কিছু থেকে থাকে। দিন তো একদিন ফুরোয়ই সকলেরই।
.
১২.
স্কাইলাইটের মধ্যে দিয়ে পূবের আকাশের সাদাটে ভাব দেখা যাচ্ছিল। দূরে কোথাও জওয়ানেরা ফিজিক্যাল ট্রেনিং শুরু করেছে। একটু আগেই বিউগেল-এর আওয়াজ শোনা গেছিল একবার। তারপর অফিসারের মুখনিঃসৃত সপ্রতিভ সংক্ষিপ্ত শব্দ, মুচমুচে অডার। এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে জওয়ানদের দৌড়নোর এবং নানা ব্যায়ামের শব্দ।
চারণ ভাবল। উঠে, একবার বাইরে যায়। সৈন্যদের ব্যায়াম করা দেখে নিজেই একটু ফিট হয়ে আসে।
ভাবলই। কিন্তু উঠতে গিয়েই দেখল সর্বাঙ্গেই ব্যথা বেড়েছে অনেক। কালকে শুধু ক্ষতস্থানগুলিতেই ব্যথা ছিল! আজ সর্বাঙ্গ যেন বিষ-বেদনাতে টনটন করছে। বিছানা থেকে নিজ চেষ্টাতে ওঠা আদৌ সম্ভব নয়। তবে কি সে এই অতি স্বল্পপরিচিত যুবতী বিধবার গলগ্রহ হয়েই থাকবে। ভারী লজ্জা হল চারণের নিজের জন্যে। নিজের কারণে। কষ্টকে ছাপিয়ে সেই অপারকতার লজ্জাটা তাকে বড়ই হীনমন্য করে তুলল। একটু পরেই বেয়ারা বেড-টি নিয়ে এল। তখন অগত্যা উঠতেই হল। উপায় থাকলে অনেক কিছুই করা দুঃসাধ্য বলে মনে হয় কিন্তু নিরুপায় হলে সব মানুষই অসাধ্যসাধন করতে পারে।
ঘরের দরজা খুলে বারান্দাতে এসে বসল ও। খুবই ঠাণ্ড। কিন্তু রোদও এসে পড়েছে বারান্দাতে, চীর-পাইনের হিজিবিজি ফিনফিনে আঙুলের বারণ না শুনে। উপত্যকা থেকে নানা পাখি ডাকছে। কী পাখি? চুকার কি? মুদারাতে ডেকে চলেছে বারবার। অনেকবার একইসঙ্গে।
বাইরেই রাখতে বলল চায়ের ট্রে। অনেক কষ্টে ঘরে ফিরে গিয়ে মোজা আর শালটা নিয়ে এল।
ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে চন্দ্রবদনীও উঠেছে। হালকা সবুজ রঙের ফ্লানেলের ড্রেসিং-গাউন পরে বেরিয়ে এল সে। রাতে শোবার সময়ে খোঁপা ভেঙে এক বিনুনী করেছে। বিনুনীটা সামনে এনে দুই বুকের মধ্যে দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে তার নাভি অবধি। ড্রেসিং গাউনের বুকের ভাঁজের মধ্যে দিয়ে গাঢ় সবুজ রঙা নাইটির নীচে খালিজ-ফেজেন্ট-এর মতন একজোড়া বুকের আভাস দেখা যাচ্ছে। সেখানে চোখ পড়তেই শীত যেন কমে গেল চারণের, সঙ্গে সঙ্গেই। মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত শায়েরী
নীগা যায়ে কাঁহা সীনেসে উঠকর?
হুঁয়া তো হুসনকি দৌলত গড়ী হ্যায়।
অর্থাৎ, নারীর বুক ছেড়ে চোখ আর কোথায় যাবে? খোদা তত সুন্দরীর সব সৌন্দর্য ওখানেই গড়ে রেখেছেন।
ভাবল, এই শায়েরী মনে পড়তেই বুঝল যে, তাহলে তেমন অসুস্থ হয়নি ও।
কেমন আছেন? চন্দ্রবদনী জিগ্যেস করল।
ভাল। মিথ্যে করে ভাল বললেও যেন ভালত্বর দিকে কিছুটা এগুনো যায়।
বলেই ভাবল, ও।
এই শিক্ষাটা পশ্চিমীদের কাছ থেকে আমাদের হয়তো নেওয়ার ছিল। চারণ ভাবল। কোনও পশ্চিমীকে কেমন আছেন? জিগ্যেস করলে তাঁরা কেউই তাঁর শরীর-বৈকল্যর দীর্ঘ বর্ণনা অথবা তার মেজশালীর ছোটছেলের নাক দিয়ে ক্রমান্বয়ে সিকনি পড়া বা সেজ জ্যাঠার সেরিব্রাল অ্যাটাক ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে আপনাকে বিব্রত করার কথা ভাবতেই পারেন না। হয়তো নিজেরাও বিব্রত হন না। কেমন আছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ওঁদের শরীর মনে যত বৈকল্যই থাক না কেন, ওঁরা পুলকভরা গলায় বলেন ফাইন।
চারণ ফাইন অবধি যেতে পাবল না। মিথ্যাচার করে ফাইন বললে তাঁর বিবেক ফাইন করে দিত তাকে।
ভাল হয়ে যাবেন আস্তে আস্তে। নিচুস্বরে বলল চন্দ্রবদনী। শরীর সুস্থ হয়ে যাবেই কিন্তু মনের উপরে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। এসব ঘটনাতে সবচেয়ে বেশি যা আহত হয় তা শরীর নয়, আমাদের সুপ্ত অহং। ইগো। কোনও মেয়ে ধর্ষিত হলে তার শরীরের কষ্টটা তার মানসিক কষ্টের তুলনাতে অতি সামান্যই হয়। আসলে, এইরকম সব ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে যায় যে, আমরা সকলেই আসলে মন-সর্বস্ব জীব। শরীরটা মুখ্য নয়, গৌণ। অথচ শরীর নিয়েই আমাদের যত আদিখ্যেতা।
চন্দ্রবদনীর এই আলোচনাতে চারণ ভাল করে যোগ দিতে পারল না কারণ তার তখনও ভাল করে কথা বলার মতন অবস্থা হয়নি। মনো-সীলেবল ও হুঁ-হা করে কাজ চালাবার মতো কথা বলতে পারছে বটে তবে স্বাভাবিক হতে এখনও আরও কদিন লাগবে।
গতরাতে গরম জলে ব্রান্ডি, পেইনকিলার এবং মুসুর ডালের খিচুড়ি খুব কাজ দিয়েছে। আর্মি হাসপাতাল থেকে একজন কম্পাউন্ডার এসে টেডভ্যাক ইনজেকশান দিয়ে গেছিলেন রাতেই। আজ সাড়ে আটটার সময়ে ও হাসপাতালে গেলে এক্সরে করবেন ওঁরা। যদিও দরকার ছিল না। এসব চন্দ্রবদনীর বাড়াবাড়ি। আসলে ওর কিছুই হয়নি।
চন্দ্রবদনী ঘরে যেতে গেল চারণের আধ ভর্তি চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে। যাবার আগে বলল, বড় চুমুকে শেষ করে দিন।
গরম আছে? অস্ফুটে বলল চারণ।
টেপিড! বলে, অন্য একটি কাপ, ওর জন্যে দেওয়া খালিকাপটি ট্রে থেকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
তারপর ফিরে এসে বলল, গরম চায়ের লিকারের সঙ্গে এই ব্র্যান্ডিটুকু খেয়ে নিন। আরও চাঙ্গা বোধ করবেন।
চারণ বলল, বাঃ বাঃ–এ যে পাঁড় মাতালের খোয়ারি ভাঙা!
চন্দ্রবদনী যেন চারণের চলে-যাওয়া মা। ভাবছিল, চারণ।
চা খাওয়া হলে, চারণ বলল, হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে, তারপর?
তারপর কি?
তারপর কোন পথে যাওয়া হবে? বলে, হাসল চন্দ্রবদনী।
তারপর বলল, এমন তো নয় যে, আমরা দুজনে চলতি হাওয়ার পন্থী, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি! আমাদের পথ তো আলাদা আলাদাই। এখান থেকেই জুদা হয়ে যেতে হবে। আপনার খুবই কষ্ট হল। তবে আমার কিছু লাভ হল। কিছু নয়, খুবই।
কি লাভ? কেন?
সে নাই বা জানলেন। তারপর একটু চুপ করে থেকে গেট-এর পাশের মস্ত প্রাচীন ওক গাছটার দিকে চেয়ে বলল, যখন শরৎকালে হরশৃঙ্গার ফোটে তখন সে না-ফুটে পারে না বলেই ফোটে। কিন্তু তার গন্ধ যখন সন্ধ্যের শরত-শিশিরের গন্ধের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে পরিবেশে ভাসতে থাকে তখন হরশৃঙ্গার গাছ কি জানে কত কী বয়ে আনে সেই সুগন্ধ তার পাশ দিয়ে পথ-চলা মানুষের মনে? সেই মানুষের মনে কত কী সূক্ষ্মবোধের জন্ম দেয়?
সূক্ষ্মবোধের জন্ম, বাইরের কোনও কিছুই দিতে পারে না, আপনার মতো সুক্ষ্ম যার মন, তার মনে তো বটেই। তাই সেই মনের তানপুরার তারে কাঁচপোকা উড়ে এসে বসলেও অনুরণন ওঠে, ওঠে চৈত্রমাসের অবুঝ হাওয়া দাপাদাপি করলেও।
বাঃ।
কি বাঃ।
সুন্দর কথা বলেন আপনি।
তাই?
তারপর বলল, এই সুন্দর কথা বলা মানুষেরাই দেশটাকে তোবাল। শুধু কথা আর কথা। বেশি কথা মানেই মিথ্যে কথা।
হবে হয়তো।
হঠাৎ-ভাবনাতে বুঁদ হয়ে গিয়ে বলল চন্দ্রবদনী।
তারপর হেসে বলল, গানটা কার বলুন তো? মনে পড়ছে না। কার লেখা? কার সুর? কার গাওয়া? শান্তিনিকেতনে রাজেশ বলে বন্ধু ছিল আমার, সংগীতভবনের। সে আমার সঙ্গে কোথাও সাইকেলে করে গেলেই এ গানটা গাইত। সে বর্ষারদিনে কোপাই-এর দিকেই যাই আর পৌষোৎসবের সময়ে মেলা প্রাঙ্গণেই ঘুরে বেড়াই।
কি গান?
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত, বল তো?
হেসে ফেলল চারণ। হেসে ফেলেই, ঠোঁটের যন্ত্রণাতে কষ্ট পেল।
বলল, হাসাবেন না, হাসাবেন না। প্লিজ!
হুঁ, শুনে হেসে উঠল চন্দ্রবদনী।
কিছুক্ষণ পরে নিজের চায়ের কাপটা ট্রেতে নামিয়ে রেখে বলল, গাড়ি এসেছিল আপনারই জন্যে। আপনি রওনাক সিংকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে কোটঘদ্বায়ার, নাজিমাবাদ হয়ে চলে যান হরিদ্বার। সেখানেও থাকতে পারেন। নইলে যেখান থেকে রুদ্রপ্রয়াগে এসেছিলেন সেই আপনার দেবপ্রয়াগেই ফিরে যেতে পারেন। বিকেলের মধ্যেই কমফর্টেবলি পৌঁছে যাবেন। অথবা ভীমগিরি মহারাজদের হৃষীকেশেও যেতে পারেন। যেমন আপনার খুশি।
তাই?
কিন্তু।
কিন্তু কি?
আপনি কি সত্যিই চান যে আমি হরিদ্বার বা হৃষীকেশ বা দেবপ্রয়াগে চলে যাই? আমি কোথায় যে যাব তা ঠিক করিনি। হরিদ্বারেই যদি যাই তবে সেখান থেকে তো, কলকাতাতেও ফিরে যেতে পারি।
কলকাতাতে?
অবাক হয়ে বলল, চন্দ্রবদনী।
হ্যাঁ। আমার বন্দরে। মাঝে কিছুদিনের জন্যে নোঙর তুলে নিয়ে এদিকে ওদিকে ভেসেই বেড়ালাম শুধু।
যেতে চেয়েছিলেন আসলে কোথায়? কোনও সুন্দর বহুবর্ণ প্রবাল নির্জন দ্বীপে কি? যেখানে জলদস্যুদের গুপ্তধন পোঁতা আছে এবং আছে প্রবাল দ্বীপের রাজকুমারী?
ঠিক তা নয়। মানে, তেমন জায়গাতে নয়।
তাহলে ঠিক কি জন্যে আপনি কলকাতা ছেড়ে হাউই-এর মতন উড়ে এসেছিলেন এই দেবভূমিতে? এখানেই চিরদিনের মতন থিতু হবেন বলে কি?
না। তাও নয়।
তবে?
খুঁজতে এসেছিলাম।
কি? পরশ পাথর?
হয়তো তাই?
পেলেন?
পাইনি। হয়তো পাওয়ার কাছাকাছি এসেছি।
তাহলে? এখান থেকে কলকাতাতেই ফিরবেন?
ঠিক করিনি এখনও। পুরো ব্যাপারটাই ফ্লুইড আছে।
আচ্ছা পাগল মানুষ যা হোক আপনি!
হয়তো।
তাহলে আপাতত আমার সঙ্গেই চলুন।
কোথায় যাবেন আপনি?
অমি রুদ্রপ্রয়াগেই ফিরে যাব। উত্তরাখণ্ড-এর জন্যে এই আন্দোলন কতদিন চলবে, কী রূপ নেবে তা তো জানি না। তাছাড়া যতদিন না নতুন চাকরি পাচ্ছি ততদিন যাওয়ার মতন কোনও জায়গাও তো নেই আমার। হয় বাবার কাছে গিয়ে থাকা, নয় ঠাকুর্দার কাছে। বাবার এখন ফরোয়ার্ড-এরিয়াতে পোস্টিং। ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়া মানা। তাছাড়া, ওই সব জায়গাতে ইয়াং আর্মি-অফিসারেরা মেয়ে দেখলে জুরাসিক পার্ক-এর প্রাণী হয়ে যায়। সে প্রাণীদের থেকে প্রাণ বাঁচানোই মুশকিল।
হাসল, চারণ।
আপনার চাপরাসি হয়ে বেরিয়েছিলাম রুদ্রপ্রয়াগ থেকে। এখন এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আপনাকে একা ছেড়ে দিই কি করে! আপনার ঠাকুর্দা বা বড়ি বুয়াই বা কি বলবেন আমাকে।
আপনার মতলব তো ভাল বুঝছি না। আপনি কি ঠিক করেছেন বড়ি বুয়ার সোয়েটারটি গায়ে চড়াবার পরই রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়বেন?
হেসে ফেলল চারণ।
হেসেই, কেঁদে ফেলল। ঠোঁটে যা ব্যথা।
আপনার গিজারটা কিন্তু অন করাই আছে।
সময়মতন চানটা সেরে নেবেন। কড়া ইস্ত্রি করা মাড় দেওয়া জামা কাপড় পরার দরকার নেই। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে জওহর কোট শাল জড়িয়ে নেবেন উপরে।
মাড় দেওয়া ইস্ত্রি করা কামড় জামা সঙ্গে থাকলে তো! তারাও মালিকেরই মতন সব ন্যাতনাতে হয়ে গেছে।
ব্রেকফাস্ট কি খাবেন? সব কিছু খাওয়ার মতন অবস্থা তো এখনও হয়নি। আপনার জন্যে পরিজ, গরম দুধ আর মিষ্টি কমলালেবু দিতে বলছি। টক থাকলে তো আবার ঠোঁট জ্বলবে। চান করেই ব্রেকফাস্ট করবেন তো?
না। আমি ব্রেকফাস্ট করার পরই চান করি।
ভাল। তবে আটটাতে ব্রেকফাস্ট দিতে বলি? আমিও তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
না, না আপনি আবার কেন? ভীষণ অস্বস্তি লাগে আমার। আমি তো শিশু নই। একাই যেতে পারব বেশ।
তবে, নন কি? শিশু?
আপনিও এইরকম অভিযোগ করছেন?
করছি। তবে সব ব্যাপারে নয়। কোনও কোনও ব্যাপারে অবশ্যই। তুলিদি আপনাকে যেমন করে বুঝেছিল, তেমন করে খুব বেশি মেয়ে বুঝতে পারবে না বোধ হয়।
তুলি কি আপনার কাছে আমার গল্প খুবই করত?
খুব। ওর জগতই ছিল শুধু আপনাকে নিয়ে। চারণময় জগত। তা নাহলে আপনাকে কাছ থেকে না জেনেও আপনাকে এমন করে আমি জানতাম কী করে! যতই গল্প শুনতাম আপনার ততই ভাবতাম কী এমন আছে বা থাকতে পারে একজন পুরুষের মধ্যে যা এমন করে তুলিদির মতন একজন পরমা সুন্দরী এবং কোটিপতির স্ত্রীকে আকর্ষণ করতে পারে।
তাই?
চারণ বলল, লজ্জিত হয়ে।
আপনার কথা শুনতে শুনতে মনের মধ্যে আমার ভাবী স্বামী সম্বন্ধে এমনই এক ধারণা গড়ে উঠেছিল যে ভীষণই ভয় হত, সেই ধারণার সঙ্গে বোধহয় কারওকেই আর মেলাতেই পারব না। ফলে আমার হয়তো বিয়ে করাই হয়ে উঠবে না। তাই তো সাত তাড়াতাড়ি…
আমার মতন স্বামী কি আদর্শ স্বামী হত? যে স্বামী পরস্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া করে…
পরকীয়ার মধ্যে বঞ্চনা থাকলে তা অবশ্যই দূষণীয়। যে পরকীয়া একজন দুঃখী পুরুষ বা দুঃখী নারীকে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়, তার জীবনকে পূর্ণ করে তোলে, যার দমবদ্ধ দাম্পত্যর ঘরে বোদে-চাঁদে ভরা একফালি বারান্দা হয়ে আসে, তা মোটেই দূষণীয় নয়।
তাছাড়া তুলিদির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটিতে পাটনের অন্ধ, সম্পদমত্ত, অশিক্ষিত বাবাকে, শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটাও ছিল। যিনি নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করে এসেছেন চিরটাকাল, তাঁর শক্তি যে শুন্যময়তারই দ্যোতক, সে কথা, এই ফাঁকির কথা, তিনি জানতে পেলে অবশ্যই বুঝতে পারতেন। তার পরে হাহাকারে ভরে যেতেন। আচ্ছ। তিনি কি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না এই বঞ্চনার কথা?
জানি না। জানতেও পারেন। আমার দ্বারা তার ব্যবসার উপকার হত বলেই, জানলেও হয়তো তাঁর কোনও উৎসাহ ছিল না। টাকা ছাড়া, মানুষটা আর কিছুকেই ভালবাসেননি পৃথিবীতে।
চন্দ্রবদনী বলল, তাছাড়া ভাল-মন্দ এই দুই শব্দই আপেক্ষিক। তুলিদির সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক করে আপনি তুলিদিকে যেমন জীবন দিয়েছিলেন তেমন তাঁকে বাঁচিয়ে ছিলেন। লিটারালি। নাক দিয়ে প্রশ্বাস নিলে আর নিঃশ্বাস ফেললেই, ভোগ-বিলাসের সমস্ত উপকরণের মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকলেই কি আর কোনও মানুষ বেঁচে থাকনে? বাঁচা যে কাকে বলে, এই কথাটাই তো অধিকাংশ নারী-পুরুষ বোঝেন না।
একটু চুপ করে থেকে বলল, যাই হোক। ও সব কথা থাক। আপনাকে খুব কাছ থেকে জানলাম দুটি দিন। এই আমার মস্ত পাওয়া। কিন্তু বললেন না তো, কি খুঁজতে এসেছিলেন এই দেবভূমিতে?
অনেকক্ষণ কথা বলল না চারণ। আরেক কাপ চা ঢেলে নিল। চন্দ্রবদনীকেও জিগ্যেস করল। কিন্তু ও নিল না।
চারণ একটু চুপ করে থেকে, বাহিরের প্রাচীন ওক গাছটার দিকে চেয়ে অফুটে, যেন স্বগতোক্তিরই মতন বলল, হয়তো বাইরের কিছু নয়। হয়তো নিজেকেই খুঁজতে এসেছিলাম। নিজের বহিরঙ্গ আমিটা অন্তরঙ্গ আমিটাকে যে কবে অমন সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলে হজম করে। ফেলেছে সে কথা যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিলাম, সেই মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। To Correct my bearings.
পেলেন খুঁজে? কারেক্ট করলেন কি নিজের বেয়ারিংস? কম্পাস নিয়ে এসেছিলেন কি সঙ্গে? স্টপওয়াচ? গায়রোমিটার?
হাসল, চারণ।
বলল, না। পাইনি খুঁজে। তবে প্রার্থিত বস্তুর কাছাকাছি পৌঁছেছি বলে মনে হয়েছে একাধিকবার, কিন্তু পরক্ষণেই তা হারিয়ে গেছে আবারও।
তারপরই বলল, আপনি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী বইটি পড়েছেন কি? যে-বইয়ের জন্যে উনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন?
না। নোবেল প্রাইজ তত প্রতিবছরই কেউ না কেউ পাচ্ছেন। পশ্চিমে সোরগোল হলেই যে সে বই ভাল হবে তার কোনওই মানে নেই। মিলন কুন্দেরা! মিলন কুন্দেরা! করে গগননিনাদী রব। উঠল। ওমাঃ। পড়ে দেখলাম, শোভা দে-র শ্বেতাঙ্গ সংস্করণ। আমিও চেষ্টা করলে ওঁর চেয়ে ভাল পর্নোগ্রাফি লিখতে পারি। সাহিত্য আর পনোগ্রাফির মধ্যে তফাৎ আছে। সাহিত্য কাকে বলে এই সরল প্রশ্নটিই করে দেখবেন অনেক বড় বড় আঁতেলদের। মনে হয়, আমার তো মনে হয়, যিনি যত বড় আঁতেল, তিনি ঠিক ততখানি কনফিউজড।
তারপরই বলল, হঠাৎ হেমিংওয়ের কথা কেন? আমি খুব ভক্ত হেমিংওয়ের। ওয়াল্ট হুইটম্যান এবং রবাট ফ্রস্ট এরও ভক্ত। You expected to be sad in the fall. Part of you died each year when the leaves fall From the trees and their branches were bare. Against the wind and the cold, wintry light. But you knew there would always be the spring. As you knew the river would flow again After it was frozen. When the cold rains Kept on and killed the spring, it was as though. A young person had died for no reason.
এটি কোন বইয়ে আছে হেমিংওয়ের?
The Moveable Feast. তবে The Old Man and the Seaই আমার খুব প্রিয় বই। এই সব লাইন মনের মধ্যে কেমন এক বিষণ্ণতা আনে। এই সব লেখা, যে অন্য অনেক লেখার চেয়ে আলাদা, তা বোঝা যায়। লেখা, যদি পড়ার মতন না হয় তবে তা পড়া এক শান্তি বিশেষ। গদ্যই হোক আর কবিতাই হোক।
তা ঠিক। চারণ বলল।
.
হাসপাতাল-টাসপাতাল চারণের একেবারেই পছন্দ নয়। নানারকম তীব্র, ঝাঁঝাল ওষুধের গন্ধ। যন্ত্রণাকাতর রোগী ও রোগিণীর ক্লিষ্ট মুখ, কারও কারও গোঙানি, মন খারাপ করে দেয়। রোগ শোক তো আছেই! সে সবকে ভুলেই থাকতে চায় চারণ। তবু যেতে হয়, হাসপাতালে, নার্সিংহোমে কখনও সখনও।
যখন ওর শরীরের নানা জায়গার এক্স-রে করা হচ্ছে দুই রেডিওলজিস্ট-এর সংলাপ কানে এল ওর।
সিনিয়র যিনি, তাঁকে ক্যাপ্টেন সিং বলে ডাকছিলেন অন্য জনে। আর অন্যজনের নাম ক্যাপ্টেন বাগারিয়া। ক্যাপ্টেন বাগারিয়া বললেন, কর্নেল শর্মা কি জানেন?
জানেন বইকি!
কী করে আপনি জানলেন?
তা বলতে পারব না। এখানের সবাই জানেন যখন, তখন কর্নেল শর্মা তো নিশ্চয়ই জানেন।
ভেরি স্যাড। স্ত্রী গেছেন সেই কবে। তারপর সেদিনই গেল জামাই। তারপর ছেলে। ভেরি স্যাড ইনডিড।
ক্যাপ্টেন সিং বললেন, ছেলের যাওয়া নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই। সে তো শহীদ হয়ে গেছে। জানি না, কোনওদিন আমাদের উত্তরাখণ্ড-এর স্বপ্ন সফল হবে কি না। কিন্তু তা হোক আর যা হোক চুকার শর্মা যে এক বিশেষ বিশ্বাসে ভর করে প্রাণ দিয়েছিল একথা গাড়োয়াল হিমালয়ের সব মানুষ মনে করে রাখবে।
চারণের বুকের ওপর এক্সরে মেশিনের চাঁইটা ছিল। কাঠের টেবলের উপর চিৎ হয়ে হাসপাতালের দেওয়া জামা পরেই শুয়েছিল। শীতও লাগছিল খুবই। কিন্তু ওই কথোপকথন শুনে শীত যেন অনেকই বেড়ে গেল।
সে তুতলে বলল, ফাটা ঠোঁট নিয়ে, কোন চুকার শর্মা?
কর্নেল শর্মার ছেলে। এখানে উনি পোস্টেড ছিলেন অনেকদিন আগে। আমরা দেখিনি। তবে এখানকার অনেকেই চেনে তাঁকে। চুকারও নাকি ছিল এখানে শিশুকালে।
চারণ বলল, যিনি গতরাতে এই হাসপাতাল থেকে কম্পাউন্ডারকে সঙ্গে নিয়ে ট্যুরিস্ট লজে এসেছিলেন, তিনি তো চুকারের দিদি। কর্নেল শর্মার মেয়ে।
তাই?
ওঁরা দুজনেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বললেন।
চারণ বলল, একটাই অনুরোধ আপনাদের। আমার কিছু হয়নি। আমাকে ছেড়ে দিন। আর খবরটা এখন ওঁকে জানাবেন না। আমিই ওঁকে সঙ্গে করে রুদ্রপ্রয়াগে নিয়ে যাচ্ছি।
আপনার পরিচয়টাতো জানলাম না। ক্যাপ্টেন সিং বললেন।
আমি কলকাতায় থাকি। আ ফ্রেন্ড অফ দ্যা ফ্যামিলি। রুদ্রপ্রয়াগেও ছিলাম। সেখান থেকে পউরি যাব বলে বেরিয়েছিলাম দুজনে একসঙ্গে। কিন্তু বনধ এর জন্যে প্রাণ বাঁচিয়ে কোনওক্রমে এখানে এসে উঠেছিলাম।
চারণ বলল।
আই সী!
ক্যাপ্টেন বাগারিয়া বললেন।
কোটদ্বোয়ারেও কি বনধ ছিল গতকাল?
ছিল! সন্ধের পরই বনধ উঠেছে।
ওঃ। আমাকে প্লিজ একটু তুলে দিন। আমি যাব।
সার্টেনলি। আপনি যান।
আপনার রিপোর্টে যদি খারাপ কিছু থাকে তো আমি মেসেঞ্জার দিয়ে মোটরসাইকেলে করে পাঠিয়ে দেব রিপোর্ট। না থাকলে, পাঠাব না। আই উইশ বোথ অফ উ আ সেফ জার্নি টু রুদ্রপ্রয়াগ।
থ্যাঙ্ক উ্য। চারণ বলল।
তারপর আস্তে আস্তে দীর্ঘ বারান্দাটা পেরিয়ে এসে রওনাক সিং-এর পার্ক করে রাখা গাড়িতে উঠল।
চারণ ভাবছিল। তার উদ্বাস্তু ব্ৰজেন জেই, তার বাবার অতি প্রিয় সজ্জন, বলতেন মাঝে মাঝেই বোঝলানা বাবা। এভরিথিং ইজ প্রিকন্ডিশন্ড। যা কিসুই জীবনে ঘটে, তা ঘটিতব্য ছিল বইল্যাই ঘটে।
কে জানে! চারণের জীবনে কী কী ঘটার ছিল?
রওনাক সিং তার ডান কানটা আবারও সবেগে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করতে করতে জিগ্যেস করল, সব ঠিক-ঠাক হ্যায় না সাহাব?
হ্যাঁ। দর্দ হ্যায়। বাসস।
দর্দ তো রহেগাই। দিলকা চোট মিলনেসে ঔর জাদা দিন রহতাথা। ইয়ে তো স্রিফ বদনকাই। দিলত ঠিকেই হ্যায় না?
চারণ একটু থমকে গেল রওনাক-এর কথা শুনে।
ওর মনে হল যে, রওনাক-এর ডান কানটা তত একবার দেখিয়ে নেওয়া হল না হাসপাতালে অথচ কাল রাতেও কম্পাউন্ডার এসেছিলেন ওদের ওখানে এবং আজ ও নিজেও হাসপাতালে এল।
গাড়িটা হাসপাতালের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে বাইরের পথে পড়ল।
চারণ ভাবছিল, আসলে, ওরই মতন যারা ভাগ্যবান, যারা মালিক, যারা ওয়েল-অফফ তাদের অধিকাংশই বোধহয় তাদের খিদমগারদের, চাকর, বেয়ারা, ড্রাইভার এদের কারওকেই সমান চোখে দেখে না। পোেষা কুকুর, বেড়াল সম্বন্ধেও তাদের যতখানি দরদ বা চিন্তা সেটুকুও সম্ভবত চারণদের কাছে এবং চারণদের জন্যে জানকবুল করা এইসব মানুষদের সম্বন্ধে নেই। এটা লজ্জার, ভারী লজ্জার।
কান কৈসী হ্যায়? রওনাক?
কিসকা কান সাহাব?
আরে! তুমহারা কান। ঔর কিসকা কান?
ঠিকেই হ্যায়। ঈয়ে দোকান নেহি ভি রহতা তো সাহাব, ম্যায় বহতই মজামে দিন গুজারনে শকতাথা। ঈয়ে দো কানসে হর ইনসান কি কাফি দুখ পঁহছতা হ্যায়। হর আদমীকি বদনমেহি ইয়ে দোকানই সবসে জাদা দর্দ প্যায়দা করতা হ্যায়। কভভি মেরি দিল চাহতা কি শালে কানকো দোকান পাক্কাড়কে ঠিকসে শিখলাউ। মগর আপনা কানকো শিখানা ইতমিনান নেহি না হ্যায়।
কিউ?
দুসিরেকো বোলি শুননা পড়তা হ্যায় না! দিল-দুখানা-ওয়ালি সারি বাঁতে। যো বহেড়া হ্যায় উ বহতই মজেমে দিন গুজারতা।
চারণ, রওনাকের উদ্ভট কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল। বলল, তুম ক্যা সাচমুচ বহেড়া বননে কি ফিক্করমে হ্যায়। দোনো কান লেকর তুম যেইসি হরক করতে রহতা হ্যায় পাঁচ মিনিট বাদহি বাদ যো হামারা লাগতা যায় কি, তুম সাচমুচ বহেড়াই বন যাওগে।
ঠোঁটের কোণে মিচকি হাসি হেসে বলল রওনাক সিং, বদ্রীবিলাজিকি দোয়ামে ম্যায় বহেড়া বন যাতাথা তো বহুতই মজা আ যাতাথা সাহাব। সাচমুচ।
চারণ লক্ষ করেছে যে রওনাক এই সাচমুচ শব্দটি ঘন ঘন ব্যবহার করে এবং তা খুবই মুচমুচে হয়ে বেরোয় তার মুখ থেকে। প্রতিবারই।
পাগলের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ভাবল চারণ। চুপ করে থাকাই ভাল। কে জানে। এই সারথি তাদের, হয়তো পাগল নয়, হয়তো অৰ্জুনেরই মতন জ্ঞানী-গুণী কেউ?
কিন্তু এ বিষয়ে মন দেবার মতন মানসিক অবস্থা তার তখন ছিল না! চুকার-এর খবরটা নিয়ে এমন কি করবে সে, তা নিয়েই ভেবে অস্থির হল। খবরটাকে কি লুকোনো যাবে? তা কি পারা যাবে। আদৌ! দশমাসের পোয়াতি তার পেটও লুকাতে পারে, ইচ্ছে করলে। কিন্তু এই খবর…।
বলল, শোনো ভাই রওনাক। চন্দ্রবদনীজিকি ছোটা ভাইকে পুলিশ জানসে মার দিয়া। যে দুটি যুবকের লাশ অলকানন্দার জলে কাল সকালে ভাসতে দেখা গেছে তার মধ্যে একটা ওরই ছোট ভাই-এর। চুকার শর্মা তাঁর নাম।
রওনাক যেহেতু তখনও পুরোপুরি কালা হয়ে যায়নি, চারণ এ কথা বলে ভেবেছিল, অবশ্যই রওনাক উঃ আঃ করবে সেই দুঃসংবাদ শুনে। কিন্তু রওনাক সিং ডান হাত দিয়ে তার ডান কান নাড়াচাড়া করতে করতে, বাঁহাতে গাড়ি স্টিয়ার করতে করতেই বলল, পরিসানি হুয়া হোগা বিচারিকা।
কিসকো?
অবাক হয়ে শুধোল চারণ।
দিদিকি ছোটা ভাইকে।
কোন চিজকি পরিসানি?
ওয়াহ। অলকানন্দাজিকি পানি কিতনি ঠাণ্ডা থী পরশু রাতমে। রাতভর বহল হুয়ে নদীমে ওতনি সর্দিমে বহতই তকলিফ হুয়া হোগা বিচারিকি!
চারণ নির্বাক হয়ে গেল রওনাক-এর বাক্য শুনে।
ও ভাবছিল, এই পৃথিবীতে এই সংসারে, একই বস্তুকে, একই ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে কত বিচিত্র চোখেই না দেখে একেকজন মানুষ।
অলকানন্দার ঠাণ্ডা জলজনিত কারণে মৃত চুকারের কষ্টের প্রসঙ্গে না গিয়ে, চারণ বলল, ইয়ে সব বাঁতে উনকি নেহি বাঁতানা রওনাক। বিচারী রো পড়েঙ্গি শুননেসে।
বেফিকর রহিয়ে সাহাব। ম্যায় কভভি না বাতাউঙ্গা। মগর, উনোনে রো কাহে পড়েঙ্গি? ফৌজি আদমীয়াঁ কি ঘর কি ছাপ্পরমে মওৎ হরওয়াক্ত রহতি হ্যায়। রহতি হ্যায়, কবুতর যেইসি। মওত তো আনাহি শকতা : আহি হ্যায়। দুখ, মওতমে নেহি হ্যায় সাহাব, দুখ দুশমনকি মওত নেহি লা পায়া, সিফ উস লিয়ে। ফৌজি আদমীকি পরিবারেমে মওতই হ্যায় জিন্দেগী। মওত, হুঁয়া আসু নেহি না বহলতা হ্যায়!
অবাক হয়ে রওনক-এর দিকে চেয়ে রইল কলকাতার বঙ্গনন্দন চারণ। ছেলেবেলা থেকে অনেকই কিছু জেনেছে, শিখেছে কিন্তু এমন কথা জন্মে শোনেনি। কখনও মনেও আসেনি।
গাড়িটা যখন বাংলোর গেট-এ ঢুকল তখন চারণ দেখল, চন্দ্রবদনী অফিস ঘর থেকে বেরোচ্ছে।
কেন? অফিস ঘর থেকে কেন?
টেলিফোন এসেছিল কি? কে জানে!
গাড়িটাকে সিঁড়ির সামনে দাঁড় করাতেই চন্দ্রবদনী বলল, আমি গাড়িটাকে নিয়ে একটু বাসস্টপেজে যাব কিংবা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে? পনেরো মিনিটেই ফিরে আসব।
কেন? কী করতে?
কেন আবার? আমাকে ফিরে যেতে হবে না রুদ্রপ্রয়াগে? আমি তো আমার শাশুড়ি মায়ের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলাম পউরিতে। দেখা যখন হল না, তখন ফিরেই যাই রুদ্রপ্রয়াগে। চাকরিবাকরির জন্যে যে সব অ্যাপ্লিকেশন করেছি তার উত্তর বা ইন্টারভিউ লেটার এলে, তা আসবে রুদ্রপ্রয়াগেরই ঠিকানাতে।
একটু পরে চারণ বলল, আমি তাহলে তৈরি হয়ে নিচ্ছি। আপনিও তো দেখছি তৈরি হয়েই নিয়েছেন। মালপত্র বারান্দাতে বের করে আমি বিলও পেমেন্ট করে দিচ্ছি। আপনি এলেই আমরা রুদ্রপ্রয়াগের দিকে বেরিয়ে পড়ব।
আপনি কেন বিল দেবেন? আমার জন্যেই তো আপনার পউরিতে আসা। এত দুর্ভোগ।
আমিই না হয় দিলাম।
দুর্ভোগের সঙ্গে সুভোগও ছিল।
উত্তর না দিয়ে চন্দ্রবদনী বলল, তবে যাই।
চারণ দুচোখ দিয়ে রওনাক সিং-এর চোখে চাবুক মেরে না বলে বলল, খবদার! যদি বলেছ কিছু তুমি চন্দ্রবদনীকে।
রওনাক চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার ডান কানের সাধনাতে লাগল। চারণের মনে হল, টিকটিকির লেজ-এর মতন ডান কানটাই না একসময়ে খসে যায় রওনাক-এর।
গাড়ি চলে গেলে ও অফিসে গিয়ে বিল চাইল। সত্যিই পেমেন্ট করে দিয়েছে চন্দ্রবদনী আগেই। লজ্জিত হল জেনে খুবই। রুম-বেয়ারাকে ডেকে মালপত্র যা ছিল অতি সামান্যই, তা বারান্দাতে বের করিয়ে এনে রোদে পিঠ দিয়ে বসল চন্দ্রবদনীর ফিরে আসার অপেক্ষাতে।
ভাবছিল, খবরটা, কখন, কী করে দেবে চন্দ্রবদনীকে। নাকি রুদ্রপ্রয়াগে গিয়েই ওর আত্মীয়দের মুখ থেকেই শুনবে ও খবরটা? চুকার শর্মার ঠিকানা তো রুদ্রপ্রয়াগই। সেখানেই তো গেছে খবরটা সবচেয়ে আগে। ওদের হদিস কেউ জানে না বলেই ওরা আগে খবরটা পায়নি। যে-ছেলেদের হাতে ও পউরিতে প্রহৃত হল ওরা। তারা যদি জানত চন্দ্রবদনী কে? তাহলে তো ওরা পাইলটিং করে নিয়ে যেত তাদের গাড়িকে।