Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চাপরাশ || Buddhadeb Guha » Page 5

চাপরাশ || Buddhadeb Guha

০৯-১০. চরৈবেতি! চরৈবেতি!

চরৈবেতি! চরৈবেতি!

বাসটা ঘুরে ঘুরে নামছে নীচে। পাশে পাশে, অলকানন্দা।

পাটন যেমন বলেছিল, সত্যিই সেই রূপের বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। কতরকম যে গেরুয়া, কমলা, কোরা, সাদা, কালচে-সাদা আর কতরকম যে নীল-সবুজ তা বলার নয়।

পাটন বলল, দেখো চারণদা, এই শ্রীনগর উপত্যকা। সমান। শ্রীনগর পেরিয়ে গিয়ে আবার আমরা উপরে চড়ব। চড়ব, তো চড়বই।

তাই?

চারণ অন্যমনস্ক স্বগতোক্তি করল।

হঠাৎ যে এমনি করে পাটনের লেজুড় হয়ে দেবপ্রয়াগ ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে তা গতকাল রাতেও ভাবেনি একবারও; পাটন ঠিকই বলেছিল। বলেছিল, এখানে কিসের আঠা পেলে তুমি?

বলেই, বলেছিল, আড়কাঠি দেখেছ কখনও?

না।

না দেখলে, আঠার মহিমা বুঝবে কি করে? থিতু, শুধু তারাই হতে পারে, যারা তপস্যাকারী, সত্যিকারের জ্ঞানপিয়াসী। যারা সাধক। তুমি আমি তা নই। আমাদের গোড়ালি জুড়িয়ে এলেই আবার চলা শুরু করে দেওয়া উচিত। থেমে পড়লেই সেই জায়গার স্থবির গাছ পাথর ফুল পোকা বা ঘাস হয়ে যাবে।

তারপর বলল, জোনাথন লিভিংস্টোন এর সীগাল বইটা পড়েছ কি চারণদা?

হুঁ।

চারণ বলল। তার মনে হল, এই প্রশ্ন পাটন যেন এর আগেও তাকে কখনও করেছিল।

পাটনের এই জ্ঞানভাণ্ডারের বহরে ক্রমশই বিস্মিত হতে হতে ছেলেটা সম্বন্ধে চারণের মনে দার্জিলিং-এর সূর্যাস্ত অথবা পুরীর সুযোদয়ের ফোটোর মতন ক্লিশে হয়ে-যাওয়া-ধারণা, যা ফ্রেমবদ্ধ হয়ে গেছিল, তা ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত।

চারণ ভাবছিল, কোনও মানুষ সম্বন্ধেই কোনও পাকা ধারণা কখনওই করতে নেই। সব রংই ধুয়ে যেতে পারে। এক রং-এর আড়াল থেকে কখন যে অন্য রং-এর বেরিয়ে পড়ে, তা কে বলতে পারে।

নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হবে চারণদা, বুঝলে। যার পা আটকে গেছে জীবনের কাদাতে, নুড়িতে, ঘাসে, তার সাহসও ক্রমশই কমে আসতে থাকবে। চারপাশের পরিবেশ আর প্রতিবেশ এর সব বদ্ধতা ছিঁড়েছুঁড়ে উৎসাবিত উৎক্ষিপ্ত হতে না পারলে তোমার মানুষ জন্মই বৃথা। বুঝেছ চারণদা। ছিড়ে ফেল, ছেড়ে চলো এই হওয়া উচিত প্রকৃত জ্ঞানপিপাসুর জীবনের মূল মন্ত্র। কয়েকদিন ধরেই আমি লক্ষ করছিলাম তোমার হাবভাব দেখে যে, তুমি যেন মোটার মোহজালে ধরা পড়ে গেছ। অথচ মোটা কিন্তু ধবতে চায় না কারওকেই। তার অজান্তেই তার ব্যক্তিত্ব অন্যকে অজগবেব শীতল চোখের মতন আকর্ষণ করে। অজানিতেই অনেকে আটকে যায়। কিন্তু আমার ভোঁদাই বাবা আর অন্যান্য যাঁদের দেখো ওঁর চারপাশে তাঁরা সবাই সিদ্ধ পুরুষ। জর্ডন আর স্টিভেন্সও সিদ্ধ হবে বলে পণ করেছে। হোক গে তারা। তোমার বা আমার পক্ষে অত সহজে সিদ্ধি আসবে না। আমাদেব পক্ষে আধ-সেদ্ধ থাকাই ভাল। হাফ-বয়েলড। হাফ বয়েলড ডিমই বা খারাপ কিসে!

বলেই বলল, ইসস কতদিন হাফ-বয়েলড ডিম খাই না।

কেন? একথা কেন বলছ?

কি কথা?

আমাদের পক্ষে আধ-সেদ্ধ থাকাই ভাল।

চারণদা, বলছি, কারণ, আমাদের ভোগ সম্পূর্ণ হয়নি বলে। আমরা রজনীশ আশ্রমে গিযে ভিড়লেও না হয় একটা কথা ছিল। ভভাগের মধ্যে দিয়ে ত্যাগ ব্যাপারটা বেশ মসৃণভাবে এসে যেত। ভোগী যে কখন ত্যাগীতে রূপান্তরিত হয়ে যায় কোন পন্থাতে, তা উপরওয়ালাই জানেন। কিন্তু অনেকে বলেন সেটা একটা মান্য-পন্থা, নান্য-পন্থা না হলেও। কিন্তু এতরকম অপূর্ণ কামনা বাসনা নিয়ে ভোঁদাইবাবার পদতলে বেশিদিন পড়ে থাকলে কবে কোন স্নানরতা বা সিক্তবসনা যুবতাঁকে বলাৎকার কবে এই পবিত্র স্থানকে অপবিত্র করে নিজেও প্যাদানি খেয়ে অক্কা পেত। এইসব ভেবেই, তোমার ভালর জন্যেই তোমাকে সময়ে সরিয়ে আনলাম। you should not indulge in more greatness than you can possibly contain. বুঝলে না!

একটু চুপ করে থেকে বলল, পবে, ইচ্ছে হলে, যেও আবার। অথবা কলকাতা বা অন্য জায়গা থেকে ফিরে এসো দেবপ্রযাগে। কে মানা করেছে! স্কুলে যেমন ভাল ঘরা ডাবল প্রমোশন পায়, তেমন এই ইস্কুলে তুমিও তো ডাবল প্রমোশন পেতেও পারো। ভোগ সম্পূর্ণ না হতেই যদি উপরওয়ালা অন্যতর কোনও যজ্ঞে তোমাকে সামিল হতে বলেন, তবে না হয় তখন তাই হয়ো। কিন্তু সবচেয়ে আগে, নিজেকে জানো। নিজেকে জানাটাই এই পথের সর্বপ্রথম পাঠ। আত্মানাং বিদ্ধি। শুনেছ কি কথাটা?

শুনেছি, মানে, পড়েছি।

চারণ বলল।

শুনেছ বা পড়েছ বলেই যে মানেও বুঝেছ তার তো কোনও মানে নেই। শুনলে আর পড়লেই যদি পণ্ডিত তৈরি হত তবে তো যত শিক্ষক, অধ্যাপক, উপাচার্য আমরা দেখি আমাদের চারধারে সকলেই তাই হতেন। পড়াশোনার উপরেও একটা অন্য জ্ঞানের পরত থাকে। কেউ কেউ সেই পরতের আশীর্বাদ সঙ্গে করে জন্মান অথবা তার যোগ্য করে তোলেন নিজেকে পরবর্তী সময়ে। শুধু তাঁরাই আসল পণ্ডিত। তা নইলে তো টিকি রাখলে আর ডিগ্রির মোট বয়ে কাঁধ ঝুঁকে গেলেই সকলেই পণ্ডিত হয়ে যেতেন।

তারপর বলল, নিজেকে জানা হোক আর নাই হোক, জানার ইচ্ছেটাও যদি নিজের মনের মধ্যে সবসময় জাগরুক রাখতে পারো চারণদা, তাহলেও জানবে যে, মাউন্ট এভারেস্ট-এর চুড়ো দেখা যাচ্ছে।

অলকানন্দার উপরের কংক্রিটের নয়া সেতু পেরিয়েছিল চারণেরা দেবপ্রয়াগ ছাড়বার পরেই। শ্রীনগরে পৌঁছে এবারে বাঁয়ে মোড় নিয়ে চলেছে বাস।

ডানদিকে পথ কোথায় গেল?

জিগ্যেস করল চারণ পাটনকে।

সেই যে বলেছিলাম না। পউরি!

দারুণ জায়গা। না?

চারণ, অদেখা পউরি প্রসঙ্গে শুধোল।

সব জায়গাই দারুণ চারণদা। কোনও জায়গাই অন্য জায়গা থেকে ভাল নয়। তেমন সব মুহূর্তও দারুণ। সবসমযে জিডু কৃষ্ণমূর্তির কথা মনে রাখবে। You must live from moment to moment, আমাদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ মানুষই হয় ভবিষ্যতে বাঁচি নয়, অতীতে। অথচ এই যে এই মুহূর্তটি, ধরো না কেন এই মুহূর্তটিই, মানে This very মুহূর্তটিই, এই যে আমরা চলেছি শ্রীনগর ছাড়িয়ে রুদ্রপ্রয়াগের পথে, পথের দুধারের এই সুন্দর দৃশ্য, এই শান্তি, এই মুহূর্তটিকেও কি। আমি অথবা তুমি পরিপূর্ণভাবে নিংড়ে নিতে পারছি বা পারার চেষ্টা করছি? বলো? জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি সপ্তাহ, মাস, বছরকে নিবিড়ভাবে পাওয়াটাই দার্শনিকের পাওয়া। সে দর্শন ত্যাগের আর দান ধ্যানেরই হোক কি চাবাকের মতানুযায়ী ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ-এরই হোক।

চারণ চুপ করেই রইল। ও ভাবছিল, পাটনটা এই সাধুসন্তদের সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের অজানিতেই বোধহয় সাধু হয়ে গেছে। নইলে, অমন বাবার এমন ছেলে হয় কি করে। তাছাড়া, একটা বহুশ্রুত কথা আছে না উদ্ভিদদের জীবনে? যাকে, উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষাতে Symbiosis বলা হয়ে থাকে, এক গাছের কোটরে অন্য গাছের বীজ বা ফল পড়ে সেখানেই এক গাছের মধ্যে অন্য গাছের জন্ম হয়। পাটনের জীবনে হয়তো এই Symbiosis-ই কাজ করছে।

বাসটা বেশ উপরে উঠেছে আবার। ঠাণ্ডাটা কনকনে। গলার বোতামগুলো তো আটকেছিল আগেই এবারে মাফলারটাও জড়িয়ে নিল। মাথায় বাঁদুরে টুপি। নিজের চেহারা নিজে দেখতে পাবছিল না ভাগ্যিস! যদি পেত, তবে ও নিজে তো দূরস্থান ওর পাওনাদার অথবা টেটিয়া মক্কেলদের কেউও ওকে চিনতে পাবত না শত চেষ্টাতেও। একেই বলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ এর প্রভাব।

ব্যোম শংকর।

কানের কাছেই এক সহযাত্রী আওয়াজ দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সারা বাস জুড়ে রব উঠল ব্যোম শংকর। ব্যোম শংকর।

বাসের পেছন থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল বোলো বাবা বদ্রীবিশালজিকি-ই-ই-ই-ই

সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা সমস্বরে বলে উঠল, জয়।

কিছু বুঝতে পারার আগেই চারণ স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, হাইকোর্টের একজন বিলেত-ফেরৎ, দুনিয়াদারী করা ব্যারিস্টার যে, একটু ইচ্ছে ও চেষ্টা করলেই শেরিফ হতে পারত কিংবা নির্বাচনের কিট পেতে পারত এ বছরেই, তার এমন অধঃপতন হয়েছে যে, সে আর বলার নয়।

লজ্জাতে, মরমে একেবারে মরে গেল যেন! ছিঃ। কলকাতার আঁতেলরা জানতে পারলে কি ভাববেন!

পাটন বলল, কেমন বুবই গো চারণ দাদা। এ নিছক কেলো নয়, একেরে ক্যাক্যাক্যাক্যালামিটি। এ ক্যালিমিটি থেকে উদ্ধার পাবে তেমন ক্যাক্যাক্যাক্যাপাকাইটি তোমার নেই। তরীর বৈঠাটিও আমারই হাতে। আমি যে পাটন! বলেই, গান ধরে দিল,

কে যাবি পারি তোরা কে?
আমি লৌকা লিয়ে বসে আচ্চি
লদী কিলারে…

পাটনের বহুমুখী প্রতিভাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়ে চারণ বলল, ক্যাপাকাইটিটা আবার কি জিনিস?

মনোজ মিত্রর Coinage।

মানে?

গেঁয়ো, ইংরেজি-অ-নবিশ লোকে capacity-র উচ্চারণ কি করবে? ক্যাপাকাইটি নয়?

হেসে ফেলল চারণ।

বলল, তোমার স্টকে কিছু আছে বটে!

হুঁ। হুঁ। এ তো Tip of the lceberg.

বলেই বলল, একটা গুলি সেবন করবে না কি? ঠাণ্ডাতে যেন এখনই এই সকাল নটাতেই নিভে গেলে! আর আজ তোমোটে তিন তারিখ নভেম্বরের। এরই মধ্যে!

চারণ চমকে উঠল। দুমাসের মতন হয়ে গেছে ওর কলকাতা ছেড়ে আসার। কই? তেমন কিছুই তো ঘটেনি, জয়িতা তো লোক পাঠায়নি খোঁজ করতে। কোনও মক্কেল, এমনকি চন্দ্র বা সরকার অথবা জালান অথবা নেগি বা খারবান্ধারাও দিল্লির অফিসকে বলেনি তাকে লিটারালি অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসতে। ও না গেলে তাদের রাজ্যপাট সব নীলামে বিকোবে। ভেবেছিল কি চারণ?

ভেবেছিল। ও এসব ভেবেছিল। ওসব idiotic wishful thinking। কারও জন্যেই কারও ঠেকে থাকে না। কোনও ডাক্তার, উকিল, ব্যারিস্টার, স্বামী, প্রেমিক। না কারও জন্যেই নয়। ঠেকে থাকে এই ভাবনাটাই নিজের নিজের আত্মম্ভরিতা বই আর কিছুই নয়। কারওই যদি তাকে দরকার সত্যিই নাই থাকল তবে সে আবার ফিরতে যাবেই বা কেন? কিসের জন্যে?

কি হল? বললে না যে! খাবে গুলি? বলো তো বের করি। ঝোলাতে আছে।

নাঃ।

বলল, চারণ।

বিরক্তিটা গুলির প্রতি, না পাটনের প্রতি, না তার নিজেরই প্রতি তা বুঝতে না পেরে।

এরপরে দুজনেই বেশ অনেকক্ষণ নিজের নিজের ভাবনাতে কুঁদ হয়ে চুপ করে রইল।

আসলে চুপ করে থাকলেই কোনও মানুষ প্রকৃতই চুপ হয়ে যায় না। মস্তিষ্কের মধ্যে কথার চাবিগুলো অগানের চাবিরই মতন ওঠে আর পড়ে, কিন্তু mute হয়ে থাকে। অন্যে শুনতে পায় না। নিজের কান ঠিকই শোনে।

এ পথে অন্য কোনও উল্লেখযোগ্য জায়গা নেই। ছোট ছোট গ্রাম আছে অলকানন্দার দুপারেই। ভিতরে ভিতরে, বিভিন্ন উচ্চতাতে। আর পায়ে-চলা পাথর বাঁধানো পথ। যেসব পথের অনেকই বর্ণনা চারণ পড়েছিল জিম করবেট-এর বইয়েতে। নানা গাছ। দেবদারু, তোন, তাড়, ওক, মেপল, বার্চ, চেস্টনাট, হর্স-চেস্টনাট, আরও কত তৃণ গুল্ম। চারণ আর কটা গাছের নাম জানে। দেখতে দেখতে চলেছে চোখে কিশোরের ঔৎসুক্য নিয়ে।

হঠাৎ পাটন বলল, এদিকে যখন এলেই তখন একটা বই লেখো না তুমি চারণদা।

বই? আমি? কী বই?

অবাক হয়ে বলল চারণ।

ট্রাভেলোগ। আবার কি বই? এইসব অঞ্চলে দুমাস রইলে, এত রকমের মানুষকে দেখলে কাছ থেকে হৃষীকেশে, দেবপ্রয়াগে। দেখবে আরও রুদ্রপ্রয়াগে। সেখান থেকে আরও কত দিকে যেতে পারো। ইচ্ছে করলেই। আচ্ছা তুমি এতদিন আছে, পুরো গ্রীষ্মটাই বলতে গেলে থাকলে, তোমার নাকের উপর দিয়ে হাওড়ার ঘুসুরীর বেন্দাবন, মালিপাঁচঘড়ার নটে, বালিগঞ্জের নেকি সুতনুকা, নিউ আলিপুরের দাম্ভিক সেন সাহেবরা, সল্টলেক-এর চালিয়াত বোসেরা, ঘোষেরা, চাটুজ্যেরা, ডায়মণ্ডহাবড়ার ছিকান্ত আর সৌদামিনী, সকলেই কেদারবদ্ৰীতে গিয়ে পুণ্য সেরে ফেলল আর তুমি ন যযৌ ন তন্তে হয়ে দেবপ্রয়াগেই পড়ে রইলে কেন বলত? তোমার কি পুণ্য করতে ইচ্ছে হল না একটুও? নাকি তোমার পাপ জমেনি তেমন, তাই পুণ্য করে তা কাটাকুটি করতে চাও না?

ঠিক তা নয়। চারণ বলল।

তবে কি? ঠিক-বেঠিক জানি না। ব্যাপারটা কি?

জানি না, বুঝিয়ে বলতে পারব কি না! সকলেই যা করে তা করতে আমার কোনওদিনই রুচি ছিল। জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই নয়। এরা যে প্রবল বেগে গেল দেবদর্শনে যুদ্ধের রথের মতন দ্রুতগামী বাসে করে, ব্যস্ততার ধুলো উড়িয়ে, হাজার হাজার মানুষ, যেমন করে প্রতিবছর মক্কা-মদিনাতে যায় হাজী হতে, সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে পৃথিবীর সব মুসলমানেরা, জেরুজালেমে যায় ইহুদিরা, মরুভূমির মধ্যের হিংলাজে যায় হিন্দুরা, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সদারজিরাতাদের কারও সঙ্গেই আমার তো কোনওই মিল নেই।

কেন? মিল নেই কেন? তুমি কি হেলিকপ্টার থেকে থ্রি-পিস-স্যুট পরা অবস্থাতে এখানে আছড়ে পডেছ? তুমি এদেশের কেউ নও?

সে কথা নয়। আমি হিন্দু মা-বাবার সন্তান কিন্তু আমি নিজে কোনও বিশেষ ধর্মাবলম্বী নই। তা বলে ধর্মের ভূমিকা, ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আমি অস্বীকারও করি না। কিন্তু যে ধর্ম সম্বন্ধে এখনও পৃথিবীর মানুষ অবহিত নয় আমি তেমনই এক ধর্মে বিশ্বাসী। যে ধর্ম আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ হয়েও অন্য কোনও ধর্মেরই সঙ্গে কোনও বিরোধ রাখে না। রাখবে না। এই ধর্ম আমার শিক্ষা, আমার শিক্ষা-বিকীরিত ঔদার্য, আমার আধুনিকতা। যে-আধুনিকতা প্রাচীনত্বর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল হয়েও উগ্ৰ অশিক্ষিত সবজান্তা বড়লোকদের বা বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত আধুনিকতা থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র।

বলেই বলল, যাক সেসব কথা। বাসের মধ্যে বসে এত গভীর আলোচনা করতে গেলে চিন্তা নড়ে যাবে, মগজ ঘুলিয়ে উঠবে।

বেশ। তা নয় মানলাম কিন্তু তোমার বই লিখতে বাধা কোথায়?

কী যে বলো পাটন! এইসব অঞ্চল নিয়ে কত ভাল ভাল বই লেখা হয়েছে তা কি তুমি জান? কত মানুষ, এবং তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে অনেকই জ্ঞানী, গুণী, অভিজ্ঞ, সারাজীবন এই কুমায়ু আর গাভোয়াল হিমালয়ের আনাচ-কানাচ ঘুরে কত সুন্দর সব বই আমাদের উপহার দিয়েছেন।

বাংলা বই?

পাটন অবিশ্বাসীর গলাতে বলল।

হ্যাঁ বাংলা বই। কেন তোমার কি ধারণা ভাল বই বলতে যা বোঝায় তার সবই ইংরেজিতেই লেখা হয়? আমার তো ধারণা ইংরেজিতে প্রকাশিত আশিভাগ বইই উনুনে দিয়ে দেওয়া উচিত। এই হীনম্মন্য মানুষদের দেশে কেউ ইংরেজি বললে বা ইংরেজি জানলেই আমরা তাকে দেবতা জ্ঞান করি। লজ্জাকর।

আঃ। তুমি এই মেজাজ নিয়ে হাইকোর্টে সওয়াল করে জিততে কি করে ভেবে পাই না।

সত্যি!

সেই আমি এই আমি নই।

তুমি নও?

নাঃ।

তবে সে কে? তুমি কতজন তুমি? আচ্ছা হেঁয়ালি করো তো!

সে একজন মুখোশধারী। আমার চেম্বারের দেওয়ালে যে-হ্যাঙ্গারে গাউন টাঙানো থাকে, যেটা গায়ে আলতো করে চাপিয়ে, যে শামলা গায়ে দিয়ে কোর্টে অ্যাপিয়ার করি আমি, তারই পাশে একটি অদৃশ্য হ্যাঁঙ্গারে ঝোলানো থাকে আমার উকিলের মুখোশ। যে-আমি কথায় কথায় মাথা নিচু করে, হাসি মুখে, বিনয়ের পরাকাষ্ঠা করে কোনও কোনও হাকিমকে বলি, মী লর্ড আর যার মুখোশের আড়াল থেকে আমার আসল আমি নিরুচ্চারে বলে, ওরে ছাগল, যা বলি, তা কান খুলে শোন। সেই আমি আসল আমি নই। সে তো একটা বিক্রি হয়ে-যাওয়া সত্তা। সে-আমি ছাগলকে ছাগল বললে, অশিক্ষিতকে অশিক্ষিত বললে আমার মক্কেলদের যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। আদালত কি কখনও অবমাননা করার মতো কাজ করেন? ছিঃ! মক্কেলদের কাছ থেকে স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে সম্মানী নেব আর তাদের সর্বনাশ করব তা তো হতে পারে না। তবে যখন ওই পাড়া ছেড়ে বাইরে চলে আসি, চলে আসি আমার চেম্বার ছেড়ে, তখন আমি আসল আমি হয়ে যাই। মুখোশটা সারা রাত, সারা গ্রীষ্মবকাশ, পুজোবকাশ, চেম্বারের দেওয়ালেই ঝোলে। তাতে ধুলো পড়ে।

তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আনতে বললাম গোবর আর ঠেলে আনলে গাই। এইসব অঞ্চল নিয়ে লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম বল তো শুনি। আশ্চর্য। আমি একটাও পড়িনি।

পাটন সম্ভবত চরতে বেরুনো চারণকে ফিরিয়ে আনার জন্যে বলল।

প্রথমেই বলতে হয়, তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ।

চারণ বলল।

কার লেখা?

প্রমোদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। শুধু এই অঞ্চলই নয়, আরও অনেক জায়গা নিয়ে লেখা। কৈলাশ, মানস সরোবরও আছে। নিজের আঁকা ছবি। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখাও আছে। প্রবোধ সান্যাল মশায়ের মহাপ্রস্থানের পথের সিনেমা দেখেই তো সাধারণ বাঙালির টনক নড়ে। ওই ছবিতেই বাঙালি আবিষ্কার করে অরুন্ধতী গুহ ঠাকুরতা এবং বসন্ত চৌধুরীকে।

তাই?

তাই বৎস।

আর কার কার বই আছে?

শঙ্কু মহারাজের। অনেক বই। সারা জীবনই বলতে গেলে এই অদম্য জীবনীশক্তির মানুষটি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে সাধারণ বাঙালিদের জন্যে এইসব পুণ্যভূমির খবর জোগালেন। এছাড়াও আরও অনেকে আছেন। সকলের নাম বলতে গেলে তুমিই Bored হয়ে যাবে।

তা ঠিক।

তারপর আবার দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে নিজের ভাবনাতে বুঁদ হয়ে রইল।

হঠাৎই পাটন বলল, চন্দ্রবদনীকে তুমি ধরে রাখতে পারলে না চারণদা? কাজটা ভাল করলে না কিন্তু। সোনাকে অবহেলা করলে অমন করে!

চারণ হেসে বলল, ফাজিল! এক নম্বরের!

তারপর বলল, সত্যি। সে গেল কোথায় বলো তো? আর তো তারপরে দেখলামই না!

তুমি না দেখলে কি হয়, সে তোমাকে দেখেছে ঠিকই।

বাজে কথা। মোটেই নয়। তুমিও ভাল করেই জানো যে, সে তোমাকে দেখেছে। কথা পড়ে হাটের মাঝে/যার কথা তার বুকে বাজে। হেঃ হেঃ।

তারপরই বলল, তোমার সঙ্গে দেখা না-হতে পারে, আমার সঙ্গে হয়েছে। সে নীচে গেছিল, হৃষীকেশেও। তোমার সেই সব বাবা ধিয়ানগিরি, বাবা ভীমগিরি আর কৃষ্ণা বহীনদের সঙ্গে দেখা করতে।

তারপর কোথায় গেছে?

তা কি করে বলব। মেয়েরা নদীরই মতন। তারা কোথায় বাঁক নিয়ে কোন অচেনা বনের মধ্যে কখন হারিয়ে যায় তা কি আগে থাকতে বলা যায়? পাখিরাই শুধু খোঁজ রাখতে পারে, রাখে তাদের। তারা যে জলের গন্ধ চেনে। এবং চেনে বলেই, দূরের নদীর গন্ধ পেয়ে কাক-উড়ান এ উড়ে গিয়ে তাদের ঠিক খুঁজে বের করে।

বাবা, এ যে কবিতা একেবারে।

চারণ বলল।

পাটন হেসে বলল, আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি কবি। এবং ভগ্নদূতও।

ভগ্নদূত মানে?

ভগ্নদূত, কারণ অন্যের জন্যে ভাল খবর আমি প্রায় কখনওই নিয়ে যেতে পারিনি। যেমন তোমার জন্যেও পারলাম না।

মানে?

মানে, চন্দ্রবদনী রুদ্রপ্রয়াগ ছেড়ে সেই যে নেমে গেছিল দীপাবলীর আগে দেবপ্রয়াগে, যখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তারপর থেকে তার কোনও খোঁজই নেই।

খোঁজ নেই মানে?

মানে, নিরুদ্দেশ।

হতেই পারে না।

চারণ জোরের সঙ্গে বলল।

কেন? হতে পারে না কেন? প্রতিদিন আমাদের কলকেতার খবরের কাগজগুলোতে পাতা জুড়ে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ এর যে সব খবর বেরোয় সেগুলো কি সব মিথ্যে?

না, তা নয়।

নয় কেন? তোমার নিজের পায়ের আঙুলে চাপ পড়েছে বলেই তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আর অন্যদের বেলা সহজেই বিশ্বাস হয়।

বিরক্ত হয়ে চারণ বলল, আঃ পাটন। থামো এবারে। সে আছে না গেছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে তা জানতে আমার বিন্দুমাত্রই ঔৎসুক্য নেই। তুমিই একটি Myth তৈরি করলে অকারণ তাকে নিয়ে, আবার তুমিই তাকে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ-এর পাতার খবর করে দিলে।

তারপর বলল, তুমিই খুন টুন করো নি তো?

করতেও পারি। করলেও বা জানছে কে? দেবভূমির এই মস্ত সুবিধে। প্রতিমুহূর্তেই এখানে জন্ম হচ্ছে অগণ্য মানুষের, আক্ষরিকার্থে নয়, ভাবার্থে। তেমন প্রতিনিয়ত মৃত্যুও হচ্ছে। সবরকম মৃত্যু। তাই নিয়ে কেউ উল্লাসও করছে না আবার চোখের জলও ফেলছে না।

সব ব্যাপারেই তোমার এই দার্শনিকতা আমার ভাল লাগে না পাটন। তোমার এই ছদ্ম-দার্শনিকতা।

পাটন হেসে বলল, আমার দার্শনিকতাটা ছদ্ম নয়, যতটুকু পেয়েছি, মোটারই অশেষ দয়াতে। কিন্তু তুমি যে পেলে না কিছুই, তোমার আধার ভাল হওয়া সত্ত্বেও। হয়তো তেমন করে নিতেও চাওনি।

চমকে উঠে চারণ বলল, হয়তো তাই সত্যি! কিন্তু কেন বলো তো?

বললাম তো! পেতে চাওনি তাই। সময় হয়নি। জীবনে প্রতিটি ঘটিতব্য ঘটনারই একটি বিশেষ সময় থাকে। সেই সময় উপস্থিত না হলে কিছুই ঘটবে না। এইসব ঘটনা পেঁপে বা কলা পাকানো নয়, যে, কারবাইডের সাহায্যে তোমার ইচ্ছে মতন পাকাবে। সময়কে তার প্রাপ্য দিতেই হবে।

বলেই বলল, চারণদা, What will be, will be well, for what is is well, To take interest is well, and not to take interest shall be well.

চমকে উঠল চারণ। বলল, কার?

Walt Whitman, আমেরিকার রবীন্দ্রনাথ।

অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে চারণ বলল, হুঁ। সময়কে সময় না দিয়ে কোনও উপায়ই নেই। না দিলেও সে আদায় করে নেবে।

বলল, স্বগতোক্তিরই মতন।

হুঁ বলল, না ওঁ বলল ঠিক বুঝল না।

ওঁ শব্দটির মানে ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর থেকে মাঝে মাঝেই ওর এমনই নির্জনে ওঁ বলে উঠতে ইচ্ছা করছে। নিজের মনের নির্জনতা বোধ করলেই মানুষে নির্জন হতে পারে। তা বাসের মধ্যে বা ট্রেনের মধ্যে বা যেখানেই তিনি থাকুন না কেন! পাটনের নিরন্তর বুকনি না থাকলে বাসের মধ্যে বসেই ও হয়তো সেই নির্জনতা বোধ করত। কিন্তু তা কি হতে দেবে পাটন!

প্রথম-দুপুরে যাত্রীদের খাওয়ার সময়ে, সাহেবি লাঞ্চ-আওয়ারে নয়, বাসটা এসে দাঁড়াল রুদ্রপ্রয়াগে। তার আগে অলকানন্দার উপরের মস্ত ব্রিজ পেরিয়ে এসেছিল। এখান থেকে সোজা গেলে কেদারনাথের পথ চলে গেছে আর মন্দাকিনীর উপরের সেতু পেরিয়ে নদীর ওপারের পথ ধরে গেলে বদ্রীবিশাল। এইখানেই মন্দাকিনী আর অলকানন্দার সঙ্গম। সঙ্গমে যেতে হলে বাস যেখানে থামল সেখান থেকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।

সত্যি সত্যিই এসে পৌঁছল তাহলে! চারণ ভাবছিল, প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্নে আর কল্পনাতে অনেকই জায়গা থাকে। সেইসব জায়গাতে বোধহয় কোনওদিনও না যাওয়াই ভাল। গেলে, ইয়ারো ভিজিটেড-এর মতো স্বপ্ন ভঙ্গ হয় হয়তো। প্রেমেন্দ্র মিত্রর বিখ্যাত গল্প তেলেনিপোতা আবিষ্কারের মতন।

কিন্তু খুব একটা স্বপ্ন ভঙ্গ হল কি? নাঃ। যেমন পড়েছিল, যেমন ছবি দেখেছিল তার, তেমনই তো দেখছে। পঞ্চাশ ষাট বছর পরেও তো খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। জিম করবেট-এর ম্যান-ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ বইতেও নদীর উপরের সেই ঝুলন্ত লোহার ব্রিজটার ছবি দেখেছিল। যার স্তম্ভের উপরে জিম করবেট দুরাত কাটিয়েছিলেন চিতাটি যদি রাতে নদী পার হয়, তবে তখন তাকে মারবেন এই আশাতে। ওই সব নদীতে এতই বেগ এবং জল এতই হিমশীতল যে বেড়ালের মাসির মতো চামড়া-সচেতন প্রাণী চিতা, নদী সাঁতরে পেরুনোর চেষ্টাই করবে না তাই। অলিখিত কার্টু ঘোষিত হয়ে গেছিল পুরো এলাকাতে, বছরের পর বছর। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানের নীরবতা নেমে আসত তখন গাড়োয়ালের এই সব অঞ্চলে বছরের পর বছর ওই একটি মানুষ-খেকো চিতার ভয়ে।

ওদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা চলে গেল নীচে। সেখানে বাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। যাত্রীরা মধ্যাহ্নের খাওয়া সারবেন। যার যা অভিরুচি। রুটি, ফুলকা, সবজি, ডাল, কাড়হি, দই। যে যা ভালবাসেন। গরম চা। বোতলের পানীয়ও। থামস-আপ, ফান্টা, লিমকা, কোক ইত্যাদি।

বাসটা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই জায়গাটাকে যেন নির্জন বোঝাল। একপাশে, বাঁয়ে, খাড়া নেমে গেছে নীচে নদীপথ। মন্দাকিনী আর অলকানন্দা মিশে যাওয়ার পরে মন্দাকিনীর আর কোনও আলাদা অস্তিত্ব রইল না। অলকানন্দার নামেই তখন সে পরিচিত। আবার অলকানন্দা যখন দেবপ্রয়াগে গঙ্গার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হল তখন থেকে সেও লীন হয়ে গেল গঙ্গাতেই। হৃষীকেশ-এ পৌঁছে যখন সমতলে ছড়িয়ে গেল ভগীরথের মতে-আনীত গঙ্গা, তখন সে শুধু গঙ্গা বলেই পরিচিত হল।

একপাশে নদী আর অন্যপাশে একেবারে খাড়া পাহাড়। ওরা যেখানে নামল তার কাছেই পাহাড়ের গায়ে দুটি হোটেল আছে পরপর। তারওপরে আর্মির ক্যাম্প। ট্রান্সপোর্ট ডিপো। বাজারের দিকে নিশ্চয়ই অনেকই হোটেল, ধর্মশালা আর চট্টি আছে।

এরপর? এবারে কি?

গলার বোতামটা ঢিলে করে, মাফলারটা খুলে ফেলে চারণ জিগ্যেস করল তার লোকাল গার্জেন পাটনকে।

এখন হাওয়া আছে কিন্তু বাস চলাকালীন যেমন লাগছিল তেমন ঠাণ্ডা তো নেই। রোদ ঝকঝক করছে চারদিকে। নীল আকাশ, সবুজ নদী, গাঢ় সবুজ জঙ্গল। রোদের কুচি উড়ছে হাওয়াতে।

চারণ পা চালিয়ে বলল, এরপর আর একদিন তুমি আমার সাধুসঙ্গ পাবে। জাস্ট একটি দিন।

মানে?

মানে আর কী। একরাত তোমার সঙ্গে কাটিয়ে তোমার একটা গতি করে দিয়ে আমি চলে যাব।

অবাক হয়ে চারণ বলল, ব্যাপারটা কি? তোমাকে তো আমি আমার অগতির গতি হতে বলিনি। দেবপ্রয়াগ থেকে বেরোলে আমাকে ট্যাকে করে আর রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছেই Jettison করছ আমায়, তোমার এই হরক এর উদ্দেশ্যটা কি? আর তুমি যাবেটা কোথায়?

বদ্রীনাথ। সেখান থেকে আরও উপরে।

সেখানে কি?

দুধাহারীবাবা আছেন।

তাই?

হ্যাঁ। সারা শীতকালটাই উনি বরফের মধ্যে বসে সাধনা করেন।

সত্যি?

না তো কি মিথ্যা? শুধু উনিই কেন! কত সাধুসন্ত আছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সমতলের মানুষেরা তো দূরস্থান, আমরাই বা তাঁদের কজনকে চিনি। তাঁদের কজনেরই বা আশ্রম বা সংগঠন আছে? এমন সন্ন্যাসীও অনেক আছেন যাঁর একজনও চেলা নেই। তাঁরা স্বয়ম্ভু কিনা জানি না। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য, পানীয়, ভীতি, দয়ামায়া, ভক্তি এসব ব্যাতিরেকেই শীত গ্রীষ্মের বোধরহিত হয়েই একা একা বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ। সময়, Eternal time, জার্মান শেফার্ড ডগদেরই মতো বরফ মেখে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে এসে সেইসব সন্নিসীদের দুপায়ের উপরে মাথা নামিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে। আসল দেবভূমি তো ওইসব জায়গাতেই চারণদা! কেদারবদ্ৰী, গোমুখ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স তো তোমার মতো সাধারণ তীর্থযাত্রীদেরই জন্যে। কলকাতাতে ফিরে পাড়ার রকে আর শ্বশুরবাড়িতে হিরোগিরিতেই এইসব অধিকাংশ যাত্রীদেরই তীর্থযাত্রার সার্থকতা। এসবই বাহ্য। আগে চলো আর। আগে কহ আর।

তা তুমি কি পথেই দাঁড়িয়ে জ্ঞান বিতরণ করবে, না খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত কিছু করবে? রাতটা যেখানে কাটাবে বলে মনস্থ করেছ, সেই ডেরাতেই তো আস্তানা গাড়লে হয় দিনে দিনে। এখনই যা হাওয়া ছেড়েছে। রাতে তো মালুম দেবে।

হ্যাঁ, চলো। তাই তো যাচ্ছি। চলছি দেখছ না। দাঁড়িয়ে আছি, থোড়িই।

বলেই, পাটন একটু এগিয়ে গেল আমাকে নিয়ে। একটা বাঁক নিয়েই একটি চারতলা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। চারতলা বটে কিন্তু হোটেলটির আদৌ depth নেই। দিল্লির জনপথে জনপথ হোটেলের এক একটি উয়িং যেমন, সেরকম। লম্বা টানা বারান্দা আর তার সামনে পাশাপাশি ঘরের সারি।

সামনে গাড়ি রাখারও জায়গা আছে।

ম্যানেজার পাটনকে দেখেই দৌড়ে এল। চারণ বুঝল যে, পাটনের যাওয়া আসা আছে এখানে।

পাটন বলল, জয় বদ্রীবিশালজিকি।

অল্পবয়সী ম্যানেজারও বলল, জয় বদ্রীবিশালজিকি!

তারপরই গুরুমুখীতে বলল, উত্তে? ইয়া থল্লে?

পাটন আঙুল দিয়ে উপরে দেখিয়ে বলল, উত্তে। উত্তে।

ম্যানেজার আমাদের নিয়ে সিঁড়ি চড়তে লাগল। লাগল তো লাগলই। পাটন বলল, ঘর আর ফালি বারান্দাটুকু নিয়ে যতখানি জায়গা, হোটেলের depth-ও ততখানিই। ওইটুকু জায়গাও যে বের করেছে এই খাড়া পাহাড়ে এই যথেষ্ট। তবে আমাদের দেশের সমস্ত পাহাড়ি এলাকাতেই যেমন আনপ্ল্যানড, আনরেস্ট্রিক্টেড কনস্ট্রাকশন হয়ে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে, তাতে দেখবে, খেপে খেপে ধ্বস নেমে সব পাহাড়ি শহরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একদিন। টাউন-প্ল্যানিং-ট্যানিং, সুয়্যারেজ, পিলারিং এসবের বালাই নেই গত পঞ্চাশ বছর। এই তো সেদিনই ভূমিকম্প হয়ে গেল না যোশীমঠ থেকে শুরু করে সর্বত্র? তুমি যে হোটেলে ছিলে হৃষীকেশে, সেই হোটেলের লিফটটার অ্যালাইনমেন্ট পর্যন্ত নড়ে গেছে। উঠতে নামতে ঢকঢক শব্দ করে। লক্ষ করেছিলে চারণদা?

হুঁ।

চারণ বলল।

অথচ তুমি সুইটজারল্যান্ডে যাও, দেখবে ছবির মতন সব কিছু। তুমি গেছ নিশ্চয়ই?

গেছি একাধিকবার। কিন্তু আমাদের কুমায়ু আর গাড়োয়াল হিমালয়ের সঙ্গে সুইটজারল্যান্ডের তুলনা? শিবের সঙ্গে বাঁদরের? কোনও তুলনাই হয় না। ওদের ঘরবাড়ি পথ সবই ভাল হতে পারে কিন্তু এমন দেশ ওরা কোথায় পাবে। শুধু আমাদের দেশের নেতাগুলো যদি মানুষ হত!

পাটন বলল, সবে সিম্পটমস দেখা দিতে শুরু করেছে। প্রকৃতিকে বহু হাজার বছর ধরে ধর্ষণ করছি আমরা। প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নিতে শুরু করবে তখন…।

চারণ বলল, শেষে সে দিন ভয়ঙ্কর।

ঠিক তাই।

এই হোটেলের মালিক কিন্তু সাহারানপুরের মানুষ। বুঝলে চারণদা। উত্তরপ্রদেশীয়। ম্যানেজার যদিও পাঞ্জাবি। এদের মস্ত বড় দুগ্ধজাত সামগ্রীর কারখানা আছে সাহারানপুরে। পাউডার মিল্ক, কনডেনসড মিল্ক, ঘি, আচার, রুটি ইত্যাদি নানা কিছু তৈরি হয়। মালিক মার্সিডিস গাড়ি নিয়ে বছরে একবার আসেন শ্বশুর শাশুড়ি এবং স্ত্রীকে নিয়ে। বদ্রীনাথ কেদারনাথ যেতে এখানে পথে থাকতে অসুবিধে হত আগে আগে, তাই এখানে এই হোটেলটিই বানিয়ে রেখেছেন।

বাঃ। আমার একজন এমন জামাই থাকলে বেশ হত।

বে-থা করো। বউই আগে আসুক। তারপরে তো মেয়ে জামাই। গাছে না উঠতেই এক কাঁদির আশা?

যে-ঘরটিতে ওদের নিয়ে ওঠাল ম্যানেজার সেটি ছোট হলেও cosy। অ্যাটাচড বাথও আছে।

আরেকটা ঘর লাগবে, চারণ বলল।

ম্যানেজার বলল, দোনো একসাথমে নেহি রহিয়ে গা? ঠিক হ্যায়। বগলওয়ালা কামরাভি খুল দে রহা হ্যায়।

পাটন বাংলাতে বলল, কেন বাবা! তুমি কি বাবুকে হোমো ঠাওরালে নাকি?

হেসে ফেলল চারণ। কিন্তু আশ্বস্তও হল। অন্য কারও সঙ্গেই একঘরে শোওয়ার অভ্যেস ওর ছিল না। রাতের ঘুম এবং বিশ্রাম ব্যাপারটা এতই ব্যক্তিগত এবং নিভৃত যে, তাতে প্রিয়তম বন্ধুকে নিয়েও একঘরে শোওয়া অসম্ভব। বান্ধবী হলে কি করত জানে না অবশ্য। তবে সে সব কল্পনাতেই ছিল। কখনও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখিনি। শোওয়ার সময়ে একা ঘরই ভাল। বেশ কিছুদিন তো দেবপ্রয়াগে ভোলানন্দজির গুহাতে অতজনের সঙ্গে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েই কাটল। তখন কিন্তু কোনও অসুবিধা হয়নি। যেখানে বাহুল্য করা যায় সেখানে কম-সম করার অভ্যেস চারণের নেই। যেখানে বাহুল্যবর্জন অবশ্যকর্তব্য সেখানে বর্জন করতে আপত্তি নেই।

পাটন পাশের ঘরটিও খুলিয়ে দুটি ঘর থেকেই চেয়ার বের করে বারান্দাতে পাতাল। রোদ এসে পড়েছে বারান্দাতে। সামনে সোজা দেখা যাচ্ছে অলকানন্দার ওপরের প্রায় আকাশছোঁয়া পাহাড়। তার মাঝে মাঝে গাছগাছালি, বস্তি। ওইটিই কি রুদ্রপ্রয়াগের মূল বস্তী? কে জানে। গৃহপালিত গাছগাছালির ভিড়ে বাড়ি ঘর তেমন দেখা যাচ্ছে না কিন্তু লোকজন যে যাতায়াত করছে তা উঁচু পাহাড়ের ridge-এর উপরে গাছগাছালির ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

কি দেখছ?

ওখানে গ্রাম আছে।

অত উঁচু পাহাড়ের উপরে?

নিশ্চয়ই! হাসালে তুমি বঙ্গনন্দন। তিব্বতেও কি ঘর বাড়ি নেই? আর এ-তো রুদ্রপ্রয়াগ। কেদারনাথ বদ্রীনাথ হলেও না হয় কথা ছিল।

অত উপরে, মানুষে যায় কি করে! থাকে কি করে!

ওরা যে পাহাড়ি। পাহাড়িরা পাহাড়ে থাকবে না। ওদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ তো থাকবেই। তা ছাড়া, মানুষে যখন চাঁদ এবং সমুদ্রর নীচে থাকার তোড়জোড় করছে তখন পর্বতের উপরে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

তবু ভারী কষ্ট ওদের! অবশ্যই।

কেন?

বাজার দোকান করতেও যদি বান্দরপুঞ্জে উঠতে আর সেখান থেকে নামতে হয়, তবে কষ্ট হবে না!

পাটন ঐ গ্রামের বাসিন্দাদের কষ্ট কল্পনা করে সহানুভূতি দেখাল।

আমাদের কাছে যেটা কষ্ট সেটাই হয়তো ওদের কাছে আনন্দ। তাছাড়া চারণদা, শৃঙ্গ বলতেই তোমার শুধু বান্দরপুঞ্ছ-এর কথাই বা মনে হল কেন? চন্দ্রবদনীও তো শৃঙ্গ। মানুষ চন্দ্রবদনীর মুখটি একবার মনে করলে তো আমি নাঙ্গা হয়েই নাঙ্গপর্বতে চড়ে যেতে পারি।

তোমার কথা আলাদা। তুমি পবনপুত্র মারুতি।

চারণ হেসে বলল।

ম্যানেজারকে বেল বাজিয়ে ডেকে এনে কষে খাবার অর্ডার করল চারণ। বলল, ঠিক দুটোর সময় এখানেই পাঠাবে। আমরা রোদে বসে খাব।

চারণ বলল, এ কি মামাবাড়ির আবদার নাকি? তোমার পুরী, কাড়হি, রাজমা-তড়কা, পালক–পনীর, ক্ষীর, হরিমির্চ, পেঁয়াজরসুন গাজর এত সব বয়ে আনতে চারতলাতে তো খচ্চর লাগবে।

পাটন ম্যানেজারের দুচোখে তার দুচোখ রেখে মুখ একটুও না ঘুরিয়ে বলল, তোমার কি ধারণা এ খচ্চর নয়? না, এর মালিক খচ্চর নয়?

তারপরই বলল, সত্যি চারণদা! ভেবে দেখো! জীবজগতে এত ভাল ভাল জানোয়ার থাকতে এই মানুষ হারামজাদারা সবচেয়ে বেশি emulate করল খচ্চরকেই। মানুষের মধ্যে তুমি যত সংখ্যক ছুপা-খচ্চর পাবে তার একাংশও পাবে না বাঘ বা সিংহ তো দূরস্থান, বাঁদর হনুমানে পর্যন্তও। হিন্দুস্থান ক্রমশ খচ্চরেরই আস্তানা হয়ে উঠছে।

আবারও চারণ হেসে উঠল জোরে চারণের কথাতে যতটা নয়, বলার ভঙ্গিতে।

ম্যানেজার কি করবে, না বুঝতে পেরে, প্রয়োজনে বেল বাজাবেন বলে, নীচে নেমে গেল।

মোটার গুহাতে চামচিকের মতন থেকে থেকে না-খেয়ে না-দেয়ে আমার সাত কেজি ওজন কমে গেছে। তা ছাড়া আমি খুব কেয়ারফুলি হিসেব করে দেখেছি চারণদা যে, মানুষের জ্ঞান অ্যাবিথমেটিকাল প্রোগ্রেসানে বাড়লে, মানুষের ওজন জিওমেট্রিকাল প্রোগ্রেসান কমে।

চারণ আবার হেসে উঠল ওর কথায়!

পাটন যে একটি ওরিজিনাল মানুষ, তার যে একটিও পোটোটাইপ নেই এই দুনিয়াতে, সে বিষয়ে চারণ অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। যতই দেখছে ওকে, ততই পাটনের চরিত্রের আনপ্রেডিটেবিলিটিতে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে।

চারণ বলল, এবার হাত মুখ ধুয়ে এসো। একটা জিনিসকে প্রসাদ করে দাও। স্বাদও ভুলে গেছি গো দাদা। আমি যদি আরও কিছুদিন এমন সব্বো-বিষয়ে বমবোচ্য পালন করি, তো হয় পাগল হয়ে যাব, নয়তো আমার অণ্ডকোষদ্বয় মস্তিষ্ক ভেদ করে ব্রহ্মলোককে বিদ্ধ করবে। অকারণে এতরকম কৃচ্ছ্রসাধনের কোনও মানেই হয় না। ধুসসস্।

ছিঃ। তোমার মুখ তো নয়, আস্তাকুঁড় পাটন।

চারণ বলল।

পাটন বলল, ওঁ।

বলেই, নিজের ঘরে চলে গেল।

চারণও ওর ঘরে গেল হাত মুখ ধুতে।

একটু পরেই পাটন চারণের ঘরের বন্ধ দরজাতে নক করল।

দরজা খুলতেই চারণ দেখল পাটনের হাতে একটি প্যাকেট। চারণের হাতে দিয়ে বলল, সাহেবরা। যদিও বলে, স্কচ আফটার সান ডাউন কিন্তু এই দেবভূমিতে অন্য নিয়ম। দিল্লি থেকে আনিয়েছি। এখন তো দেশেই হচ্ছে। ব্ল্যাক-ডগ। শালা স্বাদই ভুলে গেছি। লাগাতার ধর্মঘট তাও সহ্য করা যায়, বসা-ধর্মঘট, শোওয়া-ধর্মঘট, দাঁড়ানোধর্মঘট ইজি-চেয়ারে আধশোয়াধর্মঘট কিন্তু লাগাতার সাধুগিরি অসাধুদের পক্ষে হাইলি-ডেঞ্জারাস এক্সারসাইজ।

তা হোক। এক্সারসাইজ ইন ফিউটিলিটি না হলেই হল। চারণ বলল।

তার মানে? তুমি খাবে না বলছ?

বিশ্বাস করো পাটন, না খেয়ে দারুণ আছি। ছাড়াটা যে কত কঠিন তা তুমি জানো কি না জানি কিন্তু আমি জানি। আবার ধরাটা খুবই সোজা। কিন্তু…

পাটন বলল, তুমি একটা যা তা! এতটুকু উইল-পাওয়ার নেই তোমার! আর তুমি সাধুসঙ্গ করতে এসেছিলে এখানে! তুমি বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে বড় হতে পারো কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছে এই অধম পাটন, মনে রেখো সবসময়ে।

কি?

যার উইল-পাওয়ার নেই তার সাধুসঙ্গ তো দূরস্থান নারীসঙ্গও কপালে নেই। আগে নিজের মালিক হও তারপর দ্যুলোক-ভূলোক জয় করবে। নাও। আর বেশি বাতেল্লা কোরো না, একটা বড় করে ঢেলে দিচ্ছি। নীট খাও। বেড়ে ঠাণ্ডা আছে। খাবার আগে আরও একটা করে মারব। আব বাকিটা রাতে।

চারণ চুপ করে রইল।

পাটন বড় যত্ন করে বানাল, যেমন যত্ন করে ভোলানন্দজিকে গাঁজা বানিয়ে দিত, তারপব। আগেকার দিনের জমিদারের খাস বেয়ারারা যেমন বাঁ হাতের পাঁচ আঙুল ডান হাতের কনুইয়ের গোড়াতে ঠেকিয়ে পরম বিনয়ের সঙ্গে ডান হাতে ধরে গড়গড়ার আলবোলা বা হুইস্কির গেলাস মনিবের দিকে তুলে দিত ঠিক তেমনি করে চারণের দিকে গ্লাসটি এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও, একটু প্রসাদ করে দাও। তোমার এঁটোটা আমি নেব, অন্য গেলাসটা তুমি নাও।

পাটন বলল, বারান্দাতে তো গ্রিল বা রেলিং নেই, সিমেন্ট বাঁধানো পথ থেকে কেউই দেখতে পাবে না। পেলেও ভাববে, তুলসীপাতা আদা, মকরধ্বজের সঙ্গে মধু দিয়ে খুলনোড়াতে মেরে খাচ্ছি। কেউ সন্দ করবে না।

একটা ঈগল উড়ছিল ঘুরে ঘুরে নীল আকাশে। অনেক উপরে। তার শ্যেনদৃষ্টিতে কী যে খুঁজছে তা সেই জানে। সাপ, ইঁদুর, কাকার এর বাচ্চা?

তার ছায়াটাও ঘুরছে সঙ্গে সঙ্গে উপত্যকায়, নদীর বুকে।

পাটন এক চুমুকে আধ পেগ নীট ব্ল্যাক-ডগ গিলে ফেলে বলল, বুঝলে চারণদা। ফর আ চেঞ্জ, আজকে আমরা ভোগী। কাল থেকে ফিন যোগী।

চারণ কিছুই না বলে পাটনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। রুদ্রপ্রয়াগের সেই উজ্জ্বল, রৌদ্রস্নাত, crisp দুপুরটিতে উঁচু পাহাড়ের পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া অলকানন্দার দিকে চেয়ে মস্তিষ্কে, ব্ল্যাক-ডগ-এর নেশার সঙ্গে আরও অনেক কিছু বয়ে নিয়ে এলজিম করবেট-এর মানুষখেকো চিতা, হেমিংওয়ে আর ওয়াল্ট হুইটম্যান আর রবার্ট ফ্রস্ট-এর লেখাও।

চারণ বলল, হেমিংওয়ের একটি লেখা আছে A very well lighted place পড়েছ?

নাঃ। Men without women পড়েছি।

তারপর বলল, তুমি বুঝি Hemingway-এর খুব ভক্ত।

চারণ নড করল। বলল শুধু Hemingwayরই নয়, Whitman, Robert Frost, Jim Corbett, Che Guevara, চারু মজুমদার ইত্যাদি সকলেরই। যাঁরাই মাটি ছেনেছেন, অথবা ফোঁটা কার্তুজের গন্ধ নিয়েছেন নাকে, তাঁদের সকলেরই ভক্ত আমি।

ভাল।

জিম করবেট মানুষখেকো চিতাটাকে এই সামনের পথের উপরেই মেরেছিলেন একটা ঝুপড়ি আমগাছের নীচে। কেউ কি বলতে পারবে জায়গাটা ঠিক কোথায়?

কারও বলার দরকার নেই। একটা সাইনবোর্ড আছে। অখাদ্য ছবিও আছে একটা চিতাবাঘের। আব লেখা আছে যে এইখানেই দ্রুতপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাকে পটকে দিয়েছিলেন করবেট।

অখাদ্য বলছ কেন? চিতা কি খাদ্য?

না সে জন্যে নয়। কলকাতা হলে চিতার ছবিটা এমন হলুদ রঙা খাটাশের মতন হত না অন্তত। কলকাতার দোষের শেষ নেই কিন্তু গুণও কিছু আছে। এটাও তো একটা Shrine। অথচ কী অযত্ন! আমার তো মনে হয় জিম করবেট এই অঙ্কন কর্মটা দেখার পরই ভারত ছেড়ে যাবার সঙ্কল্প করেছিলেন।

চারণ বলল, তবুও বলব যে, জিম করবেট ভাগ্যবান।

কেন? চারণ শুধোল।

আমি এখানে আসার কিছুদিন আগে বিখ্যাত কবি শান্ত চট্টোপাধ্যায় কলকাতাতে মারা গেলেন। তাঁর শোকসভাতে বামপন্থী চিত্রী পরাণ পাধী তাঁর একটা ছবি এঁকেছিলেন। সেই মস্ত ছবিটি সামনে বেখেই শোকসভা হল। কিন্তু কী বলব! সেই ছবির সঙ্গে শান্তবাবুর উলটোদিকের বাড়ির উত্তমর্ণ গগন দাড়িপার চেহারার মিল ছিল কিন্তু তার, নিজের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। তার ছেলেবেলার কৈশোরের বা যৌবনের চেহারারও নয়। তা আমি পরাণ পাধী মশায়কে ভাল করে চিনতাম। ওঁকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পাধীদা, এই ছবিটি শান্তবাবুর কোন বয়সের ছবি?

পরাণ পাধী আমার দিকে ঘৃণা ভরে একটু তাকিয়ে বললেন, এটা চিরকালীন শান্তর ছবি।

কেন? চারণ বলল।

ছবিটা দেখে যদি মৃত ব্যক্তি বলে চেনাই না গেল তবে সেই ছবি দিয়ে শোকসভা করা হল কেন? ফোটো দিয়েও তো করা যেত!!

করা হল, কারণ পাধীদা আর আমাদের পাড়ার গেঁড়েদা কখনওই ভুল করেন না। করতে পারেনই না। তাঁদের একসপ্লানেশানেরও কোনওদিন ঘাটতি বা সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় বললে বলতে হয় খামতি হয় না। দে আর অলওয়েজ রাইট। এতএব রুদ্রপ্রয়াগের চিতার ওই চিরকালীন ছবিটিই তোমাকে মেনে নিতে হবে।

হুঁ।

চারণ বলল।

নাও শেষ কর।

পাটন আদেশ করল।

চারণ বড় এক ঢোঁক খেল।

বলল, আমি আস্তে আস্তেই খাই।

তা ভাল। মানে ধীর-স্থির হওয়াটা গুণেরই কথা কিন্তু তা বলে চিরকালীন শান্ত চ্যাটার্জির ছবির মতন ধীর হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বেশি আস্তে করতে গেলে অনেক সময়ে গা গরম করতে কবতে বিবিই পাইল্যে যাবে।

উঃ পাটন!

আমি খুবই মুখ খারাপ করি, না চারণদা?

পাটন বলল।

চারণ চুপ করে রইল।

পাটন বলল, আমি কিন্তু শুধু মুখই খারাপ করি। তোমার মতো খারাপ কাজ কিন্তু আমি কখনওই করতে পারব না।

কি খারাপ কাজ?

চারণ ভ্রূ কুঞ্চন করে তাকাল পাটনের দিকে।

তারপর আবারও বলল, কি খারাপ কাজ?

পাটন এবারে এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে বড় একটা, প্রায় পাতিয়ালা ঢালল ওর গ্লাসে। তারপর ছিপিটা বন্ধ করে চারণকে বলল, ঊ্য মে টেক ইওর ওন টাইম। বাট আই লাইক টু গাল্প ডাউন মাইন।

চারণ বলল, বললে না কি খারাপ কাজ?

পাটন তার সদ্য ঢালা হুইস্কিতে একটি বড় চুমুক দিয়ে বলল, কিছু কথা থাকে চারণদা যা বাংলাতে মানে মাতৃভাষাতে বলতে ভারী লজ্জা করে। বিশেষ করে কথাটা যখন, মাতৃসংক্রান্তই। মানে, নিজের মা সংক্রান্ত।

কার মা?

চারণ অবাক হয়ে বলল।

আমার মা।

পাটন বলল।

কি বলছ তুমি, আমি বুঝতে পারছি না পাটন।

পারবে। বললেই পারবে।

স্থির, নিষ্কম্প গলাতে বলল পাটন।

কি?

চারণের জিভ জড়িয়ে গেল। হুইস্কির জন্যে না পাটনের চোখের দৃষ্টির জন্যে তা নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না।

পাটন বলল, উ্য ফাকড মাই মাদার।

চারণ সর্পদ্রংষ্টর মতন চমকে উঠল।

পাটন বলল, ডিড নট উ্য? চারণদা?

চারণ চুপ করে রইল।

পাটন বলল, বাখরাবাদে, কটকে আমার মামাবাড়িতে? অবশ্য আমার মা চেয়েছিলেন। শী ওজ ডাইং ফর ইট। অ্যান আটারলি সেক্সস্টার্ভড লেডি। আমার হারামজাদা অর্থপিশাচ বাবার বয়স তখন বাহান্ন, মায়ের বত্রিশ, আর তোমার, কত হবে তখন? তুমিই জানো। আমার বারো। আমি পাশের ঘরে তখন জেগেই ছিলাম।

চারণের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল।

পাটন গ্লাসটা শেষ করে বলল, ওকি! তুমি শেষ করে চারণদা। চিয়ার্স।

তারপর গলা নামিয়ে বলল, আই থ্যাঙ্ক য়ু অন বিহাফ অব মাই মাদার। মাই পুওর মাদার। একমাত্র তোমার কাছ থেকেই সেই মানুষটা যতটুকু আনন্দ পাবার তা পেয়েছিল জীবনে। শী ইজ। ডেড অ্যান্ড গান। আমি ছাড়া এই কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে তোমাকে তেমন তো কেউই আর নেই! আমি, মানে আই অ্যাম ডিপলি গ্রেটফুল টু ড্য চারণদা ফর হোয়াট উ্য গেভ হার।

চারণ কিছু বলতে গেল। এ এক অন্য চারণ।

তুতলে বলল, তোমার বাবা কি জানেন? মানে জানতেন?

না। তবে সন্দেহ করত। জানলে, মানে শিওর হলে, তোমার লাশ কবে পড়ে যেত। তুমি আমার বাবাকে চেনো না চারণদা, আমি চিনি। আই নো দ্যাট বাস্টার্ড।

চারণ-এর খালি-হওয়া গ্লাসে বোতল থেকে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে পাটন বলল, নাও, খাও।

চারণ বলল, মুখ নিচু করে, তোমার বাবা না জানতে পারেন, তুমি তো জানো পাটন। তুমি কি আমাকে শাস্তি দেবার জন্যেই এখানে নিয়ে এসেছ?

তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, শাস্তি দেওয়ার জন্যে এতদূরে আনলে কেন? দেবপ্রয়াগেই তো উপর থেকে নদীতে ঠেলে ফেলে দিতে পারতে।

হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি তো শাস্তি দিতে আনিনি তোমাকে। পুরস্কার দিতেই এনেছি। ব্ল্যাক-ডগ এর বোতল তাহলে নিয়ে আসব কেন এখানে?

পুরস্কার?

স্তম্ভিত হয়ে বলল চারণ।

প্রিসাইসলি! তারপরেই হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল পাটন।

চারণের মনে হল ও এক উন্মাদের খপ্পরে পড়েছে। বড় ভয় করতে লাগল চারণের। অনেক এবং সব পুরনো কথাই মনে পড়ে যেতে লাগল একে একে।

চারণ পাটনের মুখের দিকে চেয়ে তাকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল।

ওকি আজই খুন করবে চারণকে?

পাটন, আবার হাসল। বলল, হুইস্কিটা কিন্তু ভাল। কি বল? দাম করেছে অবশ্য একটু বেশিই। বারোশ পঞ্চাশ। বুট-লেগাবের কাছ থেকে নিলে সাড়ে সাতশোতেই পাওয়া যেত। বাট জেনুইন স্টাফ। হাউ ক্যান আই বী আ মাইজাব হোয়েন আই অ্যাম গিভিং আ ট্রিট টু দ্য গ্রেট ওয়ান হু ফাকড মাই মাদার? এটুকু বলেই, আবার হাসল পাটন।

চারণের বুকের মধ্যে কষ্ট হতে লাগল। ভীষণই কষ্ট। মুখটা নামিয়ে নিল ও।

পাটন বলল, তোমাকে জল মিশিয়ে দেব কি চারণদা? না, নীটই খাও। উ্য নীড ইট নাউ। জীবনও এমন করেই খাবে। Drink it to the lees তলানি পর্যন্ত খাবে। Ulysses-এর মতন। জীবনে অথবা হুইস্কিতে জল মেশায় Half-wits বা।

তারপর বলল, দ্যাখো, দুজন প্রাপ্তবয়স্কর মধ্যে কোনও ঘটনা একদিন ঘটেছিল। একবার নয়, একাধিকবার। কয়েক বছর ধরে। তাতে মাইনব পাটনের কিছু বলার অধিকার অথবা প্রয়োজনও ছিল না। ইট মাইট হ্যাভ বীন এন এপিসোেড অফ স্প্যারোজ। অর ফর দ্যাট ম্যাটার, অফ লায়নস। আই কুড নট কেয়ার লেস। আমি আমার মাকে খুব ভালবাসতাম চারণদা। পরে, কলকাতাতে তুমি এলে, তুমি আমাদের বাড়ি, একবার এলে, তুমি মায়ের সঙ্গে শুলে, মা কতদিন যে কী আনন্দে থাকত, তা তুমি জানো না! দেখেই আমার ভাল লাগত খুব। বিশ্বাস কর তুমি। আই রিয্যালি অ্যাম গ্রেটফুল টু উ্য। সারাজীবনই কৃতজ্ঞ থাকব।

চারণ স্তম্ভিত হয়ে পাটনের মুখে চেয়েছিল।

পাটন বলল, কি হল? এতদিনেও আমাকে চিনতে পারলে না চারণদা! আমি, আমি। আমি পাটন। আমি অন্য কেউই যে নই! আত্মানং বিদ্ধি। নিজেকে জানতেই তো এসেছি এখানে চারণদা। আমি নিজেকে এখনও পুরোপুরি জানিনি। তবে মনে হচ্ছে, জানছি আস্তে আস্তে। তুমি জানবে না নিজেকে? নিজের ভিতরের নিজেকে?

চারণ পাটনের দিকে স্তব্ধ, মুগ্ধ চোখে চেয়েছিল। লজ্জা করছিল খুব। অপরাধবোধে ভরে যাচ্ছিল, কিন্তু পাটন তাকে…

চারণের মাথার মধ্যে Walt Whitman কথা বলছিলেন।

He puts things in their atitudes.
He puts to-day out of himself with plasticity and love.
He places his own times, reminiscenses, parents, brothers and sisters, associations, employment, politics, so that the rest never share them afterward, nor assume to command them

ভাবছিল, আশ্চর্য ছেলে এই চারণ! জিনস পরা, গাঁজা-গুলি-খাওয়া, মদ-খাওয়া বকা-ছোকরা হলেও ওই অনেক সন্ত-এর চেয়ে বড় সন্ত। অনেক তপস্যালব্ধ ফলই ও হয়তো সঙ্গে করেই জন্মেছে, ঈশ্বরের দান হিসেবে। অনেক গায়ক-হতে-চাওয়া মানুষ যেমন দশজন শিক্ষক রেখেও, হারমনিয়ম ভেঙে ফেলেও গলাতে সুর লাগাতে পারেন না, টপ্পার দানা গজাতে পারেন না আবার অনেক আনপড়ও যখন স্বরগম বলেন তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শ্রোতার, স্বরবিদ্ধ হয়ে যান তৎক্ষণাৎ, এও বোধ হয় তেমনই কোনও দৈবী ঘটনা। পাটন জন্ম-সাধক। সাধক হওয়ার জন্যে ওকে কোনও সাধনাই হয়তো করতে হত না। ভোলানন্দজি তাঁকে নিশ্চয়ই সম্যক বুঝেছেন। নইলে এই বাঁদরকে এত প্রশ্রয় দেন কেন? ওঁর মতন মানুষ!

চারণ চুপ করে সামনের ছড়িয়ে-যাওয়া নীল সবুজ-জলের অলকানন্দা আর আকাশ-ছোঁওয়া শিবালিক পর্বতমালার কাছিম-পেঠা পাহাড়টির দিকে চেয়েছিল। পাটনও চুপ করেই ছিল।

বুকের মধ্যে যখন অনেক কথা টগবগ করে, উথলে-ওঠা ভাতের ফ্যান-এর মতন, তখন বোধ হয় মুখ, কারও মুখই, কোনও কথাই বলতে চায় না।

ঈগলটা উড়ছে, উড়ছে, উড়ছেই তার নিঃশব্দ ঘূর্ণায়মান ছায়াটিকে একবার নদীর জল আরেকবাব পাহাড়ের রোমশ সবুজ গায়ে বুলিয়ে, বুলিয়ে, বুলিয়ে উড়ছে।

একটু পরে পাটন বলল, আরেকটা খাবে?

চারণ নিরুত্তর রইল।

খাও, খাও। আধ বোতল রাখব রাতের জন্যে। কাল আমাকে খুব ভোরে উঠতে হবে তো। বদ্রীনাথের প্রথম বাস-এই আমি চলে যাব।

আর আমি?

তুমি এখানে থাকবে।

মানে? তাহলে তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?

আমি থোড়াই এনেছি চারণদা। কে কাকে কোথায় আনে, কেই বা পাঠায়? সবই Predestined

অন্যসময় হলে চারণ বলত পাটনকে, সব ব্যাপারে তোমার এই ছদ্ম-দার্শনিকতা ভাল লাগে না। কিন্তু আজ আর সে কথা বলতে পারল না। পারল না, কারণ এই মুহূর্তে চারণের মতন এতখানি আর কেউই জানে না যে, পাটন ছদ্ম-দার্শনিক নয়।

পাটনই বলল, তুমি ভাগ্যবান মানুষ। বড় মাপের মানুষ। তুমি কোন দুঃখে যাবে কারও কাছে? মহম্মদের কাছে পর্বতই হেঁটে আসবে।

ঠাট্টা করছ পাটন?

ঠাট্টা? তোমাকে?

তারপর বলল, তুমি আমাকে একটুও বুঝতে পারেনি চারণদা। তুমিই আমার আইডল ছিলে প্রথম কৈশোর থেকে। তোমাকে আমি সত্যি অ্যাডমায়ার করি, করেছি চিরদিন। এবং বিশ্বাস করো, আজও করি। সকলের চোখ সমান নয়। আর কে যে কার মধ্যে কি দেখে তা শুধু সেই জানে। যেমন ভোলানন্দজি আমার মধ্যে দেখেছেন। নইলে হৃষীকেশ থেকে তোমাকে টেনে প্রথমে দেবপ্রয়াগে এবং পরে এখানে আনলাম কেন? বলো? আবার যেমন আমার মা তোমার মধ্যে দেখেছিলেন! কে যে কার মধ্যে কী দেখে তা অন্যের পক্ষে বোঝা কি সম্ভব?

চারণ চুপ করে চেয়ে রইল পাটনের চোখে।

তারপর বলল, তোমাকে আমারও কিছু বলার ছিল পাটন।

বলবে। তাড়া কি? বিতর্কমূলক বিষয়ের চিঠি যেমন লেখার পরে দুতিনদিন ড্রয়ারে ফেলেরাখতে হয়, বিতর্কমূলক কথাও জিভের গোড়াতে ধরে রাখতে হয়। জ্যা-মুক্ত তীর আর মুখ-মুক্ত কথা একবার বেরিয়ে গেলে আর তো ফিরে আসে না। তাড়া কি চারণদা? আমি ক্রিসমাস-এর আগেই ফিরে আসব।

হিন্দুদের ধর্মস্থান এই দেবভূমিতে বসে ক্রিসমাস শব্দটা কানে লাগল খট করে। অথচ কলকাতাতে কেউ ক্রিসমাস বললে একটুও বেমানান লাগত না।

ক্রিসমাসের আগে আমি নিজে কোথায় থাকব তার ঠিক কি? তুমি খুঁজে পাবে কি করে?

সব ঠিক আছে। মন যদি চায় তবে দেখা হবেই।

কী যে হেঁয়ালি কর সবসময়ে বুঝি না।

জীবনটাই তো হেঁয়ালি চারণদা। হেঁয়ালিটাই জীবন।

পাটন চেয়ার ছেড়ে উঠে কলিংবেল টিপল। একজন বেয়ারা প্রায় উড়ে এল বলতে গেলে চারতলাতে। বলল, বলিয়ে বাবু।

পাটন বলল, খানা বন গ্যয়া হোগা তো থোড়া বাদমে লেতে আনা। ঔর শুনো, ইয়ে সাবকা রোটি বহুতই হালকা ঔর কড়ক হোগা।

রোটি খাইয়েগা আপলোগোনে দোপেরহমে?

চাউল ভি খায়েঙ্গে। রোটি স্রেফ দো-দোহি করকে লানা। ম্যানেজার সাবকি বাতানা যো বরাদি সব চিজে বেশ পেশ করনা। উরতকি ডালকি তড়কা বনা তো? নেহি কোঈ দুসরি ডালকি?

বলেই বলল, দহি হোগা?

হানজি। হোগা জি!

তো দহিভি লেতে আনা।

চারণ বলল, হুইস্কির পরে দই! আমার অম্বল হবে। আমি খাবো না।

সত্যি। এই বাঙালি জাতটাকে বাঘে বা কুমীরে বা আলস্যেও খেতে পারল না কিন্তু স্রেফ অম্বলেই খেল। সকালে উঠে একটা সিঙ্গাড়া আর দুটি জিলিপি খেয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে ফেলো, ব্যাস। সারাদিন আর খাবার খরচ নেই। অম্বলেই পেট ভর্তি হয়ে থাকবে। দেখো না, ভেকধরা সন্নিসীগুলো কেমন মুঠো-মুঠো জেলুসেল এম পি এস খায়? আমি হলে কপিরাইটারকে বলতাম, আপ সামুচ সন্ত বননে চাহতা তত জেলুসেল এম পি এস ইস্তেমাল কিজিয়ে! দুনিয়াকি সবসে পুণ দাঁবাইয়া।

চারণ হাসল। কিন্তু কথা বলল না কোনও।

আজ পাটনেরই দিন, তারই ইনিংস। স্ট্রেইট ব্যাটে ব্লক করবে, না কাট করবে, না গ্ল্যান্স করবে না হুক করবে এ সমস্ত ওরই ডিসিশান। ওর একার। চারণ প্যাভিলিয়নে প্যাড পরে বসে আছে, বসে থাকবে, আর হাততালি দেবে।

পাটন বলল, দুপুরের আগে দই অমৃত। পরে বিষ। তবে থাক। নাই বা খেলে তুমি যদি ইচ্ছে করে।

তারপর বেয়ারার দিকে ফিরে বলল, একহি লানা দহি।

জি হাঁ।

বেয়ারা চলে গেলে পাটন বলল, আমাদের অবস্থা যেন উপোসী ছারপোকার মতন। না খেয়ে খেয়ে যখন পেটের সাইজ ছোট হয়ে গেছে তখন হঠাৎ করে এরকম গাণ্ডে-পিণ্ডে Cat-jumping rice খাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

CAT JUMPING RICE মানে কী? চারণ শুধোল।

মানে, থালাতে এই পরিমাণ ভাত থাকবে, পাহাড় প্রমাণ, যে বেড়ালও লাফ দিয়ে ডিঙ্গোতে পারবে না। তাকেই বলে Cat Jumping Rice।

চারণ হেসে ফেলল পাটনের কথা শুনে। হাসতে যে পারল, স্বাভাবিক মানুষের মতন, সেটা উপলব্ধি করে খুশি হল খুব। অবচেতনে ভেবেছিল, ওর চোয়াল বুঝি চিরদিনেরই মতো বন্ধ করে দেবে পাটনের ওই কথা। হাসি তো দূরস্থান, কথা যে বলতে পারবে তাই সাহস করে ভাবতে পারেনি।

পাটন বলল, খাওয়া-দাওয়ার পর আমি কিন্তু ঘুম লাগাব চারণদা। তুমি ইচ্ছে করলে জিম করবেট যেখানে চিতাটি মেরেছিলেন সে জায়গাটি এবং সেই দুর্দান্ত Art Workটি দেখে আসতে পারে। নইলে, হেঁটে নীচে নেমে যেতে পারো অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম দেখতে। সেই লোহার ঝুলোনো সেতু, যার কথা Man Eating Leopard of Rudraprayag-এ আছে, তুমি বলে ছিলে, তাও দেখে আসতে পারো। তবে দেবপ্রয়াগের মতন নয় এই সঙ্গম। দেখে মন ভরবে না।

বলেই বলল, সঙ্গম মানেই সুদৃশ্য। দেখাশুনোর তুমি আমার চেয়ে ভাল বুঝবে।

বলেই, এক কলি গেয়ে উঠল,

তেরে মনকা গঙ্গা/আর মেরে মনকা যমুনা কা।
বোল রাধে বোল/সঙ্গম হোগা কি নেহি/সঙ্গম হোগা কি নেহি?

.

উত্তর দিকটা, যে দিকে হবে বলে অনুমান করেছিল হাওয়াটা সম্ভবত সেদিক দিয়ে আসছিল না। যেদিকে গৌরীর ছাই মাখা, ত্রিশূল হাতে, বাঘছাল পরা সিদ্ধিসেবন করা উড়িয়াল স্বামীর বাস সেই দিকটা চারণ রাতে যেদিকে মাথা দিয়ে শুনেছিল তার ঠিক কোন দিকে সে বিষয়ে চারণের কোনওই আন্দাজ ছিল না। তবে দিক তো মাত্র চারটি নয়। দশ দিক। শহরবাসী চারণেরা চারদিক ছাড়া অন্য কোনও দিকের খোঁজই রাখে না। মাথাটা তার যেদিকেই থাকুক না কেন, মনে হচ্ছিল দেওয়াল ফুটো করে বরফের কুঁচি থেকে উঠে আসা হাওয়া যেন মস্তিষ্কের অলিগলিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।

গতরাতে বারান্দাতে বসে হুইস্কি খাবে বলেছিল পাটন। বারান্দাতে বসা আদৌ গেলে তো! ঘরের মধ্যেই বসে খেয়ে তারপর জমিয়ে খিচুড়ি খেয়েছিল বহুদিন পর। হোটেলের বাবুর্চি মুগ আব মসুর ডাল মিশিয়ে ঘি ঢেলে ভারী স্বাদু খিচুড়ি বানিয়েছিল। সঙ্গে আলুকা ভাত্তা, সেঁকা পাঁপর, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ ভাজা। কলকাতার বাগবাজারের মতো পেঁয়াজি এরা বানাতে জানবে কোত্থেকে!

পাটন বলেছিল, এরা পেঁয়াজি মারতেও জানে না, পেঁয়াজি বানাতেও জানে না।

খাওয়া-দাওয়ার পরেই পাটন বলেছিল, আমি খুব ভোরে উঠে চলে যাব। তুমি যতক্ষণ খুশি শুয়ে থেকো লেপের নীচে। তারপর ঘুম ভাঙলে বেল বাজালেই বেয়ারা চা নিয়ে আসবে।

বিল-এর কি হবে? এরা কি কার্ড অ্যাকসেপ্ট করবে? সিটিব্যাঙ্ক এবং গ্রিন্ডলেজ দুই কার্ডই আছে।

করবে। করবে। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ বলে গেছিলেন চার্বাক। এইসব কার্ড-এর মাধ্যমে পুরো দেশের মানুষকে দেউলে বানিয়ে দেবে ওরা। আমার মা বলতেন, পকেটে পয়সা থাকলে খাবি, নইলে না খেয়ে থাকবি তাও ভাল। কখনও ধার করবি না কারও কাছে এক পয়সাও। আমার মা এই শিক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু স্বামী দেবতা শুধু ধার করা নয়, তোমার আমার মতন কত অগণ্য মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের উপর ট্যাক্স দেওয়ার পর যে টাকা থাকে তা ব্যাঙ্কের থেকে ধার নিয়ে মেরে দিল। চারদিকে যত বড়লোক দেখোনা দিল্লি, বম্বে, বাঙ্গালোরে, জানবে তার একটা বড় অংশই ব্যাঙ্ক-মারা টাকাতে বড়লোক।

তারপর বলল, আমার মামা বাড়ির কাছেই, মানে বাখরাবাদেই (ও! তুমি তো গেছই! ভুলেই গেছিলাম) একজন বড়লোক ছিলেন সীতাকান্ত পারিদা। তিনি ব্যাঙের ঠ্যাং এক্সপোর্ট করেই। বড়লোক হয়েছিলেন। আমরা ছেলেমানুষরা তাঁকে দূর থেকে দেখে বলতাম ব্যাঙ-মারা বড়লোক। তখন কি আর জানতাম যে ব্যাঙ-মারা বড়লোকেরা ব্যাঙ্ক-মারা বড়লোকদের চেয়ে কত ইনোসেন্ট!

সকালে ঘুম যখন ভাঙল চারণের তখন বন্ধ দরজার তলা দিয়ে একটু আলোর আভাস আসছিল, রাতে সেই ফাঁক দিয়েই হুড়মুড়িয়ে হাওয়া ঢুকছিল। দু-একটা বাস ও গাড়ির আওয়াজ আসছে নীচের পথ দিয়ে। এদিকটা এমনিতে নির্জন। কটা বাজল কে জানে। জানার ইচ্ছেও নেই। ঘড়িটা স্যুটকেসের পেছনে বহুদিনই হল নির্বাসিত করেছে। আর সেই ঢাউস সুটকেসও তো পড়ে আছে হৃষীকেশেই। সময়ের কোনও দামই যার কাছে নেই সে সময় দিয়ে করবেই বা কি?

লেপের তলা থেকে উঠতে উঠতে ভাবল, চারমাস পরে এত আরামে আবার গোবর হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। যা কিছু অর্জিত হয়েছিল এই ক-মাসে সবই গেল বোধহয়। এই পাটন ছেলেটির গূঢ় উদ্দেশ্যটা যে কি, তা কে বলবে? কেনই বা নিয়ে এল এখানে আর কেনই বা তাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হল!

বেলটা টিপে দিয়ে দরজার ছিটকিনিটা নামিয়ে দিয়ে বাথরুমে গেল। এক পট চা না খেলে মনে হচ্ছে বাইরে বেরোতে পারবে না, অথচ গতকাল সকালেও ভোলানাথজির গুহাতে ধুনির পাশে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে ঘুম থেকে উঠে সূর্যস্তবের সঙ্গে বন্দিত নন্দিত স্পন্দিত নদী-পার থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে তারপরে পেতলের লোটাতে দুধের মধ্যে চায়ের পাতা আর চিনি ফেলে দিয়ে সকলের জন্যে চা করেছে। কোনওদিন পাটন, কোনওদিন স্টিভেন্স, কোনওদিন চারণ।

ভাবছিল যে, সুঅভ্যাস বা কৃচ্ছসাধনের পথ ছাড়াটা যত সোজা, ধরাটা তার চেয়ে অনেকই কঠিন। সত্যিই অনেকই কঠিন। যে পথ বেয়ে চলছিল গত চার মাস সেইপথে আবার ফিরে যেতে অনেকই কষ্ট হবে। পাটন কি এই ভাবেই শাস্তি দিল তাকে?

দরজা খুলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বেয়ারা বলল, বারান্দামে আকর বৈঠিয়ে না বাবু। ধূপ ছা গ্যায়া হ্যায়। বৈঠকে গরম গরম চায়ে পীজিয়ে!

তাঁর বাঁদুরে টুপি, মাফলার এবং অন্যান্য শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে সে বারান্দায় এসে বসল যখন তখন তেপায়ার উপরে ট্রে, তার উপরে টি-কোজি মোড়া কেটলি এবং গরম জলে-ধোওয়া পেয়ালা পিবিচ এবং গরম-করা প্লেটে হাফ অ্যান্ড হাফ বিস্কিট সাজিয়ে দিল বেয়ারা।

চারণ দেখল, কেটলির পাশে একটি পুরু খাম। উপরে তার নাম লেখা। অপরিচিত হাতের লেখাতে।

এটা কি? চারণ শুধোল।

খত হ্যায় বাবু।

কি দিয়েছে?

আপকি দোস্ত। উনোনেতো একদ্দম সুব্বেহি সুব্বে চল দিয়া বদ্রীবিশালজিকি তরফ। ইয়ে খত আপকি লিয়ে ছোড়কর গ্যায়ে। সুব্বেকি চায়েকি সাথই দেনে কি লিয়ে বোলকে গ্যয়া।

চারণ অনেকক্ষণ পাটনের হাতের লেখার দিকে চেয়ে রইল। চেনে না। দেখেনি তো কোনওদিন আগে। হাতের লেখা চেনে না, পাটনকেই কি চেনে?

সকালের প্রথম কাপে চুমুক দিয়ে চিঠিটা একবার তুলে আবারও রেখে দিল। ভাবল, চা শেষ করে নিজের শরীরে যথেষ্ট উত্তাপ সঞ্চার করে তারপরই খুলবে এ চিঠি। কে জানে। কি আছে এই চিঠিতে।

বেয়ারা চলে যাচ্ছিল, চারণ ডেকে শুধোল, বিল-উল বানাকে রাখনা। নাহানেকে বাদ নাস্তা কবকে ম্যায় দেবপ্রয়াগ চল দুঙ্গা।

বিল কওনচি কি বাবু? উ বাবু ম্যানেজার সাবকো সব কহকে গ্যয়া। আপ আজ দিনভর হিয়া আরাম কিজিয়েগা। কাল হৃষীকেশ সে আপকি লিয়ে গাড়ি আয়েগি।

হৃষীকেশ সে?

অবাক হয়ে বলল চারণ।

জি হাঁ।

কাঁহা যানেকো লিয়ে?

মুঝে ক্যা মালুম বাবু। সায়েদ উও খাতমে সব লিখকর গ্যায়া হোগা উনে। চায়ে লেনেকো বাদ ইতমিনানসে পড়িয়ে উও খত। জলদি কওন চি কি? সুরজত আভি আভি নিকলা। দিন বিলকুল নওজওয়ান হ্যায়।

বলেই, সেও ঘরে দাঁড়িয়ে দার্শনিকেরই মতন বলল, দিন ও রাতমে কিতনি ফরাক হোতা হ্যায়, নেহি বাবু? কাল রাতমে, আপলোগ যব খিচুড়ি খা রহেতে তব ওহি পিলকে পেড়কে নীচে সে এক বাঘ চলা গ্যয়া নদীকে তরফ।

বাঘ?

জি বাবু। বড়া বাঘ। চিতা-উতা নেহি।

আয়া কাঁহাসে?

হোটেল কি পিছুঁসে উত্বারকে আয়া থা। আরে বাপ রে বাপ। কিতনা ভাবল বাঘ থা?

তুম দিখা ক্যায়সে?

গেটকে সামনা দো দো বড়কা বাত্তি না হ্যায় হজৌর। রাত ভর জ্বলতা বহতা যায়। হামলোগোভি সামকি বাদ কবভি বের হ্যাজাক-ইয়া লানটান রাতমে নিকালতা নেহি না যায়।

তারপর বলল, রাত মে কিতনা ডর, কিতনা কিসিমকি ডর। ঔর দেখিয়ে সুরজ নিকাল গিয়া। চায়োতরফ কিতনা উজলা। কোই চিজ কি ডর নেহি, না বাহার কি, না অন্দর কি।

চায়ের কাপ হাতে ধরে চারণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। পাটনের মা তুলি ঠিক এই কথাই বলেছিল তাকে বাঘমুণ্ডার বাংলোতে। একই কথা। কিন্তু, অন্যভাবে। অন্য পরিবেশে। অন্য প্রতিবেশে।

চিঠিটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে চারণ কাপটা ট্রেতে নামিয়ে রাখল। আরও চা ঢালবে। তবে, তার আগে সামনের কাছিমপেঠা পাহাড়টার দিকে তাকাল। সূর্য পাহাড়ের ওপারে আছে। পাহাড় টপকে ওপারে তার আলো পৌঁছতে বেলা দশটা এগারোটা হয়ে যাবে।

ঈগলটা তখনও উড়ছে। কালকের মতন।

ওটা কি ঈগল, না, শকুন?

পরপর দু কাপ চা খাওয়ার পর চিঠিটা তুলে নিল হাতে। বেশ ভারী চিঠি।

ওঁ
রুদ্রপ্রয়াগ
চারণদা,
তোমাকে কাল বলেছিলাম যে কিছু শব্দ থাকে যা বাংলায় উচ্চারণ না করে ইংরেজিতে করলে যে তা করে এবং যে শোনে দুজনের পক্ষেই সহনীয় হয়।

সেই বাক্যটিকেই একটু বিস্তার করে বলব যে, অনেক বাক্য থাকে, যা মুখে বলা যায় না কিন্তু লিখে বললে বলা সহজ হয়। অনেক সময়ে, অনেক কথা মুখে বলাই যায় না, অথচ লিখে বলা যায়।

গতকাল আমি যে শব্দটি উচ্চারণ করে তোমাকে স্তম্ভিত করেছিলাম তার SHOCK তুমি হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনও। কিন্তু তোমার SHOCKED হবার মতন কিছু তো আমি বলিনি!

তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড় অবশ্যই। কিন্তু এমন বড়ও নও যে তোমার আমার মধ্যে Communication অসম্ভব।

আমার জন্মদাতা বাবার সঙ্গে অগণ্য কারণে আমার পক্ষে কোনওরকম Communicationই সম্ভব নয়। তাই জীবনের কোনও ব্যাপারেই তার সঙ্গে কোনও যোগসূত্র নেই। রাখিনি। রাখবও না।

তুমি তোমার বর্তমান বয়সে পৌঁছে যা জেনেছ, আমার পক্ষে আমার বর্তমান বয়সে দাঁড়িয়ে তা পুরোপুরি বোঝা আদৌ সম্ভব নয়। কারো পক্ষেই সম্ভব নয় তা। সম্ভব নয় যে, সেটা আমি বুঝি। জীবনের অধিকাংশ বোঝাবুঝিতেই নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পৌঁছতে হয়।

অপ্রত্যাশিতভাবে তোমাকে গতকাল যেমন গভীর দুঃখ দিয়েছি আজ তেমন গভীর আনন্দও দেব। তবে আনন্দের সঙ্গে আদেশও থাকবে আমার। হ্যাঁ। আদেশই বলছি। কারণ, আমার ভূমিকা এখন ঋত্বিকের। এরপর যা বলছি, তা মনোযোগ সহকারে শোনো এবং যা বলছি তা অবশ্যই কোরো।

চোখের সামনে যে সব ঘটনা ঘটে, তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন, তার কোনও অভিঘাত যদি আমার উপরে না পড়ে, তবে বলতে হবে আমার সব শিক্ষাই বিফলে গেছে। সমতলভূমি যেমন আমার স্বদেশ, উত্তরাখণ্ডও তেমনই স্বদেশ। ভারতীয় পাহাড়িদের সমতলভূমির উপরে যতটুকু অধিকার, সমতলভূমির বাসিন্দাদেরও পাহাড় পর্বতাঞ্চলের উপরে ততটুকুই অধিকার। উত্তরাখণ্ডে বসে ঈশ্বর-চর্চা করছে বলেই যে কেউ উত্তরাখণ্ডের মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের হতাশার সঙ্গে একাত্ম হতে পারবে না, তা আমি মনে করি না। তাছাড়া গ্রেট ব্রিটেইন-এর আইরিশরা যদি এত যুগ ধরে আয়ারল্যান্ডকে পৃথক রাজ্য বলে দাবি করে আসতে পারে, তবে কুমায়ুনি-গাড়োয়ালিদের দাবিকেই বা অস্বীকার করা হবে কেন? IR.A.র আন্দোলন যখন নাটক, নাচ আর গানের মাধ্যমেই শুধু তাদের দাবি পেশ করত সারা পৃথিবীর কাছে, তখন তো ইংল্যান্ডে কেউই তাদের পাত্তা দেয়নি। তাদের সিরিয়াসলি নেয়নি। যখন থেকে বোমা ছোঁড়া শুরু হয়েছে, নিরপরাধ মানুষদের মারা হয়েছে, শুধুমাত্র তখন থেকেই সেই দাবি একটি স্বীকৃতি পেয়েছে। তার আগে কি কেউ তাদের কথাতে কান দিয়েছিল? দার্জিলিং-এও যখন সুভাষ ঘিসিং আন্দোলন আরম্ভ করেন তখন তাঁকে নিয়ে সবাই হাসি-ঠাট্টা করেছে। কেউ কেউ বলতেন, যেমন, দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের সম্পাদক এম. জে. আকবর যে, প্রেমের গল্প লেখা এক গুখ সাহিত্যিক পৃথক দার্জিলিং রাজ্যের স্বপ্ন দেখছেন। যেন, প্রেমের গল্প লেখাটা পৃথিবীর জঘন্যতম পাপেরই একটি।

না, কেউই শোনেনি। অহিংসার পথ ছেড়ে যখন হিংসার পথে নামলেন আন্দোলনকারীরা তখনই প্রথমে তাঁদের কথাও প্রণিধানযোগ্য বলে গণ্য হতে শুরু হয়েছিল।

হিংসার পথই একমাত্র পথ চারণদা। পৃথিবীর কোথাওই কোনও কিছুই অর্জিত হয়নি অহিংসার দ্বারা আজ অবধি। হয়নি, কারণ মানুষের মতন জানোয়ার বিধাতা আর দ্বিতীয় সৃষ্টি করেননি। তারা শক্তের ভক্ত নরমের যম।

তোমাকে আমি লিখে দিতে পারি (যদিও সেই লেখা মিলিয়ে নেবার জন্যে সেদিন তুমি বেঁচে নাও থাকতে পারো) যে, নেলসন ম্যান্ডেলার আনা দক্ষিণ আফ্রিকার (গান্ধীজির আনা ভারতীয় স্বাধীনতারই মতন) স্বাধীনতার অবস্থা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে ঠিক ভারতীয় স্বরাজেরই মতন হবে। অবশ্যই হবে।

একটা প্রকৃত স্বাধীন দেশ গড়ে তুলতে শুধু আবেগ থাকলেই চলে না। মেরুদণ্ড লাগে, সততা লাগে, স্থির লক্ষ্যর দরকার হয়। এবং যে-জনগণের সাহায্যে নেতারা গদিতে আসীন হন সেই জনগণের জন্যে প্রকৃত দরদ লাগে। কুম্ভীরাশ্রু ফেলা দরদ নয়। চরিত্রবান বলতে একাধিক পুরুষ বা নারী সঙ্গ না করা মানুষী বা মানুষকে বোঝায় না। চরিত্র শব্দটির মানে কজন বোঝে বল? আমার বিচারে তুমি একজন পয়লা নম্বরী চরিত্রবান মানুষ। যদিও তুমি আমার মায়ের সঙ্গে সহবাস করেছ।

আচ্ছা এবারে এই শীতের জায়গায় সাতসকালে তোমাকে এমন out of the context দীর্ঘ বক্তৃতা করার কৈফিয়ত হিসেবে বলি যে, তাড়াতাড়ি চান করে টেরি বাগিয়ে তোমার সবচেয়ে Smart ঝিং-চ্যাক পোশাকটি পরে গায়ে সুগন্ধ মেখে সম্ভ্রান্ত তুমি তৈরি হয়ে নাও। ব্রেকফাস্টও করে নাও। ঠিক দশটায় চন্দ্রবদনী এসে তোমাকে তাদের গ্রামে নিয়ে যাবে।

তুমি গতকাল বারান্দাতে বসে সামনের উঁচু কাছিম-পেঠা পাহাড়ের পিঠের উপরের যে গ্রাম দেখে যুগপৎ মোহিত এবং ভীত হয়েছিলে ওইটিই চন্দ্রবদনীদের গ্রাম। এক দিন এক রাত তুমি ওদের আতিথেয়তা স্বীকার করে নিও। তোমার খারাপ লাগবে না। চন্দ্রবদনীরও খারাপ লাগবে না যে, সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।

বুঝতেই পারো। তার সঙ্গে অনেক আগে থাকতে এই ষড়যন্ত্রটি না করে রাখলে তো তোমাকে গাড়োয়াল হিমালয়ের রুদ্রপ্রয়াগের এক গ্রামে থাকার সুযোগটি করে দেওয়া যেত না। ওদের বাড়ি থাকলেই তুমি আমার উত্তরাখণ্ড-এর প্রীতির কারণ বুঝতে পারবে। চন্দ্রবদনীও তোমারই মতন সম্ভ্রান্ত বলেই তোমাকেই তার পছন্দ, এই চালচুলোহীন আমাকে নয়। ভাগ্যিস নয়! পছন্দ হলে, তাকে নিয়ে সমস্যাঁতে পড়তাম।

আবারও চন্দ্রবদনীর প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে কটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তাকে তো তোমাকেই দান করে গেলাম। চন্দ্রবদনীর যে অমাকে পছন্দ হল না, তার কারণ সংসারের নিরানব্বইভাগ মানুষেরই মতন Apparent-কেই ও real বলে ভেবে নিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা প্রমথ চৌধুরীর (তখন অবশ্য চৌধুরাণী হননি।) একটি চিঠির কথা মনে এল। প্রমথ চৌধুরী, যাঁর ছদ্মনাম ছিল বীরবল অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন। বাংলাও তো লিখতেন অতি চমৎকার। কাগজ সম্পাদনাও করেছেন, যে কাগজে রবীন্দ্রনাথের মতন মানুষও লিখেছিলেন। তুমি হয়তো এসব জানোই।

যাই হোক, সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, True to oneself হবার প্রধান বিপদ হচ্ছে অপর লোকে ভুল বোঝে। বহুরূপী মনে করে। একটিমাত্র Pose অবলম্বন করে সেইটেই আর পাঁচজনের চোখের সমুখে দিনরাত ধরে রাখতে পারলেই মানুষের চরিত্রটা সহজ সরল ঠেকে। অন্তত আমার মতো লোকের পক্ষে তাই।

আমাদের সরল নাম লাভ করতে হলে অসরল হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আজকাল দিন পড়েছে এমনি যে, আমাদের লোকে অযথারূপে মন্দ লোক মনে করলেও সহ্য হয় কিন্তু Hypocrite বলে মনে করলে কিছুতেই সহ্য হয় না। তবে আমাদের সকল চাঞ্চল্য, সকল চপলতার মধ্যেও একটি সুনির্দিষ্ট জিনিস অবশ্যই আছে সেটা ধরতে পারলেই আমাদের পুরোরকম ধরতে পারা যায়।

আমারও মনে হয় চারণদা যে, চন্দ্রবদনী আমার মধ্যে সুনির্দিষ্ট জিনিস, মানে আমার আসল আমি, সক্রেতিস যাকে বলেছিলেন Me! Me! The real me তাকে ধরতে পারেনি। পারেনি যে, সেটা ওর যেমন দুভাগ্য, হয়তো আমারও। আবার অন্যভাবে বললে বলতে পারি, ভালই হয়েছে। আধেক ধরা পড়েছি গো আধেক আছে বাকি।

কী বলো তুমি?

আসলে আন্দোলনকারী ছেলেদের কয়েকজন নেতা যে শিগগিরি পুলিশের হাতে কাল খুন হবে সে কথা ভেবেই মন বড় ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের সরকারের দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা আর নীচ স্বার্থপরতা এদের এই আন্দোলনকে এমন এক অগ্নিগর্ভ situation-এ ঠেলে দিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার জানেও না যে, পরে কেন্দ্রকেই হাত কামড়াতে

মায়নমারের নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রকৃত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমী Aung Saan Suu Kyi কিছুদিন আগেই খুব একটা দামি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, It is not power that corrupts but fear. Fear of losing power corrupts those who wield it. And fear of the scourage of power corrupts those who are subject to it.

এবারে শেষ করি।

আমায় এখন বেরোতেই হবে। আজ এখানেই শেষ করি। চন্দ্রবদনী এলেই তার কাছে সব জানতে পারবে।

খুশি তো? চারণদা, তুমি খুশি তো?

তুমি আমার মাকে এত খুশি করেছিলে! তোমাকে একটু খুশি করা কি আমার কর্তব্য নয়? আমার মা ছাড়া জন্মাবধি আমি আর কোনও নারীকেই ভালবাসিনি। কারও ভালবাসাও পাইনি এই স্বার্থমগ্ন দুনিয়াতে। এসব ব্যাপার তোমাকে যতখানি মানায় আমাকে ততখানি কখনওই নয়। তোমার প্রতিযোগী হতে চাইনি এই জন্যে যে, চন্দ্রবদনী জয় করা গাড়োয়াল হিমালয়ের সেই শৃঙ্গ জয় করার চেয়ে কিছু সহজ কাজ নয়। আর when defeat is unavoidable why not take it philosophically? তাছাড়া ভাবলাম যে, বাঁদরের গলায় কি মুক্তোর মালা আদৌ মানাত?

সব শুভেচ্ছা রইল।

ইতি–পাটন

পুনশ্চ

চন্দ্রবদনীর সহোদরও (একমাত্র) এই আন্দোলনে জড়িয়ে আছে। ঠিক কতখানি যে জড়িয়েছে তা চন্দ্রবদনী জানেন না। আমিও সঠিক জানি না। তবে তুমি এ প্রসঙ্গে কোনও কথা নিজ থেকে উঠিও না। উনি আদৌ কিছু নাও জানতে পারেন!

চিঠিটা হাতে নিয়ে চারণ অনেকক্ষণ বসে থাকল। তারপর বেল বাজাল। বেয়ারা এলে বলল, ঠিক সাড়ে আটটাতে নাস্তা দিতে। যাতে ও চানটান করে তৈরি হয়ে নিতে পারে।

বড়ই অস্বস্তিতে ফেলে গেল পাটন ওকে।

ইচ্ছে করলে চারণ যে দশটা বাজার আগেই উপরের অথবা নীচের দিকে রওয়ানা হতে এখনও পারে না এমন নয়। কিন্তু হৃষীকেশে চন্দ্রবদনীর নাম শোনার পর থেকেই যে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিল সেই অদেখা মানুষটির প্রতি সেই আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গেছে দেবপ্রয়াগে তাকে দেখার পর এবং তার গান শোনার পর। তার নৈকট্য যে কী বয়ে আনবে তা জানে না চারণ। পৃথিবীর প্রতিটি নারীই কোনও মনস্ক পুরুষের কাছে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। most unpredictable! তবে এটুকু বেশ বুঝতে পারছে যে, তার প্রি-ম্যাচিওর বানপ্রস্থ এবার শেষ হতে চলেছে।

জয়িতাকে চারণ ভালবেসেছিল, কিন্তু সেই অনুভূতি যে, ঠিক যাকে প্রেম বলে, তা নয়, তা ও চন্দ্রবদনীকে প্রথমবার দেখা মাত্রই বুঝতে পেরেছিল। ও যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিল। সর্পদ্রংষ্ট। চন্দ্রবদনীর ব্যক্তিত্ব তাকে বিবশ করেছিল। ঠিক ওই ধরনের অনুভূতি এর আগে অন্য কোনও নারীকে দেখেই হয়নি ওর। বড়ই কষ্ট পেয়েছে ও পাচ্ছে সেইক্ষণ থেকে, অথচ কারওকেই বলতে পারেনি।

তুলির সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল অবশ্যই। মানে, চারণের মায়ের সঙ্গে। কিন্তু সেই সম্পর্কে তুলির দিক দিয়ে মন যতখানি নিমগ্ন ছিল চারণের দিক দিয়ে শরীর থাকলেও, মন ততখানি ছিল না। চারণের জীবনে তুলিই প্রথম এবং আজ অবধি শেষ নারী যার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল।

জয়িতা তার শরীরের লোভ দেখিয়ে ওর কাছ থেকে অনেক কিছুই বাগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বদলে দেয়নি কিছুই। না শরীর, না মন। জয়িতার মানসিকতা যেমন ছিল, তেমন বোধহয় দেহোপজীবিনীদেরই হয়। শেষোক্তদের না জেনেই এ কথা মনে হয়েছে ওর। জানলে, তুলনা কবতে পারত সঠিক ভাবে। উঁচুমহলের ইংরেজি-ফুটোনো জয়িতাদের মতন মেয়েদের চেয়ে সাধারণ, গরিব প্রস্টিটুটেরাও সম্ভবত ভাল। তাদের মধ্যেও ভান-ভণ্ডামি থাকলেও লেনদেন সম্বন্ধে কোনও ভণ্ডামি থাকে না হয়তো। মনে হয়।

বেয়ারা এলে, তাকে ব্রেকফাস্টের কথা বলে বাথরুমে গিয়ে, গিজারটার সুইচ টিপে দিল। ঠিক করল, ভাল করে চান করবে আজ বহুদিন পরে।

চান করে প্রাতরাশ সেরেও ঘড়িতে দেখল যে, চন্দ্রবদনীর আসতে এখনও দেড় ঘন্টা দেরি আছে। এই মধ্যান্তরের ভার তখন থেকেই তাকে ভারী করে তুলল। কী করবে তা ঠিক করে উঠতে পারল না। তারপর সিদ্ধান্ত নিল পাটনকে একটা চিঠিই লেখে। চন্দ্রবদনীর সঙ্গে সে কোন চক্রান্ত করে রেখেছে তা সেই জানে। তাই চন্দ্রবদনীর আসার পরে চিঠি লেখার সময় পাবে কি না তা অজানা।

বেল বাজিয়ে কাগজ চাইল। একটি বলপেন সঙ্গে তখনও ছিল সভ্যতার শেষ যোগসূত্র হিসেবে যে ছেলেটি ব্রেকফাস্ট দিয়েছিল সেই প্যাড নিয়ে এল। কিন্তু তখুনি চিঠি লেখা আর হল না। মানুষ, চারণকে চিরদিনই পুঁথির চেয়ে অনেকই বেশি আকৃষ্ট করেছে। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিশে যেমন করে ও সেই স্থানের নাড়ি বোঝে, তেমন দশটি বই পড়েও কখনওই বোঝা সম্ভব নয় বলেই ও হেসেছে।

তোমার নাম কি ভাই?

অমিতাভ।

বচ্চন নয় তো?

হেসে সে বলল, উনিশ কুড়ি বছরের এক গাড়োয়ালি ছেলে, ভারি মিষ্টি হাসি।

বলল, তা নয়, তবে আমার মা অমিতাভ বচ্চনের খুব ভক্ত তাই নাম দিয়েছিল অমিতাভ। অমিতাভ বচ্চন কোডোররা কোরো পতি আর আমি রুদ্রপ্রয়াগের এই হোটেলের খিদমদগার।

তোমার দেশ কোথায়? এখানেই?

না। উত্তরকাশীতে।

ও। ভূমিকম্পে তোমাদের বাড়ির ক্ষতি হয়েছিল?

হয়নি! সেই জন্যেই তো পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এই নোকরিতে ঢুকেছি। বাড়িটা নতুন করে করতে হবে। সব ফেটেফুটে গেছে। শীতে ভারী কষ্ট। আর শীত তো এসেই গেছে। এবারে আমাকেও ফিরে যেতে হবে। ট্যুরিস্ট সিজনও শেষ হয়ে গেল।

টুরিস্ট সিজন-এ বকশিস তো ভালই পাও।

বকশিসই তো সার। মাইনে যা, তা লোককে বলতে লজ্জা করে।

তাই?

হ্যাঁ। অধিকাংশ হোটেলেই তাই। আমাদের আসল রোজগার তো বকশিসই।

তোমাদের মতো অল্পবয়সীদের সকলের নামই কি এমন আধুনিক?

আধুনিক মানে?

মানে, এই অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীবকুমার, রাকেশ…

অমিতাভ হেসে ফেলে বলল, প্রায় তাই। উত্তরের বরফি হাওয়া থেকে বাঁচা সহজ কিন্তু যুগের হাওয়া সব উড়িয়ে নিয়ে যায়।

সব মানে?

মানে, এই যাকে আপনারা ইংরেজিতে বলেন, ট্র্যাডিশন।

বাঃ। তুমি তো ইংরেজি জানো বেশ।

আমি পড়তাম তো শ্রীনগরের কলেজে।

তাই? কি পড়তে?

ইংরেজি নিয়ে পড়তাম। ইচ্ছে ছিল দিল্লিতে গিয়ে ইংরেজিতে এম এ করব। কিন্তু পাস করেই বা কি হবে। চাকরি কই?

চাকরিই যে করতে হবে তার মানে কি?

ক্যাপিটাল ছাড়া তো ব্যবসা হয় না।

ভুল কথা। ইচ্ছে থাকলেই হয়। ব্যবসা মানেই যদি ভাব প্রথম দিন থেকেই এয়ারকন্ডিশানড অফিস, সুন্দরী সেক্রেটারি, পাঁচ লক্ষ টাকা ইনিশিয়াল ক্যাপিটাল, সেটা ভুল। আমি অনেক কোটিপতিকে জানি যারা সৎপথে অতি ছোট্ট ব্যবসা থেকে অমন হয়েছেন। কি কাকে বেচা যায় আর কোথা থেকে কত কম দামে সেই জিনিস যোগাড় করা যায়, এইটা যদি একবার বুঝে ফেলতে পার তবেই ব্যবসাদার হয়ে উঠবে। তুমি যাই দেবে, খদ্দের তাই মাথায় করে কিনে নিয়ে যাবে।

মাথায় করে মানে?

মানে, আদর করে। বাংলাতে আমরা যাকে বলি, শিরোধার্য করে।

খদ্দের এসে চাইবে আম আর তুমি তাকে দেবে তেঁতুল। খদ্দের কি জানবে তার আসলে কোন জিনিসটি দরকার! বিক্রেতা হয়ে তুমি যদি খদ্দেরের স্বার্থ তার নিজের চেয়েও ভাল বুঝতে পারো, সে তুমি মোমফুলিই বেচো আর নারাঙ্গি, তুমিও একদিন কোড়োরোপতি হবেই হবে।

দেখা যাক। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ-ই জানে।

বলল, অমিতাভ।

তোমার বাবার নাম কি? মানে, তোমাদের বাবা মায়েদের সময়ে ওঁদের কী রকম নাম রাখতেন তোমাদের নানা-দাদারা?

অমিতাভ হাসল।

বলল, আপ তো অজীব অজীব কোশ্চেন পুছ রহা হ্যায় সাব।

জি। ম্যায় এক অজীব আদমিভি হুঁ। ইস লিয়ে।

বাবা-মায়েদের নাম হত এইরকম, বাবাদের ধরুন জরু, গেন্দা, ছিপাড়া এইরকম আর কী।

মায়েদের?

কুশলা, মূর্তি, এই…

গাড়োয়ালে কি অনেক জাত?

অনেক না হলেও, আছে কিছু।

কী রকম? নাম বল না কয়েকটা?

এই ধরুন, নেগি, পাঁওয়ার। পাওয়ার তেহরিতে বেশি পাবেন।

মানে? তেহরি গাড়োয়াল তো?

জি হাঁ।

চারণের মনে পড়ে গেল, কুঞ্জাপুরী থেকে দেখেছিল ঘোরানো পার্বত্য পথে বাস চলেছে তেহরি গাড়োয়ালের দিকে।

ভাবছিল পাটন, সত্যি। আমাদের দেশটা কত বড়। কত বিচিত্র। ইউরোপে তিন-চারটি দেশ পেরিয়ে যাওয়া যায় সকালে বেরিয়ে বিকেলে। আমাদের দেশে একটি জেলা একদিনে পেরুনো যায় না। বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হল্যান্ড, কতটুকুটুকু সব দেশ! জার্মানিই বা কতটুকু? অথচ সে সব দেশ মানুষদের দেশ বলে তাদের কী দাপট! জনসংখ্যা দিয়ে দেশের মহত্ত্ব বা বিরাটত্ব নিরূপিত হয় না, মানুষের উপাদান দিয়ে হয়, জাতের গুণ দিয়ে হয়। আমাদের দেশ নিয়ে কীই না করতে পারতাম আমরা। অথচ পঞ্চাশটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। পাটন ঠিকই বলে। একটা হেস্তনেস্ত করার সময় এসেছে। করলে ঐ পাটনেরাই করবে একদিন।

পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে চারণ অমিতাভকে জিগ্যেস করল, আর কি জাত বললে না?

শর্মা আছে। তারা পণ্ডিত। ভরদ্বাজ।

আর?

শেমোয়াল আছে। রাওয়াল, মানে, পুরোহিত। বদ্রীনাথের রাওয়ালদের বাড়ি দেবপ্রয়াগে। চন্দ্রবদনীজি তাঁদের রিস্তাদার।

তুমি চন্দ্রবদনীকে চেনো না কি?

চিনব না? তাঁর বাবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে…

তোমার তখন জন্ম হয়েছিল?

অমিতাভ হেসে ফেলল। বলল, শুনেছি তো সব। আমাদের গাড়োয়াল রেজিমেন্ট বাহাদুর। তবে চন্দ্রবদর্নীজির বাবা অন্য রেজিমেন্টে ছিলেন। আপনি জানেন না, রমেশ সিপ্পি চন্দ্রবদনীজিকে তাঁর ছবির নায়িকা করতে চেয়েছিলেন।

তারপর?

বহিনজি করলে তো। উনি কি দুগগি-তিগগি না কি?

ওয়াহ! ওয়াহ্!

চারণের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তোমাদের এই গাড়োয়ালে কি কি ফসল ফলাও তোমরা অমিতাভ?

অনেকইরকম।

যেমন?

যেমন মক্কী? মক্কীকা রোটি আর শুষকা শাগ-এর কথা পাঞ্জাবি ধাবাওয়ালাদের দৌলতে ঢেরই শুনেছেন। নিশ্চয়ই। সেই মক্কী। মানে মকাই।

তা শুনেছি। মক্কী ছাড়া গেঁহু হয়। জও হয়।

জও টা কি জিনিস?

একরকমের ধান। পুজোতে লাগে। চাল হয় দুরকম। সাটি এবং ঝঙ্গারা। কোদুকা হয়।

সেটা কি জিনিস?

গেঁহুরই মতন। আটা হয় তা থেকে।

আর।

শর্ষে, পালং, মুলি, ঘেণ্ডা মুলি, খাম আলু।

আর ফলের মধ্যে?

নারাঙ্গি, ছোট ছোট হয়, সান্তরা বড়। আর মাল্টাও হয় আরও বড়। তাছাড়া, যোশিমারী আল হয়। নিস্তু হয় দুরকমের ছোট ও বড়। চাকোতরাও হয়।

চাকোতরাটা কি জিনিস?

বাঙালিরা বলে বাতাবী নেবু।

হাসল চারণ, অমিতাভর মুখে শ্যামবাজারি নেবু শুনে।

তোমাদের এই পাহাড় জঙ্গলে নানারকম জানোয়ার, পাখি আছে, পড়েছি, জিম করবেট সাহেবের বইয়ে। তবু তুমি যদি নিজমুখে বল তো মিলিয়ে নিই।

নীচে হাতি আছে। দেখেছেন তো রাজাজি ন্যাশনাল পার্কে। অন্যান্য জায়গাতেও আছে। বড় বাঘ, চিতা, ভালু, বিরাট বিরাট হিমালয়ান ভালু, বুকে সাদা V চিহ্ন থাকে তাদের। ভালু এমনিতে নিরামিশাষী কিন্তু হিমালয়ান ভালুকেরা আমিষও খায়। কাকার আছে। ঘুরাল। হনুমান। পাখির মধ্যে ঈগল, নানারকম। দাঁড়কাক কুচকুচে কালো। কবুতর, মুরগী, ময়ুর, চুকোর, খালিজ ফেজেন্টেস, বুলবুলি আরও কত পাখি। অত কি আমি জানি!

বাঃ। তবু তো অনেকই জানো। আমাদের দেশে বহত মানুষ আছেন, ভারী ভারী ডিগ্রিওয়ালা মানুষ, যাঁদের ডিগ্রি পাকানো থাকে আলমারির ড্রয়ারে, তাঁদের যদি জিজ্ঞাসা করা এটা কি গাছ? তো ওঁরা বলবেন গাছ। এটা কি পাখি? পাখি। এটা কি নদী? নদী। এটা কি ফুল? ফুল। এমনকি তুমি যদি তাঁর বউকে দেখিয়ে বল ইনি কে? মানে, এঁর নাম কি? উনি বলবেন, বউ।

অমিতাভ খিলখিল করে হেসে উঠল। ভারী মজা পেয়েছে ও চারণের কথা শুনে।

বলল, আপ বহতই মনমৌজি আদমি হেঁ সাহাব। মনমৌজি কথাটার মানে অমিতাভ ঠিক জানে না। তবে তাতে চারণের প্রশস্তির রকম বোঝানোর সুবিধাতে কোনও হেরফের হল না।

অমিতাভ বলল, অব ম্যায় চলে সাহাব। ম্যায় হিয়া রহনেসে আপ খাত নেহি লিখ পায়েঙ্গে।

অমিতাভ সত্যিই চলে গেল।

পাটনকে চিঠিটি লিখতে বসলে এখন এত অল্প সময়ে শেষ করা যাবে না। কারণ, সে যে সব কথা বলে গেল সেই সব সম্বন্ধে চারণ সম্পূর্ণ একমত নয়।

একমত কেন হওয়া সম্ভব হল না পুরোপুরি ওর পক্ষে, তা বুঝিয়ে বলতে গেলে সময় এবং মনোযোগেরও দরকার। কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রবদনীর এসে পড়ার কথা। তা যদি আসে, তবে চিঠিটি মিছিমিছি আরম্ভ করে আধাশেঁচড়া করে রেখে দিতে হবে।

চিঠির ব্যাপারে চারণ চিরদিনই অত্যন্ত মনোযোগী। চিঠি যখন লেখে কারওকেই, তখন মনে করে যে, যাকে লিখছে তিনি বা সে যেন তার সামনেই বসে আছেন। তাঁর বা তার সেই মুহূর্তের বেশভূষা, মানসিকতা, সেই সময়ের আবহাওয়া, চিঠির প্রাপকের পরিবেশ, প্রতিবেশ সব কিছু সম্বন্ধেই একটা ধারণা অথবা উর্দুতে যাকে বলে আন্দাজ তাই করে নিয়ে চিঠি লিখতে বসে। চিঠির প্রাপকের মুখে-চোখে চারণের চিঠির প্রতিটা লাইন কীরকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে তাও যেন আধাশেঁচড়া করে, ডঠি যখন লেখেন তার সেই মৃত্যু চারণ কল্পনা করতে পারে। গান তো গায়কের একার নয়। গান যতখানি গায়কের, ঠিক ততখানি শ্রোতারও। একটুও কম বা বেশি নয়। চিঠি যে লেখে, আর চিঠি যে পায়, তাদের বেলাও এই একই কথা প্রযোজ্য।

চারণের মনে পড়ে গেল পাটনের মা তুলির চিঠির কথা। তুলি বয়সে চারণের সমবয়সী অথবা ছোটও হতে পারে। হয়তো ছোটই ছিল। মেয়েদের বয়স তো জিগ্যেস করা যায় না। আগে অন্তত যেত না। যখন মেয়েরা যথেষ্ট মেয়েলি ছিল এবং সেই মেয়েলিপনাতে পুরুষেরা আকৃষ্ট হত এবং মেয়েরা তাদের মেয়েলিপনার কারণে নিজেরাও বিব্রত হত না। মেয়েরা মেয়েলি হবে অথবা পুরুষ পুরুষেরই মতন। তাই তো উচিত। তাই এতে দুপক্ষের কোনও পক্ষেরই বিব্রত হবার কি কারণ একালে কী সেকালে তা চারণ কোনওদিনও বুঝে উঠতে পারেনি। মেয়েদের মধ্যে পুরুষ পৌরুষ প্রত্যাশা করে না শুধু তাই নয়, পছন্দও করে না, যেমন মেয়েরা করে না পুরুষের মধ্যে মেয়েলিপনা। এই সত্য সম্বন্ধে চারণের কোনওই সন্দেহ ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না।

ছোট্ট এবং সুন্দর চিঠি লিখত তুলি।

মেয়েরা সাধারণত চিঠি লেখার ব্যাপারে খুবই সাবধানী হয়। বিশেষ করে এদেশের মেয়েরা। শতং বদঃ না লিখঃ এই লিখন তারা সর্বদাই মেনে চলে। পুরুষ মাত্রই, যদি সে ধূর্ত, ধাউড় বা ভণ্ড না হয়, স্বভাবতই অসাবধানী, অগোছালো তার অবিভ্যক্তি এবং মনোভাবে। অবশ্য ব্যতিক্রমী পুরুষও থাকেন।

তুলির প্রথম চিঠিটির কথা মনে আছে চারণের। আতর-মাখানো ফিকে-হলুদরঙা সিল্ক-এর একটি স্কার্ফ-এর মধ্যে তুলির চিঠিগুলো জড়িয়ে রেখে দিয়েছে সে তার ড্রয়ারে। পাটনের অমানুষ বাবা, যিনি হয়তো কোনওদিনও তার মন বা শরীরকে কোনও আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে কখনওই দেখেননি, এই চিঠিগুলোর কথা জানলে চারণকে গুণ্ডা দিয়ে খুন করাতেও হয়তো বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না।

চারণের এই দোষ। উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীরই মতন ছড়িয়ে যাওয়া। যদি একে দোষ বলা যায়।

এই সব ভাবতে ভাবতে চান সেরে নিল চারণ।

চারণের ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিয়ে অমিতাভ দৌড়ে এল চারতলাতে। বলল, চন্দ্রবদনীজি আ পউছি হ্যায়। উনকি হিয়াই লায়েগা স্যার কী আপ উতরকে আইয়েগা নীচে?

চারণ বলল, না না। আমিই যাচ্ছি।

বলেই, বারান্দাতে দাঁড়িয়ে নীচে তাকাল ঝুঁকে। কারওকেই দেখা গেল না। চারণ ভাবল, নিশ্চয়ই পোর্টিকোর নীচে আছে সে, অথবা বসার ঘরে বসেছে গিয়ে।

অমিতাভকে ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে যেতে বলবে কি বলবে না, বুঝতে পারল না। রাতটাও কি চন্দ্রবদনীদের বাড়িতেই কাটাতে হবে? না শুধু Day spend করারই নেমন্তন্ন? পাটনের চক্রান্তর চক্করের প্রকারটি যে ঠিক কী রকম তাতো চারণের জানা নেই।

নীচে নেমে, বসার ঘরে উঁকি মেরে দেখল চারণ যে, সেখানেও সে নেই। বাইরে বেরিয়ে পোর্টিকোর নীচে গিয়ে দেখল, নাঃ। সেখানেও নয়।

এদিকে ওদিকে চেয়ে অবশেষে দেখতে পেল যে, একটি তরুণ হর্স-চেস্টনাট গাছের নীচে চন্দ্রবদনী দাঁড়িয়ে বাগানের শোভা দেখছে। ডান পাশ থেকে তাকে দেখল চারণ। একটি ফলসা-রঙা তাঞ্চোই সিল্ক-এর শাড়ি। তার গাঢ় বেগুনি পাড়। সাদা-রঙা ব্লাউজ। তার গলাতে ফলসা-রঙা লেসের কুঁচির কাজ করা। মুক্তোর মালা গলাতে। মুক্তোর ছোট দুটি দুল, কানের সঙ্গে লেপটে আছে। বাঁ হাতটি খালি। ডান হাতে সাদা ব্যান্ডের সাদা ডায়ালের হাত ঘড়ি। সকালের রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। চান করে এসেছে। চুলে তেল দিয়েছে। চামেলির গন্ধ বেরুচ্ছে। হয়তো চামেলির তেলই দিয়েছে। ঘন কালো ভিজে চুল এর মধ্যে তার সাদা সিঁথিটা, সে যে কতখানি ফসা তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। মুখে অন্য কোনও প্রসাধন নেই। সুত শরীর থেকে সুগন্ধ উড়ছে। মেয়েরা শরীরের নানা অদৃশ্য স্থানে নানা সুগন্ধি মাখে। সে সবের কথা চারণের জানার কথা নয়। কিন্তু চন্দ্রবদনীর দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল যে, বাহ্যিক কোনও সুগন্ধির বা প্রসাধনের কোনও প্রয়োজন হয় না চন্দ্রবদনীর। তার শরীরই সুগন্ধি। মুখেও প্রখর ব্যক্তিত্ব আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোনও প্রসাধন নেই।

চন্দ্রবদনী হাত জোড় করে বলল, নমস্কার।

নমস্কার। চারণ বলল।

কেমন লাগছে আমাদের রুদ্রপ্রয়াগ?

এসে অবধি যে-টঙে চড়িয়েছিল পাটনচন্দ্র তা থেকে তো আর নামিইনি। জায়গাটির ভালত্ব বা মন্দত্ব সম্বন্ধে কিছু যে বলব, তার উপায় কি? এমনকি করবেট সাহেব রুদ্রপ্রয়াগের কুখ্যাত মানুষখেকো চিতাটা কোথায় মেরেছিলেন সে জায়গাটা পর্যন্ত দেখা হল না।

দেখিয়ে দেব পরে। করবেট সাহেব আমার ঠাকুর্দাকে চিনতেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছেন কয়েকবার। যদিও উনি বয়সে আমার ঠাকুরদার চেয়ে অনেকই বড় ছিলেন।

তাই? তবে তো আপনাদের বাড়ি আমার কাছে এই কারণেই এক তীর্থ।

কেন? আপনি ভক্তি করেন বুঝি ওঁকে খুব?

করব না! শিকারী বলেই নয়, মানুষ হিসেবে ভক্তি করি, দেশপ্রেমী হিসেবে ভক্তি করি, সাহিত্যিক হিসেবে ভক্তি করি।

সাহিত্যিক হিসেবে?

নিশ্চয়ই। আপনি পড়েননি ওঁর লেখা?

না তো।

ঈসস। এই জন্যেই বলে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।

তারপর চারণ বলল, এখুনি কি যেতে হবে?

যেমন আপনার খুশি।

স্যুটকেসটা কি নামিয়ে আনাবে ওপর থেকে?

তা আনালেই ভাল। কারণ আমাদের বাড়িতে এমন কোনও পুরুষ নেই যাঁর জামাকাপড় আপনার গায়ে হতে পারে। আর যদি চেঞ্জ না করে চলে তবে…

রাতে কি আপনাদের ওখানেই থাকতে হবে? না এখানে এসে শোব?

সে কী! পাটন বলেনি আপনাকে?

কি?

যে, আজ আপনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। কাল ভোরে আমরা চলে যাব পউরিতে। পউরিতে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আপনি ফিরে যাবেন দেবপ্রয়াগে।

তাই?

তাই মানে? আপনি জানতেন না? নাকি অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল?

না। তা নয়। মানে আমাকে কিছুই বলেনি তো পাটন।

বলেনি? আশ্চর্য তো!

সে যাই হোক। ও যা ঠিক করেছে তাই হবে। প্রথমবারেই বুড়ি-ছোঁয়ার মতন বদ্রীনাথ কেদারনাথ দেখে ফেললে এ জীবনে আর এই গাড়োয়ালে আসাই হবে না। আমারও মন বলছিল যে, দেবপ্রয়াগেই ফিরে যাই।

চন্দ্রবদনী বলল, অবশ্য দেবপ্রয়াগে যেতে আপনাকে পউরি থেকে নেমে আসতে হবে আবার শ্রীনগরে।

তা তো হবেই।

তারপর একটু চুপ করে থেকে চারণ বলল, একটা কথা ভাবছিলাম।

কি?

আপনার মতো শিক্ষিতা, স্থানীয় নারীরও কি এসকর্ট এর দরকার? এতটুকু পথ যেতে?

সামান্য অপ্রতিভ হল চন্দ্রবদনী।

একটু ভেবে বলল, আমার? একদমই না! বরং আপনাকেই আমি এসকর্ট করে নিয়ে যেতে পারি যেখানে যাবেন।

তাই তো!

চারণ বলল, আমি তো তাই ভেবেছিলাম। আমি…

কিন্তু পাটন আশঙ্কা করছে আগামীকাল কোনও গোলমাল হতে পারে।

চন্দ্রবদনী বলল।

কোথায়? উত্তরাখণ্ড-এর সব জায়গাতেই।

কেন?

তা বলেনি। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না যে, পাটনের সঙ্গে আমার ভাই চুকোর-এর অনেকদিনের বন্ধুত্ব। সেও থাকত স্টেটস-এ। ও এখানে ফিরে আসে উত্তরাখণ্ডে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার স্বপ্ন নিয়ে। আমাদের পরিবারের অনেকেই হয় আর্মিতে নয় এয়ারফোর্সে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। আমরা, বলতে পারেন, ফৌজি পরিবার। তাই কেতাবী পড়াশুনো তার ভাল লাগেনি। তাকেও, বোধহয় Family Bug-এ কামড়েছিল। সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে একদিন এখানে ফিরে এল। ফিরে আসার মাস ছয়েক পরে পাটনের সঙ্গে এই রুদ্রপ্রয়াগ বাজারেই তার দেখা, একেবারেই অকস্মাৎ। তারপর পুনর্মিলন। চুকোর এখন রুদ্রপ্রয়াগে নেই। কোথায় আছে, সে খবরও জানি না। তবে আছে এই আদিগন্ত পর্বতমালার কোথাও না কোথাও। কিন্তু চুকোর যেখানেই থাকুক তার সঙ্গে পাটনের একটা গোপন যোগসুত্র যে আছে তা বুঝতে পারি। তবে ওইটুকুই। বুঝতেই পারি। বুঝতে পারার চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারি না।

তারপর বলল, ইফ উ্য ফিল দ্যাট আই অ্যাম অ্যান আনওয়ান্টেড কোম্পানি তাহলে আমি একাই যাব।

কী যে বলেন! এ তো আমার সৌভাগ্য। আপনাকে দেবপ্রয়াগে দেখার পর থেকে…জানি না কী বলব। সামনা-সামনি আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। ভাল তো বলতে পারি না। তাই কিছু না বলাই ভাল।

তাহলে কী ভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন?

তাও জানি না। বোধহয় চিঠিতে একটু একটু পারি। তবে বলার মতন কথা না জমে উঠলে বা বলার মতন কেউ না থাকলে।

চন্দ্রবদনী চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।

তারপর বলল, চলুন। আমরা চলতে চলতে কথা বলি। অনেক উপরে উঠতে হবে কিন্তু। বেশ অনেকটা পথ। এতখানি উঁচুতে অন্যত্র উঠলে অনেকই পুণ্যার্জনও করতে পারতেন, কিন্তু এখানে পূণ্যর সম্ভাবনা কম। তবে এটুকু বলতে পারি যে, পাপও নেই।

আমার সুটকেস কি হবে?

আপনি এখুনি তো আর চেঞ্জ করছেন না। আমার সঙ্গে দুজনে এসেছে বাড়ি থেকে। তারা বাজার করছে এখন। বাজার করা সেরে তারা স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যাবে। কাল সকাল সাতটাতে গাড়ি এসে আমাদের তুলে নেবে। আজই সন্ধের আগে এসে যাবে রুদ্রপ্রয়াগে। সে গাড়িতেই আমরা যাব কাল।

কোথা থেকে আসবে গাড়ি?

হৃষীকেশ থেকে। আপনারই তো ঠিক করা গাড়ি।

চারণ একটু থতমত খেয়ে বলল, ও, হ্যাঁ, তাই তো। ভুলেই গেছিলাম।

বলেই বুঝতে পারল, পাটন এখানেও এক তিড়ি মেরেছে। Pulled a fast one on him।

চন্দ্রবদনী বলল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছেন কি?

চারণ একটু অবাক হল। প্রথমত স্থানটি রুদ্রপ্রয়াগ। দ্বিতীয়ত প্রশ্নক চন্দ্রবদনী। তৃতীয়ত এই গাড়োয়াল হিমালয়ে বসে একেবারে পদ্মা নদীতে নেমে যাওয়াটা, শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে একটু কঠিন বলে মনে হল।

মানিকবাবু তো মুক্তিকেই বাস্তবায়িত করেছেন হোসেন মিঞার মধ্যে। করেন নি কি? হোসেন মিঞার মতো এমন একটি চরিত্র বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ।

হুঁ। সুদুরের পিয়াসী। চারণ বলল।

চন্দ্রবদনীর মুখ চোখ, ভোরের প্রথম সূর্যের আলো চন্দ্রবদনী গিরিশৃঙ্গর উপরে পড়লে যেমন ত ঝিকমিকিয়ে ওঠে, তেমনই যেন ঝিকমিকিয়ে উঠল। বলল, ঈসস। আপনি জর্জ দাদুর কথা মনে করিয়ে দিলেন।

কে জর্জ দাদু?

জর্জ বিশ্বাস।

তাই?

হ্যাঁ। আমি তখনও পাঠভবনেও ভর্তি হইনি। মা গেছিলেন পৌষ উৎসবে, শান্তিনিকেতনে। বাবারও তখন ছুটি ছিল। বাবাও গেছিলেন। জর্জ দাদু খালি গলাতে সকালবেলা গানটি গেয়েছিলেন মেলাতে।

আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি।

সুদূর বিপুল সুদূর! এই শব্দটি যে আট বছরের একটি মেয়ের বুকে কী সুরই বাজিয়ে দিয়েছিল, তাকে কোন চিরযাত্রীর অদৃশ্য বেশে সাজিয়ে দিয়েছিল তা কী বলব। আমার মধ্যে ঐ তিনটি শব্দের অনুরণন আজও থামেনি। আর জর্জ দাদু কীভাবে যে গাইতেন। কীভাবে শব্দ কটি উচ্চারণ করেছিলেন তা ভাষাতে বোঝানো যায় না। ওগো সুদূর বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও বাঁশরি-মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি।

চারণ চুপ করে ছিল।

চন্দ্রবদনী বলল, সেই ছেলেবেলা থেকে আমার মনে সদূর বিপুল সুদূর-এর একটা অস্পষ্ট ধারণ গড়ে উঠেছিল। বিশ্বাস করবেন না হয়তো বললে, আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম ভালবেসে তিনি এয়ারফোর্সের ফাইটার পাইলট ছিলেন। ওঁর সঙ্গে যেদিন প্রথম আলাপ হয়েছিল আমার, আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম যে আপনারা তো মুহূতাঁর মধ্যে কত দূরে চলে যান, হাওয়ার বেগ, শব্দের বেগ এসব আপনাদের কাছে তুচ্ছ কিন্তু সুদূর বিপুল সুদূরের মানে আমাকে বোঝাতে পারেন?

উত্তরে উনি কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, মানে, উনি তো বাংলা বুঝতেন না। ইংরেজিতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। তবুও উনি খুব উদ্দীপ্ত হয়ে বলেছিলেন Oh! Its great. The very idea is great. Yes! To go beyond an beyond and beyond is our job. We churn around the blue space. The eternal space you may as well say, we are churned by etemal space. ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি/ মোর ডানা নেই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি ও ইংরেজিতে তর্জমা করে শোনাতেই তিনি সত্যিসত্যি একেবারে thrilled। বললেন, বাঁশরির মানে তো বুঝলাম, পাশরিটা কি ব্যাপার?

চারণ বলল, আমিও কিন্তু জানি না।

চন্দ্রবদনী পথে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে বলল, ঠাট্টা করছেন।

চারণ বলল, সত্যিই জানি না। গানটা কতবার শুনেছি অথচ এই পাশরি শব্দটির মানে জানার ইচ্ছে হয়নি কখনও এমন করে। বাঁশরির সঙ্গে পাশরি মিলে গেছে, কানে মধুর ঠেকেছে, এই অবধি।

চন্দ্রবদনী বলল, পাশরি মানে, ভুলে যাওয়া। পাসরন থেকে পাসরি। সেখান থেকে বানান ভেদে বা আর্য-প্রয়োগে পাশরি।

বাঃ!

চারণ বলল, আপনি কত জানেন?

হাসাবেন না, প্লিজ। চড়াইতে ওঠার সময় হাসলে আমার পেটে ব্যথা হয়।

অবাক কাণ্ড।

চারণ বলল।

তারপর বলল, আসলে পদ্মনদীর মাঝির হোসেন মিঞার সাধনাইতো ছিল সেই অজানাকে জানার। যেখানে eternal surging water churns him, churns the space around him or to say it in the other way round, he churns the water and the space.

চারণ চুপ করে রইল। চন্দ্রবদনীর নাম তাকে মজিয়েছিল হৃষীকেশ-এ। তার গান মজিয়েছিল দেবপ্রয়াগে। আর তার ব্যক্তিত্ব, তার মেধার ঔজ্জ্বল্য মুগ্ধ করল রুদ্রপ্রয়াগে।

ও ভাবছিল, সত্যিই এই দেবভূমিতে এসে যেন দেবী দর্শনই হল।

চন্দ্রবদনী বলল, আপনি Kunt Humsun-এর Growth of the Soil উপন্যাসটি পড়েছেন?

হুঁ।

পদ্মানদীর মাঝির সঙ্গে কোথায় একটা মিল আছে না? হোসেন মিঞার চরিত্রের সঙ্গে…

এমন সময়ে বাজারের দিক থেকে, দুজন হাট্টা কাট্টা গাড়োয়ালি, হোটেলের অমিতাভর মতন নয়, এসে, গাড়োয়ালিতে চন্দ্রবদনীর সঙ্গে কী সব কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলে হোটেলের দিকে চলে গেল। একজনের কাঁধে একটি বড় থলে।

চন্দ্রবদনী বলল, চলুন এবারে বড় রাস্তা ছেড়ে আমাদের পাথরে বাঁধানো পাকদণ্ডী ধরে উঠতে হবে। কষ্ট হবে যদিও আপনার। তবে

তবে কি?

দুপাশের দৃশ্যে মন ভরে যাবে, চোখ প্রফুল্ল হবে।

বাঃ।

এবারে আমরা পিচ রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ঝুলন্ত-পুল পেরোব পায়ে হেঁটে। চলুন।

এই পথই গেছে বদ্রীনারায়ণ?

হ্যাঁ।

অলকানন্দা যে পথে এসেছে উপর থেকে সে দিকেই গেছে বদ্রীনাথের পথ। আর মন্দাকিনীর পাশ দিয়ে গেছে কেদারনাথের পথ। সামনেই কিছুটা গেলে দুই নদীর সঙ্গম। সেখানে এক বিরাট পাথর আছে। তার নাম নারদ শিলা। নারদ মুনি নাকি সেখানে বসে বীণা বাজাতেন।

আপনি এসব বিশ্বাস করেন? চারণ বলল।

করতে ক্ষতি কি? যিশুখ্রিস্ট বেথেলহম-এর কোন খামারবাড়িতে জন্মেছিলেন, মহম্মদ হাতেমতাই-এর উপরে কি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, বকর-ঈদ-এর ইতিহাস কি? তা যদি বিশ্বাস করি, লেনিন বা স্টালিনের দাড়িতে কটি চুল ছিল তাও যদি গুনে রাখতে পারি, তাহলে হিন্দুদের দেবদেবী, পৌরাণিক কাহিনীই বা কেন অবিশ্বাস করতে যাব?

তারপরে চন্দ্রবদনী বলল, এবারে তো মোটে একটি রাতই থাকবেন এখানে। কাল ভোরেই তো চলে যাব আমরা। তাই এবারে হবে না। কিন্তু পরের বার এলে আপনাকে কোটিশ্বর শিবের গুহাতে নিয়ে যাব।

সেটা কোথায়? তাছাড়া আমি তো কোনও মন্দির টন্দিরের ভিতরে যাই না। কোনও দেব-দেবী মানি না আমি। তবে ঈশ্বর নামক কোনও অদৃশ্য কিন্তু অনুভূত শক্তি যে আছে তা মানি। হয়ত আমি মুর্খ বলেই। অবশ্যই মানি।

গোয়াতে গিয়ে আপনি পর্তুগিজদের গিজা দেখেননি? ইহুদিদের সিনাগগ? প্যারিসে গিয়ে নত্ৰদাম গিজা? লানডানের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি? তাহলে হিন্দুদের মন্দির এবং দেবদেবীদের উপরেই আপনার এই বিশেষ বিদ্বেষের বা তাচ্ছিল্যর কারণ কি? আর বিদ্বেষ এবং তাচ্ছিল্যই যদি থাকবে তাহলে দেবপ্রয়াগেই বা এতদিন কি করছিলেন? হৃষীকেশে? আপনি একটি প্যারাডক্স।

হাসি-হাসি মুখে যদিও বলল চন্দ্রবদনী কথাগুলি, কিন্তু চারণ বুঝতে পারল যে কথাগুলির মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ অবশ্যই জড়িত ছিল।

চারণ হেসে ব্যাপারটাকে লঘু করে বলল, বিদ্বেষ বলব না, বলা উচিত উদাসীনতা। এ বিষয়ে পরে কখনও বিশদ আলোচনা করা যাবে। স্বামী বিবেকানন্দের কথা দিয়েই আপনাকে আমার বক্তব্য বোঝাতে পারব আশা করি। তবে এখন কোটির শিব-এর মন্দিরের কথাই বলুন শুনি।

রুদ্রপ্রয়াগ শহর ছাড়িয়ে, যদি একে শহর আদৌ বলা চলে, চোপড়া বলে একটা জায়গার পথ ধরে মিনিট পনেরোও হাঁটতে হবে না। তারপর অলকানন্দার পাড় ধরে অনেকখানি নীচে নামতে হবে নদীর দিকে।

তারপর?

কোনও জনমানব নেই। শুধুই জলের শব্দ। পাখির ডাক। জলের উপরে রোেদ পড়ে ভিবজোর এর খেলা। সেখানেই সেই অনেক পুরনো শিবমন্দির। পাহাড়ের গায়ের গুহার মধ্যে অগণ্য শিবলিঙ্গ। কেউ তৈরি করেনি। মানে, কোনও মানুষে। প্রকৃতিই নিজে হাতে গড়েছেন। প্রত্যেকটি শিবলিঙ্গর রং আলাদা আলাদা। অলকানন্দার জল সমস্তক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি করে ভিজিয়ে দিচ্ছে সেই শিবলিঙ্গগুলিকে। সেই অন্ধকার গুহার মধ্যে চব্বিশঘণ্টা প্রদীপ জ্বলছে। সেই প্রদীপ শিখার আলোতেই দর্শন করতে হয়। রুদ্রপ্রয়াগের মানুষদের কাছে এই মন্দির অত্যন্তই পবিত্র। সবসময়েই খালি পায়েই ঢুকতে হয় সেখানে।

চারণ চুপ করে শুনল চন্দ্রবদনীর কথা।

কথা বলতে বলতে ওবা পাথরে-বাঁধানো আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে বেশ অনেকটা উপরে চলে এসেছে। পেছন ফিরে এবং বাঁদিকে চেয়ে দেখলে অলকানন্দার রূপ যেন ক্রমশই আরও খুলছে বলে মনে হয়। দূরত্ব সবসময়েই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং হয়তো রহস্যময়তাও ধার দেয়, মানুষ এবং প্রকৃতিকেও।

ভাবছিল, চারণ।

চারণ বলল, রুদ্রপ্রয়াগবাসীরা কোটিশ্বরের গুহার অগণ্য শিবলিঙ্গদের পুজো করেন এমন ভক্তিভরে দেবতাজ্ঞানে, আর যে মানুষ-দেবতাটি রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাবাঘটিকে মেরে, তাঁদের বাঁচিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে, তাঁকে কি একেবারেই ভুলে গেছেন এখানের বাসিন্দারা? তখন তো অন্য কোনও দেবতাই বাঁচাতে পারেননি সেই বাঘের পেটে যাওয়া প্রায় দেড়শ জন হতভাগ্য মানুষকে।

আদৌ নয়। চন্দ্রবদনী বলল।

তারপর বলল, রুদ্রপ্রয়াগের মানুষেরা অকৃতজ্ঞ নয়। সেই চিতাবাঘকে জিম করবেট সাহেব মেরেছিলেন গুলাবরায় চট্টির কাছেই, সেই বাঘেরই নখরাঘাতের চিহ্নবাহী পণ্ডিত-এর বাড়ির অদূরের একটি আমগাছে, বাতে বসে। সেদিন দুখের রাত পোহাল, নতুন দিন এল, স্বস্তির দিন, সুখের দিন। সে দিনটি ছিল দোসরা মে। ঊনিশশ ছাব্বিশ খ্রিস্টাব্দ। তারপরের বছর থেকে প্রতিবছরই দোসরা মে তারিখে মানুষখেকো যেখানে মারা পড়েছিল সেখানে এক মেলা বসে। তার নামই করবেট মেলা। সেই মেলাতে, রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘ-এর হাতে নিহত হওয়া প্রতিটি নারী ও পুরুষের উত্তরসূরীরা প্রতিবছর যোগ দিতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। তা তারা এখন যেখানেই থাকুক না কেন! পুরনো দিনের মানুষদের কাছে তো বটেই এবং তাঁদের মুখে গল্প-শোনা মাঝবয়সীদের কাছেও জিম করবেট সাহেবও তো এক দেবতাই। কুমায়ু ও গাড়োয়াল কখনওই ভুলবে না তাঁকে।

চারণ বলল, বাঃ অনেক উঁচুতে উঠে এসেছি তো! দাঁড়ান, দাঁড়ান! একটু। পেছন ফিরে একটু দেখি ভাল করে।

দেখুন!

বলে, চন্দ্রবদনী মুখ না-ফিরিয়েই দাঁড়িয়ে রইল। গ্রীবা একটু ডানদিকে হেলানো। কয়েকটি অলক আলতো হাওয়ায় ওড়াউড়ি করছে। তার গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ, চারধারের গাছগাছালির গন্ধ, ওক, হর্সচেস্টনাট, তোন, তাড় আরও কত নাম না জানা গাছের গন্ধর সঙ্গে কলুষহীন দেবভূমির এই একশভাগ পবিত্র পরিবেশের মধ্যে ফলসা রঙা শাড়ি-পরা চন্দ্রবদনীর দিকে তাকিয়ে চারণের হঠাৎই তুলির কথা মনে হল। তুলি দাঁড়িয়ে আছে বাঘমুণ্ডার হাতিগিজা পাহাড়ের পথের একটা সমকৌণিক বাঁকে। তার পরনেও ফলসারঙা শাড়ি ছিল।

তুলি বলেছিল, চ্যাটার্জি সাহেব, ওই যে দেখুন। ওই যে বড় বড় কালো পাথরগুলো দেখছেন, ওইখানেই হাতিরা সব প্রার্থনা করতে আসে। তাইতো এই পাহাড়ের নাম হাতিগিজা।

মনকে রুদ্রপ্রয়াগে ফিরিয়ে এনে চারণ বলল, আপনি পেছনে চেয়ে দেখবেন না একবার?

না।

কেন?

আমি পেছনে তাকাই না কখনও। কী জীবনে, কী পথে!

কেন? অমন ধনুকভাঙা পণ কেন?

পেছনে তাকালেই মানুষ পেছিয়ে পড়ে। সে কী কী অর্জন করেছে বা হারিয়েছে সেই সব ভাবনাতে মেদুর হয়ে যায় তার স্মৃতি। সেই মুহূর্তে, সেই দিনে তার আর নতুন কিছু করা হয় না। সামনে এগোনো হয় না। তাই…

বাঃ। মান্য যুক্তি। অবশ্যই! চারণ বলল।

ও দেখছিল, তুলির চেয়ে চন্দ্রবদনী অনেক লম্বা। শারীরিক উচ্চতাতে তো বটেই, হয়তো মানসিক উচ্চতাতেও। সে যে এই তুষারাবৃত হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গ চন্দ্রবদনী! তার মতন হবার সাধ্য আছে আর কার? সেই মুহূর্তে ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে নীচের আশ্চর্য সুন্দর নীলচে-সবজে-সাদা অলকানন্দার জলরাশি আর তার বিচিত্র রঙা সব নুড়িময়, বালুময় চরের দিকে চেয়ে চারণের মন তুলির স্মৃতি এবং চন্দ্রবদনীর উপস্থিতিতে আপ্লুত হয়ে উঠল।

নারীরা পুরুষের জীবনের কত বড় শূন্যতা যে পূরণ করেন, তা যদি সব নারীই জানতেন। চন্দ্রবদনীও কি জানে!

ভাবছিল, চারণ।

এখানে বসি?

বলেই, একটি বড় সাদা পাথরের চাঁঙ্গড় দেখাল চন্দ্রবদনীকে চারণ।

যেখানে আপনার খুশি। তবে এই পাথরটার উপরেই একটা মস্ত বড় বাঘ বসে থাকত জ্যোৎস্না রাতে, গরমের দিনে, আমি যখন ছোট ছিলাম। আমাদের শোওয়ার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেত। মা দেখাতেন, মনে আছে।

তারপর বলল, বসলেনই যখন, তখন আমিও আপনার পাশে বসি।

না, না। পাশে নয়, পাশে নয়।

চারণ বলে উঠল।

কেন? পাশ কি কারওকে ইজারা দিয়ে রেখেছেন?

না, তা নয়। পাশে থাকলে ভাল করে দেখা যায় না যে কারওকেই।

অদ্ভুত কথা। স্বামী-স্ত্রী, রাধা কৃষ্ণ, চিরদিন তো পাশাপাশিই থেকেছেন।

তা থেকেছেন। পাশাপাশি থাকলে অন্যদের পক্ষে তাদের দেখতে সুবিধা অবশ্যই হয়, কিন্তু তাদের দুজনের একে অপরকে দেখতে সুবিধা হয় কি আদৌ?

চন্দ্রবদনী হেসে ফেলল।

বলল, সত্যিই তো! কথাটা তো কখনও ভেবে দেখিনি। আপনার দেখার চোখ খুব ভাল।

আমার চোখের দেখাও ভাল।

আপনি তো চুকোরের মতন বললেন।

চুকোর?

হ্যাঁ। আমার ভাই।

কি বলে সে?

সে বলে, দ্যাখ দিদি। আমাকে তুই হেলা করিস না। একদিন দেখতে পাবি এই চুকোর শর্মাই গাড়োয়ালের সর্বকালীন সেরা লেখক বলে সারা ভারতবর্ষে গণ্য হবে।

ও লেখে বুঝি?

কী কবে না ও। গদ্য লেখে। গান গায়। ছবি আঁকে। বাঁশি বাজায়। চুকোর আমাদের গ্রামেরই শুধু নয়, এই পুরো তল্লাটের সবচেয়ে এলিজিবল ব্যাচেলর।

তা, তার সঙ্গে দেখার চোখ আর চোখের দেখার কি সম্পর্ক? চারণ জিজ্যেস করল।

না, এ কথা বলার কারণ, চুকোরের হাতের লেখা অসম্ভব খারাপ। তা নিয়ে চিরদিনই সকলেরই কাছেই ও গালমন্দ খেয়ে এসেছে। অন্যদের কিছু বলতে পারে না। যা বলার তা ওর একমাত্র দিদিকেই বলে।

কি বলে?

বলে, হাতের লেখা কার কেমন সেটা টোটালি ইরেলিভেন্ট দিদি! কার লেখার হাত কেমন সেটাই আসল কথা! কত মূর্খ আমি দেখেছি এযাবৎ যাদের হাতের লেখা মুক্তোর মতন। আরও কত মুখ দেখেছি, যাদের ব্যাকরণের জ্ঞানও অসীম। যাদের হাতের লেখা ভাল তারা ইচ্ছে করলেই ভাল পোস্টার বা সাইনবোর্ড লিখিয়ে হতে পারে। আর যাদের ব্যাকরণের জ্ঞান গভীর তারাও ইচ্ছে করলে শ্রীনগরের বা নিদেনপক্ষে যোশীমঠের স্কুলের ব্যাকরণের মাস্টারমশায় হতে পারে। তাদের সঙ্গে একজন লেখকের তফাৎ আছে। লেখক যে, যেমন আমি, সে চেষ্টা করলে তার হাতের লেখা ভালও করে ফেলতে পারে কিন্তু পোস্টার বা সাইন-বোর্ড লিখিয়ে বা বৈয়াকরণ কস্মিনকালেও ইচ্ছে করলেই লেখক হয়ে উঠতে পারে না। লেখক হতে হলে উপরওয়ালার আশীর্বাদ লাগে। কেউ কেউ লেখক হয়েই জন্মায় রে দিদি আমার মতন। চেষ্টা করে ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায়, কিন্তু চেষ্টা করে লেখক বা কবি কখনওই হওয়া যায় না।

ঠিকই তো বলেছে চুকোর। চারণ বলল।

তারপরই বলল, চুকোর তো একরকমের পাখি, না? চকোরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে কি?

চন্দ্রবদনী হেসে ফেলল বলল, আপনি দেখছি পাটনের চেয়েও ছেলেমানুষ। চকোর-চকোরী তো জলের পাখি। হাঁস, একরকমের। আর আপনার চুকোর একরকমের Patridge।

Patridge মানে?

সমতলভূমির তিতিরও Patridge Family-রই। আমাদের চুকোর সমতলের কাসি তিত্বর, রঙ্গিলা তিত্বরেরই মতন। ওই প্রজাতিরই পাখি।

দেখতে কেমন?

কী বলব! ছাই-ছাই- গোলাপি-গোলাপি- খয়েরি-খয়েরি। লেজের শেষদিকটা চেস্টনাট রঙের। মাথার দুপাশে কালো দাগ আছে। দাগটা দুপাশেই ঘাড় অবধি নেমে গেছে। পেটের ও পিঠের পাশও কালো কালো স্ট্রাইপ। মাথার দুপাশ ও ঘাড় বেয়ে যে কালো দাগ নেমেছে তা বুকের কাছে পৌঁছে জোড় লেগে যাওয়াতে ব্রেসলেট-এর মতন দেখায়।

বাঃ।

এই Patridge, হিমালয়ের এই সব অঞ্চলেই পাওয়া যায়। কুমায়ুনেও। এর নামের উচ্চারণ কিন্তু চুকোর নয়, চুকার। ইংরেজি নামও তাই। Chukar।

ভাইয়ের নাম চুকার রাখলেন কে?

আমিই। বাবা ওর নাম রেখেছিলেন বদ্রীপ্রসাদ। মানে, বদ্রীনাথজির প্রসাদ আর কী। মা রেখেছিলেন আমার নাম, তাই ভাইয়ের নামের ব্যাপারটা বাবাকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমিই স্কল-লিভিং-সাটিফিকেট পরীক্ষার আগে ওর নাম বদলে চুকার করে দিই। ওর ভীষণই আপত্তি ছিল বাবার দেওয়া নামে। বাবা জানতে পেরে রাগ করাতে, ও বলেছিল, বাবার নাম থোড়াই বদলেছি। বদলেছি তো নিজেরই নাম।

বাবা ওর কথা শুনে হেসে ফেলেছিলেন।

চুকার বলত, বদ্রীনাথজির ছায়াতেই তো থাকি আমরা। নামের মধ্যেও তাঁকে না জড়ালে কি চলে না!

তা এত নাম থাকতে চুকারই বা কেন? পাখির নামে নাম কেন?

চারণ বলল।

চন্দ্রবদনী হেসে বলল, কারণ একটা ছিল অবশ্য। ভাই যখন ছোট ছিল ও ডাকত ঠিক মন্দা চুকার-এর মতন।

মানে?

অবাক হয়ে বলল চারণ।

মানে, চুকার যখন ডাকে, আপনাদের সমতলের তিতিরেরই মতন।

তিতিরের ডাক কেমন?

আমি শুনিনি কখনও।

আঃ আপনাদের নিয়ে পারা যায় না। কলকাতার ইট-কংক্রিটের কীট আপনারা। এইসব পাহাড়ের নীচে নামলেই বটেই, বিহারে, উত্তরপ্রদেশে মধ্যপ্রদেশে, তিতিরে তিতিরে ছয়লাপ। তিতির ডাকে চিহা চি চি চি চি চিহা করে। বাবা যখন দেরাদুনে পোস্টেড ছিলেন তখন আমাদের বাংলোর হাতার মধ্যেই যে কত তিতির ছিল কী বলব। সকাল সন্ধেতে তাদের ডাকে মাথা গরম হয়ে যেত। একসঙ্গে এবং খুব ঘনঘন সমান গতিতে অনেকবার ডাকে তিতিরেরই মতন চুকারও। মন্দা চুকাব তো ডাকে বার কুড়ি, একবার ডাকতে শুরু করলে, ভাইও ডাকত দিদি! দিদি! দিদি! দিদি! দিদি! অথবা, মা! মা! মা! মা! মা! মা!

চারণ হেসে ফেলে বলল, তাই?

হ্যাঁ। তাই চুকার।

চন্দ্রবদনী বলল।

তারপরেই উদাস হয়ে গিয়ে বলল, কী যে হবে ভাইটার আমার! ভীষণ জেদি, একরোখা অথচ ভাবালু, আদর্শপরায়ণ। ওর মতন ছেলের এই সময়ে, এই দেশে বেঁচে থাকাই মুশকিল।

চারণ বলল, ওর মতন অনেক ছেলেরই তো দরকার এই মুহূর্তে আমাদের দেশে।

চন্দ্রবদনী উদাস হয়ে গেল। তারপরে চুপ করে চেয়ে রইল নীচের অলকানন্দার দিকে।

ওর শাড়ি সরে গেছিল বুকের পাশ থেকে। চারণের অসভ্য চোখ দেখল, বেগুনি ব্লাউজে-ঢাকা বগলতলি ঘামে ভিজে গেছে। সেদিকে হঠাৎই চোখের ঝলক পড়তেই হঠাই এক তীব্র কামভাবে জর্জরিত হল চারণ। পরক্ষণেই লজ্জা পেল। পুরুষমাত্রই কি অসভ্য? নিজেই নিজেকে নিরুচ্চারে বকে দিল খুব করে। বলল, ও ও ও দুই ছেলে? একী অসভ্যতা! ভীষণ শাস্তি দেব। নিজেকে বকল, যেমন করে চারণের মা ওকে বকতেন। ভাবল, দুমাস সাধুসঙ্গে থেকে উন্নতির এই রকম!

এক সময় চন্দ্রবদনী বলল, চলুন এবারে ওঠা যাক।

চারণ বলল, চলুন।

বেশ অনেকটা উঠে এসেছে ওরা। এখন উপরে দেখা যাচ্ছে চন্দ্রবদনীদের গ্রাম, নানা গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে। রোদ-ঝলমল। সবে ধান উঠেছে, থাকে-থাকে Teracing-করা ক্ষেতে ক্ষেতে। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে খড়ের গাদা। এই পাহাড়ি খড়ের গাদার রকম সমতলের গাদার মতন নয়। পাহাড়ি ছাগল ডাকছে এদিক-ওদিক থেকে। এখানের গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ অন্যরকম। পাখ-পাখালিও সমতলের মতন নয়। কোথায় কোন অদৃশ্য জায়গাতে বসে কোনও রাখাল ছেলে ভেড়ার পালের ওপরে নজর রাখতে রাখতে বাঁশি বাজাচ্ছে গাড়োয়ালি গানের সুরে। ভারী ভাল লাগছে চারণের।

নীচ দিয়ে যে পথ চলে গেছে, একটি কেদারনাথের দিকে আর অন্যটি বদ্রীবিশালের দিকে, অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর ধারে ধারে, সেই সব পথ বেয়ে প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী জয় কেদার জয় বদ্রীবিশাল ধ্বনি দিতে দিতে চলে যান তাঁরা জানেনও না যে, সেই সব পথের দুপাশেই পর্বতগাত্রের উপরে উপরে তাঁদের চোখের আড়ালে এরকম অনেকই গ্রাম আছে। জনপদ। এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে যাবার পায়ে-চলা পথ আছে পর্বতের মাথায় মাথায়, উপত্যকায়, মালভূমিতে, উতরাই ও চড়াইয়ে, অমিতাভর বর্ণনানুযায়ী, সরগুজা, মাক্তি, গে, জ, সাট্টি, ঝাঙ্গোরা, নারাঙ্গি, মালটা, চাকোতরা আর যোশিমারি আলুর ক্ষেত পেরিয়ে এবং সিলভার ওক, ধুপি, ওয়ালনাট, নানারকম পাইন, আরুপাটে ইত্যাদি আরও কত গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়। এইসব গ্রামে গ্রামে সুগন্ধি বনপথে আর রোদ ও চাঁদের আশীর্বাদধন্য উঠোনে উঠোনে যুবক-যুবতী ভালবাসে একে অপরকে, বিয়ে করে, সংসার করে। তারপর একদিন তারাও বুড়ো হয়ে যায়। বহুবর্ণ লেপের জামা আর পেতলের নথ আর দুল পরে জ্যাবজ্যাবে করে সিঁদুর মেখে বুড়ি পিঠ দিয়ে বসে নতুন-আসা নাতির জন্যে গাঢ় গোলাপি রঙা উলের গাছি উঠোনে এলিয়ে সোয়েটার বোনে। আর বুড়ো দুহাতে তার হৃত-ক্ষমতার শেষ প্রতিভূ কালো থেলো-হুঁকোটি ধরে গুবুক-গাবুক শব্দ করে তার ক্ষেতের পাথরের দেওয়ালে রোদে পিঠ দিয়ে বসে তামাক খায়।

ভারী খুশি, ভারী আনন্দ এই আকাশে বাতাসে। এই সকালের রোদে। বড়ই ভাল লাগছে এখন চারণের। হয়তো চন্দ্রবদনীর সঙ্গও ভাললাগার একটা বড় কারণ। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া অলকানন্দা এবং মন্দাকিনীর উপরে রামধনু-তোলা চোখ-ধাঁধানো সূর্যালোকের দিকে তাকিয়ে ও ভাবছিল, ভাগ্যিস এসেছিল চন্দ্রবদনীর সঙ্গে। নইলে গাড়োয়ালের বুকের কোরকের মধ্যের এই, প্রাণের প্রাণ যে অজানাই থাকত!

এমন সময়ে পেছনে কাদের পায়ের শব্দ ও গলার স্বর শোনা গেল। পেছন ফিরে দেখল চারণ যে পাঁচ-ছজন নারী-পুরুষ উঠে আসছে উপরে, পাথরের পাকদণ্ডী বেয়ে রুদ্রপ্রয়াগ বাজার থেকে। তাদের মধ্যে চন্দ্রবদনীর সেই দুজন লোকও ছিল।

গাড়োয়ালিতে ওদের সঙ্গে কী সব সংক্ষিপ্ত দু-একটা কথা বলল চন্দ্রবদনী, কোমল আদেশের সুরে। তারা চারণদের ছাড়িয়ে টগবগিয়ে উপরে চলে গেল দেখতে-দেখতে।

চন্দ্রবদনী বলল, বসবেন না কি এখানে একটু। বসতে পারেন। আমার তাড়া নেই কোনও। আমার বড় পিসি এসেছেন চামৌলি থেকে। তিনিই আপনার জন্যে রান্না করছেন। ঠাকুমা নেই দাদু কিন্তু আছেন আমার। দাদুর বয়স তিরানব্বই। কিন্তু আপনার চেয়েও ফিট। গ্রাম থেকে বাজারে আসেন সপ্তাহে তিন-চারদিন। টানটান মেরুদণ্ড। ইংরেজ সাহেবদের মতন অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলেন। সপ্তাহে একবার শ্রীনগরেও যান বইয়ের দোকানে এবং লাইব্রেরিতে।

বলেন কি? নাঃ। দেখি, আপনাদের গ্রামে গিয়ে কেমন লাগে। পছন্দ হলে, বাকি জীবন ভাবছি। এখানেই থেকে যাব।

তারপরই বলল, আপত্তি আছে?

আমি কে আপত্তি করার? জীবন আপনার ইচ্ছে আপনার, সময় আপনার, মন যা চায় তাই করবেন। তবে বড় শহুরেদের এই ভাবনাটাও একটা বিলাস। কল্পনার সাম্রাজ্যে তো কারও অধিকারই অন্য কেউ খর্ব করতে পারে না।

চারণ বলল। এখানে বসি?

ওরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। যতই রোদের তাপ বাড়ছে ততই আরাম লাগছে। পেছন থেকে ঘাড়ে রোদ এসে পড়াতে আরামে চোখ বুজে আসছে চারণের। প্রায় সন্ধে রাত থেকে সকাল অবধি ঘুমিয়েও যেন ঘুমের আশ মেটেনি। কোন মানুষের মধ্যে কত ঘুম যে জমে থাকে সে তা নিজেও জানে না। আর কষে দম-দেওয়া টেনশন-এর স্প্রিং কখন কোথায় যে একেবারে গা-এলিয়ে দিয়ে এলো-খোঁপার মতন unwinding process শুরু করবে তাও আগে থাকতে জানা পর্যন্ত যায় না। এই মনুষ্য-শরীর বড়ই দুর্জ্ঞেয়। কী নারীর শরীর, কী পুরুষের! এ এক বিচিত্র ঘড়ি। কোনওটা ব্যাটারিতে চলে, কোনটা বা স্প্রিং-এর। কোনওটাতে ক্লকওয়াইজ দম দিতে হয়, কোনওটাতে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। অথচ আশ্চর্য! ইংরেজি শব্দটাই হচ্ছে ক্লকওয়াইজ। যে ব্যাটারিতে চলে সেই ব্যাটারি যে কখন ক্ষয়ে আসে তাও ছাই বোঝা যায় না আগে থাকতে। রিমোট কন্ট্রোলে কারও অদৃশ্য আঙুলের ছোঁয়াতে চলে শরীরী-ঘড়ি। অন্তত চারণের শরীরের ঘড়ি। কখন যে সে আপন খেয়ালে ফাস্ট হয়ে যায় আর আপন খেয়ালেই স্লো, তা আগে থাকতে বোঝা পর্যন্ত যায় না। কে জানে!

চন্দ্রবদনীর শরীরের ঘড়ি কেমন চলে! কিসে চলে?

ভাবছিল চারণ।

নিজের মনকে তাও বোঝে কিন্তু শরীরকে যে বোঝেনি কোনওদিনই। সে যে বড়ই আনপ্রেডিকটেবল। অবুঝ তার চাওয়া, অসহায় তো বটেই।

আশ্চর্য! এখানে বসে বসেই চন্দ্রবদনীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ওর তুলির কথা মনে হল। আর মনে হল, নিজের প্রথম যৌবনে লেখা দুছত্র কবিতার কথাও।

বার বার চেয়োনাকো কারও পানে।
প্রতিটি চাহনি জেনো
অজানিতে আসক্তি আনে।

চন্দ্রবদনীর প্রতি আসক্তি অবশ্য জন্মে গেছিল প্রথমবার হৃষীকেশ-এ ওর নাম উচ্চারিত হতেই। কিন্তু হিন্দুদের এই দেবভূমির পবিত্র গিরিশৃঙ্গর নামে যার নাম, তার দিকে চেয়েও চারণের মনে এমন কামভাব জাগছে কেন? চারণের শিক্ষা, রুচি, সাফল্য, মান, যশ সবই কি ভেক? মিথ্যা? তার শরীরের উপরেই যদি তার নিজের দখল নাও থাকে, মনের উপরে তো থাকবে দখল অন্তত! নইলে, কিসের শিক্ষার গুমোর ওর?

ভারী লজ্জা হল চারণের। ঘৃণাও হল খুব নিজের উপরে। তার সঙ্গে জানোয়ারের তফাৎ কোথায়? পুংলিঙ্গর সব প্রাণীই কি একইরকম মানসিকতার? তার শরীরী ক্ষুধায়? মানুষও কি ব্যতিক্রম নয়?

নিজেকে যে জানার অনেকেই বাকি সে কথাই আবার নতুন করে মনে হল।

তুলির ব্যাপারে ওর ভূমিকাটা passive ছিল। Active এবং Aggressive ভূমিকা ছিল তুলিরই। ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাকুইসেন্স, চারণ তাই দিয়েছিল। মৌন-সম্মতি। কিন্তু চন্দ্রবদনী তার শস্ত্রীর এবং মন দুইয়েরই উপরে এমন মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে এইটুকু সময়ের মধ্যেই যে, তার এই উদাসী হওয়ার উচ্চাশায় এই উদাসী হাওয়ার পথে বেরিয়ে এতদূরে আসা এবং সাধুসঙ্গে এতগুলো দিন কাটানো বৃথাই হল মনে হচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে বলে Back to square one, ওর অবস্থা একেবারেই সেরকম।

নিজের উপরে এক গভীর অনুকম্পা জন্মাল চারণের। ছিঃ। ছিঃ। বলল, নিজেকে।

কতক্ষণ সময় যে এই আত্মবিশ্লেষণে কেটে গেল, কে জানে। ততক্ষণ চন্দ্রবদনী যে কি ভাবছিল তাই বা কে জানে। মাঝে মাঝে সেও পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল চারণের দিকে। চোরা-চাউনি নয়। চন্দ্রবদনীর স্বভাব-চরিত্রে অন্দরবাহিরে চৌর্যবৃত্তির বা বক্রতার আভাস পর্যন্ত নেই কোনও। এমন পর্বতশিখরের মতন ঋজু স্বভাবের নারী চারণ আগে দেখেনি।

একসময়ে স্বগতোক্তিরই মতন চন্দ্রবদনী বলল, আমাদের বাড়িতে গিয়ে আপনি ধন্দে পড়বেন কিন্তু। ধন্দই বলব শব্দটিকে। আগেই বলে রাখা ভাল।

কেন? কিসের ধন্দ?

মা তো নেই আমার। মা থাকলে আপনার কোনও অসুবিধেই হত না। মা তো শুধুমাত্র বাঙালিই ছিলেন না। আমার মায়ের মতন Effiminate Feminine আমি আর দেখিনি। শিক্ষিতা বাঙালিনীর আদর্শ প্রতিমূর্তি ছিলেন। শিক্ষায়, রুচিতে, সংস্কৃতিতে, আচারে ব্যবহারে, চলায় বলায়। আমি ছিটেফোঁটাও গুণ পাইনি আমার মায়ের। রূপও পাইনি। মা ছিলেন ব্রাহ্ম। বাবা হিন্দু। ঠাকুর্দা বৌদ্ধ। আবার এমনি বৌদ্ধ নন। তিব্বতী বৌদ্ধ।

তারপর বলল, আমার মায়ের মতো অ্যাডভেঞ্চারাস বাঙালি মহিলাও আমি কমই দেখেছি। মানে, ভালবাসার ব্যাপারে। নইলে শান্তিনিকেতনে মানুষ হয়ে এমন এক পরিবারে, এই উত্তুঙ্গ গিরিশিখরে জীবন কাটাতে একটুও দ্বিধা কি করতেন না?

আপনার মা যে অমন সাহস করেছিলেন তার পেছনে আপনার বাবার ভূমিকাও নিশ্চয়ই অনেকখানি ছিল। যেমন-তেমন পুরুষের জন্যে কোনও নারীই অমন ঝুঁকি নিতে পারতেন না।

চারণ বলল।

তারপর বলল, বৌদ্ধদের মধ্যে হীনযান, মহাযান এইসব বিভাগের কথাই জানতাম। তিব্বতী বৌদ্ধরা কি অন্য কোনওরকম?

হাসল, চন্দ্রবদনী।

বলল, তা নয়। সে সব তো আছেই, থাকেই। তিব্বতের দালাই লামাকে যাঁরা মানেন, তাঁরাই তিব্বতী বৌদ্ধ। তাঁদের সঙ্গে জাপানের বৌদ্ধ ও ভারতের সমতলের বা দার্জিলিং বা সিকিম বা ভুটানের বৌদ্ধদের সঙ্গে কিছু তফাৎ আছে।

তারপরে বলল, আপনি Zen ধর্মের নাম শুনেছেন?

অবশ্যই।

তিব্বতী বৌদ্ধদের সঙ্গে Zen-এর কিছু কিছু মিল আছে। আপনার যদি ইন্টারেস্ট থাকে, তাহলে ঠাকুর্দা আপনাকে বুঝিয়ে দেবেন। উনি তিব্বতে ছিলেন বছর পাঁচেক, চাইনিজ অ্যাগ্রেশানের আগে পর্যন্ত। দারুণ ইন্টারেস্টিং মানুষ।

কী করে বোঝাবেন ওসব আমাকে? মানে, কোন ভাষায়?

বাঃরে! আপনাকে বললাম না যে, ঠাকুর্দা ইংরেজদের মতন অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলেন। জিম করবেট সাহেবের বন্ধু ছিলেন। সারা পৃথিবীতেই যে কত তাঁর বন্ধু ছিলেন। আমরা রুদ্রপ্রয়াগে থাকি বলে আমাদের হেয় করবেন না মশাই। গেঁয়োও ভাববেন না যেন।

ছিঃ! আমি কি ইডিয়ট? চারণ বলল।

তারপর চন্দ্রবদনীকে বলল, দেখুন! আপনাকে দেখেই আপনার পরিবার সম্বন্ধে একটি মোটামুটি ধারণা করা যায়। আমি বুদ্ধ তো নই! বৌদ্ধ না হতে পারি।

ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি, তিব্বতী বৌদ্ধদের মধ্যেও নানারকম মত-পার্থক্য আছে, মানে বিভিন্ন Relegious schools, যেমন সব ধর্মের মধ্যেই থাকে।

যেমন?

যেমন, লঙ্গচেম্পা, নাগার্জুনা, শান্তিদেভা, অতীশ..

অতীশ? মানে অতীশ দীপঙ্করের মতাবলম্বী?

ঠিক তাই। আরও আছে, সং খাপা। আপনার ইন্টারেস্ট থাকলে ঠাকুর্দা সব বুঝিয়ে দেবেন।

আপনার মা কি গোঁড়া ব্রাহ্ম ছিলেন?

চারণ জিজ্যেস করল।

ব্রাহ্মধর্মও তো একটি আলাদা ধর্ম। তবে সবচেয়ে ভোলামেলা, উদার, Minimum Rituals-এর ধর্ম। হিন্দুধর্মের মতন এতরকম Rituals সম্ভবত আর কোনও ধর্মেই নেই। তাহড়া, আপনার তো গোঁড়া শব্দটার মানে জানার কথা। গোঁড়ামি, কোনও ধর্মেরই মান বাড়ায় না। গোঁড়ামির বীজ সুপ্ত থাকে অশিক্ষারই মধ্যে, কুপমণ্ডুকতার মধ্যে। হিন্দুদের মধ্যেও তো গোঁড়া হিন্দু আজকাল নেইই বলতে গেলে।

তারপর বলল, একটা সময় পর্যন্ত বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বড়মানুষ ছিলেন তাঁদের অধিকাংশই তো হয় ব্রাহ্ম নয় ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন।

তাই?

যেমন, রামমোহন রায়, ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা,চিত্তরঞ্জন দাস, সুকুমার রায়, ড. বিধান রায়, আরও কত নাম বলব।

তা ঠিক। তবে ব্রাহ্মদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ইদানীংকালের ছেলেরা বোধহয় একটু নিষ্প্রভ। তাই না? অধিকাংশ মেয়েরাই তো বিয়ে করে দেখি অন্য ধর্মাবলম্বী ছেলেদের।

আজকাল ধর্ম মানেই বা কজন? নিজস্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও ধর্ম কি আর আদৌ আছে?

তা যা বলেছেন।

তারপর বলল, হিন্দুধর্মের মতন এমন ভেদবোধ অন্য কোনও ধর্মেই নেই। বিরাদরী ব্যাপারটাই নেই হিন্দুধর্মে। যেমন আছে ইসলাম-এ।

তা আছে। তবে ওই বিরাদরী, ইসলাম-এর Virtue যেমন, তেমন আবার Vice-ও। আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে, ইরানের খোমেইনি বা দিল্লির শাহী ইমামের ভাবভঙ্গি দেখে।

চন্দ্রবদনী বলল।

চারণ বলল, আস্তে বলুন। এই জন্যেই হয়তো আপনাকে কোতল করার ফতোয়া জারি হতে পারে। কুপমণ্ডুকতার একটা সীমা সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই থাকা দরকার বলে মনে হয় আমার।

ঠিকই তাই। হিন্দুধর্ম একটি Confused Mass-এর সংজ্ঞা যেন। ইসলাম-এর বিরাদরীর Antithesis! সাধারণে এবং অল্পশিক্ষিতরা এই Rituals-এর গোলোকধাঁধার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে মরে। বৈতরণী পেরুনো আর হয় না। পরস্পরবিরোধী মত ও পথে হেঁটে মরে। হিন্দুধর্মকে আজকাল আর কোনও Binding Force-এর মধ্যেই গণ্য করা যায় না। কিন্তু হিন্দুধর্মের এই সব জাফরি ভেঙেই তো ব্রাহ্মধর্মের জন্ম।

চন্দ্রবদনী বলল, হিন্দুধর্মের মধ্যে জাতপাতটা খারাপ। খুবই খারাপ। কিন্তু এই ধর্মাবলম্বীরা অন্য সব ধর্ম সম্বন্ধে যতখানি ঔদার্য পোষণ করে ততখানি অন্য কম ধর্মাবলম্বী করেন।

চারণ বলল, হিন্দুদের ব্রাহ্মরা কি একটু ছোট চোখে দেখেন না?

কেউ কেউ হয়তো দেখেন। তাঁরা সৎ ব্রাহ্ম নন। উদারও নন। আবার যে সব হিন্দু ব্রাহ্মদের ছোট চোখে দেখেন তাঁরাও সৎ হিন্দু নন। কোনও ধর্মই তো কোনও গন্তব্য নয়। সব ধর্মই এক একটি Means মাত্র।

ঠিকই বলেছেন। চারণ বলল।

তারপর বলল, তাঁর জামাই নগেন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি কিছুদিন আগে পড়েছিলাম দেশ পত্রিকাতে। রবীন্দ্রনাথ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মের সম্পর্কে কয়েকটি খুব দামি কথা বলেছিলেন সেই চিঠিতে। ঠিকঠাক মনে নেই কিন্তু যতদূর মনে আছে, তা সম্ভবত এইরকম।

কি বলেছিলেন?

চন্দ্রবদনী আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ কি বলেছিলেন যে আমরা হিন্দু?

ঠিক তা বলেননি। তবে অনেকটা তাই। শুনুন আগে।

বলুন।

বলেছিলেন, আমরা হিন্দু। আমাদের কোনও প্রাচীন ইতিহাসের বন্ধন নেই কোন প্রাচীন সমাজের ভিত্তি নেই আমরা হঠাৎ মুহূর্তকালের বুদ্ধু দের মত স্ফীত হয়ে উঠেছি এমন অদ্ভুত দীনতা আমরা প্রচার করতে পারব না। হিন্দুসমাজ যে মৃত পদার্থ নয় তার মধ্যে নবভাবস্রোত শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে পারে, ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্বই তার প্রমাণ। হিন্দু সমাজ যদি মৃত হত তবে ব্রাহ্ম সমাজকে সে প্রসব করতেই পারত না। সেই কথা মনে রেখে ব্রাহ্মসমাজকে হিন্দু সমাজের নবতর পরিণতি বলে আমরা যেন গৌরব করতে পারি। আমরা হিন্দুসমাজের জীবন থেকেই উদ্ভূত এবং এই পিতৃঋণ আমাদের শোধ করতে হবে।

আর? চন্দ্রবদনী বলল।

আরও অনেক কথা লিখেছিলেন। পড়ে, খুব ভাল লেগেছিল।

তারপর মুগ্ধস্বরে বলল, জানেন, রবীন্দ্রনাথ পড়লেই বুঝি, তাঁর চিঠিপত্র, শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালা, তাঁর গান শুনলে যে, মানুষ হিসেবে তাঁর তুলনাতে আমরা কত ছোট। কত সামান্য আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধিশুদ্ধি।

তা ঠিক।

কী ভাল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন আপনি! সত্যি! আমার গলাতে যদি বিধাতা একটুও সুর দিতেন।

চন্দ্রবদনী বলল, একলা গায়কের নহে তো গান। সকলে গাইলে শুনবে কে? আজকাল যেমন হয়েছে! ক্যাসেটের বিজ্ঞাপন দেখলে তো মনে হয় দেশের যত কাক চিল ব্যাঙ ইঁদুর সকলেই গায়ক হয়ে গেছে। ভাল শ্রোতার ভূমিকা গায়কের ভূমিকার চেয়ে একটুও খাটো নয়। ছিল না কোনওদিনই।

তারপর বলল, আমার তো মনে হয় রাবীন্দ্রিকও একটি ধর্মই। আমার মাও একথা বলতেন। তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মরই মতন ব্রাহ্মধর্মর মধ্যেও রবীন্দ্রিক একটি আলাদা বিভাগ। School.

ঠিকই হয়তো বলতেন আপনার মা।

হঠাই চন্দ্রবদনী উঠে পড়ে বলল, চলুন, এবারে আমরা উঠি। নইলে, পিসি আবার চিন্তা করবেন। আপনার জন্য ব্রেকফাস্টও করতে চেয়েছিলেন। আমিই নিবৃত্ত করে এসেছি। সেই ক্ষোভটা দুপুর আর রাতের খাওয়াতে পুষিয়ে নেবেন।

তারপর বলল, যারা ভাল খেতে না পারে, তারা আমার চামৌলির পিসির দুচোখের বিষ। আমার স্বামী এই কারণেই পিসির খুবই প্রিয় ছিল। ওর আকস্মিক মৃত্যুটা আমার যত না বেজেছে আমার ঠাকুর্দা, বাবা ও পিসিকে বেজেছে তার চেয়েও বেশি। মা তো চলে গিয়ে বেঁচেই গেছেন।

আর চুকারের?

চুকারের কোনও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখর বোধই নেই। অনেক বছরই হল ও সে সব বিসর্জন দিয়েছে। ও-ও শ্যামানন্দজিরই মতন এক সন্ত। হয়তো রবীন্দ্রনাথেরও মতন। যাঁরা প্রকৃত বড় মাপের মানুষ হন তাঁদের কোনও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ থাকে না। সুখকে তো বটেই সব দুঃখকেও তাঁরা আত্মস্থ করে নেন। তাঁরা তাঁদের পরিবারের কেউ নন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারওকেই তাঁদের প্রয়োজন হয় না। যে-ব্ৰততে জীবনযাপন করতে এসেছেন তাঁরা, সেই ব্ৰততেই জীবন নিবেদিত করেন। আমার ছোট ভাই হলে কি হয়, চুকারও সেই জাতের মানুষ। ওর প্রকৃতি, Material-ই আলাদা। আমাকে দেখে চুকারের সম্বন্ধে কোনও ধারণাই আপনি করতে পারবেন না। আমি অতি সাধারণ আর ও অসাধারণ।

চলুন, ওকে দেখলে, ওর সঙ্গে আলাপ হলেই বুঝবেন। পাটনের সঙ্গে ওর খুবই বন্ধুত্ব। পাটনও কিন্তু অসাধারণ ছেলে। ওই বয়সী খুব কম ছেলের মধ্যেই অমন গভীরতা দেখেছি।

গভীরতা তো আর বয়স নির্ভর নয়। অনেকে, আমারই মতন, বুড়ো হলেও অগভীরই থাকে। আবার যখন শাক্যসিংহ সংসার ছেড়েছিলেন তখন তাঁর বয়স কত ছিল? স্বামী বিবেকানন্দ কতদিন বেঁচেছিলেন?

তা ঠিক। চন্দ্রবদনী বলল।

তারপর বলল, তা যেমন ঠিক, বিনয় যেমন গুণ বলে মান্য, অতিবিনয় কিন্তু আদৌ গুণ নয়, দোষ। অতি-বিনয়ী মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু দুর্বিনীত!

তাই? আপনার ধারণা? হেসে বলল, চারণ।

হ্যাঁ। আপনি কিন্তু অতি-বিনয়ী। চন্দ্রবদনী বলল।

আরও অনেকখানি উঠে এসেছে ওরা। এইখানের পরিবেশ যেন দুই নদীর প্রয়াগের থেকেও নির্মল। সম্পূর্ণ কলুষহীন। এইখানে কোনওদিনও, আশা করা যায়, পেট্রল বা ডিজেল-এর পোড়া-গন্ধ ওড়ানো কোনও যানবাহন আসবে না। একেকবারের নিশ্বাসে যেন নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছে চারণের ভিতরে।

চন্দ্রবদনীদের বাড়ি পৌঁছে সকলের সঙ্গে আলাপিত হয়ে নানারকম গল্পটল্প করে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে দুটো বেজে গেল। অভিনব পরিবেশ এবং নিবিড় আন্তরিকতাতে মুগ্ধ হল চারণ।

বিয়ে ও করেনি। কোনওদিনও করবে কিনা তাও ঠিক নেই কিন্তু মনে মনে বলল, কোনও পুরুষের শ্বশুরবাড়ি যদি কখনওই হয়, তবে যেন এমনটিই হয়! নারীরা হয়তো জানেনও না যে, তাঁদেরই মতন প্রত্যেক পুরুষেরই মনে তাঁদের শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে একধরনের প্রত্যাশা ও কল্পনা থাকেই। সেই প্রত্যাশা পূরিত না হলে নারীদেরই মতন আশাভঙ্গতাজনিত গভীর এক কষ্টবোধ প্রত্যেক পুরুষকেও পীড়িত করেই।

কী আদর! কী আদর! চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দার তো কোনও তুলনাই নেই। মুখে সবসময়েই এক ফালি স্মিত হাসি হলুদ ফানুসেরই মতন ঝুলে আছে। কথা বলার সময়ে সেই ঈদের-চাঁদ হাসি হঠাৎই কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে যায়। আর কী গভীর পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান মানুষটির! জ্ঞান যেখানে গভীর সেখানেই সাধারণত তাকে বদ্ধ বলে মনে হয়। মনেই হয়। আসলে সেই বদ্ধতার গভীরতা চারণের মতন সাধারণ মানুষদের অনুমেয়ই নয়। অগভীর মানুষেরাই পুঁটিমাছের মতন অল্প জলে ফরফর করে। তেমন মানুষদেরই শহুরে চারণ বেশি কাছ থেকে দেখেছে। কেশর সিং সাহেবের মতন প্রকৃত স্থিতপ্রজ্ঞ জ্ঞানী অথচ সংসারী মানুষ বেশি তো দেখেনি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জ্ঞানের এবং স্থৈর্যের যেন এক বিশেষ সম্বন্ধ আছে বলে মনে হয় চারণের। ওঁ মণিপদ্মে ম এই মুখ্য ধ্বনিই বৌদ্ধ-তীর্থর চারপাশে অনুরণন তোলে। বোধি বা জ্ঞান লাভ করার পরই শাক্যসিংহ বুদ্ধ হয়েছিলেন তাই বোধহয় তাঁর অনুরাগীদের হাঁটা চলা কথা বলা সবকিছুর মধ্যেই এক বিশেষ ধরনের স্থৈর্য ও আড়ম্বরহীনতা লক্ষিত হয়।

চন্দ্রবদনীর দাদু পৃথিবীর সমস্ত সময়টুকুই যেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী লামাদের লাল বা হলুদ জোব্বার পকেটে তিনি বন্দি করে রেখেছেন। কোনও কিছুতেই বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। না, জন্মানোতে, না বড় হয়ে ওঠাতে, না মৃত্যুতে। রোগ, জরা এবং মৃত্যুকে জয় করার সাধনাই যে রাজপুত্র শাক্যসিংহের সাধনা ছিল!

চন্দ্রবদনীর চামৌলির বড় পিসিমারও তুলনা নেই। বড়ি বুয়া এই নামেই ডাকছিল তাঁকে চন্দ্রবদনী। সর্বজনীন মাতৃমূর্তি যেন! সদাহাস্যময়ী অথচ লাস্যহীনা। তাঁকে প্রথম দর্শনেই দেখে চারণের দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একখানি আগমনী গানের বাণী মনে পড়ে গেছিল

শারদ সপ্তমী উষা গগনেতে প্রকাশিল।
দশদিক আলো করে আমার দশভূজা মা আসিল।… পু
লকে ভরিল হিয়া শঙ্খ ঘণ্টা বাজাইয়া
চল সখী উলু দিয়া বরণ করো
মা আসিল।

মানুষীর মধ্যে যদি জগন্ময়ী মূর্তি কেউ দেখতে চান তবে এই রুদ্রপ্রয়াগ বাজারের অনেক উপরের এই গ্রামে এসে চন্দ্রবদনীর বড়ী বুয়াকেই দেখে আসতে হবে।

চন্দ্রবদনী বলল, বড়ি বুয়ার রান্নার উৎকর্ষ অথবা পদ দেখে কিন্তু একবারও ভাববেন না যে, আমরা রোজই এইরকমই খাই। আমরা খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই মাড়োয়ারি-গুজরাটিদেরই মতন সিম্পল। আমার মা এই ব্যাপারটাকে খুবই অ্যাপ্রিসিয়েট করতেন। সে কোটিপতিই হন আর দীনদরিদ্র, মাড়োয়ারি-গুজরাটি এবং দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যেও কিন্তু বাঙালিদের মতন অমন খাওয়ার পটি নেই। রান্না করতে আর খেতেই যদি দিনের আট ঘণ্টা চলে যায় তাহলে অন্য কাজ করা যাবে কখন? শুধু খাওয়ার জন্যেই তো এখানে আসা নয় মানুষ জন্ম নিয়ে!

আমার ঠাকুর্দা তো বটেই, বাবাও Plain living and high thinking-এ বিশ্বাসী। ভবিষ্যতেও যদি আবার কখনও যদি আমাদের এখানে আসেন তখন কিন্তু এইরকম মহাসমাদর প্রত্যাশা করবেন না।

চন্দ্রবদনী বলল।

বড়ি বুয়া বললেন, হ্যাঁ। হ্যাঁ। পরে এলে, বাড়ির ছেলের মতনই থাকবে, খাবে। রাজাবাহাদুর তো চলেই গেছে। চুকার তো থেকেও নেই। এ বাড়িতে ছেলে কোথায়? তুমি এলে বাড়ির ছেলে হয়েই থাকবে। তাছাড়া, যদি ভালমন্দ দশপদ খেতে ইচ্ছেই হয় তবে চামৌলিতে চলে এসো। আমার বড় ছেলে খড়গ ঠিক তার বাবার মতনই হয়েছে।

বাপ কী বেটা সিপাহীকি ঘোড়া।
কুছ নেহিতো থোড়া থোড়া।

চারণ হাসল। বড়ি বুয়ার কথা শুনে। তারপর বলল কিন্তু চামৌলি যেতে হয় কোথা দিয়ে? মানে, কী করে?

ওমা। তাও জানো না? এখান থেকে তো কাছেই!

তাই?

হ্যাঁ।

চন্দ্রবদনী বলল।

কাছে মানে? কতদূর এখান থেকে?

এখান থেকে চামৌলি যতদূর, চামৌলি থেকে রুদ্রপ্রয়াগও ততই দূর।

চন্দ্রবদনী হেসে বলল।

হাসল, চারণও।

এই বাক্যটিই দেবপ্রয়াগে শুনেছিল, মনে পড়ল। কে বলেছিল? চন্দ্রবদনীই কি? নাকি সাধু সন্তদের মধ্যেই কেউ, তা অবশ্য মনে পড়ল না।

বড়ি বুয়া বললেন, রুদ্রপ্রয়াগে নেমে গিয়ে অলকানন্দার ব্রিজ পেরিয়ে বাঁয়ে যে পথ চলে গেছে। সে পথে গিয়ে, ডান দিকে ঘুরে গেলে মোহনখাই বলে একটি জায়গা পড়বে। তারপর চোপ্তা, চামৌলি। আমাদের ওখানে কিন্তু পথ এখনও কাঁচাই আছে। পিচ পড়েছে সবে তাতে। তাই সেই জায়গায় প্রকৃতিও কীরকম তার একটা আন্দাজ নিশ্চয়ই করতে পারো, মানে যে-পথ এখনও পাকাই হয়নি সেই পথপাশের গ্রামের।

–নিশ্চয়ই! পারি বইকী! কল্পনা করতেও ভাল লাগে যে, পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু কিছু জায়গা রয়ে গেছে যেখানে বিজলীর আলো নেই, বাস বা ট্রাকের কান-ফাটানো এয়ার-হর্ন নেই, কেবল-টিভির ডিশ-অ্যান্টেনা নেই, ভোগ্যপণ্যর লাগাতার এবং লজ্জাকরভাবে নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন নেই।

চারণ বলল।

খেতে-করতে সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিমে। খাওয়া তো নয়, ফাঁসির খাওয়া। আসলে, ঢলেনি ততটা, পাহাড়টা এতটাই উঁচু যে, বেলাবেলিই আড়ালে পড়ে গেল সে। তার প্রাত্যহিক অধঃপতনটা শেষ অবধি কেউ ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে দেখুক তা বোধহয় এখানের সূর্যের ইচ্ছে নয়।

বড় বড় হাই উঠছিল চারণের। আলো কমতেই শীতও বাড়ল। সবসময়ই কনকনে উত্তরে হাওয়া বইছে একটা।

চন্দ্রবদনী বলল, একটু শুয়ে নেবেন নাকি আপনি? আপনার অভ্যেস তো নেই!

কিসের?

এতখানি চড়াই ওঠবার কষ্ট করার।

চারণ বলল, এমন সাধ্বী-সঙ্গর অভ্যেসও নেই, এমন আদর যত্নরও। শুধু কষ্টটার কথা ধরলেই বা চলবে কেন? তা করলে তো অন্যায় করা হবে।

তারপরই বলল, চুকার কোথায়? তার সঙ্গেই তো আলাপ হল না।

কোথায় তা আমিও জানি না। আপনাকে যখন আনতে যাবার জন্যে নামলাম নীচে, ঠাকুর্দার কাছে শুনলাম যে, সে নাকি শেষ রাতে বেরিয়ে গেছে।

তাই?

অবাক হয়ে বলল, চারণ।

তারপরই বলল, তাহলে কি পাটনের সঙ্গেই গেল? সেও তো একখানি চিঠি লিখে রেখে ভোররাতেই চলে গেছে। সে অবশ্য গন্তব্যর আভাস দিয়ে গেছে। তবে সত্যি বলেছে কি না তা বলতে পারি না।

একসঙ্গে বেরোলেই যে একই গন্তব্যে যাবে তার কি মানে আছে? কতজনেই তো একসঙ্গে প্রতিমুহূর্তেই বেরোয় পথে। তাই বলে, কোন পথ যে কাকে কোথায় নিয়ে যায়, তা কি আগে থাকতে জানা যায়? পথিকও জানে না অনেক সময়। পথ তো জানেই না।

বাঃ। বলল, চারণ।

আপনি ভারী সুন্দর কথা বলেন।

আপনিও।

তাই?

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার মক্কেলরা ছাড়া আর কেউই বলেনি এ কথা।

পাটনের মা তুলিদিও নয়?

তুলিকে আপনি চিনতেন? চমকে উঠে বলল, চারণ।

এক দুর্জ্ঞেয় হাসি হেসে চন্দ্রবদনী বলল, This world is really small.

তারপরে বলল, তুলিদির কাছে আপনার কথা এতই শুনতাম একসময়ে যে, তুলিদিকে খুব ঈর্ষা হত। ওর বাবা-মা সত্যিই আক্ষরিকভাবে তুলিদিকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিলেন। তুলিদির রূপ-গুণের কোনও তুলনা ছিল না। একটাই দোষ ছিল। সাহস বড় কম ছিল। পরকীয়াতে যতটুকু সাহস লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি সাহস লাগে সমাজ সংসারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে। বড় বেশি মেনে নেওয়ার প্রবণতা ছিল ওর মধ্যে।

তারপর বলল, সত্যি! পাটনকে দেখে এবং জেনে, পাটনের বাবা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই করা যায় না। আমি তো তাঁকে দেখেছি দিনের পর দিন।

অধিকাংশ অশিক্ষিত বড়লোকেরা ওইরকমই হয়। সব দেশেই।

বড়লোক হওয়ার পর অধিকাংশ মানুষই আর মনুষ্যপদবাচ্য থাকে না। এ কথা অশিক্ষিত বড়লোকদের মতন শিক্ষিত বড়লোকদের বেলাতেও প্রযোজ্য।

সারা জীবন টাকাওয়ালা মানুষদের নিয়েই তো কাটালাম। টাকা হজম করা, পাথর হজম করার চেয়েও কঠিন। টাকাই মানুষকে হজম করে ফেলে মানুষের অজানিতে।

সত্যিই তুলিদির কথা মনে হলে বড় কষ্ট হয়।

চন্দ্রবদনী চারণের দুচোখে দুচোখ রেখে বলল, যদি বা একটু সুখের মুখ দেখেছিল বেচারি, সেই সুখেও ততো বেশিদিন সুখি হওয়া হল না তার। সাত-তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল।

কোন সুখ?

চন্দ্রবদনী অনেকক্ষণ চারণের চোখে চেয়ে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।

তারপরে বলল, আপনি জানেন না?

চারণও একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি আমার নিজের সুখের কথাটুকুই শুধু জানি। অপরের সুখের কথা তো অপরেরই জানার কথা। মানে, সে সুখের গভীরতার কথা। কারও পক্ষেই কি অন্যের সুখের কথা জানা সম্ভব? যদি কেউ কাউকে সত্যিই সুখী করে থাকে, তার পক্ষেও জানা সম্ভব নয়।

তারপরই কথা ঘুরিয়ে চারণ চন্দ্রবদনীকে বলল, আপনি বহুদিন কাছ থেকে দেখেছেন বললেন পাটনের বাবাকে, সেটা কীরকম?

বাঃ রে। আমি পাঁচ মাস ছিলাম যে তুলিদিদের বাড়িতে একসময়ে।

সে কি? কোন সুবাদে?

বিস্মিত এবং একটু ভীতও হয়ে জিজ্ঞেস করল চারণ।

চন্দ্রবদনী বলল, সুবাদ সুবোধ্যও হতে পারে অথবা দুর্বোধ্য। অত জেনে কী করবেন?

চিন্তাতে ফেললেন দেখছি আপনি আমাকে।

সে কথা শুনে খুব জোরে হেসে উঠল চন্দ্রবদনী।

বলল, চিন্তা করা ভাল। তবে দুশ্চিন্তা করবেন না।

তীর্থ করতে এসেছিলাম আর এ কোন জটিল অঙ্কর মধ্যে এনে ফেলল আমাকে পাটনচন্দ্র? স্ব

গতোক্তির মতন বলল চারণ।

তীর্থ করতে আপনি মোটেই আসেননি!

তো? কী করতে এসেছিলাম?

নিজেকে খুঁজতে এসেছিলেন। আয়নার সামনে দাঁড়াতে এসেছিলেন।

তারপরই বলল, আশ্চর্য! আয়নার দোকানিরাও কখনও কখনও অন্য দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের পুত্থানুপুঙ্খভাবে দেখেন হয়তো। দেখতে হয়ই। যে পরিবেশে মানুষ থাকে, সেই পরিবেশ যতই, ভাল বা মন্দ হোক না কেন, তা তাকে আবিল করে দেয়ই। অনুষঙ্গ থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখার আর কোনও উপায়ই থাকে না বোধহয়। তাই না? নইলে মি. চারণ চ্যাটার্জি এই দাড়িতে-ছারপোকা, কম্বলে-ছারপোকা, দুর্গন্ধ, উপপাসী, অপার্থিব জগতের জীব, ছায়ামূর্তির মতন সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আসবেন কেন?

তারপর বলল, জানেন, আপনার কথা আমি আগেই জেনেছিলাম, মানে, এই অঞ্চলে যে আপনি এসেছেন। আপনার আসা তো আসা নয়। সে যে আবিভাব!

কী করে?

পাটনের কাছ থেকেই। কিন্তু যেদিন দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার পারে, গুরুজির গুহাতে আপনাকে দেখলাম, জোড়াসনে বসলেন আপনি এসে, পাটনের সঙ্গে, ছেঁড়া কম্বলের উপরে, তখন তুলিদিদের বাড়িতে দেখা আপনার, সাদা-রঙা লেফট্যান্ড-ড্রাইভ ওপেল ক্যাপিটান গাড়ি থেকে থ্রি-পিস সুটি পরে-নামা সেই চেহারাটার কথা মনে পড়ে গেল। এখন তো Opel Astra গাড়ি নিয়েই কত মানুষ হই-হই তুলেছে। Opel Kapitan তো Astraর চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ বড় গাড়ি ছিল, তাই না? আর তখন দেশে তো হত না, ইমপোর্ট করতে হত।

হ্যাঁ।

লজ্জিত হয়ে বলল, চারণ।

তারপরই বলল তাতে কি? কোনও শিক্ষিত মানুষেরই কাছে গাড়ি-বাড়ি টাকা-পয়সা কি গর্বের জিনিস?

না তা নয়। তবে আপনার পরিবেশ প্রতিবেশের মানুষকে যে অমন পরিবেশে দেখব তা ভাবতেও পারিনি।

চন্দ্রবদনী বলল।

তাহলে বলতে হয়, আপনি আমার গাড়ি, আমার শোফার, আমার থ্রি-পিস-স্যুটকেই দেখেছিলেন, আমাকে দেখেননি। মানে, আমার আসল আমিকে।

কার আসল আমিকেই বা কে দেখতে পায় অত সহজে? আসল আমিকে অত সহজে দেখতে পাওয়া গেলে কি সক্রেটিস অমন করে বলতে পারতেন যে Catch Me, Me, Me, the real me! তাছাড়া, তুলিদি যে আমাকে সবই বলেছিল, মানে আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কের রকম, গভীরতার কথা।

তুলি আপনাকে সব বলেছিল? মানে? কী সব?

সব, সব। সেই কটকের প্রথম রাতের কথা থেকে শুরু করে সবই বলেছিল। আসলে, বড় একলা ছিল তো বেচারি। মনে এমন কিছু কথা সব মানুষেরই থাকে, কারওকে না বলতে পারলে সদ্য মা-হওয়া নারীর স্তনভারের মতনই তার মন ভারী হয়ে ওঠে। সে ভার লাঘব না করতে পারলে অস্বস্তির আর শেষ থাকে না।

আপনি সেই ভারের কথা জানলেন কি করে? আপনি তো মা হননি কখনও।

চন্দ্রবদনী হেসে বলল, মেয়েরা মা না হলেও মায়ের জাত বলেই মায়েদের অনেক কথা এমনিতেই জানে। সে প্রসঙ্গ থাক।

চারণ বলল, ঘুমুবার আর দরকার নেই। ঘুম কেটে গেছে। শীতের দিনে, অবেলায় না ঘুমননাই ভাল। গতকাল পাটনের পাল্লায় পড়ে স্কচ-হুঁইস্কি খেয়ে তারপর হেভি লাঞ্চ করে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়াতে দিনটাই নষ্ট হয়ে গেল। তাছাড়া, কাল মনও অভিঘাতে ভারাক্রান্ত ছিল।

কিসের অভিঘাত?

সে কথা এখন থাক। আজকের দিন ও রাতটা আমি নষ্ট করতে চাই না।

দিন ও রাত তো নষ্ট হবেই। সব দিন সব রাত নষ্ট হবারই জন্যে। মানে, ফুরিয়ে যাবারই জন্যে। দিন ও রাতের গায়ে লেবেল মারার ক্ষমতাটুকুই শুধু আছে আমাদের হাতে। আসলে, মানুষের এইখানেই মস্ত হার। তাই না? আপনি কি বলেন? চাঁদে পা দিল মানুষ। কৃত্রিম উপগ্রহ ছেড়ে দিল আকাশে, পুকুরে, চারা-পোনা ছাড়ার মতন আকাশময়, কিন্তু সময়কেই ধরে রাখতে পারল না। এঁটে উঠতে পারল না তার সঙ্গে। তার গায়ে আঙুলই ছোঁয়াতে পারল না। সময়ের চেয়ে বেশি Perishable আর কোনও জিনিসই নেই বোধহয়।

সময়কে কি কোনও জিনিসের প্যায়ে আদৌ ফেলা যায়?

মানে, কংক্রিট নয়, অ্যাবসট্র্যাক্ট জিনিস? জিনিস বলব না, বলব কনসেপ্ট।

ঠিকই। বলল, চারণ।

তারপর বলল, প্রসঙ্গটা ওঠালেন আপনিই তাই বলি যে, আমি এখানে তীর্থ করতে আদৌ আসিনি। তেমন তীর্থ করতে এলে, খেতে খেতে, বমি করতে করতে, দেব-দেবতাদের নাম করে হুংকার দিতে দিতে যতদিন এসেছি এই অঞ্চলে তার এক বিশাংশ সময়েরও কম সময়ে, কলকাতায় ফিরে যেতে পারতাম। গিয়ে, জোয়ালেও জুতে যেতে পারতাম। কিন্তু মনের অশান্তি, ছটফটানি, কাটেনি এখনও। তীর্থর ধারণাটা আমার কাছে একেবারেই অন্যরকম। তা সকলের পক্ষে বোঝাও হয়তো সম্ভব নয়।

বলুনই না একটু চেষ্টা করে দেখি, বুঝতে পারি কি না।

জানি না, পারবেন কি না! তবে আপনার মা সম্বন্ধে পাটনের কাছে ও আপনার কাছে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়, তিনি হয়তো বুঝলেও বুঝতেন।

তারপর বলল চারণ, তীর্থ সম্বন্ধে এই ধারণাটিও আমার নিজস্ব ধারণা নয়। এও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই ধার করা।

বলুনই না শুনি।

তীর্থ তো অন্তরেরই ব্যাপার। তীর্থ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গেলেই হয় না, যদি না অন্তর তীর্থে যাওয়া যায়।

বাঃ! বলল, চন্দ্রবদনী।

প্রতিদিনই এসো, অন্তরে এসো। সেখানে সব কোলাহল বারণ হোক। কোনওরকম আঘাতই না যেন পৌঁছয় আমার অন্তরের গভীরে, কোনও মলিনতা যেন না স্পর্শ করে। সেখানে ক্রোধকে পালন কোরোও না, ক্ষোভকে প্রশ্রয় দিও না, বাসনাগুলিকে হাওয়া দিয়ে সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে রেখো না কেন না সেখানেই তোমার তীর্থ, তোমার দেব-মন্দির।

বাবাঃ আপনি এতও জানেন।

ঠাট্টা করছেন? চারণ বলল।

না, ঠাট্টা করছি না। সিরিয়াসলিই বলছি। কিন্তু যা বললেন এই যদি আপনার বিশ্বাস হয়, তবে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না, এত নৈতিকতা, শুদ্ধতা সত্ত্বেও তুলিদির সঙ্গে অ্যাফেয়ারটা করলেন কি করে? বাসনাগুলিকে হাওয়া দিয়ে যদি না জ্বালানোতেই বিশ্বাস করেন আপনি?

চারণ হেসে ফেলল। হেসে ফেলেই মনে হল, যখন ওর শঙ্কা পাওয়ার কথা তখন হাসল কী করে।

চন্দ্রবদনী লক্ষ করল যে, সেই হাসির মধ্যে শিশুর হাসির অপাপবিদ্ধতা আছে। লক্ষ করে আশ্চর্য হল।

চারণ বলল, আপনাকে এর চেয়ে একটু বেশি বুদ্ধিমতী বলে মনে করেছিলাম আমি।

মানে?

এ তো রবীন্দ্রনাথেরই কথা। আমি তো নিজে রবীন্দ্রনাথ নই। আমি যে অতি সাধারণ একজন রক্তমাংসের মানুষ। যে-ছাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষাতে নব্বই পার্সেন্ট নম্বর পাওয়ার সাধনা করেছিল, ফল বেরুলে দেখা গেল যে, সে হয়তো টায়-টায় নম্বর পেয়ে কোনওরকমে পাস করে গেছে। কিন্তু তা বলে তার সাধনা তো মিথ্যে নয়। সাধনার পবিত্রতা এবং মান্যতা তো সিদ্ধিনির্ভর নয়। তবে তো সব সাধনাতেই এমনকি শব-সাধনাতেও ব্যবসাদারীর সঙ্গে কোনওই তফাৎ থাকত না। শুধুমাত্র লেন-দেন এই ব্যাপার হত এইসব অন্তর্গত দেওয়া-নেওয়া। প্রত্যেকেরই সামনে তাই কোনও মহৎ আদর্শ রাখাটা খুবই জরুরি। কোনও আদর্শে আস্থা রাখাটাই একটা মস্ত সাধনা। অন্ধকার রাতে ঝড়ের মধ্যে হাল এর উপরে হাত রেখে নৌকো বাওয়াটাই দাঁড়ের উপরে হাত রেখে বাওয়ার চেয়ে অনেকই বেশি জরুরি। হালে হাত থাকলেই যে সব মাঝিই দরিয়া পেরোতে পারতই, পারবেই, তার যদি কোনও স্থিরতা থাকত তবে তো সাধনা কথাটাই মিথ্যে হয়ে যেত। তাই নয় কি? শুধুমাত্র এই তীর্থর কথাই আমি জানি। উত্তুঙ্গ গিরিশিখরে উঠে সুন্দর কালো পাথরের মন্দিরগাত্রে সাদা চকখড়ি দিয়ে যেসব তীর্থযাত্রী লিখে রাখেন, আমি এসেছিলাম, শ্রীরামপুরের কাল রায় বা চন্দননগরের ভুলু দাস অথবা কামিনী, যোগেন অথবা হৃদয়ে তীর বেঁধা ছবি ইত্যাদি, তাঁদের তীর্থযাত্রার রকম আর আমার তীর্থযাত্রার রকম তো এক নয়! পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, পুষ্প আছে। অন্তরের মতন আমিও বিশ্বাস করি, শারীরিকভাবে কোনও ক্ষেত্ৰতে পৌঁছলেই শুধু সেই কারণেই কোনও মানুষ-মানুষীরই তীর্থ করা হয় না। যদি না, অন্তরকেই তীর্থ করে তোলা যায়।

ঠিক। অবশ্যই ঠিক। চন্দ্রবদনী বলল।

তারপর হেসে বলল, আবারও বলছি আপনাকে যে, খুবই ভাল কথা বলেন আপনি।

আগেই তো বলেছি, আমার জীবিকার্জন তো মুখ দিয়েই করতে হয়। তা বলে, আমি মানুষটা মুখ-সর্বস্ব, এ কথা ভুলেও ভাববেন না।

সেটা না বললেও চলত।

তারপরই বলল, এখনও যতটুকু বেলা আছে চলুন আপনাকে আমাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।

কোনও ফাঁকা জায়গাতে চলুন। ঘিঞ্জি জায়গাতে নয়।

চারণ বলল।

নিজের মনটাকে ফাঁকা করে তুলুন তাহলেই আর ফাঁকা জায়গার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না।

বাবাঃ! আপনি দেখি সন্ন্যাসী ভীমগিরি মহারাজের মতন কথা বলছেন।

সন্ন্যাসী নাই বা হলাম বিবাগী হতে ক্ষতি কি?

এখন রাত কত তা কে জানে!

.

১০.

রাত নামার আগে আগে ওরা দুজনে পুরো গ্রামে একটা টহল দিয়ে এসে, জামাকাপড় বদলে, বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল এখন। ঘরের দুকোণে কাঠ-কয়লার কাঙরি রাখা ছিল, ফায়ার-প্লেস-এর বিকল্পে। যেমন কাশ্মীরের ঘরে ঘরে থাকে। ফারহান পরে গড়গড়ার লম্বা নল হাতে তুলে সুগন্ধি তামাক খায় কাশ্মীরীরা গুড়ক-গুড় শব্দ করে। গাড়োয়ালি, কুমায়নি, হিমাচল প্রদেশের মানুষেরাও খায়। তেমনই যেন বন্দোবস্ত, রুদ্রপ্রয়াগে চন্দ্রবদনীদের বাড়িতেও। শুধু গড়গড়ার বদলে পাইপ।

চন্দ্রবদনী বিকেলে ফিরে এসে চান করেছিল গরম জলে। এখন একটা কাঁঠালিচাঁপারঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে, গায়ে হালকা হলুদ ফুলহাতা কার্ডিগান, শাড়ির নীচে হালকা-হলুদ সিল্কের সায়ার আভাস দেখা যাচ্ছে রুপোর পায়েজোরের উপরে। পায়েও হালকা হলুদ রঙা মোজা। পুরু কার্পেটের উপরে পা দুটি মেলে রেখেছে। উজ্জ্বল বিজলী আলোর নীচে বসে ভারী উষ্ণ লাগছে চারণের। সেই উষ্ণতা কতখানি কারীর আর কতখানি বিজলী-আলোর এবং আরও কতখানি চন্দ্রবদনীর সান্নিধ্য-জনিত তা চারণ বুঝতে পারছে না।

চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দার কাছে ধম্মপদ-এর কথা শুনছিল। বৌদ্ধধর্মের ধম্মপদ-এর কথা শুনছে শিশুকাল থেকেই কিন্তু কী তার শিক্ষা, তা কখনওই জানবার সুযোগ হয়নি।

কেশর শিং শর্মা সাহেব পাইপ খান। বহু পুরনো হয়ে যাওয়া ইংলিশ ব্রায়ার পাইপ। কে জানে? হয়তো ডানহিলই হবে। সবসময়ই তাঁর হাতে থাকে। মনে হয়, যেন পাইপই তাঁর Staple Food।

কি টোব্যাকো খান? চারণ শুধিয়েছিল।

কী আর খাব? প্রিন্স হেনরি। যা পাওয়া যায় দিল্লি বা দেরাদুনে। তার সঙ্গে কখনও সখনও হল্যান্ড-এর Amphora পেলে মিশিয়ে নিই Aromaর জন্যে। Amphora কলকাতা-বম্বে-দিল্লি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। হয়তো চোরাচালানিরাই নিয়ে আসে।

তা না হলে আর আসে কি করে!

সকলের চোখের সামনেই বিক্রি হয়, পুলিশ কনস্টেবল যেমন সকলের চোখের সামনেই ট্রাকওয়ালাদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। এসব অন্যায় আর অন্যায় বলে মানে না কেউই।

চারণ হেসে বলল, অন্যায় যে করে বা যারা করে আর সেই অন্যায়কে আমরা যারা মেনে নেই, তারাও কি সমান অপরাধী নই?

তা ঠিক। তবে ন্যায়-অন্যায় ব্যাপারটা, বিশেষ করে পোস্ট-ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়াতে একটি রিলেটিভ টার্ম। আমাদের অনেক ধ্যান-ধারণার খোলনলচে পালটে ফেলার সময় হয়েছে যাতে স্বদেশী যুগের মতন অন্যায়কে অন্যায় বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি এবং চিহ্নিত করে তাকে বর্জনও করতে পারি। সব গ্রহণ-বর্জনের পেছনেই এক বিশেষ মানসিকতা থাকে। পরিবর্তন আসা দরকার সেই মানসিকতাতেই।

তারপরেই বললেন, এ প্রসঙ্গ থাক। বুড়ো হলে, মানুষ বেশি কথা বলে। তোমরাই বরং বল, আমি শুনি। তবে আমার টোব্যাকোর স্টক, চুকার কিংবা চুকারের বাবা একবার মাস দু-তিনেকের মতন এনে দেয় আমাকে।

চন্দ্রবদনীর দাদুর চেহারার মধ্যে ভারী একটা প্রশান্তি আছে। তার কাছে গেলেই নিজের মনও যেন শান্ত হয়ে যায়। মাথাতে একটা সন্ন্যাসীদের তন গেরুয়া রঙা গরম টুপি। অথচ পরেন প্যান্ট-কোট।

কেশর সিং সাহেবের পাইপের ভুড়ক ভুড়ক শব্দ শুনে মনে হল চারণের যে, পাইপটার stem-এ মনে হয় থুথু জমেছে। পরিষ্কার করা দরকার।

ভাবল, চারণ।

চুপ করে গেলেন যে বড়! কী ভাবছেন?

তারপর বলল, বড়ি বুয়ার হাতে বানানো দারচিনি-তেজপাতা-লবঙ্গ দেওয়া আর এক কাপ চা খাবেন না কি?

চারণ বলল, না, না। আর নয়। ভাল জিনিস কম বলেই ভাল।

হালকা কচি-কলাপাতা-রঙা উলের লাছি নিয়ে সোয়েটার বুনতে বসা চমৌলির বড়ি বুয়ার দিকে ও ফিরে বলল, দারুণ খেলাম বুয়া, চাটা।

বড়ি বুয়া ওকে বললেন, একদফা মেরী নজদিক আওতত বেটা।

কী ব্যাপার বুঝতে না পেরে, চারণ উঠে ওঁর কাছে গেল।

উনি বললেন, আররে বেটা, জারা উলটো হো যাও।

চারণ উলটো হয়ে, মানে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াতে বড়ি বুয়া চারণের কাঁধের মাপ নিলেন উলেব গাছি-সমেত কাঁটা দিয়ে।

চন্দ্রবদনী মুখ টিপে হাসল। চারণকে বলল, বাঃ বাঃ আপনাকে বড়ি বুয়ার এতই ভাল লেগে গেছে যে আপনার জন্যে সোয়েটারই বুনতে বসে গেলেন। রংটা অবশ্য আপনাকে মানাবে খুব। বড়ি বুয়া কপট রাগ করে বললেন, দশ পাতা ইংরেজি পড়াটাই একমাত্র শিক্ষা নয় বেটি। প্রতিবছরই কোনও-না-কোনও প্রিয়জনের জন্যে একাধিক সোয়েটার-বোনা ভালবেসে, তাদের ভালবেসে বেঁধে খাওয়ানো, তাদের জন্যে পাঁপড়-আচার বানানো এই সবই হচ্ছে মেয়েদের ভালবাসার প্রকাশ।

চন্দ্রবদনী বলল, তোমরা সময় কী করে নষ্ট করতে হয় তাই শিখেছিলে বড়ি বুয়া। তুমি দিল্লির কনট-সাকাসে চল না একবার আমার সঙ্গে। কি পালিকা বাজারে। কত রকমের কত রং-এর যে, মেশিনে-তৈরি রেডিমেড সোয়েটার পাবে সেখানে যে, একেবারে ভালবাসার পিং-হুঁলারএ হয়ে যাবে।

বড়ি বুয়া হেসে ফেললেন চন্দ্রবদনীর কথা শুনে।

চারণ বলল, পিং-হুলারেটা আবার কী জিনিস?

হাসছিল চন্দ্রবদনীও। চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দাও যোগ দিলেন হাসিতে।

স্বগতোক্তি করলেন, নাতনির রসিকতা দ্যাখো!

হাসছিল, চন্দ্রবদনীও।

কারওকে হাসতে দেখে এত সুখি এর আগে আর হয়নি চারণ। ওর মনে হল চন্দ্রবদনীর এই একটি দিনের সান্নিধ্যতেই সাধু হওয়ার মতন কাবু হয়ে পড়েছে। প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল চন্দ্রবদনী নামটিতেই। তারপর তার সঙ্গে দেবপ্রয়াগে দেখা হবার পর, তার গান শোনার পর এবং গত দু-আড়াই মাসের এক সম্পূর্ণ অন্য জীবনযাপনের পর চন্দ্রবদনীদের বাড়িতে বসে তার ঠাকুর্দা এবং চামৌলির বড় পিসিমার সঙ্গে গল্প-মস্করা করা এক পরমাসুন্দরী আধুনিকা অথচ সম্পূর্ণ ভারতীয় নারীকে খুবই কাছ থেকে দেখে অজগরের চাউনিতে আটকে-পড়া হরিণশিশুরই মতন অবস্থা হয়েছে যেন দুঁদে ব্যারিস্টার চারণ চ্যাটার্জির।

চারণের মনে পড়ে গেল যে, ওর মা বলতেন, কার মরণ যে কোথায় লিখে রেখেছেন ঈশ্বর তা শুধুমাত্র তিনিই জানেন। বাক্যটির যথার্থ তাৎপর্য এতদিন পরে হদয়ঙ্গম করল যেন চারণ। তার মৃত্যু যে, এই দেবভূমির রুদ্রপ্রয়াগের উপরের এই সুউচ্চ পর্বতের উপরের একটি বাড়ির এই উষ্ণ পরিমণ্ডলেই, unseen question-এর উত্তরেরই মতন, সেই সত্য, অদৃশ্য, ঈশ্বর-নামক element যে স্থির করে রেখেছিলেন, তাকি সে আজ সকালেও জানত! এত কিছু কি ঘটে যেতে পারে অল্প একঘণ্টার মধ্যে? একি সম্ভব? চারণ চ্যাটার্জি অন্য পক্ষের মতামতের জন্যে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করেই কী দারুণ দুঃসাহসে জীবনের এমন পরম এক জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল? কি করে? সওয়াল না জিজ্ঞেস করেই জবাব দিয়ে দিল কোন অন্ধ মুখতাতে?

চারণের একটা উর্দু শায়ের মনে পড়ে গেল,

ম্যায় দিল দে দিয়া হ্যায় উনকি,
দেখে উ্য ক্যা করেঙ্গে,
রাখতি হ্যায় দিলকে দিলমে,
ইয়া কি জুদা করেঙ্গে?

ভাবছিল, জীবনের এতখানি উষর বন্ধুর পথ পেরিয়ে এসে সেকি মরুদ্যানের সামনে দাঁড়াল? প্রেমেই পড়ল কি? কোন সকালের পাখি যে কার জন্যে কী গান মুখ করে নিয়ে আসবে, তা আগের শেষ রাতেও বা কে বলতে পারে!

চারণ আবারও বলল পিং-হুলারেটা কী? বলবেন না?

চন্দ্রবদনী হাসতে হাসতেই বলল, পিংহুলারে একটি গুরুমুখী শব্দ। মানে, ধরুন, কী বলব, জলসা বা ভ্যারাইটি-শো।

তাই?

বলে, চারণও যোগ দিল হাসিতে।

চন্দ্রবদনী তারপর বড়ি বুয়াকে হাসতে হাসতেই বলল, আর শুধুই সোয়েটার? ইন্ডানা কোম্পানির নানান আচার, পাঁচরঙ্গের আচার, তারই বা স্বাদ খারাপ কি? দিল্লির মেয়েরা প্রেগন্যান্ট হলেই আচারের বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এখন নিজের হাতে সোয়েটার পাপড় আচার বানাবে, তার সময় কার আছে? তুমি একবারে প্রাগৈতিহাসিক যুগেই পড়ে রইলে বড়ি বুয়া।

বড়ি বুয়া বললেন, সময় সকলেরই আছে। নিজের প্রিয়জনের জন্যে নিজে হাতে সোয়েটার বোনাতে যদি সময় নষ্ট হয়, তবে সেই সময় নিয়ে তোরা, কি করলি, না করলি তাতে কিই বা এসে যায়! আমার অন্তত যায় আসে না। সকলের সময়ই দামি। কে কার সময় কী ভাবে খরচ করবে সেটা তার সম্পূর্ণই নিজস্ব ব্যাপার। আমার দামি সময় আমি এইভাবেই নষ্ট করেছি আজীবন এবং ভবিষ্যতেও করব। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, পঁয়তাল্লিশ বছর বড় সুখি, দাম্পত্যজীবন কাটিয়েছি। পাঁচবছর হল একলা হয়ে গেছি। কিন্তু জীবনের একমুহূর্তও নষ্ট হয়েছে বলে মনে হয়নি।

তা হয়তো হবে। কিন্তু বড়ি বুয়া, আমাদের পৃথিবীটা যে তোমার দেওদার-ওক-পাইন–হর্স চেস্টনাট, তোন, তাড় গাছেদের গায়ের খুশবু আর চুকার এবং খালিজ ফেজান্টস-এর ডাকে জেগে-ওঠা লক্ষ হীরেব দ্যুতিতে ঝলমল করে-ওঠা শিশির-ভেজা চামৌলির সকাল বা বড় বিষয় ভগুয়া লাল এর আকাশ-ঘেরা সন্ধের মতন সুন্দর নয়। আজকের আমাদের পৃথিবী যে বড়ই দোড়াদৌড়ির, মারামারির, প্রতিযোগিতার। বড়ি বুয়া এ কথা তোমরা না বুঝলে চলবে কী করে। চন্দ্রবদনী বলল।

এ জীবনে যা বুঝেছি, যা জেনেছি, যা শান্তি পেয়েছি তাই নিয়েই যেন বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিতে পারি। তোদের বুদ্ধি তোদর যুক্তি তোদেরই থাক। স্বামী বাইরের কাজ সামলাবে, রোজগার করবে, আর স্ত্রী নিজের বাড়িকে ছবির মতন সুন্দর করে রাখবে। নিজের ছেলেমেয়েকে মনের মতন করে মানুষ করবে, স্বামী ও স্ত্রী দুজনে দুজনকে খুব ভালবাসবে, এর চেয়ে ভাল গার্হস্থ্য আর কী হতে যে পারে, তা আমি তো জানি না।

চন্দ্রবদনী বলল, আজকাল যে একজনের আয়ে কারওই সংসার চলে না বড়ি বুয়া।

এই চলা বলতে কে কি বোঝে তার উপরেই সব নির্ভর করে। এই চলার তো শেষ নেই। উপরে তাকাবার শেষ নেই। সুখ কাকে বলে, সে কথা তোদের মতন মেমসাহেবরা যে কখনই জানবি না। সুখ আর আরাম যে কোনওদিনও এক কথা ছিল না রে বেটি।

সুখ একটা মানসিক অবস্থা। সুখের সঙ্গে কোনওরকম Material Gains-এর কোনওদিনই কোনও সাযুজ্য ছিল না।

তারপরই বললেন, চারণকে, তুমি কি ইংরেজ দার্শনিক Bertand Russell-এর Conquest of Happiness বইটা পড়েছে?

না তো!

বলেই বলল, আপনার তো অনেক পড়াশোনা।

উনি হেসে বললেন, আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা বেশি পড়িনি বেটা। কিন্তু যতটুকু পড়েছি তা থেকে শেখার বা জানার মতন অনেক কিছুই পেয়েছি। গানের বেলাও তাই। আজকের মতন ব্যাঙ, ঝিঁঝিপোকা, গিরগিটি, তক্ষক, দাঁড়কাক, ষাঁড় সকলেই তখন ক্যাসেট করত না? যে যাই করত, তাৰ পেছনে দীর্ঘদিনের সাধনা থাকত। শর্টকার্টও বা ফাঁকিতে জগৎ মাৎ করার প্রবৃত্তি ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হল এই যে, আত্মসম্মান আর লজ্জাবোধ তখনও ছিল মানুষের। জানি না কেন হয়তো বুড়ো হয়েছি বলেই এখন মনে হয়, তরুণতর প্রজন্মর এমন অনেক গুণই আছে যা আমাদের ছিল না। আবার একথাও মনে হয় যে, তাঁদের এমন অনেক দোষও আছে, যা আমাদের ছিল না।

Russell কি বলেছিলেন তাই বলুন, মানে ওই বইয়ে?

চারণ বলল।

Russell বলেছিলেন, সুখি হওয়ার কথা। সুখি হতে পারা তো আর সহজ কাজ নয়। এভারেস জয়ের মতনই কঠিন কাজ। তাই নাম দিয়েছিলেন বইয়ের The Conquest of Happiness। সুখ-অসুখ-এর একটি উদাহরণও দিয়েছিলেন তাতে।

কি উদাহরণ?

লানডান-এর এক টিউব স্টেশনে একটি সুন্দরী মেয়ে নেমে এসে প্লাটফর্ম-এ দাঁড়াল ট্রেইন-এ। অপেক্ষায়। অপরূপ সুন্দরী সে। প্লাটফর্ম-এর সব মানুষ তার দিকে চেয়ে রইল। সে, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখি মহিলা হয়ে গেল। সুখের দেমাকে সে ঝলমল করে উঠল।

তারপর?

তার সামান্য পরে আর একটি মেয়ে এসে নামল সেই প্লাটফর্ম-ই। তার ফিগার আরও ভাল, সে আরও অনেক বেশি সুন্দরী। এবং সে আসা মাত্র সবাই প্রথম জনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দ্বিতীয় জনকে দেখতে লাগল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম মেয়েটি পৃথিবীর দুখিতম মহিলা হয়ে গেল।

তারপর উনি একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সুখ তো থাকে যার যার বুকের মধ্যে। অথচ সেই খবরটাই না জেনে, আমরা সুখের খোঁজে কোথায় না কোথায় দৌড়ে বেড়াই।

তারপর আবারও একটু থেমে বললেন, চন্দ্রবদনীর স্বামী বাজবাহাদুর এই কথাটা বুঝত।

পাঞ্জাবিরা সাধারণত বহির্মুখী হয়, যদিও দারুণ দিলদার, মন-মৌজী হয় সকলেই। কিন্তু বাজবাহাদুর ছিল আমার বৌমার মতন, মানে চন্দুর মায়ের মতন। মানসিকভাবে যেন বাঙালিই ছিল সে। তাই তো চন্দু এবং তার মায়ের অত পছন্দ ছিল তাকে।

বলেই বললেন, দেখ তার ফোটো।

চারণ বসার ঘরের দেওয়ালে চেয়ে দেখল, এয়ারফোর্সের উনিফর্ম পরা নয়, ক্যাজুয়াল পোশাকে এক অতি বুদ্ধিমান, উজ্জ্বল-চোখের পুরুষ।

তার তুলনাতে নিজেকে ছুঁচো বলে মনে হল চারণের।

চন্দ্রবদনীর মুখে কোনও ভাবান্তর লক্ষ করল না চারণ।

তাছাড়া সুখ ব্যাপারটা সবসময়ই রিলেটিভ ব্যাপার। যে কথা Russell অতদিন আগে বলে গেলেন। সেই কথা আজও আমরা, মানে সারা পৃথিবীর মানুষই বুঝতে পারলাম না। উনি Cocoa, We do not struggle for existence, we struggle to outshine our neighbours.

আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী কেউই যেন আমার চেয়ে ভাল না থাকে, কারও বাড়ি, গাড়ি, আসবাব, আজকাল তো আরও কত কী হয়েছে, মাইক্রোআভেন, ভিডিওক্যামেরা সে সব যেন আদৌ না হয় তাদের। আমার চেয়ে ভাল বা উঁচুদরের, কারওই যেন না হয়। এই একমাত্র প্রার্থনা হলেই মুশকিল। দুঃখে মরে যায় মানুষে। কী দুঃখ! কী দুঃখ!

বড়ি বুয়া বললেন, এই মিথ্যার মরীচিৎকার পেছনে দৌড়বার কি শেষ আছে কোনও? কোনও ধর্মই মানুষকে লোভী হতে শেখায় না। বস্তুবাদী হতে শেখায় না। পরকে হিংসা করতে তো বটেই, দ্বেষ করতে বা ঈষা করতেও শেখায় ন। তা সে ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানিজম, শিখ বা যাই হোক না কেন।

শেখর সিং সাহেব বললেন, আসলে মানুষ হিসেবে আমরা অনেকই নিকৃষ্ট হয়ে গেছি। ভোগ্যপণ্যর যোগান যত বেড়েছে, শরীরে এবং মনের শ্রমহ্রাসের নানা যন্ত্র যতই আবিষ্কৃত হয়েছে, মানুষ ততই নিকৃষ্ট হয়েছে চরিত্রে। তারা মনুষ্যত্ব থেকে তীব্রবেগে দূরে সরে যাচ্ছে।

চারণ চুপ করে ভাবছিল।

চন্দ্রবদনী বলল, দাদু আর একটা কথা বললেন না আপনি Russell-এর ওই বইয়ের।

কি কথা?

সেই যে উনি বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের Industrial Revolution ঘটে যাওয়ার পরে মানুষেরই উদ্ভাবিত সব যন্ত্রপাতি যত সাধারণ, একঘেয়ে, mundane, কাজ, তার ভার নিয়ে নেবে আর মানুষে তখন অনেক বেশি সময়ে পাবে মানবিক কাজ করার জন্যে। To do the humane things.

শেখর সিং সাহেব বললেন, আর আজ কি ঘটল বল? এত যুগ পরে মানুষ তার কায়িকশ্রম তো সব বিসর্জন দিলই এমনকি মস্তিষ্কও ইজারা দিল Computer নামক যন্ত্রকে। সারা বিশ্বে এখন Computer-এর জয়জয়কার।

বড়িবুয়া বললেন, একদিন মানুষ বুঝতে পারবে যে, সে আসলে গুহামানবের সভ্যতাতেই নিজ পায়ে হেঁটে যে ফিরে গেছে। বেশিদিন দেরি নেই আর। যা কিছু গড়ে তুলেছিল মানুষের মতন মানুষেরা সারা পৃথিবীতে, মানবিক, মন-নির্ভর, মস্তিষ্ক-নির্ভর সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত ইত্যাদি ইত্যাদি তার সবকিছুকেই সে সঁপে দিয়েছে Computer-এর হাতে।

এই ক্রিয়াকাণ্ডর মাধ্যমে সে নিজের সবরকম নিজস্বতাকেই বিসর্জন দিতে যে বসেছে এই কথা বোঝার মতন মানুষ এখন আর বেশি নেই। বিজ্ঞানের, বিজ্ঞাপনের জয়ধ্বনির মধ্যে মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যুযন্ত্রণার কাতর রব কারও কানে পৌঁছচ্ছে না। সকলেই ভাবছে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল! কিন্তু অদূর ভবিষ্যতও যে কি বয়ে আনবে তাদের জন্যে সে সম্বন্ধে কারওই কোনও ধারণাই নেই। ওই কম্পুটারের বোতামেই মানুষের মরণ-ভোমরা লুকিয়ে আছে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু-এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। এটা ভাবলেও এই পাহাড়চুড়োর গ্রামে বসে আতঙ্কিত বোধ করি অমি। জানি না মানুষের এই বিজ্ঞানমনস্কতা, ঈশ্বর-অবিশ্বাস এবং যন্ত্রনির্ভরতা মানুষকে কোথায় কোন সুগভীর কণ্টকাকীর্ণ গিরিখাদের দিকে তাড়িত করছে। কোন রাহু ভর করেছে এই ঈশ্বরবোধ রহিত ভোগবাদী দু-পেয়েদের।

চারণের মনে হল যে, এসব কথা কখনও যে তার মনেও আসেনি এমন নয়। স্বভাবতই ও শিশুকাল থেকেই বিজ্ঞানবিরোধী, যন্ত্রবিরোধী। এই বিজ্ঞানের যুগেও। বিজ্ঞানের এই রগরগে অগ্রগতি মানুষের ভোগবিলাস আর অর্থর যোগান অবশ্যই বাড়াবে, আরও আয়েসী করবে তাদের, কিন্তু সুখি কি করবে আদৌ? এইসব প্রশ্নে জর্জরিত হয়েছিল বলেই সে কলকাতা ছেড়ে এমন উদ্দেশ্যহীনভাবে হলেও এই সাধুসন্তদের মধ্যে এসে সেইসব প্রশ্নর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছে। সন্তদের এই অনাড়ম্বর কষ্টের জীবনের মধ্যে তাঁদের সুখটা যে কোথায় লুকিয়ে আছে সেটাই খুঁজতে এসেছে। তাই স্বাভাবিক কারণে চন্দ্রবদনীর দাদু আর চন্দ্রবদনীকেও ভাল করে জেনে ভারী ভাল লাগছে ওর। পাটনের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। অতি গভীর কৃতজ্ঞতা।

এখন কোথাওই আর কোনও শব্দ নেই। সব দরজা-জানালাও তত বন্ধই। তবে রাত গম্ভীর হওয়াতে অনেক নীচ দিয়ে বয়ে-যাওয়া অলকানন্দার মৃদু শব্দ উঠে আসছে, একটানা, মর্মরধ্বনির মতন। নদীর বুকের উপরে উপরে কোনও রাতচরা পাখি ডাকছে উড়তে উড়তে। তার ক্ষীণ কিন্তু সি-শার্প-এ উচ্চারিত তীক্ষ্ণ ডাক, নদীর শব্দের সঙ্গে বন্ধ দরজা-জানালাতে এসে মৃদু করাঘাত করছে।

চারণের পাশের ঘরই চন্দ্রবদনীর। মধ্যের দরজাতে খিল-তোলা। ওদিকেও খিল আছে। চন্দ্রবদনী খিল তুলতে বলেনি। তবু চারণ খিল তুলে দিয়েছে। দরজার ওদিকেও খিল তোলা কি না, জানে না চারণ।

ভাবছিল ও, ইট কাঠ-কংক্রিকেটর দরজাতে কত সহজে খিল তুলে দেওয়া যায়। এদিক-ওদিক-সবদিকের দরজাতেই। কিন্তু একজন মানুষের মনে যে অগণ্য অদৃশ্য দরজা-জানালা থাকে– লোভের, আশার, আকাঙ্ক্ষার, বাসনার, কামনার সেই সব তাতেও খিল তুলে, এক ঘর থেকে অন্য ঘরকে নিচ্ছিদ্র আড়াল তুলে দুর্ভেদ্য করা যদি যেত, তবে কী ভালই না হত।

এই ঘরটাই চুকারের। ঘরের বইপত্র, বাথরুমের দরজার পিঠে লাগানো হ্যাঁঙ্গার থেকে ঝুলিয়ে রাখা, শেষ রাতে ছেড়ে যাওয়া, একটি ফেডেড জিনস এবং দেওয়ালে চে-গুয়েভারা আর হো-চি-মিন-এর ছবি দেখে এই ঘরের মালিকের বয়স এবং মানসিকতা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়।

পাটন, চারণকে যে সব কথা বলেছিল, বিদ্রোহের কথা, উত্তরাখণ্ডর স্বীকৃতির কথা সে সব শুনে চারণ কিছুই বলেনি। বলেনি, কারণ চারণ মনে মনে অত্যন্তই প্রগতিবাদী। ছাত্ররা এবং যুবারা যদি সবসময়ে সজীব না থাকে তাদের ন্যায্য দাবি (যে দাবিকে, তারা অন্তত নিজেদের বিবেকমান্যতাতে ন্যায্য বলে মনে করে নিয়ে সোচ্চার না হয়, তবে তো তাদের শিক্ষাই বৃথা।

ওর মনে পড়ে গেল ড. সৰ্ভপল্লী রাধাকৃষ্ণান লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দিতে গিয়ে পরাধীন ভারতবর্ষের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, If we are to preserve ourselves; we must use the lighted torch, the cleansing fire, the spirit that rebels…we hear on all sides about the revolt of youth. I am afraid I have a good deal of sympathy with this attitude of revolt, and my complaint is, that it is not sufficiently widespread,

যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েরই কর্তব্য নির্দেশ উনি বলেছিলেন :

Any university that produced graduate who played for safety and cared for comfort had failed in its eventual task. Timidity and conservation were the greatest dangers to the society.

তবে যা নিয়ে বিপ্লব, যা নিয়ে বিদ্রোহ, তা সত্য ও ন্যায্য কারণের জন্যে হতে হবে।

কিন্তু এও ঠিক যে, এই আন্দোলন ও বিপ্লবের অন্য একটি পিঠও আছে। ভাঙা একবার আরম্ভ হলে, টুকরো হওয়া আরম্ভ হলে, কত টুকরো যে হবে তা কেউই বলতে পারে না। বিপ্লব বা আন্দোলন করার মতন অবস্থার মধ্যে যাতে দেশের কোনও রাজ্যের অধিবাসীদেরই পড়তে না হয়, অসন্তোষ যাতে ধিকিধিকি আগুন হয়ে না জ্বলে কোনও রাজ্যবাসীরই মনে, তা কেন্দ্রর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন বা ছিলেন, তাঁরা যদি প্রথম দিন থেকে মনে রাখতেন তবে আজ সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন এমন আগ্নেয়গিরিসুলভ অবস্থার উদ্ভব হত না। হওয়া আদৌ উচিতও ছিল না। উরুগুয়ের টুপামারা বা ফিলিপিনস-এর হুক যা বলেন এবং পাটনও গতকাল যা Th11507 : If the country docs not belong to everyone it will belong to no one. UTCO পূর্ণ সমর্থন আছে চারণের। চারণ Risis Debray-র সেই বিখ্যাত উক্তিতেও বিশ্বাস করে For a revolutionary, failure is a springboard. As a source of theory it is richer than Victory as it accumulates experience and knowledge.

কিন্তু একই সঙ্গে চারণের T.S. Ellot-এর বিখ্যাত পংক্তিগুলির কথাও মনে হয় :

Time present and time past. Are both perhaps present in time future, And time future is contained in time past.

সারা দিনের নানা সুখকর ঘটনার পরে শুয়ে শুয়ে কত কথাই যে মনে হচ্ছে চারণের। শরীরের বিশ্রাম হয় কিন্তু মননশীল মানুষের মন কি কখনওই বিশ্রাম পায়?

একটা সুগন্ধি লেপ বের করে দিয়েছেন বড়ি বুয়া চারণের জন্যে। অতিথিদের জন্যে সম্ভবত আলাদা করে রাখা থাকে। পরিষ্কার ওয়াড় পরানো। সম্ভবত আতরও লাগানো।

চারণ ভাবছিল, সচ্ছলতার নিজস্ব কোনও বিশেষ গুণ না থাকলেও তা এক এমন পরিবেশের সৃষ্টি করে যে, তার ভাগীদার হতে পেরে ভালই লাগে। তবে সেই সচ্ছলতা অবশ্যই সৎপথে অর্জিত হওয়া উচিত।

বড়ি বুয়ার কচি-কলাপাতা-রঙা উল দিয়ে তার জন্যে সোয়েটার বোনা দেখে চারণের মনের মধ্যেও নানা রঙা উলের লাছির ভিড় জমতে শুরু করে ছিল। সে মুহূর্ত থেকেই ওর মন এক সুখানুভূতিতে ছেয়ে গেছে। চন্দ্রবদনীর চোখেও কি সেই সময়ে কিছু ও দেখেছিল? কে জানে! সেই মুহূর্তে নিজেকে যেন সদ্য-যুবক বলে মনে হচ্ছিল, অনভিজ্ঞ, এমন কি সন্দেহহীনভাবে অজ্ঞ বলেও, যে নির্মল অজ্ঞতা, মানুষকে স্বর্গদ্বারে নিয়ে যায় (যে Ignorance is Bliss!)।

বিছানাতে এপাশ ওপাশ করছিল চারণ। ঘুম আসছিল না। অথচ অতখানি পাহাড় চড়েছে, আসা উচিত ছিল। এমন হয় কখনও কখনও। ঔচিত্য, অনৌচিত্যতে পর্যবসিত হয়।

পাশের ঘরে চন্দ্রবদনীও উসখুস করছে মনে হল। তার চুরির রিনঠিন, পায়জোরের অস্পষ্ট ঝুনুঝুনু। কি পরে শুয়েছে চন্দ্রবদনী, কে জানে। তারও কি ঘুম আসছে না? তারপরই ও ভাবল, চন্দ্রবদনীর মতন রূপসী এবং সর্বগুণসম্পন্ন এক নারীর মনে চারণ সম্বন্ধে কী করে এমন বৈকল্য জন্মাল? সত্যিই কি জন্মাল? এও কি সম্ভব? এত তাড়াতাড়ি কি ভুলে যেতে পারল এই বিধবা তার স্বামী রাজবাহাদুরকে?

তারপরেই মনে পড়ল, কটক শহরের বাখরাবাদে এক রাতে এক সধবা নারীর মনে এবং শরীরেও অমনই বৈকল্য ঘটেছিল।

স্ক্রিয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি,
কুতো মনুষ্যাঃ।

তার নিজের শরীর মনের কথাও তার নিজের তো অজানাই, হয়তো দেবতাদেরও অজানা। শুধু নারীদের দোষ দিয়ে কি লাভ? কখন যে কি ঘটে, আগে থাকতে কে বলতে পারে!

ওর মনে পড়ে গেল বাখরাবাদের সেই রাতের কথা। তুলিও এমনই পাশের ঘরেই শুয়েছিল। মাঝরাতে যখন চারণ তার ঘরের দরজাতে মৃদু করাঘাত শুনল, তখন ভেবেছিল, চোর এল কি?

নতুন জায়গাতে, নতুন বিছানাতে, প্রথম রাতে খুবই দেরি করে ঘুম আসে কিন্তু ঘুম আসার পর হঠাৎ কোনও কারণে ঘুম ভেঙে গেলে ওর মনে হয় নিজের বাড়ির শোওয়ার ঘরেই বুঝি শুয়ে আছে। এমন বোধহয় সকলেরই মনে হয়। তা যে নয়, তা বুঝতে সময় লাগে একটু।

পরমুহূর্তেই ভেবেছিল, চোর আর কবে কার ঘরে মৃদু করাঘাত করে ঢুকেছে? কি করবে, তা ভেবে না পেয়ে চারণ উঠে বসেছিল খাটে। তারপর উঠে গিয়ে দরজা খুলেছিল যথাসম্ভব কম শব্দ করে। ওর মনে করাঘাতের শব্দতেই একটি সন্দেহ জেগেছিল। খুলেই, আতঙ্কিত হয়েছিল মাঝরাতে তুলিকে দরজাতে দেখে। কি করবে তা বুঝে উঠতে পারার আগেই তুলি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এসেছিল। পরণে ফিকে গোলাপি নাইটির উপরে গাঢ় গোলাপি হাউসকোট।

কি করছেন? কি করছেন?

ফিসফিস করে বলেছিল চারণ। উদ্বিগ্ন, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে।

তখনও তুলিকে ও আপনি করেই সম্বোধন করত। তার কিছুদিন পরে তুলিরই আবদারে তুমি বলত। তুলি বলত, যার বড় আদর খাই, সে আপনি বললে লজ্জা করে।

ঘরে ঢুকে, তুলি নিজেই ছিটকিনি তুলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে চারণের পায়ের কাছে বসে হাঁটুর একটু উপরে, দুউরুর মধ্যে তার মুখটি রেখেছিল। থরথর করে কাঁপছিল উত্তেজনাতে, ভয়ে এবং হয়তো পাপবোধেও চারণের শরীর। তারপরেই চারণ লক্ষ করেছিল যে, তুলির চোখের জলে তাব পায়জামার দুহাঁটুর উপরের অংশটুকু ভিজে আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বড় করুণা হয়েছিল তুলির ওপরে, কষ্ট হয়েছিল ওর জন্যে, মায়া হয়েছিল, দয়া এবং আরও কী কী যে হয়েছিল তা ও জানে না। সব অন্যায়বোধ, পাপবোধ, ভয়, উত্তেজনা, আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে নিচু হয়ে দুহাতে তুলিকে কোলে তুলে নিয়ে তার বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়েছিল। আজকে মনে পড়ছে সেই বিছানাতেও আতরের গন্ধ ছিল, অম্বর আতরের। আর আজ বুড়িবুয়াৰ দেওয়া রজাইতে আছে রুহ খসস-এর গন্ধ।

তারপরে অনভিজ্ঞ চারণকে কিছুই করতে হয়নি আর। তৃষিতা, বেচারি কিন্তু অভিজ্ঞা তুলিই করল যা কিছু করার একে একে।

চারণ শুধু ভয় পেয়ে অস্ফুটে একবার বলেছিল, যদি…অ্যাকসিডেন্ট?

তুলি প্রায়ান্ধকার ঘরে তার উষ্ণ কোমল পুষ্ট ঠোঁটে চারণের আধোখোলা ঠোঁটদুটি চেপে বন্ধ কবে দিয়ে বলল, লাইগেশান করা আছে।……দশ বছর। কথা বলবেন না এখন।

বর্ষার বাগান থেকে রজনীগন্ধা আর বেলফুলের গন্ধ উড়ছিল। একটা মস্ত কনকচাঁপা গাছ ছিল তুলিদের বাড়ির বাগানের গেটের পাশে। কনকচাঁপার তীব্র গন্ধ ভাসছিল বৃষ্টি শেষের হাওয়াতে। পরিবেশে। সেই রাতটি ছিল শুক্লপক্ষের। সপ্তমী কী অষ্টমী হবে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আধখানা চাঁদের আলো জানালার কাছের কাঁঠালগাছেদের ভিজে পাতাতে পড়ে পিছলে আসছিল খোলা জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে। স্নিগ্ধ দুধলি আলোর আভাসে আভাসিত করেছিল তুলির পেঁজা-তুলোর মতন স্নিগ্ধ, সুগন্ধি নগ্নতাকে। দূরে বহমানা মহানদীর জলের গন্ধ আসছিল জোলো হাওয়াতে।

সেই বহুদূরে ফেলে-আসা রাতটাকে এখনও কোনও স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হয় চারণের। কেওড়াতলার ইলেকট্রিক চুল্লিতে ছাই হয়ে-যাওয়া উনচল্লিশ বছরের তুলির অস্তিত্বটাও এক স্বপ্ন বলে মনে হয়।

পাটনের সঙ্গে এখানে দেখা না হলে সেই সব কথা, মনে হয়তো আসতও না। সেই রাতেই বুঝেছিল চারণ যে, নারীরা পুরুষদের থেকে অনেক, অনেকই বেশি সাহসী। জীবনের সব ব্যাপারেই। কী রণে, কী রমণে!

রুদ্রপ্রয়াগে চন্দ্রবদনীদের বাড়ির উঠোনের সামনেই যে মস্ত সিলভার-ওক গাছটি আছে, তার মগডাল থেকে কোনও বড় রাতচরা শিকারি ঈগল হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল।

চমকে উঠেছিল চারণ।

নিজেকে বকল চারণ। ও নিজেও কি রাতের শিকারি পাখিরই মতন?

ছিঃ! ছিঃ!

নাঃ। চারণ বলল নিজেকে, কী করতে এই দেবভূমিতে এসেছিলে, কী খুঁজতে এসেছিলে পাতক? আর মনের মধ্যে কি পরম স্বার্থপরায়ণ ও সাধারণ সব Mundane স্থূল ভাবনা উঁকি-ঝুঁকি মারছে অনেকক্ষণ থেকে! ছিঃ। শরীরের মতন Mundane ব্যাপার মনসর্বস্ব শিক্ষিত মানুষের কাছে আর কি আছে? ও তো নিজেকে মনসব জেনে চিরদিনই শ্লাঘাবোধ করে এসেছে। আত্মার শুদ্ধি সম্পূর্ণ করতে এসে কি শরীরসর্বস্ব করে তুলল নিজেকে?

মনে মনে অন্য প্রসঙ্গে ফিরল ও।

চন্দ্রবদনীর দাদু কেশর সিং সাহেব বলেছিলেন ধম্মপদের উপদেশের কথা। ভারী ভাল লাগছিল শুনতে। যদিও কয়েকটির কথাই মাত্র বলেছিলেন উনি চারণকে। তাও ক্রমানুসারে নয়। যেমন যেমন মনে এসেছিল তাঁর তেমন তেমনই বলেছিলেন।

(১) বলেছিলেন, ঘৃণাকে কখনও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না। প্রেমই একমাত্র বোধ যা দিয়ে ঘৃণাকে জয় করা যায়।

(২) একজন মুখ, যে নিজেই জানে যে সে মূর্খ, শুধু সেই কারণেই সে একজন জ্ঞানী মানুষ। যে মুখ নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে সে অবশ্যই মুখ।

(৩) যদি কেউ হাজার মানুষকে কোনও যুদ্ধে পরাস্ত করে থাকেন তিনি তো মহাবীর। কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় বীর তিনি, যিনি নিজেকে জয় করতে পেরেছেন।

(৪) যদি কেউ একশ বছর বেঁচেও পরম সত্য যা তাকে না জেনে থাকেন তবে যিনি সেই সত্যকে জেনে গেলেন তাঁর মাত্র একদিনের জীবনও অনেক মূল্যবান প্রথমজনের জীবনের চেয়ে।

একটু থেমে থেমে, চন্দ্রবদনীর ঠাকুর্দা ধম্মপদের এই নিদানগুলি যখন বলছিলেন তাঁর রোদ-পোড়া হলদেটে-তামাটে মুখে ফানুসের মতন একটি হাসি ঝুলেছিল।

শেষে উনি শেষ উপদেশটা বলেছিলেন : মৃত্যুর হাত থেকে কারওকেই কারও ছেলে বা কারও বাবা বাঁচাতে পারেন না। মৃত্যু যখন দরজাতে কড়া নাড়ে তখন তার হাত থেকে বাঁচাতে পারেন না জ্ঞাতিগুষ্টি, প্রজা বা শাস্ত্রীরাও, কেউই পারে না। মৃত্যু অমোঘ, অবিসংবাদী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress