২. ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে ওয়াশরুমে ঢুকে নগেন দত্ত দেখলেন দেয়ালে একটা গোপন দরোজা, উঁকি দিয়ে দেখলেন টিমটিমে আলোয় একাধিক সিঁড়ি নানা দিকে নেমে গেছে, তার মানে অ্যাটাচিকেসের ভোলবদলে ভয় পেয়ে পালিয়েছে প্রফেসর চক্কোত্তি, অথচ ভয়ের তো কিছু নেই । হয়তো ওর এরেকটাইল ডিসফাংশানকেও ভাবছে আমার কারসাজি । কারসাজি করতে হলে ওর ‘বিইং’কেই ‘নাথিংনেস’ করে দিতুম । যাকগে, পুলিশের রেইড হলে মেয়েদের এই পথেই লোপাট করে দ্যায় চক্কোত্তি, বেচারা, জীবনের ফুটোগুলো নিয়ে বাঁচতে শেখেনি, পালাতে শিখেছে, বাঙালিদের নাম ডোবালো ।
এই পাড়ায় গ্যালারিগুলো পালাবার পথ রেখেছে, রাস্তাগুলো পালাবার পথ রাখেনি, সবকটা রাস্তা কোথাও গিয়ে কানা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, এছাড়া অধঃপতনের আহ্লাদে গদগদ হবার অন্য উপায় নেই, ফোসলানোর বিভ্রমে আটকে পড়ে বার বার সবাই এসে খুঁজতে চায় পাড়াটা থেকে বেরোবার বিকল্প পথ ।
আরেকটু অপেক্ষা করেই দেখি, ভাবলেন নগেন দত্ত, মাথার কোঁকড়া কালো চুলে হাত বুলিয়ে । পেছন ফিরে দেখলেন, দুটি যুবতী ঢুকলো ঘরে, বলে উঠলেন, আরে তিথি আর ছন্দরানি, তোমরা তো বিগতবুড়ি হয়ে গিয়েছিল, আবার দেহ ফিরে পেলে কী করে ? আমি তো তোমাদের পুনর্নিমাণ করে দেখলুম একটু আগে, আগাপাশতলা। এখনও পোশাক না পরেই আছো ? চক্কোত্তিবাবুর কোনো ক্লায়েন্ট এসে পড়লে বিপদে পড়বে, যাও আগে পোশাক পরে এসো ।
তিথিই প্রথম কথা বলল, নগেন দত্তকে জড়িয়ে গালে ঠোঁট চিপে, মমুয়াআআআআআঃ, ডক্টরেট করিয়ে ছাত্ররা গেছে, তাই তুমি চলে যাবার আগে পুরোনো রাতগুলো আরেকবার গুলজার করার জন্যে এলুম, তক্কে-তক্কে ছিলুম, নজর রেখেছিলুম দরোজার দিকে, চলো আমরা দুজনে তোমার দুদিকে শুয়ে জম্পেশ খেলা করি ।
নগেন দত্ত তিথি আহমেদের মুখটা ঘুরিয়ে নিজের দিকে এনে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললেন, তোরাও যে অধ্যাপক হয়ে গেছিস তা জানতুম না, অধ্যাপনার সঙ্গে মর্ষকামী সেক্স যায় কিনা তেমন জানি না গো । তখন তো তোরা আকাট ছিলিস, খেলতে ভালো লাগতো, মুকখুর সঙ্গে খেলার স্বাদ আর বিএ-এমএ পাশের সঙ্গে খেলার স্বাদে কি তফাত নেই, কী বলিস তোরা ? ।
ছন্দরানি বললে, অধ্যাপনা করি বলে কি আমাদের যৌনতা নেই, আমাদের দেহও কি অধ্যাপকদের মতন গোমড়া থাকবে নাকি ! আমাদেরও লাবিয়া আছে, উৎসুক ভগাঙ্কুর আছে, তুমি আমাদের সমান স্ট্যাটাসের, আমরা তো সীমা ভেঙে ছাত্র ফুসলিয়ে তাদের সঙ্গে শুতে পারি না, টাকা না নিয়ে শুলে স্ট্যাটাসে বাধে, এতো পড়াশুনা করে ফেলেছি, হাজার দশেক বই পড়ে ফেলেছি, সতেরোটা গবেষণার বই লিখে ফেলেছি ইংরেজি আর বাংলায়, তুমি, আমাদের দেহের ঈশ্বর, আজ দেখা দিলে আশি-নব্বুই বছর পর, ঝিনচাকুনি খেলা তো খেলতেই হবে ।
নগেন দত্ত বললেন, ওহ, আমার জ্ঞানচক্ষু যাকে বলে উন্মীলন করে দিলি তোরা দুজনে, আমি তো কখনও স্ট্যাটাসের কথা ভেবে কারোর সঙ্গে শুইনি, দেশে হোক বা বিদেশে, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে হোক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, ব্রিটেনের পুঁজিবাদে হোক বা ভিয়েতনামের সাম্যবাদে, নিউ ইয়র্কের আনডারগ্রুাউন্ড হুকারের সঙ্গে হোক বা জার্মানির ওভারগ্রাউন্ড ব্রথেলে, আমি তো ভাবতুম যা পাই তাই খাই হল প্রকৃত প্রেমিকের লক্ষণ । বুঝতেই পারছিস যে আমি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী ।
তিথি আহমেদ বললে, চলো না গো, জানই তো আমার গায়ে সুলতান ইলিয়াস শাহের রক্ত বইছে, সেরকম স্ট্যাটাসের নাগর পাইনি বহুকাল, সবই এলেবেলে রাস্তাছাপ, প্লেবিয়ান কোমরের মিনসে-মরদ, চুমু খাবার টেকনিক জানে না, শোবার শৈলী জানে না, জড়াবার আঙ্গিক জানে না, তাদের কেবল মুঠোয় কনটেন্ট হলেই হয়ে গেল, আমাদের যেন সাধ-আহ্লাদ নেই, উপচে ওঠার ইচ্ছে নেই । সংসার করিনি কেন বলো তো, সংসার মানেই তো পুনরাবৃত্তি, একই পুরুষ, একই দুর্গন্ধ, একই বিছানায় দিন নেই রাত নেই, বাচ্চার পর বাচ্চা বিইয়ে চলো বছর-বছর, ওহ ভাবা যায় না।
তোরা এখন অধ্যাপনা করিস, ছাত্র ঠ্যাঙাস, সকালে টিউশানি রাতে ইশক সমুন্দর ডাল দে অন্দর, তোদের কি বিনা পোশাকে পাগলু ডান্স করা শোভা পায়? আমার কথা বাদ দিচ্ছি, আমি হলুম জমিদার বাড়ির ছেলে, কর্নওয়ালিসের দেয়া অধিকার শরীরে রয়ে গেছে, আইনে থাকুক বা না থাকুক, তাই ভাবছিলুম…।
নগেন দত্ত ভেবেছিলেন অধ্যাপক চক্কোত্তির পেছন-পেছন ওয়াশরুমের কোনও একটা গোপন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখবেন রহস্যটা কি, আবার দুজন যুবতী টোপ ফেলেছে, লোভ ছাড়তে পারছেন না, জানোয়ারগুলো ভেতর থেকে ডাক দিচ্ছে । সেই সঙ্গে মনের ভেতরে কুন্দনন্দিনীর চাহিদা আকুপাঁকু ।
বিনা পোশাকে কই, ঠিক করে চেয়ে দেখবে তো ! তুমিই তো সালভাদর দালিকে ১৯২৯ সালে বলেছিলে আমার শরীরে ‘দি গ্রেট ম্যাসটারবেটর’ পেইনটিংখানা এঁকে দিতে, দ্যাখো কেমন ঝলমল করছে সারা শরীর জুড়ে, বলল তিথি আহমেদ, নগেন দত্তের দিকে পেছন ফিরে, সামনে দিক দেখাবার পর।
নগেন দত্ত বললেন, তাই তো চিন্তায় ছিলুম যে তোরা বুড়ি হলি কেমন করে, দাদামশায়ের উইলে লেখা আছে যে আমি যার সঙ্গেই শুই না কেন, তার বয়স উনিশ থেকে কুড়ির ভেতরে আটকে থাকবে ।
আমি উনিশেই আছি গো, তিথি আহমেদ নিজের দুই বুকে হাত রেখে বললে, এ রঙ একেবারে পাকা, তোমার গায়ে বা ধুতি-পাঞ্জাবিতে লাগবে না । সালভাদর দালি তো বলেই ছিলেন তোমাকে যে ‘দি গ্রেট ম্যাসটারবেটর’ হল কালজয়ী পেইনটিং, আমার দেহ জয় করে ফেলেছে কালপ্রবাহকে । তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী আমার পিরিয়ডও মাসে-মাসে হয় না যে পেইনটিং খারাপ হয়ে যাবে ; সেই যে সালভাদর দালি আমার দেহে এঁকে দিলেন, তারপর তো একশো বছর হতে চলল, মাসিক হয়নি, স্যানিটারি প্যাড বেঁধে পেইনটিংটার মাঝখানে প্যাচ বসাতে হয়নি । কালেজে পড়াতে গেলে এর ওপর জিনস আর টপ পরে নিই, যদিও উপাচার্য মশায় বলেছেন যে পেইনটিঙ দেখতে না পেলেও ছাত্ররা পেইনটিঙের নাম শুনে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে । আমি উপাচার্য মশায়কে বললুম যে আমার পড়াবার বিষয় হল ‘লিঙ্গ উইথ স্টিকস’, যাকে কালেজ পড়ুয়ারা বলে লিঙ্গুইস্টিকস, তাতে তো তারা বিপথগামী হচ্ছে না, বিশ্বখ্যাত পেইনটিঙ দেখে হবার প্রশ্ন ওঠে না।
তা ঠিক,বললেন নগেন দত্ত, সালভাদর দালি বলে কথা, কজনের ভাগ্যে জোটে অমন দৈহিক অমরত্ব ! তাছাড়া কালেজের ছাত্রদের পড়াবার সময়ে তুই দেহের ভাষাকে আড়াল করে রাখতে পারছিস, মাংসের ত্রিকোনমিতিকে আড়াল করে রাখতে পারছিস, যখন কোনো ছাত্রের সঙ্গে শুচ্ছিস তখন সে তোর দেহের গোপন চিহ্ণ আবিষ্কার করে আহ্লাদে রসাক্ত হবার সুযোগ পাচ্ছে ।
ছন্দরানি বললে, আমার বুকদুটোকে কাঁচা আমের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল পাবলো পিকাসো নামে তোমার এক বন্ধু, দুটোরই তলায় হাত আঁকা, যেন তুমি তুলে ধরে আছো, যেদিন আঁকছিল সেইদিনকে তো তুমি অমন করেই হাত রেখেছিলে, আর এই তলায় মাঝখান থেকে কাটা পিচফল এঁকে দিয়েছিল, তার বদলে ওনার সঙ্গে শুতে হয়েছিল, তুমি বলেছিলে, শুয়েনে-শুয়েনে, কজনেরই বা ভাগ্য হয় পাবলো পিকাসোর সঙ্গে শোবার, তা উনি ভেবেছিলেন উনিই বুঝি ধামসা-ধামসি করতে এক্সপার্ট, আমি এমন ধামসে দিয়েছিলুম যে ওনার রাশিয়ান বউকে চেয়ার ঠেলে ওনাকে এয়ারপোর্টে প্লেন ওব্দি নিয়ে যেতে হয়েছিল। শোবার আগে উনি ওনার গুয়ের্নিকা নামের পেইনটিঙ আমার গায়ে শাড়ির মতন এঁকে দিয়েছিলেন, সুবিধে এই যে স্নান করলেও যায় না আর শাড়ি পরারও দরকার হয় না ।
তা ভালো করেছিস, কাঁচা সবুজ আম দেখে কালেজের ছেলেদের নোলা নিশ্চই সকসক করে, কার্নিভালের লালা ঝরায় । তুই কী পড়াচ্ছিস তোর কালেজে, জানতে চাইলেন নগেন দত্ত, তুইও কি উনিশে আটকে আছিস ।
না গো, বললে ছন্দরানি, আমি কুড়িতে রয়েছি সেই ইংরেজদের সময় থেকে, তখন স্যানিটারি ন্যাপকিন আসেনি, দ্রৌপদীর মতন কানি বাঁধতে হতো । কিন্তু ইংরেজদের সময় থেকে পিরিয়ড তিরিশ বছরে একবার হয় বলে নিশ্চিন্তে আছি । আমি অনেক সহজ বিষয় পড়াই, লুডহ্বিগ হিটগেনস্টাইন নামে একজন সায়েবের লেখালিখি, যা উনি জটিল করে লিখে গেছেন ।
মানে ?
এই ধরো উনি বলেছেন, এক এক করে বলব, নাকি গড়গড় করে বলে যাবো ? গড়গড় করে বললে আমি বুঝতে পারব না কি বলছি আর তুমি কী শুনছ ?
তাহলে এক এক করেই বল ।
লুডহ্বিগ হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন :
১) সেই সমস্ত ব্যাপারই হল জগৎ যা যেমন ঘটে চলেছে ।
২) সেই সমস্ত ব্যাপার একসঙ্গে হল জগৎ, বস্তুর নয় ।
৩) জগৎ নির্ধারিত হয় ঘটনা দিয়ে আর ওই ঘটনাগুলোর ঘটনা হবার মধ্যে দিয়ে ।
৪) তার কারণ ঘটনার সামগ্র্য ঠিক করে দ্যায় যা যেমন ঘটছে আর যা যেমন ঘটছে না ।
৫) যে সমস্ত ঘটনা যৌক্তিক পরিব্যাপ্তির ভেতরে রয়েছে তা-ই হল জগৎ ।
৬) ঘটনাসমূহের দ্বারা জগৎ বিভাজিত ।
৭) অন্য সবকিছু একইরকম থেকে গেলেও, প্রতিটি ব্যাপার যেমন ঘটছে তেমন হতে পারে কিংবা তেমন নাও হতে পারে ।
৮) একটা ঘটনা, তা যেমন ঘটছে, তা হল অস্তিত্বশীল বস্তুস্হিতি ।
৯) বস্তুস্হিতি হল বস্তুর সমন্বয় ।
১০) কোনও না কোনও সম্ভাব্য বস্তুস্হিতির অঙ্গ হওয়া বস্তুগুলোর পক্ষে অপরিহার্য ।
দশটা তর্কবিন্দু এক-এক করে বলার পর নগেন দত্ত আগ্রহ হারিয়ে বার বার ওর কাঁচা আমের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে ছন্দরানি জিগ্যেস করল, আরও অনেক আছে, অনেক-অনেক, সেগুলোও বলব ?
নগেন দত্ত বললেন, থাক আর বলতে হবে না, তা এতো তর্কবিন্দু থাকা সত্ত্বেও, এই জগতে তাহলে কুন্দনন্দিনীকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন ?
তিথি আর ছন্দরানি দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, এখনও সেই কুন্দনন্দিনীর খোঁজ চলছে ? কী এমন আছে কুন্দনন্দিনীর যা আমাদের নেই ?
তোদের বাইরেটা আছে, তা কুন্দনন্দিনীর মতনই, কিন্তু আমি চাই কুন্দনন্দিনীর ভেতরের কুন্দনন্দিনীকে । যে কোনো মেয়ের বাইরেটা আমি কুন্দনন্দিনীর মতন গড়ে নিতে পারি, হুবহু পারি, কিন্তু কোনো মানুষের ভেতরটা তো পারি না, তাই আসল মানুষটাকে দরকার, তাকে ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসা তো ভেতরের ব্যাপার, জানিসই তো ।
একটুক্ষণ থেমে নগেন দত্ত বললেন, এই একই কথা স্ট্যালিনের সঙ্গে হয়েছিল, উনি বলেছিলেন মানুষের ভেতরটা না বদলাতে পারলে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না । স্ট্যালিন চলে গেল আর সবায়ের ভেতরে উনি একটা করে যে স্ট্যালিন গড়ে দিয়েছিলেন, তারাও চলে গেল ওনার সঙ্গে, যতো দেশের নেতার ভেতরে স্ট্যালিন একটা করে স্ট্যালিন ঢুকিয়ে ছিলেন, তারাও তাদের ভেতরের স্ট্যালিনকে বের করে ফেলে দিয়ে পুরোনো মালগুলো বের করে আনলে, তাদের দেশগুলোতেও একই ব্যাপার ঘটল, বুঝতে পারছিস তো কী বলছি ।
নগেন দত্তের বাঁ পাশের চেয়ারে বসে, ডান পায়ের ওপর বাঁ পা রেখে, তিথি আহমেদ জানতে চাইল, তাহলে লিবিয়ার গদ্দাফি আর ইরাকের সাদ্দাম গেল কেন ? ছন্দরানি বসল নগেন দত্তের ডানদিকে, পা ফাঁক করে দোলাতে লাগল , নগেন দত্তের গায়ে গা ঠেকছিল, বুঝতে পারছিলেন নন্দরানির দেহে তাপ রয়েছে, তিথি আহমেদের দেহ সেই তুলনায় ঠাণ্ডা।
নগেন দত্ত বললেন, আরে ওরা কিছুই বদলাতে পারেনি, শুধু ভয় পাওয়াকে বদলে দিয়েছিল, তাই তো নিজেরাও ভয় পেয়ে শেষকালে গিয়ে লুকোলো নর্দমায় আর গর্তের ভেতরে । মানুষের ভেতরটা বদলাবে তবে তো দেশটাকে বদলাবে । ওরা যাবার পর ভেতরের ভয় অনেকেরই চলে গেছে, তারা এখন অন্যদের ভয় পাইয়ে খুন লোপাট গণধর্ষণ বোমা-মারা সোনাদানা লুট, মূর্তিভাঙা, কালোবাজারি, পেটরল বিক্রি, ক্রীতদাসী বিক্রি এই সব কাজ করে চলেছে, ওদের ভেতরটা যা ছিল, কয়লার রঙের বরফখণ্ড, তা-ই রয়ে গেছে ।
মূর্তিগুলোকে কেন ভাঙে আজও বুঝতে পারলুম না, এ এক হেঁয়ালি ! বললে ছন্দরানি ।
হেঁয়ালির কি আছে ? নিজেদের মেয়েমানুষের যদি অমন বড়ো-বড়ো বুক না থাকে, নিজেদের পুরুষদের যদি অমন বড়ো-বড়ো ব্রবডিংনাগের মেশিন না থাকে, তাহলে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে ভাঙাভাঙি করা ছাড়া তো আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত হবার পথ নেই ।
গলার স্বরে আফশোষ ফুটিয়ে তিথি আহমেদ, গায়ে শাড়ির মতন জড়ানো সালভাদর দালির হলুদ রঙের পেইনটিং, বাঁহাত দিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, দেয়ালে ওই গুরু-মহারাজের ছবি দেখছো, ওই বাঞ্চোতের সঙ্গে আমাকে মাসে একবার শুতে যেতে হয়, পাঁচতারা হোটেলে, উনি সেখানে স্যুট-টাই পরে কর্পোরেট মালিকের সাজে আসেন । ভালো পয়সা আর পাঁচতারার শীতাতপ আরাম সত্ত্বেও লোকটার গায়ে রামছাগলের বোটকা বিটকেল গন্ধে বমি পেয়ে যায়, বাঞ্চোটার লিঙ্গও এক ইঞ্চের, চক্কোত্তি বলে যে অমন হিটলারেরও ছিল, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়, ক্লাইমেক্সের সময়ে রামছাগলের মতন জিভ বের করে উলু দ্যায় ।
পেপার ওয়েটের ভেতরে গোলাপি রঙে ‘ভালোবাসা’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে তিথি আহমেদ বলল, ভালোবাসা কাকে বলে তা জানা হল না জীবনে, রোমান্টিক প্রেম কাকে বলে তা অনুভব করা হল না, শুধু শোয়া আর শোয়া ।
নগেন দত্ত তিথি আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তো সারাজীবন খুঁজে চলেছি ভালোবাসার পাত্রীকে, আমিও তো জানি না, আমারও তো শোয়া আর শোয়া । তিথির হনু সামান্য উঁচু, গালে গোলাপি আভা, ঠোঁট চিনাদের মতন ছোট্ট আর গোল হলেও, ছড়ানো শ্যাম্পু করা চুল কাঁধ পর্যন্ত, নাকও ছোটো আর একটু ওঠানো, মুখশ্রীতে ক্ষমতা আছে নিজের ভাব প্রকাশের আর লুকোনোর, জোরে হাসে, হাসাতেও পারে নানা কথা বলে ।
সুর্মা আতর কাজল তেল মাখা, গোলছাঁদের মুখে টসটসে হাসি ফুটিয়ে ছন্দরানি মজুমদার পা নাড়াতে-নাড়াতে বললে, আমি এই বেশ ভালো আছি, তোমাকেই ভালোবেসেছিলুম, তা এখনও বজায় রেখেছি, তা সে যতজনের সঙ্গেই শুই না কেন । তারপর নগেন দত্তের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললে, তখন থেকে তুমি আমার আমের দিকে তাকাচ্ছ, খেতে ইচ্ছে হয় খাও না, তোমারই তো ফল, তোমার গাছে ফলিয়ে গেছে তোমার বন্ধু পাবলো পিকাসো ।
নগেন দত্ত জিগ্যেস করলেন, একবার বাঁদিক আর আরেকবার ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে, চক্কোত্তি গেল কোথায়, ওয়াশরুমের ভেতরের গোপন দরোজা দিয়ে সেই যে গেছে, ফেরার নাম নেই ।
তিথি আহমেদ, চোখ বুজে, চোখের গোলাপি অন্ধকারে নিজেকে পুরোপুরি চুবিয়ে বলল, ও, তাই বুঝি, তাহলে কোনও কারণে তোমাকে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, এখন কিছুদিন আর ফিরবে না ।
সে কি রে, অবাক হলেন নগেন দত্ত, তাহলে এই যে রাত হতে চলল, রাতচরা খদ্দেররা আসা তো আরম্ভ হয়ে গেছে, দরদস্তুর, সময়, ঘরনির্দেশ, মাগবাছাই সেসব কে সামলাবে ।
ছন্দরানি মজুমদার , যার দেহে আঁকা পিকাসোর গুয়ের্নিকা শাড়ি, আর যার চাউনির মধ্যে কৌতূহল ঝলকাচ্ছিল, বললে, কেন, যে দুজন আমাদের আন্ডারে পিএইচডি করছে, তারাই তো সামলায় পিসি বাড়ি না থাকলে, ওদের শেখানো-পড়ানো হচ্ছে কেন, এই জন্যেই তো ! পিসির তো ছেলেপুলে নেই, তার ওপর কি একটা ব্যামো আছে যে ছেলেপুলে হবে না, তাই ওরা দুজনই ওনার বংশ ধরে আছে ।
ছন্দরানির সবুজ ফজলি আমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোর আম দেখতে-দেখতে মনে পড়ে গেল সাত বছর আগে পালতোলা নৌকোয় তোর সঙ্গে পূর্ণিমার রাতে শোয়ার কথা, আমার ছোঁয়াকাতর অঙ্গ তোকে ভেদ করে ভেতরে গিয়ে থামতেই চাইছিল না, এগিয়েই যাচ্ছিল, যেন কিছু অনুসন্ধান করছে, তখন আমি বুঝতে পারলুম যে তোর ভেতরে গিয়ে আমার প্রাণপুরুষ স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে, অদ্ভুত স্বপ্ন, আজও মনে আছে, মাংসের তৈরি মেশিনের শহর, বাড়িঘরও মাংসের, রাস্তাঘাটও মাংসের, গাছ আর ফুলফলও মাংসের, কতো রঙের মাংস, শুধু মানুষ আর অন্য প্রাণীরা পেতলের তামার রুপোর লোহার আর নানা ধাতুর মিশেলের । আমার অঙ্গ ঘুরে বেড়াতে লাগল ওই মাংসের শহরে, দেখল ধাতুর তৈরি সব মানুষ আর প্রাণীরাই আনন্দ করছে, নাচছে গাইছে মদ খাচ্ছে ভাতরুটি খাচ্ছে, ছাগল-গোরু-শুয়োরের মাংস ধাতুর বলে তাদের ব্লাস্ট ফার্নেসে গলিয়ে গেলাসে আর কাপে ভরে খাচ্ছে । তুই বলতে লাগলি, হে আড়ম্বর আরও ভেতরে এসো, আরও ভেতরে এসো, আরও ভেতরে এসো, কিন্তু তুই আমাকে বলছিলি না, তোর ভেতরে গিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিল, তাকে বলছিলি, আমি যদিও ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কিন্তু তোর কথা শুনতে পাচ্ছিলুম, বুঝতে পারছিলুম যে স্বপ্নটা আমি দেখছি না, দেখছে আমার প্রিয় অঙ্গখানা তোর প্রিয় অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে ।
হ্যাঁ, এই এক তোমার অস্ত্রখানার চরিত্রেরই দেখেছি তোমার সঙ্গে মিল আছে, স্বপ্ন দেখতে জানে, বেশির ভাগ মিনসে নিজেরাই মেশিন, জানেই না যে তারা যেমন স্বপ্ন দেখে, তেমনই তাদের অঙ্গখানার স্বপ্নের সঙ্গে আমার অঙ্গের স্বপ্নের মিল হওয়া উচিত । তোমাকে বলেছিলুম তো, সেদিন নৌকোয় আমার অঙ্গখানাও একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখছিল, ভেসে চলেছি একজন মানুষের ভেতরের নৌকোয় চেপে, লাল রঙের সমুদ্রে সে কি ঢেউ, লাল জলের ঘুর্ণি উঠে এলো আর আমার অঙ্গ সেই লাল ঘুর্ণির সঙ্গে ঘুরতে লাগল, ভাসিয়ে নিয়ে চলল লাল বানভাসিতে আশেপাশের সবকিছু, তারপর আছড়ে লাল জলের সমুদ্রে পড়ে গেল লাল জলের জলস্তম্ভ । আমি ভার্জিন ছিলুম তো, আর সেটাই ছিল আমার প্রথম রাত, তার আগে থেকেই, তোমাকে দেখে পর্যন্ত ভালোবাসতে শুরু করেছিলুম, মনে আছে তোমার, আমি তোমার বুক চাটছিলুম, হাত চাটছিলুম, কোমর চাটছিলুম, মনে হচ্ছিল তোমার পুরোটা চেটে নিজের পাকস্হলিতে ঢুকিয়ে নিই । আমার শরীরের ভেতরে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার ছেড়ে দেয়া ভয়ংকর সামুদ্রিক জীবরা, হাঙর, তিমি, শুশুক, ড্র্যাগনমাছ, ভ্যামপায়ার স্কুইড, লাল-জেলিফিশ, ব্লবমাছ, কফিনমাছ, আইসোপড, স্টারগেজার, চিমেরা, অক্টোপাস, অ্যাঙ্গলারমাছ, হ্যাচেটমাছ, ব্যারেলচোখো, ভাইপারমাছ, গবলিনমাছ, ওঃ, কতো রক্ত বেরিয়েছিল, যা দেখে তোমার মতন নৈমিত্তিক অভিজ্ঞ মানুষও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলে ।
আসলে তোর ভেতরে ঢুকে আমার স্বপ্নের নদী খুঁজে বেড়াচ্ছিল কুন্দনন্দিনীকে, ডাকছিল তাকে কেঁদে-কেঁদে, তারপর না পেয়ে মুষড়ে পড়েছিল ।
ছন্দরানি বললে, আমি তোমাকে চেয়েছিলুম, তোমাকে পেয়েছিলুম, আজও তোমাকেই চাই, অন্যের সঙ্গে শুলেও চোখ বুজে মনে করি যে তোমার সঙ্গেই শুয়ে আছি, আমার সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তা তুমিই করছ । তোমাকে জিইয়ে রেখেছি আমার ভেতরে, প্রতিদিন ক্লায়েন্টরা আমাকে এইভাবে তোমাকে পাইয়ে দ্যায় ।
তিথি আহমেদ বললে, সমস্যা কি জানিস, তিরিশ হাজারিনীর দেশে যারা আসে সকলেই দুঃখি, ভাবে শুলে বুঝি দুঃখু চলে যাবে, অথচ শোবার ব্যাপার তো আনন্দের, আহ্লাদের, মাংসের সঙ্গে মাংসের সংঘাত আর সংঘর্ষের, জন্নতপ্রাপ্তির । এই এক তোমাকে ছাড়া নগেন, কাউকে দেখলুম না যে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারে ।
ছন্দরানি সায় দিয়ে বললে, হ্যাঁ গো সত্যি কথাই বলেছে তিথি, বুড়োগুলো তো বটেই ছেলে-ছোকরারাও কুন্দনলাল সায়গলের কান্নাকাটি শুনতে চায় । শুনে-শুনে মুখস্হ হয়ে গেছে, অনেক সময়ে এমন রাত গেছে যে শোবার বদলে রাত জেগে সায়গল গেয়ে গেছি একের পর এক । মেড়োপার্টিগুলো ফাটকায় লস খেয়ে আসে আর কান্নার গান শুনতে চায়, এই করে-করে চটকলগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলে ।
তাই বুঝি ? দাঁড়া, কুন্দনলাল সায়গলকে ডাকছি, উনি ভালো বোঝেন কোন গানটা আসল-দুঃখের আর কোন গানটা দুঃখের অভিনয়ের ।
ডাকো তাহলে । বললে ছন্দরানি, ও নগেন দত্তের ক্ষমতায় অবিশ্বাস করে না । করার কথা নয় । যার মাংস ওর দেহে গিয়ে স্বপ্ন দেখে পথ হারিয়ে যায়, তার ক্ষমতার তুলনা হয় না ।
কই সায়গল, এসো, তোমার দুজন প্রেমিকা তোমার দুঃখের গান শোনার জন্যে উৎসুক ।
দরোজা খুলে ঘরে ঢুকলেন কে এল সায়গল, এক হাতে শিভাস রিগাল বোতল, আরেক হাতে একটা বড়ো কাঁচের গ্লাস। একটু ঝুঁকে পড়েছেন গানের ভারে।
চক্কোত্তির চেয়ারে বসে জিগ্যেস করলেন, কোন গানটা তোমাদের শোনাবো ?
তিথি আর ছন্দরানি দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, সায়গলসাব, আমাদের একটা দুঃখের গান শোনান । আমাদের ক্লায়েন্টরা দুঃখের গান শোনার জন্যে হাপিত্যেশ করে থাকে ।
সায়গল বললেন, আমার নিজের তো কোনো দুঃখ নেই, সবাই দুঃখ কমাবার জন্যে মদ খায়, আমি দুঃখ পাবার জন্যে মদ খাই, দাঁড়াও বোতলটা খালি করে নিই, তোমরা দুজনেও খাবে নাকি, এটা আসল শিভাস রিগাল, প্রযোজকের দেয়া ভেজাল মাল নয় ?
ওরা দুজনে বললে, না,না, আপনি খান, যদিও ভেজালে আমাদের আপত্তি নেই, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন আসল আর ভেজালে কোনো তফাত নেই স্যার ।
সায়গল পুরো বোতল ফাঁকা করে গান ধরলেন । নগেন দত্ত চোখ বুজে গানটার পুরোনো সঙ্গীতযন্ত্র প্রয়োজনমতো জুড়ে দিলেন ।
অব ম্যায় কা করুঁ কিত জাউঁ
ছুট গয়া সব সাথ সহারা
অপনে ভি কর গয়া কিনারা
এক বাজি মেঁ সবকুছ হারা
আশা হারি, হিম্মত হারি
অব ক্যা দান লগাউঁ
মাঈ কা করুঁ কিত জাউঁ
জো পৌধা সিঁচা মুরঝায়া
টুট গয়া জো মহল বনায়া
বুঝ গয়া জো ভি দিয়া জলায়া
মন অন্ধিয়ারা জগ অন্ধিয়ারা
জ্যোত কহাঁ সে লাউঁ মাঈ
কা করুঁ কিত জাউঁ…
গান শেষ হলে, বোতল আর গ্লাস হাতে নিয়ে উবে গেলেন কুন্দনলাল সায়গল ।
তিথি বললে, দেখলে তো, কেবল আমার নয় ছন্দরও ওই একই প্রবলেম । ওফ দুঃখ বিষাদ অবসাদ গ্লানি ক্ষোভ উদ্বেগ উৎকন্ঠা বিবমিষা যন্ত্রণা করে-করে মরে গেল খদ্দেরগুলো, এখানে এসেছিস আনন্দ কর, আনন্দ দে, তা নয়্, কান্নাকাটি, এক্কেবারে সহ্য করতে পারি না । মদে চুর হলে তো একেবারে ল্যাজেগোবরে, বাড়িতে তো কাঁদতে পারে না, এখানে এসে কাঁদে।
তার কারণ আছে, বললেন নগেন দত্ত, আমি তোর সঙ্গে প্রথম রাতে শুয়েই বুঝে গিয়েছিলুম, অবশ্য আমাকে বুঝতে হয়েছিল হাত দিয়ে, মগজ দিয়ে নয় । তুই ইলিয়াস শাহী পরিবারের, তোকে কম বয়সে খতনা করা হয়েছিল, তোর দেহের স্বপ্ন দেখার কুঁড়িটাকে কেটে ফেলে দেয়া হয়েছিল তো ফুল আর কোথ্থেকে ফুটবে, আমি জেনে গিয়েছিলুম যে ফুল ফোটাতে হলে অনেকক্ষণ সার দিতে হবে, মাটি খুঁড়তে হবে, জল দিতে হবে, তারপরই তোর দেহে স্বপ্ন আসবে যা তোর মগজ নষ্ট করতে পারবে না ।
ছন্দরানি বললে, আমার ঘরে ইশকুলের একটা ছেলে আসে, এগারো ক্লাসে পড়ে, টিউশানির টাকা খরচ করতে আসে তিরিশ হাজারিনীর দেশে । তুমি তো জানোই যে কারোর বুকেপিঠে ঘামাচি আর গালে ব্রণ আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না । ছেলেটা আলোয় পোশাক ছাড়তে লজ্জা পাচ্ছিল বলে আমি আলো নিভিয়ে ওর শার্ট-প্যান্ট খুলতে সাহায্য করলুম, তারপর দেখি কি, সারা পিঠ আর বুক জুড়ে ঘামাচি ।
পা নাড়ানো থামিয়ে ছন্দরানি বললে, আমার কাছে ঘামাচির ট্যালকম পাউডার রাখি, তা ভালো করে মাখিয়ে দিলুম ছেলেটার পিঠে-বুকে, গালের ব্রণতে বোরোলিন লাগিয়ে দিলুম । ছেলেটা বিছানায় টাকাটা রেখে কেঁদে ফেললে, সে এক কেলেঙ্কারি, কিছুতেই শুতে রাজি হল না, শার্ট-প্যাণ্ট পরে টুক করে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সিঁড়ি দিয়ে পোঁ-পাঁ । তারপর যখনই আসে, পাউডার মাখিয়ে দিতে বলে, টাকা দিয়ে বলে, এটা পাউডার আর পাউডার-মাখানোর দাম মনে করে রেখে নিন। কতোবার বলেছি যে এসো বিছানায় এসো, অন্তত শিখে যাও কী করে কি করতে হয়, তা নয়, পাউডার মেখে চোখের জল ফেলে চলে যায় । একদিন বললে, ওর একজন প্রেমিকা আছে, সেও জানে যে ওর গা-ময় ঘামাচি হয়, কিন্তু কখনও বলেনি যে চলো তোমায় পাউডার মাখিয়ে দিই, কিংবা পাউডার কিনে দিয়ে বলেনি যে এটা গায়ে মেখো । ছেলেটা এলে আমার ভালো লাগে, বলে দিয়েছি যে ইচ্ছে হলেই এসো, কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে কষে এক থাপ্পড় দেবো ।
যাক, তিরিশ হাজারিনীর দেশে একজন তো তোকে শ্রদ্ধায় উন্নীত করেছে, বললেন নগেন দত্ত, তোর নিজের ছেলে লণ্ডনে পড়াশুনা করলেও, এখানে পাতানো ছেলের ভালোবাসা পাচ্ছিস আবার ছেলে তোর প্রেমিকও, কজনের ভাগ্যেই বা ছেলে-প্রেমিক জোটে, ।
তিথির মুখের প্রকাশভঙ্গী দেখে নগেন দত্তের মনে হল, তিথি যেন ভাবছে ছন্দরানির সঙ্গে জীবন পালটা-পালটি করে নিতে পারলে ভালো হতো । তিথির চরিত্রে একটা ব্যঙ্গ করার দিক আছে, যাকে ভুল করে মনে হতে পারে দাম্ভিকতা ।
দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী ওদের দুজনেরই আইডিওলজিকাল মেনোপজ শুরু হয়ে গেছে, উনিশ-কুড়িতে আটকে থেকে কোনো সমস্যা নেই ।
হ্যাঁ গো, ছেলেটা আমায় ম্যাম বলে ডাকে, কতোবার বলেছি যে আমার নাম ধরে ডাক, তা ডাকবে না, বলে যে ওর প্রেমিকা আর ও দুজনে মিলে অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে পালাবে মাওবাদী বিপ্লব করতে; কী যে বিপ্লবে পেয়েছে আজকালকার ছেলেমেয়েদের । এতো রকমের মাল আসে, কী বলব, তারা নানা সম্পর্কের আগল ভাঙতে চায়, যা তিরিশ হাজারিনীর দেশের বাইরে অনুমোদন পায় না । একজন আমাকে বৌদি বলে ডাকে তো একজন কাকিমা, একজন মাসিমা বলে ডাকে তো আরেকজন পিসিমা । মুখে বিড়বিড় করতে থাকে তারা, নানা কথা বলে-বলে, বৌদি তোকে ভালোবাসি, মাসি তোকে ছাড়া বাঁচব না, কাকি তুইই আমার সব, পিসি তুমি আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছো । আমিও সায় দিয়ে যাই, যাতে যার আনন্দ । এদের অনেকে প্রথম দিন এলে বুঝতে পারি যে খেয়াঘাট কোথায় আর বন্দর কোথায় তা জানে না ।
নগেন দত্ত বললেন, আমার পতৃদেবও আমাকে শেখাবার জন্যে যার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার কাছেই আমি বন্দর আর খেয়াঘাটের পার্থক্য শিখেছিলুম।
ছন্দরানি বললে, একবার কালেজের ছয়টা ছেলে এসেছিল, দেখেই টের পেয়েছিলুম পয়সাঅলা বাড়ির, বললে যে, কাগজে গণধর্ষণ পড়ে-পড়ে ওদেরও গণধর্ষণ করার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু রাস্তাঘাটের পার্টিগুণ্ডাদের মতন তো গণধর্ষণ করতে পারবে না, তাই এই বাড়িতে এয়েচে । মাসিপিসি বললে, তার জন্যে তো তোমাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে হবে, যাকে গণধর্ষণ করবে তার সঙ্গে টানাহেঁচড়া করতে হবে, সেসব করতে গিয়ে ঘরের জিনিসপত্রের ভাঙচুর হলে খেসারত কে দেবে । ওদের দলের ফর্সা ছেলেটা একতাড়া পাঁচশো টাকার নোট মাসিপিসিকে দিয়ে বললে, এই নিন আগাম ক্ষতিপূরণ, দু-ক্রেট বিয়ার আর চিকেন ললিপপ আনিয়ে দিন, আর যাকে আমরা গণধর্ষণ করব তাকে তার আলাদা চার্জ দিয়ে দেবো, কেননা যা ব্যক্তিগত তা যে সর্বজনীন তা আমরা আজ প্রমাণ করে ছাড়ব ।
নগেন দত্ত কৌতূহলে বললেন, তারপর ?
মাসিপিসি ওদের পাঠিয়ে দিলে মীরার ঘরে, মীরাকে তো চেনো, ওর গায়ে এডওয়ার্ড মুঞ্চ ১৮৯৩ সালে ‘দি স্ক্রিম’ পেইনটিঙ এঁকে দিয়ে গিয়েছিল শাড়ির মতন করে, ওর ঘরটা বেশ বড়ো, খাটের চারিপাশে যথেষ্ট জায়গা আছে, আয়নাও সাবেকি, ঠুনকো নয়, ঠাকুরদেবতার তাকও বেশ ওপরে । ছোঁড়াগুলো কেমন করে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, মীরার দেয়া চোলাই মদ খেয়ে বোকার মতন হাসাহাসি করছিল । কাস্টামাররা প্রথম এসে সন্দেহমাখা চাউনি তুলে তাকায় । মীরাকে দেখেছো তো, রঙ ধবধবে, চুলও বড়ো, ছোট্টো কপাল, পাতলা ঠোঁট, শুধু চোখ দুটো ছোটো বলে মার খেয়ে গেছে, নয়তো ওর রেট দশ মিনিটের দশ হাজারে শুরু হতো । যাকগে, তা ছেলেগুলো সাহস যোগাতে পারছে না দেখে মীরা একজনের গালে বসিয়ে দিলে কষে একখানা চড় ।
বাইরে উড়ন্ত বাদলাপোকাদের দিকে তাকিয়ে কথা বজায় রাখল ছন্দরানি, চড় খেতেই তার মুখ থেকে বাংলা ভাষা লোপাট, খিস্তি আরম্ভ করে দিলে, খানকি, ব্লাডি বিচ, রাঁঢ়, মাগি, ফাকিং স্লাট, স্ট্রিট হুকার, এইসব, তবুও কেউ এগোচ্ছে না দেখে আরেকজনকে দিলে একখানা চড়, আমরা বারান্দা থেকে রগড় দেখছিলুম, ওদের মধ্যে যেটা ঢ্যাঙা ছিল সেই প্রথমে এগিয়ে গেল মীরার দিকে, তাকে টেনে আলাদা করলে ফর্সা ছেলেটা, লেগে গেল নিজেদের মধ্যে সত্যিকার মারামারি, বিয়ারের বোতলগুলো খুলে-খুলে এ ওকে ও তার মাথায় ঢেলে নিজেদের ভিজিয়ে ফেললে, মীরাও সেই সুযোগে বাকি দুটোকে কষিয়ে দিলে চড়, একটা ছোকরা লাফিয়ে মীরার ওপর পড়তেই মীরা তাকে নিয়ে সোজা বিছানায়, নিজের গোড়ালি দিয়ে ছেলেটের পোঁদে দুতিনবার চাপ দিতেই তার হাওয়া কলকলিয়ে বেরিয়ে গেল, সিংহির মতন আঁচড়ে কামড়ে গরগর আওয়াজ তুলে ওর শখ মেটালো । পরের তিনটেকেও মীরা আঁচড়ে কামড়ে পোঁদে গোড়ালির চাপ দিয়ে ওই ভাবেই হাওয়া বের করে দিলে, বিয়ারে ভিজে পোশাক শোকাবার জন্যে ল্যাংটো পোঁদে ল্যাংচা বের করে বসে-বসে ললিপপ খেলে ছোঁড়াগুলো । ওদের ছিল প্রথমবারের শোয়াশুয়ি, মীরার দেয়া বোরোলিন লাগিয়ে পা ফাঁক করে অনেকক্ষণ ধরে ল্যাংচার জ্বালা সারিয়েছিল ।
হাসিমুখে ছন্দরানি স্মৃতির আমোদ নিয়ে বললে, ওরা গণধর্ষণের পালা সাঙ্গ করে বিদেয় হল । মীরা ওদের বলেছিল, যখন ওরা ওর ঘর থেকে টলতে-টলতে বেরোচ্ছে, এখন মদে চুর হয়ে আছো, যাও গিয়ে নর্দমায় একরাত কাটিয়ে বাড়ি ফিরো, নর্দমায় রাত না কাটালে জীবনের উত্তম অভিজ্ঞতা হবে না ।
হাসি বজায় রেখে ছন্দরানি আরও বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশে মীরার কিন্তু খ্যাতি আছে একসঙ্গে দশবারোজনকে হ্যাণ্ডল করার । মীরা বলেছিল, ওদের মধ্যে একজনকে ও চিনতে পেরেছিল, সে মীরার ভাইপো, যে ভাইটা পার্টি করতো আর মীরাকে ফুসলিয়ে বেচে দিয়েছিল দিল্লির এক ব্যাবসাদারকে, তার বড়ো ছেলে ।
তাছাড়া কি জানো, বলল ছন্দরানি কিছুক্ষণ থেমে, যেন চেঁচিয়ে চিন্তা করছে, মীরার ঘরের আয়নায় নিজেকে দেখতে গেলে নিজেকে দেখা যায় না, তার বদলে হনুমান, শিম্পাঞ্জি, বেবুন, গেরিলা, বাঁদর, ওরাং ওটাং দেখতে পাওয়া যায়, আগের জন্মে লোকটা যা ছিল, তাই কেউ বেগড়বাঁই করলেই আয়নার পর্দাটা সরিয়ে দ্যায় মীরা, ও তো জুলজির অধ্যাপনা করে, জন্তু-জানোয়ারের অন্তরজগতের খবর রাখে ।
তিথি বলল, এমন-এমন সব জোটে না, কী বলব । যাকগে, সেই থেকে বসে আছ, রাত তো বেশ হল, তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চই ? বলো তো কিছু রান্না করি তোমার জন্যে, পোর্টাবেলো মাশরুমের সঙ্গে অলিভ অয়েলে বাছুরের মাংস দারুণ রাঁধতে পারি, বা যদি চাও তাহলে রসুন রেড ওয়াইন ভিনিগারে চুবিয়ে হরিণের মাংসের স্টির-ফ্রাই, পরোটায় মুড়ে, কিংবা অর্ডার করে আনাই ; তিরিশ হাজারিনীর দেশে খাবার হোটেল প্রচুর।
নগেন দত্ত বললেন, তার চেয়ে চল বাইরে গিয়ে খাওয়া যাক, সালামি আর বিয়ার, তারপর না হয় একটা ফিল্ম দেখা যাবে, কতো যুগ হয়ে গেল দেখিনি । ওয়াশরুমের যে রাস্তায় চক্কোত্তি পালিয়েছে, ওই রাস্তার কোনো একটা সিঁড়ি দিয়েই যাই, ওকে খুঁজে পেতে পারি, খুঁজে না পেলেও ক্ষতি নেই, নিচের তলায় কি হয় আর চক্কোত্তির গোপন ব্যাপারখানা জানারও ইচ্ছে রয়েছে ।
কোন রাস্তা ? গোপন পথ আছে নাকি কোনো, কই জানি না তো ! এতোকাল রয়েছি এই বাড়িতে ! বললে তিথি আহমেদ ।
নগেন দত্ত বললেন, তিথির দিকে চেয়ে, সে কি রে, ওই ওয়াশরুমের ভেতরে একটা দরোজা আছে, সেই দরোজা দিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি নিচে কোথাও কিংবা অনেক দিকে চলে গেছে, তা তোরা জানিস না ? আজব ব্যাপার ।
ছন্দরানি বললে, মুখময় শঙ্কার পাতলা চাদর, না, এই ঘরে কতোবার এসেছি গেছি, কখনও তো চক্কোত্তিমশায়কে দেখিনি টয়লেটে গেলো আর লোপাট হয়ে গেল ।
লোপাট হয়ে গেল বলেই তো অপেক্ষা করে এক ঘণ্টা পরেও যখন এলো না, তখন ভেতরে ঢুকে সিঁড়িগুলো দেখতে পেলুম, বললেন নগেন দত্ত ।
দুজনেই বললে, চলো, আমরা ওনার কালোধান্দার অনেককিছু জানি, আবার অনেককিছু জানিও না । এই পোশাকেই যাই, হাজার তিরিশিনীর দেশে পোশাক-আশাকের তেমন বাঁধাধরা নিয়মনীতি নেই, ওপর ঢাকা-তলা ঢাকা মনে হলেই হল, তা সে ঢাকা বাস্তব হোক বা কাল্পনিক ।
তিথি বললে, আমি তো সালভাদর দালির আঁকা দেহশাড়ি পরেই আছি, ছন্দও পাবলো পিকাসোর আঁকা দেহশাড়ি পরে আছে । তুমি তোমার পোশাক পালটে নাও ।
ব্রিফকেস খুলে পোশাক পালটে নিলেন নগেন দত্ত । লাল টিশার্ট, ব্লু-জিনস আর জগিঙ-জুতো । ইল্যাসটিক ব্যাণ্ডে বাঁধা পিগটেল চুল । ব্রিফকেস টেবিলের ওপরেই রেখে দিলেন, চক্কোত্তি ফিরলে যা করার করবে ।
টয়লেটের গোপন দরোজা খুলে ওরা দেখলো অনেকগুলো সিঁড়ি রয়েছে আর তাদের মুখে বোর্ড টাঙানো ; ইতিহাসের পুর্নলিখন, ধর্মের কারখানা, রাজনৈতিক বৈধতা, গ্রন্হাদির রূপবদল, চিৎকারনিলয়, স্লোগানছন্দ, খোচরত্বের প্রশিক্ষণ, নাটুকেপনা প্রশিক্ষণ, গুপ্তচর প্রশিক্ষণ, দলবদল প্রশিক্ষণ, ভোটার ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি প্রশিক্ষণ, ইত্যাদি ইত্যাদি, এক পলকে যেটুকু পড়া গেল । সবকটা বোর্ডের তলায় ছৌ-নাচের মুখোশ ঝুলছে, এক-একটায় এক-একরকম, দেবীর, দেবতার, অসুরের, দানবের, পশুর । কারণ আছে নিশ্চই ।
যে বোর্ডে লেখাছিল ‘রাজনৈতিক বৈধতা’’ সেই সিঁড়িটা সামনে ছিল বলে সেটা দিয়েই নামল ওরা ।
নেমে দেখতে পেল, হাসপাতালের বিশাল অপারেশান থিয়েটার, কড়িকাঠ থেকে তার বেঁধে ঝোলানো, সাদার ওপর গেরুয়ায় লেখা বোর্ড টাঙানো, তার তলায় অপারেশান চলছে পার্টিশান করা ঘরে, তীব্র আলোর তলায় সার্জেনরা গেরুয়া মেডিকাল স্ক্রাব পরে, মুখে গেরুয়া কাপড়ের স্ক্রাব বেঁধে একাগ্র হয়ে শল্যচিকিৎসায় ব্যস্ত ।
বোর্ডে যা লেখা রয়েছে তার সঙ্গে শল্যচিকিৎসকদের কাজের মিল খুঁজে না পেয়ে, তিথি আহমেদ বলল, একেই বলে লিঙ্গ উইথ স্টিকস বা লিঙ্গুইস্টিকস, যা পড়ছ বা যা দেখছ তার সঙ্গে যা ভাবছ তার মিল নেই ।
ওরা তিনজন যে নামল তাতে শল্যচিকিৎসক আর সাহায্যকারী নার্সদের দৃকপাত নেই । পরিবেশ বেশ শীতল, প্রায়ান্ধকার, গভীর । চিকিৎসালয়ের ভীতিকর গন্ধের নৈঃশব্দ । ছন্দরানির মনে হল আতঙ্কের অন্ধকারের গিঁট গড়ে উঠছে গলার কাছে ।
নগেন দত্ত দেখলেন, বোর্ডগুলোয় লেখা রয়েছে কী ধরনের অপারেশান চলছে : রাইনোপ্লাস্টি ( নাককে সুন্দর করা তোলার কাজ চলছে ), ব্লেফারোপ্লাস্টি ( চোখের পাতায় সৌন্দর্যদান করার কাজ চলছে), ফেশিয়াল স্কার রিভিজন ( মুখের দাগ মোছার চিকিৎসা চলছে ), ফোরহেড লিফ্টস ( কপালকে আকর্ষক করার চিকিৎসা চলছে ), হেয়ার রিপ্লেসমেন্ট ( টাকে চুল বসাবার চিকিৎসা চলছে ), মেনট্রোপ্লাস্টি ( থুতনিকে সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), অটোপ্লাস্টি ( কানকে সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), ব্রেস্ট রিকন্সট্রাকশান আফটার ম্যাসেকটনি ( ক্যানসারে স্তন কাটা গেলে নতুন স্তন বসাবার কাজ চলছে ), ফ্যালোপ্লাস্টি ( লিঙ্গকে ছোটো বা বড়ো করার কাজ চলছে ), ম্যাস্টোপ্লাস্টি ( স্তনকে বড়ো বা ছোটো করার কাজ চলছে ), বাটক লিফ্ট ( পশ্চাদ্দেশ উঁচু করা তোলার কাজ চলছে ), লাবিয়াপ্লাস্টি ( যোনিকে বড়ো বা ছোটো করার কাজ চলছে ), ব্রাউপ্লাস্টি ( ভ্রূযুগল সৌন্দর্যময় করার কাজ চলছে ), ভার্জিনিটি রিপেয়ার ( সতীচ্ছদ রিপু করার কাজ চলছে ), পাম রিপ্লেসমেন্ট ( হাত কচলাবার হাত জোড়া চলছে ) ।
ছাদের দিকে তাকিয়ে ওরা টের পেলো যে পাহারা দেবার জন্যে কর্তৃপক্ষ বাদামি মেঘের মতন রসায়নে উড়িয়ে রেখেছেন নানা রকমের ভুতপ্রেত, পেত্নি, শাঁকচুন্নি, মেছোভুত, গেছোভুত, ব্রহ্মদত্যি, কানাভুলো, পিশাচ, মিলিটারি ভুত, অতৃপ্তভুত, তারা নিজেদের মধ্যে সংস্কৃত আর লাতিন ভাষায় কথা বলছে ।
একটা গেছোভুত ছন্দরানির সবুজ আমে মুখ রেখে চুষে উড়ে গিয়ে ফিরে এসে কুঁচকিতে থাবড়া মেরে চলে গেল । ছন্দরানি তার গালে কষে চড় মারলেও বুঝতে পারল যে ভুতটা কোনো পারদর্শী বাষ্পীয় রসায়নে তৈরি, ছোঁয়া যায় না । অথচ ভুতটার গায়ে বিজবিজে এঁটুলি । সংস্কৃত ভাষায় ভুতটা বলল, বস্তুরা যে অবস্তু তা নিজের হাতে দেখলি তো রে মাগি ।
তিথি আহমেদকে জড়িয়ে ধরল একটা মেছোভুত, কী বিটকেল গন্ধ, বলে চেঁচিয়ে ভুতটাকে দুহাতে ছাড়াতে চেষ্টা করলেও পারল না তিথি, ভুতটা কোনো বস্তু দিয়ে গড়া নয় । ভুতটা রাস্তাছাপ ছোকরার মতন সিটি বাজিয়ে ছাদের কাছে উড়ে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল, লাতিন ভাষায়, বস্তুদেরও বস্তুহীনতা হয় গো খুকি ।
বিরাট দুটো মাই ফুলিয়ে একটা শাঁকচুন্নি বাদামি মেঘ থেকে সরাসরি নেমে এসে নগেন দত্তকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে চুমো খেয়ে বুকের গোলাপি বেলুন আরও ফুলিয়ে ফাটালো, তার ভেতর থেকে দুধ বেরিয়ে ছিটকে জ্বালা করতে লাগল ওদের তিনজনের । নগেন দত্ত শাঁকচুন্নির গলা দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে, ভুতটার মাথা আর ধড় আলাদে হয়ে উড়ে গেল খিঁকখিঁক হিঁঃহিঁঃ হাসতে হাসতে ।
এবার সবকটা ভুতপ্রেত, শাঁকচুন্নি, মেছোভুত, গেছোভুত, ব্রহ্মদত্যি, কানাভুলো, অতৃপ্তভুত বাদামি মেঘকে নিয়ে নিচে নেমে এসে তিথি আর ছন্দরানিকে ঘিরে পাক খেতে লাগল, নাচতে লাগল বাদামি মেঘের কুণ্ডলী, ক্রমশ নীল রঙের দেবতা-টাইপ হয়ে, বাবরি চুলে ময়ূর-পালক, ওদের ঘিরে গাইতে লাগল, নাচতে লাগলো হিপ-হপ ।
সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে নগেন দত্ত মনে করতে পারলেন যে গানটা যিনি লিখেছেন, জয়দেব, তাঁর সঙ্গে বহুকাল আগে, বারো শতক নাগাদ, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে একবার দেখা হয়েছিল, মন্দিরের নাচিয়েরা এই গানটা গাইতে গাইতে নেচেছিল :
স্মরসমরোচিতবিরচিতবেশা
গলিতকুসুমদরবিলুলিতকেশা
হরিপরিরম্ভণবলিতবিকারা
কুচকলসোপরি তরলিতহারা
বিচলদলকললিতাননচন্দ্রা
তদধরপানরভসকৃতন্দ্রা
চঞ্চলকুণ্ডলললিতকপোলা
মুখরিতরসজঘনগতিলোলা
দমিতবিলোকিতলজ্জিতহসিতা
বহুবিধকূজিত রতিরসসিতা
বিপূলপূলকপৃথুবেপথুভঙ্গা
শ্বসিতনিমিলতবিকসদনঙ্গা
শ্রমজলকণভরসুভগশরীরা
পরিপতিতোরসি রতিরণধীরা
গান শেষে, নীল দেবতা-টাইপ মিলিয়ে যেতে, ব্রহ্মদত্যি সংস্কৃততে বলল, দরোজা তো খুলবে না, দরোজা তো খুলবে না, আগে বলো, অলবার্সের হেঁয়ালি কাকে বলে ?
নগেন দত্ত উত্তর জানতেন, তিনি এককালে কালেজে বিজ্ঞান পড়াতেন । সংস্কৃততে বললেন, মহাবিশ্ব যদি সুষমভাবে তারাপূর্ণ হতো, তাহলে যেদিকেই তাকাই না কেন, আমাদের দৃষ্টি কোনো না কোনো তারার পিঠে গিয়ে পৌঁছোনোর কথা, আর সেক্ষেত্রে, রাতের আকাশ অন্ধকার হবার কথা নয় । রাতের আকাশ অন্ধকার থাকে কেননা আমাদের দৃষ্টি একই সঙ্গে সব তারার পিঠে গিয়ে পৌঁছোয় না । বহু তারার আলো এখনও পৃথিবীতে এসে পৌঁছোয় নি ।
মিচকে প্রেমিকের মতন মিলিয়ে যাওয়া নীল মানুষ বাদামি মেঘ হয়ে গেল আর ভুতগুলো হাততালি দিয়ে ছাদের কাছে মিশে গেল ।
বাইরে বেরোবার কাঁচের দরোজার কাছে গেলে তা আপনা থেকে খুলে গেল । দরোজার ওপরে গুরু-মহারাজের ফ্রেমেবাঁধানো বিশাল ছবি, ওপরের ঘরের ছবির মতনই চন্দনকাঠ চাঁছাইয়ের মালা পরানো । একই বাণী সোনালি রঙে লেখা, “সত্যের জয় কখনও হয় না, কখনও হয়নি, কখনও হবে না” ।
দরোজার কাছে যে মিলিটারি ভুত দাঁড়িয়েছিল, সারা মুখে আর গায়ে পোশাকের বদলে সাদা রঙ করা, কেবল লিঙ্গের রঙ কুচকুচে কালো, লাল শিশ্ন জ্বলছে টর্চের মতন, সে ওদের দেখে স্যালুট ঠুকলো । নগেন দত্ত একটা এক হাজার টাকার নোট দিতে, গদগদ লোকটা মাথা নিচু করে আবার সেলাম ঠুকলো। বলল, স্যার, আমাদের ভুতপ্রেত বলে মনে করবেন না, আমরা সবাই ভুতগ্রস্ত দেবদূত, আপনারা কখনও দেবদূত দেখেননি বলে হয়তো আমাদের বিশুদ্ধ ভুত বলে মনে করছেন ।
নগেন দত্ত লাতিন ভাষায় জিগ্যেস করলেন, ছৌ-নাচের মুখোশগুলো কিসের জন্যে ?
মিলিটারি ভুত সংস্কৃততে বলল, জানি না স্যার, আগে যে মেছোভুত বাউন্সার ছিল সে জানতে চাওয়ায় তার চাকরি চলে গেছে । তবে কানাঘুষা শুনেছি যে এই অপারেশান থিয়েটারে ভবিষ্যতের মানুষ গড়ার কাজ চলছে, তাদের মুখ হবে মুখোশের মতন আর কাজ করবে যন্ত্রের মতন, তাদের একটা করে নম্বর থাকবে আর মানুষের বদলে তাদের বলা হবে নাগরিক, তারা গ্রামে থাকুক বা জঙ্গলে সবাই হবে নাগরিক, তারা টাকার জন্যে সবকিছু করবে ।
মিলিটারি ভুত চলে গেলে, তিথি বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশটা তার মানে মরণের গুরু-মহারাজ বাঞ্চোতের, ইচ্ছে করে লিঙ্গকে ন্যানোনুনু করিয়ে নিয়েছে, যাতে যে ওর সঙ্গে শোবে সে গলদঘর্ম হয়ে যাবে ব্যাটাকে জাগিয়ে তুলতে, ক্যাওড়াটার পলিটিকালি কারেক্ট লিঙ্গ, বোকাচোদার গায়ে পুলিশের জেরা করবার ঘরের টেবিলের মতন তেলচিটে দুগ্গন্ধ।
আরে ! চমকে উঠলেন নগেন দত্ত, বললেন, এই হম্বিতম্বি গুরু-মহারাজই অধ্যাপক চক্কোত্তির কোম্পানির জিএম, এরই পারমিশান নেবার জন্যে চক্কোত্তি গেছে ওনার আশ্রমে । এতক্ষণে বুঝতে পারলুম তারক ব্যানার্জির সঙ্গে কোন ব্যাপারে কথা হচ্ছিল । তিনটে মেয়েকে নিয়ে আসবে, তাদের একলাখ করে বিক্রি করেছিল অলরেডি, এবার তাদের ভার্জিনিটি রিপেয়ার করে আর শল্যচিকিৎসায় সুন্দরী করে প্রত্যেককে দুলাখ টাকা করে বিক্রি করবে ।
ওনার আশ্রম তো ছত্তিশগড় না ঝাড়খণ্ডে কোথাও আছে ঘন জঙ্গলের ভেতরে, বললে তিথি আহমেদ, খিস্তিখোরটা আমাকে পটিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, যাইনি, জঙ্গলের লাইফ আমায় স্যুট করবে না, মশারি টাঙিয়ে আমি কাস্টমার সার্ভিস ভালো দিতে পারি না , তারওপর লোকটা ন্যানোনুনুর কাহ্ণ । জীবনের বেশিরভাগ তো কাটালুম তিরিশ হাজারিনীর দেশে, এখানের অনিশ্চয়তার অনির্ণেয়তার নেশা ধরে গেছে গো । প্রতিদিন মানুষের সঙ্গে সাময়িক সম্পর্ক পাতাই, আমার সম্পর্ক প্রতিদিন বদলাতে থাকে, তা নয় এক ব্যাটা থলথলে গুরু-মহারাজের আশ্রমে গিয়ে পাকা সম্পর্ক তৈরি করে ভৈরবী হয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে নাচো আর রাতে তার ওজন সামলাও । ভাবলেও ঝাঁট জ্বলে যায় ।
গম্ভীর মুখে ছন্দরানি মন্তব্য করলে, হ্যাঁ, মানবসম্পর্ক কখনও স্হায়ী হওয়া উচিত নয় ; স্হায়ী হলে তারা বালকের সুবোধত্ব হারিয়ে ফ্যালে, খিল্লি কেস হয়ে যায় ।
বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখলো বিরাট আঁস্তাকুড়, শল্যচিকিৎসার পর বাড়তিমাংস ফেলে দেয়া হয়েছে জঞ্জালের স্তূপে, নাকের চিলতে, ঠোঁটের টুকরো, মাইয়ের শাঁস, পেটের বাড়তি চর্বি, পাছার বাড়তি মাংস আর চামড়া, নুনুর ডগা, যোনির কুচি, ফেলে দেয়া হাত-পা-মুণ্ডু আর নানা রকমের মাংসের ছাঁট যা চেনার উপায় নেই, আর একটা ড্রামে রক্ত, যতো রক্ত বেরিয়েছে তা ওই ড্রামে এনে ফেলে থাকবে ।
তিথি আহমেদ, যে সাধারণত কোনোকিছুই সিরিয়াসলি নেয় না, ওর মনে হল, কোনো দৃশ্য দেখলে তার একটা মানে গড়ে নেয়া যায় মনের ভেতরে, কিন্তু যা দেখছে তা যেন চিরকুট না লিখে মারা যাওয়া আত্মহত্যাকারীর মতন রহস্যময় ।
আঁস্তাকুড় জুড়ে মানুষের গাদাগাদি, পুরুষ, নারী, কিশোর, বাচ্চা সবাই কাড়াকাড়ি করছে মাংস নিয়ে তক্ষুনি খাবার জন্য, যা হাতে পাচ্ছে গপাগপ খেয়ে ফেলছে, গলায় আটকে গেলে ড্রামের কাছে গিয়ে আঁজলা ভরে রক্ত খেয়ে আবার ফিরে এসে মানুষের ছাঁট মাংস খাচ্ছে, জঞ্জাল খাচ্ছে, টিনের কৌটো, কাঁচের বয়াম, প্লাসটিকের বোতল, পচা কাপড়, আধুনিকতার ফেলে দেয়া সমস্তকিছু খেয়ে ফেলছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন আধুনিকতাকেই সাবাড় করে দিতে চাইছে, এদের ধাপার মাঠে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে কয়েক দিনে সব খেয়ে পরিষ্কার করে ফাঁকা মাঠ বানিয়ে দিতো। ওদের হাতগুলো আর হাঁ-মুখ বেশ বড়ো।
ছন্দরানি বললে, এই মানুষগুলো কারা, ওপরে তিরিশ হাজারিনির দেশের রাস্তায় তো কখনও দেখিনি এরকম রোগা, হাড়গিলে, না-খেতে পাওয়া মানুষদের কাড়াকাড়ি, আমরা বোধহয় আনডারগ্রাউণ্ডে অন্য কোনো সিসটেমে চলে এলুম ।
নগেন দত্তও এরকম মানুষজন দেখেননি আগে, শিড়িঙ্গে, হাড়ের ওপর চামড়া, গায়ে মাংস প্রায় নেই, বাচ্চাগুলোর পেট তবুও ফোলা, এরা বোধহয় অনেককাল স্নান করেনি, চুল রুক্ষ, পোশাক বলতে পুরুষরা কানি বেঁধে আছে, নারীদের ময়লা শাড়িতে যতোটুকু শুকনো বুক ঢাকা যায়, বাচ্চাদের পোশাক বলতে কিছুই নেই ।
গায়ে সাদা রঙ করা মিলিটারি ভুতটা, যাকে সিকিউরিটির লোকের চেয়ে বাউন্সার বলেই মনে হচ্ছিল, এসে লাঠিপেটা করে তাড়ালো লোকগুলোকে, বলল, যতোই তাড়াই, তিষ্ঠোতে দ্যায় না, দশ মিনিট পরেই আবার দল বেঁধে চলে আসে, এতো খাচ্ছে, দিনের পর দিন খাচ্ছে, তবু ওদের পেট ভরে না । আমি একজন ভুতগ্রস্ত দেবদূত, আমাকেও ভয় পায় না । অন্য ভুতদের লেলিয়েও দেখেছেন কর্তৃপক্ষ, কাউকেই ভয় পায় না ওরা ।
খেলেই বা, ক্ষতি কি ? গলার স্বরে ঔদ্ধত্য মিশিয়ে বলল তিথি আহমেদ।
মিলিটারি ভুত বলল, ওরা খায় কিন্তু হাগে না । এরা তিরিশ হাজারিনীর দেশের বৈধ নাগরিক নয়, তাই নিচের স্তরে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, পরার পোশাক নেই যাদের, তাদের বৈধ কাগজপত্রই বা কোথ্থেকে হবে, তিরিশ হাজারিনীর দেশের ব্যবস্হাকে পালটাবার কোনো উপায় নেই, এই লোকেরা পালটে দেবে ভেবেছেন, তাহলেই হয়েছে । কন্ঠস্বরে সহানুভূতি থাকলেও, ষণ্ডামার্কা ভুত চাকরির দাবি-দাওয়ার কাছে অনুগত, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বলল কথাগুলো, সম্ভবত আগন্তুকদের কৌতূহল মেটাবার জন্য বলে-বলে অভ্যস্ত ।
ওরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, এটা বোধহয় গণতন্ত্রের আনডারগ্রাউন্ড ব্যবস্হা ।
একটু এগিয়ে, নগেন দত্তর দুইপাশে ছন্দরানি আর তিথি ওনার পকেটে ওদের একটা হাত ঢুকিয়ে, কাঁধে মাথা রেখে, হাঁটতে লাগল । নগেন দত্ত জানেন চারিপাশের পরিবেশকে কেমন করে নিয়ন্ত্রণ আর মেরামত করে নিতে হয় । বাঁহাত ডানদিকের পকেটে ঢুকিয়ে তিথি আহমেদ নগেন দত্তর প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে করতে বললে, এটা আমার । ডানহাত বাঁদিকের পকেটে ঢুকিয়ে প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে করতে ছন্দরানি বললে, এটা আমার ।
তিথি আর ছন্দরানি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল তোমার আদি রসের দুটো যন্ত্র নাকি, শোবার সময়ে তো একটাই দেখেছি ।
নগেন দত্ত বললেন, তোরা পকেটে হাত ঢোকাতেই জেনে গিয়েছিলুম কী করতে চলেছিস, তাই দুজনের মধ্যে রেশারেশি যাতে না হয় তাই দুটো প্রত্যঙ্গ করে নিলুম । দাদামশায় ওনার উইলে লিখে গেছেন যে আমার ওপর যদি একইসঙ্গে একই সময়ে কয়েকজন দাবি জানায় তাহলে নিজেকে সমানভাবে তাদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে দেবো ।
তিথি আহমেদ নগেন দত্তর গালে তুলতুলে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুমু খেল, মমুয়াআআআআআঃ ।
নগেন দত্ত বললেন, দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী তোদের তো অনেক সম্পত্তি আর টাকাকড়ি দেয়া হয়েছে, তবু এই তিরিশ হাজারিনীর দেশে পড়ে আছিস কেন ?
ছন্দরানি নগেন দত্তের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, আরে, তোমরাই শুধু জীবনের সাধআহ্লাদ উপভোগ করবে, আমাদের বুঝি ইচ্ছে হয় না, অনেকের সঙ্গে শুই, নানা আঙ্গিকে শুই, নানা বয়সের সঙ্গে শুই, নানা ভাষার সঙ্গে শুই, নানা মাপের সঙ্গে শুই, নানা চামড়ার সঙ্গে শুই, নানা গন্ধের সঙ্গে শুই ? তোমার দাদামশায়ের উইল অনুযায়ী এখন কম বয়সে যতদিন আটকে আছি ততোদিন জীবনের মজাগুলো নিয়ে নিতে চাই ।
তিথি বললে, হ্যাঁ, শনৈশনৈ । কাদের সঙ্গ পাইনি বলো দিকিন ? ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের সময়ে একজন ছোকরা এসে আমার লেপের তলায় ঘুমোচ্ছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে ঘুম থেকে তুলে লাঠি পিটিয়ে নিয়ে চলে গেল ।
১৯১৫ সালে গদর ষড়যন্ত্রের সময়ে একজন আমার লেপের তলায় এসে লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
১৯২০ সালে অনুশীলন সমিতির একজন এসে আমার সঙ্গে লেপের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল ।
১৯২০ সালে কুইট ইনডিয়ার সময়ে একজন লালটুশ যুবক আমার লেপের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে ধরেবেঁধে নিয়ে চলে গেল।
১৯২৮ সালে কমিউনিস্টদের যখন মিরাট ষড়যন্ত্রর দোষ দিলে, তখন আমার চাদরের তলা থেকে একজন দাঁড়িঅলা ছোকরাকে ব্রিটিশের পুলিস ধরেবেঁধে নিয়ে গেল ।
১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় এক গুণ্ডা এসে আমার খাটের তলায় লুকিয়েছিল, ব্রিটিশের পুলিশ তাকে প্যাঁদাতে-প্যাঁদাতে নিয়ে গেল ; ওই বছরেই কিসান সভার একজন আমার লেপের তলায় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, ব্রিটিশ পুলিশ দরোজা ধাক্কিয়ে লোকটাকে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্টরা যখন ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ জিগির তুলে ট্রামবাস পোড়ালে তখন স্বদেশি পুলিশ আমার ঘর থেকে মাসকাবারি বাবুকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৫৪ সালে এক উদ্বাস্তু নেতা আমার ঘরে লেপের তলায় দুপুরে জিরোচ্ছিল, তখন স্বদেশী পুলিশ ধরেবেঁধে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৬২ সালে একজন চিনা যুবক আমার লেপের তলায় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন স্বদেশী পুলিশ তাকে চড় মারতে-মারতে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরী নামে এক চশমাপরা রোগাটে কবি আমার ওপর চেপে সবে আরম্ভ করেছে, স্বদেশী পুলিশ টেনে আমার ওপর থেকে নামিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে চলে গেল, পুলিশের সঙ্গে দুজন খোচর ছিল যারা ওই কবিটার চলাফেরার ওপর নজর রাখতো ।
১৯৭০ সালে বর্ধমানের সাঁইবাড়ির গোলমালের সময়ে একজন লোক এসে আমাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, তাকে প্যাঁদাতে-প্যাঁদাতে নিয়ে গেল পুলিশের মতন পোশাক পরা একদল লোক ।
১৯৭১ সালে একজন নকশাল যখন আমার খাটের তলায় এসে লুকিয়েছিল, স্বদেশী পুলিশ মার দিতে-দিতে হিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৭৬ সালে ইন্দিরার এমারজেন্সির সময়ে একজন লেখক আমার কম্বলের তলায় ঘুমোচ্ছিল, স্বদেশী পুলিশ তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল ।
১৯৭৯ সালে যখন মরিচঝাঁপি থেকে পালিয়ে এসে একজন বুড়ো শান্তিতে আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিল, পুলিশ তাকে টানতে-টানতে নিয়ে চলে গেল ।
১৯৮২ সালে গেরুয়া লুঙ্গি পরা গোঁফদাড়িঅলা একজন মাঝবয়সী আমার ঘরে শুয়েছিল, সাদা পোশাকের পুলিশ বললে যে সে আনন্দমার্গী, আইন ভেঙেছে, তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল ।
২০০০ সালে নানুরের এক মুসলমান বুড়ো আমার লেপের তলায় লুকিয়েছিল, তাকে সাদা পোশাকের লোকেরা হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল ।
২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের এক চাষি আমার লেপের তলায় আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিল, তাকে স্বদেশি পুলিশ মারতে-মারতে ধরে নিয়ে গেল ।
২০১১ সালে মুখে গামছা বেঁধে একজন ঘুমোচ্ছিল আমার কম্বলের তলায়, যাতে আমি লোকটার মুখ ছাড়া সবকিছু দেখতে পাই, তাকে তো মুখে গামছা ঢাকা অবস্হাতেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল স্বদেশী পুলিশ ।
তাহলে দেখতে পাচ্ছে, দেশটাকে কতো ভালো করে জানতে পেরেছি তিরিশ হাজারিনীর দেশের নাগরিক হয়ে ? জীবন বড্ডো ব্যানাল, বুঝলে গো, তা থেকে বেরোবার উপায় তো খুঁজে পেয়েছি ।
নগেন দত্ত তিথির গালে চুমো দিয়ে বললেন, সাবধানে থাকিস, এখন উত্তরাধুনিক যুগ চলছে তিরিশ হাজারিনীর দেশে, লোকে খুন হয়ে গেলে টিভি আর কাগজের গল্প হয়ে যায়, তারপর তার কথা সবাই ভুলে যায়, নতুন গল্প চলে আসে । এটা তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার দিনকাল ।
তিথির মুখেচোখে তখওন আত্মগর্বের ছোঁয়া । নিজের চেয়ে চারিপাশের জগতসংসারকে নিয়ে বেশি চিন্তিত যেন । একনাগাড়ে কথা বলার পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তিথি আহমেদ বলল, ব্যথায় আনন্দ আছে, যন্ত্রণাতেও আহ্লাদ আছে, আহ উহ করাতেও মজা আছে , পোঁদে চিমটি কাটে তাও অনেক সময়ে ভালো লাগে, আমরা তো লজ্জাবোধের সিংহাসনে বসে রাজত্ব করি ।
তিথির কথাকে এগিয়ে নিয়ে গেল ছন্দরানি, বলল, তিরিশ হাজারিনীর দেশে আমরা সবায়ের শিরদাঁড়া তরতাজা করে দিই, রিফ্রেশ করে পৃথিবীর সঙ্গে লড়তে পাঠাই, ওদের চিন্তার ভেতরে লড়বার গানের সুর ঢুকিয়ে দিই । যাদের শিরদাঁড়া থাকে না তাদের কুণ্ডলিণী দিয়ে শিরদাঁড়া ঢুকিয়ে পথে ছেড়ে দিই, বলি যে, যাও, পেঁদিয়ে এসো, লাথিয়ে এসো, বাঞ্চোত দুনিয়াটাকে ।
নগেন দত্ত ছন্দরানির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর বয়স না হয় আটকে আছে, তোর ছেলের বয়স তো আটকে নেই, সে তো তোর চেয়ে বয়সে বড়ো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ।
তিথি আহমেদের দিকে তাকিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তোর মেয়েরও বয়স তোর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে, মনে রাখিস ।
দুজনেই বলে উঠল, ওরা তোমার বাচ্চা তুমি বুঝবে, তুমি ওদের ইনজিনিয়ার-ডাক্তার বানাতে চেয়েছো, ওদের কাছে আমরা দুজনে তো কবেই মরে গেছি ।
নগেন দত্ত বললেন, কদিন বাদেই আমি লণ্ডনে যাচ্ছি, গিয়ে ওদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেব,নয়তো ওদের বয়স আমার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে মুশকিল হবে।
ও মা, সেকি ! ভাইয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে ? তোমার কি মাথা খারাপ ? বললে ছন্দরানি । যেন উদ্বেগের স্বপ্ন ভেঙে আচমকা জেগেছে ।
নগেন দত্ত বললেন, দাদামশায়ের উইলে সেরকমই লেখা আছে, আমি তো রাজনীতিক নই যে আইনি নির্দেশকে অমান্য করব । দাদামশায় লিখে গেছেন যে আমার দুই শয্যাসঙ্গিনীর সন্তানদের পরস্পরের বিয়ে না হলে তারা সম্পত্তির ভাগ পাবে না ।
দাদামশায় রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতেন, রোমের যেমন ভাইবোনের সম্পর্ক থেকে বিরাট সাম্রাজ্যের পত্তন হয়েছিল, উনিও চেয়েছেন যে আমার ছেলেমেয়ের মিলনে তেমনই এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক । দাদামশায় ওনার উইলে লিখেছেন যে তিরিশ হাজারিনীর দেশের অবস্হা ভালো নয়, সেখানের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে যেন আমার সন্তানদের দূরে রাখা হয়, যেন নতুন একটা দেশের পত্তন করা হয়, যেখানে বরফের রঙ কখনও কয়লার মতন হবে না, টিউকলের জল খেয়ে আর্সেনিক আর আন্ত্রিক হবে না, নুন খেয়ে নিমকহারামি হবে না, বিশ্বাসঘাতকতা থাকবে না, মানুষের হাগবার মাঠে জাতিপ্রথা প্রয়োগ করে হবে না, বিরোধীদের মাটিতে পুঁতে দিলেও তারা যেন সেখানে আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে, মাঠের পাকা ফসল কেটে নিলে যে কাটল তার যেন পেচ্ছাপ-পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়, মিছিলে হাঁটলে নেতারা যেন নাগরিকের পায়ে রুমা অয়েল মালিশ করে দ্যায়, আরও অনেক নির্দেশিকা আছে, দুশোর বেশি, অতো কি আর মনে থাকে ।
তিথি আর ছন্দরানি চুপ করে, নগেন দত্তের কথা, এতক্ষণ যাবত শোনার বদলে, নিজেদের হাতে-ধরা নরম মাংসকে শক্ত করে তোলার চেষ্টা করছিল ।
নগেন দত্ত বললেন, তোরা যা করার চেষ্টা করছিস তা হবে না, কেননা, দাদামশায়ের উইলে এ-কথাও লেখা আছে যে যুগপৎ দুজনে আমাকে উত্তেজিত করতে পারবে না, আমার উত্তেজনাবোধ সেসময়ে নিস্পৃহ দিবানিদ্রায় থাকবে ।
ওঃ, বলে দুজনেই আত্মনিয়ন্ত্রণ করে নিলে, কী আর করা যায়, বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই ।
নগেন দত্ত বললেন, তাছাড়া ওরা তো জানে না যে ওরা ভাইবোন । ছন্দরানি, তোর ছেলের নাম রেখেছি অর্ণব মজুমদার আর তিথি, তোর মেয়ের নাম রেখেছি লিপি আহমেদ । ওদের নাম তোদের বলেছিলুম অনেককাল আগে, জানি না ভুলে গেলি কেমন করে ।
প্রসঙ্গ পালটাতে হল নগেন দত্তকে, বললেন, এটা তো তিরিশ হাজারিনীর দেশ নয় রে, মাটির তলায় অন্য কোনো দেশে এসে পড়েছি আমরা । পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে জিপিএস নির্দেশের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করলেন, কোন দেশে বা রাষ্ট্রে এসে পড়েছেন । জিপিএস নির্দেশে বললে, “কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্হা জানিয়েছে আপনাদের সমীক্ষা একান্তভাবে গোপনীয়, আপনার সঙ্গিনীরা জীবিত অবস্হায় তাঁদের দেহশাড়ি কোনো বিদেশিকে বিক্রি করতে পারবেন না ।”
দূরে অধ্যাপক চক্কোত্তিকে যেতে দেখে, শার্ট-প্যান্টের বদলে খালি গা্য়ে লুঙ্গি পরেছিল, নগেন দত্ত চেঁচিয়ে ডাকলেন, চক্কোত্তি, ও চক্কোত্তি, কোথায় গিয়েছিলে, তোমার অপেক্ষায় বসে-বসে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছি তোমার খোঁজে ।
ওরা দেখল, নগেন দত্তের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে, কুড়ি-পঁচিশজন অধ্যাপক চক্রবর্তী, সকলে একই রকম চাককাটা লুঙ্গি পরে, আকাশ থাকে নেমে আসছে হাত দুটোকে ডানার মতন নাড়াতে, নাড়াতে ।
একজন চক্কোত্তি মাটিতে নেমে, লুঙ্গিকে হাঁটু পর্যন্ত তুলে, বলল, বলুন কী বলবেন, আমরা আজ ব্যস্ত আছি, নির্বাচন করাতে যাচ্ছি ।
তিথি আহমেদ বলল, আপনি একজন থেকে এতোগুলো হয়ে গেলেন কেমন করে মাসিপিসি ? কে আসল কে নকল কিছুই তো বুঝতে পারছি না ।
চাককাটা লুঙ্গি-পরা চক্কোত্তি বলল, আমরা সকলেই আসল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে তিরিশ হাজারিনীর শাখা-প্রশাখা আছে তা আমরাই চালাই, তবে আজকে নির্বাচন বলে আমরা একত্রিত হয়েছি, আমাদের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন, থাকে বটে নাম-কা-ওয়াস্তে প্রতিদ্বন্দ্বী, আমরাই তাদের দাঁড় করাই, নয়তো লোকে কী ভাববে । আমাদের বাবা জি এম আর মা জি এম অজস্র চক্কোত্তি গড়ে তুলেছেন নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্যে, সেই কাজেই যাচ্ছি, পরে দেখা হবে ওভারগ্রাউণ্ডে । বলে উড়ে চলে যাবার চেষ্টা করছিল নেমে-আসা চক্কোত্তি, হাত দুটোকে ডানার মতন নাড়িয়ে, কোমর থেকে ঝুলছে চাককাটা লুঙ্গি ।
তিথি আহমেদ বললে, এখানে কোনো শৌচালয় দেখছি না, হাগা পেয়ে গেছে, মুততেও হবে, একটু ডিরেকশানটা বলে দিন না ।
উড়তে-উড়তে প্রফেসর চক্কোত্তি বললে, এখানে হাগবার মোতবার পাদবার আজাদি নেই ।
নগেন দত্ত বললেন, আমি আর ছন্দ তোকে আড়াল করছি, তুই পুরো-কোটা হেগে-মুতে-পেদে নে ।
তিথি আহমেদ শিমুল-পলাশে ঘেরা গাছতলায় বসে হেগে-মুতে-পেদে নিলে ।
নগেন দত্ত বললেন, পাদবার আজাদি নেই, এ আবার কেমন বখাটে-ক্ষয়াটে জগত ! মনে আছে, ১২৩৬ সালে যখন দিল্লি গিয়েছিলুম, রাজিয়া সুলতান বলেছিল ওসব তুর্কিদের মাথায় আমি হাগি আর ওদের মুখে পাদি। মনে আছে, ১৩০৩ সালে যখন চিত্তোরে ছিলুম, আলাউদ্দিন খিলজি সেখানের রাজাকে মেরে রাজার সুন্দরী বউ পদ্মিনীকে পাবার চেষ্টা করেছিল ; রানি আত্মহত্যা করার আগে সোনার থালায় হেগে আর মুতে পাঠিয়েছিল খিলজিকে, আমার স্বচক্ষে দেখা, আর এটা কিরকম আন্ডারগ্রাউণ্ড এলাকা যে হাগবার-মোতবার-পাদবার স্বাধীনতা নেই ।
কে বললে নেই, না থাকলে জোর করে আজাদি নিতে হয়, বলে বেশ জোরে পাদল ছন্দরানি মজুমদার, তারপর বললে, তা নির্বাচন অথচ তো মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে না তো !
গাছ থেকে ঝরা শিমুলের পাপড়ি দিয়ে পোঁদ পুছতে-পুঁছতে তিথি আহমেদ বলল, খুনোখুনির পালা শেষ হয়ে গেছে বোধহয়, আঁস্তাকুড়ে যারা জঞ্জাল খাচ্ছিল, তারা মরা মানুষের হাত-পা-মুণ্ডুও তো খাচ্ছিল চুষে-চুষে, হয়তো নির্বাচনের ছাঁটমাংসও তাতে ছিল, এখানে সকলেই লেড়িয়েছে বলে মনে হয় ।
নাঃ, এটা বোধহয় কোনো জনগণতান্ত্রিক দেশ, তিরিশ হাজারিনীর দেশ নয়, তিরিশ হাজারিনীতে নির্বাচন হলে সবাইকে নিজের পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়ে বোতাম টিপতে হয়, একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজনের কোনো মিল থাকে না । এদেশে দেখছি সকলেই চক্কোত্তির মতন দেখতে, কারোর সঙ্গে কারোর তফাত নেই, বললে ছন্দরানি মুজমদার । তিরিশ হাজারিনীতে তো নির্বাচনের রেট আর আমাদের রেটে বিশেষ তফাত নেই, এখানে সবাই দেখতে সমান, রেট ফিক্স হয় কেমন করে !
নগেন দত্ত বললেন, অনেক এলাকায় সত্য নিজেই সত্যের শত্রু ।
তিথি আহমেদ বললে, ঠিকই বলেছিস ছন্দ, ওপরে ছিল সন্ধ্যাবেলা । এতো তাড়াতাড়ি দুপুর হয়ে গেল কেমন করে ! যাকগে যাক, চলো কিছু খেয়ে নেওয়া যাক, সেই সকাল থেকে দুজন সমকামীকে পড়াতে-পড়াতে কিছুই খাওয়া হয়নি ; হেগে পেট একেবারে খালি ।
একটা চীনা রেস্তরাঁ দেখে ঢুকলো তিনজনে, বসল ফাঁকা টেবিলে । দেয়ালে ঝুলছে গ্যাঙ অফ ফোরের চিয়াং চিংএর সাদা-কালো ছবি, চশমা-পরা, ওপর দিকে তাকিয়ে ।
ওরা দেখল ওয়েটাররা সকলেই চক্কোত্তির মতন হুবহু লুঙ্গি পরে, যারা খাচ্ছে, তারাও হবহু চক্কোত্তি । চীনা রেস্তরাঁ নাম দিয়েছে কেন তাহলে !
মেনুতে নতুন ধরণের পিৎজা দেখে অর্ডার দিল, লেখা রয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব বিফল হবার কারণে এবং দেং জিয়াও পিং-এর বিড়ালতত্বের প্রভাবে কাঁচা মাল সব চিন থেকে আসে বলে বেশ সস্তা । পিৎজায় টপিং দেয়া আছে ফ্রাইড জোঁক, পিকলড কেঁচো, উচ্চিংড়ের চিজলিং, হাফ-বয়েলড কোলা ব্যাঙের জিভ, কাঁচা সবুজ ফড়িং আর ঘন চিজের আস্তরণ, সঙ্গে সৌদি আরব থেকে আনা উটের দুধের চা ফ্রি ।
তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার যখন পিৎজা খাচ্ছিল, চিজের সুতোর আঠালো টান পিৎজা থেকে ওদের মুখ পর্যন্ত বেশ অশ্লীল আনন্দ দিচ্ছিল নগেন দত্তকে, এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, খেতে-খেতেও তোরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিস ।
নগেন দত্ত পিৎজা খেতে-খেতে, মেনুকার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, এদের এখানে দেখছি মানুষের ঘাম থেকে চোলাই করা মদ পাওয়া যায় । তিন জনের জন্যে তিন পেগ অর্ডার দিয়ে বললেন, তোদের স্ট্যালিনের গল্প বলার সময়ে একরকম মদের কথা বলতে তো ভুলেই গেছি, স্ট্যালিন খাইয়েছিলেন । আমি মুলো আর ভোদকা খেয়ে গেছি, গন্ধ পেয়ে উনি বললেন, আরে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মদ তৈরি হয় চোখের জল চোলাই করে, সাইবেরিয়া থাকে ড্রামে ভরে-ভরে আসে, খাইয়েছিলেন নতুন বোতল খুলে, তিন পেগ খেয়েছিলুম, চোখের জল তো নোনতা হয়, কিন্তু উনি নতুন প্রযুক্তির গুণে তাকে রেড ওয়াইনের চেয়ে মিষ্টি করে তুলেছিলেন ।
তিথি আহমেদ বললে, আহা গো, টেকনোলজিটা যদি জেনে আসতে তাহলে আমাদের কাজে দিতো, কতো ফ্যাঁচফ্যাঁচে সর্দি কান্না যে কাঁদে পুরুষরা আমার কাঁধে মাথা রেখে, যদি চোখের কাছে কাচের বয়াম ধরি তাহলে রোজ সকালে একজন কাস্টামারের কাছ থেকে একলিটার করে বিশুদ্ধ কান্নার জল পেয়ে যাবে, সারা রাতে দশজন কাস্টামার হলে দশ লিটার ।
ছন্দরানি মজুমদার ঘামের মদে চুমুক দিতে-দিতে বললে, এর স্বাদ তেমন ভালো নয়, কেমন যেন নরমাংসে মেশানো পেট্রলের গন্ধ বেরোচ্ছে, মনে হয় গদ্দাফির লিবিয়া কিংবা সাদ্দামের ইরাক থেকে আমেরিকানরা চুরি করে এনে বাজারে ছেড়েছে, এখন তো খোলাবাজারের আলোবেলা ।
ওয়েটারকে ডেকে তিথি আহমেদ জিগ্যেস করল, জোঁকগুলো তো শুকনো, রক্তে টুসটুসে নয় কেন ?
ওয়েটার একটা কাঁচের প্লেটে ঝাড়ন ঘষতে-ঘষতে বলল, ম্যাডাম, জোঁকগুলো তো চিন থেকে ইমপোর্ট করা, কাস্টমসের লোকেদের ঘুষ না দিলে ছাড়ে না, ততো দিনে ওদের গা থেকে রক্ত শুকিয়ে যায় ।
ছন্দরানি ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ইনডিয়ান জোঁক দিলেই তো পারেন, টপিং তাহলে ফ্রেশ থাকবে।
ওয়েটার প্লেট পোঁছা বজায় রেখে বললে, ইনডিয়ান জোঁকে চীনা জোঁকের মতন স্বাদ হয় না ; চীনা জোঁকের বিশেষ চাষ হয়, পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে সেখানকার নাগরিকদের হাত-পা বেঁধে তাদের গায়ে জোঁক ছাড়া হয়, টুপ-টুপ করে জোঁকগুলো পড়ে গেলে রেড আর্মির লোকেরা কালেক্ট করে এক্সপোর্ট করার পারমিশান দ্যায় ।
আপশোষ বেরোলো তিথি আহমেদের মুখ থেকে, খোলাবাজার হয়েও এই অবস্হা !
ছন্দরানি একটা জোঁক চুষতে-চুষতে বলল, খোলাবাজারের বাঁশ আমেরিকানদের পোঁদেই ঢুকছে এখন, চাকরি নেই, কারখানা বন্ধ, সস্তার জিনিস চিন থেকে যাচ্ছে, সস্তার শিক্ষিতরা ইনডিয়া থেকে যাচ্ছে, আইটির সস্তার জিনিসও যাচ্ছে ।
খেয়ে, টিপস দিয়ে, বেরোতে যাবে, চীনা রেস্তঁরায় একজন চক্কোত্তি আরেকজনকে পেটে ছোরা মেরে দিলে, তাকে বেয়ারাগুলো, তাদের দেখতেও চক্কোত্তি, জড়িয়ে ধরতে, ছাড়িয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি ছোরা চালানো আরম্ভ করলে, দুজনের পেটে লাগতে তারা মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগলো, একজন চক্কোত্তি বেয়ারা ওদের বলল, পালান পালান, এ বিরোধীতার কাজ করে বলে পাগল হয়ে গেছে, নিজের ইশকুল, নার্সিং হোম, ভুটভুটির ব্যাবসা, চালের কল, আলুর কোল্ড স্টোরেজ, গাঁয়ে তিনতলা পাকাবাড়ি, অনেক-কিছু করে ফেলেছে, পালান পালান ।
তিথি জানতে চাইল, কিসের বিরোধীতা করেছিল ?
বেয়ারা বলল, বিরোধিতার আবার কারণ হয় নাকি ! কারণ থাকলে তো বিরোধিতাই হতো না ।
নন্দরানি নিজের মনে বললে, এখানেও ওই একই ব্যাপার, খুন হয়ে গল্প হয়ে যাও, তারপর নতুন খুন এসে পুরোনো খুনের গল্পকে সরিয়ে দেবে । চলো, এখানে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
ওরা বেরিয়ে হন হন হাঁটা দিলো ।
বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মিছিল যাচ্ছিল বলে রাস্তা পেরোতে দেরি হল, বাচ্চাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা “ভয় পাবার মতো কিছু লিখবেন না”, ‘ভয় পাবার মতো কিছু বলবেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু ভাববেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু শুনবেন না”, “ভয় পাবার মতো কিছু দেখবেন না”, সেই সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে, “তুঘলকের জয় হবেই, জয় তুঘলকের জয়, তুঘলক জিতবেন, তিনি জিতবেন, তিনি জিতবেন, তিনি তুঘলক, তিনি তুঘলক, তিনি তুঘলক, তিনি জিতবেন, তুঘলকবিরোধীরা নিপাত যাক, নিপাত যাক, জয় দৌলতাবাদের জয়, মানুষ যদি নাও পৌঁছোয় তার ঠ্যাং দৌলতাবাদে পৌঁছোবে, জয় তুঘলকের জয় ।”
তিথি আহমেদ নাক চাপা দিয়ে বলল, এ কি রে বাবা, বাচ্চাদের গা থেকে রামছাগলের বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে, এই গন্ধই তো গুরু-মহারাজের গা থেকে বেরোয় ।
ছন্দরানি বিজ্ঞের মুখ করে বলল, ওই গুরু-মহারাজটাই তার মানে তুঘলক, কতো বেজন্মা বাচ্চা পয়দা করেছে, তাদের গায়ের দুর্গন্ধ দিয়ে তাদের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে ।
সম্ভব, খুবই সম্ভব তিথি, তুঘলকের গা থেকে অমন গন্ধ বেরোতো বলে লিখে গেছে ইবন বতুতা, বললেন নগেন দত্ত । তুঘলক নানা তত্ব বের করেছিলেন, একজনের চেয়ে বেশি মানুষকে যদি নির্বিচারে কোতল করতে হয় তাহলে তার জন্যে তত্ব দরকার, আর উনি তো মানুষ খুন করার রেকর্ড করে গেছেন, শত্রু হোক বা বন্ধু হোক, কাউকে বাদ দেননি ।
নতুন মোহম্মদ বিন তুঘলক এলো নাকি ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে নেমে, স্বগতোক্তি করলেন নগেন দত্ত, যে হারে পুতুলনাচের পুতুলরা সংখ্যায় বাড়ছে ।
রাজপথে একটা সিনেমা হল দেখতে পেয়ে তিথি আহমেদ চেঁচিয়ে উঠল, ওই তো, ওই যে একটা সিনেমা হল. চলো-চলো, প্রমথেশ বড়ুয়া কিংবা ফিয়ারলেস নাদিয়ার ফিল্ম হলে জমে যাবে ।
ছন্দরানি মজুমদার, বলে উঠল, তোর ওই একঘেয়ে পছন্দ, আমি দেখতে চাই দেব-শুভশ্রী জুটির ফিল্ম । দেবের পরাণ জ্বলিয়া যায় রে, চ্যালেঞ্জ, খোকাবাবু, খোকা চারশোবিশ, চাঁদের পাহাড়, দুই পৃথিবী, রোমিও, সবকটা দেখেছি । তুইও তো দেখতে গিয়েছিলি ।
তিথি আহমেদ : দেবটা তৃণমূল বলে ভাল্লাগে না ।
ছন্দরানি মজুমদার : ভালো না লাগবার কী আছে ? ওর বাড়ির সবাই সিপিএমকে ভোট দ্যায় । নগেন দত্ত : চুপ কর দিকিনি তোরা । কুন্দনন্দিনীকে খুঁজতে বেরিয়েছি আর তোরা এখন প্রমথেশ বড়ুয়া-ফিয়ারলেস নাদিয়া-দেব নিয়ে পড়লি । আমার মনের ভেতরের গোলাপি অন্ধকারে যদি তোদের দুজনকে বসিয়ে দিতে পারতুম তাহলে বুঝতে পারতিস আমার মনের চিনচিনে হাহাকারগুলো ।
সিনেমা হলের সামনে পৌঁছে ওরা দেখলো, দেয়ালে বিশাল পোস্টার লাগানো, একজন সুন্দরীর মুখ আঁকা, পোস্টারে লেখা সুপ্রসিদ্ধ পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘কুন্দনন্দিনী”, মহাসমারোহে পঞ্চাশতম বৎসর চলিতেছে, কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনাম তালপাতা প্রাপ্ত, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের ভাল্লুক প্রাপ্ত, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের সিংহ প্রাপ্ত, স্পেনের চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনামের শামুক প্রাপ্ত এবং লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্ল্যাটিনাম চিতাবাঘ প্রাপ্ত ।
তিথি আহমেদ বললে, এই পরিচালক তো বেশ নামকরা গো, তিরিশ হাজারিনীর দেশের বইমেলায় আগুন ধরিয়েছিল, সেই লোকটা না ?
ছন্দরানি মজুমদার বললে, উনি একলা আগুন ধরাননি, ওনার সঙ্গে গৌতম ঘোষ নামে আরেকজন ছিলেন, যাঁকে মুজফফরপুরের লোকেরা নিবারণ বলে ডাকতো ছোটোবেলায় ।
নগেন দত্ত বললেন, কী আবোল-তাবোল বকছিস তোরা, ওটা ছিল সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মগজভাঁড়ের গুলগল্প, হাংরি আন্দোলনকে বদনাম করার জন্যে । কল্পনা ব্যাপারটা হল ক্ষয়রোগ, ক্ষইয়ে দিতে থাকে, ভেতরে-ভেতরে, মানুষকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে, দেশকে ।
তিথি আহমেদ বললে, হ্যাঁ, ওই আন্দোলনের অনেকে প্রফেসর বেবি নস্কর , প্রফেসর দীপ্তি কুণ্ডু আর প্রফেসর মীরা দাশের ঘরে প্রায়ই দূর-দূর থেকে আসত, অশোকনগর, চন্দননগর, উত্তরপাড়া, বরানগর, বেলঘরিয়া, বেনারস, হাওড়া, বিষ্ণুপুর, ত্রিপুরা, বি টি রোড, আরও নানা শহর থেকে, প্রফেসর বেবিকে ওদের খুব পছন্দ ছিল, বেবির দেহশাড়ি এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন তোমার বন্ধু পল গগাঁ, ওনার দি সিয়েস্তা পেইনটিঙের হুবহু, তাই ওরা বেশ পছন্দ করতো প্রফেসর বেবিকে, গায়ে মাখবার সেন্ট পাউডার ময়েশ্চারাইজার সুগন্ধী কনডোম এনে দিত, ফুলের তোড়া এনে দিত, গান শোনাতো, সবাই মিলে টাকা তুলে টাকাও দিতো, বেবি তো সাজগোজ করে না, তাই ওদের পছন্দের ছিল । বেবি অন্য গ্যালারিতে চলে যাবার পর ওদের একজনের কি দুঃখ কি দুঃখ, মোটা কাঁচের চশমাপরা স্কুল-টিচার বেবিকে মার্কসবাদ বোঝাতো, স্ট্যালিন, মাওসে তুং, কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বোমবার্ড দি হেডকোয়ার্টার বোঝাতো, নিজের বই উপহার দিত, যৌনকর্মীরা কেন যৌনকর্মী তা বোঝাতো, হাসতো এমন যেন গার্গল করছে, বেবিকে লেখা প্রেমপত্রও আছে বেবির আয়নার ড্রয়ারে ।
টিচারটাকে প্রফেসর বেবি বলত, পৃথিবীকে বদলানো যায় না গো, কিছুই বদলানো যায় না, তুমি এইসব আলফাল চিন্তা করে, মদে চুর হয়ে, জীবন নষ্ট করছ কেন ? বেবি বাংলার প্রফেসর শুনে ওদের সে কি আনন্দ ।
আমি বলতুম, জীবনের আনন্দ নাও, বেঁচে থাকার আনন্দ নাও, জীবনের উদ্দেশ্য থাকলে বেঁচে থাকার মজা নষ্ট হয়ে যায়, বলল ছন্দরানি মজুমদার ।
তিথি বলল, বেশিরভাগ মরদরা জানে না যে অন্ধকারই সেক্সকে আলো যোগায়, অথচ তারা তুলতুলে ফাটলে আলো খুঁজে বেড়ায় ।
ওরা তিনজন দেখল সিনেমা হলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মিলিটারি ভুতটা, সারা গায়ে সাদা রঙ আর লিঙ্গ কয়লার মতন কুচকুচে, শিশ্নে আলো জ্বলছে, নগেন দত্তকে দেখে চিনতে পারল, হেসে বলল, স্যার “হাউস ফুল”, এই শো তো শেষ হয়ে এলো, পরের শোও সম্পূর্ণ বুকড ।
নগেন দত্তর তর সইছিল না, পকেট থেকে তিনটে হাজার টাকার নোট বের করে মিলিটারি ভুতের হাতে দিয়ে বললেন, ঢুকতে দাও, নইলে ঢুকেই যাবো আর তুমি টের পাবে না, দেখতেই হবে, ওই তো পোস্টারে যার মুখ আঁকা সে-ই তো কুন্দনন্দিনী, তাকেই খুঁজছি আজ পঞ্চাশ একশো দুশো বছর যাবত ।
মিলিটারি ভুত গেটের তালা খুলে দিয়ে বলল, যান, তাড়াতাড়ি যান, শেষ হয়ে এলো, লাস্ট সিনে পাবলিক এতো জোরে-জোরে কাঁদে যে সংলাপ শুনতে পাবেন না । লাইটম্যানকেও ওর পাওনা মিটিয়ে দেবেন, তাহলে এইলের সিঁড়িতে বসে দেখতে পারবেন, অলরেডি এইলের সিঁড়িতেও পাবলিক বসে আছে ।
মিলিটারি ভুতকে আরেকটা একহাজার টাকার নোট দিয়ে নগেন দত্ত বললেন, তাড়াতাড়ি করো, তুমিই নিয়ে চলো, ফিল্ম শেষ হয়ে গেলে কুন্দনন্দিনীকে পাবো কী করে । মিলিটারি ভুত, যার কালো কুচকুচে লিঙ্গের টর্চ জ্বলছিল, তার পেছন -পেছন, টর্চের আলোয়, দৌড়োলো তিনজনে, আরেক হুবহু মিলিটারি ভুত টর্চ জ্বেলে, টাকা নিয়ে, ওদের বসতে দিলে, পর্দার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নগেন দত্ত, কুন্দনন্দিনী আমি এসে গেছি ।
দ্বিতীয় মিলিটারি ভুত টর্চ নিভিয়ে, বকুনি দিয়ে বলল, এই চুপ করুন, কুন্দনন্দিনীর সংলাপ শুরু হচ্ছে, তারপর ডাকবেন ।
নগেন দত্ত দেখলেন কুন্দনন্দিনী ওনারই বসতবাড়ির পালঙ্কের রেলিঙে মাথা রেখে মাটিতে বসে কাঁদছিল। অবাক হলেন,পর্দায় তো উনি নিজে, কই ফিল্মে তো কখনও অভিনয় করেননি । ফিল্মের নগেন দত্ত আর কুন্দনন্দিনীর সংলাপ শুনতে লাগলেন, হতবাক, থ, কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলেন না ।
ফিল্মের নগেন দত্ত : এ কি কুন্দ ! তুমি কি দোষে ত্যাগ করিয়া যাইতেছ ?
কুন্দনন্দিনী : তুমি কি দোষে আমাকে ত্যাগ করিয়াছ ? কাল যদি তুমি আসিয়া এমনি করিয়া একবার কুন্দ বলিয়া ডাকিতে — কাল যদি একবার আমার নিকটে এমনি করিয়া বসিতে — তবে আমি মরিতাম না । আমি অল্পদিন মাত্র তোমাকে পাইয়াছি — তোমাকে দেখিয়া আমার আজিও তৃপ্তি হয় নাই ।
এইলে-বসা নগেন দত্ত : আরে, আমি আবার কখন ছেড়ে গেলুম ! কতোকাল ধরে তোকে খুঁজে চলেছি, একশো বছর, দুশো বছর হয়ে গেল, আর তুই এখন মরার কথা বলছিস !
কুন্দনন্দিনী : আমি অল্পদিন মাত্র তোমাকে পাইয়াছি — তোমাকে দেখিয়া আমার আজিও তৃপ্তি হয় নাই । আমি মরিতাম না । ছি ! তুমি অমন করিয়া নীরব হইয়া থাকিও না । আমি তোমার হাসিমুখ দেখিতে দেখিতে যদি না মরিলাম — তবে আমার মরণেও সুখ নাই ।
ফিল্মের নগেন দত্ত : কেন তুমি এমন কাজ করিলে ? তুমি একবার কেন আমায় ডাকিলে না ?
এইলে-বসা নগেন দত্ত : আমি আবার কী করলুম, আমি তো কবে থেকে তোকে ডেকে চলেছি, তোর খোঁজই পাইনি এতোকাল ।
তিথি আহমেদ : তোমার কুন্দনন্দিনী বিষ খেয়েছে মনে হচ্ছে, দেখছ না ঠোঁট কেমন করছে, মরবার কথা বলছে, কিছু একটা করো নগেন, শিগগির কুন্দনন্দিনীকে হাসপাতালে নিয়ে চলো ।
ছন্দরানি মজুমদার : ওই ফিল্মের নগেনটা এক নম্বরের কাপুরুষ, কোথায় অ্যামবুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তা নয়, সংলাপবাজি করছে, আর তুমিও নগেন, এখানে এইলে হাত গুটিয়ে বসে আছ, যাও যাও, পাঁজাকোলা করে তুলে আনো, আমি ততক্ষণ একটা অ্যামবুলেন্স ডেকে আনছি ।
তিথি আহমেদ : তাড়াতাড়ি যা ছন্দ, ট্যাক্সি পেলে ট্যাক্সিই ধরে নিস, বলিস ডবল ভাড়া দেবো, যা ছুট্টে যা।
কুন্দনন্দিনী : তাহা ভাবিও না । যাহা বলিলাম তাহা কেবল মনের আবেগে বলিয়াছি । তোমার আসিবার আগেই আমি মনে স্হির করিয়াছিলাম, দিদি যদি কখনও ফিরিয়া আসেন তবে তাঁহার কাছে তোমাকে রাখিয়া আমি মরিব — আর তাঁহার সুখের পথে কাঁটা হইয়া থাকিব না ।
তিথি আহমেদ : এই দিদিটা আবার কে ?
এইলে-বসা নগেন দত্ত : মন্তর পড়ে বিয়ে-করা আমার প্রথম বউ, সূর্যমুখী ।
তিথি আহমেদ : নিজেই কেলো করে রেখেছো । কুন্দনন্দিনীকে এতই যদি ভালোবাসতে তাহলে ওকে জোর করে ধরে রাখতে হতো । এখন ভোগো, নিজের খোঁড়া কুয়োয় নিজেই পড়েছ ; কে বলেছিল কুয়ো খুঁড়তে ? তোমার কি জলের অভাব ছিল !
এইলে-বসা নগেন দত্ত : আমি তো বুঝতেই পারছি না ফিল্মের নগেন দত্তটা কিছু ব্যবস্হা নিচ্ছে না কেন!
কুন্দনন্দিনী : আমি মরিব বলিয়াই স্হির করিয়াছিলাম — তবে তোমাকে দেখিলে আমার মরিতে ইচ্ছা করে না । আমার কথা কহিবার তৃষ্ণা নিবারণ হইল না — আমি তোমাকে দেবতা বলিয়া জানিতাম — সাহস করিয়া কখনও মুখ ফুটিয়া কথা কহি নাই । আমার সাধ মিটিল না — আমার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছে — আমার মুখ শুকাইতেছে — জিভ টানিতেছে — আমার আর বিলম্ব নাই ।
ছন্দরানি মজুমদার : এখনও বোকার মতন বসে আছো তোমরা, যাও যাও, কুন্দনন্দিনীকে কোলে তুলে নিয়ে এসে, ফিল্মের নগেন দত্তকে বাদ দাও, ওর দ্বারা কিসসু হবে না, তাড়াতাড়ি করো, অ্যামবুলেন্স এসে গেছে, আমার এক ক্লায়েন্ট ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, উনি পেট থেকে বিষ বের করে তিরিশ হাজারিনীর দেশের অনেক মেয়েকে বাঁচিয়েছেন ।
ফিল্মের নগেন দত্তের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল কুন্দনন্দিনী । ওরা তিনজনে এইল দিয়ে দৌড়োতে-দৌড়োতে ফিল্মের ভেতরে ঢুকে ফিল্মের নগেন দত্তর কোল থেকে কুন্দনন্দিনীকে পাঁজা-কোলা করে তুলে সিনেমা হলের বাইরে দৌড়োলো ।
কুন্দনন্দিনী গলা জড়িয়ে ধরল নগেন দত্তর ।
নগেন দত্ত বললেন, কুন্দ, তোকে আমি বাঁচাবোই, কতোকাল ধরে তোকে খুঁজছি, তোকে ভালোবাসতে চাইছি ।
কুন্দনন্দিনী বলল, আমার ঠোঁটে এখন বিষ, তুমি বাঁচিয়ে তোলার পর চুমু খাবো গো, কতোকাল অপেক্ষায় আছি ।
সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা থেকে গাড়িদের একপাশে সরিয়ে, অ্যামবুলেন্স পৌঁছোলো এস এস কে এম হাসপাতালে ।
ড্রাইভারের পাশ থেকে দ্রুত নেমে অ্যামবুলেন্সের পেছনের দরোজা খুলে নগেন দত্ত দেখলেন তিথি আহমেদ আর ছন্দরানি মজুমদার বসে আছে ।
নগেন দত্ত জানতে চাইলেন, কুন্দনন্দিনী কোথায়, ওকে তো স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখে তারপর সামনে গিয়ে বসলুম ।
তিথি আহমেদ : ও মা, কুন্দনন্দিনী তো বললে, ও বিষ খায়নি, বিষ খাবার বিভ্রম তৈরি করছিল, সিগন্যালে অ্যামবুলেন্স থামতে, ও বললে তোমার পাশে গিয়ে বসতে যাচ্ছে ।
ছন্দরানি মজুমদার : আমিও তো এতক্ষণ ভাবছিলুম তোমার পাশেই বসে আছে ।
নগেন দত্ত : কই, আসেনি তো ! আবার কয়েকশো বছরের জন্যে হারিয়ে গেল ও, আবার আমাকে খুঁজে বেড়াতে হবে, জীবনে ভালোবাসবার সুযোগ বোধহয় কখনও আসবে না, শুধু ভালোবাসার খোঁজই করতে থাকবো ।
তিথি আহমেদ নগেন দত্তকে জড়িয়ে ধরে বলল, এখন তুমি কিরকম অনুভব করছ বলো, কী ভাবছা তা বলতে হবে না ।
নগেন দত্তর অস্ফূট কাতরোক্তি শোনা গেলো, ভালোবাসাকে অতিক্রম করে এবার থেকে নিজেকে খুঁজবো, নিজেকে তো আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি ।