Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তেইশ

ঘণ্টা-দুই পরে সতীশ পাথুরিয়াঘাটার উদ্দেশে নিষ্ক্রান্ত হইয়া মনে মনে কহিল, উঃ কি শয়তান! যাক, আমিও বাঁচিয়া গেলাম। আমার কাঁধের উপর হইতে ভূত নামিয়া গেল। পথে চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল, কিন্তু উপীনদাকে আজ মুখ দেখাইব কেমন করিয়া? কারণ, আগুনে হাত দিলে কি হয়, ইহা যেমন সে নিশ্চিত জানিত, তাহার আবাল্য-সুহৃৎ উপীনদাকে সে ঠিক তেমনি চিনিত। তাঁহার কাছে এ-সকল অপরাধের ক্ষমা নাই, আজন্ম স্নেহের মূল্যেও বিন্দুপরিমাণ প্রশ্রয় কিনিবার ভরসা নাই, এ কথা তাহার চেয়ে বেশী আর কে বিদিত ছিল?

কিরণময়ীদের বাটীর সদর দরজা খোলা ছিল। সেইখানে আসিয়া সতীশ চুপ করিয়া দাঁড়াইল, এবং ভিতরে প্রবেশ করিবার পূর্বে সমস্ত কথা আর একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিতে লাগিল।

মনে হইল, শুধু কি উপীনদা তাহার পরম মিত্র, গুরু এবং আদর্শ? তাঁর চেয়ে যথার্থ আপনার কে আছে? সেই উপীনদার পাশে গিয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার তাহার আর এতটুকু পথ নাই। সে কল্পনায় স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, আজ দেখা হইবামাত্রই তাঁহার সেই অত্যন্ত কঠোর শুদ্ধ-চক্ষের জ্বলন্ত চাহনি তাহাদের আজন্ম বন্ধুত্ব, স্নেহ, প্রেম সমস্তই নিঃশেষে দগ্ধ করিয়া দিবে—কিছুই ক্ষমা করিবে না।

আবার ইহাই কি সব? এ বাটীর কবাটও নিশ্চয়ই তাহার মুখের উপর আজ হইতে চিরদিনের মত রুদ্ধ হইয়া যাইবে। আর এখানে প্রবেশ করিবে সে কোন্‌ মুখ লইয়া?

কিন্তু, এত ক্ষতি, এত লাঞ্ছনা যাহার জন্য, এতবড় সর্বনাশ যে সাধিয়া গেল, সে তাহার কে ছিল? যে নিজে ধরা দেয় নাই, অথচ বাঁধিয়া গেল; দুঃখ ভোগ করে নাই, অথচ দুঃখের সাগরে ডুবাইয়া গেল। যাহাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না, অথচ মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া অসাধ্য! নিশ্বাস ফেলিয়া সতীশ মনে মনে কহিল, সাবিত্রী, দুঃখ দিয়াছ, সেজন্য আর দুঃখ নাই—কিন্তু সত্য-মিথ্যায় জড়াইয়া এ কি বিষম বিড়ম্বনায় আমাকে বাঁধিয়া রাখিয়া গেলে!

দাসী হঠাৎ মুখ বাড়াইয়া কহিল, বৌমা ডাকচেন আপনাকে।

সতীশ চমকিয়া চাহিল। প্রশ্ন করিল, উপেন্দ্রবাবু এসেছেন?

হাঁ, কাল অনেক রাত্তিরে।

তাঁর ছোটভাই? বৌঠাকরুন?

দাসী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, কৈ না। তিনি একলা এসেছেন। এসে পর্যন্ত আমাদের বাবুর কাছে বসে আছেন।

বাবু কেমন আছেন?

দাসী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আর বাবু! শেষ হলেই হয়।

সতীশ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, বৌঠান কোথায়?

তিনি এইমাত্র স্নান করে রান্নাঘরে গেলেন।
সতীশ আর কোন প্রশ্ন না করিয়া পা টিপিয়া যথাসাধ্য পদশব্দ বাঁচাইয়া সোজা রান্নাঘরে চলিয়া গেল। কিরণময়ী বোধ করি অপেক্ষা করিয়াই ছিল, সতীশ দ্বারের কাছে আসিতেই উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে—ও কি ঠাকুরপো, চোখ-মুখ যে ভয়ানক বসে গেছে—রাত্রে ঘুমোও নি নাকি?

প্রশ্নটা সতীশের কানে প্রবেশ করিবামাত্রই তাহার মুখখানা ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হইয়াই তৎক্ষণাৎ নিবিয়া ছাই হইয়া গেল। কহিল, হাঁ, সারারাত্রি জেগে তাকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করেচি। শুনে সন্তুষ্ট হলে ত? আর এখানে যেন না ঢুকি, এই ত? কিন্তু সেই ছোটলোক উপীনবাবুকে বোলো, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সত্য কথাই বলতাম। সংসারে সে ছাড়া সত্যি কথা বলতে পারে, এমন লোক আরও আছে। তা ছাড়া সে আমার এমন কেউ নয় যে, ভয়ে মিথ্যে বলতে হতো। বোলো তাকে—বুঝলে বৌঠান! বলিয়াই সতীশ ফিরিয়া চলিল।

অকস্মাৎ সতীশের এই ভাব, এই অত্যুগ্র কণ্ঠস্বর—কিরণময়ী যেন দিশাহারা হইয়া গেল। সতীশ বড় ঘরের দরজা পার হইয়া যায় দেখিয়া কিরণময়ী ব্যস্ত হইয়া বাহিরে আসিয়া ডাকিল, যেয়ো না ঠাকুরপো, শোনো—

সতীশ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া চেঁচাইয়া কহিল, কি হবে শুনে? সত্যি বলচি বৌঠান, সে যে এতবড় ছোটলোক, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। যেখানে সে থাকে, সেখানে আমি থাকিনে। আজ বুঝতে পারচি, হঠাৎ কেন সেদিন বাবা ও-রকম চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু বোলো সেই ইতরটাকে, আমি তাকে গ্রাহ্যও করিনে।

কিরণময়ী ব্যাকুল হইয়া কহিল, কাকে? কি বলচ ঠাকুরপো?

ঠিক বলচি বৌঠান, ঠিক বলচি। তাকে বললেই সে বুঝবে। কিন্তু তোমাকেও বলে যাই আজ—বিনা দোষে তোমার বাড়ির দরজা আমার মুখের ওপর বন্ধ করে দিলে বটে,—কিন্তু একদিন বুঝবে—সতীশ যত মন্দই হোক, তাকে বিশ্বাস করে কেউ কোনদিন ঠকেনি। আর একটা কথা তাকে বোলো, সে যত ইচ্ছে—প্রাণভরে আমার সর্বনাশের চেষ্টা করে যেন, কিন্তু আমিও তাকে আর মুখ দেখাব না, সেও যেন আমাকে—হঠাৎ সতীশ দরজার দিকে চাহিয়া থামিয়া গেল, এবং পরক্ষণেই মুখ ফিরাইয়া ঝড়ের বেগে প্রস্থান করিল। তাহারই দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া কিরণময়ীরও দুই চক্ষু পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ উপেন্দ্রর মুখের উপর গিয়া পড়িল। তিনি চেঁচামেচি শুনিয়া রোগীর শয্যাপার্শ্ব হইতে উঠিয়া আসিয়া ঘরের কবাট ঈষন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন।

কিরণময়ীর একবার মনে হইল, ব্যাপারটা কি, উপেন্দ্র তাহা জানিতে চাহিবেন। কিন্তু তিনি কোন কথাই বলিলেন না, নিঃশব্দে কবাট বন্ধ করিয়া দিয়া ভিতরে সরিয়া গেলেন।
কিরণময়ীর বিস্ময়ের অবধি নাই। এ কি কাণ্ড! সতীশ তাহার উপীনদাকে এমন করিয়া তাহারি মুখের উপর অপমান করিয়া গেল কেমন করিয়া? কিসের জন্য? সে রান্নাঘরে ফিরিয়া গিয়া হাতের কাজগুলা যেন স্বপ্নাবিষ্টের মত করিয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু মনের মধ্যে একটা গভীর ক্ষুব্ধ বিস্ময় সহস্র রূপ ধরিয়া নিরন্তর চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিয়া ফিরিতে লাগিল। তাহার ঘরের মধ্যে যে এতবড় একটা বিপদ আসন্ন হইয়া রহিয়াছে, ক্ষণকালের জন্য সে তাহাও ভুলিল, শুধু ভাবিতে লাগিল, কাল সন্ধ্যার পর সতীশ বাসায় ফিরিয়া গেছে, তার পরে এই একটা রাত্রির মধ্যে এমন কি ঘটনা ঘটিতে পারে যাহাতে সে এমন উন্মত্ত আচরণ করিয়া চলিয়া গেল।

অথচ উপেন্দ্র একটা কথাও জানিতে চাহিলেন না। তাহার মনে হইল, ক্ষণকালের জন্য উপেন্দ্রর শুষ্ক কঠিন মুখের উপর যেন দুঃসহ বিস্ময় ফুটিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু ইহা সত্য কিংবা শুধু তাহারই মনের কল্পনা, তাই বা কে জানে!

উপেন্দ্র ফিরিয়া গিয়া মুমূর্ষুর শয্যাপ্রান্তে তাঁহার পূর্ব স্থানটিতে বসিয়া রহিলেন। তিনি স্বভাবতঃই শান্ত-প্রকৃতির। সহসা কাহারো সপক্ষে বা বিপক্ষে মতামত গ্রহণ করিতেন না। কিন্তু সেই সহজ নির্মল বিচার-ক্ষমতা তাঁহার ছিল না, কাল রাত্রে যখন সুরবালা প্রভৃতিকে জ্যোতিষের বাটীতে পৌঁছাইয়া দিয়া গভীর রাত্রে একাকী হারানের কক্ষে আসিয়া প্রবেশ করিয়াছিলেন, হারানের শ্বাসকষ্ট তখন ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছে। ভিতরে সংজ্ঞা আছে কি না, তাহা অনুমান করা কঠিন। চারিদিকে চাহিয়া ব্যাপারটা তাঁহার কি ভীষণ ঠেকিয়াছিল! অথচ, কোথাও যেন এতটুকু ব্যাকুলতা নাই। ইতিপূর্বে তিনি যে দুই-একটা মৃত্যুশয্যা চোখে দেখিয়াছিলেন, ইহার সহিত তাহাদের কতবড় প্রভেদ। রোগীর শিয়রে তেমনি একটা তেলের প্রদীপ অত্যন্ত ম্লান হইয়া জ্বলিতেছে, মা ঘরের একটা কোণে মাদুর পাতিয়া নিদ্রিত—শুধু কিরণময়ী জাগিয়া বসিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহারও আচরণে উদ্বেগের কোন লক্ষণ খুঁজিয়া না পাইয়া তাঁহার নিশ্চয় বোধ হইয়াছিল, সে যেন পরম ঔদাস্যে স্বামীর মৃত্যু প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। মায়েরও কেমন যেন নির্লিপ্ত ভাব,—নিজের রোগ ও রুগ্নদেহ লইয়াই অস্থির।

কাল রাত্রে উপেন্দ্র যেন অত্যন্ত সুস্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছিলেন, শুধু যে মৃত্যুর বিভীষিকাই এই দুটি রমণীর মধ্যে আর ছিল না তাহা নহে, পরন্তু ইহার বাঁচিয়া থাকাটাই যেন একটা বাঁধের মত হইয়া এই ক্ষুদ্র পরিবারটির সুখ-দুঃখের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করিয়া, আবর্জনায় নিরতিশয় পীড়িত করিয়া তুলিয়াছে। যেমন করিয়াই হউক, এর অবরোধ হইতে মুক্তি পাইলেই ইহারা যেন নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচে।
উপেন্দ্র আজিও কিরণময়ীকে চিনিতে পারেন নাই—সে সুযোগই তাঁহার ঘটে নাই। কিন্তু সতীশ চিনিয়াছিল। তাই প্রথম যেদিন ইঁহারা হারানের আহ্বানে এ বাটীতে পদার্পণ করিয়াছিলেন, কিরণময়ীর সে রাত্রির আচরণ সতীশ ত ভুলিয়া ছিলই, অধিকন্তু নিজের রূঢ়তার সহস্র অপরাধ স্বীকার করিয়া, তাঁহার ক্ষমা লাভ করিয়া, ভাইয়ের স্থান অধিকার করিয়াছিল। কিন্তু উপেন্দ্রর সে অবকাশ ঘটে নাই। তাই কাল রাত্রে ঘরে ঢুকিয়া এক মুহূর্তেই তাঁহার অপ্রসন্নচিত্ত মায়ের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে নিবিড় ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। তাই সকালে কিরণময়ী যখন চা দিয়া গেল তিনি স্পর্শও করিলেন না।

সকালে সতীশের আসা-যাওয়া আঘোরময়ী টের পান নাই। তখন তিনি নীচে নিজের কাজে ব্যাপৃত ছিলেন, এখন পা টিপিয়া ঘরে ঢুকিয়া ছেলের পানে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কেহ তাঁহাকে সান্ত্বনা দিল না, নিষেধও করিল না। হঠাৎ তাঁহার চায়ের বাটির প্রতি চোখ পড়ায় কান্নার সুরে প্রশ্ন করিলেন, কৈ বাবা, চা খেলে না যে?

উপেন্দ্র সংক্ষেপে কহিলেন, না—

অঘোরময়ী অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন,—না না, সে হবে না বাবা—সারা রাত্রি জেগে আছ,—এর উপর আবার তোমার অসুখ-বিসুখ হয়ে পড়লে আমি আর বাঁচব না উপীন।

উপেন্দ্র কথা কহিলেন না, শুধু কেবল অঘোরময়ীর মুখের পানে একটা তিক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আর এক দিকে চাহিয়া রহিলেন। ইহার অর্থবোধ করা অঘোরময়ীর সাধ্য ছিল না। তিনি পুনঃ পুনঃ জিদ করিতেই লাগিলেন, কিন্তু সে দৃষ্টির অর্থ বুঝিল কিরণময়ী। এই ঘরে এই মৃতকল্প সন্তানের পার্শ্বে বসিয়া পরের ছেলের জন্য জননীর এই উৎকট ব্যাকুলতা কত যে অসঙ্গত ও অশোভন দেখাইল, তাহা তাহার তীব্র বুদ্ধির অগোচর রহিল না। কিন্তু সে যাই হোক, উপেন্দ্রও কেন যে এই একটা তুচ্ছ অনুরোধের বিরুদ্ধে এইরূপ দৃঢ় পণ করিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলেন, তাহারও কারণ কিরণময়ী অনুমান করিতে পারিল না। ইঁহার আচরণটাও তাহার চোখে কম অরুচিকর ঠেকিল না।

এই জেদাজেদি স্থগিত হইল ডাক্তারের আগমনে। সাহেব ডাক্তার মিনিট দুই-তিন পরীক্ষার পরে তাঁহার শেষ জবাব দিয়া গেলেন, এবং এই সঙ্গে ভরসাও দিয়া গেলেন যে, আগামী শেষ-রাত্রির এদিকে শেষ হইবার সম্ভাবনা নাই।

বেলা তখন দশটা। কিরণময়ী একটুখানি কাছে সরিয়া আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, আপনার একবার সেখানে দেখা দিয়ে আসাও ত দরকার।

উপেন্দ্র কোন দিকে না চাহিয়া কহিল, তেমন দরকার নেই। তাঁরা সমস্ত জানেন।

কিরণময়ী কহিল, তবুও একবার যান। এখন ত কোন ভয় নেই—ততক্ষণ স্নান করে একটু বিশ্রাম করে ফিরে আসতে পারবেন।
উপেন্দ্র কথা কহিল না। কিরণময়ী মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, একটুখানি বুঝে দেখুন, স্নানাহার না করে উপোস করে এখন মুখোমুখি বসে থেকে কোন ফল নেই। গাড়িতে এসেচেন, কাল সমস্ত রাত্রি জেগে বসে আছেন, তার ওপর আজ সারা দিনরাত্রি এমন করে বসে থাকলে অসুখ হয়ে পড়তে পারে। সতীশঠাকুরপোও নেই—এ সময় আপনি যদি—তা ছাড়া আপনাকে সত্যিই বড় ক্লান্ত দেখাচ্চে। আমি বসে আছি—ততক্ষণ আপনি একটুখানি ঘুরে আসুন। কথা শুনুন—উঠুন।

সহসা উপেন্দ্র মুখ তুলিয়া চাহিয়াই দৃষ্টি অবনত করিয়া ফেলিল। এমন করিয়া এত কথা কিরণময়ী আর কখনো তাঁহার সাক্ষাতে কহে নাই। এ কণ্ঠস্বরে শুভাকাঙ্ক্ষার আতিশয্য নাই, অথচ কি দৃঢ়! কি কোমল! উপেন্দ্রর কানের মধ্যে কিরণময়ীর এই প্রথম সস্নেহ অনুরোধ কি অপরূপ হইয়াই ঠেকিল! বহুদিন পূর্বে একদিন রাত্রে যে তীব্রকণ্ঠ, যে কঠিন ভাষা ইহারই কাছে সে শুনিয়া গিয়াছিল, তাহার সহিত ইহার কি আশ্চর্য প্রভেদ!

উপেন্দ্র কোনদিকে না চাহিয়া প্রশ্ন করিল, আপনাদের আজ কিরকম হবে?

কিরণময়ী কহিল, সে কথা কেন জিজ্ঞাসা করচেন? আমাদের আজ যে দুঃখের দিন, তার ত কেউ ভাগ নিতে পারবে না। আপনি কিন্তু আর দেরী করবেন না, এইবেলা উঠে পড়ুন!

সত্য কথা বলিবার এ কি অদ্ভুত শান্ত-কঠিন ভঙ্গী! মুহূর্তের জন্য উপেন্দ্র সমস্ত ভুলিয়া তাহার বিস্ময়-বিস্ফারিত দুই চক্ষের পরিপূর্ণ দৃষ্টি কিরণময়ীর মুখের উপর নিবদ্ধ করিল। প্রথমেই চোখ পড়িল তাহার সিঁথার পুরোভাগে সিঁদুরের উজ্জ্বল রেখাটা—নারী-সৌভাগ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন—এ জীবনের পরম শ্রেয়ঃ এখনো নিশ্চিহ্ন হয় নাই—আয়তির সমস্ত গৌরব বহন করিয়া এখনও বিদ্যমান আছে। প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাসে উপেন্দ্রর সর্বশরীর একবার কাঁপিয়া নড়িল উঠিল।

কিরণময়ী তাহা দেখিতে পাইল, কিন্তু তাহার আভাসমাত্রও তাহার মুখে প্রকাশ পাইল না। কহিল, আপনি উঠুন, আমি একটু দুধ খাইয়ে দিই।

উপেন্দ্র সরিয়া বসিয়া কহিল, ওষুধটা—

কিরণময়ী ব্যথিত স্বরে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না না, আর তাতে কাজ নেই। অনেক ওষুধই জোর করে খাইয়েচি, আর খাওয়াতে চাইনে।

উপেন্দ্র প্রতিবাদ করিল না। ঔষধের অনাবশ্যকতা সে নিজেও কম জানিত না। স্বামীকে দুধ পান করাইয়া সে পুনর্বার অনুরোধ করিতেই উপেন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল এবং অতিশীঘ্র স্নানাহার করিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়া দ্বার পর্যন্ত অগ্রসর হইতেই কিরণময়ী মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, আসবার সময় সতীশঠাকুরপোর বাসাটা হয়ে আসবেন কি?

উপেন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কেন?

কিরণময়ী কহিল, আমার ত লোক নেই যে, তাঁর বাসায় একবার পাঠাব, সেই জন্যে বলছিলুম, আপনি যদি একবার—
উপেন্দ্রর সহসা মনে হইল, এই ডাকিতে পাঠাইবার প্রস্তাবের দ্বারা তাহাকেই যেন বিশেষভাবে একটু খোঁচা দেওয়া হইল। তাই তিক্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তাকে কি আপনার বিশেষ কোন প্রয়োজন আছে?

এই কণ্ঠস্বর ও তাহার তাৎপর্য কিরণময়ীর অগোচরে রহিল না। কিন্তু, তাই বলিয়া নিজের কণ্ঠস্বরের দ্বারা আর তাহাকে সে বাড়াইয়া তুলিল না। শুধু বলিল, এ দুঃসময়ে ত আমার সকলকেই প্রয়োজন উপীনবাবু। তা ছাড়া, কেন যে হঠাৎ তিনি আপনার উপর অমন রাগ করে চলে গেলেন, তাও ত জানিনে। তাই ভাবচি, একবার তাঁকে ডেকে আনবার চেষ্টা করা কি ভাল নয়?

উপেন্দ্র মনে মনে বিরক্ত হইয়া কহিল, আপনি সেজন্য উদ্বিগ্ন হবেন না। সে ত আমারই বন্ধু, আমাদের ভাল-মন্দ আমরাই স্থির করে নিতে পারব। তবে, আপনার যদি বিশেষ কাজ থাকে ত—তার কাছে লোক পাঠিয়ে দিতে পারি—আমার নিজের যাবার সময় হবে না।

কিরণময়ী মৃদুস্বরে কহিল, সেই ভাল। লোক পাঠিয়ে দেবেন। তার আসাই চাই। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বোঝাপড়া যবে হয় হোক, কিন্তু আমি তার বোন। আমার এতবড় বিপদের দিনে আমাকে শাস্তি দিতে আপনাদের আমি দেব না।

না না, তার আবশ্যক কি, আমি খবর পাঠিয়ে দেব—বলিয়া উপেন্দ্র বাহির হইয়া গেল। অবশ্য, ভাই-বোনের নূতন সম্বন্ধ কোথায় কিভাবে গড়িয়া উঠিবে তাহা স্থির করিয়া দিবার ভার তাহার উপরে নাই, এ কথা সে মনে মনে স্বীকার করিয়া লইল। কিন্তু তথাপি যে আত্মীয়তার ধারা একদিন শুধু তাহার মধ্য দিয়াই পথ পাইয়াছিল, সে যে আজ তাহাকেই অতিক্রম করিয়া প্রবাহিত হইতেছে, এ সংবাদ তাহাকে আঘাত না করিয়া পারিল না। বন্ধুর প্রতি সে যা খুশী করিতে পারে, কিন্তু তাহাদের এই ভাই-বোনের নিকটতম সম্বন্ধের মধ্যে কিরণময়ী কোন বন্ধুকেই যে হস্তক্ষেপ করিতে দিবে না, ইহা বুঝিবার পক্ষে সে অস্পষ্টতার লেশমাত্র স্থান রাখে নাই।

ক্ষুদ্র গলি দ্রুতপদে পার হইয়া আসিয়া উপেন্দ্র বড় রাস্তায় গাড়ি ভাড়া করিল। অন্ধকার-শীতল মৃত্যুপুরীর বাহিরে, শহরের এই প্রখর সূর্যালোকদীপ্ত, জীবন্ত, কর্মচঞ্চল রাজপথের উপরে দাঁড়াইয়াও কিন্তু সে আরাম বোধ করিল না। মনের ভিতরটায় কেমন যেন একরকম জ্বালা করিতেই লাগিল।

আবশ্যক হইলে কিরণময়ী যে কিরূপ উগ্রভাবে কঠিন হইয়া উঠিতে পারে, তাহা সে একদিন দেখিয়াছিল, কিন্তু তাহার শান্ত বিরুদ্ধতাও যে তাহা অপেক্ষা অল্প কঠিন নয়, আজিকার এই গুটি কয়েক কথাতেই সে স্পষ্ট অনুভব করিল। সতীশের সহিত তাহার যে একটা বিবাদ ঘটিয়াছে, কিরণময়ী তাহা টের পাইয়াছে বুঝা গেল। কিন্তু, কলহের কারণ যাহাই হোক, দোষ-গুণের বিচার সে নিজেই করিবে, আর কাহাকেও হাত দিবে না, এই কথাটাই ঘুরিয়া ফিরিয়া তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতে লাগিল।

চব্বিশ

নারীর সম্বন্ধে উপেন্দ্রর মত পরিবর্তন করিবার সময় আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ তাহাকে মনে মনে স্বীকার করিতে হইল, স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের মধ্যে মস্ত ভুল ছিল। এমন নারীও আছে, যাহার সম্মুখে পুরুষের অভ্রভেদী শির আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে। জোর খাটে না, মাথা অবনত করিতে হয়। এমনি নারী কিরণময়ী। সেই প্রথম পরিচয়ের রাত্রে ইহারই সম্বন্ধে উপেন্দ্র সতীশের কাছে, মুখে অন্যরূপ কহিলেও অন্তরে সকরুণ অবজ্ঞার সহিত ভাবিয়াছিল, ইহারা সেই-সব উগ্র-স্বভাবা রমণী—যাহারা অতি সামান্য কারণেই জ্ঞান হারাইয়া উন্মাদের মত বিষ খাইয়া, গলায় দড়ি দিয়া ভয়ঙ্কর কাণ্ড করিয়া বসে। আজ দেখিতে পাইল, না, তাহা নয়। ইহারা একান্ত সঙ্কটের মধ্যেও মাথা ঠিক রাখিতে জানে, এবং লেশমাত্র উগ্র না হইয়াও অবলীলাক্রমে আপন ইচ্ছা প্রয়োগ করিতে পারে। এ বাটীতে সতীশের আসা-যাওয়া উচিত-অনুচিত যাই হোক, কিরণময়ী ডাকিয়াছে, এ খবরটা সতীশকে দিতেই হইবে।

এই কথাটা পথে যাইতে যাইতে সে যতই আলোচনা করিতে লাগিল, ততই তাহার মন আক্ষেপে ভরিয়া উঠিল। কারণ, সতীশকে অত ভালবাসিত বলিয়াই, তাহার উপর আজ উপেন্দ্রর বিতৃষ্ণার যেন অন্ত ছিল না। সে যে অপরাধ করিয়াছে, তাহার বিচার আর একদিন হইবে, কিন্তু আজ যে সতীশ প্রকাশ্যে, তাহারি মুখের উপর তাহার চিরদিনের অধিকৃত অগ্রজের সম্মানিত আসনটিকে সদর্পে মাড়াইয়া গেল, কোন সঙ্কোচ মানিল না, সকল দুঃখের চেয়ে এই দুঃখই উপেন্দ্রর মর্মে গিয়া বিঁধিয়াছিল।

কিছুদিন পূর্বে উপেন্দ্র বাড়িতে বসিয়াই একখানা অনামা পত্রে সতীশের কথা শুনিয়াছিল। সে পত্র, রাখালের লেখা। যখন দুজনের ভাব ছিল, তখন সতীশের নিজের মুখেই রাখাল তাহার এই পরম বন্ধুটির বহু অসাধারণ কাহিনী অবগত হইয়াছিল। উপেনদার অসামান্য বিদ্যা-বুদ্ধি এবং তাহার তুষার-শুভ্র অকলঙ্ক চরিত্রের খ্যাতি এবং সকল গর্বের বড় গর্ব ছিল তাহার সেই উপীনদার অপরিমেয় স্নেহ। সেইখানে ঘা দেওয়ার মত মারাত্মক আঘাত যে সতীশের পক্ষে আর কিছুই হইতে পারে না, ধূর্ত রাখাল তাহা ঠিক বুঝিয়াছিল।

কিন্তু, সে পত্র তখন কোন কাজই করে নাই। উপেন্দ্র চিঠি পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া পত্র-প্রেরকের উদ্দেশে হাসিয়া বলিয়াছিল, তুমি যেই হও এবং সতীশের যত গোপনীয় কথাই জানিয়া থাকো, আমি তোমার চেয়েও তাহাকে বেশী জানি; এবং দিন-দুই পরে সতীশের পিতার প্রশ্নে সহাস্যে কহিয়াছিল, সতীশ ভালই আছে। তবে, বোধ করি, কাহারও সহিত ঝগড়া-বিবাদ করিয়া সাবেক বাসা ত্যাগ করিয়া অন্যত্র গিয়াছে। সে লোকটা একখানা অনামা পত্রে তাহার সম্বন্ধে যা-তা লিখিয়া জানাইয়াছে।
বৃদ্ধ উদ্বিগ্নমুখে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, কিরকম যা-তা উপীন?

উপেন্দ্র জবাব দিয়াছিল, সে-সকল মিথ্যা গল্প শুনিয়া আপনার সময় নষ্ট করিয়া লাভ নাই। আমি ত সতীশকে হাতে করিয়া মানুষ করিয়াছি—আমি জানি, সে এমন কিছু করিবে না যাহাতে আত্মীয় কাহারও মাথা হেঁট হয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তাহার সেই বিশ্বাসের শিরে বজ্রপাত হইল সাবিত্রীকে স্বচক্ষে দেখিয়া। সতীশের নির্জন কক্ষের মধ্যে প্রসাধননিরতা একাকিনী রমণী! তাহার সে কি সুগভীর লজ্জা! এবং সমস্ত লজ্জা ছাপাইয়া সেই দুটি আয়ত চক্ষুর ব্যথিত ব্যাকুল দৃষ্টিতে কি ত্রাসই না ফুটিয়া উঠিয়াছিল! সে কি ভুল করিবার? এক মুহূর্তেই উপেন্দ্রর মনের মধ্যে রাখালের সেই বিস্মৃতপ্রায় চিঠিখানির আগাগোড়া একেবারে যেন আগুনের অক্ষরে জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। প্রশ্ন করিবার, সংশয় করিবার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না।

সে চিঠিখানিকে বিশ্বাসযোগ্য করিয়া তুলিতে রাখাল চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। তাহাতে সাবিত্রীর নাম ত ছিলই, নানাবিধ বিবরণের মধ্যে তাহার ভ্রূর উপর একটি ছোট কাল আঁচিলের কথা উল্লেখ করিতেও সে ভুলে নাই। চিহ্নটি এতই সুস্পষ্ট যে, পলকের দৃষ্টিপাতেই তাহা উপেন্দ্রর লক্ষ্যগোচর হইয়াছিল।

সতীশকে ডাকিয়া দিবার অপ্রিয় কাজটা যাইবার পথেই শেষ করিয়া যাইবে কি না, স্থির করিতে করিতেই ভাড়াটে গাড়ি জ্যোতিষ-সাহেবের বাটীর সম্মুখীন হইল এবং ফটকে প্রবেশ করিতেই তাহার উৎসুক দৃষ্টি কিসে যেন বাড়ির দক্ষিণ দিকের দোতলা কক্ষের অভিমুখে আকর্ষণ করিয়া লইল।

উপেন্দ্র মুখ বাড়াইয়া দেখিল, যাহা নিঃসংশয়ে প্রত্যাশা করিয়াছিল, ঠিক তাহাই। উন্মুক্ত সুদীর্ঘ বাতায়ন ধরিয়া একখানি স্তব্ধ প্রতিমা এই পথের পরেই যেন সমস্ত প্রাণমন পাতিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। এতটা দূর হইতে ভাল করিয়া দেখা সম্ভব নহে, তবুও তাহার মনশ্চক্ষে ওই বাতায়নবর্তিনীর ওষ্ঠাধরের ঈষৎ কম্পনটুকু হইতে চক্ষুপল্লব-প্রান্তের জলের রেখাটি পর্যন্ত এড়াইল না। তাহার এতক্ষণকার চিন্তাজ্বালা, অভিমান ও অপমানের ঘাত-প্রতিঘাতের বেদনা মুছিয়া গিয়া শুধু কেবল এই একটা কথা মনে জাগিল, সুরবালার সারারাত্রি এবং এই-সমস্ত সকালটা না জানি কি করিয়াই কাটিয়াছে। যে সাধ্য থাকিলে হয়ত তাহাকে ঘরের বাহির হইতেই দেয় না, সে যে এই অপরিচিত শহরের মধ্যে গভীর রাত্রে তাহার অসুস্থ স্বামীকে একাকী বাড়ির বাহিরে যাইতে দিয়া এতটা বেলা পর্যন্ত কিরূপ করিয়াছে, তাহা চিন্তা করিয়া একদিকে তাহার যেমন হাসি পাইল, অন্যদিকে তেমনি চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল।

সরোজিনী বোধ করি খবর পাইয়া সেইমাত্র ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিয়া বাহিরের বারান্দায় উপস্থিত হইয়াছিল, উপেন্দ্রকে দেখিবামাত্র তাহার চোখ-মুখ হাসির ছটায় ভরিয়া গেল। গাড়ি হইতে নামিতে না নামিতেই বলিয়া উঠিল, বাইরে আর একদণ্ডও নয়, একেবারে উপরে চলুন।
উপেন্দ্র যথাসাধ্য গম্ভীর-মুখে হেতু জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিল। সরোজিনী তখন সহাস্যে কহিল, বেশ মানুষটিকে কাল রাত্রে আমার জিম্মা করে দিয়েছিলেন—না নিজে ঘুমিয়েছে, না আমাকে ঘুমুতে দিয়েছে। সারারাত্রি গাড়ির শব্দ শুনেচে, আর জানালা খুলে দেখেচে—ও কি, চিঠি লিখতে বসে গেলেন যে! না না, সে হবে না—একবার দেখা দিয়ে এসে তার পরে যা ইচ্ছে করুন—এখন নয়।

বাহিরের বারান্দায় একটা ছোট টেবিলের উপর লিখিরাব সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত ছিল, উপেন্দ্র একখানা কাগজ টানিয়া লইয়া কহিল, বরং চিঠি লিখে তার পরে যা বলুন করতে পারি, কিন্তু তার পূর্বে নয়। পাঁচ মিনিটের বেশী লাগবে না—ইচ্ছে হয় গিয়ে খবর দিতে পারেন।

সরোজিনী তেমনি হাসিমুখে বলিল, আমার খবর দেবার দরকার নেই—তিনিই আমাকে খবর দিতে বাইরে পাঠিয়েছেন। আচ্ছা, পাঁচ মিনিট আমি দাঁড়িয়ে রইলুম—আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে তবে যাব।

উপেন্দ্র আর জবাব না দিয়া চিঠি লিখিতে লাগিল। লিখিতে লিখিতে তাহার মুখের উপর ব্যথা ও বিরক্তির সুস্পষ্ট চিহ্নগুলি যে অদূরে দাঁড়াইয়া সরোজিনী নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিল, তাহা সে জানিতেও পারিল না।

পত্র সমাপ্ত করিয়া তাহা খামে পুরিয়া ঠিকানা লিখিয়া উপেন্দ্র মুখ তুলিয়া চাহিল। কোচ্‌ম্যান আসিয়া সরোজিনীকে লক্ষ্য করিয়া জানাইল, গাড়ি প্রস্তুত হইয়াছে।

উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, আপনি বেরুবেন নাকি?

সরোজিনী কহিল, হাঁ। আমার ছোট পিয়ানোটা মেরামত করতে দিয়েচে, সেইটে একবার দেখে আসব।

উপেন্দ্র খুশী হইয়া কহিল, ঠিকানা লেখা আছে, একটু কষ্ট স্বীকার করে এই চিঠিখানা সহিসকে দিয়ে বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। বলিয়া উপেন্দ্র সরোজিনীর প্রসারিত হাতের উপর চিঠিখানি রাখিয়া দিল।

সরোজিনী কিছুক্ষণ ধরিয়া তাহার শিরোনামার প্রতি চাহিয়া রহিল। ঐ দুই ছত্র নাম ও ঠিকানা পড়িতে এতটা সময় লাগে না। তার পরে মুখ তুলিয়া কহিল, সতীশবাবু এবার আমাদের বাড়িতে উঠলেন না কেন?

সে ত আমাদের সঙ্গে আসেনি—সতীশ বরাবরই এখানে আছে।

সংবাদ শুনিয়া সরোজিনী চমকিয়া গেল। উপেন্দ্রর এ-সকল লক্ষ্য করিবার মত মনের অবস্থা ছিল না, থাকিলে সে আশ্চর্য হইত।

সরোজিনী নিজের লজ্জা চাপা দিতে সহজভাবে বলিবার চেষ্টা করিল, তিনি কখনো এদিকে মাড়ান না—অথচ এতদিন এত কাছে রয়েচেন।

উপেন্দ্র অন্যমনস্ক হইয়া আর একটা কিছু ভাবিতেছিল, কহিল, বোধ করি, আপনাদের কথা তার মনে নেই। কথাটা কত সহজ, কিন্তু কি কঠিন হইয়াই আর একজনের কানে বাজিল!

ভাল কথা, দিবাকর কৈ, তাকে দেখছিনে যে?
তিনি দাদার সঙ্গে হাইকোর্টে বেড়াতে গেছেন। চলুন, আপনাকে সঙ্গে করে আগে ভিতরে দিয়ে আসি; বলিয়া সরোজিনী বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।

মিনিট-কুড়ি পরে ফিরিয়া আসিয়া সে যখন গাড়িতে উঠিয়া বসিল এবং আদেশমত গাড়ি সতীশের বাসার অভিমুখে রওনা হইল, তখন ভিতরে বসিয়া সরোজিনীর বুকের ভিতরটা কাঁপিতে লাগিল এবং গাড়ি যতই অগ্রসর হইতে লাগিল, হৃৎস্পন্দন ততই যেন দুর্নিবার হইয়া উঠিতে লাগিল।

ঠিক মনে হইতে লাগিল, সে এমনই কি একটা গুরুতর কাজের ভার লইয়া চলিয়াছে— যাহার সিদ্ধির উপর তাহার নিজেরই যেন সমস্ত ভবিষ্যতের ভাল-মন্দ নির্ভর করিয়া আছে।

অনতিকাল পরে গাড়ি সতীশের বাসার সম্মুখে আসিয়া থামিল এবং সহিস পত্রখানি হাতে করিয়া নামিয়া গেল। সরোজিনী গাড়ির একটা কোণ ঘেঁষিয়া আড়ষ্ট হইয়া কান পাতিয়া দরজার উপর সহিসের করাঘাত শুনিল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দ এবং তাহার ভিতরে যাওয়া অনুভব করিল এবং তাহার পর প্রতি-মুহূর্তে কাহার সুপরিচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে আসিবার আশঙ্কায় ও আকাঙ্ক্ষায় স্তব্ধ কণ্টকিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে নিশ্চয় জানিত, গাড়ি এবং গাড়ির ভিতরে যে বসিয়া আছে, সহিসের কাছে তাহার পরিচয় অবগত হইয়া সতীশ নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইবে। তাহার একবারও মনে হইল না, যে ব্যক্তি এতকাল এত কাছে বাস করিয়াও এমন করিয়া ভুলিয়া থাকিতে পারে, এ সংবাদ তাহাকে হয়ত অণুমাত্রও বিচলিত না করিতে পারে।

আবার সহিসের কণ্ঠস্বর দ্বারের কাছে শুনিতে পাওয়া গেল—সে দ্বার রুদ্ধও হইল এবং ক্ষণকাল পরেই সে চিঠি হাতে লইয়া একা ফিরিয়া আসিল। কহিল, বাবু বাড়ি নেই।

বাড়ি নেই? মুহূর্তকালের জন্য সরোজিনী সুস্থ হইয়া বাঁচিল। মুখ বাড়াইয়া কহিল, চিঠিটা ফিরিয়ে নিয়ে এলি কেন, রেখে আয়।

সহিস জানাইল, বাবু কলিকাতায় নাই, বেলা দশটার ট্রেনে বাড়ি চলিয়া গেছেন।

কথাটা শুনিয়া কেন যে তাহার এই বাসাটা একবার স্বচক্ষে দেখিয়া লইবার দুর্দমনীয় স্পৃহা হইল, তাহার হেতু সে ঠিকমত নিজেও বুঝিতে পারিল না। কিন্তু, পরক্ষণেই নামিয়া আসিল এবং আর একবার কবাট খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। হিন্দুস্থানী পাচক জিনিসপত্রের পাহারায় নিযুক্ত ছিল, তাহার সাহায্যে সমস্ত ঘরগুলা ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিয়া নীচে আসিবার পথে দড়ির আলনায় ঝুলানো একটা অর্ধমলিন চওড়া পাড়ের শাড়ির প্রতি সরোজিনীর দৃষ্টি পড়িল। কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করায় ব্রাহ্মণ নিজের ভাষায় ব্যক্ত করিল এ বস্ত্রখানি মা-জীর।
সাবিত্রী অপরাহ্নবেলায় স্নান করিয়া তাহার পরিধেয় সিক্ত বস্ত্রখানি শুকাইতে দিয়াছিল, তাহা তখন পর্যন্ত তেমনিই টাঙ্গানো ছিল। সরোজিনী বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসাবাদ দ্বারা এই মাইজীর সম্বন্ধে যতটুকু অবগত হইল, তাহাতে আরও আশ্চর্য হইয়া গেল। যে-সকল ব্যাপার সচরাচর এবং সহজভাবে ঘটে না, এবং যাহার মধ্যে পাপ আছে, তাহা তলাইয়া বুঝিতে না পারিলেও সকলেই নিজের বুদ্ধি অনুসারে একরকম করিয়া বুঝিতে পারে। এই হিন্দুস্থানীটিও সস্ত্রীক উপেন্দ্রর আসা এবং অমন করিয়া তৎক্ষণাৎ চলিয়া যাওয়া হইতে আজ সকালে মনিবের অকস্মাৎ প্রস্থানের মধ্যে মাইজীটির যে সংস্রব ছিল, তাহা অনুমান করিতে পারিয়াছিল। বিশেষ করিয়া সতীশের উদ্‌ভ্রান্ত আচরণ কোন লোকেরই দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব ছিল না। তাই সে সাবিত্রীর অসুখ প্রভৃতি অনেক কথাই কহিল এবং তাহাকে দেখা-শুনা করিবার জন্যই যে তাহার মনিবকে এমন ব্যস্ত ও ব্যাকুল হইয়া অকস্মাৎ প্রস্থান করিতে হইয়াছে তাহাও সে একরকম করিয়া বুঝাইয়া দিল। সরোজিনী এই একটি নূতন তথ্য অবগত হইল যে, উপেন্দ্ররা সর্বপ্রথমে এই বাড়িতেই আসিয়াছিলেন, মোট-ঘাট নামানো পর্যন্ত হইয়াছিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সমস্ত তুলিয়া লইয়া সেই গাড়িতেই প্রস্থান করিয়াছিলেন। অথচ, তাঁহারা কেহই সতীশের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নাই। তাহার পরে আজ এই পত্র,—স্পষ্ট বুঝা গেল, উপেন্দ্র তাঁহার বন্ধুর আকস্মিক প্রস্থানের কথাটা বিদিত নহেন। অধীর ঔৎসুক্যে সে ক্রমাগত এই রমণীটির সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্ন করিয়া ইহার বয়স এবং সৌন্দর্যের যে তালিকা পাইল তাহা সত্যকে ডিঙ্গাইয়াও বহু ঊর্ধ্বে চলিয়া গেল। অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া সে যখন গাড়িতে উপবেশন করিল, তখন তাহার পিয়ানো সারানোর শখ চলিয়া গেছে এবং অজ্ঞাত গুরুভারে বুকের ভিতরটা ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে।

এই রহস্যময়ী যে কে, এবং কি সূত্রে আসিয়াছিল তাহা জানা গেল না। কিন্তু একটা লুকোচুরির অস্তিত্ব তাহার মনের মধ্যে দৃঢ়মুদ্রিত হইয়া রহিল।

সতীশ ও কিরণময়ীর উপর বিরক্তি ও অভিমান উপেন্দ্রের যত বড়ই হউক, তাহাকে প্রাধান্য দিয়া কর্তব্য অবহেলা করা তাহার স্বভাব নয়। তাই আহারাদির পর পাথুরেঘাটার বাড়িতে ফিরিয়া যাওয়াই তাহার ইচ্ছা ছিল বটে, কিন্তু নিদারুণ শ্রান্তি আজ তাহাকে পরাস্ত করিল। অধিকন্তু সুরবালা এমনি বাঁকিয়া দাঁড়াইল যে, তাহা অবহেলা করিয়া যাওয়াও অসাধ্য হইয়া পড়িল।

ঘণ্টা-কয়েক পরে তাহার উৎকণ্ঠিত নিদ্রা যখন ভাঙ্গিয়া গেল, তখন বেলা আর নাই। ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিতেই পাশের টিপয়ের উপর চিঠিখানার উপর চোখ পড়িল। তুলিয়া লইয়া দেখিল, পত্র তেমনি বন্ধ রহিয়াছে—যে কারণেই হউক, তাহা সতীশের হাত পড়ে নাই। সাড়া পাইয়া সুরবালা ঘরে ঢুকিয়া কহিল, সতীশ-ঠাকুরপো এখানে নেই, বেলা দশটার গাড়িতে বাড়িতে চলে গেছেন।
সংবাদ শুনিয়া উপেন্দ্রের মুখ কালি হইয়া গেল। প্রথমেই মনে হইল, এই অপরিচিত শহরের মধ্যে হারানের আসন্ন মৃত্যু-সংক্রান্ত যাবতীয় কর্তব্য এখন একাকী তাহাকেই সম্পন্ন করিতে হইবে। উঃ, সে কত কাজ! এবং ভীষণ নিদারুণ! লোক ডাকা, জিনিসপত্র যোগাড় করা, সদ্যবিধবা ও জননীর কোলের ভিতর হইতে তাহার একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ টানিয়া বহন করিয়া লইয়া যাওয়া! এই মর্মান্তিক শোকের দৃশ্য কল্পনা করিয়াই তাহার সর্বাঙ্গ পাথরের মত ভারী ও সমস্ত চিত্ত পাথুরেঘাটার প্রতিকূলে মুখ বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। নিজের অজ্ঞাতসারে সে যে ভিতরে ভিতরে সতীশের উপর কতখানি নির্ভর করিয়া বসিয়াছিল, তাহা এইবার অভিমান ও অপমানের আবরণ ভেদ করিয়া দেখা দিল।

এই-সকল কার্য উপেন্দ্রর নিতান্তই প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। সাধ্যমত কোনদিন সে ইহার মধ্যে পড়িতে চাহিত না। কিন্তু সতীশের কাছে তাহা কতই না সহজ! দেশে এমন লোক মরে নাই, যেখানে সে তাহার কর্মপটু সুস্থ সবল দেহটি লইয়া সর্বাগ্রে উপস্থিত হয় নাই, এবং সমস্ত অপ্রিয় কার্য নিঃশব্দে বিনা-আড়ম্বরে সম্পন্ন করিয়া দেয় নাই। এ দুঃসময়ে সকলেই তাহাকে খুঁজিত, এবং তাহার আগমনে শোকার্ত ও বিপন্ন গৃহস্থ এই দুঃখের মাঝেও সান্ত্বনা এবং সাহস পাইত। সে যখন একেবারে কলিকাতা ছাড়িয়া চলিয়া গেল, তখন ক্ষণকালের জন্য উপেন্দ্র কোনদিকে চাহিয়া আর পথ দেখিতে পাইল না।

সুরবালা স্বামীর মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া হারানের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু সতীশের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল না। সরোজিনী ফিরিয়া আসিয়া কথা বাহির করিবার জন্যে গল্পচ্ছলে যাহা বিবৃত করিয়াছিল, তাহা হইতেই সে কাল রাত্রির ব্যাপারটা অনুমান করিয়া লইয়াছিল, সতীশ যে তাহার স্বামীর কত বড় বন্ধু, তাহা জানিত বলিয়াই এই ব্যথাটা এখন এড়াইয়া গেল।

সুরবালার সাংসারিক বুদ্ধির উপরে উপেন্দ্রর কিছুমাত্র আস্থা ছিল না বলিয়াই সে কোনদিন স্ত্রীর কাছে কোন সমস্যার উল্লেখ করিত না, কিন্তু এইমাত্র সে নিজেকে এতই বিপন্ন ভাবিতেছিল যে, তৎক্ষণাৎ সমস্ত অবস্থাটা প্রকাশ করিয়া ফেলিয়া ব্যাকুল হইয়া কহিল, সে যে আমাকে এই বিপদের মাঝে ফেলে রেখে চলে যাবে সুরো, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। একা এই অজানা জায়গায় আমি কি উপায় করি! বলিয়া উপেন্দ্র যেন অসহায় শিশুর মত স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

কিন্তু আশ্চর্য, স্বামীর এতবড় বিপদের বার্তা পাইয়াও সুরবালার মুখে লেশমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ পাইল না। সে কাছে সরিয়া আসিয়া তাহার একটা হাত ধরিয়া পুনরায় বিছানার উপর বসাইয়া দিয়া ধীরভাবে কহিল, তা অত ভাবচ কেন, এ কলকাতায় কারো জন্যেই কারো আটকায় না। তোমার চা তৈরী হয়েছে, হাতমুখ ধুয়ে তুমি চা খেয়ে নাও। ছোটঠাকুরপোকে সঙ্গে করে আমিও যাচ্চি চল।
উপেন্দ্র অবাক হইয়া কহিল, তুমি যাবে?

সুরবালা অবিচলিতভাবে কহিল, যাব বৈ কি! মেয়েমানুষের এ দুঃসময়ে কাছে থাকা মেয়েমানুষেরই কাজ—বলিয়া সে অনুমতির জন্য অপেক্ষা মাত্র না করিয়া পাশের ঘর হইতে চা আনিয়া হাজির করিল এবং দিবাকরকে সংবাদ দিয়া নিজে প্রস্তুত হইবার জন্য শীঘ্র বাহির হইয়া গেল।

গৃহস্থের ঘরে ঘরে যখন সবেমাত্র সন্ধ্যাদীপ জ্বলিয়া উঠিয়াছে, ঠিক এমনি সময়ে তাহারা পাথুরেঘাটার বাড়িতে প্রবেশ করিল। সদর দরজা খোলা, কিন্তু নীচে কোথাও কেহ নাই। অন্ধকার ভাঙ্গা বাড়ি শ্মশানের মত স্তব্ধ। উভয়কে সাবধানে অনুসরণ করিতে ইঙ্গিত করিয়া উপেন্দ্র নিঃশব্দে উপরে উঠিয়া হারানের রুদ্ধ কবাটের সম্মুখে আসিয়া ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। ভিতর হইতে শুধু একটা মর্মভেদী দীর্ঘশ্বাস কানে আসিয়া বাজিল। কম্পিতহস্তে দ্বার ঠেলিয়া চাহিতেই আঁধার শয্যাতলে আপাদমস্তক বস্ত্রাচ্ছাদিত হারানের মৃতদেহ চোখে পড়িল। তাহার দুই পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া সদ্যবিধবা উপুড় হইয়া পড়িয়া ছিল—সে একবার মাথা উঁচু করিয়া দেখিল এবং পরক্ষণেই বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আর্তকণ্ঠে ‘মা’ বলিয়া চীৎকার করিয়াই উপেন্দ্রর পদতলে মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল এবং সেই মুহূর্তেই চক্ষের নিমেষে সুরবালা উদ্‌ভ্রান্ত হতবুদ্ধি স্বামীকে এক পাশে ঠেলিয়া দিয়া ঘরে ঢুকিয়া কিরণময়ীর মুখখানি কোলের উপর তুলিয়া লইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress