ষষ্ঠ অংক
অঘোরময়ী, কিরণময়ী, সতীশ
অঘোরময়ী– বৌমা, ও বৌমা, ইদিকে একবার এসো ত….
কিরণময়ী— এই ত। কিছু বলছিলে?
অঘোরময়ী— একি! বৌমা, এখনও এমন এলোঝেলো হয়ে আছো। উপিন হয়ত আজ আসবে।
কিরণময়ী– তুমি প্রতিদিনই উপিনবাবুর আসার আশায় থাকো।
উনি বাড়ি ফিরে গেছেন , সময়মতো আসবেন। চিন্তা করো কেন?
অঘোরময়ী— করবো না? ওদিকে ডাক্তার আসে না….উপিন কী তাকে বারণ করে গেলো।
কিরণময়ী– হ্যাঁ যা ভালো বুঝেছেন , করেছেন। আর ডাক্তারকে আসতে আমিই বারণ করেছি, মা। তিনি নন।
অঘোরময়ী– কি? কেন? ডাক্তার কি শুধু হারানকে দেখতে আসত? টাকা দিতো না?
এখন চলবে কি করে?
কিরণময়ী– জানি, আর এই জন্যই আমার চুল বাঁধবার এতো গরজ তোমার।
অঘোরময়ী– কি এতো বড়ো কথা। অলপ্পেয়ে, মুখরা……
কিরণময়ী– হ্যাঁ, আমি মুখরা, কিন্তু, তোমার কথামতো সেজেগুজে ডাক্তারকে ভুলিয়ে অকারণ আসতে আর বলবো না।
অঘোরময়ী— চুপ কর্। নস্টা মেয়েমানুষ! ডাক্তার কতোদিন আর টাকা দিয়ে যাবে অযথা।
কিরণময়ী– হ্যাঁ। ঠিক। এই কারণেই তাকে আর আসতে না বলে দিয়েছি।
তোমার ছেলের ত দরকার নেই আর , তাকে ত কবেই জবাব দিয়ে দিয়েছে ডাক্তার।
অঘোময়ী— হায়, আমার কপাল , এখন দুবেলা খাওয়া জুটবে কি করে….
অলক্ষ্মী বউ.. ….হাড় জ্বালানি ।
যাচ্ছ কোথায়?
কিরণময়ী– আমার কি এসব কলহ করবার সময় আছে মা। যাচ্ছি মা তোমার রাতের বিছানা করতে।
অঘোরময়ী– আমার আবার রাতের বিছানা !!! শোবার সময় আমিই পেতে নেবো।
রাত হতে এখন ঢের দেরি।
কিরণময়ী- জানি, কাজ সেরে রাখি।
অঘোরময়ী– তুমি বরং সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে আমার কাছে একটু বলো দিকিন।
দিবারাত্র খেটে খেটে দেহ তোমার আধখানা হয়ে গেল।
কিরণময়ী– সবই কপাল মা। আমি একরকম চাই, উনি আরেকরকম চান, তুমি তোমার মতো চাও।
সবই এ শরীরের উপর চাপ।
আমি বুঝি, কার মন কি চায়।
অঘোরময়ী– রাখো তোমার কেতাবী কথা।
ঐ দ্যাখো নীচে দরজায় কে কড়া নাড়ছে। কেউ এসেছে, নিশ্চয়ই উপেন।
শুনতে পাচ্ছ না।
কিরণময়ী– হু যাচ্ছি।
অঘোরময়ী– এইজন্যই বলি বৌ, একটু গা ধুয়ে চুল বেঁধে পরিপাটি থাকতে।
কিরণময়ী– তা আর বুঝি না মা, কোথায় তোমার গরজ।
অঘোরময়ী– – দূর হ, অলক্ষ্মী অপয়া
সংসারে কোনও মন নেই….
……………………………………………..
কিরণময়ী– একি তু… আপনি!!
এসো ভেতরে এসো, সতীশ ঠাকুরপো?
সতীশ– আপনি দেখছি এখনও আমাকে মাপ করেন নি।
কিরণময়ী– না। তুমি ত মাপ চাও নি ঠাকুরপো। চাইবার আগেই গায়ে পড়ে দিলে মানী লোকের অমর্যাদা হয়।
সতীশ– আমার কোন দাম নেই বউঠাকরুণ।
আমার কোন অমর্যাদা হবে না– আমাকে আপনি মাপ করে দিন।
কিরণময়ী– এমন জিনিস অনেক আছে ঠাকুরপো, যাকে ক্ষমা করলেই তার শেষ হয়ে যায়।
সতীশ– তাহলে?
কিরণময়ী– ক্ষমা করতে গেলে যদি আবার সতীশবাবু বলতে হয় তাহলে সে ক্ষমা করতে আমি পারব না।
সতীশ– তাহলে? (হাসি)
কিরণময়ী– আবার “তাহলে”। তোমাকে ধরে রাখার যে শেকল আমার হাতে তুলে দিয়েছ,তা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ফিরিয়ে নেবে, তা আমি হতে দেবো না।
সতীশ– যথা আজ্ঞা বউঠাকরুণ।
উপেনদা বলেছিল যাবার আগে– আমি যেন এ বাড়িতে আসি, খোঁজখবর করি আর হারানদাকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থাও করি।
কিরণময়ী– বেশ , তাহলে উপরে এসো আর শাস্তি হিসাবে….
সতীশ — শাস্তি, কেন শাস্তি কিসের?
কিরণময়ী— ঐ যে সময়মতো উপিনদার হুকুম পালন করো নি।
সতীশ– বেশ চলো উপরে, কি শাস্তি দেবে।
কিরণময়ী– চলো। সোজা রান্নাঘরে, তুমি লুচি বেলে দেবে আর আমি ভাজব।
সতীশ– আমি!! আমি লুচি বেলবো?
হা হা হা
কিরণময়ী– হ্যাঁ। ওটাই তোমার যোগ্য শাস্তি।
সতীশ– হারানদা কেমন আছেন?
কিরণময়ী– প্রাণটুকু আছে। যাও দেখে এসো।
সতীশ– আচ্ছা বৌঠান, আমায় লুচি বেলতে বলছ কিন্তু আমি লুচি বেলতে পারি, কি করে জানলে, আমার গায়ে কি তা লেখা আছে?
কিরণময়ী– লেখা পড়তে জানা চাই ঠাকুরপো, সেদিন রাতে, আমার গায়েতেই কি কিছু লেখা ছিল — অথচ
তুমি পড়েছ?
কি, বলো, মুখ হেট করে আছো কেন?
সতীশ— আমার খুব অন্যায় হয়েছিল সেদিন, আসলে আমার রাগ….
কিরণময়ী— আচ্ছা, ঠাকুরপো, মা বলছিলেন উপিনদা কখনও মাকে না জানিয়ে চলে যাবেন না। হঠাৎই বুঝি তাকে চলে যেতে হয়েছিল।
অথচ….
সতীশ— দোষ আমার, আমার উপর ভার দিয়েই তিনি চলে গেছেন। আসলে বউঠানের শরীর ভালো যাচ্ছে না।
কিরণময়ী— তোমার উপিনদা তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন, না—
সতীশ— সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
কিরণময়ী—হয়ত…. কি জানি ভাই, কোনটা যে স্বাভাবিক, কোনটি অস্বাভাবিক আমার কেমন গুলিয়ে যায়। তবে তিনি ঠিক কাজ করেন নি। মায়ের বিশ্বাসে ঘা লেগেছে, বলে গেলে মা আপত্তি করতেন না।
সতীশ– কি হলো , হঠাৎই এমন আনমনা হয়ে গেলে?
কিরণময়ী— না , অসুখ বিসুখে হলে ত তাকে যেতেই হবে।
সতীশ– ঠিক, কিন্তু উপিনদা একটু বাড়াবাড়ি ই করেন, মনে হয়। এইত কিছুদিন আগে বৌঠানের পানি বসন্ত হয়েছিল, উপিনদা আটদশদিন বউঠানের শিয়র থেকে উঠলেন না পর্যন্ত।
কিরণময়ী— হু। বললে যে , তিনি ছৌটবৌকে বড্ড ভালোবাসেন।
সতীশ– ওঃ, ভয়ানক ভালোবাসেন।
কিরণময়ী– আচ্ছা ছোট বৌ দেখতে কেমন, ঠাকুরপো, খুব সুন্দরী?
সতীশ–হ্যাঁ। খুব সুন্দরী
কিরণময়ী– ( মৃদু হাসি) আমার মতন?
সতীশ– সত্যিই জানতে চান?
কিরণময়ী— হু, সত্যি বই কি ঠাকুরপো।
সতীশ— দেখুন আমার মতামতের বেশি দাম নেই। কিন্তু যদি থাকে, তাহলে এই বলি আমি’ আপনার মতো রূপ বোধকরি পৃথিবীতে আর কারোর নেই। আর…
কিরণময়ী– আর কি? কি বলতে চাচ্ছ?
সতীশ– না। এই…উপিনদা বলেছিলেন আপনি নাকি বই পড়তে খুব ভালোবাসেন।
কিরণময়ী– উনি কি করে জানলেন?
সতীশ– তাতো বলতে পারবো না হয়ত বা হারানদা বলেছিলেন।
কিরণময়ী– হু, অভুক্ত প্রথম খেতে পেয়েছিল আর তা পরে হলো নেশা।