দ্বিতীয় অংক
কিরণময়ী, অঘোরময়ী, হারান
অঘোরময়ী– বৌমা, ও বৌমা…… ও কিরণময়ী, বলি ইদিকে এসো
কিরণময়ী–ডাকছিলে। মা……
অঘোরময়ী–এ কি! এখনো চুল বাঁধো নি, গা ধোও নি , ওদিকে সন্ধ্যা নেমে এলো যে…..
কিরণময়ী— কোথায় সন্ধ্যা মা, সূর্য ঢলে পড়তে অনেক দেরী মা।
আমি রান্না ঘরের কাজ সেরে নি।
অঘোরময়ী— রান্নাঘরের কাজ পরে করলেও চলবে, একটু পরে ডাক্তার আসবে হারাণকে দেখতে, সে কথা কি মনে আছে?
কিরণময়ী– কেন মনে থাকবে না মা….তোমার ছেলে যে শয্যাশায়ী, সর্বদা বিছানায় কাতরাচ্ছেন,কাণে শুনতে পাচ্ছি, চোখে দেখতে পাচ্ছি, তুমি বরং ডাক্তারের কথা না ভেবে তোমার ছেলের কাছে গিয়ে বসো।
অঘোরময়ী– আ হা…আবাগীর বেটি,আমাকে হুকুম দেয়। আমি হলাম গিয়ে অঘোরময়ী, হারাণের মা– ….মরণকালে হারাণ আমার একটু বৌয়ের হাতের সেবা পায় না।
এমনই হারাণের কপাল, নাহলে এমনটি হয়….ঘরে, অলক্ষ্মী।
কিরণময়ী—কি বললে মা….আমি
অলক্ষ্মী…….এই অলক্ষ্মীই তোমার ও তোমার ছেলের জন্য রাতের সাবু জ্বাল দিচ্ছে।
আর তুমি এতো অস্থির হচ্ছো কেন মা?
অঘোরময়ী— কি আমি অস্থির হচ্ছি?
কিরণময়ী– হ্যাঁ। নয়ত কি? আমার
গা- ধোওয়া, আমার চুল বাঁধা , সন্ধ্যা দেবার এতো তাড়া…… আমার এতো পরিপাটির দরকার কি?
তা কি তোমার ছেলের জন্য, না আর কারোর জন্য?
অঘোরময়ী— তোর মতো ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ বৌ আর দেখি নি গো…..
আবাগীর বেটি, তুই মরিস না কেন?
নষ্টা মেয়েছেলে !!!
কিরণময়ী– হা হা হা …… আমি মরে গেলে, তোমার ছেলের চিকিৎসে, তোমাদের দুবেলা খাবার কি করে যোগাড় হবে মা?……ভেবে দেখেছ একবার, এই নস্টা মেয়েছেলে আজ না থাকলে……
অঘোরময়ী– দূর হ সামনে থেকে…..
মুখরা, অসতী…. উঃ রূপ ধুয়ে জল খাস….. আবার আমার খাবার খোঁটা দিস্ !
কিরণময়ী– তা সে সত্যি কথা গায়ে লাগলে আর আমি কি করব মা!!!
অঘোরময়ী– আমার হারাণের কপাল….. উঃ, রূপের গরব……তোর রূপ হারাণ ফিরেও দেখে না….
কিরণময়ী— ঠিক বলেছ মা….তোমার ছেলের সাধ্য কি যে আমার রূপের পরখ করবে?
অঘোরময়ী— কি এতোবড় কথা?
কিরণময়ী– মা সত্যি বলোত……
সাধ করে কেন এই অনাথ অভাগী রূপসীকে ঘরে এনেছিলে ?
কোন্ আশায়? সে কি তোমার অক্ষম ছেলের মৃত সঞ্জীবনী হয়ে পুর্নজীবন দেবার জন্য???
অঘোরময়ী— চুপ কর, অলপ্পেয়ে, বাজা, কুলটা, ঢলানি মেয়েমানুষ, তোকে দেখলেও ঘেন্না….দূর হ, সামনে থেকে–
কিরণময়ী– হা হা হা, তা বটে, সত্যিই ঘেন্না হয় বুঝি—
অঘোরময়ী– দূর হ, দূর হ…..
কিরণময়ী— হ্যাঁ মা, দূর আমি হচ্ছি ঠিকই, ডেকেছিলে, তাই এসেছিলাম।
যাচ্ছি, তবে ঐ আবার রান্না ঘরেই।
নতুবা রাতে তোমরা খাবে কি মা?
হারাণ– মা, ও মা… মা ইদিকে একবার এসো না, মা।
অঘোরময়ী— হ্যাঁ, এই যাই….উঃ, আর পারি না।
……………………………………………..
অঘোরময়ী— বাবা হারাণ, কেমন আছিস বাপ…… হাপের ব্যথা কমেছে?
হারাণ– মা, আমার কাছে একটু বসো, কথা আছে।
অঘোরময়ী— হ্যাঁ, বসি, একটু কি জল খাবি? না, মধু দিয়ে একটু মকরধ্বজ মেরে দেবো?
হারাণ— আহা, বলছি ত কিছু দরকার নেই ।
অঘোরময়ী– হ্যাঁ, তা কি বলবি বল?হাতপাখাটা….. আবার রাখলো কোথায়, ঐ দ্যাখো, ঐ দেয়ালে লোটকে রেখেছে…
মাথায় একটু বাতাস করি বাবা?
হারাণ– না, না,না— বাতাস করতে হবে না, আমার শীত করে….. ওঃ, কি কষ্ট!!! আঃ….উঃ, শোন মা, তোমার উপিনকে মনে আছে ? তাকে আমি পত্র দিয়েছি, এখানে আসতে।
অঘোরময়ী– ও, তাই, তো কোন্ উপিন?
হারাণ– আঃ, উপিন….উপিন, মনে নেই?
সেই যে নোয়াখালী, বাবা যে সরকারী স্কুলে পড়াতেন, উপিনও পড়তো?
অঘোরময়ী— ও….. হ্যাঁ, হ্যাঁ …. উপিন,
সে তো প্রায় দশ বারো বছর আগের কথা–
হারাণ– নোয়াখালীতে বাবা উপিনদাকে বাড়িতে গিয়েও পড়াতেন, আমিও যেতাম।
অঘোরময়ী– হ্যাঁ, তোরা দুটিতে একসঙ্গে পড়তিস তোর বাবার কাছে, দুটিতে তখন খুব ভাব ছিল, তো, হারাণ, উপিনকে কেন আসতে লিখেছিস, আর সে আছে কোথায়?
হারাণ– তারা ত এখন নোয়াখালী আছে মা, উপিন এখন মস্ত উকিল, আর তার শ্বশুরমশাই ত টাকার কুমীর, খুব অবস্থা ভালো…..
অঘোরময়ী– পয়মন্ত বউ ত ভাগ্যের কথা, আহা আর তোর যা কপাল….
হারাণ– থাক মা, শোনো, বলছিলাম, উপিনই এখন বাড়ির কর্তা। পিতা বুড়ো হয়েছেন, বড়ো ভাই বিবাহ করেন নি….আর বিধবা বড়োদিদি সংসার দেখেন।
অঘোরময়ী— তা ভালো, কিন্তু হারাণ বাপ, তো তাকে আসতে লিখলে কেন রে, সে এসে কি করবে?
হারাণ– মা, আমার শরীরের যা অবস্থা , আজ আছি, কাল কি থাকবো!! তাই ভাবছি, তোমার একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে ভালো হয়।
অঘোরময়ী— হারাণ রে, কি যে বলিস…
হারাণ– না, তখন কোথায় থাকবে, কি হবে তখন, এইসব ভাবি আর কি।
উপিন উকিল মানুষ, একটা চিন্তাভাবনা করছি ….
অঘোরময়ী– সে কথা ত আমিও ভাবি বাবা, মা হয়েও আজ নিজের পেটের ভাবনার বড়ো, এরপর এই পোঁড়ো বাড়িতে ডাক্তার ত আর আসবে না….আর কি বা বলবো……যে কটা দিন বেঁচে আছিস,ডাক্তার আসে, খাবার জোটে, এরপর…..এমন বউ কপালে এলো….তার ত ভাবনা নেই।
হারাণ– মা মা, তুমি চিন্তা করো না, সেজন্যই উপিনকে আসতে বলেছি, একটা ব্যবস্থা তোমার হবে মা।
অঘোরময়ী– হলেই ভালো। এমন বউ, রূপের গরমেই গেলো…..তুই না থাকলে এ বউ কি আর ঘরে থাকবে, আমি কোথায় যাবো রে হারাণ…..
হারাণ– আঃ। বলছি ত উপিন আসুক, সব ব্যবস্থা হবে।
অঘোরময়ী— (কান্না)…..দেখি, তিনি আবার কি করছেন, এদিকে ডাক্তার আসার সময় হলো, সে বোধ কি আছে আবাগীর বেটির। রূপের দেমাকেই গেলো…..
হারাণ– আঃ, আবার কাঁদছ কেন?
বলছি ত…….এই বসত বাড়ি, ভাঙা হলেও ত মূল্য আছে, আর কিছু কোম্পানীর কাগজও আছে, তোমার ব্যবস্থা একটা হবে। এখন উপিন এলে উপায়….
অঘোরময়ী– আর তোর কপাল , বাবা,
এমন বউ ঘরে, কোনদিন ছেলের আমার সুখ হলো না, আবাগীর বেটি…
হারাণ–থাক্ ওসব কথা মা, আমার সময় হয়ে এসেছে। উপিনকে সব বোঝাতে পারলে, লেখাপড়া একটা হলেই শান্তিমতো যেতে পারি…..
অঘোরময়ী– হাঁফাচ্ছিস বাবা , আঃ বড়ো কষ্ট তোর…. থাক্ আর কথায় কাজ নেই….বাতাস করি, একটু ঘুমো।