নবম অংক
অঘোরময়ী, উপেন্দ্র, কিরণময়ী, দিবাকর
কিরণময়ী– ঠাকুরপো। ওমা। এই সকালেই কোথা থেকে বেড়িয়ে ফিরলে, জলখাবার খাবে ত, হাতে তোমার ওটা কি কাগজ।
দিবাকর– এটা ” সূর্যোদয়”- পড়বে?
কিরণময়ী– এখন ত কাজ অনেক, তুমি এক কাজ করো আমার বিছানার বালিশের তলে রেখে দাও। দুপুরে পড়ব।
ঐ কাগজ কি কিনলে? বিশেষ কিছু আছে?
দিবাকর– হু, আসলে ” চন্দ্রদয়ে” আমার একটা লেখা বেড়িয়েছিল তার সম্বন্ধে মানে সমালোচনা।
কিরণময়ী– হু। লুকিয়ে লিখেছ প্রেমের গল্প বুঝি?
দিবাকর– বাঃ, লুকিয়ে কেন হবে। তাহলে কাগজে দিলাম কেন?
কিরণময়ী– তবে আমার কাছে বুঝি লুকোন।
দিবাকর– যাও, তোমার সব তাতেই ঠাট্টা।
কিরণময়ী– সম্পর্কই যে ঠাট্টার ভাই। তা ছাড়া কি নিয়েই বা বাঁচব। আচ্ছা দুপুরে পড়ে তোমার সাথে আলোচনা করব কেমন?
…………………………………………..
কিরণময়ী– এই যে ঠাকুরপো, কি, ঘুমুচ্ছ, না , স্বপ্নের নায়িকাকে নিয়ে কথা বলছ।
দিবাকর- না, বৌদি, জেগে আছি। এসো।
কিরণময়ী– আমায় সেদিন গুরুদেব বলে মেনে নিয়েছিলে না, লেখা শিক্ষার গুরুদেব।
দিবাকর— হু তাইত, তুমি বলো আমি লিখব।
কিরণময়ী– আগে তোমার লেখা দেখাও, ” বিষের ছুড়ি” চন্দ্রোদয়ে যে বেড়িয়েছে।
দিবাকর– ও সেটা দেবো, আচ্ছা , এখন ত আমার এখানে নেই। আর তুমি রোজ রোজ আমার কথা এতো শুনতে চাও কেন বলোত?
কিরণময়ী– ইচ্ছে করে ভাই, তুমি যাকে ভালবাসো তার কথা শুনতে মন চায় না।
দিবাকর– আমাকে? আমার কেউ নেই, বৌঠান।
কিরণময়ী– ইস্ ওমনি লজ্জায় কান লাল হলো ত।
দিবাকর– আচ্ছা, বৌঠান তুমি চোখ বুজলেই কি তোমার স্বামীর মুখ দেখো?
কিরণময়ী– যিনি আমার যথার্থ স্বামী, তিনি আমার অন্তরে আছেন , চোখ বুজে তাকে দেখতে পাই।
তার সাথে মিলিত হতেও চাই।
দিবাকর– তা কি করে সম্ভব, তিনি এখন পরপারে।
কিরণময়ী– সম্ভব, আমি ত যেতে চাই, যদি তিনিও চান, তিনি জীবিত, এ পাড়েই আছেন।
দিবাকর– মানে?
কিরণময়ী– বুঝতে পারছ না তো। মন থাকলে,আর একটু ভাবলেই পাবে।
দিবাকর– সে কেমন !!!
কিরণময়ী– আমিও চলে যেতাম যদি তারও মত থাকত।
দিবাকর– আমার কেমন লাগছে… বৌঠান, সত্যি বলছ?
কিরণময়ী–সত্যি নয়ত কি?
দিবাকর– সে রাজী হলেই তুমিও রাজী।
কিরণময়ী– হু, এতদিন ধরে যা শেখালুম, সবই ব্যর্থ, নিজের বুকে হাত রেখে একটু ভাবো ত, খুঁজে পাও কিনা উত্তর।
অঘোরময়ী– বৌমা, তোমরা কি সব কানের মাথা খেয়েছ, কখন থেকে নীচে কড়া নাড়ছে।
কিরণময়ী– কেন মা, আমাকেই বার বার যেতে হবে , নীচে ত ঝি আছেই সে খুলে দিতে পারে।
অঘোরময়ী– সে তো বাসন ধুচ্ছে। ঐ খুলেছে, হুঃ — আবার তিনি দেবরের ঘরে ঢুকলেন …..
ওমা, উপিন এসেছিস , বাবা। আয় আয় বোস এখানে।
উপেন– মক্কেলের ইচ্ছায় আসা। কালই ফিরে যাবো, তো ভাবলাম খবর নিয়ে যাই।
অঘোরময়ী— তা বেশ করেছিস বাবা। ওই ত গেলে কোথায়, একখানা মাদুর পেতে দাও বৌমা, উপিন কি দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি গো।
কিরণময়ী– কেমন আছেন , ঠাকুরপো, বৌ ভালো আছে। খবর না দিয়ে এমন হঠাৎ যে।
উপেন– দিবাকরের খবর কি বলুন ত? না দেয় চিঠিপত্র, না দেয় খবর।
বেড়িয়েছে বুঝি?
কিরণময়ী– মাথা ধরেছে বলে শুয়েছেন, কি জানি. বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
অঘোরময়ী– এই ত তুমি তার ঘর থেকে বেরুলে বৌমা, সে ঘুমুচ্ছে কিনা তাও জানো না?
কিরণময়ী– না জানি নে।
উপেন– দিবাকর, দিবাকর ঘুমিয়েছিস্?
এই ত উঠে এসেছিস্ ।
দিবাকর– কখন এলে ছোড়দা?
উপেন– সকালে। তা তোর মাথা ধরেছে নাকি?
দিবাকর — সামান্য
অঘোরময়ী– মাথা ধরবে না বাছা, প্রথম দিকে তবু যা হোক একটু ঘুরে ফিরে আসতে, এখন একেবারে ঘরের বার হও না।
উপেন–চিঠিপত্র লেখাও বন্ধ করেছিস্ । কোন্ কলেজে ভর্তি হলি ?
দিবাকর– কলেজ খুললেই ভর্তি হবো। এখনও হইনি।
অঘোরময়ী– কি করে খবর জানাবে উপিন?
দুজনে কি যে রাতদিন ফষ্টি নষ্টি, হাসি- তামাসা, ফুস্ ফুস্ গল্প গুজব হয় তা ওরাই জানে।
উপেন– আজ ষোল সতেরো দিনের বেশি সমস্ত কলেজ খুলে গিয়েছে– তুই তাও বুঝি জানিস নে?
অঘোরময়ী– আমি ত বার বার বলি, বৌমা, ও পরের ছেলে, লেখাপড়া করতে এসেছে, ওর সঙ্গে অষ্ট প্রহর অত কেন?
আর হলোই বা দেওর– বৌ মানুষের সোমত্থ ছেলের কাছে একটু সরম-ভরম থাকবে না? আমি দিব্যি করে বলতে পারি উপিন, সমস্ত দোষ ঐ হতভাগীর। দেখলে। তেজ মেরে কেমন চলে গেল।
কিরণময়ী–আমি রান্নাঘরে মা, পালিও না জেনো, ঠাকুরপো। আমার খানকতক লুচি ভেজে আনতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
মা। ঝিকে একবার দোকানে পাঠাব ঠাকুরপোর জন্য একটু মিষ্টি আনবে?
……………………………………………
কিরণময়ী– আমার ঘরে তোমার খাবার দিয়েছি ঠাকুরপো। এসো
…………………………………………….
কিরণময়ী– আজ এই দিয়েই খাও ঠাকুরপো, এর বেশি কিছু করতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।
উপেন– ( থালা ঠেলে দিয়ে)বৌঠান, এখানে আমি খেতে আসিনি। এসেছি আপনার সাথে নিভৃতে দুটো কথা কইতে ।
কিরণময়ী– এ তো আমার বহু ভাগ্য, কিন্তু খাবে না, কেন?
উপেন– আপনার ছোওয়া খাবার খেতে আমার ঘৃণা বোধ হচ্ছে।
কিরণময়ী– ও, তোমার রাগ ঘৃণা সব ঠাকুরপো দিবাকরের জন্য ত?
কিন্তু বিধবার কাছে। সেও যা, তুমিও তাই।
উপেন– আপনার সাথে কথা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে।
কিরণময়ী– আচ্ছা ঠাকুরপোর সাথে আমার কি সম্পর্ক তাত তোমার অনুমান মাত্র। কিন্তু যেদিন নিজের মুখে তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছিলাম, সেদিন ত ঘৃণায় এমন খাবার থালা ঠেলে দাও নি?
উপেন– কি বলতে চাও?
কিরণময়ী– বলি, এই যে, নিজের বেলা বুঝি, কুলটার হাতের মিষ্টান্নে ভালবাসার মধু বেশি মিঠে লাগে, ঠাকুরপো?
উপেন– বৌঠান, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, আজও আমার সুরবালা বেঁচে আছে।
কিরণময়ী– তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
উপেন– আমার আসে যায়, কারণ সে বলে, আমাকে যে একবার ভালবাসবে, সে আর কারোকে ভালবাসতে পারে না। এই আপনি আমায় ভালবাসেন, বলেছিলেন না?
আর আমি সেই ভরসাতেই দিবাকরকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
ছিঃ, ছি ছি। এই আপনার পরিচয়?
কিরণময়ী– (কান্না) বিশ্বাস করো বিশ্বাস করো ঠাকুরপো, সব মিথ্যে, সব আমার অভিমান। অভিনয়, ক্ষোভের কথা। সব মিথ্যে, তুমি যা ভাবছ সে সম্পর্ক নয় দিবাকরের সাথে।
আমি তোমাকে ছাড়া আর কারোকে–, কি বলব, এ আমার রাগ আর অভিমান, বিশ্বাস করো।
উপেন– বিশ্বাস! ভালো আপনি কারোকেই বাসতে পারবেন না। শুধু সর্বনাশ করতেই পারবেন। ছি ছি। শেষে দিবাটাকে…..
অঘোরময়ী– খাওয়া হলো উপিন–
উপেন– না। মাসিমা, খেতে পারলাম না, অসুখ করেছে।
অঘোরময়ী– অসুখ, তাহলে আজ এখানেই থেকে যাও।
উপেন — না না, মাসিমা, আমায় যেতেই হবে। কাজ আছে আর তা ছাড়া দিবাকর কেও সাথে নিয়ে যাবো। দিবাকরকে বলুন তৈরি হয়ে নিতে।
অঘোরময়ী– ওমা, সেকি কথা। দিবাকর কেন যাবে? তা ছাড়া আজ অমাবস্যা , এই রাতে দিবাকরকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কাল সকালে নিয়ে যেয়ো। আমার এ কথাটা রাখো বাবা উপিন।
উপেন– বেশ তাই হবে , আজ আসি মাসিমা। কিন্তু কাল সকালেই আসব। দিবাকরকে বলবেন , তৈরি হয়ে থাকতে।