Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরদিন প্ৰাতঃকালে আমরা স্তম্ভ-অভিমুখে যাত্ৰা করিলাম, মোড়ল স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমাদের সঙ্গে চলিল।

গ্রামের সীমানা পার হইয়াই পাহাড় ধাপে ধাপে উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্থানে স্থানে চড়াই ত দুরূহ যে হস্তপদের সাহায্যে অতি কষ্টে আরোহণ করিতে হয়। পদে পদে পা ফস্কাইয়া নিম্নে গড়াইয়া পড়িবার ভয়।

ভিক্ষুর মুখে কথা নাই; তাঁহার ক্ষীণ শরীরে শক্তিরও যেন সীমা নাই। সর্বাগ্রে তিনি চলিয়াছেন, আমরা তাঁহার পশ্চাতে কোনওক্রমে উঠিতেছি। তিনি যেন তাঁহার অদম্য উৎসাহের রজ্জু দিয়া আমাদের টানিয়া লইয়া চলিয়াছেন।

তবু পথে দু-বার বিশ্রাম করিতে হইল। আমার সঙ্গে একটা বাইনোকুলার ছিল, তাহারই সাহায্যে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। বহু নিম্নে ক্ষুদ্র গ্রামটি খেলাঘরের মতো দেখা যাইতেছে, আর চারিদিকে প্রাণহীন নিঃসঙ্গ পাহাড়।

অবশেষে পাঁচ ঘণ্টারও অধিক কাল হাড়ভাঙা চড়াই উত্তীর্ণ হইয়া আমাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছিলাম। কিছুপূর্ব হইতেই একটা চাপা গম গম শব্দ কানে আসিতেছিল—যেন বহুদূরে দুন্দুভি বাজিতেছে। মোড়ল বলিল, উহাই উপলা নদীর প্রপাতের শব্দ।

প্রপাতের কিনারায় গিয়া যখন দাঁড়াইলাম তখন সম্মুখের অপরূপ দৃশ্য যেন ক্ষণকালের জন্য আমাদের নিষ্পন্দ করিয়া দিল। আমরা যেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম তাহার প্রায় পঞ্চাশ হাত ঊর্ধ্বে সংকীর্ণ প্রণালী-পথে উপলার ফেনকেশর জলরাশি উগ্র আবেগভরে শূন্যে লাফাইয়া পডিয়াছে; তারপর রামধনুর মতো বঙ্কিম রেখায় দুই শত হাত নীচে পতিত হইয়া উচ্ছঙ্খল উন্মাদনায় তীব্র একটা আবর্ত সৃষ্টি করিয়া বহিয়া গিয়াছে। ফুটন্ত কটাহ হইতে যেমন বাষ্প উখিত হয়, তেমনই তাহার শিলাহত চুৰ্ণ শীকরকণা উঠিয়া আসিয়া আমাদের মুখে লাগিতেছে।

এখানে দুই তীরের মধ্যস্থিত খাদ প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া-মনে হয় যেন পাহাড় এই স্থানে বিদীর্ণ হইয়া অবরুদ্ধ উপলার বহির্গমনের পথ মুক্ত করিয়া দিয়াছে। এই দুর্লঙ্ঘ খাদ পার হইবার জন্য বহুযুগ পূর্বে দুর্বল মানুষ যে ক্ষীণ সেতু নির্মাণ করিয়াছিল। তাহা দেখিলে ভয় হয়। দুইটি লোহার শিকল—একটি উপরে, অন্যটি নীচে-সমান্তরালভাবে এ-তীর হইতে ও-তীরে চলিয়া গিয়াছে। ইহাই সেতু। গর্জমান প্রপাতের পটভূমিকার সম্মুখে এই শীর্ণ মরিচা-ধরা শিকল দুটি দেখিয়া মনে হয় যেন মাকড়সার তন্তুর চেয়েও ইহারা ভঙ্গুর, একটু জোরে বাতাস লাগিলেই ছিঁড়িয়া দ্বিখণ্ডিত হইয়া যাইবে।

কিন্তু ওপরের কথা এখনও বলি নাই। ওপরের দৃশ্যের প্রকৃতি এপার হইতে সম্পূর্ণ পৃথক এবং এই ধাতুগত বিভিন্নতার জন্যই বোধ করি প্রকৃতিদেবী। ইহাদের পৃথক করিয়া দিয়াছেন। ওপারে দৃষ্টি পড়িলে সহসা মনে হয় যেন অসংখ্য মর্মর-নির্মিত গম্বুজে স্থানটি পরিপূর্ণ। ছোট-বড়-মাঝারি বর্তুলাকৃতি শ্বেতপাথরের ঢিবি যত দূর দৃষ্টি যায় ইতস্তত ছড়ানো রহিয়াছে। যাঁহারা সারনাথের ধমেক স্তুপ দেখিয়াছেন তাঁহারা ইহাদের আকৃতি কতকটা অনুমান করিতে পরিবেন। এই প্রকৃতি-নির্মিত স্তুপগুলিকে পশ্চাতে রাখিয়া গভীর খাদের ঠিক কিনারায় একটি নিটোল সুন্দর স্তম্ভ মিনারের মতো ঋজুরেখায় ঊর্ধ্বে উঠিয়া গিয়াছে। দ্বিপ্রহরের সূর্যকিরণে তাহার। পাষাণ গাত্র ঝকমক করিতেছে। দেখিয়া সন্দেহ হয়, ময়দানবের মতো কোন মায়াশিল্পীই বুঝি অতি যত্নে এই অভ্ৰভেদী দেব-স্তম্ভ নির্মাণ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে।

পৃথিবীর শৈশবকালে প্রকৃতি যখন আপন মনে খেলাঘর তৈয়ার করিত, ইহা সেই সময়ের সৃষ্টি। হয়তো মানুষ-শিল্পীর হাতও ইহাতে কিছু আছে। বাইনোকুলার চোখে দিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম, কিন্তু ইহার বহিরাঙ্গে মানুষের হাতের চিহ্ন কিছু চোখে পড়িল না। স্তম্ভটা যে ফাঁপা তাহাও বাহির হইতে দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই; কেবল স্তম্ভের শীর্ষদেশে একটি ক্ষুদ্র রন্ধ চোখে পড়িল—রন্ধটি চতুষ্কোণ, বোধ করি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে এক হাতের বেশি হইবে না। সূর্যকিরণ সেই পথে ভিতরে প্রবেশ করিতেছে। ইহাই নিশ্চয় মন্ত্রোক্ত রন্ধ্র।

মগ্ন হইয়া এই দৃশ্য দেখিতেছিলাম। এতক্ষণে পাশে দৃষ্টি পড়িতে দেখিলাম, ভিক্ষু ভূমির উপর। সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া বুদ্ধস্তম্ভকে প্ৰণাম করিতেছেন।

ভিক্ষু অভিরাম আমাদের নিষেধ শুনিলেন না, একাকী সেই শিকলের সেতু ধরিয়া ওপারে গেলেন। আমরা তিন জন এপারে রহিলাম। পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, এবার বুঝি শিকল ছিঁড়িয়া গেল, কিন্তু ভিক্ষুর শরীর কৃশ ও লঘু, শিকল ছিড়িল না।

ওপারে পৌঁছিয়া ভিক্ষু হাত নাড়িয়া আমাদের আশ্বাস জানাইলেন, তারপর স্তম্ভের দিকে চলিলেন। স্তম্ভ একবার পরিক্রমণ করিয়া আবার হাত তুলিয়া চিৎকার করিয়া কি বলিলেন, প্ৰপাতের গর্জনে শুনিতে পাইলাম না। মনে হইল তিনি স্তম্ভের দ্বার খোলা পাইয়াছেন।

তারপর তিনি স্তম্ভের অন্তরালে চলিয়া গেলেন, আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। চোখে বাইনোকুলার লোগাইয়া বসিয়া রহিলাম। মানসচক্ষে দেখিতে লাগিলাম, ভিক্ষু চক্রাকৃতি অন্ধকার সোপান বাহিয়া ধীরে ধীরে উঠিতেছেন; কম্পিত অধরা হইতে হয়তো অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত হইতেছে—তথাগত, তমসো মা জ্যোতির্গময়–

সেই গোশীর্ষ চন্দনকাষ্ঠের মূর্তি কি এখনও আছে? ভিক্ষু তোহা দেখিতে পাইবেন? আমি দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু সেজন্য ক্ষোভ নাই। যদি সে-মূর্তি থাকে। পরে লোকজন আনিয়া উহা উদ্ধার করিতে পারিব। দেশময় একটা মহা হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে।

এইরূপ চিন্তায় দশ মিনিট কাটিল।

তারপর সব ওলট-পালট হইয়া গেল। হিমালয় যেন সহসা পাগল হইয়া গেল। মাটি টালিতে লাগিল; ভুগৰ্ভ হইতে একটা অবরুদ্ধ গোঙানি যেন মরণাহত দৈত্যের আর্তনাদের মতো বাহির ধ্রুয়াসিতে লাগিল। শিকলের সেতু ছিঁড়িয়া গিয়া চাবুকের মতো দুই তীরে আছড়াইয়া পড়িল।

১লা মাঘের ভূমিকম্পের বর্ণনা আর দিব না। কেবল এইটুকুই জানাইবা যে ভারতবর্ষের সমতলভূমিতে যাঁহারা এই ভূমিকম্প প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহারা সেই ভুমিকম্পের জন্মকেন্দ্রের অবস্থা কল্পনা করিতেও পরিবেন না।

আমরা মারি নাই কেন জানি না। বোধ করি পরমায়ু ছিল বলিয়াই মারি নাই। নৃত্যেন্মাদ মাটি—তাহারই উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া ছিলাম। চোখের সম্মুখে বুদ্ধস্তম্ভ বাত্যাবিপন্ন মেহঞ্জের মাঞ্চলের মতো দুলতেছিল। চিন্তাহীন জড়বৎ মন লইয়া সেই দিকে তাকাইয়া ছিলাম।

মনের উপর সহসা চিন্তার ছায়া পড়িল—

ভিক্ষ! ভিক্ষুর কি হইবে?

ভূমিকম্পের বেগ একটু মন্দীভূত হইল। বোধ হইল যেন থামিয়া আসিতেছে। বাইনোকুলারটা হাতেই মুষ্টিবদ্ধ ছিল, তুলিয়া চোখে দিলাম। পলায়নের চেষ্টা বৃথা, তাই সে-চেষ্টা করিলাম না।

আবার দ্বিগুণ বেগে ভূমিকম্প আরম্ভ হইল; যেন ক্ষণিক শিথিলতার জন্য অনুতপ্ত হইয়া শতগুণ হিংস্ৰ হইয়া উঠিয়াছে, এবার পৃথিবী ধ্বংস না করিয়া ছাড়িবে না।

কিন্তু ভিক্ষু—?

স্তম্ভ এতক্ষণ মাস্তুলের মতো দুলিতেছিল, আর সহ্য করিতে পারিল না; মূলের নিকট হইতে দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেল। অতল খাদের প্রান্তে ক্ষণকালের জন্য টলমল করিল, তারপর মরণোন্মত্তের মতো খাদের মধ্যে ঝাঁপ দিল। গভীর নিম্নে একটা প্ৰকাণ্ড বাম্পোচ্ছাস উঠিয়া স্তম্ভকে আমার চক্ষু হইতে আড়াল করিয়া দিল।

দেখিতে পাইলাম। বাইনোকুলারটা অবশে চোখের সম্মুখে ধরিয়া রাখিয়াছিলাম। দেখিলাম, ভিক্ষু রন্ধ্রপথে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার মুখে রৌদ্র পড়িয়াছে। অনির্বচনীয় আনন্দে সে মুখ উদ্ভাসিত। চারিদিকে যে প্ৰলয়ঙ্কর ব্যাপার। চলিয়াছে সেদিকে তাঁহার চেতনা নাই।

আর তাঁহাকে দেখিলাম না; মরণোন্মত্ত স্তম্ভ খাদে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

একাকী গৃহে ফিরিয়া আসিয়াছি।

তারপর কয়েক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, কিন্তু এ কাহিনী কাহাকেও বলিতে পারি নাই। ভিক্ষুর কথা স্মরণ হইলেই মনটা অপরিসীম বেদনায় পীড়িত হইয়া উঠে।

তবু এই ভাবিয়া মনে সান্তুনা পাই যে, তাঁহার জীবনের চরম অভীপ্সা অপূর্ণ নাই। সেই স্তম্ভশীর্ষে তিনি তথ্যগতের কিরূপ নয়নাভিরাম মূর্তি দেখিয়াছিলেন জানি না, কিন্তু তাঁহার জীবনব্যাপী অনুসন্ধান সফল হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। মৃত্যুমুহূর্তে তাঁহার মুখের উদ্ভাসিত আনন্দ আজও আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে।

২৮ আষাঢ় ১৩৪৩

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress