দৈত্য-নির্মিত স্তম্ভ
এই আখ্যায়িকা যদি আমাদের হিমাচল-অভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনী হইত তাহা হইলে বোধ করি নানা বিচিত্ৰ ঘটনার বর্ণনা করিয়া পাঠককে চমৎকৃত করিয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু এ-গল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে অবাস্তর কথার স্থান নাই। দৈত্য-নির্মিত স্তম্ভ অন্বেষণের পরিসমাপ্তিটুকু বর্ণনা করিয়াই আমাকে নিবৃত্ত হইতে হইবে।
কলিকাতা হইতে যাত্রা শুরু করিবার দুই সপ্তাহ পরে একদিন অপরাত্নে যে ক্ষুদ্র জনপদটিতে পৌঁছিলাম তাহা মনুষ্য-লোকালয় হইতে এত ঊর্ধ্বে ও বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত যে হিমালয়-কুক্ষিস্থিত। ঈগল পাখির বাসা বলিয়া ভ্রম হয়। তখনও বরফের এলাকায় আসিয়া পৌঁছাই নাই; কিন্তু সম্মুখেই হিমাদ্রির তুষার শুভ্ৰ দেহ আকাশের একটা দিক আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। আশেপাশে পিছনে চারিদিকেই নগ্ন পাহাড়, পায়ের তলায় পাহাড়ী কাঁকর ও উপলখণ্ড। এই উপলাকীর্ণ কঠিন ভূমি চিরিয়া তন্ত্রী উপলা নদী খরধারে নিম্নাভিমুখে ছুটিয়া চলিয়াছে। আকাশে বাতাসে একটা জমাট শীতলতা।
আমরা তিন জন—আমি, ভিক্ষু অভিরাম ও একজন ভুটিয়া পদপ্রদর্শক—গ্রামের নিকটবর্তী হইতেই গ্রামের সমস্ত স্ত্রীপুরুষ বালকবালিকা আসিয়া আমাদের ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বহির্জগতের মানুষ এখানে কখনও আসে না; ইহারা সুবর্তুল চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমাদের নিরীক্ষণ করিতে क्नांकिक।
চেহারা দেখিয়া মনে হইল—ইহারা লেপচা কিংবা ভূটানী। আর্য রক্তের সংমিশ্রণও সামান্য আছে; দুই-একটা খড়েগির মতো তীক্ষ্ণ নাক চোখে পড়িল।
এইরূপ খড়গ-নাসিক একজন প্রৌঢ়াগোছের লোক আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিয়া নিজ
আমরা সরলভাবে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিলম। শুনিয়া লোকটির চোখে মুখে প্রথমে বিস্ময়, তারপর প্রবল কৌতূহল ফুটিয়া উঠিল। সে আমাদের আহ্বান করিয়া গ্রামে লইয়া চলিল।
মিছিল করিয়া আমরা অগ্রসর হইলাম। অগ্ৰে মোড়ল, তাহার পিছনে আমরা তিন জন ও সর্বশেষে গ্রামের আবালবৃদ্ধ নরনারী।
একটি কুটিরের মধ্যে লইয়া গিয়া মোড়ল আমাদের বসাইল, আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুৎপীড়িত দেখিয়া আহার্য দ্রব্য আনিয়া অতিথিসৎকার করিল। অতঃপর তৃপ্ত ও বিশ্রান্ত হইয়া দোভাষী ভুটিয়া মারফৎ বাক্যালাপ আরম্ভ করিলম। সূর্য তখন পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে; হিমালয়ের সুদীর্ঘ সন্ধ্যা যেন স্বচ্ছ বাতাসে অলক্ষিত কুঙ্কুমবৃষ্টি আরম্ভ করিয়াছে।
মোড়ল বলিল, গ্রাম হইতে চার ক্রোশ উত্তরে উপলা নদীর প্রপাত-ঐ প্রপাত হইতেই নদী আরম্ভ। ঐ স্থান অতিশয় দুৰ্গম ও দুরারোহ; উপলার অপর পারে প্রপাতের ঠিক মুখের উপর একটি স্তম্ভের মতো পর্বতশৃঙ্গ আছে, উহাই বুদ্ধস্তম্ভ নামে খ্যাত। গ্রামবাসীরা প্রতি পূর্ণিমার রাত্ন বুদ্ধস্তম্ভকে উদ্দেশ করিয়া পূজা দিয়া থাকে। কিন্তু সে স্থান দুরধিগম্য বলিয়া সেখানে কেহ যায় না, গ্রামের নিকটে উপলা নদীর স্রোতে পূজা ভাসাইয়া দেয়।
ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করিলেন, উপলা পার হইয়া স্তম্ভের নিকটবর্তী হইবার পথ কোথায়? মোড়ল মাথা নাড়িয়া জানাইল, পথ আছে বটে, কিন্তু তাহা এত বিপজনক যে সে-পথে কেহ পার হইতে সাহস করে না। উপলার প্রপাতের নীচেই একটি প্রাচীন লৌহ-শৃঙ্খলের ঝোলা বা দোদুল্যমান। সেতু দুই তীরকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু তাহা কালক্রমে এত জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে যে তাহার উপর দিয়া মানুষ যাইতে পারে না। অথচ উহাই একমাত্র পথ।
আমাদের গন্তব্য স্থানে যে পৌঁছিয়াছি তাহাতে সন্দেহ ছিল না। তবু নিঃসংশয় হইবার অভিপ্ৰায়ে মোড়লকে জিজ্ঞাসা করিলম, ওই স্তম্ভে কি আছে তাহ কেহ বলিতে পারে কি না। মোড়ল বলিল, কি আছে তাহা কেহ চোখে দেখে নাই, কিন্তু স্মরণাতীত কাল হইতে একটা প্ৰবাদ চলিয়া আসিতেছে যে বুদ্ধদেব স্বয়ং সশরীরে এই স্তম্ভে অবস্থান করিতেছেন, তাঁহার দেহ হইতে নিরস্তর চন্দনের গন্ধ নিৰ্গত হয়। —পাঁচ হাজার বৎসর পরে আবার মৈত্ৰেয়া-রূপ ধারণা করিয়া তিনি এই স্থান হইতে বাহির হইবেন।
ভিক্ষু আমার পানে প্রোজ্জ্বল চক্ষু চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, বুদ্ধদেব সশরীরে এই স্তম্ভে আছেন, তাহার দেহ থেকে চন্দনের গন্ধ নিৰ্গত হয়—প্রবাদের মানে বুঝতে পারছেন? যে-শ্রমণরা বুদ্ধমূর্তি এনেছিল, তারা সম্ভবত ফিরে যেতে পারেনি–এই গ্রামেই হয়তো থেকে গিয়েছিল—
ভিক্ষুর কথা শেষ হইতে পাইল না। এই সময় আমাদের কুটির হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকানি খাইয়া মড়মড় করিয়া উঠিল। আমরা মেঝের উপর বসিয়া ছিলাম, আমাদের নিম্নে মাটির ভিতর দিয়াও একটা কম্পন শিহরিয়া উঠিল। আমিও ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম—ভূমিকম্প।
নিশ্চিন্তমনে মেঝোয় বসিয়া ছিল, আমাদের ত্ৰাস দেখিয়া সে মৃদুহাস্যে জানাইল যে ভয়ের কোনও কারণ নাই; এরূপ ভূমিকম্প এখানে প্রত্যহ চার-পাঁচ বার হইয়া থাকে, এ দেশের নামই ভূমিকম্পের জন্মভূমি।
আমরা অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলাম। ভূমিকম্পের জন্মভূমি! এমন কথা তো কখনও শুনি নাই। —তখনও জানিতাম না কি ভীষণ দুদন্তি সন্তান প্রসব করিবার জন্য সে উদ্যত হইয়া আছে।
ভিক্ষু অভিরাম কিন্তু উত্তেজিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ঠিক! ঠিক! শিলালিপিতে যে এ কথার উল্লেখ আছে—মনে নেই?
শিলালিপিতে ভূমিকম্পের উল্লেখ কোথায় আছে স্মরণ করিতে পারিলাম না; ভিক্ষু তখন ঝোলা হইতে শিলালেখের অনুলিপি বাহির করিয়া উল্লসিত স্বরে কহিলেন, আর সন্দেহ নেই বিভূতিবাবু, আমরা ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। —এই শুনুন। বলিয়া তিনি মূল প্রাকৃতে লিপির সেই অংশ পড়িয়া শুনাইলেন—কথিত আছে যে, অসুর-দেশীয় দৈত্যগণ দেবপ্রিয় ধমাশোকের কালে হিমালয়ের স্পন্দনশীল জঙঘাপ্রদেশে ইহা নির্মাণ করিয়াছিল।
মনে পড়িয়া গেল। স্পন্দনশীল জঙঘাপ্রদেশ কথাটাকে আমি নিরর্থক বাগাড়ম্বর মনে করিয়াছিলাম, উহার মধ্যে যে ভূমিকম্পের ইঙ্গিত নিহিত আছে তাহা ভাবি নাই। বলিলাম, হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন, ও-কথাগুলো আমি ভাল করে লক্ষ্য করিনি। এ জায়গাটা বোধ হয় শিলঙের মতো ভূমিকম্পের রাজ্য—
এই সময় মোড়লের দিকে নজর পড়িল। সে হঠাৎ ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুদ্র তির্যক চক্ষু জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে, ঠোঁট দুইটা যেন কি একটা বলিবার জন্য বিভক্ত হইয়া আছে। তারপর সে আমাদের ধাঁধা লাগাইয়া পরিষ্কার প্রাকৃত ভাষায় বলিয়া উঠিল, শ্রবণ করা। সূর্য যে-সময় উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পদে পদার্পণ করিবেন। সেই সময় বুদ্ধস্তম্ভের রন্ধপথে সূৰ্য্যলোক প্রবেশ করিয়া তথাগতের দিব্যদেহ আলোকিত করিবে, মন্ত্রবলে স্তম্ভের দ্বার খুলিয়া যাইবে। উপর্যুপরি তিন দিন এইরূপ হইবে, তারপর এক বৎসরের জন্য দ্বার বন্ধ হইয়া যাইবে। হে ভক্ত শ্রমণ, যদি বুদ্ধের অলৌকিক মুখচ্ছবি দেখিয়া নিবাণের পথ সুগম করিতে চাও, এ কথা স্মরণ রাখিও। এক নিশ্বাসে এতখানি বলিয়া মোড়ল হাঁপাইতে লাগিল।
তীব্র বিস্ময়ে ভিক্ষু বলিলেন, তুমি-তুমি প্রাকৃত ভাষা জান?
মোড়ল বুঝিতে না পারিয়া মাথা নাড়িল।
তখন ভুটানী সহচরের সাহায্য লইতে হইল। দোভাষী—প্রমুখাৎ মোড়ল জানাইল, ইহা তাহাদের কৌলিক মন্ত্র; পুরুষপরম্পরায় ইহা তাহাদের কণ্ঠস্থ করিতে হয়, কিন্তু মন্ত্রের অর্থ কি তাহা সে জানে না। আজ ভিক্ষুকে ঐ ভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া সে উত্তেজিত হইয়া উহা উচ্চারণ করিয়াছে।
আমরা পরস্পরের মুখের পানে তাকাইলাম।
ভিক্ষু মোড়লকে বলিলেন, তোমার মন্ত্র আর একবার বল।
মোড়ল দ্বিতীয় বার ধীরে ধীরে মন্ত্র আবৃত্তি করিল। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিতে পারিলাম। এ মন্ত্র নয়—বুদ্ধস্তম্ভে প্রবেশ করিবার নির্দেশ। বৎসরের মধ্যে তিন দিন সূযালোকের উত্তাপ র্যন্ত্রপথে স্তম্ভের ভিতরে প্রবেশ করিয়া সম্ভবত কোনও যন্ত্রকে উত্তপ্ত করে, ফলে যন্ত্ৰ-নিয়ন্ত্রিত দ্বার খুলিয়া যায়। প্রাচীন মিশর ও আসীরিয়ায় এইরূপ কলকব্জার সাহায্যে মন্দিরদ্বার খুলিয়া মন্দিরের ভণ্ড পূজারিগণ অনেক বুজরুকি দেখাইত-পুস্তকে পড়িয়াছি স্মরণ হইল। এই স্তম্ভের নিমাতও অসুর—অর্থাৎ আসীরীয় শিল্পী; সুতরাং অনুরূপ কলকব্জার দ্বারা উহার প্রবেশদ্বারের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নয়। যে-শ্রমণগণ বুদ্ধমূর্তি লইয়া এখানে আসিয়াছিল তাহারা নিশ্চয় এ রহস্য জানিত; পাছে ভবিষ্য বংশ ইহা ভুলিয়া যায়। তাই এ মন্ত্র রচনা করিয়া ব্ৰাখিয়া গিয়াছে।
কিন্তু মোড়ল এ মন্ত্র জানিল কিরূপে?
তাহার মুখখানা ভাল করিয়া দেখিলাম। মুখের আদল প্ৰধানত মঙ্গোলীয় ছাঁদের হইলেও নাসিকা, ভ্রূ ও চিবুকের গঠন আৰ্য-লক্ষণযুক্ত। শ্রমণগণ ফিরিয়া যাইতে পারে নাই; তাহাদের দশ জনের মধ্যে কাহারও হয়তো পদস্থলন হইয়াছিল। এই মোড়ল সেই ধৰ্মচ্যুত শ্রমণের অধস্তন পূরুষ-পূর্বপুরুষের ইতিহাস সব ভুলিয়া গিয়াছে, কেবল শূন্যগর্ভ কবচের মতো কৌলিক মন্ত্রটি কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিয়াছে।
চমক ভাঙিয়া স্মরণ হইল বৎসরের মধ্যে মাত্র তিনটি দিন স্তম্ভের দ্বার খোলা থাকে, তারপর বন্ধ হইয়া যায়। সে তিন দিন কবে? কতদিন দ্বার খোলার প্রত্যাশায় বসিয়া থাকিতে হইবে?
ভিক্ষুকে জিজ্ঞাসা করিলম, উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে সূর্য কবে পদার্পণ করবেন?
ভিক্ষু ঝোলা হইতে পাঁজি বাহির করিলেন। প্ৰায় পনর মিনিট গভীর তন্ময়তার সহিত পাঁজি দেখিয়া মুখ তুলিলেন। দেখিলাম তাঁহার অধরোষ্ঠ কাঁপিতেছে, চক্ষু অশ্রুপূৰ্ণ। তিনি বলিলেন, কাল পয়লা মাঘ; সূর্য উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে পদার্পণ করবেন—। কি অলৌকিক সংঘটন! যদি তিন দিন পরে এসে পৌঁছাতুম–তাঁহার কণ্ঠস্বর থরথর করিয়া কাঁপিয়া গেল, অস্ফুট বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন, তথাগত!
কী সর্বগ্রাসী আকাঙক্ষা পরিপূর্ণতার উপান্তে আসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছে, ভাবিয়া আমার দেহও কাঁটা দিয়া উঠিল। মনে মনে বলিলাম, তথাগত, তোমার ভিক্ষুর মনস্কাম যেন ব্যর্থ না হয়।