ধর্মোন্মত্ততা বস্তুটা সংক্রামক
ধর্মোন্মত্ততা বস্তুটা সংক্রামক। আমার মধ্যেও বোধ হয় অজ্ঞাতসারে সঞ্চারিত হইয়াছিল। তাই, উল্লিখিত ঘটনার কয়েক দিন পরে একদিন ফা-হিয়ানের ভ্রমণ-বৃত্তান্তের পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে হঠাৎ এক জায়গায় আসিয়া দৃষ্টি আটকাইয়া গেল; আনন্দ ও উত্তেজনায় একেবারে লাফাইয়া উঠিলাম। ফা-হিয়ান পূর্বেও পড়িয়াছি, কিন্তু এ-জিনিস চোখে ঠেকে নাই কেন?
সেইদিন অপরাহ্নে ভিক্ষু অভিরাম আসিলেন। উত্তেজনা দমন করিয়া বইখানা তাঁহার হাতে দিলাম। তিনি উৎসুকভাবে বলিলেন, কি এ?
তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম।
বৈশালী হইতে দ্বাদশ শত পদ দক্ষিণে বৈশ্যাধিপতি সুদত্ত দক্ষিণাভিমুখী একটি বিহার নিমণি। করিয়াছিলেন। বিহারের বামে ও দক্ষিণে স্বচ্ছ বারিপূর্ণ পুষ্করিণী বহু বৃক্ষ ও নানাবর্ণ পুষ্পে অপূর্ব শোভা ধারণ করে। ইহাই জেতবন-বিহার।
বুদ্ধদেব যখন ত্ৰয়ন্ত্রিাংশ স্বৰ্গে গমন করিয়া তাঁহার মাতৃদেবীর হিতার্থে নব্বই দিবস ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন, তখন প্রসেনজিৎ তাঁহার দর্শনাভিলাষী হইয়া গোশীর্ষ চন্দনকণ্ঠে তাঁহার এক মূর্তি প্ৰস্তুত করিয়া যে-স্থানে তিনি সাধারণত উপবেশন করিতেন তথায় স্থাপন করিলেন। বুদ্ধদেব স্বৰ্গ হইতে প্রত্যাগমন করিলে এই মূর্তি বুদ্ধদেবের সহিত সাক্ষাতের জন্য স্বস্থান পরিত্যাগ করিল। বুদ্ধদেব তখন মূর্তিকে কহিলেন, তুমি স্বস্থানে প্ৰতিগমন কর; আমার নির্বাণ লাভ হইলে তুমি আমার চতুর্বর্গ শিষ্যের নিকটে আদর্শ হইবে। এই বলিলে মূর্তি প্ৰত্যাবর্তন করিল। এই মূর্তিই বুদ্ধদেবের সবাপেক্ষা প্রথম মূর্তি এবং ইহা দৃষ্টেই পরে অন্যান্য মূর্তি নির্মিত হইয়াছে।
বুদ্ধ-নির্বাণের পরে এক সময় আগুন লাগিয়া জেতবন-বিহার ভস্মীভূত হয়। নরপতিগণ ও তাঁহাদের প্রজাবৰ্গ চন্দন-মূর্তি ধ্বংস হইয়াছে মনে করিয়া অত্যন্ত বিমর্ষ হন; কিন্তু চারি-পাঁচ দিন পরে পূর্বপার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র বিহারের দ্বার উন্মুক্ত হইলে চন্দন-মূর্তি দৃষ্ট হইল। সকলে উৎফুল্ল হৃদয়ে একত্র হইয়া বিহার পুনর্নিমাণে ব্ৰতী হইল। দ্বিতল নির্মিত হইলে তাহারা প্ৰতিমূর্তিকে পূর্বস্থানে স্থাপন করিল।…
তন্দ্রামূঢ়ের ন্যায় চক্ষু পুস্তক হইতে তুলিয়া ভিক্ষু আমার পানে চাহিলেন, অস্পষ্ট স্খলিতস্বরে বলিলেন, কোথায় সে মূর্তি?
আমি বলিলাম, জানি না। চন্দন-মূর্তির উল্লেখ আর কোথাও দেখেছি বলে তো স্মরণ হয় না।
অতঃপর দীর্ঘকাল আবার দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। এই ক্ষুদ্র তথ্যটি ভিক্ষুর অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত নাড়া দিয়া আলোড়িত কইয়া তুলিয়াছে তাহা অনুমানে বুঝিতে পারিলাম। আমি বোধ হয় মনে মনে তাঁহার নিকট হইতে আনন্দের একটা প্ৰবল উচ্ছাস প্রত্যাশা করিয়াছিলাম; এইভাবে অভাবিতের সম্মুখীন হইয়া তিনি কি বলিবেন কি করিবেন তাহা প্রত্যক্ষ করিবার কৌতূহলও ছিল। কিন্তু তিনি কিছুঁই করিলেন না; প্রায় আধা ঘণ্টা নিশ্চলভাবে বসিয়া থাকিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চক্ষে সেই সুদানিদ্ৰোখিতের অভিভূত দৃষ্টি—কোনও দিকে দৃকপাত করিলেন না, নিশির ডাক শুনিয়া ঘুমন্ত মানুষ যেমন শয্যা ছাড়িয়া একান্ত অবশে চলিয়া যায়, তেমনি ভাবে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।
তারপর তিন মাস আর তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলাম না।
হঠাৎ পৌষের মাঝামাঝি একদিন তিনি মূর্তিমান ভূমিকম্পের মতো আসিয়া আমার স্থাবরতার পাকা ভিত এমনভাবে নাড়া দিয়া আলগা করিয়া দিলেন যে তাহা পূর্বত্নে অনুমান করাও কঠিন। অন্তত আমি যে কোনও দিন এমন একটা দুঃসাহসিক কার্যে ব্ৰতী হইয়া পড়িব তাহা সন্দেহ করিতেও আমার কুষ্ঠা বোধ হয়।
তিনি বলিলেন, সন্ধান পেয়েছি।
আমি সানন্দে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলাম, আসুন—বসুন।
তিনি বসিলেন না, উত্তেজিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, পেয়েছি বিভূতিবাবু, সে মূর্তি হারায়নি, এখনও আছে।
সে কি, কোথায় পেলেন?
পাইনি এখনও। প্রাচীন বৈশালীর ভগ্নাবশেষ যেখানে পড়ে আছে সেই বেসাড়ে গিয়েছিলুম। জেতবন-বিহারের কিছুঁই নেই, কেবল ইট আর পাথরের স্তুপ। তবু তারই ভেতর থেকে আমি সন্ধান পেয়েছি—সে মূর্তি আছে।
কি করে সন্ধান পেলেন?
এক শিলালিপি থেকে। একটা ভাঙা মন্দির থেকে একটা পাথর খসে পড়েছিল—তারই উল্টো পিঠে এই লিপি খোদাই করা ছিল। এক খণ্ড কাগজ আমাকে দিয়া উত্তেজনা-অবরুদ্ধ স্বরে বলিতে লাগিলেন, জেতবন-বিহার ধ্বংস হয়ে যাবার পর বোধ হয় তারই পাথর দিয়ে ঐ মন্দির তৈরি হয়েছিল; মন্দিরটাও পাঁচ-ছ-শ বছরের পুরনো, এখন তাতে কোনও বিগ্ৰহ নেই।–একটা বিরাট অশথ্ গাছ তাকে অজগরের মতো জড়িয়ে তার হাড়-পাঁজর গুড়ো করে দিচ্ছে-পাথরগুলো খসে খসে পড়ছে। তারই একটা পাথরে এই লিপি খোদাই করা ছিল।
কাগজখানা তাঁর হাত হইতে লইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম; অনুমান দশম কি একাদশ শতাব্দীর প্রাকৃত ভাষায় লিখিত লিপি, ভিক্ষু অবিকল নকল করিয়া আনিয়াছেন।
পাঠোদ্ধার করিতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। শিলালেখের অর্থ এইরূপ—
হায় তথাগত! সদ্ধর্মের আজ মহা দুর্দিন উপস্থিত হইয়াছে। যে জেতবন-বিহারে তুমি পঞ্চবিংশ বর্ষ যাপন করিয়াছ তাহার আজ কি শোচনীয় দুৰ্দশা! গৃহিগণ আর তোমার শ্রমণদিগকে ভিক্ষা দান করে না; রাজগণ বিহারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। পৃথিবীর প্রান্ত হইতে শিক্ষার্থিগণ আর বিনয়-ধর্ম-সূত্ত অধ্যয়নের জন্য বিহারে আগমন করে না। তথ্যগতের ধর্মের গৌরব-মহিমা অস্তমিত হইয়াছে।
তদুপরি সম্প্রতি দারুণ ভয় উপস্থিত হইয়াছে। কিছুকাল যাবৎ চারিদিক হইতে জনশ্রুতি আসিতেছে, তুরুস্ক নামক এক অতি বর্বর জাতি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করিয়াছে। ইহারা বিধর্মী ও অতিশয় নিষ্ঠুর; ভিক্ষু-শ্রমণ দেখিলেই নৃশংসভাবে হত্যা করিতেছে এবং বিহার-সঙঘাদি লুণ্ঠন করিতেছে।
এই সকল জনরব শুনিয়া ও তুরুস্কগণ কর্তৃক আক্রান্ত কয়েক জন মুমূর্ষ পলাতক শ্রমণকে দেখিয়া জেতবন-বিহারের মহাথের বুদ্ধরক্ষিত মহাশয় অতিশয় বিচলিত হইয়াছেন। তুরুস্কগণ এই দিকেই আসিতেছে, অবশ্যই বিহার আক্রমণ করিবে। বিহারের অধিবাসিগণ অহিংসধর্মী, অস্ত্ৰচালনায় অপারগ। বিহারে বহু অমূল্য রত্নাদি সঞ্চিত আছে; সবাপেক্ষা অমূল্য রত্ন আছে, গোশীর্ষ চন্দনকাষ্ঠে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি—যাহা ভগবান তথ্যগতের জীবিতকালে প্রসেনজিৎ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তুরুস্কের আক্রমণ হইতে এ সকল কে রক্ষা করিবে?
মহাথের বুদ্ধরক্ষিত তিন দিবস অহোরাত্ৰ চিন্তা করিয়া উপায় স্থির করিয়াছেন। আগামী অমাবস্যর মধ্যযামে দশ জন শ্রমণ বিহারস্থ মণিরত্ন ও অমূলা গ্ৰন্থ সকল সহ ভগবানের চন্দন-মূর্তি লইয়া প্ৰস্থান করিবে। বিহার হইতে বিংশ যোজন উত্তর হিমালয়ের সানু-নিষ্ঠ্যুত উপলা নদীর প্রস্রবণ মুখে এক দৈত্য-নির্মিত পাষাণ-স্তম্ভ আছে; এই গগনালেহী স্তম্ভের শীর্ষদেশে এক গোপন ভাণ্ডার আছে। কথিত আছে যে, অসুর-দেশীয় দৈত্যগণ দেবপ্রিয় ধমাশোকের কালে হিমালয়ের স্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশে ইহা নির্মাণ করিয়াছিল। শ্রমণগণ চন্দন-মূর্তি ও অন্যান্য মহার্ঘ বস্তু এই গুপ্ত স্থানে লইয়া গিয়া রক্ষা করিবে! পরে তুরুস্কের উৎপাত দূর হইলে তাহারা আবার উহা ফিরাইয়া আনিবে।
যদি তুরুস্কের আক্রমণে বিহার ধ্বংস হয়, বিহারবাসী সকলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, এই আশঙ্কায় মহাথের মহাশয়ের আজ্ঞাক্ৰমে পরবর্তীদিগের অবগতির জন্য অদ্য কৃষ্ণা-ত্রয়োদশীর দিবসে এই লিপি উৎকীর্ণ হইল। ভগবান বুদ্ধের ইচ্ছা পূর্ণ হউক।
এইখানে লিপি শেষ হইয়াছে। লিপি পড়িতে পড়িতে আমার মনটাও অতীতের আবর্তে গিয়া পড়িয়াছিল; আট শত বৎসর পূর্বে জেতবন-বিহারের নিরীহ ভিক্ষুদের বিপদ-ছায়াচ্ছন্ন ত্ৰস্ত চঞ্চলতা যেন অস্পষ্টভাবে চোখের সম্মুখে দেখিতে পাইতেছিলাম; বিচক্ষণ প্রবীণ মহাস্থবির বুদ্ধরক্ষিতের গভীর বিষণ্ণ মুখচ্ছবিও চোখের উপর ভাসিয়া উঠিতেছিল। ভারতের ভাগ্যবিপর্যয়ের একটা ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ যেন ঐ লিপির সাহায্যে আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য চলচ্ছায়ার মতো প্ৰত্যক্ষ করিয়া লইলাম। দেশব্যাপী সন্ত্রাস! শান্তিপ্রিয় নিবীর্য জাতির উপর সহসা দুরন্ত দুর্মদ বিদেশীর অভিযান! তুরুস্ক! তুরুস্ক! ঐ তুরুস্ক আসিতেছে! ভীত কণ্ঠের সহস্ৰ সমবেত আর্তনাদ আমার কৰ্ণে বাজিতে লাগিল।
তারপর চমক ভাঙিয়া গেল। দেখিলাম ভিক্ষু অভিরামের চোখে ক্ষুধিত উল্লাস। গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম, মহাস্থবির বুদ্ধরক্ষিতের উদ্দেশা সিদ্ধ হয়েছে—কিন্তু কত বিলম্বে!
তিনি প্ৰদীপ্তশ্বরে বলিয়া উঠিলেন, হোক বিলম্ব। তবু এখনও সময় অতীত হয়নি। আমি যাব বিভূতিবাবু। সেই অসুর-নির্মিত পাষাণ-স্তম্ভ খুঁজে বার করব। কিছু সন্ধানও পেয়েছি।–উপলা নদীর বর্তমান নাম জানতে পেরেছি।–বিভূতিবাবু, দেড় হাজার বছর আগে চৈনিক পরিব্রাজক কোরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে গোবি মরুভূমি পার হয়ে দুস্তর হিমালয় লঙ্ঘন করে পদব্ৰজে ভারতভূমিতে আসতেন। কি জন্যে? কেবল বুদ্ধ তথ্যাগতের জন্মভূমি দেখবার জন্যে। আর, আমাদের বিশ যোজনের মধ্যে ভগবান বুদ্ধের স্বরূপ-মূর্তি রয়েছে, জানতে পেরেও আমরা তা খুঁজে বার করতে পারব না?
আমি বলিলাম, নিশ্চয় পারবেন।
ভিক্ষু তাঁহার বিদ্যুদ্ধহ্নিপূর্ণ চক্ষু আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া এক প্রচণ্ড প্রশ্ন করিয়া বসিলেন, বিভূতিবাবু, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?
ক্ষণকালের জন্য হতবাক হইয়া গেলাম। আমি যাইব! কাজকর্ম ফেলিয়া পাহাড়ে-জঙ্গলে এই মায়ামৃগের অন্বেষণে আমি কোথায় যাইব।
ভিক্ষু স্পন্দিতস্বরে বলিলেন, আট-শ বছরের মধ্যে সে দিব্যমূর্তি কেউ দেখেনি। ভগবান শাক্যসিংহ আট শতাব্দী ধরে সেই স্তম্ভশীর্ষে আমাদেরই প্ৰতীক্ষা করেছেন—আপনি যাবেন না?
ভিক্ষুর কথার মধ্যে কি ছিল জানি না, কিন্তু মজ্জাগত বহির্বিমুখতা ও বাঙালী-সুলভ ঘরের টান যেন সঙ্গীতযন্ত্রের উচ্চ সপ্তকের তারের মতো সুরের অসহ্য স্পন্দনে ছিঁড়িয়া গেল। আমি উঠিয়া ভিক্ষুকের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, আমি যাব।