বর্ষা শেষ হইয়াছে
বর্ষা শেষ হইয়াছে।
মাঝে মাঝে বাতাসে হঠাৎ যে শীতের আমেজ পাওয়া যায় এখনো তা ভিজা ভিজা মনে হয়, কান্নার শেষে তোয়ালে দিয়া মুছিয়া নেওয়ার পর মালতীর গায়ের শীতল স্পর্শের মতো। কালী মার কাছে চলিয়া গিয়াছিল, কয়েকদিনের জন্য আবার আসিয়াছে। মনোরমার তাড়া নাই, বিফল হওয়ার ভয়ও যেন নাই। কালীর দেহে যৌবনের বিকাশে যেমন এতটুকু ব্যস্ততা দেখা যায় না অথচ বিকাশ তার অনিবার্য গতিতে ঘটিতেই থাকে, মনোরমার অভিযানও তেমনি ধীর স্থির মন্থর গতিতে গড়িয়া ওঠে। খেলার ছলে হৃদূস্পন্দন পরীক্ষা করার বিরুদ্ধে কালীর প্রতিবাদ যেমন রাজকুমারের অজ্ঞাতসারেই তিলে তিলে হুকুম হইয়া মাথা তুলিতে আরম্ভ করে, তাকে ঘিরিয়া মনোরমার জাল বোনাও তেমনি হইয়া থাকে তার অদৃশ্য।
কালীকে মনোরমা কখনো বেশি সাজায় না, তার ঘরোয়া সাধারণ সাজেই বৈচিত্র্য সৃষ্টির চেষ্টা করে। কালীর একরাশি কালো চুল আছে, কোনোদিন মনোরমা লম্বা বিনুনি ঝুলাইয়া দেয়, কোনোদিন রচনা করে ফুলানো কঁপানো খোপা। সকালে ঘরের কাজ করার সময় কালীর গায়ে সাদাসিধে ভাবে জড়ানো থাকে নিমন্ত্রণে যাওয়ার জমকালো দামি শাড়ি, বিকালে সযত্ন প্রসাধনের পর তাকে পরিতে হয় সাধারণ মিলের কাপড়।
সকালে কালী কাতর হইয়া বলে, ভালো কাপড়খানা নষ্ট হয়ে যাবে যে দিদি?
মনোরমা বলে, হোক। আঁচলটা জড়া দিকি কোমরে, ঘর দোর ঝাঁট দে রাজুর। খাটের তলায় ঝটাস ভালো করে।
বিকালে আরো বেশি কাতর হইয়া কালী বলে, এটা নয় দিদি, পায়ে পড়ি তোমার, ওটা পরি এখন, আবার খুলে রাখব একটু পরে?
মনোরমা বলে, না, অত ফ্যাশন করে কাজ নেই তোমার। গরিবের মেয়ে গরিবের মতো থাক।
কাছে টানিয়া আদর করিয়া বলে, বোকা মেয়ে, ভেঁড়া কাপড়ে তোকে যে বেশি সুন্দর দেখায় রে!
রাজকুমারের কাছে সে আফসোস করে, বড় চপল মেয়েটা রাজু, বড় চঞ্চল।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলে, তাও বলি, মেয়ে যেন মানুষের মন কাড়তে জন্মেছে। কি দিয়ে এমন মায়া জাগায় ছুঁড়ি ভগবান জানেন। ডাইনী এসে জন্মায় নি তো মানুষের পেটে? কদিনের জন্যে তো এসেছে, সেখানে পাড়াসুদ্ধ সবাই অস্থির, রোজ সবাই জিজ্ঞেস করে, কালী কবে ফিরবে গগা কালীর মা? যদুবাবু মস্ত বড়লোক ওখানকার, বংশ একটু নিচু, তার গিন্নি মাসিকে এখন থেকে সাধাসাধি করছে, ছেলে বিলেত থেকে ফিরলে কালীকে আমায় দিও কালীর মা।
তবে তো কালীর বিয়ের জন্য কোনো ভাবনাই নেই।
কে ভাবে ওর বিয়ের জন্য?
মনোরমার কাছে এসব শোনে আর কালীকে রাজকুমার একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে। তার মনে হয়, কেবল কথাবার্তা চালচলন শিক্ষা-দীক্ষার দিক হইতে নয়, কালীর গড়নটি পর্যন্ত যেন ঘরোয়া ছাঁচের, বহুকাল আগে মিসেস বের্নসের আঁকা গত শতাব্দীর বাঙালি নারীর ছবির আদর্শে কালীর দেহ গড়িয়া উঠিতেছে।
এরকম মনে হয় কেন? সাজপোশাকের এমন কোন নূতনত্ব তো কালীর নাই যে জন্য এরকম একটা ধারণা জন্মিতে পারে। সাধারণ বাঙালি সংসারের আর দশটি মেয়ের মতোই তার সাধারণ বেশভূষা। অন্য কোনো মেয়েকে দেখিয়া তো আজ পর্যন্ত তার মনে হয় নাই, দেয়াল আর ঘোমটার আড়ালে শুধু একজনের দৃষ্টিকে বিহ্বল করার জন্য তার রূপযৌবন, দেহটি শুধু তার সেবা আর গৃহকর্মের উপযোগী:
রিণি, সরসী আর মালতীর সঙ্গে, আত্মীয় এবং বন্ধু পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে, কালীকে মিলাইয়া দেখিয়া রাজকুমার রহস্যভেদের চেষ্টা করে। ট্রামে বাসে ঘোমটা-টানা ঘোমটা-খোলা বৌ আর স্কুল-কলেজের মেয়ে উঠিলে তাদের সঙ্গেও মনে মনে কালীকে মিলাইয়া দেখিতে তার ইচ্ছা হয়।
নিজের এক অলস কল্পনার ভিত্তি খুঁজিয়া বাহির করিতে গিয়া এমন এক বিস্ময়কর সত্য প্রথম আবিষ্কারের অস্পষ্টতায় আবৃত হইয়া তার মনে উঁকি দিতে থাকে যে রাজকুমার অভিভূত হইয়া পড়ে। ব্যাপারটা আরো ভালো করিয়া বুঝিবার জন্য তার উৎসাহ বাড়িয়া যায়। তার এই খাপছাড়া গবেষণার যে একটি অতি বিপজ্জনক দিক আছে এটা তার খেয়ালও থাকে না।
যে রাজকুমারের এতকাল দেখা পাওয়াই কঠিন ছিল হঠাৎ তার ঘন ঘন আবির্ভাব ঘটিতে থাকায় এবং তার শান্ত নির্বিকার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও অনুসন্ধিৎসু হইয়া উঠায় আত্মীয় জন বন্ধুবান্ধবের বাড়ির মেয়েদের চমক লাগিয়া যায়। রাজকুমারের ব্যগ্ৰ উৎসুক চাহনি সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হইতেছে দেখিয়া কেউ দারুণ অস্বস্তি বোধ করে, কেউ মনে রাখিয়া যায়, কেউ অনুভব করে রোমাঞ্চ। প্রত্যেকে তারা বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবিতে থাকে, এতকাল পরে আমার মধ্যে হঠাৎ কি দেখল যে এমন করে তাকিয়ে থাকে? কেউ তার সামনে আসাই বন্ধ করিয়া দেয়, কেউ কথা ও ব্যবহারে কঠিনতা আনিয়া দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করে, কেউ আরো কাছে সরিয়া আসিতে চায়।
রিণি, সরসী আর মালতী রাজকুমারের এই অদ্ভুত আচরণ তিন ভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে তিনজনেই, অস্বস্তিও বোধ করিয়াছে প্রায় একই রকম, কিন্তু ব্যাপার বুঝিবার চেষ্টায় তাদের মনে এমন ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার উদয় হইয়াছে যে জানিতে পারিলে মানুষের মন সম্বন্ধেও একটা নূতন জ্ঞান খুব সহজেই রাজকুমারের জন্মিয়া যাইত।
রিণি ভাবে : এতদিনে কি বুঝিতে পারা গেল সেদিন গান প্র্যাকটিস করার সময় সে অমন আগ্রহের সঙ্গে মুখ বাড়াইয়া দিলে রাজকুমার তাকে কেন অপমান করিয়াছিল? রাজকুমারের মন কবিত্বময়, বাস্তব জগতের অনেক উঁচুতে নিজের মানস-কল্পনার জগতে সে বাস করে; বড় ভাবপ্রবণ প্রকৃতি রাজকুমারের। তার মনের ঐশ্বর্য রাজকুমারকে মুগ্ধ করিয়াছে, তার সি কথা গান ভাবালোকের অপার্থিব আনন্দ দিয়াছে রাজকুমারকে, তার সান্নিধ্য অনুভব করিয়াই রাজকুমারের মন এমনভাবে অভিভূত হইয়া গিয়াছে যে একটি চুম্বনের প্রয়োজনও সে বোধ করে নাই। সেদিন রাজকুমার তাই চমকাইয়া গিয়াছিল, কি করিবে ভাবিয়া পায় নাই। গান শুনিতে শুনিতে যে মানুষটা স্বপ্ন দেখিতেছিল হঠাৎ সচেতন হওয়ার পর তার খাপছাড়া ব্যবহারে অপমান বোধ করিয়া সেদিন তার রাগ করা উচিত হয় নাই। হয়তো সেদিন রাজকুমারের প্রথম খেয়াল হইয়াছিল, সে শুধু মন আর হাসি গান কথা নয়, একটা শরীরও তার আছে। হঠাৎ যে রাজকুমার এমন অসভ্যের মতো খুঁটিয়া খুঁটিয়া তার সর্বাঙ্গে চোখ বুলাইতে আরম্ভ করিয়াছে, এটা হয়তো তার এই নূতন চেতনার প্রতিক্রিয়া। তার অপূর্ব রূপ প্রথম দেখিতে আরম্ভ করিয়া রাজকুমারের চোখে ধাঁধা লাগিয়া গিয়াছে।
সরসী ভাবে : এতদিন তার শরীরটাই ছিল রাজকুমারের কাছে বড়। তার দিকে তাকাইলে মানুষ সহজে চোখ ফিরাইতে পারে না, তার এই দেহের বিস্ময়কর রূপ মানুষের মধ্যে দুরন্ত কামনা জাগাইয়া দেয়। এতকাল রাজকুমার তার শরীরটা দেখিয়াই মুগ্ধ হইয়াছে, তাই লজ্জা সঙ্কোচে তার দিকে ভালো করিয়া তাকাইতে পারে নাই। তারপর রাজকুমার বুঝি তার অন্তরের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। পুরুষের মন-ভুলানো মেয়েলি হাবভাবের সস্তা অভিনয় সে যে কখনো করে না, লজ্জাবতী লতা সাজিয়া থাকে না, নাকী সুরে কথা বলে না, ভাবপ্রবণতা পছন্দ করে না, বাজে খেয়ালে হালকা খেলায় সময় নষ্ট করে না, এসব বোধহয় রাজকুমারের খেয়াল হইয়াছে। খুব সম্ভব সেদিনের সভায় রাজকুমার তার প্রকৃত পরিচয় পাইয়াছিল। তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে তার ভিতরের গভীরতার জন্য রাজকুমার তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে। ভালবাসে বলিয়া এখন আর রাজকুমার তার দিকে চাহিতে সঙ্কোচ বোধ করে না, মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া যায়।
মালতী ভাবে : ডি ছি, রাজকুমার কেমন মানুষ? সে তো স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। রাজকুমারের এমন পরিচয়ও তাকে পাইতে হইবে। সে ভালবাসে জানা গিয়াছে কিনা তাই রাজকুমার এখন তাকে যাচাই করিতেছে। তাকে নয়, তার দেহকে। কোথায় তার কোন খুঁত আছে। রূপের, খুঁজিয়া খুঁজিয়া তাই এখন বাহির করিতেছে রাজকুমার। ভালবাসার দৃষ্টিতে যদি এমন মনোযোগের সঙ্গে রাজকুমার তাকে দেখিত! কিন্তু চোখে তার ভালবাসা নাই। মনে মনে কি যেন সে হিসাব করিতেছে আর যাচাই করার দৃষ্টিতে তার সর্বাঙ্গে চোখ বুলাইতেছে!
কালীও অনেক কথা ভাবে। কিছু সে বুঝিতে পারে না, তার ভয় হয়, লজ্জায় সে আড়ষ্ট হইয়া যায়। আপনা হইতে কখনো যে ডাকিত না, হঠাৎ একবার সে কেন অকারণে কাছে ডাকে? সামনে দাড় করাইয়া কেন বলে, এদিক মুখ কর, ওদিকে মুখ কর, পিছন ফিরে দাঁড়াও?
মনোরমাও রাজকুমারের ভাবান্তরে আশ্চর্য হইয়া গিয়াছে। এমন বোকা সে নয় যে মনে করিবে কালীকে হঠাৎ বেশি পছন্দ হইয়া যাওয়ায় সর্বদা তাকে ডাকিয়া রাজকুমার তার সঙ্গে ভাব করিতে চায়। পছন্দ হইয়া থাকিলে আর ভাব করার ইচ্ছা জাগিয়া থাকিলে এভাবে যখন তখন বিনা কারণে ডাকার বদলে সে বরং বিশেষ দরকার হইলেও কালীকে ডাকিত না। রাজকুমারকে অন্য সকলে যতটা চেনে মনোরমা তার চেয়ে অনেক বেশিই চিনিয়াছে। গিরীন্দ্রনন্দিনীর সঙ্গে যেমন ব্যবহারই রাজকুমার করিয়া থাক, যদি ধরিয়াও নেওয়া যায় যে হঠাৎ কেঁকের মাথায় সে অন্যায় ব্যবহারই করিয়াছিল, গিরির টানেই সে যে সেদিন তাদের বাড়ি গিয়াছিল, মনোরমা তা বিশ্বাস করে না। গিরির জন্য যাইতে ইচ্ছা হইলে সে কখনো সে বাড়ির চৌকাঠ মাড়াইত না।
মনোরমা ভাবিয়া কূলকিনারা পাইতেছিল না, রাজকুমার তার সমস্ত ভাবনা ছিটাইয়া দিল। সকালবেলা রাজকুমার তাকে বলিল, কালীকে রিণিদের বাড়ি একটু নিয়ে যাচ্ছি দিদি।
ওমা, কেন?
শুধু ঘরে বসে থাকবে? দু-চারজনের সঙ্গে একটু ভাবসাব করে আসুক?
মনোরমার মুখ হাসিতে ভরিয়া গেল।
বেশ তো নিয়ে যাও, আমায় আবার জিজ্ঞেস করা কেন?
কালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৈশিষ্ট্য মনের মধ্যে বহিয়া নিয়া গিয়া রিণি, সরসী, মালতী আর অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে রাজকুমারের বড় অসুবিধা হইতেছিল। ওরকম আন্দাজী গবেষণায় এত বড় একটা তথ্য কি যাচাই করা চলে? পাশাপাশি দাঁড় করাইয়া কালীর সঙ্গে অন্য মেয়ের দেহের গড়নের তুলনা না করিলে অনুমানকে প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা উচিত হইবে না।
কালীকে সঙ্গে করিয়া সে দুবেলা বাহির হয়, এক এক জনের বাড়ি গিয়া কালীর সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেয়। সকলে তারা ভাবে এ আবার কি খেয়াল রাজকুমারের? মনোরমা খুব খুশি হয়। এতদিন তার শুধু আশা ছিল, এবার তার ভরসা জাগে যে আশা হয়তো তার মিটিবে।
ধীরে ধীরে রাজকুমারের কাছে তার অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট অনুমান স্পষ্ট প্রমাণিত সত্য হইয়া উঠিতে থাকে। দ্বিধা সন্দেহ মিলাইয়া যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হইতেছিল, মাথাটা বুঝি তার খারাপ হইয়া গিয়াছে, পাগলের মতো সে অনুসরণ করিতেছে নিজের বিকৃত চিন্তার। এই আত্মগ্লানির বদলে এখন সে অনুভব করিতে থাকে আবিষ্কারের গর্ব।
কালীকে দেখিয়া তার মনে হইয়াছিল, তার দেহের গড়ন ঘরোয়া, অন্তঃপুরের একটি বিশেষ আবেষ্টনীতে একটি বিশেষ জীবনের সে উপযোগী! এখন সে জানিতে পারিয়াছে কেবল কালী একা নয়, সকলের দেহের গড়নেই এই সঙ্কেত আছে, দেহ দেখিয়া বুঝিতে পারা যায় সমাজের নানা স্তরে জীবনের বহু বিচিত্র পরিবেশের কোনটিতে সে খাপ খাইবে।
শুধু মন নয়, দেহের গঠন দেখিয়াও বিচার করিতে হয় কোন জীবন কার পক্ষে স্বাভাবিক, কোন জীবনে কার বিকাশ বাধা পাইবে না।
দেহ? এতকাল রিণি, সরসী আর মালতীর মনের সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল, আজ তাদের দেহ কি বিস্ময়কর সংবাদই তাকে জানাইয়াছে! শুধু মনের হিসাব ধরিয়া সংসারে নিজেদের স্থান বাছিয়া নিতে গেলে জীবন ওদের ব্যর্থ হইয়া যাইবে। অসংখ্য নারী ও পুরুষের যেমন গিয়াছে।
একদিন সরসীকে রাজকুমার বলিল, রিণি আর মালতীকে নেমন্তন্ন কর না?
কেন?
এমনি, তোমাদের একটা গ্রুপ ফটো নেব।
কবে?
কাল সকালে।
হঠাৎ আমাদের ফটো নেবার শখ হল কেন?
শখের কি কেন থাকে সরসী?
এসব শখের থাকে। আচ্ছা বলব। কিন্তু সকালে কেন, বিকেলে বললে হবে না?
তাই বোললা। তিনটে-চারটের মধ্যে যেন আসে।
রাজকুমার একটু ভাবিল, খানিক ইতস্তত করিয়া বলিল, আচ্ছা, জ্যোৎস্না, মমতা ওদের বললে হয় না? আর তোমার সেই রুক্মিণীকে?
ওদেরও ফটো নেবে নাকি?
দোষ কি?
সরসী হাসিল, না দোষ কিছু নেই। হঠাৎ এতগুলি মেয়েকে একত্র করে ফটো নিতে চাইলে একটু খাপছাড়া মনে হবে, আর কিছু নয়। সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু জ্যোৎস্না, মমতা আর রুক্মিণীকে নয় চিনলাম, ওদের কারা?
লিস্ট করে দিচ্ছি।
লিস্ট? প্রকাণ্ড গ্রুপ হবে বল? এত সব অদ্ভুত শখ চাপে কেন তোমার? দুদিন যদি কিছু তুমি না কর, তিন দিনের দিন একটা কিছু করে অবাক করে দেবেই দেবে। এমনি চালচলন ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় বয়স বুঝি সত্তর পেরিয়েছে, হঠাৎ যে তোমার কি হয় বুঝি না।
রাজকুমার সতেরটি মেয়ের নাম লিখিয়া লিস্ট করিয়া দিলে সরসী ভুরু কুঁচকাইয়া বলিল, এতগুলি মেয়েকে বলতে হবে? কি ধরনের গ্রুপ হবে এটা? বান্ধবী গ্রুপ, না শুধু চেনা মেয়ের গ্রুপ কুমারী গ্রুপ বলা চলবে না, তিন জনের বিয়ে হয়েছে।
কি যেন বুঝিবার চেষ্টা করিতে করিতে চিন্তিতভাবে সরসী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, রাজকুমারের চোখে মানে আবিষ্কার করিতে চায়।
ফটোর কথা মিছে। কি যেন মতলব আছে তোমার। আমায় বল রাজু।
ওদের সকলকে একত্র করে দেখতে চাই।
কেন?
একটা ব্যাপার বুঝতে চাই। তুমি বুঝবে না, সরসী।
বুঝব না? তোমায় আমি সকলের চেয়ে ভালো বুঝি, তা জান?
রাজকুমার একটু হাসিল। হাসিটা সরসীর পছন্দ হইতেছে না টের পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে আবার গম্ভীর হইয়া গেল।
জানতাম না, কিন্তু মেনে নিচ্ছি। তবে এটা ঠিক আমার বোঝার কথা নয়। এ অন্য ব্যাপার। রাজেনবাবুকে ভালো বুঝলেও তার নতুন মেটিরিয়াল স্পিরিচুয়ালিজমের থিয়োরি কি বুঝতে পারবে ভরসা কর?
থিয়োরি না বুঝতে পারি থিয়েরিটা কোন বিষয়ে সেটুকু বুঝতে পারব বৈকি।
তবে শোন। মেয়েদের দেহের গড়নের সঙ্গে মনের গড়নের সম্পর্কটা বুঝবার চেষ্টা করছি।
ও, তাই বল!
অন্ধকারে হোঁচট খাইতে খাইতে সরসী যেন হঠাৎ আলো দেখিতে পাইয়াছে। চোখে তার উত্তেজনা দেখা দেয়, মুখ উজ্জ্বল হইয়া ওঠে।
রাজকুমার বলিতে থাকে, আমার মতে দেহের গড়নের সঙ্গে মেয়েদের মনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে সরসী। সুস্থ স্বাভাবিক দেহের কথাই বলছি। যে আবেষ্টনীতেই একটি মেয়ে বড় হোক, তার দেহের গড়নের জন্য মনের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকবেই। তোমার মানসিক ধর্মের কয়েকটা বিশেষ রূপ আছে, তুমি যদি জন্মের পরদিন থেকে অন্য একটি পরিবারে মানুষ হতে তবু এই বৈশিষ্ট্য বজায় থাকত। যেমন ধর, তোমার সাহস। তোমার দেহের গড়ন না বদলিয়ে কোনো প্রভাব তোমার সাহস নষ্ট করতে পারত না। প্রকাশটা হয়তো অন্য রকমের হত। অন্য বাড়িতে অন্য অবস্থায় মানুষ হলে তুমি হয়তো পথকে ভয় করতে, পুরুষকে ভয় করতে, বেলগাছকে ভয় করতে, মার খেয়ে কাঁদতে ভয় করতে, তবু কতগুলি দিকে সাহস তোমার থাকতই। অসুখ বিসুখ বিপদ আপদে বাড়ির মধ্যে হয়তো একা তোমার মাথা ঠিক থাকত, হাতে শুধু শাখা পরে তুমিই হয়তো।
হাসিমুখে বড়বাবুর দশ হাজার টাকার গয়না পরা বৌয়ের সঙ্গে গল্প করতে, তুমিই হয়তো–
বুঝেছি, বুঝেছি। আর শুনতে চাই না রাজু, থাম। তুমি সত্যি বাঁচালে আমায়। তোমার থিয়োরি না পাগলামি সে তুমিই জান, কদিন থেকে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায় নি এটুকু যে বুঝতে পারছি তাই আমার ঢের! এইজন্য তুমি অমন করে তাকাচ্ছিলে আমাদের দিকে, ট্রামে বাসে আদ্দির পাঞ্জাবি-পরা ঘোড়াগুলোও যেমনভাবে তাকাতে পারে না? কি আশ্চর্য মানুষ তুমি রাজু!
রাজকুমারকে সরসী চা করিয়া দিল, তিনরকম খাবার দিল। কথা বলিতে লাগিল অনর্গল। তার হাসি কথা চলাফেরা সব যেন হঠাৎ হালকা হইয়া গিয়াছে। কথা বলিতে বলিতে সরসী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, তোমার ও থিয়োরি কি শুধু মেয়েদের সম্বন্ধে খাটে ছেলেদের বেলা খাটে
না? শুধু মেয়েদের নিয়ে পরীক্ষা করার তোমার অত আগ্রহ কেন শুনি।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়া রাজকুমার বলিল, ছেলেদের বেলাও খাটে। নিয়ম একই। তবে পুরুষের দেহের সঙ্গে মনের সম্পর্ক অতটা ঘনিষ্ঠ নয়। দেহের গড়ন অনুসারে মনের যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত সেটা একেবারে চাপা পড়ে যেতে পারে, থেকেও না থাকার শামিল হয়ে যায়। মেয়েদের ব্যাপার অন্যরকম।
তারা দেহসর্বস্ব বলে?
না, তাদের দেহ অন্যরকম বলে। দেহের অনুভূতি অন্যরকম বলে। দেহের উপযোগিতা অন্যরকম বলে। আরো অনেক কিছু আছে।
বিদায় দেওয়ার সময় সরসী বলিল, কাল তোমার লিস্টের সকলকে আসতে বলব, তুমি কিন্তু ওদের জানিও না শখটা তোমার। গ্রুপ ফটো তোলার শখ আমার, তোমায় দিয়ে আমি ফটো তোলাচ্ছি। বুঝতে পারছ?
পরদিন কালীকে সঙ্গে করিয়া রাজকুমার সরসীর বাড়ি গেল। তিনটি মেয়ে আসিতে পারে। নাই। তবু চোদ্দটি মেয়ে আসিয়াছে। কালী আর সরসীকে ধরিলে ষোল জন। এতগুলি মেয়েকে একসঙ্গে পরীক্ষা করার সুযোগ পাইয়াও রাজকুমার খুশি হইতে পারিল না। এতগুলি দেহ আর মনের বৈশিষ্ট্য মিলাইয়া দেখা রাজকুমারের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। শুধু কথা বলিয়াই সময় কাটিয়া গেল।
Kub valo laglo